খাড়া!
খাড়া! কেডা? কেডায় আমারে খাড়াইতে কয়? থপথপ করে হাঁটে ইসমাইল শেখ। মোটা থলথলে শরীরে হাঁটলে পথের ওপর পায়ের পদাঘাতে এক ধরনের বেঢপ শব্দ তৈরি হয়। মাঝবয়েসি ইসমাইল শেখ হাঁটছে আর আপনমনে বকে যাচ্ছে, মাগি তোরে আমি দেইখা লমু। কত্তো বড় সাহস তোর? আমার ঘরবাড়ি রাইখা তুই বাপের বাড়ি চইলা যাস? তোর পায়ের নলি যুদি আমি ভাইঙ্গা না দেই আমার নাম…
নিজের নামটা উচ্চারণ করার আগেই শুনতে পায় ইসমাইল শেখ, তোকে না খাড়া হতে বললাম? খাড়া।
থমকে দাঁড়ায় ইসমাইল শেখ, তীক্ষ্ন চোখে তাকায় চারদিকে, কাউকে দেখতে পায় না আশেপাশে। মাথার ওপর নিদাঘ দুপুরের কড়কড়ে মেঘ। ডানে-বাঁয়ে কয়েকটি আম আর সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে বাতাসের সঙ্গে। ভ্রু কুঁচকে আবার তাকায়, নাহ্ – কেউ কোথাও নাই। রাগের বিভ্রম মনে করে সামনে পা বাড়ায় ইসমাইল শেখ, সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায়, খাড়া!
আরে কোন চুতমারানি আমারে খাড়াইতে কয়? আমার কামের অভাব আছে নিহি? এহন যাইতেছি আমার বউয়ের বাপের বাড়ি। মাগি আমার লগে রাগ কইরা বাপের বাড়ি গেছে। কেডায় রান্দে-বাড়ে? বড় মাইয়ার বয়স মোটে দশ বচ্ছর। মাইঝা মাইয়ার বয়স আট বচ্ছর। ছোট মাইয়ার বয়স ছয় বচ্ছর। হের পরে একটা পোলা অইচিল, অইয়াই মরছে। মাগির আবার প্যাড অইচে, কইচি এইফিরও যদি মাইয়া অয় তোরে তালাক দিমু। আর দেহো মাগির ত্যাজ – তালাকের হুমকি পাইয়া আমার সোংসার থুইয়া বাপের বাড়ি গিয়া উঠছে। মাগিরে চুল ধইরা টাইনা বাড়ি আনমু। বাড়ি আইনা চুলের মুডি ধইরা খালি লাত্থি দিমু, খালি লাত্থি দিমু মাগিরে, আমারে চেনে নাই? কতদিন কইচি মুই ইসমাইল শেখ, মোর বাপের নাম করিম শেখ …
উজানগাঁওয়ের কাঁচা রাস্তা দিয়ে থপ্থপ্ পা ফেলে দ্রুত হাঁটছে আর নিজের মুখে অভ্যাসের বশে কথা বলছে ইসমাইল শেখ। উজানগাঁওয়ের লোকেরা তাকে ডাকে ‘কথার ভূত’ বলে।
কিন্তু আবার শুনতে পায় সে – করিম শেখের পোলা ইসমাইল শেখ তোরে না খাড়াইতে কইলাম! ভেসে আসা গলাটা এইবার একটু কর্কশ।
থমকে দাঁড়ায় ইসমাইল শেখ। তাকায় চারপাশে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে, কেডায় আমারে ডাহে? কেডায় আমার বাপের নাম লইচে?
তুই আকাশের দিকে চাইয়া থাকলে আমারে দেখবি ক্যামনে?
চেতে যায় ইসমাইল শেখ। মাটিতে পদাঘাত করে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে, ওই হালার পো তয় কোন দিকে চামু?
