নেপথ্যের আড় ও প্রত্যয়ী নন্দনের বর্ম

আবাল্য হেডিং পড়া থেকে দৈনিক সংবাদের পাঠক হয়ে ওঠায় আমার নিজস্ব কোনো দায় নেই। বাবা সংবাদের পাঠক, একমাত্র সংবাদই পড়তেন, একেবারে নিরুপায় না-হলে অন্য কাগজে তাঁকে কখনো চোখ দিতে দেখিনি। আমাদের শহরে জাতীয় দৈনিকগুলো পৌঁছতে বিকেল প্রায় সন্ধেয় হেলে যেত। ততক্ষণে রেডিয়োয় বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার ও আকাশবাণীর প্রচারে সিপাহসলার এরশাদ-সংক্রান্ত গতকালের প্রধান খবরগুলো বড়োদের জানা। খেলার খবর তো সবখানেই এক, তাই তাও আমাদের জানা।

কাজ থেকে ফিরে বাবা সংবাদ চোখের সামনে নিয়ে বসতেন। প্রধান খবরগুলো পড়ার পরে বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা, গাছপাথরের সময় বহিয়া যায় আর সন্তোষ গুপ্তের কলামে তাঁর চোখ যেতে যেতে সন্ধে উতরে যেত। খেলার খবর আমাদের যেটুকু যা পড়ার ও খেলোয়াড়দের ছবি দেখার তা এর মধ্যে শেষ করে ক্লাসের বইপত্র নিয়ে বসেছি। বারো পৃষ্ঠার খবরের কাগজ সংবাদ। লেটার টাইপে ছাপা। শুধু বৃহস্পতিবারে মূল কাগজের সঙ্গে আসত আলাদা আরো চার পৃষ্ঠা। সেটি হাতের কাছে না-পেলে বাবা বলতেন, আজকের সাপ্লিমেন্টটা কোথায়? ওই চার পৃষ্ঠার সাপ্লিমেন্টের প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে লেখা থাকত ‘সংবাদ সাময়িকী’। কোনো সপ্তাহে প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে ডানদিকে, কখনো বাঁয়ে। অনেকদিন পর্যন্ত আমি ‘সংবাদ সাময়িকী’ অর্থ সাপ্লিমেন্টই মনে করতাম। ওটা যে সাহিত্যপাতা সবে হাইস্কুলে ওঠার কালে তা বোঝার বয়েস হয়নি। আভিধানিক অর্থে সাপ্লিমেন্ট কথাটা ঠিকই বলতেন বাবা, তাঁর কাছে ওটা সাহিত্যপাতা নয়, সাহিত্যের নিয়মিত পাঠক তিনি কখনো ছিলেন না। ‘সংবাদ সাময়িকী’র তৃতীয় পৃষ্ঠায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হতো, সেটি তাঁকে পড়তে দেখেছি আগ্রহ নিয়ে, কখনো অন্য লেখাও তিনি পড়েছেন। মনে আছে ‘প্রাবৃট’ শিরোনামের একটি লেখায় তাঁর কলমের লাল কালির দাগ; কোনো লেখা পড়ার সময়ে আন্ডারলাইনও করতেন। কয়েক বছর বাদে আর-একটি লেখার কোনায়ও বড়ো করে লালকালির টিক চিহ্ন দিয়েছিলেন কয়েকবার, শামসুর রাহমানের ‘শুধাংসু যাবে না’ কবিতাটিতে। তবে রবীন্দ্র-নজরুল সংখ্যা আর ছাব্বিশে মার্চ-ষোলোই ডিসেম্বর ও একুশে ফেব্রুয়ারির আট পৃষ্ঠার সংখ্যাগুলো তাঁর বাড়তি মনোযোগ পেত।

এ-সময়েই আবুল হাসনাত-সম্পাদিত ‘সংবাদ সাময়িকী’র সঙ্গে বাবার কারণে আমার এক দূরবর্তী সংযোগ ঘটে। একটি কারণে আবুল হাসনাতের ওপরে ওই বয়সের স্বাভাবিক বিরক্তিও জন্মেছিল। একবার রবীন্দ্রসংখ্যায় জয়নুল আবেদিনের আঁকা রবীন্দ্রনাথের স্কেচ ছাপা হয়েছে। বাবা নিজে দেখেছেন। নিশ্চয়ই তাঁর খুবই মনে ধরেছে সেই আঁকা। ঘরের দেয়ালে ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধিয়ে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের ফটোগ্রাফের সঙ্গে এই আঁকার কোনো মিল নেই। সংবাদের নিউজপ্রিন্টে শিল্পাচার্যের আঁকা ছবিখানা যে খুব ফুটেছে, তাও নয়। কিন্তু শুক্রবার সকালে সেটি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখালেন বাবা। নিজের মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, তোলা ফটোর বাইরে এভাবেও আঁকা যায় তাঁর ভাষায় কবিগুরুর মুখ। সেদিন কী যে বুঝেছিলাম তা আজো আমার কাছে অজ্ঞাত।

তবে সবচেয়ে বড়ো যে-বিপত্তিটা বেধেছিল যা থেকে সেই নিজস্ব বিরক্তি, তাও কোনো-একটি রবীন্দ্রসংখ্যারই জন্যে। সিক্স অথবা সেভেনে পড়ি। সে-বছরের পঁচিশে বৈশাখের (বাইশে শ্রাবণও হতে পারে) ‘সংবাদ সাময়িকী’তে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে ‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হ’তে…। শেষ দু-পঙ্ক্তি ‘মস্তক তুলতে দাও অনন্ত আকাশে/ উদার আলোক মাঝে উন্মুক্ত বাতাসে।’-এর নিচে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরের পাশে খুব ছোট টাইপে লেখা, নৈবেদ্যের একটি কবিতা। কদিন বাদে কবিতাটা বাবা ফটোকপি করে নিয়ে এসেছেন। তারপরে নির্দেশ, কোনো দোকানে গিয়ে এটি বাঁধিয়ে আনতে হবে। আনলাম। তখনো জানি না, কী ঘটতে চলেছে। বললেন, হাতের লেখার ছাঁচ হতে হবে এমন, অক্ষরগুলোর গতি ডান দিকে, এতে খুব দ্রুত লেখা যাবে। ফলে সেই থেকে ‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হ’তে, হে মঙ্গলময়,/ দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়, এই কবিতার বাঁধানো ফটোখানা সামনে রেখে চলল আমার হাতের লেখার নিজস্ব প্রশিক্ষণ।

