পটেশ্বরী

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

তৃতীয় কিস্তি

এই পরিমন্ডলে আমরা নিশ্চিন্তে চার-চারটে বছর কাটিয়ে দিলাম। এক তরুণ শিক্ষক নিয়োগ করেছিলাম বাচ্চাদের কিছু শেখানোর জন্য ততটা নয়, যতটা ওদের কিছুটা ব্যস্ত রাখতে। সে-সময়ে অমৃতার সাড়ে পাঁচ বছর বয়েস। দুমাস যেতে না যেতেই দেখি দিব্যি হাঙ্গেরিয়ান বলছে আর ছোট ছোট বাক্য লিখেও ফেলছে। সে-সময় রঙ-পেনসিল দিয়ে ছবি অাঁকা ধরেছে। দেখে তাজ্জব হচ্ছি, কীভাবে ওর আশপাশে ছড়ানো খেলনাগুলো এঁকে দিচ্ছে। পুতুল, খেলনা গাড়ি, টেডি বেয়ার… সাত বছরে পড়ার আগে আবার অাঁকা ধরল আমার মুখে শোনা হাঙ্গেরীয় রূপকথাগুলো। যেগুলো কী মন দিয়ে শুনত ততদিন। পরের দিকে নিজের মতো করে রূপকথা বানানো ধরল, বিলকুল নিজের কল্পনায় আর তাদের জীবন্ত করতে থাকল ছবি এঁকে এঁকে।

হাঙ্গেরির বৃত্তান্ত তো খুব বলে যাচ্ছি, কিন্তু এই হাঙ্গেরিতে কী করে এলাম, কেন এলাম না শোনালে অমৃতা শের-গিলের উপাখ্যান শুরু হবে কী করে? এই শুরুটা না হয় ইন্দুই করবে ওর বয়ানে, এই দায়িত্বটা আমি ওকে দিতেই পারি। আমারও তো অনেক ইতিহাস ওকে বলে যেতে হবে। আমার মুশকিল হলো যা-ই বলি তাতে আমার নিজস্ব একটা প্রেক্ষিত জুড়ে দিই। কোনো কিছুকেই রেয়াত করি না। তাতে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায় আমার ছবির মতো। অমৃতার মন ও আঙুলের ছাপ বসানো। লুকিয়ে-চুরিয়ে আমার পক্ষে কোনো অপরাধ করা সম্ভব নয়, সব কিছুতেই অমৃতার হস্তাক্ষর যেন। তাছাড়া কোনো কিছুই তো লুকিয়ে করাতে এতটুকু সম্মতি ছিল না আমার। আমার লেখা চিঠি আর লেখালেখিগুলোই তো তার প্রমাণ।

আমার খুব ইচ্ছে ছবি অাঁকার জীবনে ঢুকে পড়ার। প্যারিসের জীবনের ঢের কথা বুকের মধ্যে জমে আছে। কিন্তু তার আগে দুনাহারাস্তির আরেকটা ছবি তুলে দিই। বাবার একটা লেখা থেকে।…

মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ফলে ভারত থেকে টাকা আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। তখন ব্যয়ভার কমাতে বুদাপেস্ত ছেড়ে দুনাহারাস্তি গ্রামে গিয়ে সংসার পাতলাম। ফলে পরিবারের সেই সৌখিন, ফুরফুরে দিনগুলোর ইতি হয়ে গেল। বউকে সারাক্ষণ খেটে মরতে হচ্ছিল বাচ্চা মানুষ করতে – রাঁধাবাড়া, কাচাকাচি, ওদের দেখভাল; তাতে ওর স্বাধীন, উন্নত স্বভাবটা ফুটে বেরুচ্ছিল।  আর আমাকেও ওই হাঁড়-কাপানো শীতে কাঠ কাটা, কুয়োর জল তোলা ইত্যাদি করে যেতে হচ্ছিল।

বাচ্চারা এই সময় ওদের মায়ের অাঁচলধরা হয়ে গেল। দিন থেকে দিন ওরা কাছাকাছি এলো। যদিও দুধ বা মাখনের বড় টানাটানি তখন, খাদ্যদ্রব্য যা পাওয়া যায় যুদ্ধের বাজারে তা দিনকে দিন নিকৃষ্ট হলো। ওরকম এক সময় অমৃতা যখন ওর হাতে মিষ্টি তুলে দিয়েছিল অভিনেত্রী মারি জাম্মাইকে, সে তো গলে গিয়ে বলে বসেছিল, ‘কী লক্ষ্মী মেয়ে রে! এত সুন্দর আর দিলখোলা, ওর তো জীবনে সুখ আর আরাম পেতে বেশ কষ্টই হবে।’