বিকট হাসির শব্দ আসে কানে, আসমান থাইকা চোখ নামাইয়া মাডির দিকে রাখ।
ইসমাইল শেখ ভয়ে দিশেহারা, কাউকে কোথাও দেখতে পায় না; কিন্তু আজগুবি কথা শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে চারপাশের মাটি, বাতাস, গাছপালা, পশুপাখি কথা বলছে। ভাবছে, বউ চন্দনার বাপে কোনো জাদুটোনা করলো না তো? চন্দনার বাপে মজিদ মিয়া জাদুটোনা জানে। জাদু দিয়া অসুস্থ লোকজনকে সুস্থ করে – ভূত-প্রেত তাড়ায়। হেই মজিদ মিয়া কোনো জাদুটোনা করলো নাকি? আবারো ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে ইসমাইল শেখের – করতেই পারে। বিয়ার পর থেকেই তো চন্দনা একদিনও মাইর ছাড়া থাকতে পারে নাই। শরীরের এমন কোনো জায়গা নাই, মাইরের বা আঘাতের চিহ্ন নাই।
কী দেখছোস?
মাটির ওপর থেকে ডানে-বাঁয়ে তাকায় ইসমাইল শেখ। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না – কে কথা বলছে? কোত্থেকে বলছে? মুখের ওপর মুখ, চোখের ওপর চোখ না রেখে বলা যায় কথা? কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে! ভয় না পেয়ে উপায় আছে? ইসমাইল শেখের দশাসই শরীর একটু কাঁপছে অজানা-অদেখা আতঙ্কে।
কাউকে তো দেখতে পাইতেছি না, আধো ঘুমে আধো জাগরণে ইসমাইল শেখ। কেডা আপনে? সামনে আহেন। বালের হেজিপেজি আমার ভালো লাগে না – শেষের দিকে একটু ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
খিক্খিক্ হাসির শব্দ আসে ইসমাইল শেখের কানে,
গা-জ¦লা হাসি – মেজাজ খিঁচড়ে যায় আরো, আপনে হাসেন ক্যা? সামনে আহেন সাহস থাকলে –
আমি তো তোর সামনেই আছি।
সরাসরি ইসমাইল শেখকে তুই ডাকছে, মেজাজ আরো সপ্তমে যায়। উজানগাঁওয়ের কোনো হালায় না – শেখ বাড়ির পোলা, মজিদ শেখের পোলা ইসমাইল শেখরে ডর দেহায়? একফির সামনে আহুক, ঘাড় থেকে মাথাটা নামাইয়া দিমু এক কোপে! সামনে আয় হালার পো, সামনে আয় …
আমি তো সামনেই আছি তোর! ভরাট আর ক্ষুধার্ত কণ্ঠস্বর।
সামনে আছেন তয় দেখতে পাই না ক্যা? গলা খোলে ইসমাইল শেখ।
তুই তো আমারে দেখতে পাইতেছোস, দেখোসও; কিন্তু না-দেখার ভান করো। প্রত্যেক দিন, প্রতি মুহূর্তে তুই আমারে দেখতেছোস ইসমাইল শেখ। তোর কী মনে হয়, আমি কিছুই বুঝি না?
হালায় আমার নামও জানে দেহি! কী ঝামেলায় পড়লাম, মনের মধ্যে বিরক্তি-ক্রোধ একসঙ্গে খিচুড়ি পাকায় ইসমাইল শেখের, কী সব কতা কন! আমি সব সমায় আপনেরে দেহি কেমনে? আপনে তো আমার সামনেই নাই। যে সামনে নাই হেরে দেহি কেমনে?
