দ্য স্পিগ্যালকে গুন্টার গ্রাস ভাষা ক্রমাগত নবায়ন হবে

অনুবাদ : আতাউর রহমান রাইহান

১৯২৭ সালে পোল্যান্ডের গ্যাডন্সক শহরে জন্ম নেওয়া গুন্টার গ্রাস সেনাবাহিনীর চাকরি ও যুদ্ধবন্দি থাকার পর খামার এবং খনি-শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। গ্যাডন্সক তখন ডানজিগ নামে পরিচিত ছিল।

লেখাপড়া করেন জার্মানির ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি চারুশিল্পী হিসেবেও পরিচিত। নিজের বইয়ের সব কাভার করেছেন নিজ হাতেই।

১৯৫৯ সালে তিনি লেখেন দ্য টিন ড্রাম উপন্যাস, যেটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা এনে দেয়। এরপর তিনি ক্যাট অ্যান্ড মাউস (১৯৬১) ও দ্য ডগ ইয়ার্স (১৯৬৫) নামে দুটি উপন্যাস লেখেন। এ-বইদুটি তাঁর ডানজিগ ট্রিলজির অংশ।

১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে তাঁর আত্মজীবনী পিলিং দ্য ওনিয়ন প্রকাশ পায়। এ-বইটিতে প্রথম প্রকাশ করেন যে, তিনি হিটলারের সশস্ত্র গ্রুপ ওয়াফেন এসএসের সদস্য ছিলেন, যেটা নিয়ে জার্মানজুড়ে ব্যাপক তোলপাড়ও হয়েছিল।

তাঁর বই গ্রিমস ওয়ার্ডসে জার্মান ভাষাতত্ত্ব ও রূপকথার গল্প সংগ্রাহক জ্যাকব ও উইলহেলম ভাইদের প্রতি ভালোবাসা  প্রকাশ পায়। নোবেল পাওয়ার পর জার্মান দৈনিক দ্য স্পিগ্যালে তাঁর এ-সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

 

স্পিগ্যাল : আপনার নতুন বই গ্রিমস ওয়ার্ডস, অ্যা ডিক্লারেশন অফ লাভ। জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী এবং উনিশ শতকের রূপকথার  গল্প-সংগ্রাহক গ্রিমস ভাইদের প্রতি আপনার এই ভালোবাসা কীভাবে শুরু হয়েছে?

গুন্টার গ্রাস : উইলহেলম এবং জ্যাকব গ্রিমসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি গ্রিমসের রূপকথার গল্প শুনে শুনেই বেড়ে উঠেছি। ডানজিগে স্টেট থিয়েটারে খ্রিষ্টের আগমন উদযাপন মৌসুমে টম থামবের নাটকটি দেখেছিলাম। আমার মা সেখানে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আমার সৃষ্টিশীল কাজে গ্রিমস ভাইদের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

স্পিগ্যাল : সেটা কীভাবে?

গ্রাস : ‘টিন ড্রাম’ গল্পের অসকার মাটজিরাথের মধ্যেই টম থামব বেঁচে আছেন। আমার বেশকিছু পান্ডুলিপিতে জ্যাকব এবং উইলহেলম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘দ্য র‌্যাট’ গল্পে তারা একজন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, যারা এসিডবৃষ্টিতে বনের গাছকে মৃত্যু থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন।

স্পিগ্যাল : গ্রিমস ভাইদের মধ্যে আপনি কী ধরনের আবেদন খুঁজে পেয়েছেন?