সুদূর দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা (গায়ে দগদগে মহকুমার গন্ধ) শহরবাসী সিক্স-সেভেনে পড়া একজন ছাত্রের সেই আকৈশোর সংবাদের বিষ্যুদবারের সাপ্লিমেন্ট অথবা ‘সংবাদ সাময়িকী’র সঙ্গে সরাসারি সংযোগ। সেই সংযোগের একদিকে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, অন্য প্রান্তে আবুল হাসনাত, বাকি দু-দিকে বাবা আর আমি। অদৃশ্য এক চতুর্ভুজের চার বাহু। আমার হস্তাক্ষর প্রশিক্ষণের রাগ তো আর রবীন্দ্রনাথের ওপর পড়ার কোনো সুযোগ নেই, বাবাও তো ভালো কথাই বলেছেন কী অসাধারণ হাতের লেখা ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর,-এর কবির, তাঁর উদ্দেশে আর কী বলা যায়, যত ক্ষোভ তখন সংবাদের ওই পাতার ওপর। অর্থাৎ, সেই মানুষটি যিনি ওটা ছাপিয়েছেন। তিনি আমার অপরিচিত আহমেদুল কবির নন; নন সন্তোষ গুপ্ত, বৈহাসিক কিংবা গাছপাথর। একেবারে অন্য একজন। যিনি ওই  সাপ্লিমেন্টটা সম্পাদনা করেন, নাম না-জানা আবুল হাসনাত।

ফলে কোনো কিশোর যেমন খেদ প্রকাশ করে, অংক যে আবিষ্কার করেছিল, তারে একবার পাইলে? আমার ভিতরে অতটা ক্ষোভ না-থাকলেও অনিচ্ছায় কিছু ক্ষোভ তো দানা বেঁধেছিল। ক্ষোভও তো একপ্রকার সংযোগ। বারো-তেরো বছর বয়সে জয়নুলের আঁকা রবীন্দ্রনাথ দেখার সেই অবুঝ মুগ্ধতা (!) আর নৈবেদ্যর বিখ্যাত কবিতাটির প্রতিলিপি সামনে রেখে বাংলা লেখার চেষ্টায় বিক্ষুব্ধ সংযোগে অনেক দূর থেকে যুক্ত হন আবুল হাসনাত। সেই আমার নিজেরই অজানিতে আবুল হাসনাতের সঙ্গে সংযুক্তি।

কিন্তু এতে ‘সংবাদ সাময়িকী’র সঙ্গে আমার বাড়তি আর কোনো যুক্ততা রচিত হয়নি তখন। কোনো কারণও নেই। পড়িনি সেখানের কোনো লেখা। একেবারে অবশ্য পাঠ্য, বাবা পড়তে বলেছেন এমন না-হলে। কিন্তু সেই আদেশের ফাঁক গলে একসময়ে হৃৎকলমের টানে আর কখনো অলস দিনের হাওয়া (বুঝি বা না-বুঝি) কিংবা কোনো গল্প সাহিত্যপাঠকের আগ্রহেই পড়তে শুরু করি। হয়তো এর কারণ সংবাদপাঠকের উত্তরাধিকার হিসেবে ওই ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না। হতে পারে, বুঝে গেছি এখানেই ছাপা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা। কিন্তু যার বেশির ভাগেই কামড় বসানোর মতো দাঁত আমার গজায়নি। তবু ধীরে ধীরে ওই চারটি পৃষ্ঠার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে দন্তশক্তিও খানিকটা বিকাশমান। এইসমস্ত পড়ার আগ্রহ থেকে দুই-এক ছত্র গদ্যলেখার চেষ্টা শুরু করেছি। তা স্থানীয় সাপ্তাহিকে ছাপাও হয়। এ সময়ে হৃৎকলমের টানেতে সৈয়দ শামসুল হক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রূপমে পুনর্মুদ্রিত ‘সংশয়ের পক্ষে’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধের অন্তর্গত বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘ভিন্নমত অন্যস্বর’ কলামে জবাবও দিলেন। এর পরে শওকত ওসমানসহ আরো কেউ ওই প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আমিও নিজস্ব অর্বাচীন ধারণায় কিছু না বুঝে দুখানা চিঠি লিখলাম। একখানা ‘সংবাদ সাময়িকী’তে, অন্যটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। যা ঘটার তা-ই ঘটল। ‘সংবাদ সাময়িকী’তে সে চিঠি ছাপা হলো না, হওয়ার যোগ্যও ছিল না তা। ওদিকে সবেপড়া চিলেকোঠার সেপাইয়ের লেখকও উত্তর দিলেন না। তাঁর ঠিকানাটা পেয়েছিলাম ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত ওই প্রতিক্রিয়ার নিচে। তবে এর কিছু পরে সংবাদে আমার একটি দীর্ঘ চিঠি ছাপা হয়েছিল, বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধ শিরোনামের একটি সংবাদের সম্পূরক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায়, চিঠিপত্র যেখানে ছাপা হয় সেখানে আর খেলাঘরে বেরিয়েছিল একটি গল্প। ‘সংবাদ সাময়িকী’তে কোনো লেখা পাঠানোর সাহস ও শক্তি কোনোটাই আমি অর্জন করিনি। তখনো বাংলাদেশে জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা বলতে আমি ‘সংবাদ সাময়িকী’ই বুঝি, সেটি বাবার কাছ থেকে পাওয়া ওয়ারিশ!