এই সময়েই স্প্যানিশ ফ্লু জ্বর ছড়ানো শুরু হলো। তাতে বেজায় কাবু হলো অমৃতা। একটা সময় তো আশঙ্কা হলো, ও আর বাঁচবেই না। গ্রামে তো একটাও ডাক্তার নেই। নিরুপায় হয়ে ওর মা ছোট মেয়েকে সঙ্গে করে ডাক্তারের খোঁজে পাশের গ্রামে গেল। তিনি তো আসবেনই না, তাঁর নিজের তল্লাটেই এত রোগী। অবশেষে বিফল হয়ে ওরা যখন ফিরল – আমি তো সেই সারাটা সময় মেয়ে আগলাচ্ছি আর মনের দুঃখে প্রার্থনা করে যাচ্ছি – বাচ্চাটা দেখা গেল সেরে উঠছে, ওর জ্বরজারি কাটছে।…

এই দুনাহারাস্তিতেই মা আর বাবার দুই অপূর্ব, স্নেহময় মূর্তি দেখেছি। এখানেই সত্যি করে কাছাকাছি হয়েছি মাসতুতো বোন ভিয়োলা আর মাসতুতো ভাই ভিক্টরের, যাকে বড় হয়ে ভালোবেসে বিয়েও করলাম। কত ঘনিষ্ঠতা হলো বোন ইন্দুর সঙ্গে যার চানের জলে খেলনা ফেলতাম, আর যে-মায়ের সঙ্গে ডাক্তারের খোঁজে গিয়েছিল আমি যখন ফ্লু-তে যাই-যাই।

 

দুই

অমৃতাকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তারের খোঁজে যে গিয়েছিলাম এই বৃত্তান্ত বাবার মুখে শুনেছিলাম, পরে ওঁরই লেখায় পড়ি। অমৃতার শৈশবকথা মার লেখাতে পড়েছি। আর নিজে ওর জীবনের এত কিছু দেখলাম এতকাল ধরে যে লিখতে বসে খেই হারিয়ে ফেলছি।

আরেকটা সমস্যাও আছে। এক শিশুর কাছে আরেক শিশু তো ঠিক শিশু হিসেবে ধরা দেয় না, সে একটা পরিপূর্ণ মানুষই যেন। আর অমৃতা বয়েসে আমার চেয়ে সামান্য বড় হলেও ও যে সত্যি কবে শিশু ছিল আমি বুঝে উঠতে পারি না। ওর বড় হয়ে ওঠা আমি আমার ছোটবেলার চোখে দেখেছি, কিন্তু ওই ‘বড় হয়ে ওঠা’টা যে কী তা সেভাবে ঠাওর করতে পারিনি। ছোট থেকেই ও আমার কাছে বড়ই ছিল; বড় বোন, বড় কিছু, চোখ বড় করে দেখার মতো কিছু একটা, কেউ একটা। যাকে নিয়ে সবারই খুব আদিখ্যেতা। যাকে আদুরে নামে ডাকি অমরি। কিন্তু জানি ও আসলে অমৃতা।

পিঠোপিঠি বলে দুজনকে দুজনের আয়নামূর্তি ভাবা হতো, কিন্তু একটা বয়েস থেকে একটু-একটু টের পাচ্ছিলাম যে আয়নামূর্তির আয়নাটুকুই আমি, আসলটা ও। এই ভাবনাটা কবে থেকে যে একটা অন্তঃশীল ঈর্ষাস্রোতের রূপ নিল আজ আর মনে করতে পারব না। চাইও না মনে করতে। কী আর হবে মনে করে? আসল এবং আয়না দুটোই তো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

তবু বলি, অমৃতাকে আমি খুব, খুব, খুব, খুব, খু-উ-ব ভালোবাসতাম। ভালোবাসা আদায় করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওর। ওকে যখন হিংসে করতাম তার মধ্যেও একটা ভালোবাসা ছিল। এই ভালোবাসার সূত্রপাত খুব ছেলেবেলায়। যখন ওর লেখা রূপকথা আর সেই রূপকথার ছবি দেখে দেখে আমি নিজেও এক মায়াজগতে ঢুকে পড়ছি।

