পথিকৃৎ শিল্পীদের প্রতিভূ

এস এম সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলাচর্চার সূত্রপাত হয়েছে বস্ত্তত ঔপনিবেশিক ভারতের কলকাতায়। এদেশের প্রথম প্রজন্মের পথিকৃৎ শিল্পীরা ভিক্টোরীয় শিল্প-ঐতিহ্য ও আদর্শে প্রবর্তিত কলকাতা আর্ট স্কুলের শিল্পশিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমিন, হাবিবুর রহমান প্রমুখ শিল্পী গত শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তাঁদের জীবন ও শিল্প বিকশিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতের বহুবিধ ঘটনা ও সময়ের অভিঘাতে। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাঁদের হাত ধরেই বাংলাদেশের শিল্পকলা সেই ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ধারণ করেছে। অবিভক্ত ভারতে বাঙালি মুসলমান সমাজ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে থাকার দরুন উন্নত জীবনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান পুনরায় নতুনভাবে ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হয়। বিষয়টি বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীসমাজেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কলকাতা আর্ট স্কুলের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। তখন থেকেই তিনি এদেশে শিল্প-আন্দোলন শুরুর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য ঢাকায় ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সূত্রপাত করেন। এটি তাঁর এক ঐতিহাসিক কীর্তি। তিনি এদেশে আধুনিক চারুকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ। চারুকলা আন্দোলন ও আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে কয়েকজন শিল্পী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ। এদেশের চারুশিল্পকে আধুনিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তিনি এক একনিষ্ঠ সাধক ও শুদ্ধতম ঋত্বিক। উপমহাদেশের খ্যাতিমান এই শিল্পী বাংলাদেশে ছাপচিত্র চর্চা ও বিকাশে পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন। শিল্পাচার্যের সহযাত্রী ও প্রথম প্রজন্মের শিল্পীসকল এক এক করে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আলোকবর্তিকার মতো শেষতক আমাদের মাঝে বেঁচে ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। বাংলাদেশের শিল্পকলা-আন্দোলন ও চর্চার যাঁরা পথিকৃৎ, তিনি ছিলেন তাঁদের সর্বশেষ প্রতিনিধি। অবশেষে তিনিও চলে গেলেন ১৯ মে মধ্যরাত পার করে। নববই বছর পূর্ণ হতে যাঁর বাকি ছিল এক মাস তিনদিন। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চারুকলার একটি কালের পরিসমাপ্তি ঘটলো।

দুই
১৯২২ সালের ২২ জুন কলকাতার ভবানীপুরের পিতৃপুরুষের বাড়িতে মাঝরাত্তির শেষে সফিউদ্দীন আহমেদের জন্ম। অবশ্য যৌক্তিক কারণে তাঁর জীবনবৃত্তান্তে জন্মদিন ২৩ জুন। সফিউদ্দীনের বাবা মতিনউদ্দীন আহমেদ তৎকালীন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলিম পরিবারে এক উদার সাংস্কৃতিক আবহে সফিউদ্দীনের শৈশব অতিবাহিত হয়। শৈশব-কৈশোরে অর্জিত নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের মূল্যবান শিক্ষা তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনে শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এক বিশাল শূন্যতা ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন তিনি। তখন থেকে তাঁর জীবনযুদ্ধ শুরু। কৈশোরেই ভবানীপুরের বাড়ি ভাগ নিয়ে চাচাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, আর্ট স্কুলে পড়া নিয়ে আত্মীয়স্বজনের মধ্যকার অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বিধবা মায়ের অভাব-অনটনের সংসার, সর্বোপরি নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিরামহীন যুদ্ধ – এসবই বোধ করি সফিউদ্দীনকে মানসিক দৃঢ়তা দিয়েছে। মা বিবি জমিলা খাতুন ছিলেন তাঁর সুখে, দুঃখে, আনন্দে ও বিরহে এক বিশাল ছায়াতরুর মতো। সেই সময় বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি চিত্রচর্চা করতে পেরেছেন মমতাময়ী মায়ের কল্যাণে। দেশভাগের পর বহুবিধ টানাপড়েন থেকে মুক্তির আশায় ও জীবনের স্থিরতার লক্ষ্যে তিনি মাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। মা আমৃত্যু পুত্র সফিউদ্দীনের সঙ্গেই ছিলেন। ঢাকায় স্বামীবাগের বাড়িতে ১৯৫৪ সালে মা পরলোকগমন করেন।