এরপরে ঢাকায় এসে রূপম ও মাটিতে আমার গল্প প্রকাশিত হওয়ার পরেও ‘সংবাদ সাময়িকী’তে গল্প পাঠানোর সাহস কোনোভাবেই জড়ো করতে পারি না। কারণ ওই আবাল্য সংবাদের সাহিত্যপাতা সম্পর্কে নিজের ভিতরে দৃঢ় হয়ে থাকা এর মান। ‘সংবাদ সামায়িকী’তে তখন নিয়মিত গল্প প্রকাশিত হয় রেজাউর রহমান, মঞ্জু সরকার, সুশান্ত মজুমদার, মঈনুল আহসান সাবেরের। প্রবন্ধ লেখেন আহমদ রফিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, হায়াৎ মামুদ, সনৎকুমার সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মফিদুল হক। নিয়মিত গ্রন্থসমালোচক সন্তোষ গুপ্ত। কবিতায় প্রধান কবিরা প্রায় সকলেই উপস্থিত। হৃৎকলমের টানে ও অলস দিনের হাওয়া নামে সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক কলাম লেখেন সৈয়দ শামসুল হক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সৈয়দ হকের বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণও ধারাবাহিক বেরিয়েছে আগে। ধারাবাহিক গল্প বেরোয় বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সমুদ্রচর ও বিদ্রোহীরা’। অনিয়মিত কলাম নিরাবেগ বোঝাপড়া লিখেছেন কায়েস আহমেদ, তাঁর গল্পও অনিয়মিত। নাসরীন জাহান, শাহীন আখতার কিংবা নাফিজ আশরাফ, হামিদ কায়সারের গল্প পড়ি। সেখানে আমার গল্প পাঠানোর ইচ্ছে আর আগ্রহের কথা একমাত্র বলতে পারি সুশান্ত মজুমদারকেই। তিনি বলেন, নয়াপল্টনে হাউজ বিল্ডিংয়ের কাছে একদিন সংবাদ অফিসে গিয়ে হাসনাতভাইকে একটা গল্প দিয়ে এসো। সুশান্তদা সংবাদের ঠিকানাও বলেন, সঙ্গে জানান, এরচেয়ে ডাকে পাঠিয়ে দাও। হাসনাতভাই কিন্তু তেমন কথা বলেন না।

সুশান্ত মজুমদারকে একথা বলি না, ৩৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ এই ঠিকানা আমার মুখস্থ। দুবার চিঠি আর একবার খেলাঘরে লেখা পাঠিয়েছি বাগেরহাট থেকে। কিন্তু ‘সংবাদ সাময়িকী’তে লেখা পাঠাইনি কখনো। সেখানে আমার দৌড় একখানা না-ছাপা হওয়া চিঠিতেই। একবার মনে হয় লেখা ডাকে পাঠানোই ভালো, একবার ভাবি গিয়ে দিয়ে আসব।

এ-সময়ে আবুল হাসনাতের সঙ্গে ক্ষণিকের পরিচয়ের সুযোগ হয়। তা একেবারেই আকস্মিক। অরুণ সেন সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছেন। যাবেন মফিদুল হকের সাহিত্য প্রকাশের দফতরে। সেটি সংবাদ অফিস-লাগোয়া। মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে অরুণ সেন শান্তা সেন-সহ সাহিত্য প্রকাশের দফতরে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরে সেখানে আবুল হাসনাত এলেন। সেই তাঁকে প্রথম দেখি। রফিক স্যার পরিচয় করিয়ে দেন।

সেদিনের ওই পরিচয়টুকুর জোরে কদিন বাদে সংবাদ অফিসে একটি গল্প নিয়ে হাজির হই। সেই প্রথম ৩৬ পুরানা পল্টনের অফিসে যাওয়া। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠার পরে বাঁয়ের ঘরে বসেন সন্তোষ গুপ্ত। তাঁকে দরকারটা বলতে, সামনে দেখলেন। বারান্দার পরে একটু খোলামতন জায়গায় দক্ষিণমুখী টেবিলে চেয়ারে বসা আবুল হাসনাত। কদিন আগে সাহিত্য প্রকাশের অফিসে আলাপ হয়েছে, আমাকে চিনেছেন এমন ছায়া তাঁর চোখের কোথাও পড়ল না। টেবিলের উলটো পাশে কোনো চেয়ার নেই। আমাকে বসতে বলার কারণও নেই। চোখ তুলে তাকালেন। অর্থাৎ, কেন এসেছি। বললাম। হাত বাড়ালেন। তারপর শুধু শুনলাম, ‘হুঁ।’ অর্থাৎ, আসুন।

তাহলে সুশান্ত মজুমদার যা বলেছিলেন তা-ই। লেখা নিয়ে কোনো কথা হবে না। আমার সামনে খামে তিন ভাঁজ করা লেখাটা খুললেনও না। শুধু, ‘হুঁ।’ সেকথা বলতেই সুশান্তদা বললেন, হাসনাতভাই অমনি। তাছাড়া লেখা নিয়ে কথা বলারই-বা কী আছে? ভালো হলে কিংবা পছন্দ হলে কিংবা ধরো মুদ্রণযোগ্য হলেই ছাপবেন। মুদ্রণযোগ্য লেখা পাওয়াই তো সম্পাদকদের জন্যে কত কষ্টের। হাসনাতভাই এই যে কথা বলেন না, বলা প্রয়োজন মনে করেন না, এতে একটা নৈর্ব্যক্তিকতাও কিন্তু তৈরি হয়। যেটা সাহিত্য সম্পাদকের খুব প্রয়োজনীয়। নয়তো কত ধরনের যে তদ্বির। কেন ‘সংবাদ সাময়িকী’তে মাঝে মাঝে কোনো কোনো লেখা পড়ে বোঝো না, ওগুলো হাসনাতভাইয়ের মতো মানুষকে খানিকটা অনিচ্ছায় ছাপতে হয়েছে। অনুরোধের আসর! অনুরোধের আসর কথাটা সুশান্ত মজুমদার বললেন খুব মজা করে। হাসনাতভাইয়ের ওই একটি ‘হুঁ’-র জবাব সুশান্তদাই দিয়ে দিলেন।