গ্রাস : আপসহীন বৈশিষ্ট্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা আপসহীন ছিলেন। ১৮৩৭ সালে হ্যানওভার রাজ্যের সংবিধান বিলোপের বিরুদ্ধে তাঁরা গটিনজেনে প্রতিবাদ করেছেন। এভাবে তাঁরা রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন সবসময়।

গটিনজেন সেভেন নামে পরিচিত এই গ্রুপের অন্য বিদ্রোহী অধ্যাপকদের মতো তাঁরা নিজেদের চাকরি হারিয়েছেন এবং এমনসব কাজ করেছেন, যা আসলে অন্য যে-কারো পক্ষে অসম্ভব ছিল। উদ্ধৃতি এবং সাবধানবাণীর একটি জার্মান অভিধান তাঁরা লিখেছেন। জার্মান বর্ণমালার ষষ্ঠ অক্ষরটির উদ্ভাবকও তাঁরা।

স্পিগ্যাল : একশ কুড়ি বছরেরও বেশি সময় পরে।

গ্রাস : সেই দীর্ঘ সময়টা আমাকে খুব মুগ্ধ করে রেখেছিল।  গত পনেরো বছরে জার্মানির দুই অংশের গবেষকরাই এ-বিষয়টির ওপর কাজ করেছেন। ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝামাঝিতে তাঁরা পূর্ব বার্লিন ও গটিনজেনে নিজেদের দপ্তরে বসে একটি জার্মানভাষী অভিধানের জন্যে পাদটীকা সংগ্রহ করেছেন। গ্রিমস ওয়ার্ডসে আমি যা কিছু বলেছি তা জার্মান ইতিহাসের প্রতিফলন মাত্র।

স্পিগ্যাল : এদেশে আপনার ব্যক্তিগত ইতিহাসও আপনার বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

গ্রাস : পিলিং দ্য ওনিয়ন বইটিতে তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা এবং ডাই বক্সে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধনের কথা লিখেছি। তবে ডাই বক্সে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের দিকগুলোও এসেছে। গ্রিমস ভাইয়েরা এমন একটা সময় বেঁচে ছিলেন, যখন একটা বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে, যা আমার বইয়ে উল্লেখ করেছি।

স্পিগ্যাল : গ্রিমস ভাইদের আপনি শব্দ-গোয়েন্দা বলে অভিষিক্ত করেছেন। তাঁরা প্রতিটি বর্ণের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। আপনি অবশ্য লিখেছেন, একদিকে শব্দ অনুভূতি তৈরি করে, অন্যদিকে নির্বোধ তৈরিতেও তাঁরা কার্যকর ভূমিকা রাখেন। শব্দ যেমন আপনাকে মঙ্গলজনক কিছু দিতে পারে, তেমনি  বেদনাদায়কও হতে পারে। শব্দের এই বিচিত্র দিক কীভাবে আপনার জীবনে রূপ দিয়েছে?

গ্রাস : আমার কাছে মনে হয়েছে, শব্দ যেমন করুণায় ভরা, বিপরীতে তাতে লোভনীয় রমরমা আনন্দও থাকে, যা আসলে অনেক সময় একটা আগড়ম-বাগড়ম অবস্থাও তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাডলফ হিটলার যেমন বলেছেন, আপনি কি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চান? আবার কোনো একজন বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতা অবশ্যই হিন্দুকুশ পর্বতমালায় সুরক্ষিত আছে। এ-ধরনের বাক্য শক্তিশালী অর্থ বহন করে এবং এগুলো  সেই অর্থ প্রয়োগ করতেও পারে। কারণ তারা পর্যাপ্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। আমি বেদনাভরা শব্দ শুনেছি। আমার মতো নাগরিকের জন্য এটা সাধারণ কিছু নয়। কারণ তারা দেশের অন্যায্য ভাষাগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে এবং ভালো কিছু করার প্রতি মনোযোগ দেয়। সাধারণ প্রয়োগবিধির অংশ হয়ে মৃত যুক্তিকে থামিয়ে দিতে পারে এ-পরিভাষা।

স্পিগ্যাল : কোনো ইতিবাচক শব্দগুলো আপনি স্মরণ করে থাকেন?

