নক্ষত্র ও নক্ষত্রের অতীব নিসত্মব্ধতা

জাহাঙ্গীর কবির

 

দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে

ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া

হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী

ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় – ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি,

তবে ঐ পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে

লিখিতে যেয়ো না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে

অমত্মরের কথা;

(‘স্বপ্নের হাতে’, ধূসর পা-ুলিপি)

 

কবিতার আড়ালের মানুষটি সবসময় নিজের লেখা কবিতার মতোই ছিলেন দুর্জ্ঞেয়। হয়তো তাঁর অমত্মরস্থ স্বভাবের সঙ্গে মিল থাকলেও, মানুষ ওপরে ওপরে যে-মানুষটিকে দেখেছে, তা ছিল একেবারেই আটপৌরে স্বভাবের। এরকম ছিলেন বলেই হয়তো কবিতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে পেরেছেন, আমাদের ভাবনার প্রায় অগম্য এক জগৎ। সেই আপাত সাধারণ চেহারার মধ্য থেকে অসাধারণ গুণাবলি নিয়ে যখন উপস্থিত হলেন বা পাঠক তা আবিষ্কারে হতবাক হলো, জীবনানন্দ তখন কবিতার কালের গ– পেরিয়ে অনেক সুদূরে। বারবার ধরতে গিয়েও মেলে না। এই মনে হয় একরকম, ক্ষণেই রূপ পালটে অন্যরকম হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা। আর তাই যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও সঠিক চিহ্নায়ন হতে পারেনি  জীবনানন্দের কবিকৃতি। এ-যেন শত সহস্র বছর আগেকার কোনো পাঠোদ্ধার-অযোগ্য পুঁথি, কোনো বিশেষজ্ঞ নেই তা থেকে কোনো সরল অর্থ প্রকাশ করবে। তাই বারবার আমরা জীবনানন্দকে উদ্ধার করেও অতৃপ্ত হয়ে এর ‘দুর্বোধ্য’তাকে গাল দিই। এজন্য কবিতাই একমাত্র ভরসা কবিতা বোঝার। তাই হয়তো জীবনানন্দের ওপর সেরকম উলেস্নখযোগ্য বই রচিত হয়নি। অসংখ্য লেখা আছে তাঁর ওপরে বিভিন্ন পত্রিকায়। রবীন্দ্রোত্তর কোনো কবিকে নিয়ে এত বিপুলসংখ্যক লেখা দেখা যায় না। স্রোতের মতো এই ধারা বয়ে চলেছে। কবিতাই একমাত্র ভরসা কবিতাকে এবং কবিকে বোঝার। একবার-দুইবার-বারবার কবিতার নিবিড় পাঠেই অর্থের মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটবে।