দুই কি তিন সপ্তাহ পরেই গল্পটা ছাপা হয়েছিল। ‘সংবাদ সাময়িকী’তে আমার প্রথম লেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কমনরুমে সেই বৃহস্পতিবারে, দুদিকে বিছানো পত্রিকার স্ট্যান্ডে, সকাল আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ ‘সংবাদ সাময়িকী’র সেই দ্বিতীয় পৃষ্ঠাটা আমি এখনো দেখতে পাই। মাঝখানে সময় ছাব্বিশ বছর। গল্পের নাম ‘বুড়ো কবিতা লিখতেন’। তাহলে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে আমার লেখা! বাবার ভাষায়, সাপ্লিমেন্টে। অন্তত বছর দশেক আগে প্রথম শোনা সেই সাপ্লিমেন্ট কথাটা সেদিন অজানিতে কানে এসেছিল।

যথারীতি সে-সংখ্যায় হৃৎকলমের টানে আছে। আছে অলস দিনের হাওয়া। আর দেশের প্রধান প্রাবন্ধিকদের লেখা সামনের পাতায়। মাঝখানে আমার এই অনুপ্রবেশ। যার অনুমোদন, ওই একটি শব্দ ‘হুঁ’।

কিন্তু কয়েক মাস বাদে, দ্বিতীয় গল্পটি দিতে গিয়ে, হাসনাতভাইয়ের চোখের ভাষায় একটু যেন পরিবর্তন দেখলাম। কিন্তু বাড়তি কোনো অনুমোদন নেই। সেদিন বাড়তি দুটো শব্দ বললেন। বললাম, ‘একটা গল্প নিয়ে এসেছি।’ হাসনাতভাই বললেন, ‘হুঁ। রেখে যান।’ হাতটা আর বাড়ালেন না। নিজের হাতের কাজ থেকে চোখ তুলে একবার তাকালেন। আমি লেখাটা রেখে চলে এলাম। এমন আচরণে একটু বিব্রত লাগে। তবু ওঁর আচরণ সম্পর্ক জানা আছে বলে কিছু মনে করার নেই।

যদিও ঘটনা ঘটল একেবারেই উলটো। সম্ভবত সেদিন সোমবার। গল্পটা দিয়ে এসেছি। বৃহস্পতিবার দুপুরে আমি খুলনা শহরে। একটা পত্রিকা স্টল থেকে সংবাদ হাতে নিয়ে দেখি, আমার দিন তিনেক আগে দিয়ে আসা গল্প। পিকচার প্যালেসের মোড়ে দাঁড়িয়ে ‘সংবাদ সাময়িকী’র পৃষ্ঠায় চোখ দিয়ে হাসনাতভাইয়ের ওই ‘রেখে যান’-টুকুর তাৎপর্য একেবারে বদলে যায়। ফলে বাড়তি কথা তিনি বলুন কি না-ই বলুন, আমার দিক দিয়ে কৃতজ্ঞতাবোধের কোনো কমতি তো থাকে না!

এরপর আর বেশ কবার তাঁকে সশরীরে গল্প দিতে যাইনি। ডাকে পাঠিয়েছি। কোনো প্রয়োজনে পল্টন এলাকায় যাওয়া হবে, তা না ঘটলে মনে হতো ডাকে লেখা পাঠানোই সুবিধার। আমি লেখা পাঠিয়েছি, তিনি ছেপেছেন। এই সংযোগে পারস্পরিক এক সেতু অদৃশ্যভাবেই রচিত হয়ে গিয়েছিল।

শুধু একবার, একটি গল্প পাঠিয়েছি অন্তত মাসখানেক, আকৃতিতেও একটু বড়ো, তাই সংশয় হয়তো সেজন্যে ছাপা হচ্ছে না। ভাবলাম অন্তত একবার তাঁর কাছে জানতে যাই। গেলামও। নিচুগলায় বললাম, ‘হাসনাতভাই, একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম। দেখেছেন?

পুরো জিজ্ঞাসা শেষ করার আগেই তিনি জানালেন, ‘এই গল্পটা আমি ছাপতে পারব না। সংবাদ পারিবারিক কাগজ। আপনি এটা অন্যত্র দিয়ে দেবেন।’ বলে লেখাটা খুঁজতে শুরু করলেন, ‘আর আমাকে আর একটা গল্প দিয়ে যাবেন।’

বললাম, ‘ও গল্পের কপি আমার কাছে আছে।’

সত্যি বলেছিলেন তিনি। সংবাদ তো দৈনিক। সেখানে একটি গল্পের শুরুতেই বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বরাতে, একজন নারীর একটানা দুশো সোয়া দুশোজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার বর্ণনা, উত্তমপুরুষ বা গল্পের কথক যার বরাতেই হোক, সম্পাদকের রুচিতে না আটকালেও সেই সংবাদপত্রের যে-পাঠকগোষ্ঠী তাদের কথা তো তাঁকে মাথায় রাখতেই হয়।

খুঁজে পেতে সেই গল্পের কপিটা আমায় দিয়ে দিলেন। আমি সেটি একটি পাক্ষিকে দিয়ে দিই, সেখানে ছাপা হয়। এই ঘটনায় একটি বিষয় বুঝলাম, দৈনিকের গল্পের ক্ষেত্রে সম্পাদককে কখনো কখনো কিছু সীমাবদ্ধতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়।

