শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
চতুর্থ কিস্তি
হাঙ্গেরির দুনাহারাস্তিতে এক অদ্ভুত নিসর্গের মধ্যে ছিলাম আমরা, তেমনই এক অপূর্ব নিসর্গ সিমলার। উপরন্তু মা ‘দ্য হোম’কে নতুন নতুন কার্পেট, আসবাব, ছবি দিয়ে সাজিয়ে আমাদের লাইফস্টাইলকেই আনকোরা নতুন করে ফেলল। থিয়েটার-টিয়েটার যাওয়া, এবাড়ি-ওবাড়ি ডিনার, বড়-বড় পরিবারের সঙ্গে ওঠাবসা তো ছিলই, তার সঙ্গে টক্কর দিয়ে চলল মার গৃহোন্নয়ন।
মার গৃহ বলতে শুধু বাড়িই নয়, তার দুটি কন্যারত্নও। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর বাড়ির শোভা আমি ও ইন্দুও। আমাদের পিয়ানো ও বেহালা শেখানোর ব্যবস্থা হলো। আর আমাকে ছবি অাঁকা শেখানোর জন্য এক বিলিতি শিক্ষক নিয়োগ করা হলো; কদিন যেতে না যেতেই বুঝে গেলাম ওঁর কাছে কিছু শেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভদ্রলোকের নাম মেজর হুইটমার্শ। আর ওঁর কাজ ছিল একই জিনিস আমাকে দিয়ে বারবার, বারবার অাঁকানো। আমি বুঝলাম এ অসম্ভব, এঁকে ভাগানো দরকার।
আমার পরের শিল্প শিক্ষক হলেন সদ্য লন্ডনের স্লেড স্কুল অফ আর্টের চাকরি ছেড়ে আসা এক ফ্যাশানদুরস্ত শিল্পী, হ্যাল বেভান পেটম্যান। ভদ্রলোকের বিশেষ পরিচিতি এটাই যে, তিনি সমাজের সৌখিন, কেতাদুরস্ত মহিলাদের পোর্ট্রেট বানাতেন আর নামী পরিবারের ছেলেমেয়েদের অাঁকা শেখাতেন। ওঁর স্টুডিয়োর পরিবেশটা আমার পছন্দ ছিল, তাই অনেকটা করে সময় কাটিয়ে দিতাম ওখানে।
একটা ব্যাপারে অবিশ্যি মেজর হুইটমার্শের সঙ্গে মিল পেলাম আমার নতুন শিক্ষকের। প্রথম জনের মতো এঁরও যত ঝোঁক ড্রইংয়ের ওপর। বলতেনও, জানিস অমরি, এই ছবি অাঁকাঅাঁকির আসলটাই হলো ড্রইং। তারপর নিজের হাতের ওপর টোকা মেরে বলতেন, ছবির অস্থিমজ্জা।
দুজনের অমিলটা অন্যখানে – অ্যাপ্রোচে। হুইটমার্শকে একটা ড্রইং করে দেখালেই বলতেন, বাহ্, বেশ হয়েছে। তখন হয়তো বললাম, এবার কী অাঁকব? অমনি বললেন, না না না, অন্য কিছু না। ওটাই ফের করে দেখাও।
বাধ্য হয়েই বললাম, কেন এটা কি ভালো হয়নি? তখন বললেন, অবশ্যই ভালো হয়েছে।
বললাম, তাহলে?
তখন চুরুটে দম দিয়ে বললেন, প্র্যাকটিস মেকস পারফেক্ট। অনুশীলনই কাজকে নিখুঁত করে।
অগত্যা…
পেটম্যানের এই ব্যাপারটা ছিল না। ড্রইং, ড্রইং করে পাগল ঠিকই, কিন্তু ভালো একটা ড্রইং দাঁড় করালে প্রতিক্রিয়াটা একেবারে আলাদা। বলবেন, চমৎকার!
