পড়ন্ত বাংলাদেশের আখ্যান

তিমিরযাত্রা গল্পকার মোজাফফর হোসেনের প্রথম উপন্যাস। ২০২০ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের প্রকাশক পাঞ্জেরী প্রকাশন। ভালো লাগা এই ব্যতিক্রম উপন্যাসকে ঘিরে আমার কিছু কথা পাঠকদের জানাতে চাইলাম।

উত্তরাধুনিক ধাঁচে লেখা এটা একটি অবশ্যপাঠ্য উপন্যাস। বেশ যত্ন দিয়ে পরিশ্রম দিয়ে সাজানো।

তিমিরযাত্রা এক স্মৃতিনির্মাণ, নাকি চলচ্চিত্রনির্মাণ! যেন সাদা দেয়ালে টানানো সাদা কাপড়ে কেউ প্রজেক্টর দিয়ে ছবি আরম্ভ করেছেন। একে একে দৃশ্য নিজস্ব গতি নিয়ে চলেছে শেষতক। মুক্তিযুদ্ধ, ’৭১-পরবর্তী শৈশব এবং পরবর্তী যাবতীয় ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র সুরুজ, যে বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী।

সুরুজের বাবা প্রায় বাক্হীন। ঠিক বাক্হীনতা নয়। বাবা দিনদিন কথা বলা কমিয়ে দিচ্ছেন। আগে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলতেন, এখন তাও বলেন না। মানসিক রোগের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তার পরামর্শমতো বাবাকে নিয়ে গ্রামে যাওয়া স্থির করল সুরুজ। ডাক্তার সাহেবের মতে, এটা দর্শনের ভাষায় ‘স্কেপিজম’। অর্থৎ তিনি সত্যের মুখোমুখি হতে চান না। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। বাবা সারারাত অন্ধকারের টবে বনসাই হয়ে বসে থাকেন। তার এই নির্লিপ্ততাকে যে করেই হোক কাটাতে হবে।

কিন্তু মা গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন রাজি নন। মা বলেন, ‘সরল কাঠি দিয়ে আঁকাবাঁকা জীবনের গভীরতা মাপতে গিয়ে যেখানে কাঠিটা ভেঙে যায়, বুঝতে হবে এর পরেই বাঁকটা আছে। সত্যটা আরও তলে।’

মোজাফফর ঘটনাকে এমনভাবে বাঁকবদল করেন যে, মানসিকভাবে আদৌ প্রস্তুতি থাকে না পাঠকের। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল ঘটনার সঙ্গে নিজেকে টেনে নিয়ে যায়। বাবার কথা-না-বলার কারণ জানতে গিয়ে সুরুজ বাবাকে নিয়ে চলে এলো গ্রামে। মায়ের কিছুটা অমতেই। মায়ের কেন অমত ছিল এটাই হয়তো পুরো উপন্যাসের সোনার কাঠি রুপোর কাঠি।

মা বারবার বলছিলেন, সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেও না।

বাড়ি যাওয়ার কথা উঠতেই সুরুজের বাবা বলে উঠলেন, ‘কতদিন মাকে দেখিনি। আমার মা কি ছিল কখনও?’

মেহেরপুর জেলার একটি গ্রামে বাবার বন্ধু হাফিজুল চাচার বাড়িতে এলো বাবাকে নিয়ে। উদ্দেশ্য বাবার যদি পুরনো মানুষজন, গ্রামীণ পরিবেশ, রাস্তাঘাট, পুকুর, জোনাকি এসব দেখে না-মনে-পড়া থেকে হয়তো ফিরবেন। কিছুটা হয়তো আলগোছে মনে পড়েই যাবে না চাইলেও। মনে করার চর্চা কি পুরোটাই বিফলে যাবে?

