মাওলা প্রিন্স কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, স¤পাদক, অধ্যাপক। নজরুল-জীবনানন্দসহ আধুনিক সাহিত্যপাঠে তাঁর আগ্রহ প্রবল। নিজ লেখায়, বিশেষ করে আবার বছর কুড়ি পর কাব্যে জীবনানন্দ দাশের খানিকটা ভাব-প্রভাব দৃষ্ট হয়। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় স্পষ্ট হয় যে, প্রিন্সের কবিতায় ভিন্ন সুর ও স্বর আছে, যা তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম। ইতোপূর্বে প্রকাশিত তাঁর নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ (২০১৩), দিবারাত্রির প্রেমকাব্য (২০১৪) এবং সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী (২০১৯) কাব্যসমূহের নিরিখে বলতে হয়, কবি মাওলা প্রিন্স ক্রমশ প্রচলিত ও নিজস্ব লেখনরীতি ভেঙে নতুন করে তা সাজাচ্ছেন। তাঁর আবার বছর কুড়ি পর কাব্যগ্রন্থটি সে-সত্যের উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
এই গ্রন্থের কবিতাসংখ্যা চল্লিশ। প্রতিটি কবিতা নয় পঙ্ক্তির। রচনাকাল ২৮শে অক্টোবর থেকে ৬ই ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ – মাত্র এক মাস আটদিন। জীবনের চিরন্তন অনুভূতি-উপলব্ধিকে সীমিত পরিসরে অপূর্ব কাব্যকলায় বেঁধেছেন মাওলা প্রিন্স। অনিবার্য আকর্ষণে একটানা পড়ে ফেলা যায় কবিতাগুলি। পড়তে গিয়ে কবির অনুভব, পাঠকের হয়ে ধরা দেয়। এখানেই কবির সাফল্য নিশ্চিত। আজকের সময়-সমাজ-প্রকৃতি-মানুষ – কুড়ি বা কুড়ি কুড়ি বছর পর কী ভাবে প্রভাবিত হয়; হতে পারে – তারই কাব্যরূপ আবার বছর কুড়ি পর। এখানে কবিজীবন, তাঁর পারিবারিক জীবনের প্রচ্ছন্ন ছায়া আছে, আছে সামগ্রিক মানবজীবনের রূপ-রূপান্তর। সেইসঙ্গে দেশচিত্র, ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী জায়গা – রামসাগর, সেন্টমার্টিন, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, আঙুরপোতা, দহগ্রাম, তিনবিঘা করিডোর স্থান নিয়েছে কবিতার প্রয়োজনে।
রূপ-সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আসক্তি চিরকালীন। নারীর রূপে কবি মুগ্ধ। কবি মাওলা প্রিন্স রূপের তুলনা প্রকাশে অপরূপ। যেমন – ‘রূপ তার সরস্বতীর আদল’ (‘পাতা ছিলো ছেঁড়া’), ‘চন্দ্রভানের মতো রূপ তার’ (‘সবুজ সরস্বতী’), ‘মুঠোপদ্মর মতো রূপ তার’ (‘ঘামের ঘ্রাণ’) কিংবা ‘হৈমন্তির মতো গড়ন -’ (‘অপভ্রংশমালা’) কবিতার ভাবপ্রকাশ কিংবা উপমা-প্রতীকের প্রয়োজনে অনেক কবিতায় চেনাজানা মহৎ ব্যক্তি বা গল্প, উপন্যাস, কবিতার চরিত্র এসেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভালোবাসার ধারক হিসেবে। যেমন : বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, শকুন্তলা, মহুয়া, শৈবলিনী, হৈমন্তী, সুভা, সুরবালা, পার্বতী, বিলাসী, তিশনা প্রমুখ।
ভালোবাসা বা ভালোলাগার সুখময় স্মৃতি বছর কুড়ি পর অম্লান আছে কিংবা বিবর্ণ হয়েছে – পরিণতির দুটো ক্ষেত্রেই পাঠকের কৌতূহল ধরে রাখে। মাওলা প্রিন্স সদর্থক চেতনার লালক। তাই তিনি ‘যদি আবার’ কবিতায় বলেন :
শেষ হবে না আতুমির গল্প।
কুড়ি কিংবা
কুড়ি কুড়ি বছর পর
হলো দেখা হয় যদি আবার
বিষণ্ন চোখে চেয়ো না
হাসিমুখে বলো কথা;
ব্যথাগুলো গোপনে বুনে দিও সমতলে
সেখানে গাছ হবে;
নারাঙ্গি বনে কাঁপবে সবুজ পাতা –
মাওলা প্রিন্সের কবিতায় চোখ ও চুল বিশেষ অনুষঙ্গ রূপে উদ্ভাসিত। এছাড়াও তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, নক্ষত্র, চাঁদ, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, শিশির, পাখি, প্রজাপতি, কার্তিক, পৌষ, হেমন্ত প্রভৃতি স্থান পায় নিপুণ অনুভবে, দক্ষ প্রয়োগশৈলীতে। যেমন :
কুড়ি কুড়ি বছর পর পুনরায় দেখা
বনশ্রীর পথে;
নাম তার মনে নাই
নক্ষত্রের মতো ক্ষয়ে গেছে
রাতের ভেতর;
কার্তিকের হিমে পার্বতীর চোখ ওমের পাহাড় – (‘নক্ষত্রের মতো’)
গ্রন্থভুক্ত প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই উপমা-রূপকের চিত্রকল্প আছে। দু-চারটি একেবারে নতুন, পাঠককে চমকে দেওয়ার মতো। একটা নমুনা, ‘স্তন তার সবুজ নারিকেলের পাতা।’ (‘আগুন জ্বলে’) আরেকটা নমুনা হতে পারে, ‘মাদুলি হাতে বিলাসী মিশে শিসে-বিষে -’ (‘সোনার মুদ্রা’)। মাওলা প্রিন্সের কবিতায় শারীরিক রূপ-সৌন্দর্য আছে; নেই কামজ লালসা। প্রতিটি কবিতা অতি ছোট। একই মাপ – নয় চরণ। কিন্তু ভাব-বিষয় অনেক বড় – গভীর জীবনদর্শনসম্পৃক্ত। মাওলা প্রিন্স এখানে অতীতস্মৃতিবিধুর। মানুষ, মনুষ্যত্ব, প্রেমপ্রীতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবনের পুনরাবৃত্তি আবার বছর কুড়ি পর কাব্যকে করেছে সমৃদ্ধ এবং নবমাত্রিকতায় ভাস্বর।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.