বাবা-মার ইতিহাস, ওঁদের প্রেমে পড়া, বিদেশে সংসার পাতা সংক্ষেপে বলে দেব আমার সংক্ষিপ্ত অমৃতাকথায়; সংক্ষিপ্ত, কারণ আমি বাড়িয়ে, ফেনিয়ে কিছুই বলতে, লিখতে পারি না। না ফেনিয়েও, একটাও মিছে কথা না ঢুকিয়েও অমরি কিন্তু কী ইংরেজি, কী হাঙ্গেরিয়ানে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারত। যখন কিছু লিখছে, ধরা যাক মাকে একটা চিঠি, তখনো সেই মুহূর্তটাকে, সেই মুহূর্তে আশপাশের জগৎটাকে ছবির মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করতে পারত। যেন চিঠিটা ওর সেই মুহূর্তের বাঁচার স্বাক্ষর। যেমন ছবি অাঁকা ছিল ওর বাঁচার আরাম, প্রমাণ, অনুভূতি। ওর মগজ ও হৃদয়ের বহিরঙ্গ।

সে যাক, অমৃতার বড়বেলার ছবির কথায় তো আসতেই হবে কখনো। তার আগে বাবা-মার কিছু কথায়; কিন্তু তার আগে শিশুকালের দুটো-একটা কথা। ওর ও আমার রূপকথাবেলা…

অমৃতার লেখা রূপকথার বইটা আজো যত্ন করে রাখা আছে। একটা নয়, আসলে দুটো। প্রথমটায় লেখাগুলো শুধু হাঙ্গেরিয়ানে। পরেরটায় হাঙ্গেরিয়ান এবং ইংরেজিতে। দুটো বইয়েরই ছবি দেখে কে বলবে মোটে সাত বছর বয়েসের কাজ। আর রূপকথার মধ্যে কোথায় যেন একটা বিষাদের ছোঁয়া। ওই বয়েসে কোথায় পেল মেয়েটা ওই বিষাদের সুর? আগে কখনো এভাবে মনে হয়নি কথাটা, আজ হলো। অথচ ওই ছবি ও লেখা দেখছি আমার শৈশব থেকে।

মা ওর রূপকথার খাতার একটা প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিল। নামকরণ হলো ‘শের-গিল অমৃতা : ওর লেখা ও ছবি। ১৯২০’।

আমার খুব প্রিয় ছিল ওর লেখা দেলিলার গল্প ও কবিতা। সেখানে একটা বনের মধ্যে নীল সরোবরের ধারে বসে দেলিলা কাঁদছে। হঠাৎ এক যুবকের আবির্ভাব হলো, যাকে দেখে দেলিলা বেশ রেগেই গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশ তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল, কী চাও? আমার চোখের জল দেখতে এসেছ? যদি ভালোই না বাসো তাহলে এলে কেন?

যুবকটি ভাবল, এই শীতের রাতে অভুক্ত মেয়েটিকে ছেড়ে যাই কী করে? এই সব ভেবে একসময় ঘুমে এলিয়ে পড়া দেলিলাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়ির এক সুন্দর, শ্বেতশুভ্র ঘরে এক নরম বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর যত্নের সঙ্গে একটা রেশমি চাদর ছড়িয়ে দিলো ওর গায়ে।

গল্পের এখানেই শেষ, বিয়েথা বা তারপর চিরকাল সুখে-শান্তিতে থাকাটাকা নেই। যদিও ওর অন্য সব রূপকথায় শুভবিবাহ ও সুখে থাকার কথা আছে। এই গল্পে বরং একটা ছোট্ট কবিতা আছে শেষে। যার শিরোনাম ‘দেলিলা’।

বনের মাঝে প্রান্তরে এক নীল সরোবর

কিন্তু সেথায় একলা মেয়ে চান করে এক

অন্য জলে,

চাঁদের আলোর ঝরনাতলে।

ছেলেবেলাতেই দেলিলার গল্পটা টেনেছিল খুব। এখন একটা অন্য ছবি ভেসে ওঠে গল্পের দৃশ্যটায়। বনের অন্ধকারে একলা, অভিমানী দেলিলার মধ্যে আমি অমৃতাকে দেখতে পাই। আর – যেটা ভাবলে গা শিরশির করে – মনে হয় ওর বনের অন্ধকারে একলা বসে থাকার কারণ আমি। আমিই তো ওকে এই তো সেদিন রাতের অন্ধকারে সিমলার বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলাম।

