নবনীতা দেবসেন : জীবনতৃষ্ণার বাতায়ন

এই তো সেদিন ছিল সাত তারিখ। মানে ৭ নভেম্বর ২০১৯। আকাশে তেমন মেঘ ছিল না, হয়নি কোনো বৃষ্টি। কিন্তু প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় সবকিছু ল-ভ- করে দিয়ে গেল এক মেঘ। যে-মেঘের কোনো ইঙ্গিত থাকে না, থাকে না কোনো সংকেত কিংবা কোনো পূর্বাভাস। মৃত্যু নামক মেঘের তা-বে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলা সাহিত্যের আকাশ যাঁর তারায় তারায় ভরে উঠেছিল, পূর্ণ করে ছিল পাঠকের হৃদয় Ñ তিনি কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর (অপরাজিতা দেবী) একমাত্র কবিতা নবনীতা দেবসেন (১৩-০১-১৯৩৮ Ñ ০৭-১১-২০১৯)। এই কবিতাই নানা রূপে, নানা চিত্রে, নানা ধ্বনিতে, নানা ছন্দে যে-অপরূপ ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিল তা পাঠকমাত্রই জানেন। নানা রূপে, বর্ণে, গন্ধে ছড়িয়ে আছে তাঁর বহুবিধ পরিচয়। বিশেষ কোনো বিশেষণে তো বাঁধা যায় না তাঁকে। কবি, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, বাচিকশিল্পী, প্রাবন্ধিক, গবেষক, বিশ্বসাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম সমালোচক, বুদ্ধিজীবী, সংগঠক, নারীনেত্রী Ñ যে-নামেই ডাকুন তাঁকে, সে-নামেই তিনি পূর্ণ। তবে নিজের কাছে তাঁর আত্মতৃপ্তি কবি হিসেবেই। নানা মাধ্যমে লিখেছেন তিনি। বহুবিধ পরিচয় তাঁর। কিন্তু কোন পরিচয়ে তিনি আনন্দিত কিংবা পরিতৃপ্ত Ñ এমন প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলেছেন, ‘আমার প্রথম পরিচয় আমি কবি। তারপর আস্তে আস্তে গদ্যের পাড়ায় চলে এসেছি। গদ্যে এসে সব রকম লেখা দিয়েই চেষ্টা করেছি। তবে প্রথমে হাত দিয়ে বেরিয়েছে কবিতা। হয়তো কবি হিসেবে পরিচয় দিলেই খুশি হতে পারি।’ কারণ কবিতা তাঁর আশৈশব সঙ্গী। কবিতাই তাঁর প্রাণভোমরা। কবিতা তাঁর রক্তে, বর্ণে, গন্ধে। তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্তটাই কাব্যময়। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘এক কবির গর্ভে আর আরেক কবির ঔরসে আমার জন্ম। অক্ষরের জগৎটাই যার ভিটেমাটি, ঘরসংসার, সে আর কবিতা লিখবে না কেন। যেমন আমার গাছে-চড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, কাগজের নৌকো গড়া, তেমনি আমার কবিতা লেখা। কবিতা আমার জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সহজ। একা বাড়ির একলা শিশু, কবিতা আমার স্বভাবসঙ্গী। আশৈশব।’ মানুষের জীবনে যেমন নিত্য অপরিহার্য কিছু কর্ম থাকে, তেমনি নবনীতা দেবসেনের কাছে কবিতা তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের একটি নিত্য অংশ। তাঁর জীবন আর কবিতা যেন একে অপরের অঙ্গাঙ্গি। কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর ‘ভাল-বাসা’ নামক বাড়ির একমাত্র ভালোবাসার কবিতা হলো নবনীতা দেবসেন। সেভাবেই কবিতার কাছে নবনীতার আত্মনিবেদন Ñ ‘এই নাও।/ আমি তোমার।/ তুমি রাখলে আছি।/ না রাখলে, নেই।’
কেবল আত্মনিবেদন নয়, সত্যিকার অর্থে কবিতার সঙ্গেই তাঁর বসতি। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য প্রথম প্রত্যয়। সেই প্রথম প্রত্যয় থেকেই কবিতা তাঁর হাত ধরে ছিল। কবিতার পথে তিনি হেঁটেছেন দশকের পর দশক। কিন্তু কবি যখন গদ্যের সভায় গেছেন, তখন একটুও পা টলেনি। বরং গদ্যের সভায় গড়েছেন নিজস্ব আসন। ষাটের দশকের নকশাল আন্দোলনে উত্তাল বাংলা নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর কবিমনকে। সেই পটভূমিতেই নবনীতার প্রথম উপন্যাস আমি অনুপম। কবিতার নরম কলম সরিয়ে তখন যেন গদ্যের ধারালো তলোয়ার। বয়স হলেও প্রতিবাদ করে গেছেন। কয়েক বছর আগে যখন মুক্তমনা সাহিত্যিকদের ওপর হামলা হয়েছে, তখনো তিনি গর্জে উঠেছিলেন।
চিরদিন তাঁর লেখায় সমকালের গন্ধ। জীবনের উদ্যাপন। কবিতার হাত ধরেই তাঁর সাহিত্যিকজীবন শুরু। ১৯৫৯ সালে প্রথম কবিতার বই প্রথম প্রত্যয়তেই কবিতা যেন ছবি এঁকেছিল। হাসতে হাসতেই তৈরি করেছিলেন প্রণয়ের পাহাড় : ‘কেউ বলুক, না বলুক, তুমি সব জানো।/ তা কোথাও পাহাড় আছে/ ছোট কথা, বড় কথা, ছোট দুঃখ, বড় বেদনা/ সব ছাড়িয়ে/ মস্ত এক হাসির পাহাড়/ একদিন সেই পাহাড়ে ঘর বাঁধবো তোমার সঙ্গেই/ লোকে বলুক, না বলুক; তুমি জানো।’ নামি কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর অন্তর্যামী ছিলেন নবনীতা। কবি দম্পতির ‘ভাল-বাসা’র একমাত্র আলো ছিলেন নবনীতা। যতদিন ছিলেন, লিখে গেছেন। লেখাকে কখনো ‘না’ বলেননি। তাঁর জীবন জুড়ে ছিল জীবনের জয়গান। তাঁর লেখায় ছিল জীবনের উদ্যাপন। তাঁর লেখা ছিল বাঙালির ভালোবাসা। তাঁর ‘ভাল-বাসা’র বাড়িটি আজ ফাঁকা; কিন্তু বাঙালির ভালোবাসার বারান্দায় তিনি থাকবেন চিরকাল।