গ্রাস : সত্যিই আমার শৈশবের সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েকটি শব্দ আছে, যা আমি বারবার স্মরণ করি। যেমন আডেবার বা সারস। এই শব্দটির কথা মনে পড়লে আমার স্মৃতির জগৎ নতুন করে জেগে ওঠে। আরেকটি শব্দ হলো লাবসাল বা সতেজ, যেটি আমি পুরোপুরি ভুলতে বসেছি। লাবসাল শব্দটি শুনতে খুবই আরামদায়ক। এ শব্দটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর নিরাপদে বাড়ি  ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়।

স্পিগ্যাল : এই আওয়াজ যেন নিরাপদে বাড়িতে থাকার অনুভূতির কথা মনে করিয়ে দেয়।

গ্রাস : এটা খুবই সত্যি কথা। আমি প্যারিসে বসে আমার উপন্যাস দ্য টিন ড্রাম লিখেছি। সেখানে আমি ডগ ইয়ার্স উপন্যাসের কাজও শুরু করি। কিন্তু চার বছর পর আমার খেয়াল হলো, আমি যেন অনুভব করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমার চারপাশেই বিদেশি ভাষা। পরে জার্মান ভাষায় কথা বলে এমন একটি স্থানে আমাকে ফিরে যেতে হয়েছে। নাৎসি আমলে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হতে হয়েছিল এমনসব লেখকের অনুভূতিও আমার মতো ছিল। অনেকেই এই কষ্ট সইতে পারেনি। যদিও তাঁদের দেশের মাটিতে নৃশংস একনায়কের শাসন চলছিল। তাঁরা ভাষার অভাব বোধ করেছেন। তাঁদের যেমনি নিজেদের বুঝতে হয়েছে, তেমনি অন্যদেরও।

স্পিগ্যাল : এই একই অভিজ্ঞতা, যদিও সেটা এতটা প্রবল নয়, নিজের দেশের ভেতর থেকেও যা অনুভব করা যেতে পারে। তরুণ সংস্কৃতিতে এটার একটা নিজস্ব ভাষাতাত্ত্বিক শৈলী আছে। আপনার নাতিরা যা কিছু বলছে, তা কি সবসময় আপনি বুঝতে পারেন?

গ্রাস : অবশ্যই, আমার জন্য এটা একটা বিস্ময়কর অর্জন। আমার নাতি-নাতনিদের সহায়তায় বর্তমান চলতি পরিভাষাগুলো আমি বুঝতে পারি। তাল মেলাতে পারি তাদের কথাবার্তার সঙ্গে। তবে নর্ক (knorke) বা স্ফীত – এরকম শব্দ এখন আর ব্যবহার করা হয় না।

স্পিগ্যাল : এই যে শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে, এজন্য কি আপনি অনুশোচনা করেন?

গ্রাস : সৌভাগ্যবশত, নর্কের মতো শব্দ সাহিত্যে খুবই মানায়। সাধারণত, আমি জ্যাকব গ্রিমসের সঙ্গে একমত। ভাষার সমৃদ্ধি এবং পরিবর্তনের স্বার্থে আমাদের উচিত এগুলো মেনে  নেওয়া। পুরনো শব্দ হারিয়ে যাবে, নতুন নতুন শব্দের উৎপত্তি ঘটবে, এভাবে ভাষা ক্রমাগত নবায়ন হবে। ফ্রান্সে ভাষার ওপর পুলিশি খবরদারি চালানো হয়েছিল, এতে সেখানে ভাষা অনেকটা আনুষ্ঠানিক ও অপরিবর্তনীয় হয়ে পড়েছে।

স্পিগ্যাল : গ্রিমস ওয়ার্ড বইটিতে আপনি লিখেছেন, তখন আপনার নাম পরিবর্তনে আপনার কোনো আপত্তি ছিল না।

গ্রাস : আমার নাম গ্রাস লেখার ক্ষেত্রে আমি স্বাধীন ছিলাম। আমার নাম এভাবে লিখতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি।

স্পিগ্যাল : আপনি সেই লেখকদের একজন, যাঁরা নিজের বই নিজেই সাজিয়েছেন। আপনার সব বইয়ের মলাট আপনি নিজেই করেছেন। নিজের বইয়ের মলাট নিজেরই করা কেন আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে?

গ্রাস : মলাট করা ছিল পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার আগে শেষ অাঁচড়, প্রথম বাক্যটি লেখার মতোই এটা গুরুত্বপূর্ণ।  লেখালেখির মতো বইয়ের মলাট তৈরিতেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

স্পিগ্যাল : বইয়ের একটি ভালো মলাটের বৈশিষ্ট্য কী?

