নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

\ ৩৩ \

 

রাতের ঘন অন্ধকার, হারিকেনের দীপ্তিও তার চিমনির বাইরে বিস্তার লাভ করতে পারে নাই। বাঁশবনের ভেতরে হাওয়ার অবিরাম সরসর ধ্বনি। সেই ধ্বনিও এমন প্রবল যে তাকে ঠেলে মইনুল হোসেন মোক্তারের গৃহিণীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হতে পারে নাই। এই ভ্যাপসা গরমকালেও সর্বাঙ্গ চাদরে মোড়া ওয়াহেদ ডাক্তার, অন্ধকারে প্রায় বিলীন, সে চাদরের তলা থেকে ভূতের মতো হাত বাড়িয়ে বন্ধুপত্নীর হাত থেকে মাটির খোরাটি গ্রহণ করে। মোক্তার স্ত্রীকে প্রায় ধমকের স্বরে বলে ওঠে, এই যা দেখিলু তো দেখিলু, কাইল ফজরেই

কলকলায়া দশজনার কাছে না বলিস যে ওয়াহেদ ডাক্তার আসিছিলো। নারীলোকের কলকলানি! প্যাটের কথা উজাড় না করিলে প্যাট ফুলি ওঠে! ওয়াহেদ ডাক্তার আসে নাই। যা দেখিলি দেখিস নাই। বিত্তান্ত বাহিরে তুই দশজনাকে কইস যদি, তোরে অ্যাকদিন কি হামারে অ্যাকদিন! এ-কথা শুনে মহিলা তাঁর স্বামীর দিকে যে তীব্র দৃষ্টি হেনে সমুখ থেকে বিদায় লন, মোক্তারের তা নজরে পড়ে না।

স্ত্রী ঘরের ভেতরে চলে গেলে কিছুক্ষণ সেদিকে নজর করে মইনুল হোসেন ডাক্তারকে বলে, না! তোমার চিন্তা নাই। তুমি যে আসিছিলে, পরকাশ হবার নয়। এলা তোমার কাম! কিং ওয়াহেদ নামে সুন্দর নকশা করিয়া সিল তোমার চাই। হেথাকার জলেশ্বরী বাজারে হায়দর দপ্তরি সিল বানায়, তবে ঘটনা এই – তার নিজের কাছে ছিল বানাবার যন্ত্র নাই। অর্ডার নিয়া তাঁই সিল বানাইতে যায় রংপুরের বড় দোকানে। তাছাড়া তার প্যাটও বড় পাতলা। কথা একখান থেকি দশখান হইবে। – তবে? ওয়াহেদ ডাক্তার চিন্তিতস্বরে বলে, তবে উপায়? মোক্তার তখন বলে, উপায় তুমি মোর হাতে ছাড়ি দেও। আমি রংপুরে যাবো তোমার সিল বানাইতে। তবে চিন্তা তো সেইটা নয়, চিন্তা! ঘোর চিন্তা আরো আছে। তোমার কাছে কি খবর নাই যে মন্মথ দারোগা তোমার রাজধানী হরিষাল রওনা হয়া গেইছে!

এ-কথা শুনে চমকে ওঠে ওয়াহেদ ডাক্তার। – কখন? – এই তো আইজ ফজর অক্তে তাঁই রওনা হয়া গেইছে বলি সংবাদ পাই। বড় চিন্তাতে ছিলোম। তার বাদে হঠাৎ তোমাকে রাইতে হাজির দেখিয়া আরো চিন্তা হয় যে তুমি কি ডর ভয়ে পলায়া আসিলে! এ-কথা ডাক্তারের কানে পশে কি পশে না, ঠাহর হয় না। চাদর মোড়া লোকটা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তখন মোক্তার তাকে তাড়া দেয়, ধন্দ মারি থাকিলে যে! খাও খাও। জলপান করি নেও। দই আর খই, শান্তি করি খাও। কও তো ভাতের জোগাড় দেখি। – না! না! টাইম নাই।