না, এবার আমাকে বাবা-মার কথায় আসতেই হচ্ছে। পারি না, পারি না করেও তো কথা বাড়িয়েই যাচ্ছি।

বাবা, উমরাও সিংহ শের-গিলের জন্ম অমৃতসরের নিকটে মজিঠিয়ায় ১৮৭০-এ। ওঁর ঠাকুর্দা অত্তর সিংহকে কিছু গ্রাম দান করে মজিঠিয়ার কর্তা নিয়োগ করেছিলেন মহারাজা রণজিৎ সিংহ। রণজিৎ সিংহেরই সৈন্যবাহিনীতে কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যু হয় অত্তর সিংহের। তখন ওঁর পদে নিযুক্ত হন ওঁর পুত্র সুরত সিংহ। যিনি সাহস ও উদ্যমের সঙ্গে দায়িত্ব বহন করে বাহিনীর সেনাপতি পদে উন্নীত হন এবং ১৮৪৯ সালের সেই বিখ্যাত দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে প্রবল প্রতাপে লড়াই করেন ব্রিটিশদের সঙ্গে।

যখন বেদম আঘাত পান যুদ্ধে ব্রিটিশরা ওঁর ন্যায্য স্বীকৃতি হিসেবে ওঁকে রাজা উপাধি অর্পণ করে এবং তৎকালীন ইউনাইটেড প্রভিন্সেজের গোরখপুর জেলায় বিস্তীর্ণ এলাকার স্বত্ব দান করে। ওঁরই এক ছেলে সুন্দর সিংহ গোরখপুরের সেই জমিতে ভারতের এক বৃহত্তম চিনিকল পত্তন করেন এবং নিজের সারাটা সময় ব্যয় করেন পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটাতে। ওঁর অন্য দুই প্যাশন ছিল শিখ সম্প্রদায়ের স্বার্থে কাজ করে যাওয়া আর ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন।

সুন্দর সিংহের অন্য ছেলে উমরাও সিংহ নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সংস্কৃত, ফার্সি আর উর্দু রচনাবলি অধ্যয়নে। ১৯২০ সালের ১৪ জুনে প্রাচ্যতত্ত্ববিদ আলেক্সান্ডার কেগালকে লেখা এক চিঠিতে তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছেন ভগবদ্গীতা ও যোগদর্শনের ছাত্র হিসেবে। সেখানে আরো লিখেছেন যে, তিনি ওমর খৈয়মের চৌপদী নিয়ে কাজে ন্যস্ত আছেন। ওঁর অন্য এক আগ্রহের বিষয় অপর এক ফার্সি কবি সরমদের রচনা, যে-সরমদকে মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব হত্যার আদেশ দেন।

উমরাও সিংহ চর্চা করেছেন জ্যোতির্বিদ্যা, যোগ, লিপিকরণ এবং দারুশিল্প। ছিলেন জাতীয়তাবাদী, উর্দু কবি মহম্মদ ইকবালের বন্ধু, যদিও ইকবালের বিশ্বকে ঐসলামিক করার ধ্যানধারণার সঙ্গে সহমত ছিলেন না। ভক্ত হয়েছিলেন লিও টলস্টয়ের, বরণ করেছিলেন নিরামিষ ভোজনের আহারনীতি এবং বর্জন করেছিলেন মদ্যপান।

সর্বোপরি উমরাও ছিলেন এক অতিদক্ষ ও চরম উৎসাহী ফটোগ্রাফার। নিজের তোলা নিজের ছবির সংখ্যা আশির ওপরে। নিজের চেহারা-চরিত্র-মনোভঙ্গি এত সুন্দর ধরা আছে সে-সব সেলফ পোর্ট্রেটে যে আলোকচিত্রগুলোকে চিত্রশিল্পের অন্তর্গত বলে মনে হয়। ফটোগ্রাফির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি আরেকটা স্বতন্ত্র কাজ করেছিলেন উমরাও। তিনি ডজনখানেক অটোক্রোম করেছিলেন সেকালে, যার সামান্য কিছু নমুনা আজ পাওয়া যায় ভারতে। অটোক্রোম হলো কাচের ওপর তোলা কালার পজিটিভ ছবি।