গ্রাস : কোনো কিছুর প্রতীকের মতো মলাটেই বইয়ের বিষয়বস্ত্ত সহজ ও সংক্ষিপ্তাকারে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ডগ ইয়ার্স বইটির মলাটে কুকুরের একটি মাথা প্রয়োজন ছিল। আঙুলের ছায়ার মধ্য দিয়ে যেটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লোকাল অ্যানেসথেটিক বইটির জন্য আমি একটি বাতি ও আঙুল বেছে নিয়েছি। বইটির মলাটে বাতির ওপর একটি আঙুল রাখা হয়েছে। ব্রাদারস গ্রিমসের জন্য একটি জোড়া প্রতিকৃতি অাঁকতে গিয়ে কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। কারণ এটা কেবল বার্তার একটা অংশই বহন করছে।

স্পিগ্যাল : বইয়ের বিপণন বিকাশের কথা শুনে আপনি অবশ্যই হতাশায় ডুবে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিন বইয়ের বিক্রি দ্রুত বাড়ছে।

গ্রাস : আমি মনে করি না, এটাই কাগজের বইয়ের শেষ যুগ। এটা ভিন্নরকম মূল্যায়ন পাবে। বইয়ের গণউৎপাদন কমে যাবে। তবে আমাদের শিশুদের কাছে কাগজের বই-ই হস্তান্তর করতে হবে শেষ পর্যন্ত।

স্পিগ্যাল : মানুষ আইপ্যাডে গ্রিমস ওয়ার্ডস পড়ছে, এমনটা কখনো কি ভেবেছেন?

গ্রাস : খুব একটা না। কিন্তু আমি প্রকাশকদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি। সেটা হলো, আইন যতক্ষণ পর্যন্ত লেখককে কার্যকর হিসেবে সুরক্ষা দিচ্ছে, ততক্ষণ আমার বই কেউ সহজলভ্য করতে পারবে না। এক্ষেত্রে প্রত্যেক লেখককে আমি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।

স্পিগ্যাল : আপনি প্রতিবাদের কথা বলছেন?

গ্রাস : কম্পিউটারে বই পড়ার প্রবণতা আমি কমিয়ে আনতে চাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সবাই কম্পিউটারে বই পড়া বন্ধ করে দেবে। এরপরও পান্ডুলিপি লেখার সময়ে  বৈদ্যুতিন প্রক্রিয়ার অসুবিধার বিষয়গুলো খুবই পরিষ্কার হচ্ছে। বেশিরভাগ তরুণ লেখক তাঁদের পান্ডুলিপি সরাসরি কম্পিউটারে লেখেন। এরপর সেটির সম্পাদনা ও অন্যান্য কাজ করেন। আমার ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রাথমিক পর্যায় আছে। যেমন বইটি হাতে লিখে ওলিভেটি টাইপরাইটারে কম্পোজ করি। শেষ পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত সচিব বেশকিছু কপি কম্পিউটারে রাখে এবং প্রিন্ট দিয়ে বের করে আনে। এছাড়া অনেক হাতে লেখা সংশোধনও আমি সংযুক্ত করি। কম্পিউটারে সরাসরি লিখলে এই পর্যায়গুলো থাকছে না।

স্পিগ্যাল : ওলিভেটি টাইপরাইটার কি পুরনো ফ্যাশন বলে আপনার মনে হচ্ছে না?

