জাহিদ মুস্তাফা
ছবি আকায় নিসর্গ সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত বিষয়। শিল্পীরাই পছন্দ করেন নিসর্গ নিয়ে আকতে। উদার প্রকৃতির বিস্তৃত ভুবন, সৌন্দর্যের সহস্র পর্দার রহস্যময়তা সৃজনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন প্রায় সব চিত্রকর। সুদূর কানাডায় বসবাসকারী শিল্পী আলমগীর হক প্রকৃতি নিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব করে নিজের চিত্রপট সাজিয়েছেন। ‘অনুভবে নিসর্গ’ শীর্ষক একক ছাপচিত্রের এ-প্রদর্শনী হয়ে গেল ঢাকার ধানমন্ডিতে বেঙ্গল শিল্পালয়ে। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে এ-প্রদর্শনী চলেছে ৬ মার্চ পর্যন্ত।
আলমগীর হক সত্তরের দশকের চিত্রশিল্পী। জন্ম তাঁর ঢাকায় ১৯৫৩ সালে। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন চারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৭৯ সালে ভারতের বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দেশ-বিদেশে তাঁর একক প্রদর্শনীর সংখ্যা পনেরোটি। এছাড়া প্রচুর যৌথ ও দলীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তাঁর অংশগ্রহণ আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। ২০০০ সালে কানাডার সাসকাচুয়ান আর্টস বোর্ড প্রদত্ত ইনডিভিজুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স গ্র্যান্ট এবং ১৯৯৫ সালে স্পেনের বার্সেলোনায় যিনি প্রিন্টস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
এচিং ও অ্যাকুয়াটিন্ট ছাপচিত্র মাধ্যমকে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে অধিকমাত্রায় প্রচলন ঘটাতে আলমগীর হকের প্রচেষ্টা। আমরা লক্ষ করে আসছি সেই আশির দশক থেকেই। আশির দশকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে তাঁরই পরিচালনায় আগ্রহী তরুণ ও নবীন শিল্পীদের নিয়ে বেশকটি ছাপচিত্র কর্মশালা হয়েছে। এরকম একটি কর্মশালায় আমিও ছিলাম একজন প্রশিক্ষণার্থী। তখন দেখেছি – তাম্রতক্ষণের কলাকৌশলে, ছাপচিত্র-জ্ঞানে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কুশলী। দেশে থাকতেই তিনি শিল্পবোদ্ধাদের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো, আলমগীর হক পড়েছেন পেইন্টিং নিয়ে, তবে তাঁর মূল ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে ছাপচিত্র। ছাত্রাবস্থা থেকেই। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি চারুকলায় শ্রেষ্ঠ প্রিন্টমেকারস পুরস্কৃত হন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৮ সালে তিনি প্রিন্ট সোসাইটি অফ পোল্যান্ডের ডাইরেক্টরি অফ প্রিন্টমেকারসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সম্মান অর্জন করেন। ১৯৯০ সাল থেকে আলমগীর হক কানাডায় বসবাস করছেন।
প্রবাসে শিল্পী ছাপচিত্রের করণকৌশল নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের কাজের একটি গতিপথ নির্মাণ করেছেন। এসিডের বদলে প্রকৃতিবান্ধব কৌশল হিসেবে লবণ প্রয়োগ করে এচিং নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন শিল্পী। তাঁর এই টেকনিক শিখিয়েছেন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্ট স্টুডিওর প্রথম কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের।
‘অনুভবে নিসর্গ’ প্রদর্শনীতে শিল্পী-কৃত ছাপচিত্রের সংখ্যা ছিল ঊনষাটটি। এ-কাজগুলোয় প্রকৃতির নানা রূপবৈচিত্র্য শিল্পী তুলে ধরেছেন। বিদেশে অবস্থানের ফলে – নানা দেশের শিল্প ও শিল্পীকে প্রত্যক্ষ করে তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও বোধের মধ্য দিয়ে যে আন্তর্জাতিকতার বিস্তার ঘটেছে তার অনুরণন আমরা পেয়ে যাই আলমগীর হকের ছাপচিত্রে। তাঁর এসব ছাপচিত্র দেখে অনুভব করি তাঁর সৃজন গহন ও বৈচিত্র্যসঞ্চারী। নিসর্গের কত ফর্ম-রং-রেখার বিবরণ বিধৃত সেখানে। তবে তা বদলে বদলে যায় সময়ের সঙ্গে, আলোছায়ার তারতম্যের মতো। নিসর্গের বিমূর্তায়ন তাঁর সৃজনকে আরো গহন, আরো গভীর করেছে। সৃজনের জন্য তাঁর উন্মুখতা, প্রকৃতির ভেতরকার সৌন্দর্য অবলোকনের তৃষ্ণা আমরা প্রত্যক্ষ করি চিত্রপটে।