আমি হয়তো বললাম, এটাকে কি তাহলে রং করব?
ওঁর জবাব হতো, মেয়েটির নিশ্চয়ই একটা বান্ধবী আছে। এবার তাকে অাঁকো।
অাঁকলাম।
তখন বললেন, ধরো ওরা একটা মেলায় যাচ্ছে। তখন কী পোশাক পরবে?
ভেবেচিন্তে তাও এঁকে দিলাম।
তখন পেটম্যান স্যার বললেন, ওয়াও! এই তো চাই। এবার তুমি ওদের গায়ে, পোশাকে রং দাও।
একবার মা জানতে চাইল, কেমন বুঝছেন ওকে?
পরে শুনেছিলাম স্যার বলেছেন, ও তো শিল্পী হয়েই জন্মেছে। একেকটা লাইনেই একেকটা ফর্ম ফেঁদে ফেলছে। ওকে ঠিকঠাক এগোতে দিলে দারুণ শিল্পী হবে।
এর অনেক বছর পর, বয়েস যখন ছাবিবশ, ফিরে এসেছি প্যারিসের বোজারে অাঁকা শিখে, প্রদর্শনী করছি লাহোরে, স্যারকে আমন্ত্রণ করেছিলাম চা-এ। চা খেতে খেতেই দেখাচ্ছিলাম আমার ছবি। উনি তো দেখেন আর অবাক হন, আর সমানে বলতে থাকেন, কী কান্ড করেছিস, অমরি! বললাম, কেন, কী করলাম স্যার?
পেটম্যান স্যারও আমাকে মুগ্ধ করে দিয়ে বললেন, কী অরিজিনাল! কী মডার্ন!
আমার কাজে লোকের অবাক হওয়াটা এক সময় গা-সওয়া হয়ে গেছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে আমার বিস্ময়ের ঘোর কোনোদিনই কাটেনি। বুদাপেস্ত, দুনাহারাস্তি, সিমলা, প্যারিস বুঝলাম, কিন্তু এরই মধ্যে, এই তিরিশ বছরেরও কম জীবনে একটা ইতালীয় পর্বও সেঁধিয়ে আছে। আর কী করে সেটা ঘটে পড়ল সেটাও কিছু কম বিচিত্র নয়।
সেই বয়েসে, মাত্র এগারো বছর তখন, বুঝিনি যে, মার সঙ্গে আমার আর ইন্দুর ইতালিযাত্রার পেছনে মার এক প্রেমে পড়ার ঘটনা আছে। বলা যায় মারও জীবনে সেটা এক ইতালীয় পর্বই। সে-পর্বে যেতে গেলে একটা আলোকচিত্রের দিকে নজর ফেললে কাজে দেবে। ছবিটা সিমলায় বাবার তোলা।
সে-ছবিতে আমি ও ইন্দু আছি, মা আছে, আমার আর ইন্দুর দুটো আবক্ষ মূর্তি আছে, ক্লে মডেলে – আর একধারে সে মূর্তির শিল্পী, পাস্কিনেলি। মার প্রেমিক। আমার বিশ্বাস, শিল্প-শিক্ষার কারণ দেখিয়ে মা যখন আমাদের নিয়ে পাস্কিনেলির সঙ্গে ফ্লোরেন্স গেলেন, তখন বাবাও সঠিক জানত না ইতালীয়র সঙ্গে মার সম্পর্কটা কদ্দুর কী।