টাইম নাই – কথাটা মইনুল হোসেন মোক্তার গ্রহণ করে অন্যভাবে। তার ধারণা হয়, মন্মথ দারোগা যে ওয়াহেদ ডাক্তারকে গ্রেফতার করবার জন্যে হরিষাল রওনা হয়ে গেছে, এ-সংবাদেই সে বিচলিত, তাই ধার মুখে জলপান পেয়েও সে হাত গুটিয়ে রেখেছে। না, ওয়াহেদ ডাক্তার দই-খইয়ে হাত দেয় না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে থেকে ঝটিতি উঠে দাঁড়ায় এবং অচিরে দাওয়া থেকে নেমে লাশকাটা ঘরের দিকে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে পথ নেয়। মোক্তার তখন স্ত্রীকে ডেকে বলে, ব্যাপারখানা কি দেখিলু? ভূতের ভয় নাই, মন্মথ দারোগাকে ভয়! লাশকাটা ঘরের দিকে হনহন করিয়া গেইলো, লাশের ভয় নাই, দারোগার কথা শুনিয়াই ত্রস্ত!

ত্রস্ত হবার কথাই! মন্মথ দারোগার নামে গাছের পাতাও শিহরে ওঠে, আধকোশার দুরন্ত স্রোতও থমকে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ আমলের পুরনো দারোগা। ইয়া মোচ তার, সটান চামচের মতো, ঠোঁটের প্রান্ত ছাড়িয়ে কানের লতি ছুঁয়ে শোভা পায়। ঘোড়াটিও তার তেমনই। মানুষ সমান উঁচু তার দেহ। রং দুধে ধোয়া ধবধবে শাদা। মুখে তার বলক ওঠা দুধের মতো ফেনা। নাম তার অশ্বিনী। ভয়াবহ দাপে চলে। অশ্বিনীর খুরের ধারে আগুনের ফুলকি ওঠে। দাপের চোটে মাটি থরথর করে কাঁপে। সকাল-বিকাল ঘোড়াকে দৌড় করায় মন্মথ দারোগা। থানা থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার পিঠে দারোগাবাবু হেই ছুটে আধকোশার পাড় পর্যন্ত, আবার সেখান থেকে বিদ্যুৎবেগে মুখ ঘুরিয়ে ডাকবাংলোর পাড়ে রেললাইন পর্যন্ত, সবই যেন চোখের নিমেষে। পথচারীর পরোয়া নাই, ঘোড়ার সমুখে কেউ উলটে পড়লো কি পড়লো না, দেখা নাই, সারা শহর যেন দারোগা আর তার ঘোড়ার দৌড়ের ফাঁকা মাঠ!

এ তো গেলো ঘোড়ার কথা। দারোগার কথা বলাই হয় নাই! এমন দারোগাদের কারণেই বাংলায় ব্রিটিশ রাজত্ব করে গেছে দুশো বছর। ব্রিটিশ তার ভগবান। ব্রিটিশ তার মা-বাপ। এতকাল মানুষেরা দেখেছে গ্রেফতারি পরোয়ানা কি হুলিয়া মাথায় নিয়ে জলেশ্বরীতে গা-ঢাকা দিতে আসে সেই কলকাতা কি দূরদূরান্ত থেকে বাঙালি বিপ্লবী কি কমিউনিস্ট কর্মীরা। একবার তিস্তা পার হলেই নিশ্চিন্ত। আর তাদের পায় কে! রাজারহাট, নবগ্রাম, বুড়িরচর, শনিরভিটা তো আছেই, আধকোশা পার হয়ে হস্তিবাড়ি, মান্দারবাড়ি কি হাগুড়ার হাট, হরিষাল পর্যন্ত এলাকার মানুষেরা এদের আশ্রয় দিয়ে আসছে সেই কত-কত বৎসর, লুকিয়ে রেখে আসছে, ভাতপানি দিয়েছে, তারপর সময় সুসার হলে আবার তারা নিজ এলাকায় ফিরে গেছে, আবার আন্দোলন করেছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। অবশেষে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে-পরে, জলেশ্বরীতে ব্রিটিশ পাঠায় মন্মথ দারোগাকে। ঘোড়া হাঁকিয়ে গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে মন্মথ দারোগা খুঁজে খুঁজে বের করেছে পলাতক রাজনৈতিক কর্মীদের। সহজে কাজ উদ্ধার না হলে আশ্রয়দাতা গ্রামীণ সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, ধানের পাকা ক্ষেত তছনছ করেছে, হাটবাজার বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর বনের প্রাণী ধরার মতো শিকারি এই দারোগা পলাতক বিপ্লবীদের হাতে-পায়ে হাতকড়া ডান্ডাবেড়ি দিয়ে জলেশ্বরীর ট্রেনে তুলে দিয়েছে। আর, তার আগে থানায় এনে তাদের ওপর নিজ হাতে চাবুক চালিয়েছে সে।