দুই
নবনীতা দেবসেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করেছিলেন। বরং বর্ণাঢ্য বললে প্রকৃত অর্থে একটু কম বলা হয়। নবনীতা যে-জীবন যাপন করেছেন, সে-জীবন দোয়েল কিংবা ফড়িংয়ের নয়, সে-জীবন মানুষের, তবে সব মানুষের নয়। সকল মানুষের প্রত্যাশিত কিংবা কাক্সিক্ষত কিন্তু যাপিত নয়। সে-অর্থে নবনীতা ঈশ্বরের বরপুত্র এবং আক্ষরিক অর্থেই এক ঐশ্বর্যের রানি ছিলেন। তৎকালীন প্রতাপশালী ও নামি কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণীর ‘ভাল-বাসা’র বাড়িতে ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি নবনীতার জন্ম। নবনীতা নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই নামের বিষয়ে একটি ছোট কাহিনি আছে। নবনীতা দেবসেন নিজেই সে-কাহিনি উল্লেখ করেছেন এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন,
নামটা তিনি প্রথমে দিয়েছিলেন আমার মাকে, বাবার সঙ্গে বিবাহের পরে, তিনি নতুন জীবনে আনীতা হলেন, তাই নব-নীতা। কিন্তু মা আঠাশ বছর রাধারাণী নামে পরিচিত থেকে, অনভ্যস্ত নতুন নামটি গ্রহণ করতে পারেননি। সবিনয়ে অক্ষমতা জানিয়েছিলেন কবিকে, আশীর্বাদটুকু নিচ্ছি, নামটি নয়। তার সাত বছর পরে, একটি অভিমানী চিঠি লিখে ‘উত্তরাধিকারসূত্রে’ নবনীতা নাম আমাকে কবি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আশীর্বাদী পাঠিয়েছিলেন। আমি তখন তিন দিনের মেয়ে। এই নাম আমার না চাহিতে পাওয়া ধন।
সোনার চামচ মুখে দিয়ে যাঁদের জন্ম, নবনীতা সেই প্রবাদবাক্যের রানি। তাই তো বন্ধুরা তাঁর প্রতি ঈর্ষায় বলত, ‘তোর জীবনে মাঝামাঝি কিছু নেই। সবই তুমুল, সবই তীব্র। তীব্র সুখ, তুমুল যন্ত্রণা।’ মায়ের কাছেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি। স্কুল গোখেল মেমোরিয়াল। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন। পরে এই যাদবপুরেই তুলনামূলক সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক। সংসারযাপন বাঙালি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে (১৯৫৮-৭৬)। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় ডিস্টিংশনসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন। আর ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি অর্জন। কিন্তু এসব পরিচয় তাঁর কাছে মামুলি। কেবল কবি পরিচয়টিই তাঁর আত্মতৃপ্তিদায়ক। কবি পরিচয়েই তাঁর সকল সুখ। কবিতা লেখাতেই তাঁর অন্দর ও অন্দরের আনন্দ। তাই তিনি লিখেছেন Ñ ‘কোনও দিন কোনও লেখা লিখে মনে হয় না যথেষ্ট ভাল হল। আমি তো প-িত নই। নিজেকে আমার কবি মনে হয়। কবি হওয়ার চেষ্টা আমি করব। যতদিন পারি চেষ্টা করব।’
প্রণম্য ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর বাঙালনামা বইয়ের বরাত দিয়ে বলা যায়, ব্যক্তি আপনাআপনি গুরুত্বপূর্ণ হয় না Ñ ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে হয় নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ব্যক্তির জন্মস্থান, পরিবারের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিম-ল, ব্যক্তির বেড়ে ওঠার নানা প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সম্পর্ক, ব্যক্তির কর্মতৎপরতা, তার চেয়েও বড় কথা রাষ্ট্রের বাঁকবদলেওই ব্যক্তির ভূমিকা Ñ সমস্ত কিছুর সুসমন্বয়েই ব্যক্তি তার জাতি-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেদিক মাথায় রেখে বিবেচনা করলে তপন রায়চৌধুরী-বর্ণিত সমস্ত প্রক্রিয়াই যাঁদের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে বিরাজ করে, নবনীতা দেবসেন তাঁদের অন্যতম। পারিবারিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ‘সোশ্যাল প্রপার্টি’ বলতে যা বোঝায় তা এবং তাঁর নিজের অর্জিত জ্ঞান, জ্ঞানত সম্পর্ক, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পদমর্যাদা ও অবস্থান এবং তাঁর কর্মতৎপরতা