পাঠ্য বিষয়ের ব্যাপার আলাদা, সেখানে অনেক অ-কবিকেও কবি হিসেবে প্রমাণ করতে হয়। ভালো না লাগলেও তাঁর গুণকীর্তন করা লাগে। আবার পেশাদার কবিতার সমালোচক, লেখকরাও এই বিষয়ে তাঁদের পেশার কারণে অনেক কিছু লিখে থাকেন। পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, জার্নাল ইত্যাদি প্রকাশে পছন্দনীয় লেখা খুব কমই মেলে। নিয়মিত তো আর ভালো লেখা তৈরি হয় না। তবু অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে। কখনো কখনো ভালো লেখার সাক্ষাৎ যে মেলে না, তা নয়। প্রচেষ্টাটাই এখানে মুখ্য। নিয়মিত যারা পাঠক, তাঁদের বিরতি পড়ে না পাঠে। যদিও তিনি খোঁজেন ভালো লেখা, পেলে নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করেন। কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। কবিতা এক নিরমত্মর চেষ্টা, তার ভেতর থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসেন। আবার বড় বা শ্রেষ্ঠ কবির সব কবিতাই যে ভালো, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এর মধ্য থেকে পাঠক-গবেষক-শিক্ষাবিদ, সবার পরিচয়ই পাঠক, মূলত অনেক দিনের প্রচেষ্টা, সাধনার মধ্য দিয়ে বেছে নিতে সমর্থ হন তাঁর প্রিয় লেখা। অনেক নন্দিত হওয়ার পরও এখনো জীবনানন্দের ‘অনভিজাত’ অভিধা ঘোচেনি। তিনি এখনো ‘আভিজাত্য’ অর্জনে অসমর্থ বলেই হয়তো অন্যদের সঙ্গে তাঁর এই পৃথক কবিত্বশক্তি ভিন্নতর হয়ে দিন দিন তা সবাইকে ছাড়িয়ে আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে। অথচ তাঁর সমসাময়িক বা পরবর্তী অনেক কবিই খুব স্বল্প প্রয়াসে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন। তাঁরাও বড় কবি, বাংলা সাহিত্যে কবিতা ছাড়াও শিল্পের অন্যান্য বিষয়েও অনেক গুণ বিদ্যমান। তবু তাঁদের সঙ্গে জীবনানন্দের এক সুস্পষ্ট পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। জীবনানন্দকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথ এখনো তৈরি হয়নি। জীবনানন্দের ছায়া উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে কবির আবির্ভাব জরম্নরি হয়ে পড়লেও গত শতাব্দীর মধ্য-পূর্বকাল থেকে আজ পর্যমত্ম সেরকম কেউ দৃশ্যমান হয়ে ওঠেননি। বরং তাঁকে এড়াতে গিয়ে আরো জড়িয়ে পড়েছেন তাঁরই প্রভাব-বলয়ে। কবি কিন্তু তাঁর সময়ে রবিপ্রভার বাইরে যে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার জন্য কোনো সচেতন প্রয়াস কোনো কবিতা বা কাব্যগ্রন্থে দেখা যায়নি। ঝরা পালকের কবিতা দিয়ে জীবনানন্দকে বিচার করা হয় না, আবার বাদও দেওয়া যায় না। কবি নিজেও অবশ্য ঝরা পালকের বিষয়ে একটু সংকুচিত ছিলেন। (এটা তাঁর স্বভাবের বৈপরীত্য) বরং যাঁরা সরাসরি রবীন্দ্রবিরোধিতায় সোচ্চার ছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁদের সবাইকেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, তাঁদের এই কাব্য-আন্দোলন অপ্রয়োজনীয় ছিল। ভীষণভাবে এর দরকার ছিল। তার প্রমাণ তিরিশোত্তর সাহিত্য। জীবনানন্দ আত্মমুখীন ছিলেন, সংঘ-সমিতি-দলাদলি, এসবের বাইরেই থাকতে পছন্দ করতেন, নিজের চৌহদ্দির বাইরে কখনো পা বাড়াননি। সহজাত এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই বিড়ম্বনায় জীবনানন্দকে পড়তে হয়নি। সে-কারণে নির্বিঘ্নেই তিনি রবীন্দ্রনাথের বাইরে তাঁর নিজস্ব একটা জগৎ সৃষ্টি করে নিতে পেরেছেন। সেই জগতের মাহাত্ম্যই এখন গবেষণা করে চলেছেন, পাঠক-বিদ্যার্থীরা।

‘আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেকার রবীন্দ্রানুসৃতির মতোই, বর্তমানের জীবনানন্দীয় ঘোর, আমার ধারণায়, বাংলা কাব্যকে এক জায়গায় আটকে রেখেছে, জীবনানন্দকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে না আসতে পারলে মুক্তি অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের সৃষ্টি জ্যোতির্ময়তম, কিন্তু সেজন্যই বলছি, তাঁর সর্বসমাচ্ছন্ন করা প্রভাব পরম সর্বনাশের ব্যাপার।’ (পরিচয়, আষাঢ় ১৩৭২, অশোক মিত্র)