উমরাও সিংহের পিতার মৃত্যু হলে ব্রিটিশরা ওঁকে এবং ওঁর ভাইকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিল। অতি অল্প বয়েসেই উমরাওয়ের বিয়ে দেওয়া হলো ক্যাপ্টেন গুলাব সিংহ নামের এক ক্ষমতাবান শিখ পুরুষের কন্যার সঙ্গে। সে-বিয়েতে চারটি সন্তানও হলো উমরাওয়ের। তার পরই ওঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটল এবং উচ্চতর পাঠের জন্য উমরাও পাড়ি দিলেন লন্ডন। এবং সেখানেই ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ঘনিষ্ঠতা হলো মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহের প্রবাসিনী প্রপৌত্রী রাজকুমারী বাম্বা সোফিয়া জিন্দান দলীপ সিংহের সঙ্গে। সংক্ষেপে প্রিন্সেস বাম্বা। সে এক কাহিনি বটে, আর এই সূত্রেই শেষ অবধি সাক্ষাৎ, সোহাগ ও মিলন হলো উমরাও সিংহ শের-গিল ও মারি অাঁতোয়ানেত গোটেসমানের। সংক্ষেপে অমৃতা এবং আমার বাবা ও মার।

প্রিন্সেস বাম্বার পরিচিতিটা, না বলে উপায় নেই, বেশ চাঞ্চল্যকর। ওঁর এবং উমরাওয়ের সাক্ষাৎ ও সম্পর্কও গল্পের বস্ত্ত। যে-গল্পটা বলাও দরকার।

প্রিন্সেস বাম্বা ছিলেন রঞ্জিৎ সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র দলীপ সিংহের কন্যা। যাঁকে সিংহাসনে বসানোর জন্য ওঁর মা রানি জিন্দানকে তদারকির ভার দেওয়া হয়েছিল যতদিন না দলীপ প্রাপ্তবয়স্ক হন।

রানি জিন্দান বেশ রঙিন চরিত্র ছিলেন এবং তাঁকেও বাগে আনতে ১৮৪৬-এর ভৈরোয়াল চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। একটা কাউন্সিল অফ রিজেন্সি স্থাপনা করে রাজ্যের রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয় হেনরি লরেন্সকে। ছেলের সঙ্গে দেখা করারও অনুমতি ছিল না গৃহবন্দি জিন্দানের। দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর দলীপকেও সিংহাসনচ্যুত করা হলো এবং ইংরেজরা সরাসরি পঞ্জাব অধিকার করল।

দলীপকে এই সময় পাঠানো হয় কানপুরের কাছে এক খ্রিষ্টান মিশনারি অধ্যুষিত নগর ফতেগড়ে। সেখানে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিতও হন দলীপ। ইতিমধ্যে ব্রিটিশরা গুজব ছড়ানো শুরু করে মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহ যৌন সম্পর্কের পক্ষে অক্ষম ছিলেন এবং দলীপ হলেন রানি জিন্দান ও এক গরিব ভিস্তিওয়ালার সন্তান। এহেন এক পরিস্থিতিতে দলীপ পালিয়ে আশ্রয় নেন কাঠমান্ডুতে।

দলীপ ধর্মান্তরিত হওয়ায় ব্রিটিশরা বেশ নিশ্চিন্ত হলো, কারণ একজন বিধর্মীর পক্ষে স্থানীয় শাসক হওয়ার সুযোগ রইল না। তবু ওঁকে উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন যেতে দেওয়ায় আপত্তি ছিল সাহেবদের। পাছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে বসেন!

কার্যত সেটাই হলো, কারণ লন্ডন গিয়ে অচিরে মহারানির নেকনজরে পড়লেন দলীপ। সব রাজকীয় ভোজে ওঁর আমন্ত্রণ আসতে লাগল ব্রিটিশ রাজপুরুষদের ওজর-আপত্তি সত্ত্বেও। অধিকন্তু রাজপরিবারেরই ক্ষুদ্র বৃত্তের মধ্যে ওঁকে টেনে নিলেন রানি। পরিবারের বালক-বালিকাদের সঙ্গে দলীপ খেলছেন তেমন দৃশ্যের বেশ কিছু স্কেচ করলেন ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স অ্যালবার্ট ওঁর পোর্ট্রেট তুললেন ক্যামেরায়।

মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহের থেকে কেড়ে নেওয়া প্রবাদপ্রতিম কোহিনূর হিরেটাও দলীপকে ফেরত করতে চেয়েছিলেন রানি। দলীপ দরাজদিল হয়ে সেটি তাঁকে ফিরিয়েও দেন। আরো অনেকখানি এগিয়ে দলীপ এক গণ্যমান্য বিলিতি সাহেব হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে জমিদারি করায় অভ্যস্ত হলেন, স্কটিশদের মতো কিল্ট পরা ধরলেন এবং থেকে থেকেই বেড়াতে গেলেন কন্টিনেন্টে। অতঃপর ১৮৬৪-তে কায়রোর এক মিশনারি স্কুলের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে বিয়ে করলেন এক আধা-জার্মান, আধা-ইথিওপীয় যুবতীকে, নাম বাম্বা মুলার, যে বলতে পারত শুধুই আরবি। এই যুগলেরই এক কন্যা বাম্বা, যার সঙ্গে লন্ডনে বন্ধুত্ব হলো উমরাও সিংহের।

এর কিছু পরেই ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয় দলীপের। যার সূত্রপাত ইন্ডিয়া অফিসের সঙ্গে টাকাকড়ি নিয়ে বিবাদ। তখন থেকে রানি ভিক্টোরিয়াও দূরত্ব রচনা শুরু করলেন ওঁর সঙ্গে। ১৮৮৬-তে দলীপ স্থির করেন ভারতে ফিরে শিখ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব পুনরাধিকার করবেন। কিন্তু ফেরার পথে এডেনে তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশরা। তখন পরিবারবর্গকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে তিনি প্যারিসে গিয়ে এক ব্রিটিশবিরোধী গুপ্ত আন্দোলনে শরিক হন। তাঁর স্ত্রী রাজকুমারী বাম্বার মৃত্যু হয় ইংল্যান্ডে এবং দলীপ নিজে মস্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন ফ্রান্সে। রানি ভিক্টোরিয়া অবশ্য দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস-এ ছুটিতে যাওয়ার ফাঁকে একবার ওঁকে দেখতে যান। এবং  ১৮৯৩-এ মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের এলভডেনে ওঁর সমাধি হলে ফুলের স্তবক পাঠান।

এই দলীপ সিংহের কন্যা, দ্বিতীয় প্রিন্সেস বাম্বা দিনে দিনে এক আকর্ষক যুবতী হয়ে উঠলেন। গানবাজনার প্রতি ভীষণ টান। আর লন্ডনে দেখা হতে টান তৈরি হলো সুদর্শন পঞ্জাবি যুবা উমরাও সিংহের প্রতি।

এ তো গেল লন্ডন পর্ব। এর কিছুদিন বাদে প্রিন্সেস বাম্বা লাহোর এলেন, মনের সুপ্ত বাসনা উমরাওকে বিবাহ করবেন। কিন্তু রাজকুমারীর মন্দ কপাল, তিনি সফরসঙ্গিনী করে আনলেন লন্ডনে পরিচয় হওয়া এক হাঙ্গেরীয় গায়িকাকে, যার চোখকাড়া চেহারা আর মনকাড়া গুণাবলির ফাঁদে পড়লেন উমরাও। পিয়ানো বাজিয়ে গায়িকার গান শুনে তো উমরাও আত্মহারা এবং অচিরে প্রেমে হাবুডুবু।

ওই সফরেই বিয়ে হলো সেই মেয়ে ও উমরাওয়ের। শিখ আচারে চার হাত মিলল লাহোরে। তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২। মারি অাঁতোয়ানেত গোটেসমান হয়ে গেল মারি অাঁতোয়ানেত শের-গিল। আর এর বছর দুয়েকের মধ্যে অমৃতা ও আমার মা।

মারি অাঁতোয়ানেতের ঠাকুর্দা আদল্ফ গোটেসমান বড়লোকের ছেলে, কাজ করতেন অস্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীতে। ওঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন ফরাসি, থাকতেন ভিয়েনায় এবং অল্পবয়সেই মারা যান। তখন আদল্ফ দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। সেই দ্বিতীয় জন ওলন্দাজ। সেই দ্বিতীয়ারও মৃত্যু ঘটলে আদল্ফ বিবাহ করেন এক হাঙ্গেরীয় মহিলাকে। এই তিন স্ত্রীর গর্ভের যে সব  সন্তান তাদের মধ্যে সম্পর্ক, বলা বাহুল্য, ছিল জটিল ও সমস্যাকুল। আদল্ফের ফরাসি গৃহিণীর পুত্র লুই কাজ করত এক বিমা কোম্পানিতে এবং শোনা যায়, নিজের হাতে প্রাণ নিয়েছিল।