‘সংবাদ সাময়িকী’তে আমার লেখার সংখ্যা বাড়ে। একটি-দুটি বইয়ের আলোচনাও লিখেছি। আর সবই গল্প। শাহবাগ বা এখানে-ওখানে কখনো হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে, কথা হয় সামান্যই। কখনো একেবারে কাছে আর কেউ না থাকলে নিচু গলায় বলেন, ‘লেখা হলে পাঠিয়ে দেবেন।’ বুঝতে পারি, এ আমার প্রতি তাঁর অনুমোদন। ফলে একবার সুযোগও নিলাম। একটি দীর্ঘ গল্প, দৈনিকে একবারে ছাপলে পাঁচ-ছ পৃষ্ঠা হবে। জানি এ-লেখা একমাত্র ধারাবাহিকই ছাপানো যেতে পারে। ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হয়, কিন্তু গল্পও? হতে পারে, তা বলে আমার? তবু যা থাকে কপালে বলে ডাকে পাঠিয়েছিলাম। ছাপা হবে কি হবে না এ বিষয়ে পুরোপুরি অনিশ্চিত। সত্যি ছাপা হয়নি, হচ্ছে না। কয়েক মাস বাদে সংবাদ অফিসে গেলাম ভুল স্বীকার করতে, এত বড়ো একটা গল্প পাঠানো উচিত হয়নি। নিজের কাছে রেখে দিই, পরে কখনো সুযোগ হলে কোনো সাপ্তাহিকে দেওয়া যাবে। যদিও তখন পর্যন্ত কোনো সাপ্তাহিকের বিশেষ সংখ্যায় আমার লেখা ছাপা হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি।

এই কথাগুলো বলব বলে ঠিক করে গিয়েছি, ওদিকে হাসনাতভাই আমায় তা-ই বললেন। পাশের চেস্টড্রয়ার থেকে লেখাটা বের করে হাতেও দিলেন আমার। যথারীতি জানাতে ভুললেন না, আর-একটি লেখা যেন দিয়ে যাই। আমি সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে আসব, হাসনাতভাই ডাকলেন, ‘শুনুন।’ (তিনি আমাকে আপনি সম্বোধনই করেছেন সবসময়। যতবার বলেছি তুমি বলতে, ততবারই বলেছেন সে দেখা যাবে। ওইটুকুই। সে-সময়ে আর দ্বিতীয়বার অনুরোধের সুযোগ দিতেন না।) হাসনাতভাইয়ের ওই ডাকে ফিরতেই তিনি আমাকে অবাক করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘লেখাটা রেখে যান, থাক আমার কাছে, দেখি কী করা যায়। দীর্ঘ গল্প। ছাপার সুযোগ কম।’

মাসখানেকের ভিতরে, এই লেখাটি ছাপা হতে শুরু হলো, ‘করুণা ঢালীর বিরহমিলন’। এর ওপরে লেখা : ধারাবাহিক গল্প। আট কি নয় কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। ‘সংবাদ সাময়িকী’র দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় নয়, তৃতীয় পৃষ্ঠাতে। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হতো নিয়মিত গল্প।

আবুল হাসনাত-সম্পাদিত ‘সংবাদ সাময়িকী’তে তাঁর এই আনুকূল্য আর মনোযোগ আমি সবসময়ে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছি সবে, ততদিনে ওই ধারাবাহিক গল্পটা বাদে আমার অন্তত নয়-দশটি লেখা সেখানে ছাপা হয়েছে। পরে অন্যদের কাছে শুনেছি, ‘সংবাদ সাময়িকী’তে এভাবে ক্রমশ লেখা ছাপা হওয়ায় অনেকেই মনে করতেন, আমি মাঝবয়েসি কেউ। কেননা, সংবাদের ওই পাতায় সবসময়ই প্রচলিত অর্থে তরুণ লেখকদের উপস্থিতি একটু কম। সেখানে আমার এমন উপস্থিতি, সেই অজ্ঞাত পাঠকদের কাছে আমার বয়েস বাড়িয়ে দিয়েছিল।

দুই

সংবাদ সাময়িকী’র আবুল হাসনাত আর কালি ও কলমের আবুল হাসনাত, ব্যক্তিক অর্থে নয়, সম্পাদক অর্থে দুজন মানুষ। তা যতটা তাঁর ইচ্ছেয় ঘটেছে তার চেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে কাগজ দুটোর অন্তর্গত চরিত্রের জন্য। মাঝখানে আছে তাঁর অল্প কিছুদিনের একটি পাক্ষিকের সঙ্গে যুক্ততা। যতদূর মনে হয়, এ-সময়ে তিনি ধীরে ধীরে সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। ওই পত্রিকার সম্পাদক হায়াৎ মামুদ, নির্বাহী সম্পাদক তিনি।

এরপর কয়েক বছর বাদে, কালি ও কলমের যাত্রা শুরু। কালি ও কলম আর  ‘সংবাদ সাময়িকী’র চরিত্রগত তফাৎ হতে বাধ্য। সেটিই ঘটেছিল। যে-জন্যে এই দুই সাময়িকপত্রের সম্পাদক যেন প্রায় দুজনই। ‘সংবাদ সাময়িকী’ দৈনিক সংবাদের সাহিত্যপাতা। দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সংবাদের চরিত্র বামপন্থার দিকে, শুধু দিকে ঠিক বলা হলো না, সে-চরিত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতাপূর্ণ ও সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে নোয়ানো। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের যে চোরস্রোত বহমান, সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক। হাসনাতভাই একদা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে সাহিত্যপাতায় সেই নন্দনকে লালন করতেন, সে-ছাপও পড়ত। একইসঙ্গে এ-কথাও সত্যি ‘সংবাদ সাময়িকী’তে এদেশের লেখককুলের অনেকের অনুপস্থিতিও ছিল অবধারিত। তাঁর গণসাহিত্য-পর্বের কথা জানা নেই। সে আমাদের বাল্যের ঘটনা। যদি আমার দেখা ‘সংবাদ সাময়িকী’র মধ্য পর্ব থেকে তাঁর সম্পাদিত অন্তিম পর্ব পর্যন্ত এক সম্পাদককে ধারাবাহিকভাবে বুঝে নিতে চাই, তাহলে সেখানে আবুল হাসনাতের কাজে সেই বিশ্বাসের নন্দনই ধরা পড়ে :