আমাদের সংসারে তরুণ ইতালীয় ভাস্কর জুলিয়ো চেসারে পাস্কিনেলির আবির্ভাব ১৯২৩-এ। পাতিয়ালার মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহের দ্বারা রাজ্যের সভাভাস্কর নিযুক্ত হয়ে ওঁর ভারতে আসা। সে বছরই সিমলা এলেন ভদ্রলোক ওঁর পাথরের আবক্ষ-মূর্তির প্রচারে। এসে তো সপ্তম স্বর্গে তিনি মার সঙ্গে প্রাণ খুলে ইতালীয় বলতে পেরে। মাও সেই সুযোগে ওঁকে কমিশন করে বসল আমার আর ইন্দুর মূর্তি করে দেবার জন্য। সেইসঙ্গে নিজেরও একটা বাস্ট। এসবের মধ্যে কখন যে ওদের অতটা ভালোবাসা গড়ে গিয়েছিল কেউই খুব একটা টের পায়নি।
আমাদের ইতালিযাত্রায় বাবা সঙ্গে ছিল না। বাবা যে আমার জীবনে কতখানি তার অাঁচ পেলাম যখন বাবা – আমার প্রিয় আপুকা – বন্দরে এলো আমাদের জাহাজে তুলে দিতে। ওহ্, কী কষ্ট! কী কষ্ট! বুক সমানে মুচড়োচ্ছে যখন আপুকা আমাদের জাহাজে রেখে চলে গেল আর জাহাজ বন্দর ছাড়ল। কিছু সময়ের মধ্যে আমরা শুধু আমাদের প্রিয় ভারতের তটরেখাই দেখতে পাচ্ছি, সে-তটের কোথাও একটা দাঁড়িয়ে আপুকা দেখছে আমাদের জাহাজ দিকপ্রান্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলোই ২৩ মার্চ, ১৯২৪, লিখেছিলাম আমার ডায়েরিতে। যদিও জাহাজে চড়ার তারিখটা ছিল ১৫ জানুয়ারি, ১৯২৪।
আমরা ইতালির জেনোয়াতে গিয়ে নামলাম আঠারো দিন পর, ২ ফেব্রুয়ারি। সেখান থেকে ফ্লোরেন্স গিয়ে আমাদের অনতিকালে ভর্তিও করা হলো সান্তা আনুনচিয়াতা পাজ্জো ইম্পেরিয়াইয়ন স্কুলে। একটা বিশাল বড়, চমৎকার আদবকায়দাসম্পন্ন এবং আমার চোখে, এক জঘন্য স্কুল। মা যে কোন বুদ্ধিতে, কী স্বার্থে, দেশ থেকে আমাদের টেনে এনে এখানে ছুড়ে ফেলল, আমার বুদ্ধিতে খেলল না। মা এবং ওই রোমান ক্যাথলিক স্কুল দুইয়েরই বিরুদ্ধে আমার বিদ্রোহ শুরু হলো। জানি না সেই থেকেই মার সঙ্গে আমার ভালোবাসা আর ঘৃণার সম্পর্ক জারি হলো কিনা। ধর্মের বিরুদ্ধে মতির উৎপত্তি, বলা বাহুল্য, ওই থেকেই।
ইস্কুল যে আমার ওপর ক্ষেপে উঠল তার কারণ অতি সরল – আমি একটা ন্যুড এঁকেছিলাম!
তাতেই বুঝি গোটা বাইবেল অশুদ্ধ হয়ে গেল। আমায় ডেকে শুধোনো হলো, এর মানে কী?
বললাম, সিস্টার, ছবির আবার মানে কী? যা দেখছেন তাই।
তিনি বললেন, এটা কি একটা দেখার জিনিস?
বলতেই হলো, একটা ছবি থেকে যে-যার মতো মানে করে নেয়, তাই না?