তিন
সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৬-৪২ কালপর্বে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন আবদুল মঈন, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অতুল বসু, বসন্তকুমার গাঙ্গুলি, মুকুল দে, প্রহ্লাদ কর্মকার, রিসেন মিত্র প্রমুখকে। ওই স্কুল থেকেই তিনি টিচারশিপ কোর্স সম্পন্ন করেন (১৯৪৪-৪৬)। আর্ট স্কুলে ভর্তির পর থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সফিউদ্দীনের চিত্রকর্মে অ্যাকাডেমিক রীতি ও বাস্তবধর্মী গুণ লক্ষ করা যায়। এই সময়ে অঙ্কিত ড্রইং, জলরং, তেলরংসহ ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমের কাজে বাস্তবধর্মী নিসর্গ দৃশ্য, মানুষ, গ্রামীণ পরিবেশ, সাঁওতালদের সরল জীবন, শীর্ণকায় ময়ূরাক্ষী নদী, আকাশছোঁয়া দীর্ঘ শালবৃক্ষের সারি ইত্যাদি বিষয় বিশেষভাবে উপজীব্য হয়েছে। উড এনগ্রেভিং মাধ্যমের ছাপাই ছবি ‘মেলার পথে’, ‘সাঁওতাল রমণী’ ও ‘জঙ্গলের পথ ধরে’ শীর্ষক বহুল পরিচিত চিত্রগুলো তারই চমৎকার নিদর্শন। উল্লিখিত চিত্রগুলোয় বিষয়বস্ত্তর বিন্যাস, আলো-ছায়া ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গের সংযোজনে শিল্পীর অসামান্য দক্ষতা ও মেধার পরিচয় মেলে। ১৯৪৫ সালে অঙ্কিত ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমের ছাপাই ছবি ‘দুমকা’ শীর্ষক কাজটিও এদিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ x ২৩ সে.মি. আয়তনের এই চিত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করি দুমকা অঞ্চলের একটি গ্রামীণ মেঠোপথ। পথের দুধারে দীর্ঘ শালবৃক্ষের সারি। কোনো এক রাখাল বালক কয়েকটি মোষ নিয়ে আড়াআড়িভাবে পথ অতিক্রম করছে। শালবৃক্ষের মনোরম ছায়া ও রোদের ঝিলিক পথজুড়ে অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে। অদূরের ঢালু জমি পরিপ্রেক্ষিতের ছন্দে মিলেছে সুদূর দিগন্তে। অত্যন্ত সরল ও মনোমুগ্ধকর এই ছবির সূক্ষ্ম ড্রইং, বিষয়ের বিন্যাস, নাটকীয় আলো-ছায়া ও পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণের মধ্যে শিল্পীর অসামান্য মুন্শিয়ানা প্রকাশিত হয়েছে। ইমপ্রেশনিজম শিল্পরীতির দিকপাল শিল্পী ক্লোদ মনের ‘পপলার’ শীর্ষক চিত্রগুলো দর্শকের মনে যেমন অনুভূতির জন্ম দেয়, বোধ করি শিল্পী সফিউদ্দীনের ‘দুমকা’ শীর্ষক চিত্রকর্মে অনেকটা তেমনি অনুভবের প্রতিভাস আছে। উল্লেখ্য, এই সময় তিনি ইমপ্রেশনিজম শিল্পরীতির প্রতি বিশেষভাবে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁর তেলরঙে অঙ্কিত ‘দুমকা’ সিরিজ, ‘দিলীপ দাশগুপ্তের প্রতিকৃতি’, ‘সূর্যমুখী’, ‘ধানঝাড়া’ ইত্যাদি চিত্রকর্মে বাস্তবানুগ ও অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির সঙ্গে ইমপ্রেশনিজম শিল্পরীতির মিশ্রণ ঘটেছে। এখানে স্মর্তব্য যে, সফিউদ্দীন আহমেদ প্রধানত ছাপচিত্রী হিসেবে খ্যাতি পেলেও, জীবনের প্রথম পুরস্কার অর্জন করেছেন অসামান্য এক তেলরং চিত্রের জন্য।