কেবল জাতি-রাষ্ট্রের জন্য নয়, বিশ্বজনীন নাগরিক হিসেবেই তাঁকে মহিমান্বিত করে তোলে। খুব কম মানুষের জীবনেই এমন সুযোগ থাকে। সে-কারণে তিনি নিজেকে ‘বড্ড ভাগ্যবতী’ হিসেবেই মনে করেছেন। নামি কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণীর একমাত্র উত্তরাধিকারসূত্রেই আশৈশব লাভ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল রথীমহারথী ও মনীষীর স্নেহ, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র, অমিয়, বিষ্ণু দে, নরেশ গুহসহ কে যে নেই তা বলা মুশকিল। তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন সে-সম্পর্কে :
বাংলা কবিতার পঞ্চাশ বছরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল ষোলো-সতেরো বছর বয়সের মধ্যেই দুটি আশ্চর্য গৃহের কল্যাণে। ‘ভাল-বাসা’ আর ‘কবিতা-ভবন’ আমাকে যে সুযোগ এনে দিয়েছিল, দুর্ভাগা আমি তার কিছুই কাজে লাগাতে পারিনি। মা-বাবার কাছে আসতেন প্রমথ চৌধুরী, প্রিয়ম্বদা দেবী, নজরুল, কুমুদরঞ্জন, কালিদাস রায়, যতীন বাগচী থেকে অচিন্ত্য, প্রেমেন্দ্র, অজিত, বুদ্ধদেব, অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষদা, অমিতাভ চৌধুরী, অরবিন্দ গুহ, আনন্দ বাগচী, শরৎ মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন পর্যন্ত। গদ্য লেখকদের কথা এখানে বলছি না। আর বাদবাকিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে ‘কবিতা-ভবন’-এ Ñ সুধীন্দ্রনাথ, অরুণ সরকার, নরেশ গুহ, তারাপদ, প্রণবেন্দু, দীপক, জ্যোতি। শঙ্কুর (অজিত দত্তের মেজ ছেলে) কাছেই দীপক, প্রণবেন্দুকে প্রথম দেখি। তখন দীপক, অলোকরঞ্জন, আনন্দ বাগচী, অরবিন্দ গুহ তরুণদের মধ্যে প্রধান। শঙ্খদার, সুনীলের, অলোকের, কবিতাদির লেখাও খুব চোখে পড়ছে।
অর্থাৎ সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে শ্রীজাত Ñ কে নেই তাঁর বন্ধু, স্বজন, সতীর্থর তালিকায়! রাজ্যের সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসুও তাঁর আশৈশব পরমজন ও প্রতিবেশী। এ তো কেবল স্বদেশের তালিকা। আর পরবাসেও তিনি বন্ধু, স্বজন, সতীর্থ ও নির্দেশক হিসেবে পেয়েছেন নাদিন গর্ডিমার, হোর্হে লুই বোর্হেস, গ্লোরিয়া নেইলর, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গুন্টার গ্রাস, জ্যাক দেরিদা, জার্মেন গ্রিয়ার, নির্মলপ্রভা বরদলই, উমবের্তো একোসহ বহু কবি-সাহিত্যিক-গবেষক-সমালোচক-তাত্ত্বিককে। আর অন্যদিকে শিক্ষকভাগ্যই কি কম? তিনি লিখেছেন :
যেমন বাবা-মা। তেমনি সব বন্ধু, আর তেমনি সব গুরু পেয়েছি বটে! আমার সৌভাগ্যের তালিকায় একটি প্রধান ঘটনা হল কয়েকজন সত্যিকারের কবিকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে শুদ্ধসত্ব বসু আমাকে যতœ করে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য শেখান। তাঁরই উৎসাহে ‘একক’ পত্রিকায় আমার কবিতা বেরুত। তিনিই আমাকে শ্লোক রচনা করতে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে জন্মদিনে ও বিয়ের তারিখে শ্লোকের পর শ্লোক লিখে আমি বাবা-মা-মামা পপুয়াকে ধন্য করে দিয়েছিলুম কয়েক বছর। এই শিক্ষা পরে নানাভাবে কাজে লেগেছে বাংলা কবিতা লেখায়। বুুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ, নরেশ গুহ, অলোকরঞ্জনের কাছে ইউরোপীয়, ইংরিজি ও বাংলা সাহিত্যের ক্লাস করেছি। একবার অমিয় চক্রবর্তীর কাছেও পড়েছিলাম আমেরিকায়। কবিদের সঙ্গে চাকরি করি। নরেশদা, জগন্নাথবাবু, প্রণবেন্দু, মানবেন্দ্র। জন্ম থেকেই আমার নিয়তি আমাকে কবিদের আয়ত্তের মধ্যে রেখে দিয়েছে। ঘরে মা তো একাই দুজন কবি Ñ রাধারাণী, অপরাজিতা। আমি কবিতা লিখব, এতে আমার কৃতিত্ব কীসের? কৃতিত্ব পরিবেশের।