গ্রাস : নাহ্। কম্পিউটারে কিছু একটা লিখলে সেটি একেবারে শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। যদিও কাজটি শেষ হতে অনেকগুলো পর্যায় বাকি থাকে। কম্পিউটারে লেখার  ভেতরে এক ধরনের মোহিনী অবস্থা তৈরি করে। আমি প্রথমে লিখি, এরপর হস্তলিখিত কপিটি অপরিচিত বলে মনে হয়। তখন এই লেখায় আমার অপছন্দনীয় বলে যা কিছু থাকে, তা বাদ দিয়ে দিয়ে সেখানে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি করি। এরপর সেই লেখা ওলিভেটি টাইপরাইটারে কম্পোজ করি। এই পুঙ্খানুপুঙ্খতার জন্য লেখাটাকে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে  যেতে হয়। লেখার খুঁটিনাটি ভুলগুলোও চোখে পড়ে। পরবর্তীকালে আমি সংশোধিত কপির সঙ্গে প্রথমে যা লিখেছিলাম তার সমন্বয় ঘটাই। এতে ভুলগুলো কমে যায় এবং লেখায় অযৌক্তিক কিছু থাকে না।

স্পিগ্যাল : এর পরও গত কয়েক দশকে আপনার ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে?

গ্রাস : প্রথমত, আমি সময়ের সব বিরতি ও দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে চাই। আমি যখন দ্য টিন ড্রাম, ক্যাট অ্যান্ড মাউস এবং ডগ ইয়ার্স লিখি, এটা এমন একটা সময় ছিল যখন নতুন কিছু করলে অনেক প্রবীণ লেখকও তা সমর্থন করতেন না।

স্পিগ্যাল : যুদ্ধ-পরবর্তী সাহিত্যিক, যাঁরা সাধারণ ও সুস্পষ্ট ভাষায় লিখতেন, তাঁদের প্রতিনিধিদের কথা বলছেন?

গ্রাস : হ্যাঁ, ওইসব লেখককে সবদিক দিয়ে সচেতন থাকতে হয়েছে। নাৎসি আমলে জার্মান ভাষা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু মার্টিন ওয়ালসার এবং হ্যানস এনজেনসবার্গারসহ আমরা তরুণ লেখকরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে চাইনি। এতে একটা ভাষা যা কিছু দিতে পারে, তার সবকিছু প্রদর্শনের ভেতর দিয়েই আমার ভাষা জন্ম নিয়েছে। এই বৃদ্ধ বয়সেও নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়া জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। এখনো সচেতনভাবে লিখছি।

স্পিগ্যাল : আপনি এখানে আসলে কী বলতে চাচ্ছেন?

গ্রাস : ব্যাপকহারে আমার জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, গ্রিমস ওয়ার্ডে যা আমি বর্ণনা করেছি। ১৯৬১ সালে প্রথমবারের মতো পশ্চিম বার্লিনের তখনকার মেয়র উইলি ব্রান্ডটের সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। বার্লিন দেয়ালের স্থাপনা দেখাও ছিল আমার একটি অভিজ্ঞতা। ১৯৮৯-৯০ সালে দুই জার্মান একীভূত হওয়ার আগে আমি অনেকবার পূর্ব জার্মানি সফর করেছি।

স্পিগ্যাল : সেখানে যেতে কোন জিনিসটা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?

গ্রাস : একটা একীভূত সাংস্কৃতিক জাতির ধারণায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সেই বিবেচনায় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির লেখকরা পূর্ব বার্লিনের একটি বাসায় মিলিত হয়েছিলাম। সেখানে আমাদের পান্ডুলিপি থেকে আমরা পড়ে শুনিয়েছি। আমার সন্দেহ ছিল, তথ্যদাতারা তৎকালীন জার্মানের গোপন পুলিশ বাহিনী স্টাসির পক্ষে কাজ করত। পরে আমি কী করব, তাও তাঁরা বুঝতে পেরেছে।

স্পিগ্যাল : দুই জার্মানির একীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে আপনি যুক্তি দিয়েছেন। আপনার এখনকার মতামত কী?