লুইয়ের মা এসেছিলেন এক সুখ্যাত ফরাসি পরিবার থেকে। সেই পরিবার, মারতঁ লেভি, বলতে গেলে এক ডাকেই পরিচিত ছিল; লুইয়ের মার গানের গলা এবং পিয়ানোর হাত ছিল অপূর্ব। যা লুইয়ের কন্যা মারি অাঁতোয়ানেতে এসে নবোদ্যমে প্রকাশ পেল।

মারি যখন সংসারে এলো ততদিনে পরিবারের বড়লোকি হাল উবে গেছে, তবু বাবা ও মা ওর শিক্ষাদীক্ষায় কোনো কার্পণ্য করেননি। যে-শিক্ষার মধ্যে গান ও পিয়ানো ছিল। যেহেতু মারির বাসনা ছিল অপেরা গায়িকা হবে, তাই সেই চর্চার জন্য ওকে ইতালিও পাঠানো হলো। শেষ অবধি ও অপেরা গায়িকা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওই সব ট্রেনিংয়ের দাক্ষিণ্যে একটা দুর্ধর্ষ কণ্ঠস্বর ও শৈলী রপ্ত করেছিল। সেই সঙ্গে হাঙ্গেরিয়ানের পাশাপাশি চমৎকার ইতালীয় বলার দক্ষতা।

লুইয়ের সন্তান-সন্ততির মধ্যে মারিই ছিল বয়োজ্যেষ্ঠা, সর্বকনিষ্ঠ এরভিন বাকতায়, যে পরে নামজাদা ভারততত্ত্ববিদ ও চিত্রকর হয়েছিল। আর অন্য দুই বোন ছিল ব্লাঙ্কা ও এলা। এছাড়াও এক ছেলে ছিল যে মার্কিন দেশে গিয়ে থেকে গিয়েছিল। সব ভাই-বোনই প্রায় রকমারি গোত্রের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। মারি যেমন বিয়ে করল এক শিখকে; ব্লাঙ্কা বিয়ে করল আইরিশ রক্তের ভিক্টর এগানকে। (যারই ছেলে আরেক ভিক্টর এগানকে জীবনসঙ্গী করেছিল অমৃতা) এবং এরভিন বাকতায় বেশি বয়েসে এক হাঙ্গেরীয়কেই বিয়ে করে তার নাম বদলে রাখলেন অদিতি। সংস্কৃতিতে যার মানে দাঁড়ায় চিরকালীন।

অমৃতার জন্মের পাঁচ বছর পরে ওকে আর আমাকে রোমান ক্যাথলিক হিসেবে ব্যাপ্টাইজ করা হলো। মা নিজে গির্জায় প্রায় যেতই না, কিন্তু ওঁর একটা ভয় ছিল। ভয়টা হলো দৈবাৎ আমাদের কারো মৃত্যু হলে ভদ্রভাবে কবর দেওয়া যাবে না। কারণ দীক্ষিত না হলে ওটা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

১৯১৮-র ১৭ নভেম্বর আমাদের ব্যাপ্টিজম হলো। তাতে শিখদের পবিত্র শহর অমৃতসরের যে-নামকরণ দিদির হলো, সেই অমৃতা নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো আন্তোনিয়া। যদিও আইনি কাগজপত্রে ওর ইন্দো-হাঙ্গেরীয় নামটা বহাল রইল – অমৃতা দালমা। সেখানে অবশ্য বাবা উমরাও সিংহের পরিচয়ে জানানো হয়েছে ‘ধর্মবিশ্বাসহীন’। জানানো হয়েছে, তিনি মজিঠিয়ায় বসবাসকারী এক ব্রিটিশ নাগরিক। বাবার এই দ্বিবিধ পরিচয়পত্র প্রমাণ করে শের-গিল পরিবার কী সাঙ্ঘাতিক সংকটের ভেতর দিয়ে এদেশ-ওদেশ হয়ে ঘুরে মরেছে। এই লুকোচুরির জীবন থেকে অমৃত মন্থন করেই হয়তো অমৃতা ভেসে উঠেছিল, কে জানে!