[…] কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ১৯৭১ সালে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কর্মে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পেরেছিলাম, সেজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি। তবে এ গর্বও ম্লান হয়ে যায় আজ যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধ সমাজে সিঁড়ি ভাঙার সোপান হয়ে ওঠে। বড়ই কষ্ট পাই তখন, বেদনায় হৃদয় চূর্ণ হয়। ষাটের দশকে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী ছিলাম এবং জীবনের মানে খুঁজে নিয়েছিলাম এই কর্মপ্রবাহে। অ্যাকাডেমিক অধ্যয়নে নিজেকে যে ব্যাপৃত করেছিলাম তা নয়। বেঁচে থাকার আর্তি ও মর্মবেদনা ছিল এই সময়ে। তবুও হতাশা গ্রাস করেনি কোনোদিন। জীবনকে ধন্য করেছে এই পথচলা। সংবাদ সমায়িকী বিভাগটিকে উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি, প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি সংবাদ সাময়িকীকে বিকল্প সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলতে।

ওদিকে, কালি ও কলম যখন বেরিয়েছে, ততদিনে পশ্চিমবাংলার বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা দেশের প্রভাব এদেশে প্রায় শুকিয়ে এসেছে। তখন দেশের মতন একটি সাহিত্যপত্রিকা করাটাও কোনো কাজের কথা নয় এই জন্যে, সাহিত্যের ওই ধারাই বদলে গেছে। সেদিক থেকে ‘সংবাদ সাময়িকী’ যেমন শুরু থেকেই যা করণীয় তার লক্ষ্যকে স্থির রাখতে পেরেছে, দৈনিকের সাময়িকী হলেও এর ভিতরে সাহিত্যের অপ্রাতিষ্ঠানিকতার একটি ছাপ অন্তর্গতভাবে বহমান ছিল, সেটি কালি ও কলমে ধারণ করতে পারার কোনো কারণ নেই। সেটি ওই কাগজের কর্তৃপক্ষ আর সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাত কেউ চানওনি। চাইবেনই-বা কেন? বরং তাঁরা চেয়েছেন, বাংলা ভাষার একটি মাসিকপত্র যা পশ্চিমবাংলায়ও গ্রহণীয় হবে। পশ্চিমবাংলার লেখকদের তাই কালি ও কলমে বেশ জায়গাও দেওয়া হয়েছে। যতদূর মনে করতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সমরেশ মজুমদার, আফসার আমেদ, তিলোত্তমা মজুমদারের ধারাবাহিক উপন্যাস বেরিয়েছে সেখানে; এমনকি বর্ষপূর্তি সংখ্যায় যে-দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, এর একটি পশ্চিমবাংলার লেখকদের। এমনকি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় কালি ও কলমের কলকাতা সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল।

সেদিক থেকে কালি ও কলম শুরু থেকেই বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক কাগজের চরিত্র অর্জনের চেষ্টা করেছে। তাঁর ‘সংবাদ সাময়িকী’ সম্পাদনার প্রায় তিরিশ বছরে যে-চরিত্র, যে-ধরন, যে-গড়ন (দৈনিকের সাময়িকী আর মাসিক সাহিত্যপত্রের ফারাক অর্থে নয়) কালি ও কলম তা কখনো অর্জনের চেষ্টা করেনি। ওদিকে পাঠকের রুচিও তো বদলে গেছে; সামাজিক বিন্যাস, যোগাযোগের ধরন, জনজীবনের ভাষারও বদল ঘটেছে। তখন চাইলেও ‘সংবাদ সাময়িকী’র সাহিত্যিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আবুল হাসনাতের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। রক্ষা কেন মেলানোও প্রায় অসম্ভব। যেন দুই কালের অসেতুসম্ভব অবস্থার ভিতরে কালি ও কলম  সম্পাদকের পথচলা শুরু হয়েছিল।

একটু আগে যে-কথা লেখা হয়েছে, কালি ও কলমের শুরুতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে যোগাযোগের ধরন বদলে গেছে, সে-সময়ে অনিবার্য প্রয়োজনে আমিও রাজধানীর বাইরে। ফলে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হওয়ার সুযোগ কম। ওদিকে মোবাইল ফোন আর ই-মেইলে যোগাযোগ অনেক সহজ। তিনি চিরকাল স্বল্পভাষী, কাজের ক্ষেত্রে একাগ্র। নির্দেশও নির্র্দিষ্ট। তাই তাঁর ফোন তুললে, খুব সংক্ষেপে একটি নির্দেশ ‘গল্প পাঠান।’ অথবা, ‘ই-মেইলে চিঠি পাঠিয়েছি, দেখেছেন নিশ্চয়, অমুক তারিখের ভিতরেই লেখা পাঠাবেন।’ ২০০৪ থেকে কথাটা যত ওজন মাখানো থাকত, ততটা নির্দেশযুক্ত নয় হয়তো-বা। কিন্তু ক-বছর পরে একেবারেই নির্দেশ, যেন আমার লেখাটা তাঁর চাই। বলতেনও কখনো কখনো সেভাবে। অমুক তারিখের ভিতরে লেখাটা আমার চাই। সাকল্যে ৩০ সেকেন্ডের আলাপ। যা বলার এর ভিতরেই বলে ফেলেছেন।

নির্দেশনা ওইটুকুই। ছাব্বিশ বছর ধরে তাঁর সম্পাদিত-পত্রে গল্প ছাপা হয়েছে, কিন্তু লেখার আকৃতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। গল্প লিখতে বলেননি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে। শুধু একবার, তাঁর সংবাদ-পর্বের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে কোনো গল্প লিখেছি কি না অথবা লিখতে চাই কি না, জানতে চেয়েছিলেন। কারণ বলেননি। আমি অপারগতা প্রকাশ করেছি শুধু। পরে দেখেছি ওকথা বলেছিলেন তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প সংকলনটির জন্যে। ওটি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকাশিত সেরা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের সংকলন; এর পরে প্রকাশিত আর সব কোনো না কোনোভাবে ওই সংকলনেরই অনুসারী অথবা অনুগামী!