কবিতা লেখা কি তাহলে কেবল পরিবেশের ব্যাপার? মোটেও নয়। পরিবেশ যদি কবিতা লিখিয়ে নিতে পারত, তো সেই পরিবেশের সবাই তো কবিতা লিখত আর সবাই তো কবি হয়ে যেত। কিন্তু তা তো হয় না। কবির জন্য দরকার কবিমন। নিঃশর্ত এক মন আর নির্মল মনন, যা হয়তো তৈরি করে দেয় পরিবেশ। তাছাড়া ব্যক্তির প্রতিভা ও সাধনা দরকার। একাগ্র সাধনা। আপনা-আপনি তো আর প্রতিভা হাজির হয়ে যায় না। দরকার অনুভবের, দরকার অনুরণনের। কারণ পরক্ষণেই নবনীতা নিজেই বলেছেন যে, ‘এতদসত্ত্বেও একটি কবিতা লিখতে আমার সময় লাগে অনেক। পরিশ্রম হয় প্রচুর। কবিতা কষ্টসাধ্য।’ সেই কষ্টসাধ্য ব্যাপারকে সাধ্যের মধ্যে আনতে, করায়ত্ত করতে দরকার হয় দুর্গম মরু পারাপারের। ব্যক্তি কবিকেও সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করতে হয়। মাঝে মাঝে রোদ্দুরে ঠা-ঠা হয়ে যায় প্রাণ। জীবনে দেখা দেয় মস্ত ফাটল। তবু কবিতাই তাঁকে রক্ষা করে। সকল ক্লান্তির মাঝে আলোর প্রলেপ দিতে পারে কবিতা। নবনীতার তাই ভরসা কবিতা। কবিতা নামক প্রাণভোমরাই তাঁর আশ্রয়। কবি তাই লেখেন, ‘গাছের কি ক্লান্তি আছে? গাছ শুধু আশ্রয় সাজায়।/ তুমিও তরুর মতো, তুমিও তৃণের মতো হও।/ দুঃখ শুধু পুরুষের ক্ষত Ñ/ তুমি তাতে যৌবনের প্রলেপ লাগাও।’

তিন
নবনীতা দেবসেনের বহু পরিচয়। তবে একমাত্র কবিপরিচয় ছাড়া তাঁর কাছে সবই মামুলি। নবনীতার প্রাণ-ভৌগোলিক অস্তিত্বের ঠিকানা কেবলই কবি নবনীতা। আর এই পরিচয়েই যেমন পরিতৃপ্ত, তেমনি নাছোড়। কবিতার জন্যই তাঁর সকল সাধনা। কবিতার জন্য তিনি ছাড়তে পারেন কবিগুরুর কাছ থেকে ‘না চাহিতে পাওয়া ধন’ও। কারণ কবিতাই তাঁর সর্বসত্তা। সর্বময় প্রাণ। তিনি সে-প্রসঙ্গে লিখেছেন,
এক-একটা শব্দ ছোটবেলায় প্রায়ই আমাকে জাদু করে ফেলত। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া হলে কী হবে, নবনীতা নামটা আমার একদম পছন্দ ছিল না। ওতে কোনও ছবিও নেই, বাজনাও বাজে না। স্কুলে যাবার পথে একটা সাইন বোর্ড দেখতুম হাজরার মোড়ে Ñ বীণাপাণি বিপণি। সারাদিনই নামটা কানের মধ্যে গুনগুন করে গানের মতো বাজত। একদিন বুদ্ধি করে আমার সব খাতা-বইয়ের মলাটে পুরনো নাম কেটে দিয়ে, নতুন নাম লিখলুম কুমারী বীণাপাণি বিপণি দেব।
কারণ কবিতায় ছবি আর সুর থাকা অপরিহার্য। কবিতায় সব শব্দ ছবির মতো দেখা যাবে, শব্দগুলো ধ্বনিত হয়ে সুরের সঙ্গে তাল ও লয়ে রূপ পাবে, তবেই তো কবিতা। কারণ কবিতা তো বক্তৃতা নয়, নয় কোনো বিবৃতি; কবিতা হলো ব্যঞ্জনা। তাই তো কবিতার আকাশেই তিনি ভেসে থাকতে চান আজীবন : ‘জলে স্থলে কাজ নেই Ñ/ থাক শুধু তেজ, মরুৎ, ব্যোম।/ মুছে যাক স্তন, কটি, কাঁখ, কুন্তল Ñ/ মুছে যাক হাসি অশ্রুজল/ লুপ্ত হোক তোর জল স্থল Ñ/ আমার আকাশ থাকবেই।’
শিল্পী একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয় না তাঁর সৃষ্টি। এখানেই স্রষ্টার সার্থকতা। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টাও বেঁচে থাকে কালে-কালান্তরে। কবি নবনীতা দেবসেনও মনে করেন পৃথিবীর স্থল-জল, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সবটাই মুছে যাবে; রবে কেবল তাঁর সৃষ্টির আকাশ। মহাকালের বিচারে স্রষ্টার এই সৃষ্টিই রবে চিরকাল। তাই কবির একটাই প্রত্যাশা ‘আমার আকাশ থাকবেই।’ আর সেই আকাশে কবি দেখতে চান জীবনকে, জগৎকে, পরিবেশ-প্রতিবেশকে। তবে, সবচেয়ে বেশি দেখতে চান নিজেকে। কারণ তিনি নিজেই মনে করেন, ‘কবিতা তো দর্পণ, দেখতে জানলে ভাল কবিতায় জীবনের ছবি সম্পূর্ণই খুঁজে পাওয়া যাবে।’ শুধু তাই নয়। তাঁর মনে হয়, ‘কবিতার প্রত্যেকটি লাইনেই কবির পাসপোর্ট সাইজ ফোটোগ্রাফ আঁটা থাকে।’ আর সেই ফটোগ্রাফে সবার আগে কবি নিজেকে দেখতে চান। কবি যখন কবিতার সামনে দাঁড়ান, তখন তাঁর বাহির-অন্দর সমস্তটাই ছবি হয়ে ভেসে ওঠে তাঁরই প্রতিবিম্বে। তাই কবি নবনীতা বলেন, ‘দু’একটা মুখের সামনে দাঁড়াতে পারি না/ মনে হয় মুখ ধোওয়া নেই/ মনে হয় মুখে বুঝি ময়লা লেগে আছে/ কোনো কোনো মুগ্ধ মুখ দর্পণের মত স্বচ্ছ কিনা,/ দেখা যায় স্পষ্টত নিজেকেই Ñ/ নিজের চেয়েও বেশি কাছে।’
নবনীতা ব্যক্তিজীবনে যতটা স্পষ্টবাদী, তার চেয়ে ঢের স্পষ্টভাষী তাঁর কাব্যে। তিনি যেমন গর্জে ওঠেন সমস্ত বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরদ্ধে, তেমনি তাঁর কাব্য কখনো কখনো হয়ে ওঠে ধারালো তলোয়ার। কিন্তু মানুষ এত বেশি মিথ্যা বলে যে, মিথ্যাকেই অনেক সময় সত্য মনে হয়। মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতে হয় সত্য আর মিথ্যার প্রভেদে। তবু মানুষ কিন্তু মুখে বলে ‘সোজাসাপটা’ কথা। যখন মানুষের ভ-ামি প্রকাশ পায়, মুখ আর মুখশ্রী স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন মানুষ সহসাই বলে ওঠে Ñ ‘জীবন এত সোজা নয়।’ কিন্তু আসলেই কি তাই? নবনীতা সেই সোজাসাপটার ভেতর-বাহির খোঁজ করেছেন তাঁর কবিতায়। কবি বলেছেন, ‘আমি সামান্য মানুষ/ আমি কি করে সোজা বলব,/ সোজা চলব? হাঁটতে গেলেই/ ডান পাটা একটু ডাইনে হেলে পড়ে/ বাঁ পা-খানা বাঁয়ে হেলে যায়/ সেই ছেলেবেলা থেকেই/ ঢের চেষ্টা করে দেখেছি মশাই/ কিছুতেই নাকের সোজা হাঁটতে পারিনে।/ একে কি আপনি ভ-ামি বলবেন?/ আমাকে কি বলবেন?/ দুমুখো সাপ?/ দেখুন দাদা/ দুটো জিনিস কেবল সোজাসুজি চলে :/ Ñ আকাশ ফুঁড়ে বিষ্টি,/ Ñ আর চক্ষু ফুঁড়ে জল।/ আর, একখানা কথাই কেবল/ সোজাসুজি বলা যায় :/ Ñ মিথ্যে।’