চার
১৯৫৭-৫৯ কালপর্বে শিল্পী লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে অধ্যয়ন করেন। সেখানে ৪২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনি ছাপচিত্রের এচিং ও এনগ্রেভিং মাধ্যমে ডিস্টিংশনসহ ডিপ্লোমা অর্জন করেন। লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (১৯৫৬) সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রধারায় বাস্তবানুগ অনুষঙ্গ ছিল প্রধান। কিন্তু লন্ডনে যাওয়ার পর বাস্তবানুগ বিষয়বস্ত্ত ও অবয়ব চিত্র থেকে অনেকটা হারিয়ে যায়। এই সময় থেকে তাঁর চিত্রের জমিনে বহুবিধ অপরিচিত ফর্ম, ইমেজ এবং সূক্ষ্ম, স্থূল ও মোটা রেখা ব্যঞ্জনা পেতে থাকে। সফট গ্রাউন্ড অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের ছাপাই ছবি ‘নেমে যাওয়া বন্যা’ এবং এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট চিত্র ‘মাছ ধরার সময়’, ‘সেতু পারাপার’, ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’, ‘আসন্ন ঝড়ের পূর্বে’ শীর্ষক প্রভৃতি চিত্রকর্মে আমরা বিভিন্ন প্রতীকের প্রাধান্য লক্ষ্য করি। প্রতীকায়িত মাছ ও চোখ তাঁর ছবিতে জীবনমথিত এক মর্মন্তুদ হৃদয়ের গল্প নানামাত্রায় অর্থবহ করেছে। চোখের বিভিন্ন ফর্ম ও অভিব্যক্তি সফিউদ্দীন আহমেদের কয়েকটি ছবিতে বিশেষভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। এনগ্রেভিং মাধ্যমে অঙ্কিত ‘একুশে স্মরণে’, ‘একাত্তরের স্মৃতি’ ও ‘একাত্তরের স্মরণে’ চিত্রকর্ম তিনটিতে শিল্পী চোখের ফর্মকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিভাত করেছেন। সূক্ষ্ম ড্রইং, জ্যামিতিক শুদ্ধতা, পরিপ্রেক্ষিত ও কুশলী বিন্যাসের ফলে চোখের ফর্মগুলো বহুবিধ অর্থ ও অনুভবের সৃষ্টি করেছে।

পাঁচ
সফিউদ্দীন আহমেদ ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ছবি এঁকেছেন। চিত্রকলার প্রায় সকল মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত মনোযোগ, একাগ্রতা ও ধ্যানের সঙ্গে কাজ করেছেন। এটি সত্যি বিস্ময়কর বটে। তাঁর একমাত্র আরাধনা ছিল শুদ্ধ ও নিখুঁত শিল্পের লক্ষ্যে। জীবনযাপনের পরিপাটি পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে জীবন ও শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছেন প্রত্যাশিত শুদ্ধতা। তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবন ও শিক্ষকজীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ছাপচিত্রী উইলিয়াম স্টেনলি হেটারের (১৯০১-৮৮) দারুণ গুণমুগ্ধ ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। লন্ডনে অধ্যয়নকালে তিনি হোয়াইট চ্যাপেল গ্যালারিতে হেটারের চিত্রপ্রদর্শনী দেখেন এবং সেখানে ঘটনাচক্রে হেটারের সাক্ষাৎও লাভ করেন। হেটারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সেই সাক্ষাৎ সফিউদ্দীনকে সারাজীবন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনেক শিল্পতাত্ত্বিক মনে করেন, সফিউদ্দীনের কিছু ছবিতে বিশেষত এনগ্রেভিং মাধ্যমের চিত্রে হেটারের প্রভাব অনুভূত হয়। কথাটি যৌক্তিক, তবে তিনি শুদ্ধতা, স্বকীয় রীতি ও চিত্রভাষা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেকে একজন মৌলিক চিত্রকর হিসেবে উন্নীত করেছেন। একজন শিল্পীর জীবনে এ এক বিশাল সাফল্য।
সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পসমগ্র নিয়ে বস্ত্তনিষ্ঠ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সে-লক্ষ্যে আমাদের এখন থেকেই কাজ করে যেতে হবে। বোধকরি একজন শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট পথ।
মহান শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। 