এচিং ও অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে ১৯৯৫ সালে আকা ‘ফর্মের বিষয় ও বর্ণ-৮’ শীর্ষক চিত্রকর্ম শিল্পীর একটি অসামান্য কাজ। জ্যামিতিক ফর্মের আয়োজন ও বর্ণের চমৎকার প্রয়োগে আলোছায়ার চমৎকারিত্বে দারুণ দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে এটি। ৯০ গুণিতক ৬১ সেন্টিমিটার পরিমাপের কাগজে ৭৬ গুণিতক ৪৬ সেন্টিমিটার ছাপ। ছাপের ফাঁকে ফাঁকে সাদা কাগজের রেখা যেন আলো-হাওয়ার দ্যোতনা আনে দর্শক মনে। বেগুনি রঙের ওপর কালো, সবুজ রঙের ছাপ ও টেক্সচার মিলে যে সৌন্দর্য নির্মাণ করে তা আরো বিকশিত হয়েছে হলুদাভ ও সবুজাভ জানালা ও দরজার আহবানে।
আরেকটি এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট ছাপচিত্র – শিরোনাম ‘প্রিন্ট-দশ’ – বর্ষণের আগের ঘোরতর কালো আকাশের বুকে ছাইরঙা মেঘের মতো মৃদু আলোর উৎসারণ যেন। টার্কিশ ব্লু বর্ণের চোখ-সওয়া রঙের পরিপ্রেক্ষিতে গড়েছেন – ‘রিফ্লেকেটেড ইমেজ’। মধ্যবর্তী দরজার ধূসরতার দুপাশে ডানামেলা যোগ চিহ্ন যেন সৌন্দর্যে অবগাহনের আহবান জানাচ্ছে।
১৯৯৫ সালের আরেকটি প্রিন্ট – যার মাধ্যম জলহীন লিথো। শিল্পী এর চারপাশে যেন রোলার দিয়ে জায়গা করে, ঠিক মাঝখানে ওই প্রিন্ট আম্বার বর্ণের হালকা টোনে কিছু ইমেজ আরোপ করায় কাজটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘নীল ও নীলাভ’ সবুজ নামে আরেকটি লিথো ছাপচিত্রে দুটি বর্ণের টোনাল ইমেজ এবং কম্পোজিশনের সহজতার মজাটা পাওয়া যায়। দুটি কাজই ১৯৯৫ সালে করা।
শিরোনামহীন কয়েকটি ল্যান্ডস্কেপ করেছেন শিল্পী আলমগীর হক সাম্প্রতিককালে। এগুলোও জলহীন লিথো ছাপচিত্র। জমির জ্যামিতিক বিন্যাস রেখে, তার ওপর বৃক্ষ কিংবা পাতার কিছু ইফেক্ট এনেছেন। একধরনের স্বাচ্ছন্দ্য আছে তাঁর এসব কাজে, যা দেখে মনে হয় শিল্পী তাঁর চিত্রপটের সীমানাকে যুক্ত করতে চাইছেন। আমেরিকান পপ আর্টের বর্ণলেপনের ধরনটা কোনো কোনো লিথো ছাপচিত্রে পাওয়া যায়। যেমন – শিরোনামহীন ‘ল্যান্ডস্কেপ ১৭’ শীর্ষক ছাপচিত্রটিতে লাল, কালো, নীল বর্ণের উচ্ছ্বাসটা তদ্রূপ।
সতেরো-আঠারো বছর আগের ছাপচিত্রগুলোর ধরন একরকম। ফর্ম ও জ্যামিতিক বিশ্লেষণে সেগুলো নিয়ম মেনে আয়োজন করা যেন। এমন কাজ দেখার জন্য আগে থেকেই তৈরি আমাদের চোখ। কিন্তু সর্বশেষ কাজগুলো যেন বন্ধনহীন, বলগাহারা, মুক্ত। যেন বহুকালের আদল ভেঙে মুক্তবাতাসে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার মতো স্বতঃস্ফূর্ততা এসব ছাপচিত্রকলায়। পেইন্টিংয়ের গুণাবলি তিনি তুলে এনেছেন নিজের ছাপাই ছবিতে। নিসর্গের ভেতর বাড়ির সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে অর্জিত তার রূপ-রস-রং তিনি তুলে ধরেছেন নিজের চিত্রপটে। ফলে বিমূর্ত রীতিতেও প্রকৃতির ভিতরকার প্রাণসঞ্চারী আবেদন সার্থকভাবে ফুটে ওঠে আলমগীর হকের চিত্রকর্মে। খুব সূক্ষ্মভাবে এসব অনুষঙ্গ পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর কাজে। আর দীর্ঘকালের প্রবাসজীবনে তাঁর মনে যে আন্তর্জাতিকতা বোধের সৃষ্টি করেছে তা দিনকে দিন ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। নিজের বোধ আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে বহু সংস্কৃতির শিল্প অভিঘাত মিলে আলমগীর হক ছাপচিত্রী হিসেবে অনেকটাই পরিণত হয়েছেন, পরিশীলিত হয়েছেন। এসব বিবেচনায় বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজিত এ-প্রদর্শনীটি হয়ে উঠেছে তাৎপর্যময়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.