জীবনানন্দের মধ্যে অন্ধকার এবং মৃত্যু-ভাবনার যে সমভিব্যাহার তা যেন অনেক সময় সমার্থক হয়ে দেখা দেয়। এধরনের অনেক কবিতা তাঁর প্রধান প্রায় সব কাব্যগ্রন্থেই মেলে। ধূসর পা-ুলিপি থেকে এর শুরম্ন। ‘অন্ধকার’, ‘মৃত্যুর আগে’, ‘আট বছর আগের একদিন’ ইত্যাদি কবিতায় এই চেতনার প্রবল উপস্থিতি। এই কবিতাগুলোর মধ্যকার অমত্মর্নিহিত তাৎপর্য এ-ধারণার সঙ্গে কতটা যথার্থ, তার একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।

অনেক অনেক দিন

অন্ধকারের সারাৎসারে অনমত্ম মৃত্যুর মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে

বুঝতে পেরেছি আবার;

‘অন্ধকারের সারাৎসার’, এরকম অন্ধকারকে নিয়ে সারাৎসারের মতো আলংকারিক শব্দ ব্যবহারের নজির মনে হয় জীবনানন্দের পূর্বে কেউ ভাবেননি। সারাৎসারের অসংখ্য সমার্থক শব্দের মধ্যে প্রথম যে শব্দটি স্মরণে আসে, তা হলো বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ অন্ধকার কেমন হয়? যার কোনো খুঁত নেই। কেবলই অন্ধকার। প্রকৃত, আসল, খাঁটি, যথার্থ। কবিতার নামও ‘অন্ধকার’। এই কবিতা লেখার আগেই কি কবি নাম ঠিক করেছিলেন, না কবিতা লেখার পরে, কোনটা? ঘোর লাগে মনে, ভাবতে গেলে অবশ-বিবশ, হতবিহবল হতে হয়। মনে হয় দুটির মধ্যেই লেখার আগে একটা পারম্পর্য ছিল। শুধু নাম ঠিক করে বা বিষয়বস্ত্ত নির্দিষ্ট করে এই কবিতার নামকরণ করা হয়েছে কিনা – একটা ধন্ধ থেকে যায়। এই কবিতার এই একটি শব্দই যেন অনেক জিজ্ঞাসার ধারক। অন্ধকারকে কত ব্যাপকভাবে দেখতে, অনুভব করতে পারলে, এরকম একটি কবিতা লেখা যায়!

সে-আঁধার বিদীর্ণ হলো কীভাবে? ‘সূর্যের মূর্খ উচ্ছ্বাসে’, তা না হলে যে ‘অনমত্ম মৃত্যুর’ মধ্যে হারিয়ে বা তলিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন না। বলেছেন –

ভয় পেয়েছি,

পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;

দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে

অন্ধকার থেকে তিনি মোটেই বের হতে চাননি। এই ভয় কি কবিতার আক্ষরিক অর্থের সত্যতা প্রকাশ করে, না এর মধ্যে কোনো গভীর অনুধ্যান আছে যার ব্যাখ্যা সাধ্যাতীত পাঠকের কাছে? এই প্রশ্নের দোলাচলে তিনি আবার বললেন –

মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য

আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

কার দ্বারা নির্দেশিত হলেন? মানুষিক সৈনিক কেন? মানুষ রক্ষা বা মানুষ হতে পৃথিবীর মুখোমুখি হতে বলার অর্থ পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য নেই, সে-কারণেই কি কবি এই আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী থেকে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে চান? একি আরো আরো আলোর প্রত্যাশা? তাই যদি হবে তাহলে এই অন্ধকার কি প্রকৃত অর্থে কবির আলোহীনতার প্রতি এক দুর্নিবার আক্রোশ!