গ্রাস : আমি অতীতে যেটা মনে করতাম, এখনো সেই বিশ্বাসেই আছি। এত ত্বরিতগতিতে পূর্ব জার্মানিকে একীভূত করা উচিত হয়নি। এটা অদ্ভুত যে, আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা হারিয়েছে। তখন একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল, যেটা করা ঠিক হয়নি। দুই একনায়কের শাসনের পর গণতান্ত্রিক সচেতনতা তখন বেড়েছে। পূর্ব জার্মানির গণতন্ত্রপন্থীরা তখন উই আর দ্য পিপল বা আমরাই জনতা বলে স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে তার অনেক আগে পূর্ব জার্মানির শিল্পকারখানা শেষ হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব জার্মানির এক কোটি সত্তর লাখ লোক তখন একাকীই যুদ্ধের বোঝা বহন করে যাচ্ছিল।

স্পিগ্যাল : গ্রিমস ওয়ার্ডে আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শে সম্ভাব্য ভুলের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করেননি। সেটা কি এখনো ভুল নয়?

গ্রাস : দুই জার্মানির একীভূত হওয়ার পরে আমি ভীত ছিলাম  যে, বৃহৎ জার্মানির সব ক্ষমতা বার্লিনকেন্দ্রিক হবে। কিন্তু  সৌভাগ্যবশত, জার্মান ফেডারেল শাসন ব্যবস্থা সেই প্রবণতা পুষিয়ে নিতে পেরেছে। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।

স্পিগ্যাল : আপনি কি মনে করেন, আপনার জীবনে এ ছাড়া আর কোনো ভুল আপনি করেছেন?

গ্রাস : সবাই জানে কিশোর বয়সে আমি হিটলারের তারুণ্যভিত্তিক আন্দোলনের প্রতি প্রলুব্ধ হয়েছিলাম। আমার পিলিং দ্য ওনিয়ন বইটিতে এ-ব্যাপারে আমি পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেছি। এই ভুলের পর যে-কোনো মতাদর্শিক মনোভাব থেকে বাঁচতে আমি নির্দিষ্ট নিরাপত্তা পেয়েছি।

স্পিগ্যাল : গ্রিমস ওয়ার্ডসে আপনার নাৎসি বাহিনীর সশস্ত্র গ্রুপ ওয়াফেন-এসএসে যোগ দেওয়ার সময়ের কথা বর্ণনা করেছেন। নাৎসি বাহিনীতে আপনার শপথ নেওয়ার কথা পরিষ্কার বর্ণনা দিয়েছেন। তখন আপনার বয়স সতেরো ছিল। এটাও কি আপনার জীবনের ভুলের অংশ ছিল না?

গ্রাস : আমার দিক থেকে কোনো ভুল করিনি। আমাকে তখন নাৎসি বাহিনীর জন্য বাছাই করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো           হাজার হাজার লোককে তখন বাছাই করা হয়েছিল। আমি ওয়াফেন-এসএসে কোনো স্বেচ্ছাসেবী ছিলাম না। যুদ্ধের পর আমাকে অন্ধ আনুগত্য থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর  কোনোদিন এমন শপথ নেব না, তাও জানি।

স্পিগ্যাল : আপনার শেকড় জার্মান ইতিহাস থেকেই এসেছে। কিন্তু আপনি যে-কোনোভাবেই হোন না কেন, মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি করে আসছেন। নতুন করে জেগে ওঠা দেশপ্রেমের জোয়ার সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী? বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় যেমনটা আমরা দেখছি।

গ্রাস : আমি সবসময়ই মনে করি, ইচ্ছা করলেই এক ব্যক্তি পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী আলোচনা পরিত্যাগ করতে পারে না। যদি আমাদের জাতীয় পরিচয় সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি কার্যকরভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, তবে আমরা ইউরোপে  কেবল একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারব, যেটা জাতীয়তাবাদকে ছাড়িয়ে যাবে।

স্পিগ্যাল : আপনি মনে করেন, আপনার অনুসারী লেখকদের মধ্যে জোরালো রাজনৈতিক বক্তব্যের অভাব আছে?

গ্রাস : যদি তাঁরা এ-সম্পর্কিত ঐতিহ্য থেকে কোনো শিক্ষা নিতে না পারে, তবে সেটা খুবই অনুতাপের হবে। এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটা উচিত হবে না। পূর্ব জার্মানিতে গণতন্ত্রের বিকাশে বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপক অবদান রেখেছেন। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, এখন সে-অবদান কমে গেছে। অর্থনৈতিক সংকট, শিশুদের পুষ্টিহীনতা, অভিবাসন, ধনী ও গরিবের ব্যবধান নিয়ে তরুণ লেখকরা তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন।

স্পিগ্যাল : জার্মান চ্যান্সেলরকে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে আপনার সমসাময়িক লেখক মার্টিন ওয়ালসার জার্মান সরকারকে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এই যুদ্ধ সম্পর্কে আপনার কোনো মতামত আছে?