তিনি বললেন, এ-ছবি থেকে আমি যা মানে করছি সেটা তোমার পক্ষে খুব একটা সুখের হবে না।
কী এক রোখ চেপে গিয়েছে তখন, বলে দিলাম – আমার কিন্তু সুখ হয়েছে ছবিটা এঁকে। আমি তাতেই খুশি।
ছবিটা টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘর এবং আমার জীবন থেকে গটগট করে বেরিয়ে চলে গেলেন সিস্টার।
সে তো গেলেন, ফ্লোরেন্সে কিছুকাল থাকার পরই আমাদের জীবন থেকে পাস্কিনেলিরও হটে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলো। যার একটা কারণ আমি।
মা যে কিছুটা টের পাচ্ছিল না, তা নয়। বিশেষ করে আমার ছবি শেখাটা যে প্রায় চুলোয় যাচ্ছে সেটা ইস্কুলে অাঁকা ছবির চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছিল। আমি কী ছবি অাঁকতে পারি, অাঁকতে চাই, মা জানত। আর দেখতে পাচিছল ইস্কুলেই বা কী মক্শো করানো হচ্ছিল।
মা একটু লজ্জাতেই পড়েছিল। কারণ আমাদের ইতালিতে আনাই হয়েছিল ইতালীয় ভাষা শেখানো আর রেনেসাঁস শিল্পের সঙ্গে পরিচয় করানোর বাহানায়। ভাষা শেখাটা হয়েই যাচ্ছিল আর ইস্কুলে হাবিজাবি অাঁকাঅাঁকি হলেও রেনেসাঁসের মাস্টার অাঁকিয়েদের শহর ফ্লোরেন্স এক অন্য পথে আমাকে ভরিয়ে তুলছিল। শিল্পের শহরে চলতে-ফিরতে রেনেসাঁসের মুখোমুখি হচ্ছিলাম। মনকে বোঝাচ্ছিলাম, চুলোয় যাক সান্তা আনুনচিয়াতা, এই তো আমার ইস্কুল।
ব্যাপারটা যে কত ভেতরে ঢুকেছিল তা স্পষ্ট হলো পরে যখন প্যারিসে কাজ শিখছিলাম। ফরাসি মেজাজে, ফরাসি আবহাওয়ায় কাজ করছি অথচ কাজের মধ্যে কোথায় একটা ইতালীয়। হঠাৎ একদিন একজন আমার ছবি দেখে উগরেই দিলেন, আরে, এ তো দেখছি ভেনিসীয়দের বংশধর।
যা-ই হোক, ফ্লোরেন্সে থাকাটা যে সুখের হচ্ছিল না তার একটা কারণ যদি হয় ইস্কুল তো অন্য কারণ আমাদের থাকার ব্যবস্থা। তৃতীয় একটা কারণ অবিশ্যি দ্রুত মা ও পাস্কিনেলির ভালোবাসা চটকে যাওয়া। এই তৃতীয় কারণটাই টুক করে আগে বলে নিই।
টুক করে বলতে হলো কারণ জুলিয়ো চেসারে পাস্কিনেলির সঙ্গে মার প্রেমটেম তো ওই বয়েসে ধরতে পারিনি সেভাবে, কিন্তু ফ্লোরেন্সে নামার কিছুদিন পর থেকে ওদের ছাড়া-ছাড়া ভাবটা চোখে পড়ছিলই। জানি না, মা ওখানে পৌঁছেই প্রথম জানল কিনা লোকটার ফ্লোরেন্সে একটি বউ ও কটি ছানাপোনা আছে।
এ্যহস্পর্শ! একে ওই ইস্কুল, তার ওপর এক কিম্ভুত প্রকৃতির বাড়িউলি, তাতে তিন নম্বর ধাক্কা মার পিরিতের পুরুষ পাস্কিনেলি। মার লাতিন প্রেমিক বিদেয় হতে আমাকেও ইস্কুল থেকে তুলে নেওয়া হলো। বাঁচলাম।