নবনীতার কবিতার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ছবি ও গান। তাঁর প্রতিটি কবিতাই যেন এক-একটি ছবি। ভেসে ওঠে আমাদের দৃষ্টির সামনে, ভাবিত করে মনকে। আন্দোলিত করে প্রাণকে। আরো সুন্দরভাবে হাজির হয় তাঁর কাব্যের ধ্বনি। আমাদের কানে, মনে, প্রাণে ধ্বনিত হয় এক সুর। সম্মোহিত করে পাঠককে। তাঁর প্রতিটি কবিতার গাঁথুনি এমনই যে, প্রত্যেক শব্দ যেন কথা কয়, ছবি হয়ে ফুটে ওঠে, গান হয়ে ভেসে বেড়ায়। তাঁর কবিতার শব্দ আর ছন্দের মিশেল এমনই অপূর্ব যে, খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় ‘নবনীতার কবিতা’ বলে। নবনীতার কাব্যের বহু মাহাত্ম্যের একটি হলো কবিতায় স্থান ও কাল জীবন্ত থাকে; কিন্তু নির্লিপ্ত নয়। কবি আলাপে শরিক হয়ে কথা বলেন, বিতর্কে লিপ্ত হন, আঘাত করেন। সবটা মিলিয়ে অনায়াসে স্থান ও কালের সীমানা অতিক্রম করে ফেলেন। যে-কোনো স্থান ও কালের সঙ্গে মিলিয়ে নবনীতার কবিতা পড়া যায়। ফলে নবনীতার কবিতায় সমকাল থাকে ঠিক, তবে সে সমকাল চিরকালেরই একটি অনবদ্য রূপ। সমকালের গন্ধ অনায়াসে মুছে দিয়ে স্থান-কালের সীমানা অতিক্রম করার প্রয়াস অনেক কবির মধ্যে পাওয়া যায়; কিন্তু নবনীতার কবিতায় তা হাজির থাকে নবমহিমায়। তাঁর কবিতায় পারস্পরিক আলাপের যে-ঢং তা যে-কোনো কবি থেকে আলাদা। ওই যে বললাম, তাঁর কবিতায় বিতর্কে লিপ্ত থাকার, বিতর্ক জারি রাখার, যুক্তি হাজিরের যে-মুনশিয়ানা তা সম্ভবত বাংলা কবিতায় নবনীতাকে কবি হিসেবে স্বোপার্জিত মুদ্রায় চিহ্নিত করতে দারুণভাবে কাজ করে। শুধু কবিতা নয়, তাঁর গদ্যের ক্ষেত্রেও এ-কথা সমভাবে প্রযোজ্য। নবনীতার শব্দ ও বাক্যের নির্মাণশৈলী এমন যে, তাতে সুর আর ছবি আপনাআপনি এসে যায়। পাঠককে জোর করে তাঁর চিন্তন মস্তিষ্কের খেলায় নিমজ্জিত হতে হয় না। গদ্যের ক্ষেত্রেও নবনীতার কথকীয় ঢং তাঁর গদ্যের মেজাজকে তৈরি করে। পূর্বেই বলেছি, নবনীতার সমস্ত লেখাতেই ছবি আর গান যেন একাকার। এ দুয়ের মিশেল খুব কম লেখকই বজায় রাখতে পারেন। সবচেয়ে দারুণভাবে ফুটে ওঠে তাঁর স্মৃতিমূলক লেখাগুলো। যেমন, নটী নবনীতা বইয়ের একজায়গায় নবনীতা লিখেছেন,
তবে কী জানেন, এখন আর মন মানে না। সারাটা জীবনই তো নানান বিচিত্র রোলে কাটছে। বহির্ভুবনে আমার যে ভূমিকা, তার সঙ্গে আমার অন্তর্লোকের ভূমিকাটির প্রায়ই যোগ থাকে না। কর্মক্ষেত্রে থাকতে হয় মাস্টারের ভূমিকায়, অথচ মনে মনে আজও লাস্ট বেঞ্চিতে বসে কাটাকুটি খেলছি। ঘরে থাকতে হয় মাতৃত্বের মহিমাম-িত ভূমিকায়, অথচ যেই রাস্তায় কাচের বাক্সর গোলাপি বুড়ির চুলের ঘণ্টিটা বেজে ওঠে, কী বাঁদর নাচের ডুগডুগিটা কানে আসে, অমনি আমার মন দৌড়ে চলে যায় পুবের বারান্দায়। বুকের ভেতরে মনে হয় খুবই জরুরি ডাক। যদিও থাকি গাড়ির স্টিয়ারিঙে,
কিন্তু মনে মনে আছি পথচারীর রোলেই। হয়তো কোনওকালেই ‘নটী নবনীতা’ বলে যাত্রার পালা লেখা হবে না, মোহনকুমার-মোহিনীকুমারীরা মাথা ঘামাবেন না আমার নটী জীবনচিত্রণের কঠোর শিল্পশৈলী নিয়ে। কিন্তু গাঁয়ে না মানুক, আপনি লিখতে তো বাধা নেই? অন্যরা যেমন করে না লিখেই লেখক হয়, আমিও তেমনি করেই অভিনেত্রী হয়ে যাব। আগে তৈরি হোক জীবনী, পরে হবে জীবন। এখন ইতিহাস তো রচয়িতার হাতে।
এই উদ্ধৃত অংশটুকু খেয়াল করলেই খানিকটা হদিস পাওয়া যাবে নবনীতার গদ্য সম্পর্কে। তাঁর গদ্যে ছবি আর গান যেমন থাকে, তেমনি থাকে ব্যঙ্গ-কৌতুক আর শ্লেষের ব্যবহার। তাঁর গদ্যের ঢংয়ে শ্লেষ এমনভাবে হাজির থাকে যে তা পাঠককে আঘাত করে, মনকে করে জাগ্রত। গদ্যের শৈলীতে পাঠকমাত্রই অনুভব করেন এক স্বাদ। যাকে আমরা বলি সুস্বাদু গদ্য তার সমস্ত বৈশিষ্ট্যই নবনীতার গদ্যে হাজির থাকে। কিন্তু খেয়াল করার ব্যাপার হলো, তাঁর গদ্য কাব্যিকতায় মোহগ্রস্ত নয়। কবির আবেশে তিনি গদ্য লেখেন না। তিনি গদ্য লেখেন গদ্যকারের মননে। যেমন, নটী নবনীতা বইয়ের আরেক জায়গায় তিনি লিখছেন Ñ ‘অনেকখানি ইচ্ছের সঙ্গে একটুখানি স্মৃতি, অনেকখানি স্বপ্নের মধ্যে এক চামচে সত্য, আমিত্বের এই আলো-আঁধারিতেই তৈরি হয় সেই জরুরি রচনাটি, যা আপনাকে এককথায় আপনি-যা-হতে-চান তা-ই বানিয়ে দিতে পারে।’ গদ্য সম্পর্কে এরকম সুস্বাদু ও শিল্পময় গদ্যভাষ্য বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি চোখে পড়ে না। গদ্যের শিল্পরূপ সম্পর্কে তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল। যেহেতু চিত্র, চলচ্চিত্র এবং সংগীতের ধারণা অতি অল্প বয়সেই তাঁকে ইঁচড়েপাকা করেছে, তাই গদ্যের ভাব, ভাষা ও শিল্পরূপ খুব সহজেই হয়েছে তাঁর হস্তগত। গদ্য ও পদ্যের ফারাক সম্পর্কেও তিনি যে সচেতন তা টের পাওয়া যায় তাঁর এক মন্তব্যে। তিনি লিখেছেন, ‘গদ্যে যা লিখি, পদ্যে তা লিখি না। এটা খুব জরুরি। কবিতায় মানুষ তো তাই লিখবে, যা গদ্যে কিছুতেই লেখা যায় না? যা গদ্যেও লেখা সম্ভব, তা গদ্যেই বেশি গুছিয়ে লেখা সম্ভব, এ আমার বিশ্বাস! কবিতায় ফুটবে কেবল সেই অধরা মাধুরী, যা গদ্যে ধরা দেয় না। যা অনিবার্যভাবে, বিশুদ্ধভাবেই কবিতার।’ অর্থাৎ মনন ও সৃজন, আবিষ্কার ও নির্মাণের ব্যাপারটা নবনীতার কাছে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। আত্মচেতন আর গদ্য ও পদ্য সম্বন্ধে এমন পরিচ্ছন্ন ধারণার কারণেই বোধহয় তাঁর গদ্যের রস যুক্তিগ্রাহ্য কিন্তু আবেদনময়, বিশ্লেষিত কিন্তু প্রাঞ্জল, চিত্র ও রূপময় কিন্তু শ্লেষ ও কৌতুকময়। তাঁর গদ্যের ব্যঙ্গ পাঠকের মনকে তিক্ত নয়, রিক্ত করে। নবনীতার এই গদ্যের শিল্পরূপ খেয়াল করলে মনে হবে তাঁর আত্মজীবনী লেখা দরকার। কেননা, আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে এসব উপাদান কার্যকরভাবে হাজির থাকতে হয়; কিন্তু নবনীতা নারাজ। কারণ শিল্পের সম্যক সত্তা সম্পর্কে তাঁর ধারণা যেমন পরিচ্ছন্ন, তেমনি সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি পরিষ্কার। তাই নবনীতা লিখছেন, ‘আত্মজীবনী লেখার আগে আমারও উচিত ছিল বাগ্দেবীর কাছে একশটি জিহ্বা, একশটি দক্ষিণহস্ত প্রার্থনা করা Ñ যাতে আত্মগুণগাথা প্রচারের যথাযোগ্য কল্পনাশক্তি অর্জন করতে পারি। তা যখন পারিনি, নেহাৎ সংকীর্ণ সত্যি কথা লিখে, এ যাত্রায় ‘নটী নবনীতা’ হওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় ফসকেই গেল।’ নটী নবনীতা হওয়ার সম্ভাবনা ফসকে গেলেও শিল্পী নবনীতা যে এক অপূর্ব মহিমায় চিত্রিত হয়েছেন তাঁর সব গ্রন্থের পাতায় পাতায়, সমস্ত পঙ্ক্তিমালায়। সেই শিল্পের মাধুর্য এমনি যে, তার অতৃপ্তিহীন বাতায়ন তৃষ্ণা বয়ে যেতে ইচ্ছে করে জীবনের পর জীবন।

চার
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-সমালোচক, ভাবুক, লেখক ও দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুবের সমস্ত জীবনের সাধনাই ছিল রবীন্দ্রসৃষ্টির নব নব সৌন্দর্যের অনুসন্ধান। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পাঠের মুগ্ধতায় শিখেছিলেন বাংলা ভাষা। সাধনা করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে নানা রূপে, নানা সৌন্দর্যে উপস্থাপন করেছেন মৃত্যুভাবনাকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভাবনা ছিল কল্পিত; কিন্তু আবু সয়ীদ আইয়ুবের মৃত্যুকে আলিঙ্গন ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও অপূর্ব। আইয়ুবের জীবনসঙ্গী
গৌরী আইয়ুবের বরাত দিয়ে তাঁর পরম বন্ধু আরতি সেন বর্ণনা করেছেন তাঁর মৃত্যুক আলিঙ্গনের সেই মুহূর্তের কথা :
গৌরীর কাছে শুনলাম যে ঠিক কোন মুহূর্তে যে আইয়ুব নিঃশব্দে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন কেউ জানতে পারেনি। সকালবেলা গৌরী তাঁর মুখ ধুইয়ে, চুল আঁচড়ে দিয়ে, রেডিও খুলে দিয়ে পাশের ঘরে একটু এসেছিল। সকালে পৌনে আটটায় রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান আইয়ুব নিয়মিত শুনতেন। সেদিন গান হচ্ছিল : ‘এখনো ঘোর ভাঙ্গে না তোর যে, মেলে না তোর আঁখি Ñ কাঁটার বনে ফুল ফুটেছে দেখিসনে তুই তা কি।’ গৌরী হাসিমুখে ঘরে এসে বলল, ‘শুনছেন, আপনার জন্য কী গান হচ্ছে? এবার চোখ মেলুন’; কিন্তু চোখ আর মেলল না। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল যে গানটা আইয়ুব শুনছিলেন। কাঁটার বনে ফুল ফোটার বার্তা নিয়েই তিনি চলে গেছেন। কী জানি!