এসব তো জলেশ্বরীর মানুষের কাছে বিস্মরণ হয়ে যায় নাই। মহকুমায় নতুন হাকিম এলেই প্রথম তার খোঁজ পড়ে মন্মথ দারোগার। লম্বা সালাম-আদাবের পর দারোগার বাঁধা নিবেদন, রাজ করেন নিশ্চিন্তে! আমি থাকতে ব্রিটিশের রাজত্বে বেচাল এতটুকু আপনি দেখবেন না। পাকিস্তানের জন্মকালে হাকিম নেয়ামতউল্লাহ্ও মন্মথ দারোগার এহেন আশ্বাস পেয়েছেন বটে, কিন্তু এখন ব্রিটিশ নাই, এগারোদিনের পাকিস্তান এখন, তবু শাসন বলে কথা! নিশান বদল হতে পারে, শাসন তো গাছে উঠে যায় নাই! পাকিস্তানের বুকে হরিষাল এলাকার রাজা ঘোষণা দিয়েছে ওয়াহেদ ডাক্তার – শহরে গাঁয়ে লোকে যতই হাসাহাসি করুক যে উন্মাদের উন্মাদ, লোকটা যে  বিচার-আচার শুরু করে দিয়েছে, এমনকি একজনকে ফাঁসি পর্যন্ত দিয়েছে, এটা তো সরকার চোখ বুজে হজম করতে পারে না!

মহকুমার হাকিম নেয়ামতউল্লাহ্ শহরের একমাত্র পাকা দোতলা দালান তাঁর হাকিম-কোঠার বারান্দার ঘুপচিতে বসে দাড়িতে মেহেদি লাগাচ্ছিলেন ভোরবেলা, এর মধ্যে বাইরে ঘোড়ার চিঁহিহিঁ ডাক। শহরে ঘোড়া একটাই আর সেটি থানার দারোগার। নেয়ামতউল্লাহ্ একটু গা তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে ওপর থেকেই দেখে নেন – মন্মথ দারোগা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামছে। পুরো উর্দি পরা, পায়ের বুট আর ফ্যাটা বাঁধা দেখেই পরিষ্কার ঠাহর হয় – দারোগা কোনো ধরপাকড়ের কাজে বেরিয়েছে।

আর্দালি বশির ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেয়, দারোগাবাবু কইলে যে টাইম তার নাই, এলায় জরুরি সাক্ষাৎ আর্জেন্ট চাই! খুব বিরক্ত হন নেয়ামতউল্লাহ্, মনটা তাঁর একেবারেই বশে নাই অন্য কারণে, মন খুব ঝটপট করছে কদিন থেকে, কেন তা অচিরে বলা হবে, এখন তিনি ধমক দিয়ে ওঠেন, আর্জেন্ট! বললে তুমি! ইডিয়ট! রাস্কেল! যাও, তাকে অপেক্ষা করতে বলো, আর গোসলের গরম পানি রেডি করো! এই বলে দাড়িতে তিনি মেহেদি লাগিয়ে চললেন আগের মতোই। এ-কাজটা তাঁর স্ত্রী বড় আদরে করে দেন বরাবর, কিন্তু ব্রিটিশের বিদায় আর পাকিস্তানের জন্ম, এই পরিবর্তনের সমূহ কালে জলেশ্বরীতে পোস্টিং পেয়ে পরিবার তিনি মুর্শিদাবাদেই রেখে এসেছেন। চোদ্দই আগস্ট মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের মধ্যে পড়েছে, এতে খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু এখন আবার রব শোনা যাচ্ছে – না, মুর্শিদাবাদ হিন্দুস্থানের ভাগেই ফিরে যাবে, না, মনটা আজ ভোরে তার এ-কারণেও ঝটপট করছে না।