গ্রাস : অবশ্যই আছে। তবে অন্যসব যুদ্ধের মতো আফগান যুদ্ধকে অতি সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। এটা ইরাক যুদ্ধের মতো নয়। এই যুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ বিপুল ভুলের প্রমাণ  রেখে গেছে। কিন্তু সেখান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনার দায়িত্বশীল পথ বের করে আনা খুবই কঠিন। ভিয়েতনামের মতো আমেরিকানরা আরেকটা ভুল করেছে আফগানিস্তানে। তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও ব্যর্থ হয়েছি।

স্পিগ্যাল : যদি আফগান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা না হয়। একজন নোবেলজয়ী হিসেবে আপনার কণ্ঠ অনেক বেশি ওজন বহন করে, যেটা আগে করত না। কেন আপনি কিছু বলা থেকে বিরত আছেন?

গ্রাস : আমি যা করছি, তা নিয়ে আমি সবসময় মগ্ন থাকি না। এ-সত্ত্বেও আমি সারাদিন এই ভেবে ভেবে আকুল হয়ে বসে থাকি না যে, আমি একজন নোবেলজয়ী। কখনো কখনো নোবেল জয়ের কথা আমার মনে পড়ে। তবে যখন আমি লিখতে বসি, তখন এই নোবেল জয়ের ঘটনা আমাকে লিখতে কোনো সাহায্যও করে না। যদিও এটা আমাকে আঘাতও করে না।

স্পিগ্যাল : এটা কি আপনাকে চাপের ভেতরেও রাখে না?

গ্রাস : এই পুরস্কার আমাকে লেখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা  তৈরি করে না। চাপে তো রাখেই না। একটু বেশি বয়সে নোবেল পাওয়ায় সম্ভবত এমনটা হয়েছে। যুদ্ধের পরে ১৯৫৮ সালে জার্মান লেখকদের সংগঠন গ্রুপ-৪৭ আমাকে যে পুরস্কার দিয়েছিল, সেটা আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তখন গির্জার ইঁদুরের মতোই আমি দরিদ্র ছিলাম। আমার সহকর্মী  লেখকরা আমাকে তখন পুরস্কৃত করেছিল, যেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অর্থ তৈরি করেছিল। আমার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তার মানে আমি এই বলছি না যে, নোবেল খুবই ছোট একটি পুরস্কার। আমি বলছি, যুদ্ধ-পরবর্তী সেই পুরস্কার আমার জীবনকে বেশি প্রভাবিত করেছিল।

স্পিগ্যাল : জীবনের শেষ পরিণতি নিয়ে আপনি কি চিন্তিত?

গ্রাস : না, আমি মোটেও চিন্তিত নই। একদিক দিয়ে বলতে  গেলে আমি মৃত্যুর জন্যই প্রস্ত্তত। তবে এ নিয়ে আমার কিছু ঔৎসুক্য রয়েছে। আমার নাতি-নাতনিদের ক্ষেত্রে কী ঘটবে? এসব ক্ষেত্রে কিছুটা মামুলি ব্যাপার রয়েছে। আমি এখনো অভিজ্ঞতার পেছনে ছুটছি। জ্যাকব গ্রিমস লিখেছিলেন, সর্বশেষ ফসল বৃন্তেই থাকে। এটা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। আমি তাই করছি। আমার নিজের বয়সের ক্ষেত্রেও সেটার প্রতিফলন ঘটাচ্ছি। মৃত্যু নিয়ে মূলত আমার কোনো ভয় নেই।

স্পিগ্যাল : আপনাকে ধন্যবাদ।

গ্রাস : আপনাকেও ধন্যবাদ।