বাঁচলাম বলে বাঁচলাম! যে-পেনসিওনেতে উঠেছিলাম আমরা, সে তো দান্তের নরক হয়ে উঠছিল। ডায়েরিতে বাবার উদ্দেশে কান্নাকাটি জুড়ছিলাম আর মার কষ্ট-দুঃখ দেখে নিজের মনের কষ্টগুলো সবিস্তারে নোট করছিলাম। একটু আগে বলছিলাম প্যারিসের লুভর-এ ‘মোনা লিসা’র সামনে দাঁড়িয়ে ধাঁ করে বড় হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো শিল্পের ভাবনাচিন্তায়। কিন্তু ফ্লোরেন্সের ইস্কুলে রোমান ক্যাথলিকদের ইস্পাতকঠিন নিয়মযন্ত্র এবং আমাদের বাড়িউলি ওই পাগলি সিনিওরা সান্দ্রিনেলির উৎপাতে মার দিশেহারা দশা আর চোখের জল আমাকে আমার বয়েসের চতুর্গুণ বড় করে দিচ্ছিল। যে-মনের কষ্ট আমার অনেক ছবিরই অন্তর্লীন সুর হয়েছিল কালে কালে।
আগে বাবাকে লেখা কথাগুলো শোনাই। লিখেছিলাম…
প্রিয়, মিষ্টি আপুকা, প্লিজ চলে এসো যত্তো তাড়াতাড়ি পারো, কারণ তোমার কথাই তো আমরা সারাক্ষণ ভাবি, তাহলে কেন তুমি আমাদের কাছে এসে যাচ্ছ না? তোমাকেই তো চাইছি আমি এখন। তোমাকে এক হাজারটা চুমু দিলাম – তোমার আদরের অমৃতা। সূর্যটা কী সুন্দর চকচক করছে। তুমি এসে পড়ো, আমরা একসঙ্গে চান করব। তোমাকে চকোলেট পাঠাতে চাই, যদি না যেতে যেতে গলে যায়।
আবার একবার লিখলাম…
আমার মিষ্টি আপুকা, তাড়াতাড়ি চলে এসো, তোমার জন্য বড় মন খারাপ করছে। কারণ তুমি কাছে নেই আর তুমি আসছও না। ভীষণ মন খারাপ হলো মা যখন তোমার দ্বিতীয় চিঠিটা এনে পড়াল। এত কষ্ট হলো যে কেঁদেই ফেললাম। তোমার মেয়ে তোমাকে হাজার বার চুমু দিলো। অমৃতা। আপুকা, প্রিয় আপুকা, প্রিয় আপুকা, যত তাড়াতাড়ি পারো এসে যাও। প্লিজ!
এখন, এতদিন পর মনে হয় আমার চিঠিগুলোতে শুধু আমার নয়, মার কান্নাগুলোও লুকিয়ে থাকত। আমার মুচিকা, থুড়ি, মা ফ্লোরেন্সের দিনগুলোতে আমার আর ইন্দুর কাছে এক দেবী হয়ে উঠেছিল। ফ্লোরেন্সের স্মৃতির মধ্যে মুচিকার অনেক কান্নার ছবি আছে; তার একটা তুলে দিচ্ছি…
এক সন্ধ্যায় মা আমাদের অপেরা দেখাতে নিয়ে গেল। কী এক আশ্চর্য সন্ধ্যা সেটা! অপেরার শেষ দিকে তো চোখে জল এসে গেল। তখন কে বুঝেছে আরো কান্না জমা আছে রাতের জন্য!
যখন ঘরের দোর দিতে না দিতেই সিনিওরা সান্দ্রিনেলি নামের ভয়ংকরী কোত্থেকে দুদ্দাড় করে ছুটে দড়াম দড়াম করে দরজায় পিটতে লাগল। মা তো ভয়ে কাঠ, কী আবার ঘটল হে যিশু! কবাট খুলতেই দেখা গেল হাত-পা ছুড়ে কী তার নেত্য আর চেঁচানি। সমানে ইতালিয়ানে খিঁচিয়ে যাচ্ছে – ভা ভিয়া ভাই আল্লা তুয়ে ইন্ডিয়া কন লা তুয়া কাসাপাঙ্কা। যাও বেরোও, আর ওই লজ্ঝড় ফার্নিচারটা নিয়ে ভারতে ফেরত হও।
ভাবা যায়, আমাদের ওই প্রিয় পুরনো পিয়ানোটাকে শ্রীমতী ভয়ংকরী বললে কিনা লজ্ঝড় ফার্নিচার!