তাঁর বহুদিনের অভ্যেস, পনেরো দিন পরপর দাড়ির মেহেদি নতুন করে লাগানো। দাড়িও তাঁর বাড়ে তাড়াতাড়ি, দশ দিনের মাথাতেই দাড়ির গোড়ায় আসল পাকা শাদা রং উঁকি দিতে থাকে। শৌখিন মানুষ তিনি, মেহেদির গোড়ায় শাদা পাড় ওঠা একেবারেই তাঁর পছন্দ নয়। চোদ্দই আগস্ট পাকিস্তানের নিশান তোলার আগের সন্ধ্যাকালে মেহেদি লাগিয়ে বেশ পরিপাটি হয়েছিলেন, দ্যাখো তার এগারোদিনের মাথাতেই পাকা রং দাড়ির গোড়ায় উঁকি দিচ্ছে! মনটা তাঁর ভালো নাই পাকিস্তানের সেই চোদ্দই আগস্টে নতুন দেশের নিশান তোলার সকাল থেকেই। তিনি যে কাদিয়ানি, এ-কথাটা মানুষের ভিড়ে ফিসফাস হতে শুরু করে সেই সকাল থেকেই। এটাই তাঁর বুকের ভেতরে দাপাদাপি করছে – না জানি কী হয়! সেইদিনই সন্ধ্যাকালে মুসলিম লীগের নজির মিয়া এসে জরুরি সাক্ষাৎ করেন তাঁর সঙ্গে। – আপনি যদি কাদিয়ানি, বিশেষ কী রসুলুল্লাহকে আপনারা আখেরি নবী মানেন না, এর সত্যতা যদি কিছু থাকে তো হামার কাছে গোপন না করেন হাকিম সাহেব! চাপিবার তো কোনো কারণ দেখি না। পাকিস্তানের ফরেন মিনিস্টার যে নিয়োগ করা হয় বলিয়া শুনিছি, সেই জাফরুল্লাহ খানও বোলে কাদিয়ানি! হয় কি নয়?

নেয়ামতউল্লাহ্কে স্বীকার করতেই হয়, হাঁ, জাফরুল্লাহ সাহেব কাদিয়ানি। তবে তিনি খুব জোরের সঙ্গেই বলেন, আমরা তো মুসলমানের বাইরে নই, মিস্টার নজির! আমরা আপনাদেরই মতো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলি। তবে তারপরেও কিছু কথা আছে, সেটা আরেকদিন আলাপ করা যাবে, আজ এসব কান-কথায় কান দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করাই ভালো। অনেক আন্দোলনের পর, অনেক ত্যাগ স্বীকারের পর পাকিস্তান হাসেল করা গেছে, আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া, কায়েদে আজমকে লাখো সালাম, এখন বারো ঘণ্টাও পার হয় নাই পাকিস্তানের, এর মধ্যে এসকল কথা নিয়ে আপনি এসেছেন যে আমি পাকা মুসলমান কিনা, এটা কী উচিত হয়? – নজির মিয়া কথাটা নিয়ে আর কিছু অগ্রসর হলে, নেয়ামতউল্লাহ্ ভাবছিলেন তিনি বলে বসবেন কিনা – এই যে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, তিনিও তো সেই অর্থে মুসলমান নন, তিনি খোজা ইসমাইলি সম্প্রদায়ের, আর এই সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহর পাশাপাশি ব্রহ্মা-বিষ্ণুকেও মানে! না, এতটা ফাঁস করা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। জিন্নাহ সাহেবের নামে এমন কথা বললে হয়তো তাকে কতল করাও ফরজ হয়ে যাবে মুসলিম লীগের এই লোকাল লিডারের!