আবার খিক্খিক্ হাসি, ইসমাইল শেখ! তুই বেশি পাইকা গেছো! মনে রাখিস, বেশি পাকা ভালো না।
উদ্ভ্রান্ত ইসমাইল শেখ, দুপুরের টাইমে কোন ঝামেলায় পড়লাম? কে আমারে চুলকায়? আমি উজানগাঁও গ্রামের মোটামুটি পরিচিত – জন্ম সেই আটত্রিশ বছর আগে, আমারে গ্রামের সবাই ট্যাক্স দিয়া চলে। শেখ বাড়ির পোলা আমি, হেই আমারে ঘোল খাওয়াইতেছে কোন হুমুন্দির পুতে? সাহস কত? ঘটনা চন্দনার বাপে করতেছে না, বুঝে গেছে ইসমাইল শেখ। তাইলে করতেছে কেডা? জুলফিকার মৃধা? আমার বিয়া করার আগে চন্দনারে বিয়া করতে চাইতেছিল। কিন্তু আমি জোর কইরা চন্দনারে বিয়া কইরা বাড়ি আনি – হেই প্রতিশোধ নিতে চায় জুলফিকার মৃধা, এতদিন পরে? দাঁতে দাঁত ঘষে ইসমাইল শেখ, জুলফিকার মৃধা! তোরে আমি দেইখা লমু।
তুই জুলফিকার মৃধাকে জড়াইতাছোস ক্যান? আবার হাসি শুনতে পায় ইসমাইল মৃধা। বিশ্রী শব্দে হাসছে, হাসির শব্দ আসছে মাথার ওপর দিয়ে। মাথার ওপর তাকায়, আমগাছ কাঁঠালগাছ কলাগাছ … গাছের পাতারা ঝরে পড়তে পড়তে হাসছে?
আমি যে জুলফিকার মৃধাকে ভাবতেছি, না-দেখা এই শত্রু দুপুরের রোদে জানলো ক্যামনে? তাহলে – জুলফিকারই সত্য? জুলফিকারই সব ষড়যন্ত্রের মূল? মাথার চুল ক্রোধে খাড়া হয়ে যায় ইসমাইল শেখের। অনেকবার দেখেছে, সময় সুযোগ পেলেই তার বাড়ির আশপাশে ঘোরে। মনের মধ্যে ওর গভীর ষড়যন্ত্র। চন্দনাকে তুলে নিতে চায়? জুলফিকার? তোরে আমি…
ভাবনার মধ্যে ইসমাইল শেখ অনুভব করে পায়ের তলায় চুলকাচ্ছে। সেই চুলকানোতে অনেকটা কান চুলকানোর আরাম পাচ্ছে, কে চুলকাচ্ছে পায়ের তলা? ডান পা তুলে কুঁজো হয়ে ডান পায়ের তলা চুলকায়। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পা চুলকায়। ইসমাইল শেখের মনে হয়, মাটির তলা থেকে কেউ ওর পা চুলকে দিচ্ছে? মাটির তলা থেকে? কে হতে পারে? ইচ্ছে করছে, মাটির ওপর থেকে দুই পা তুলে শূন্যের ওপর হাঁটতে। কিন্তু দুই পা তুলে কি হাঁটাচলা করা যায়? ভরদুপুরে কী বিপদেই পড়লাম? যাইতেছি চন্দনারে আনতে – ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে থাকে ইসমাইল শেখ – মজিদ শেখের পুত্র, উজানগাঁও গ্রামের।
কী ভয় পেয়েছিস? হাসির শব্দ আসে পায়ের তলা, মাটির বুকের ভেতর থেকে।
তোতলায় ইসমাইল শেখ, নাহ্, না, ভয় পামু ক্যান? ভয় পায় না ইসমাইল শেখ, মজিদ শেখের পোলা।
সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলার মাটি আড়মোড়া ভাঙার গতিতে মোচড় দিতে থাকে, মনে হয় মাটি খসে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? বিরক্তিতে অস্বস্তিতে ইসমাইল শেখ ছটফট করছে। চন্দনা কী জুলফিকারের সঙ্গে মিলে কোনো ষড়যন্ত্র করছে? জাদুটোনার মন্ত্র চালিয়েছে, যাতে আমি ওর বাপের বাড়ি যেতে না পারি! জাদুর মন্ত্রে আমার পায়ের তলার মাটি আমারে সুড়সুড়ি দিচ্ছে? ক্রোধের সময়েও যাতে আমি হাসি?
না, তোরে সুড়সুড়ি দিচ্ছি না ইসমাইল শেখ। তোরে পাকাচ্ছি ফোঁটায় ফোঁটায়, যেভাবে খেজুরের রস পাকায় আগুনের জ¦ালে একটু একটু কইরা।
ক্যান? আমারে পাকাচ্ছেন ক্যান?