যা বলেছিলাম তাই করলাম। সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দিলাম পরিবারের সঙ্গে। এখন বরং আমরা দেশে পাড়ি দিই। নেই নেই করে দশ-দশটা বছর তো কেটে গেল হাঙ্গেরিতে। বাবা ভারতেই ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তু বাদ সাধল ব্রিটিশ সরকার। বলল, যুদ্ধের সময় বাবা বিদেশে বসবাসকারী সন্দেহভাজন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে যোগ রাখত। তাই দেশের মাটিতে পা রাখা নিষেধ।

বহুত কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ অবধি ভারতে আসার অনুমতি পাওয়া গেল। কাকা সুন্দর সিংহ তখন ভাইসরয়ের ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। ওঁকে মেটাতে হলো তাবৎ ঝঞ্ঝাট। এবং অবশেষে, ১৯২১-এর ২ জানুয়ারি আমরা জাহাজে চড়লাম ভারতের পথে, আর মাঝখানে অল্প দিনের জন্য নামলাম প্যারিসে।

যেখানে অমৃতার প্রথম সাক্ষাৎ, ‘মোনা লিসা’ দর্শন হলো।

 

তিন

বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম ‘মোনা লিসা’র সামনে। মার কাছ থেকে পাওয়া ছাপা ছবিতে কতবার দেখা হয়েছে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে স্বয়ং মানবী দর্শন হচ্ছে। মাফ করবেন, ছবির মধ্যে ঢুকলে আমার অতীত, বর্তমান সব লুপ্ত হয়। বর্তমানের মধ্যেও একটা ‘এই মুহূর্ত’, ‘এই ক্ষণ’ আছে, আমি তাতে স্তব্ধ হয়ে থাকি।

এক্ষণ ‘মোনা লিসা’ আমার সামনে। আমি এক লাফে দিব্যি বড় হয়ে গেছি। সববাই মহিলার রহস্য নিয়ে ভাবে, আমি ভাবছি ওই হাসি ফোটানোর করণকৌশল নিয়ে। রঙের প্রলেপ নিয়ে। সামান্য সংযোজনায় ইতালির পরিবেশ ও আবহাওয়া রচনায়। মহিলার পোশাক ও চুলের রঙের মধ্যে একটা ভারসাম্য ও দোলনে। সর্বোপরি ওর চাহনিতে এক স্নিগ্ধতার আভাস। আমি সমানে ভেবে চলেছি কাউকে অাঁকতে গেলে তাকে কতখানি দেখা ও বোঝার দরকার। যাকে অাঁকা হচ্ছে তার সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক কী রকম ও কতখানি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এবং কোনো কোনো মুহূর্তে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পী ও তার বিষয় অভিন্ন? এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে?

‘মোনা লিসা’ ছাড়াও আমার অনেক সময় কাটল লুভ-এ। অনেক সময় কাটল প্যারিসের অপেরায়, থিয়েটারে, জাদুঘরে। প্যারিসের সীমিত সময় দেখতে-দেখতে ফুরিয়ে গেল। আমরা দক্ষিণ ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরে গিয়ে এসএস মালভা জাহাজে গিয়ে চড়লাম। ওই জাহাজেই অষ্টম জন্মবার্ষিকী পালন হলো।

একটা বড় কেক সাজানো হয়েছিল আটটা মোমবাতি দিয়ে। কুচবিহারের মহারানিও সেই জাহাজে ছিলেন তাঁর মেয়েদের নিয়ে। সে ভারি ফুর্তির সময় সেদিন। সববাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে আমার কী আহ্লাদ সেদিন। স্পষ্ট মনে পড়ে।

ভারতে বম্বে-দিল্লি হয়ে আমরা অবশেষে সিমলায় আমাদের নতুন আস্তানা ‘দ্য হোমে’ এসে উঠলাম। মাকে বিয়ে করে হাঙ্গেরি রওনা হওয়ার সময় বাবা ওঁর প্রথমা স্ত্রীর সন্তানদের সর্দারনগরের সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিল। কাজেই নতুন ঘরের ব্যবস্থা করতেই হচ্ছিল। তা যে শেষ অবধি সিমলায় এসে ঠেকল এ এক মস্ত সৌভাগ্য। r (চলবে)