তবে নজির মিয়ার মতলবটা ঠাহর করতে পারেন নেয়ামতউল্লাহ্। পাকিস্তান এনেছে মুসলিম লীগ, অতএব মুসলিম লীগেরই দাপট এখন চোদ্দই আগস্টের সন্ধ্যাবেলায় বারোঘণ্টা বয়সের এই পাকিস্তানে, আর, সেইসূত্রে জলেশ্বরীতে এখন মুসলিম লীগের নেতা নজির মিয়া! সেই দাপটটাই পাকা করতে নজির মিয়ার আগমন তাঁর কাছে। মাথা ঠান্ডা রেখে, জিন্নাহর আসল ধর্মবিশ্বাসটা মনে মনে রেখেই, ঠান্ডা এক গেলাশ লেবুর শরবত দিয়ে নেয়ামতউল্লাহ্ আপ্যায়ন করেন নজির মিয়াকে। কাদিয়ানি প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যে তিনি আনসার বাহিনীর কথা উত্থাপন করেন আচমকা। – মিস্টার নজির, তারপর স্থানীয় আনসার বাহিনীর খবর কী? কাটিহার-কাউনিয়া রেললাইন ধরে ট্রেনে করে মোহাজেররা আসতে শুরু করবে, তাদের দেখভাল করতে, টাউনে তাদের খোশ আমদেদ করতে, যতদিন তাদের নিজ ব্যবস্থা না হয় ততদিন তাদের রুটি-ডালের কসুর যাতে না হয়, এসব কাজে তো খুব ডিসিপ্লিন্ড অ্যান্ড ডেডিকেটেড আনসার বাহিনী চাই।

দ্রুত এরপর তিনি তোলেন জিন্নাহ ফান্ডের কথা, বলেন, ফালতু কথায় আমার কান নাই, মিস্টার নজির! আপনি কি জানেন না, জিন্নাহ ফান্ড করা দরকার? গরমেন্ট তো এইমাত্র নতুন দেশের চার্জ নিলো, এখন পাকিস্তান, কিন্তু পাকিস্তানের টাকা কোথায়! সব ক্যাশ রিজার্ভ দিল্লিতে, আর দিল্লি এখন হিন্দুস্থানের রাজধানী, হিন্দুর কব্জায়। মিস্টার নেহেরু পাকিস্তানই দিতে চান নাই, পাকিস্তান যদি হয়েছে তো তিনি দেবেন পাকিস্তানকে তার শেয়ারের ন্যায্য টাকা! কক্ষণো না! দেয়ারফোর, পাকিস্তান চালাতে টাকা আমাদের পাবলিককেই জোগাড় করতে হবে। আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে, একথা আপনাকে আমার বুঝিয়ে বলতে হবে? – নজির মিয়া অপ্রস্ত্তত গলায় বলেন, না, তা কেন? আই অ্যাম ফুললি অ্যাওয়ার, স্যার! – নজির মিয়ার মুখে এই প্রথম স্যার সম্বোধন শুনে ভরসা পেলেন নেয়ামতউল্লাহ্ যে, যাক! কাদিয়ানি প্রসঙ্গটা ভালোভাবেই চাপা দেয়া গেছে! নজির মিয়া বলেন, জিন্নাহ ফান্ডের জন্যে আমরা টাউনে চাঁদা তুলতে বের হবো। আপনি সঙ্গে থাকিলে ভালো হয়! বোঝেন তো, হেথায় কংগ্রেসের বড় জোর ছিলো, কমিউনিস্ট পার্টিরও একটা জায়গা ছিলো, তার বাদে সুভাষ বোসের ফরওয়ার্ড ব্লকেরও জোর কম নয় জলেশ্বরীতে।