তোরে খাবো। একটু একটু করে খাবো, তিল তিল করে খাবো, জিলাপির মতো করে ছমছম বাজিয়ে খেলবো আর আয়েশ করে খাবো। খমখম করে খাবো। শিয়ালের মতো খাবো। শুয়োরের মতো খাবো। কুমিরের মতো খাবো। খাবোই খাবো … একটা সুর বয়ে যায় কাঁচা রাস্তার ওপরে, গাছপালার ছায়াগন্ধবিলাসে।
ক্যান? ক্যান আমারে খাইবা? ইসমাইল শেখ আর্তনাদে বিলাপ জুড়ে দেয় – আমি ইসমাইল শেখ তোমার কী ক্ষতি করচি?
পায়ের তলার মাটি খুলে যায় দুই ভাগে, বের হয়ে পড়ে মাটির বিকট এক লকলকে জিহ্বা। মাটির জিহ্বা পেঁচিয়ে ধরতে চায় উজানগাঁওয়ের মজিদ শেখের পুত্র ইসমাইল শেখকে। পায়ের নিচে মাটির মুখ ব্যাদান করে বের হয়ে আসা মাটির জিহ্বা দেখে ইসমাইল শেখের চোখ বিস্ফারিত। বিস্ময়ে আতঙ্কে মাটির পথ ছেড়ে আকাশে উড়বে, না দৌড়ে পালাবে – বুঝে উঠতে পারছে না সে।
দুই পায়ের এক পায়ে লেফট-রাইট করতে শুরু করে ইসমাইল শেখ – মাটির লকলকে জিহ্বা একটা পা ধরলে আরেকটা মুক্ত রাখার জন্য তার কৌশল। হঠাৎ মনে হচ্ছে গোটা রাস্তাটা – যে-মাটির রাস্তাটা উজানগাঁও গ্রামের পূর্ব দিক থেকে সোজা পশ্চিমে কচা নদীর দিকে নেমে এসেছে, সেই চিরচেনা রাস্তাটা আজদাহা সাপের মতো নড়ছে, ধীরে ধীরে। নড়াচড়ায় কোনো তাড়াহুড়ো নেই, নেই কোনো দুঃখও, মনে হচ্ছে অনেক অপেক্ষার পর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে পায়ের নিচে পড়ে থাকা কাঁচা রাস্তাটার। অনেকটা শখের গোয়েন্দার ঢঙে চৌকশ ভঙ্গিতে রাস্তাটা নড়ছে, নাচছে, হাসছে, খেলছে …। কিন্তু মজিদ শেখের পুত্র ইসমাইল শেখ তো চিরচেনা রাস্তাটার এই অদ্ভুত নড়াচড়ায়, রাস্তার মুখ চিড়ে জিহ্বা বের হওয়ার ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজেকে কোথায় প্রতিস্থাপন করবে ইসমাইল শেখ – রাস্তার ওপর? আকাশে? না হাওয়ায়?
তুই তো কোথাও যেতে পারবি না রে – খুব আয়েশী ভঙ্গিতে মাটির পেয়ালায় দুধ মালাইয়ের চা চাখতে চাখতে গ্রাম্য মোড়লের ঔদার্যে উজানগাঁওয়ের চিরচেনা মাটির রাস্তাটা আলাপ জুড়ে দেয় – না আকাশে, না বাতাসে। তুই থাকবি আমার গহ্বরে, কঠিন অন্ধকারে। আমার জিহ্বাটা হাজার বছর ধইরা উপোস। তোরে দিয়া প্রথম আহার সম্পন্ন করবো রে ইসমাইল শেখ – মজিদ শেখের পোলা।
হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে ইট ভাঙার পর যেমন টুকরো টুকরো হয়ে যায় আস্ত ইট, ঠিক সেই রকম টুকরো টুকরো হয়ে যায় ইসমাইল শেখ, চন্দনার স্বামী – ক্যান আমারে খাইবেন?
রাস্তার খাজনা দিছো?