এদিকে আবুল হাসনাতের কালি ও কলম পর্বে, নিজের লেখার ক্ষেত্রে, খেয়াল করেছি, নির্দেশনায় সেই স্বাধীনতা থাকায়, অনেক দীর্ঘ গল্প লিখেছি। দৈনিকের মতো নির্দেশের চাপে গল্পকে আকৃতির দিক দিয়ে কখনো খাটো করতে হয়নি। তাঁর হাত দিয়ে যে গোটা তিরিশেক গল্প (‘সংবাদ সাময়িকী’, কালি ও কলমসহ একটি পাক্ষিকে) প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর রচয়িতার অন্তর্গত স্বাধীনতার আনন্দ কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া চলে নয়। সেই ধন্যবাদ তাঁকে কখনো দেওয়া হয়নি। দেওয়া যায়ওনি। সে-তোয়াক্কাও করতেন না তিনি। সিলেটে বছর তিনেক আগে বেঙ্গলের উৎসবে, একসময়ে দুজনে কাছাকাছি, তাঁকে সেকথা বলতে চেষ্টা করেছিলাম, হাসনাতভাই প্রায় নিচুগলায় ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘বাদ রাখুন ওসব কথা। কাগজটা করছি, সবাই মিলে ওটাকে চালিয়ে নিতে হবে, লেখা হলে দেবেন। সবসময় চাইতে হবে কেন? এ তো উলটো দাবি। অর্থাৎ একসময়, সেই যে সংকোচের পায়ে সংবাদ অফিসে একটি লেখা নিয়ে হাজির হতাম, তখন তো লেখা চাইতেন না, এখনো কেন তাঁর সম্পাদনাকে তা-ই ভাবি না।

কিন্তু, ওই ধন্যবাদ দিতে গেলে ‘বাদ রাখুন’-এর ভিতরেই আসলে আবুল হাসনাতের সম্পাদনার নেপথ্য শর্ত। নিজে লেখক তিনি। কবিতা লেখেন, চিত্র-সমালোচনা করেন, শিশুসাহিত্যে সহজ অধিকার, প্রয়োজনে কারো প্রয়াণে স্মরণাঞ্জলিও লিখেছেন অনেক; সবখানে অনায়াস যাত্রা, কিন্তু সম্পাদক-ব্রতে সে-সবকে যে পাশে সরিয়ে রাখতে হয়, সম্পাদনা নেপথ্য কর্ম একথা সারাটা জীবন পালন করে গেছেন। সামনে থাকার সুযোগ, সুযোগ থাকলেই তো ফাঁদ, সেই ফাঁদের প্রলোভনে নিজে কখনোই পা দেননি। একটু হয়তো ভুলই বলা হলো, সেই পা-টি তিনি সচেতনে সরিয়ে রেখেছেন। যে-কোনো কাগজে সম্পাদক নেপথ্য নেতা, সাহিত্যপত্রে সেটি আরো তীব্র, সেই সচেতনতাটুকু দীর্ঘকাল এমন যত্নে রাখা প্রায় অসাধ্য। তাঁর স্বপ্নভাষী চরিত্রে সে-দৃঢ়তা হয়তো মানসিকতার সঙ্গে জড়াজড়ি করেছিল, তিনি তাই লালন করতেন। অথবা সেটিকে লালন করতেই ওই স্বপ্নভাষীর বর্ম, যা রক্ষার জন্যে নেপথ্যতাকে সামনে আনতেন না। নৈর্ব্যক্তিকতার আড় যদি তাতে ভাঙে!

ফলে যখন যে-সাহিত্যপত্রের তিনি সম্পাদক, ওই নেপথ্য নৈর্ব্যক্তিকতার জোরে তিনি তা নিজের মতন করে গড়ন দিতে পেরেছেন। সেই চেষ্টায় আবুল হাসনাতের কোনো ত্রুটি ধরা যাবে না। হয়তো সমালোচনা করা যাবে। সমালোচনা তো বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন কি সিকান্দার আবু জাফরের সমকালেরও করা যায়। সম্পাদনার ত্রুটিও চাইলে ধরা যায়। কোনো সংকলনই তো কখনোই পূর্ণতর নয়। সবসময়েই তা এক পূর্ণতার দিকে যাবার প্রয়াস। সবার মনমতো তা কখনোই হয় না। আর আমাদের বেড়ে ওঠার কাল তো সাহিত্যপত্রহীনতার প্রাথমিক যুগ, দৈনিকের হাতে সাহিত্যের শাসনের কাল, যা ২০০০-এর পর থেকে তেলেজলে বলীয়ান হয়েছে, সেখানে কালি ও কলমে তাঁর প্রয়াসের কোনো কমতি ছিল না। যেটি ঘটেছিল ও ঘটতে বাধ্য, সম্পাদকের বয়েস বাড়ে, তিনি তাঁর তারুণ্যকে ষাট ও সত্তর কি আশির দশকে রেখে প্রাজ্ঞ হন, ওদিকে সাহিত্যের ময়দানে ততদিনে এসে পড়েন আরো তরুণপ্রাণ, ইতিমধ্যে সাহিত্যিকভাষার স্বাভাবিক কিছু পরিবর্তনও ঘটে, হয়তো তখন আর সম্পাদকের পক্ষে সেই তারুণ্যের প্রতি নির্ভরতার কোনো সুযোগ থাকে না। তিনি তাঁদের চিনে-বুঝে উঠতে পারেন না। তাঁকে পথ চলতে হয় ‘একটু সাবেকদের’ নিয়েই, এজন্যে কোনো দোষ তাঁকে দেওয়া যায় না। আবুল হাসনাত সেই গ্রন্থিমোচনেরও চেষ্টা করছেন কখনো কখনো, সাম্প্রতিক গল্পসংখ্যাগুলোয় সে-নির্দশনও আছে। কিন্তু তাতে শ্যাম আর কুল সবসময়ে একযাত্রায় রক্ষিত হবে, সাহিত্য সম্পাদনার কোনো ইতিহাসই সে-কথা বলে না।