শুধু তাই নয় ‘নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে’ও পারতেন না। এত বিশুদ্ধ অন্ধকারে হারিয়ে ছিলেন! মৃত্যুর মতো মিশে ছিলেন সেই অন্ধকারে! অন্ধকারকে যেন মৃত্যুর সমার্থক শব্দে পরিণত করে ফেলেছেন।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে ছিলাম – পউসের রাতে –

কোনোদিন আর জাগবো না জেনে

এ তো এক সিদ্ধামেত্মর ঘোষণা। ‘নদীর চ্ছলচ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম’, কোনো ইচ্ছেই ছিল না জেগে ওঠার? এ কারণেই?

সমসত্ম হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;

সূর্যের রৌদ্রে আক্রামত্ম এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের

আর্তনাদে

উৎসব শুরম্ন করেছে।

এত অন্ধকারপ্রীতি তো মৃত্যুরই শামিল। এই কবিতা থেকে কিন্তু এরকম ভাবার অবকাশ নেই যে, মৃত্যু এবং অন্ধকারের প্রতি তাঁর অসীম বোধ কাজ করেছিল। অনেক কিছুর মতো এটাও কবির একটা পরিচয়। তিনি তো কোনো নির্দিষ্ট বৃত্তবন্দি ছিলেন না। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় এরকম চিমত্মা দেখা গেলেও শেষ পর্যমত্ম কিন্তু ধিক্কার দিয়েছেন আত্মহননে প্রলুব্ধ লোকটিকে। এজন্য পেঁচাকে দুষেছেন, কেন পেঁচা কোনো শব্দ করে তার সম্বিৎ ফেরাতে চেষ্টা করল না। ‘রক্ত ক্লেদ বসা থেকে ফের উড়ে যায় মাছি’ অথবা ‘দুরমত্ম শিশুর হাতে ফড়িংয়ের ঘন শিহরণ মরণের সাথে লড়িয়াছে’ বেঁচে থাকার এরকম বাঙ্ময় প্রত্যয় তুলে ধরেছেন। আবার অন্যখানে ‘জাগিবার কার আছে/ দরকার আছে ঘুমাবার;’ এরকমও বলেছেন। ধূসর পা-ুলিপির ‘মৃত্যুর আগে’ পুরো কবিতাতে চারদিকের ছড়ানো-ছিটানো, কবির ভালোলাগা বিষয়ের অনুপুঙ্খ বিবরণে ঠাসা। এর সবকিছুই কবির এত নিজস্ব যে তাকে মনে করে রাখতে চাচ্ছেন, দেখে যেতে চাচ্ছেন, মৃত্যুর পর আর মিলবে না দেখা, সেই কষ্টবোধ সঞ্চারিত হয়েছে অত্যমত্ম ব্যথিত অনুরণনে।

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউসসন্ধ্যায়,

দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল

কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়

তারা সব;

মৃত্যু-উত্তর পউসসন্ধ্যার এই নরম নারীর কুয়াশার ফুল ছড়াতে দেখবেন না, যারা কিনা পাড়াগাঁর সাধারণ মেয়েদের মতো হয়েও অসাধারণ হয়ে মিশে আছে এই শীতের নির্জনতায়। জীবনকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কতখানি ভালোবেসে অনুভব করা গেলে বলা যায় –

দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,

হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,

ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো মাখিয়াছে খুদ,

চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গরা রূপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা

নির্জন মাছের চোখে; – পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার অাঁধারে

পেয়েছে, ঘুমের ঘ্রাণ – মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’য়ে গেছে তারে;

অন্ধকারের আস্বাদ থেকে জাগতে না চেয়ে যিনি বলেন ‘আর জাগবো না আমি কোনোদিন আর’ তাঁর কেন মৃত্যুর আগে এতসব ভালোলাগা বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ? এত ছেড়ে না যেতে চাওয়ার বাহানা? সেই ভালোলাগা পৃথিবীকে তলিয়ে-ডুবিয়ে অন্ধকারের সারাৎসারে মিশে থাকার সুতীব্র বাসনা আরো এক অনমত্ম জীবনের অন্বেষা নয় কি? তা না হলে কেন বললেন –

আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর

পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা

ক’য়ে গেছে; – আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতরে

আরো-এক আলো আছে : দেহে তার বিকেল বেলার ধূসরতা

চোখের দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির :

পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় মস্নান ধূপের শরীর;

পৃথিবীকে ভালোবেসে ব্যথা পেয়ে কবির আর্তি সমসাময়িক ‘অন্ধকার’ কবিতায় গরল বর্ষণ করেছেন। এ-যেন সমগ্র সভ্যতার নামে পৃথিবীর অনাচারের বিরম্নদ্ধে ‘ভয়াবহ আরতী’।

‘অন্ধকার’ কবিতায় বারবার সেই সুর অনুরণিত হয়েছে। তার ধ্বনি পাঠকের ইন্দ্রিয়ে বেদনার গভীর আর্তি হয়ে বেজেছে।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিমত্মা, কাজ,

সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরম্নষ, অনমত্ম

আকাশগ্রন্থি,

শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,

শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;

এই সব ভয়াবহ আরতী!

‘এ চিত্রকল্প বিকট শব্দ ও যন্ত্রণানুভূতিরই প্রতিষ্ঠা। তার মধ্যে আশ্চর্যভাবে লিপ্ত রয়েছে বিশৃঙ্খল ও জুগুপ্সা। কিন্তু তাও আসছে একটি কল্পিত দৃশ্যের আভাস থেকে।’ (অম্বুজ বসু, ১৩৭২, পৃ ১৪২)

এটাকে চিত্রকল্প বলে জ্ঞান করলেই শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। এর মধ্যে যে যন্ত্রণাকাতরতার ভয়াবহতা, তা মানুষের সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে তাকে নিরমত্মর ক্লিষ্ট করে। এখানে কোনো স্বসিত্ম বা শামিত্মর বারতা নেই, নেই কোনো সামত্মবনা। এরপরে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। গোটা ব্রহ্মা-কেই তিনি টেনে নামিয়েছেন মৃত্যুর প্রতীকে, শামিত্মর  বিপক্ষ শক্তিরূপে। শুধু এই একটি মাত্র কবিতায় মৃত্যুপ্রেম এবং জীবনের প্রতি যে বিরূপতা, তা সারা কাব্যগ্রন্থ তন্নতন্ন করেও পাওয়া যাবে না। জীবনানন্দের মধ্যে যাঁরা জীবনবিমুখ কবির অনুসন্ধান এবং প্রমাণ দিতে চান, তাঁদের জন্য এই কবিতাটি পরম পূজনীয়। এক সময় ধূসর পা-ুলিপির কবিতাগুলো নিয়ে তাঁর মধ্যে নির্জনতা, নৈরাশ্য, হতাশা, বিষাদের প্রতীকরূপ চিহ্নিত করেছিলেন বা করার চেষ্টা কিছুই বাকি রাখেননি সমালোচকরা। ঠিক তার পরের কাব্যগ্রন্থেই, বনলতা সেনে এসে এরকম একটা কবিতা পেয়ে যাওয়া কম কথা নয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতার পরে জীবনানন্দকে নিয়ে ভাবনার ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছিল। অথচ ধূসর পা-ুলিপিতেই অনেক কবিতা, কবি সম্পর্কে যেসব অভিধা ব্যবহার করা হয়, তার সবগুলোকেই খ-ন করার প্রকৃত এবং অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমান। ধূসর পা-ুলিপির প্রথম কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’-এ –

আমি ঝরে যাবো – তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিবে ধরে সেদিন পৃথিবীর ’পরে,

– আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

পরের অনুচ্ছেদেই আছে

রয়েছি সবুজ মাঠে – ঘাসে –

আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে;

এই উচ্চারণের পরে জীবনের সীমা কতদূর পর্যমত্ম বিসত্মৃত, তা কি ভাবা যায়! অবসরের গানে এসেই কি দেখা গেল, কর্ম শেষের বিকেলে প্রাণচাঞ্চল্যের অপরূপ বিবরণ :