খাজনা? প্রতিবছরই তো খাজনা দিই – অবাক ইসমাইল শেখ। এই বছরও কাছারি বাড়ির তহসিল অফিসে খাজনা দিচি সাড়ে তিনশো টাহা।
সেই খাজনা তো দাও সরকাররে। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধইরা এই আমার বুহের উপর দিয়া পদাঘাত করতে করতে চইলা যাও, আসো, বইসা বইসা গল্প করো, প্রয়োজন মনে করলে মাটি কাইটা রক্তাক্ত কইরা ফেলো – কহনো কুনুদিন রাস্তার দুঃখ-বেদনা কষ্ট-হাহাকার বুঝতে চেষ্টা করেচো?
হাসে, মুখ ফুলিয়ে, বুক চিতিয়ে হাসে ইসমাইল শেখ – আমার লগে ফাইজলামি করো হালার রাস্তা! রাস্তার আবার খাজনা? কেউ হোনচে কোনোকালে? আমারে আসলে ভূতে পাইছে, রাস্তার কাঁচা মাটির ওপর শরীরের সকল শক্তি দিয়ে পদাঘাত করে ইসমাইল শেখ, আমি ইসমাইল শেখ, মজিদ শেখের পোলা, আমার লগে মশকারি? কোপাইয়া মাজা ভাইঙ্গা দিমু!
পদাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণায় ইসমাইল শেখ চিৎকার করে ওঠে, মাগো!
কী হলো? কাঁচা রাস্তা খিক্খিক্ হাসে, কানতাছো ক্যান মজিদ শেখের পোলা? পায়ে ব্যতা পাইচো?
মাটির ওপর বসে ডান পায়ের গোড়ালির দিকে তাকায় ইসমাইল শেখ, লাল রঙের ইটের টুকরোর দাঁত বসে গেছে পায়ের মাংসের মধ্যে। রক্ত পড়ছে। ব্যথায় পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। কী ঘটছে? সকালটা তো ভালোই ছিল। টকটকে রোদের রঙে ভরেছিল দিন, ভোরের মুখ। সকাল পার হয়ে দুপুরের এই সন্ধিক্ষণে চন্দনার বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে, নিজের বাড়ির সামনে এসব কী ঘটছে? এই রাস্তা দিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় আসা-যাওয়া করেছে। কী চমৎকার লতানো ঘাসে মোড়া বৃক্ষের ছায়ায় ঢাকা রাস্তা কবে থেকে ফুঁসে উঠেছে? কেন উঠেছে? চিরচেনা প্রিয় রাস্তা কেন সাপে রূপান্তরিত হচ্ছে? আমার চারপাশে কি শত্রুর ব্যারিকেড? আগামী বছর ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী হবো, সেটা কি কারো জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে মন্ত্র পড়ে লেলিয়ে দিয়েছে? নিরীহ নিরুত্তাপ পথ এমন করে তেতে উঠলো কেন? কী অবাক ঘটনা, ইতিহাসে, ভূপৃষ্ঠে কেউ শুনেছে গ্রামের কাঁচা রাস্তা খাজনা দাবি করছে? শান্ত নিরুত্তাপ পথ অজগর সাপে পরিণত হয়? পথের কখনো মুখ হয়? সেই মুখ দাঁতাল রক্তখেকো হতে পারে? কাঁচা রাস্তা পথিক বা মানুষ কামড়ে জখম করে দেয়?
ইসমাইল শেখ?
জে! কোঁকাতে কোঁকাতে প্রশ্নের সাড়া দেয় ইসমাইল শেখ। পেরেশানির সঙ্গে বলে, আমি আপনের কী ক্ষতি করলাম? ক্যান আমার ওপর রাগ করছেন?
গমগম করে ওঠে রাস্তার গলা, তোর একলার উপর না, দুনিয়ার সকল মানুষের ওপর দুনিয়ার সকল রাস্তা ক্ষেইপা গেছে। একেক দেশের একেক রাস্তা দিয়ে শুরু করলাম – প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য – কাঁচা রাস্তা অনেকটা আয়েশের সঙ্গে গরম মুড়ির সঙ্গে চা পানের ভঙ্গিতে বলছে, আমার ওপর দায়িত্ব পড়ছে এই দেশের পথচলা মানুষগো খাইয়া খাইয়া ফতুর করার।
কে আপনারে দায়িত্ব দেচে?