ধারণা করি, এই জন্যে তাঁর লেখকসত্তাকে ছাড় দিতে হয়েছে। কবিতাচর্চায় নিয়মিত হতেন কি না, সেটি একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু চিত্র-সমালোচক হিসেবে সেই আগ্রহের জায়গাটিতে তিনি যদি আরো সময় ও অভিনিবেশ দিতে পারতেন, তাহলে এক্ষেত্রে তাঁকে সর্বমান্যে পরিণত করত। এটি সাহিত্য সম্পাদনার নেপথ্য কারিগরির কারণে তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রকে অবহেলা করা অথবা কম মনোযোগ দেওয়া। হয়তো বেঙ্গলের মতো প্রতিষ্ঠানে আরো অনেক কাজ ছিল, যা তাঁকেই সামলাতে হতো। হতে পারে, তাঁর টনটনে দায়িত্বজ্ঞান ও বাড়তি দায়িত্বের চাপ শরীরের দিকেও সবসময়ে তাকাতে দেয়নি। তবু এর ভিতরে সময় করে হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে আর প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্যর মতো দুটি স্মৃতিকথা তিনি রচনা করেছেন, সেখানে আছে তাঁর বেড়ে ওঠা, কর্মতৎপরতা আর ব্যক্তিগত নন্দনের প্রকাশ। এই জন্যে অন্তত এটুকু আমাদের জন্যে স্বস্তির যে, বাংলাদেশে সাহিত্য সম্পাদনার জগতের সবচেয়ে কীর্তিমান মানুষটি সেখানে আমাদের সামনে হাজির থাকবেন। তাঁকে বুঝে নেওয়ার সুযোগও ঘটবে :

যৌবনকালে সুধীন দত্তের মত আমার মনে হয়েছিল, এ বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী; এ মত ও নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে দিয়েছিল ছাত্র ও যুব বিদ্রোহ। বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মী হয়ে ওঠা ও একই সঙ্গে রাতে সংবাদে চাকরি জীবনকে বহুভাবে অভিজ্ঞ ও সমৃদ্ধ করেছিল। মনন ও প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল কত মানুষের যে সান্নিধ্য পেয়েছি চাকুরি ক্ষেত্রে তার তালিকা দীর্ঘ।

লেখার এই প্রায় শেষ দিকে এসে বুঝতে পারছি, যে-কোনো স্মৃতিচারণ শ্রদ্ধাঞ্জলিতে একটি ফাঁক থাকে। সেখান থেকে চাইলে নিজেকে সরিয়েও রাখা যায় না। তা হলো, যাঁর উদ্দেশে এই কথাগুলো তাঁকে নিয়ে বলবার সময়ে রচয়িতা নিজের কথাও প্রকাশ করতে বাধ্য হন। সেখানেই বিপত্তি। কেননা রচয়িতা প্রায়শ পার্শ্বচরিত্র হিসেবে হাজির নন, নিজেকেও যেন চাইলে কীর্তিমানের কর্মের এক শরিকি-ভাব বহালও রাখেন। এর যা-যা কিংবা যেটুকু এখানে ঘটেছে সেজন্যে হাসনাতভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই, যিনি আবুল হাসনাতকে খুঁজতে গিয়ে পড়বেন এ-লেখা তাঁর কাছে মাফ চাওয়ার আছে! কেননা আবুল হাসনাতের মতন সাহিত্যপত্রের কাজে প্রকাশ্য, তাঁর যা কাজ আমাদের সামনে তা নিয়ে হাজির অথচ ব্যক্তি হিসেবে তিনি অপ্রকাশ্য, কাজটা সামনে থাকলেই তিনি কারিগরের চোখে খুশি, তাঁর কথা বলতে গিয়ে নিজেকে যতটুকু সামনে আনতে হলো, এ তো নিরুপায়ীর আবরণ উন্মোচন।

আবুল হাসনাতের সঙ্গে পরিচয়ের পরে অন্তত দুদিন এইসমস্ত কিছুর বাইরের মানুষটি হঠাৎ সামনে ধরা দিয়েছিলেন। অন্তত বছর কুড়ি আগে আজিজ মার্কেটের একটি চায়ের দোকানে বসে আছি দুজনে। একেবারেই ব্যক্তিগত কথাবার্তা হচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি মোহাম্মদ রফিকের জন্যে। তাঁর সঙ্গে হাসনাতভাইয়ের কোনো প্রয়োজন, আমাকেও থাকতে হবে। সেই বিকেলে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় আমার কাছে হাসনাতভাই ছিলেন চেনার বাইরে। হাসিঠাট্টার কথাও হয়েছে কোনো প্রসঙ্গে। তবে কোনো মানুষ সম্পর্কে কখনো বিদ্বেষ নিয়ে কথা বলতেন না। শ্রদ্ধা প্রকাশ না-করা গেলে চুপ করে থাকতেন। বড়ো চোখ জোড়া আরো একটু বড়ো হতো। বিব্রতবোধেও প্রায়শ তা-ই। দ্বিতীয় ঘটনাটি সিলেটে। বারো-চোদ্দ বছর আগে। কালি ও কলম, শিল্প ও শিল্পীর কাজে এসেছেন। তাঁর আমন্ত্রণে ছোটোখাটো সমাবেশ। আমি একটু আগেই গিয়েছি। কুশলবিনিময়ের পরে, কেউই প্রায় আসেনি তখনো, হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলেন, ‘সব খবরাখবর ভালো তো? সিলেট ভালো লাগছে?’ একগাল হেসে জানতে চেয়েছিলেন। এই অপরিচিত হাসনাতভাই, সম্পাদক হিসেবে ভিন্ন মানুষ হয়ে যান, নাকি সেদিন হঠাৎ অন্তর্গত স্নেহ আর অপ্রকাশ্য রাখতে পারেননি!