দিনের পর দিন এক ঘরে থেকে থেকে যে-স্থবিরতা তৈরি হয়েছে তার থেকে তাকে বের করার জন্য কানাডাফেরত পুত্র দেশে ফিরে জানতে পারে একের পর এক না-লেখা চরিত্র, নির্মম অক্ষমতা, বিষাদের পাণ্ডুলিপি।

সুরুজ সবচেয়ে অবাক হয়েছে যখন হাফিজুল চাচা জানালেন, তার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ডাকনাম শফিক। কেউ এতদিন তাকে কিছু বলেনি – না বাবা, না মা। এত বড় গৌরবের কথা শুনেও সুরুজ অবাক হয় না।

উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন একা একাই তৈরি হয় আবার মসৃণভাবেই এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ধরা দেয়। লেখকের নির্মেদ গদ্যের মুনশিয়ানা এখানেই।

লেখক মোজাফফর হোসেন সুরুজের বেড়ে-ওঠা কিশোর বয়স এবং এই বয়সী ছেলেদের যৌনতাবিষয়ক স্বাভাবিক উৎসাহকে ব্যক্ত করতে গিয়ে এক ভয়ংকর সত্যকে আমাদের সামনে দাঁড় করান। এই সত্য পাঠক হিসেবে আমাকে কুঁকড়ে দেয়।

প্রেমহীন কাম কিংবা নৃশংসতা কখনো কোনো সুস্থ স্বাভাবিক যৌনতা হতে পারে না, যেটা সুরুজের মায়ের জীবনে ঘটে তার অবদমিত ইচ্ছেতেই। সুরুজের ভাষায়, ছোটবেলায় এক লোক আসতো বাবার বয়সী। মা দরজা আটকে দিতেন অর্থাৎ মা তাকে চাইতেন। কিন্তু সেখানে প্রেম ছিল না। কৌতূহল থেকেই সুরুজের দরজার ফুটো আবিষ্কার করা। তখনো সে জানে না সামান্য এক ফুটো তার জীবন ওলটপালট করে দেবে। সেই ফুটোতে চোখ রাখতে গিয়ে সুরুজ সেই বয়সেই বুঝেছে নারীর যৌনতা, নারীর নগ্নতা, অস্বাভাবিকতা।

এই সময়ে অপ্রচলিত অনাকাক্সিক্ষত অথচ সত্য বিষয় উঠে এসেছে মোজাফ্ফরের কলমে অনায়াসে। একের পর একে গোপন কক্ষ খুলে যেতে থাকে পাঠকের সামনে, মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে যায় যেন কোনো ভুলে ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়েছে একমাথা প্রশ্ন নিয়ে। কিন্তু তার কোনো খেই পাচ্ছে না।

কেন মাকে লোকটা টর্চার করত এবং মা সেই যন্ত্রণা নিয়ে লোকটাকে নিয়মিত অনুমতি দিতেন সেটা জানতে আমাদের তিমিরযাত্রা পড়তে হবে। ছিদ্রদৃশ্য দেখার পরপরই সুরুজকে কানাডায় পড়তে পাঠানো হয়।

মেহেরপুরে সন্ধ্যা ঘনায়। হাফিজুল চাচা বাবাকে দেখে অনেক খুশি হন, অনেক কথা বলেন। বাবাকে বিব্রত মনে হয়। তিনি উত্তর করেন না।

তিমিরযাত্রা উপন্যাসে সুরুজ বাবাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য গ্রামে এলেও গ্রামেই অল্প অল্প করে জটগুলো খুলতে থাকে। একের পর এক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হতে থাকে সুরুজের সামনে।

চাচার বাসায় সকালে ঘুম ভেঙে ভালো লাগে সুরুজের। ‘সেখানে চাচার পুত্রবধূ মিলি রান্নাঘরে, চাচা রোয়াকে পাতা চেয়ারে বসা, এক কোনায় কামিনীগাছের গোড়ায় একটা ছাগল বাঁধা। শুয়ে আছে। রান্নাঘরের পাশে জ্বালানিঘরের চাটাইয়ে খাঁচার ওপরে একটা কবুতর ঝিম ধরে বসা। খাঁচার ভেতরটা খালি। সবকিছু এমন শান্ত মনে হয় কোনো পেইন্টিংয়ে ঢুকে পড়েছি।’ এই বর্ণনাটা এত প্রাঞ্জল যে আমি নিজেই সোজা সেই পেইন্টিংয়ে ঢুকে যাই।