আরে হারামজাদা, এতো প্রশ্ন করো কেন? রেগে যায় কাঁচা রাস্তা – তোরা মানুষেরা যেমন সমিতি করিস, রাজনৈতিক দল করিস, আমরা দুনিয়ার কাঁচা রাস্তারা মিলে সেই রকম সংগঠন করেছি। বিশ্ব কাঁচা রাস্তা সমিতি। সংক্ষেপে বিকারাস। দুনিয়ার সব দেশে কাঁচা রাস্তা সমিতি হয়েছে। আমি বাংলাদেশের কাঁচা রাস্তা সমিতির সভাপতি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি – হাজার হাজার বছর ধইরা তোরা – মানুষেরা আমাদের বুকের ওপর দিয়া, পাঁজরের ওপর দিয়া, মুখের ওপর দিয়া পদাঘাত করে করে চলতেছিস। রাস্তার ওপর খাড়াইয়া মনের সুখে প্রস্রাব-পায়খানা করোস। যখন প্রয়োজন মনে করোস রাস্তার বুকের ওপর খোন্তা কাঁচি চালিয়ে মাটি কাটোস -= আমাদের রক্তাক্ত ব্যথার কান্না শুনতে পাও না। হাজার হাজার বছর ধরে নিঃশব্দে সহ্য করেছি মানুষের অকারণ নৃশংস পদাঘাত, কাটাকাটি আর অজাচার, কিন্তু আর করবো না। দুনিয়ার মজদুর এক হও, সেøাগান দিয়া মানুষেরা যেমন সংগঠন করে, সংগঠিত হয় – ঠিক সেই রকম সংগঠন আমরা গড়ে তুলছি দুনিয়া জুড়ে – বিকারাস। আর কোনো মানুষ আমরা বুকে নিমু না।
প্রকৃতি বইলা যে একটা ভূগোল আচে দুনিয়ায়, তোরা মানুষেরা ভুইলা গেছোস – অহংকারে তোদের পা মাটিতে না, মাটির বুকে লাগে।
বাজান? বাড়ির সামনে কাঁচা রাস্তার ওপর বাপকে বসে
থাকতে দেখে এগিয়ে আসে ইসমাইল শেখের আট বছরের কন্যা জয়বানু শেখ।
তোর মাইয়ডারে ডাক দে, একলা তোকে খাবো কেন – যহন নাগালে আইচে তোর মেয়েটাও? অরেও তোর সঙ্গে খামু। ডাক দে – খিক্খিক্ হাসে বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তার দাঁতাল মুখ।
কাঁচা রাস্তার বিকট মুখগহ্বরের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ইসমাইল শেখ, বাজান এদিগে আহিস না, তুই বাড়ি চইলা যা।
পাশের বাড়ির বন্ধুদের সঙ্গে বৌচি খেলে ক্লান্ত হয়ে গেলে বাড়ি ফিরছে জয়বানু শেখ। গোলগাল নাদুস-নুদুস মুখ মেয়েটার। মুখে মায়ার পাখনা মাখানো ছায়া। চোখ দুটি কোমল। যেখানে বাপ দেখলে দু-হাত বাড়িয়ে কোলে নেয়, সেখানে কেন যেতে নিষেধ করছে? মায়ে বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায় বাপ রাগ করছে? মেয়েটা বাপের কাছে আরো আদর পাওয়ার জন্য দুই হাত বাড়িয়ে দৌড়ে কাছে যাচ্ছে বাপের। বাপ ইসমাইল শেখ চিৎকার করছে, বাজানরে এদিকে আহিস না। পথ আমাকে খাইয়া ফালাইতেছে রে, বাজান …
রাস্তার ওপরে না উঠে রাস্তার পাশে নিচে দাঁড়িয়ে অবাক জয়বানু শেখ। দেখতে পায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা ফাঁক হয়ে বের হয়ে আসছে লাল লকলকে বিরাট জিহ্বা। ভয়ে জয়বানু শেখ দাঁড়িয়ে যায়, বাজান? ওই জিবলা কাইটা দিমু?