মাঠের নিসেত্মজ রোদে নাচ হবে –

শুরম্ন হবে হেমমেত্মর নরম উৎসব

হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে

কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে

ফলমত্ম ধানের গন্ধে – রঙে তার – স্বাদে তার ভরে যাবে

আমাদের সকলের দেহ;

রাগ কেহ করিবে না – আমাদের দেখে হিংসা করিবে না

কেহ।

অথচ এই ধূসর পা-ুলিপি থেকেই নির্জনতার বা নির্জনতম উপাধি ধারণ করতে হয়েছিল কবিকে। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় আরো প্রসারিত হলো। ইতিহাস, ভূগোল, গোলক অতিক্রমে কবি সমগ্রতার পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন। এটা প্রমাণের আর অবকাশ রইল না যে, তিনি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের কবি নন। নির্দিষ্ট ওই অর্থে, তিনি কবি এবং কবিই। সে-কারণেই ‘অন্ধকার’ কবিতা নিয়ে খটকা। এই কবিতার ছত্রে ছত্রে বিবৃত হয়েছে ঘুম এবং মৃত্যুর আবহ। গভীর ঘুমের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে। নিবিড় ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না হয়, তার জন্য সব আলো অপসারণে গভীরতম অন্ধকারের আস্বাদন চেয়েছেন। বলেছেন, ‘আর জাগবো না। কোনোদিন আর জাগবো না।’ এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন জীবনানন্দ অনুরাগী ও ভক্ত পাঠক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন –

জীবনানন্দের কবিতায় পুনরাবৃত্তি দূরত্ব নির্ণায়ক। ‘কোনদিন জাগবো না আমি – কোনদিন আর।’ এখানে ‘কোনদিন আর’ অনমেত্মর দিকে চলে গেছে। দূরত্ব বেড়ে গেছে। আবার ‘কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে’ : এখানে ‘তাহার’ শব্দে দুজনের মাঝে ‘হা’ দূরত্ব সৃজন করেছে। পুনরাবৃত্তিতে দুজনের মাঝে হা ঘুচে গেছে, দূরত্ব কমে গেছে, অমত্মরঙ্গ হয়েছে।

এভাবে দেখলে পর্যবেক্ষণে আপেক্ষিকতা দৃষ্টিগোচর হয়। তখন ঠিক কবিতা আর শুধু আক্ষরিক সত্যে আটকে থাকে না। কবিতা কখনোই আক্ষরিক সত্য নয়। সেদিক দিয়ে লাইন ধরে ধরে কবিতাকে ব্যাখ্যা এক ধরনের বোকামি বা অনর্থক পরিশ্রমও বটে। এর ফলে ব্যক্তিচিমত্মাই প্রবল হয়ে ওঠে, কবিতার বিসত্মারে বিঘ্ন ঘটে। একটি কবিতার অজস্র জিজ্ঞাসার পরেও অনুত্তর থেকে যায়। কবিতার সৌন্দর্য এখানেই। তবে যে-কোনো কবিতায় এরকম অনুসন্ধানও কাম্য নয়।

এই অত্যাশ্চর্য সুন্দর কবিতা একটিই যথেষ্ট একজন কবির জন্য। আর কোনো কবিতা না লিখলেও হয়তো চলত। এই অনুভূতি একবার নয়, বারবার আসে অনেক অনেক কবিতায়। যার তালিকা করাই অসম্ভব। জীবনানন্দ এখানেই পৃথক সমগ্র বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য ভালো কবিতার জন্য। শেষ পর্যমত্ম এই ঘোষণা থেকে একচুলও সরলেন না। আরো দৃঢ়বদ্ধ হয়ে যেন কবির কাছ থেকে পাঠকের মর্মমূলে গেঁথে গেল এই চেতনা।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো – ধীরে – পউসের