বাবা গ্রাম দেখতে বের হতে চান না, ফলে সুরুজ প্রথমে হাফিজুল চাচার সঙ্গেই গ্রাম দেখে। যুদ্ধপরবর্তী দেশের নানান বিষয় তার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। অনেকদিন কানাডায় থাকাতে সে দেশের কিংবা গ্রামের অনেক কিছু জানে না।

পরের দিনও বাবা বের হলেন না। রফিক নামে এক ছেলের সঙ্গে সুরুজ বের হলো। গ্রাম ক্রমাগত টানতে থাকে তাকে। সে জেনে যায় বাবার বীরত্ব, দেশপ্রেম, প্রত্যয়। রীতিমতো ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তিনি তার প্রাপ্য সম্মান পেলেন না। সময়ের রাজাকার দিন বদলে মন্ত্রী হলেন; ফলে সমাজ থেকে নিজেকে একসময় গুটিয়ে নিতে থাকলেন বাবা। শুধু কি এই কারণ?

বাবাকে তেমন কথা বলতে শোনা যায় না। এখানেও চুপ করে বসে থাকেন। সুরুজই নিজে থেকে নানা কথা বলে। বাবা হঠাৎ বলেন, নারায়ণ মাস্টার … নারায়ণ মাস্টার। গ্রামের কুসংস্কার অনুযায়ী নারায়ণ মাস্টারের লাগানো গাছ এবারের বর্ষা গেলে কেটে ফেলা হবে। কেননা ‘জেএসসি’র ফলাফল ভালো হচ্ছে না? রফি মোল্লা বলেছেন, একজন হিন্দুর লাগানো গাছ ওভাবে স্কুলটাকে জড়িয়ে আছে বলে আল্লাহর রহমত আসছে না। এই শতাব্দীতে এসে এই ধরনের কুসংস্কার এখনো মানা হয় দেখে অবাক হতে হয়। লেখক তাঁর তীক্ষèদৃষ্টিতে খুঁটেখুঁটে এসব তুলে এনেছেন।

যুদ্ধটা কেন হয়েছিল? বাবা প্রশ্ন করেন, তার এই কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত নয় সুরুজ।

আমি যুদ্ধে কেন গিয়েছিলাম? এই প্রশ্নটিও সুরুজকে ধাক্কা দেয়।

বাবা কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তার জবাব হাফিজুল চাচা দিতে পারেন না।

চাচা বলেন, ‘মানুষ যুদ্ধে গেছে দেশের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য।’ কোনো ভাবনাচিন্তা করে কেউ যুদ্ধ করেনি তখন, যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেছে। যাঁরা মাসের পর মাস যুদ্ধ করেছেন তাঁরা নিজেরাই ভুলে গেছেন নিজেদের অতীত।

মেহেরপুর জেলার একেক মুক্তিযোদ্ধার জীবনে লুকানো একেক গল্প। ‘খেদের কবি’র কাছে বাবার গল্প পাওয়া যায় না। এখানে প্রত্যেকের একটা গল্প আছে। না শোনাতে পেরে তারা গল্পটা ভুলে গেছেন। সুরুজ খুঁজে পায় গ্রামের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা ‘খেদের কবি’কে। যিনি বাবার কথা নয়, নিজের কথা বলতে উদগ্রীব। দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পান না। এই বয়সে বৃদ্ধ পিতাকে ছেলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সুরুজের মনটা ভার হয়ে ওঠে।

বাবা সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণাই পালটে দেন হানিফ হোসেন, সহযোদ্ধা। সুরুজ জানত বাবা সাঁতার জানে না, কিন্তু চাচা বললেন, বাবা খুব ভালো সাঁতার জানতেন। বাবা কিছু বলেন না। মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন, হানিফ চাচা বলেন, যুদ্ধশেষে হাসপাতালে দেখা হয়েছিল। বাবার ঊরুতে গুলি লেগেছিল এবং যৌনাঙ্গ উড়ে গিয়েছিল।

উপন্যাসের এই পর্যায়ে এসে সুরুজের চোখ থেকে অন্ধকারের পর্দা অনেকাংশেই খুলতে শুরু করে।