এরূপ মৃত্যুর আকাক্সক্ষা অনেকেরই থাকে, কিন্তু পায় কজনে? তবে নবনীতা দেবসেন পেয়েছেন, বলা যেতে পারে, আইয়ুবের চেয়েও সুন্দরভাবে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে যখন তিনি নিজেকে পৃথিবী থেকে শূন্যের বুকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন তাঁর কন্যা রবীন্দ্রসংগীত গাইছিলেন, যাতে তিনি আনন্দের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারেন। নবনীতার মেয়ে নন্দনা দেবসেন বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই মা অসুস্থ ছিলেন। তবে মায়ের মনের জোর খুব বেশি। তা নিয়ে অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। গতকাল মায়ের অক্সিজেন কমে আসছিল, বাইপাফ ও নেবুলাইজার দিচ্ছিলাম আমরা। একসময় দিদি আর আমি গান গাইতে শুরু করলাম। দেখলাম, গান শোনার পর মা’র অক্সিজেন একটু বাড়ছে। মা’র মাথাটা আমার বুকেই ছিল। মা গান শুনতে শুনতেই চলে গেলেন।’ যে-মানুষটি জন্মের পর শুনেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত, আর শৈশবে ছোটখুকুর চোখে ঘুম আনত রাধারাণী দেবীর রবীন্দ্রসংগীত Ñ ‘তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও সে ঘুম আমার রমণীয় Ñ’ কিংবা ‘আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী,’ সেই জন্ম থেকে আমৃত্যু রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে যাঁর বসতি, যাঁর রক্তের শিরায় শিরায় রবীন্দ্রসংগীত, সেই মানুষের মৃত্যুবরণ অপূর্ব হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই তো ‘ভাল-বাসা’র ঘরকে শূন্য করে রবীন্দ্রসংগীত সঙ্গে নিয়েই শেষযাত্রায় নবনীতা। তাহলে কি কবি আগেই প্রস্তুত ছিলেন তাঁর মৃৃত্যুকে নিয়ে? তিনি লিখেছেন, ‘সময় হয়েছে বুঝে হঠাৎ না-বলে/ ট্রেন থেকে নেমে যাবো প্রস্তুতিবিহীন।/ টুপ করে ঝ’রে যাবো প্রতীক্ষায় সবুজ মাটিতে/ শ্বেত শুভ্র আমলকীর ফলের মতন Ñ/ অথবা, কে জানে, হয়তো রক্তারক্তি, বিচ্যুত শিমুলে।’ কবির মৃত্যুকে বরণের যে-আয়োজন, যে-প্রস্তুতি, তাতে সহজেই অনুভব করা যায় তাঁর সৌন্দর্যবোধের ধরন সম্পর্কে। কবির আত্মসৌন্দর্য ও কাব্যসৌন্দর্যের মিশেলে সৃষ্টি হয়েছে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের এক অপরূপ নন্দন। তবে সমস্ত সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও কবির ভয় অন্য খানে। কবিতা তাঁর অন্তরাত্মা, কবিতাই তাঁর অন্তর্যামী। তাই কবির ভয় কবিতা ছাড়া কীভাবে থাকবেন তিনি। কবি লিখেছেন, ‘ভয় করছে। মনে হচ্ছে/ এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো/ শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত/ স্বজন/ এই হাত, এই নাও হাত।’ কবির শেষ মুহূর্তেও ছুঁয়ে ছিল তাঁর স্বজন নয় Ñ পরমজন, তাঁর কবিতা। কারণ কবি কোনো কিছুকেই ভয় পেতেন না। ভয় পেতেন কেবল কবিতাহীন জীবন। কাব্যহীন জীবন কবির কাছে সবচেয়ে বেদনাময়, সবচেয়ে কষ্টদায়ক। তাই তিনি লিখেছিলেন :
আজন্ম একলা ঘরে যে মানুষ, সে একাকিত্বে ভয় পায় না। কিন্তু জানি একদিন বয়স হবে, ব্যাধির প্রতাপ আরও বাড়বে, ক্ষমতা নিবে যাবে, ফাঁকা হয়ে যাবে বৈঠকখানা ঘর। বার্ধক্যেও নিঃসঙ্গতাকেও আমি ভয় করি না, আমার একটাই ভয়, কবিতা যেন আমাকে শেষদিনে পরিত্যাগ না করে। সে নিঃসঙ্গতা পক্ষাঘাতের মতো; সে বড় ভয়ানক হবে। কবিতা আমার নাড়ীর সঙ্গে জড়ানো কবচকুন্তল। কবিতা আমার অভিমান, আমার প্রার্থনা, আমার নিঃসঙ্গতা, আমার সঙ্গ, আমার পূর্ণতা, আমার অতৃপ্তি। কবিতাই সত্য অর্থে সেই ‘বিজন জীবন বিহারী’। জীবনের গহনে যে বিজন জীবন সেখানে যে ছায়াময় অনুভবের গোপন সঞ্চার, তার অনুরণনটুকুও স্বছন্দে ধরে ফেরতে যে পারে সেই পরম ফাঁদের নাম কবিতা।
কবিতাই যাঁর জীবনের সমস্ত অনুরণন, কবিতা যাঁর পূর্ণ-অপূর্ণতার নয়নমণি, কবিতা তাঁকে ছাড়বে কীভাবে। কবিতা তাঁকে ছাড়েনি, তিনি ভয়কে করেছেন জয়। কারণ কবিতা তো তাঁর ‘নাড়ীর সঙ্গে জড়ানো কবচকুন্তল।’ তবু কবি লিখেছেন Ñ ‘জয় নয়, পরাজয় নয়/ বরং হয়েছে মুক্তি/ কী দরকার রণে?/ তুই থাক পিতৃপুরুষের কোলে/ নির্ভার, নিদায় Ñ/ তুই থাক অনন্ত যৌবনে।’ সেই মুক্তিই কবি লাভ করেছিলেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। কবিতাই তাঁকে করেছে পরিতৃপ্ত, কবিতাই দিয়েছে মুক্তি। তিনি সমস্ত ভয়কে তুচ্ছ করতে পারেন কেবল কবিতা ছাড়ার ভয় ছাড়া। কারণ কবিতা তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সকল
বিপদে-আপদে একমাত্র আশ্রয়দাতা কিংবা পরমনির্ভরতার কমল স্থান হলো কবিতা। তিনি নিজেই বলেছেন সে-কথা :
কিন্তু জীবনের উচ্ছ্বাসে কবিতা ভেসে গিয়েছিল। লিখতুম না তা তো নয়, কিন্তু খুব অল্প। সেজন্য দুঃখ ছিল, ছিল কি? ছিল না। ‘একটা জীবন ভাঙতে ভাঙতে অন্য জীবন গড়ছি না কি?’ এতই নেমকহারাম আমি যে, জীবন আর কবিতার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বললে প্রত্যেকবারই বলব Ñ ‘জীবন চাই।’ যদিও বেশ জানি জীবন বিশ্বাসঘাতক, শেষ আশ্রয় কবিতাই। কবিতা ঠকায় না। জোয়ারভাটার শাসন না মেনে জীবন যখন উদ্দাম জলস্তম্ভ হয়ে আমাকে তলিয়ে দিতে এসেছে, তখন তো ছুটে গেছি কবিতারই দালানকোঠায়। আশ্রয় পেয়েছি। বেঁচে গেছি।
তাই কবিতার সঙ্গে কবির কখনো বিশ্বাসভঙ্গ হয়নি। একে অপরের সঙ্গে কখনো করেনি বেইমানি। তাই বিশ্বাসঘাতক মানুষ শুধু নয়, মরণব্যাধি ক্যান্সারও যখন তাঁকে তলিয়ে দিতে এসেছে, তখনো কবিতাকে আশ্রয় করেই কবি হুংকার দিয়েছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ততে এসেও কবি তাই লিখেছেন, ‘আমার কি তালা-ভাঙা দরজার/ অভাব আছে?/ আমার তো/ হৃদকমল থেকে শ্বাসকমল Ñ/ সব দরজাই আধখোলা। তো/ এই কর্কটকমলের এত/ মাতব্বরি কীসের? লাঠিসোঁটা/ একটু বেশি আছে বলে?’