রাতে –

কোনোদিন জাগবো না আমি – কোনোদিন আর।

শেষে কোনো আশ্চর্যবোধক চিহ্নও রাখেননি। কত স্থির, সুচিমিত্মত প্রত্যয় যেন। ধূসর পা-ুলিপি এবং বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সমসাময়িক কালেই লেখা। সেজন্য কোনো একটা কবিতাকে বিচ্ছিন্ন করে ভিন্ন অর্থ অনুসন্ধান বৃথা বরং তাকে বিচ্ছিন্ন বলাই শ্রেয়। সেই অর্থে মৃত্যুচিমত্মাও যদি প্রবল হয়ে থাকে, তাতেও কিছু আসে যায় না। মৃত্যুচিমত্মা মানুষের সহজাত বোধ থেকেই আসে, মৃত্যু অনিবার্য বলেই। তাকে যদি উপমা প্রতীকে কবিতায় রূপ দেওয়া যায়, তবে তা নিশ্চয় ওই একটি কবিতার মধ্যেই সীমায়িত থাকে না। কবিতার পারম্পর্যের সঙ্গে আলাদা করা যায় না। এখানে বরং এটা বলা যায় যে, যে-কোনো একটি বিষয়কে এত সুনির্দিষ্ট করে কবিতা রূপে বিশ্বাসযোগ্য করার অসাধারণ প্রকাশ। ‘অন্ধকার’ কবিতাটা এ-কারণেই ‘অরব অন্ধকারে’র মতো  গাঢ়-ঘন-নিবিড়।

হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে

আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,

অন্ধকারের সত্মনের ভিতর যোনির ভিতর অনমত্ম মৃত্যুর মতো মিশে

থাকতে চেয়েছি।

এরপরেই বলছেন – ‘কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।’ বা ‘তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;’ তারপরে এ-ও বলছেন, ‘আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।’ তিনি পৃথিবীর হয়েও         পৃথিবীকে মেনে নিতে পারছেন না। এই না-পারার কারণ কী? এখানে ‘জাগিবার কাল আছে/ দরকার আছে ঘুমাবার’ সে সুর নয়। জাগতেই অস্বীকার করছেন। পৃথিবীকে জাগিয়ে রাখে যে-সূর্য, তাকেও বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। পৃথিবী তাঁর কাছে মৃত এক গ্রহ, তাবৎ মানুষ ‘নষ্ট শশা’? এই আক্রোশ কি তবে সভ্যতার প্রতি ইঙ্গিতবহ? মেনে নিতে পারেননি এর কদর্য দিকগুলো, স্বার্থপরতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এই সময় থেকে নিজেকে আড়াল করার তীব্র বাসনা থেকেই কি ‘আর জাগবো না আমি’ বলেছেন! তাহলে কি ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় অশ্বত্থের শাখায় উদ্বন্ধনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন     যে-মানুষটি, তিনিই কবির অনুরূপ!

বধু শুয়ে ছিল পাশে – শিশুটিও ছিল

প্রেম ছিলো আশা ছিলো

তারপরেও কেন তার মনে হলো

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি,

 

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অমত্মর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লামত্ম করে

ক্লামত্ম-ক্লামত্ম করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লামিত্ম নাই;

 

‘যদি এই অচিকিৎস্য জীবন-ক্লামিত্মতেই কবিতার শেষ হতো, তাহলে এটি এত দূর পর্যমত্ম আলোচ্য হতো না। কিন্তু ঠিক শেষের ক-লাইনেই আমরা অন্য একটা স্বর শুনলাম – যেন একটা ঢেউ স’রে যেতে-যেতে দ্বিগুণ বেগে ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো – কবি ফিরিয়ে আনলেন জরাজীর্ণ পেঁচাটাকে, যে আত্মহত্যায় বাধা দিতে পারেনি, কিন্তু জীবিতের কানে অবিরাম জ’পে যাচ্ছে তার প্রাণসত্তার আদিম আনন্দ।’ (বুদ্ধদেব বসু, ১৩৮২)