সুরুজ জানতে পারে মা পাকিস্তান ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। মা হিন্দু ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জেদ করে বাবা দ্রুত বিয়ে করেন মাকে। মায়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল মেজ চাচার সঙ্গে; কিন্তু চাচা যুদ্ধে শহিদ হোন। ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেলেন যখন তখন মা অন্তঃসত্ত্বা। তাই বাবা-মায়ের বিয়ে সমাজ মানতে পারেনি। গ্রাম ছাড়েন বাবা।

বাবা মুক্তিযোদ্ধা – এই পরিচয় যখন সুরুজকে গর্বিত করছে ঠিক এমনই সময় সে জানতে পারছে যে, সে যুদ্ধশিশু। অভাবনীয় ঘটনা, আমি বারবার থেমে থেমে পড়ি।

সুরুজ এসেছিল বাবাকে কথা বলাতে। এখন ধীরে ধীরে তার নিজের কথা বলার ইচ্ছেটুকু গ্রাস করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে দাদা-দাদির কবর আন্দাজে খুঁজে দেখেছিল। ভুল মানুষের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ভুল মানুষ প্রার্থনা করে এলো। এখন সুরুজ কাউকে বলতে পারছে না নানা-নানির কবর খুঁজে দিতে। যার মা হিন্দু তার নানা-নানির দেহ তো পোড়ানোর কথা।

এতকাল পর গ্রামে এসে সুরুজ আবিষ্কার করে আত্মীয়স্বজন মেকি একটা আলগা আদর করছেন। তারা সম্পদ-দখলের ভয়ে ভীত; তাদের ধারণা, সুরুজ তার ভাগের অংশ বুঝে নিতে এতকাল পরে গ্রামে এসেছে। যখন তারা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয় যে, জমি নিতে আসেনি তখন তারা ব্যস্ত হয় নিজের মাদ্রাসায় পড়া ছেলেকে কিভাবে সুরুজের সঙ্গে কানাডায় পাঠানো যায় চেষ্টায়।

এরই মধ্যে মিলি আসে সুরুজের জীবনে। মিলি তাকে কাছে টানতে চায়। কিন্তু ওই যে দরজার ফুটো দিয়ে দেখা মায়ের পৈশাচিক দৃশ্য থেকে সুরুজ বের হতে পারেনি, – তাই তার কাছে কোনো নারীর শরীর আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। মিলির কাছে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চায় সুরুজ। নারীর নগ্নতা সে সহ্য করতে পারে না।

যাওয়ার সময় মিলি কাঁদছে। মিলিকে সুরুজ বলে, তোমার সমস্যা তুমি নারী। এরপর আর কথা চলে না। মিলি মানতে পারে না তবু শোনে।

সুরুজের সমস্যা টের পেয়েই বাবা তখন তাকে কানাডায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা সুস্থ নেই, মা সুস্থ নেই। সুরুজ সুস্থ নেই।

একটা বড় যুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন যুদ্ধের শিকার যাঁরা তাঁদের আসল যুদ্ধ শুরু হয়।

বাবা একসময় প্রশ্ন ভুলে যান যার উত্তর মনে আছে। সুরুজ বলে, উত্তর দাও, আমি প্রশ্ন খুঁজে নেব। কেউ কিছু খুঁজে পায় না – না প্রশ্ন, না উত্তর।

তিমিরযাত্রা পড়তে গিয়ে অন্যকিছু পড়তে পারিনি। এতটাই মন ঝুঁকিয়ে আমাকে পড়তে হয়েছে যে অনেক সময় ফের পেছন থেকে পড়া শুরু করেছি। একজন যুদ্ধশিশুকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করানোটাও বাবা-মায়ের জন্য কম যুদ্ধের নয়। নারী-পুরুষ সম্পর্কের বদলে আরো কিছু সম্পর্ক রয়ে যায়। বাংলাদেশের ডিসটোপিয়ান উপন্যাস তিমিরযাত্রা পড়ন্ত বাংলাদেশকেই উপস্থাপন করে।