নবনীতা জীবনকে দেখেছেন গভীরভাবে, গভীর থেকে। জীবনের প্রতি তাঁর সুগভীর প্রেম। তাই তো তাঁর সাহিত্য যেন জীবনের উদ্যাপন। সাহিত্যের পথে হেঁটেছেন তিনি আজীবন। সাহিত্য আর জীবন যেন একাকার। সাহিত্যই তাঁর জীবনের সম্বল। লেখাই যেন তাঁর প্রাণশক্তি। প্রিয় সাহিত্যিকের প্রতি আমাদেরও নিবেদন একটি গান। কারণ গানের ভেতর দিয়েই তাঁর বিশ্বপ্রকৃতিতে প্রবেশ ও নিঃশেষ। সেই গানই হোক কবির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার স্মারক। তাঁর কথা স্মরণে আপনাআপনি গুঞ্জরিত হয় রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তিমালা Ñ ‘বাণী মোর নাহি,/ স্তব্ধ হৃদয় বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি॥/ আমি অমাবিভাবরী আলোহারা,/ মেলিয়া অগণ্য তারা/ নিষ্ফল আশায় নিঃশেষ পথ চাহি॥/ তুমি যবে বাজাও বাঁশি সুর আসে ভাসি/ নীরবতার গভীরে বিহ্বল বায়ে/ নিন্দ্রাসমুদ্র পারায়ে।/ তোমার সুরের প্রতিধ্বনি তোমারে দিই ফিরায়ে,/ কে জানে সে কি পশে তব স্বপ্নের তীরে/ বিপুল অন্ধকার বাহি॥’

পাঁচ
নবনীতা ছুটে বেড়িয়েছেন জীবনের এলোমেলো তাগিদে, বাঁচার খুশিতে। তাই তাঁর সাহিত্য মানে জীবনের জয়গান। জীবনের উদ্ভাসণ। জীবন আর শিল্প যেন হাতে হাত রেখে চলেছে। তাঁর রচণায় পাঠক খুঁজে পায় আত্মানুসন্ধানের অবকাশ, আত্ম-অনুশীলনের অবকাশ, আত্ম-অবলোকনের অবকাশ। আর তিনি খুঁজেছেন সহৃদয় হৃদয়সংবেদী পাঠক। কারণ তিনি মনে করেন, লেখা একবার প্রকাশিত হয়ে গেলেই লেখকের আর কোনো প্রভুত্ব থাকে না। তখন সে-লেখা হয়ে যায় পাঠকের সম্পত্তি। আর সেই পাঠকের ভালোবাসাই নবনীতার একমাত্র প্রত্যাশা। তাই তিনি মনে করেন, ‘লিখে ইতিহাস হয়ে যাব এমন আশা করি না। কিন্তু যদি এক মুহূর্তের জন্যেও আরও একজন মানুষের হৃদয়ে গ্রাহ্য হয় আমার লেখা, তাকে মগ্ন করে রাখে, তাতেই আমি ধন্য, কৃত-কৃতার্থ। এইটুকুই আমার লোভ।’ তাঁর কর্ম রবে বাঙালির মনে ও প্রাণে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি যতদিন থাকবে, ততদিন রবে নবনীতা দেবসেন। সাহিত্যের সমগ্র সত্তায় তিনি যে অপূর্ব শিল্প সৃষ্টি করেছেন, সেই শিল্পের মাধুর্য এমনি যে তাঁর অতৃপ্ত তৃষ্ণার বাতায়ন বয়ে যেতে ইচ্ছে করে জীবনের পর জীবন। আর সহৃদয় হৃদয়সংবেদী পাঠকের মনে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তাঁরই কবিতার মতো করে Ñ ‘ঘুমের গভীরে আরো নীল ঘুমে/ নীলতর স্বপ্নের বাগানে/ নক্ষত্রের ভিতর বাড়িতে, লীলাময়/ আগ্নেয় পুষ্পের মধ্যে/ ফণা তোলা বেগুনী হলুদে ঘোর লালে/ কু-লিত তাম্র-শ্যামে/ ধাতব ফুলঝুরি হয়ে/ পৌঁছে গেছ সুস্থির স্বদেশে/ চির নিরাপদ।’

সহায়কপঞ্জি
আরতি সেন (২০০৭), ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব স্মরণে’, আইয়ুব : স্মরণগ্রন্থ, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম-সম্পাদিত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
তপন রায়চৌধুরী (২০১৬), বাঙালনামা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
নবনীতা দেবসেন (১৩৬৬), নবনীতা দেবসেনের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
নবনীতা দেবসেন (২০১৭), নটী নবনীতা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
নবনীতা দেবসেন (২০১৫), ‘চট করে লেখা কিছু মানুষের হৃদয়ে পৌঁছায় না’ (সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আহমাদ মাযহার), শিল্পসাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলো, সম্পাদক : মতিউর রহমান, ২৭ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার; ঢাকা।
সুদেষ্ণা বসু (২০১২), সাক্ষাৎকার : নবনীতা দেবসেন, বইয়ের দেশ, সম্পাদক : হর্ষ দত্ত, জুলাই-সেপ্টেম্বর, বর্ষ ৮, সংখ্যা ৩, কলকাতা।