নেয়ামতউল্লাহ্ সরাসরি রাজি হন না জিন্নাহ ফান্ডের জন্যে শহরবাসীর কাছে চাঁদা তুলতে যেতে। বলেন, আমি গরমেন্টের লোক, আর জিন্নাহ ফান্ড হচ্ছে পাবলিক এন্টারপ্রাইজ, ভলান্টিয়ারলি মানুষকে চাঁদা দিতে হবে। আমি সাবডিভিশনের হাকিম যদি আপনার সঙ্গে যাই তবে লোকেরা মনে করবে দিস ইজ আ গরমেন্ট অর্ডার! নো! আপনারা নিজেরা বেরোন, ফান্ডে যদি কেউ চাঁদা দিতে স্বীকার করে বা কংগ্রেস কি ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা টাউনের মানুষজনকে ভুল বোঝায় বা হাঙ্গামা করে – দেন ইউ লেট মি নো! ইফ নেসেসারি আমি পুলিশি অ্যাকশন নিতেও পিছপা হবো না। আমি ভালো করেই কংগ্রেসওয়ালাদের জানি-চিনি। পাকিস্তানকে বানচাল করতে এখনো তারা অ্যাকটিভ অ্যান্ড আই হ্যাভ দ্য ইনফরমেশন। শোনেননি, দিল্লির এক কংগ্রেস নেতা কী বলেছে? বলেছে, পাকিস্তান এক মাসের মধ্যেই ভেস্তে যাবে! শুনেই শিউরে ওঠেন নজির মিয়া, বারবার বলতে থাকেন, খোদা না খাস্তা! খোদা না খাস্তা! – আর, নেয়ামতউল্লাহ্ দ্বিগুণ আবেগ মাতিয়ে বলেন, খোদা পাকিস্তান কো হেফাজত কর্হে!

একান্তে এখানেই আমরা বলে নিতে পারি যে, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, যিনি পাকিস্তানের গণপরিষদের সাংসদ হয়েছিলেন পূর্ববাংলারই বদন্যতায় পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ববাংলারই একটি আসন সুবাদে, আর সেই লিয়াকত যিনি বলতেন – কেয়া, বাঙালি লোগ মুসলমান নেহি হ্যায়? তো মুসলমানকো জবান উর্দুই হোতা হ্যায়, তব্ বাঙালি কেঁউ                বাংলা-বাংলা করকে চিল্লাত হ্যায়! ইয়ে হিন্দুস্থান কি চাল হ্যায় পাকিস্তান তোড়নে কা! সেই লিয়াকত যখন বাহান্ন সালে রাওয়ালপিন্ডির মাঠে গুলিতে নিহত হন, তখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে তিনি নাকি বলেছিলেন – খোদা পাকিস্তান কো হেফাজত কর্হে!

তা সেই হেফাজতের ব্যাপারেই কোনো বিঘ্ন হলো কিনা কে জানে! দাড়িতে মেহেদি লাগাতে লাগাতে, আর মন্মথ দারোগাকে বিনা নোটিশে ভোরবেলায় হাকিম কোঠায় আসতে দেখে, নেয়ামতউল্লাহ্ একটু চিন্তিত হলেন। গত পরশু দিন থেকে শহরে জিন্নাহ ফান্ডের চাঁদা তুলতে বেরুচ্ছে মুসলিম লীগের নেতারা, গত রাতেও উড়ো একটা খবর এসেছিলো যে কংগ্রেসের স্থানীয় এক নম্বর নেতা রাজেন্দ্রলাল চক্রবর্তী বাজারে বেরিয়ে দোকানদারদের বলেছে – না, চাঁদা দেবেন না। এ-চাঁদা ওই নজির মিয়াদের পকেটে যাবে। তার এ-কথা শুনে মুসলিম লীগের এক ছোকরা নাকি রাজেনবাবুর ঘাড়ের চাদর টেনে তারপর পাকিয়ে তারই গলায় পেঁচিয়ে টান দিয়েছিলো – শালার শালা, পুটকিতে তোর বাঁশ দেমো! এই নিয়ে নাকি বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার মসজিদের নামাজিরা মগরেব নামাজ পড়ে উঠেই এক মিছিল বের করেছিলো – হিন্দুস্থানের দালালেরা হিন্দুস্থানে চলি যাও! পাকিস্তানে থাকিতে হইলে মোছলমান হয়া যাও!

নেয়ামতউল্লাহ্র কাছে অধিক রাতে খবর এসেছিলো, টাউনে দাঙ্গা পরিস্থিতি শুরু হতে পারে। তিনি রাতেই থানায় মন্মথ দারোগাকে সতর্ক থাকতে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। কে জানে, হয়তো সেই কারণেই এত ভোরে মন্মথ দারোগা তাঁর আর্জেন্ট সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এসেছে। (চলবে)