দেশে ফেরার বাই উঠেছিল বটে আমার। কাঁইমাঁই লেগেই ছিল ইস্কুলের ছবির ক্লাস নিয়ে। একদিন স্পষ্টাস্পষ্টি মাকে শুনিয়েই দিলাম, ছবির যে-টিচার জুটেছে আমার তাতে আর কদিন পর অাঁকার ইচ্ছেটাই ছুটে যাবে।
মা মুখ গম্ভীর করে কথাটা শুনল, চোখে একটা স্বপ্নভঙ্গের হতাশা। দুফোঁটা জলও কি দেখলাম না চোখে?
উঠে এসে মা আমার হাতটা ধরল। তোমার জন্যই তো সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসা। তোমার ভালো না লাগলে আমি কালই দেশের টিকিট কাটব।
মার মুখে দেশের টিকিট কথাটা শুনে ভীষণ ভালো লাগল। অত গুছিয়ে-গাছিয়ে সংসার পেতে সিমলার বাড়িই মার ঘর এখন। আমার হ্যাঁ না কিছুই বলতে হয়নি, পরদিনই মা জাহাজের টিকিটের বন্দোবস্ত করতে গেল।
আমার এই পরের স্মৃতি জাহাজের ডেকে। ডায়েরিতে তারিখটা ধরা আছে ২৫ মে, ১৯২৪। আর কী লিখেছি তাতে?
ডায়েরির সেই এন্ট্রির একটা শিরোনামও দিয়েছিলাম – ‘জাহাজে’।
এখন আমি লোহিত সাগরে ভাসমান জাহাজের ডেকে। একটা ভয়ংকর গরম দিন, সূর্য যেন আগুনের গোলা। কিন্তু ততটা পুড়ছি না, কারণ গোটা জাহাজ ঢেকে রাখা হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাসের চটে।
এইখানে বসে আমি আমার বন্ধু সারোগিনিকে অাঁকব। আমি ওর পাশে ডেকের ওপর শুয়ে ওকে অাঁকছি।
ভারতে নোঙর করে সিমলার জীবনে প্রবেশের আগে আমি আরেকটিবার ক্ষণিকের জন্য ফ্লোরেন্স ফিরব। জাকোমো পুচ্চিনির ওই অমর অপেরা মাদাম বাটারফ্লাইয়ের চোখের জল আনা সন্ধ্যায়। কাহিনিটা গানে গানে সেই যে মাথায় থেকে গেল তা ক্রমে ক্রমে হৃদয়ে স্থান নিল এবং সারাটা জীবন থেকে গেল। কেন? এখন তাও ভাবি। গল্পটা তো এক জাপানি গেইশাকে নিয়ে। যাদের জীবনে কতই তো প্রেম আসে। এই গেইশার প্রণয়ীদের মধ্যে এক মার্কিন জাহাজি এসেছিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন।
প্রণয়ে খাদ ছিল না কারোই। সে-প্রেম থেকে পিছিয়ে আসার কোনো উপায় পায়নি গেইশা যখন মার্কিন প্রেমিক অবিশ্বাসী হয়ে পড়ল। পুচ্চিনির গড়া সুরে সে যেন বিষের জ্বালা। মার বুকের ব্যথাও ভাবি। কত পত্রালাপ মার অমর কম্পোজারের সঙ্গে সংগীত নিয়ে। মাকে নিজের একটা ছবি অটোগ্রাফ করেও পাঠিয়েছিলেন পুচ্চিনি।
আমরা দেশে ফিরে এলাম। তার কিছুদিন পরই দেহরক্ষা করলেন মাদাম বাটারফ্লাইয়ের রচয়িতা। সেই তারিখটাও মা ছবির অ্যালবামে লিখে রাখল : ২৯ নভেম্বর, ১৯২৪। আর তারপর? তারপরটা আরোই অবাক করার…
১৯২৫-এর ১৮ জুন দ্য সিমলা টাইমজে খবর বেরুলো – মাদাম শের-গিলের পুচ্চিনি কনসার্ট আজ সন্ধ্যা সাড়ে নটায় ‘রিঙ্ক’-এ। নটি নিবেদনের মধ্যে থাকছে মাদাম বাটারফ্লাই থেকে আরিয়া।
আরো লেখা হলো : মাদাম শের-গিলের কোনো পরিচয় দানের প্রয়োজন নেই। তিনি মহান পুচ্চিনির শিষ্যা। ওঁকে শোনার মধ্যে প্রভূত আনন্দ, আজ সেটা আরোই বর্ধিত হবে। হল ভেঙে পড়বে।
চার
এর পরেও আরো আছে। দ্য সিমলা মিউজিক ক্লাব ২৬ আগস্ট তাদের প্রোগ্রামে মাকে দিয়ে পুচ্চিনির দুটো গান করাল।
এতে ধারণা হতে পারে, সিমলা ফিরে মা বুঝি মার গান নিয়ে পড়ল। ভুল। মার প্রথম চিন্তা ছিল অমরির পড়াশুনো, মনমেজাজ, স্কুল। ফিরে এসেই ওকে ভর্তি করা হয়েছিল আরেক ক্যাথলিক ইস্কুল দ্য কনভেন্ট অফ জিসাস অ্যান্ড মেরিতে।
স্কুলের নাম শুনেই অমরি বলল, আবার ক্যাথলিকদের জিম্মায় ফেলছ, মা?
মা বলল, কেন সোনা, ক্যাথলিকরা কি অচ্ছুত?
অমরি বলল, ওরা কেন অচ্ছুত হবে, ওদের শাসনের বেড়িতে থাকলে দুনিয়াটাকেই আর ছুঁয়ে দেখা যায় না।
মা কফি বানাচ্ছিল, কফির পটটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল, কেমন শুনি?
অমরি সোফায় বসে ছবি অাঁকছিল। ছবিটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল, এটা একটা যিশুর ছবি। গির্জায় ওঁর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যান্ত্রিকভাবে হাতজোড় করে গান গাওয়ার থেকে এটা কি কিছু কম প্রার্থনা?
মা বলল, আমি তোমার সঙ্গে একেবারে একমত। কিন্তু একটা ভালো স্কুলে তো তোমায় পড়তে হবে।
– কিন্তু স্কুলে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু কিছু না শিখলাম, তো?
ঘরের এক কোণে বসেছিল বাবা, এক গ্লাস দুধ নিয়ে। ওখান থেকেই সিদ্ধান্ত জুগিয়ে দিলো – তাহলে তোমায় স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হবে।
হঠাৎ যেন একটা স্বস্তির পরিবেশ নেমে এলো খাবার ঘরে। মা কফি সার্ভ করা শুরু করল। এই মওকায় বাবা আর মার সম্পর্কে আর দু-একটা কথা শুনিয়ে নিই, পরে কাজে দেবে। অমরি কী বলবে সে অমরি জানে। অনেক পরে ওঁর চোখের মণি অমরির সঙ্গে মার খুব খটাখটি লাগত নানা কারণে। তাতে ওর ধারণা হয়েছিল, মা আমাকে বেশি টানে। আর বাবা? একটা সময়ের পর বাবা অমরির জন্য ক্যামেরা খুলে বসে থাকত ওর ছবির, ওর মুখের একেকটা মুহূর্ত ধরবে বলে। একদিন তো আমাদের প্যারিসের রু দ্য বাসানোর ফ্ল্যাটে আবেগের বসে ওকে ডেকেই বসল, মাই ডিয়ার মোনা লিসা!r(চলবে)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.