কী দিয়া কাটবি?
দা লইয়া আহি?
ঘাড় কাত করে ইসমাইল শেখ, পারবি আনতে?
বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করে জয়বানু শেখ, পারমু।
যা তাইলে বাজান, কণ্ঠে কাতরতা।
কাঁচা রাস্তা এতক্ষণে ফুঁসে ওঠে, হারামখোর অকৃতজ্ঞ মানুষ! আমাগো বুকের ওপর পদাঘাত কইরা হাঁইটা-চইলা আমাগো জিহ্বা কাটতে চাও? মাটির রাস্তার মুখগহ্বর দ্বিগুণ হয়ে যায়, আয় তোকে এক নিমিষে খাই, কাঁচা রাস্তার লকলকে জিহ্বা সামনে বাড়তে শুরু করে।
ইসমাইল শেখ দৌড় শুরু করে, পেছনে ভেসে আসে বিকট অট্টহাসি। ইসমাইল শেখের বাড়ি উজানগাঁও গ্রামে। গ্রামের পাশে বিশাল বপুর কচা নদী। নদীতে মাছ ধরে ঝাকি জালে। মাছ ধরতে ধরতে দেখে কচা নদীর তীব্র স্রোতের বিপরীতে ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে। সেই আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গতিতে ইসমাইল শেখের পেছনে পেছনে দৌড়ে আসছে তীব্র আক্রোশে কাঁচা রাস্তার মুখ আর
সঙ্গে প্রসারিত রক্ত লকলকে জিহ্বা। দৌড়, দৌড় আর দৌড় … প্রাণের ভয়ে আপ্রাণ দৌড়ে যাচ্ছে ইসমাইল শেখ। কিন্তু পেছনে পেছনে আসছে খলবল করে দোলার পর দোলা দিয়ে রক্ত-টকটকে কাঁচা রাস্তার আগ্রাসী মুখ, মুখের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা রক্তলোলুপ জিহ্বা, হাজার বছরের কষ্টসাধ্য অপেক্ষায় থাকা কাঁচা রাস্তার কাঁচা জিহ্বা ছুটছে …
দৌড়াতে দৌড়াতে ইসমাইল শেখের মুখ থেকে জিহ্বা বের হয়ে আসছে, দুই গালের প্রান্ত ছুঁয়ে লালা ঝরছে। একপলক দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে পেছনে তাকায়, বীভৎসভাবে হাসতে হাসতে পলকে পলকে এগিয়ে আসছে উজিয়ে আসা রাস্তার মুখ ও রক্তাক্ত জিহ্বা।
প্রাণের মায়ায় আবার দৌড় শুরু করে ইসমাইল শেখ; কিন্তু বুঝতে পারছে ওর দৌড় আর কাঁচা রাস্তার দৌড়ের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। জীবনের মায়ায় ইসমাইল শেখ হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আছাড় খেয়ে পড়ে রাস্তারই ওপর। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে শুনতে পায় ইসমাইল শেখ কাঁচা রাস্তার স্লোগান – আজকে তোরে ছাড়বো নারে …। ভয়ে আড়ষ্ট ইসমাইল শেখ পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় গ্রামের অনেক পা ছুটে আসছে … পড়িমরি দৌড়। কান্নাকাতর দৌড়। হাঁপানো দৌড়। রক্তমাখা দৌড়। শোকাভিভূত দৌড়। প্রাণ বাঁচানোর দৌড়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বয়োবৃদ্ধ দৌড় … পড়িমরি ইসমাইল শেখ আবার দৌড় শুরু করে। পরনের লুঙ্গি খুলে যাচ্ছে, ওপরের হালকা গেঞ্জি দৌড়ের শুরুতেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইসমাইল শেখ বুঝতে পারছে না, কে কার আগে যাবে? রাস্তার লকলকে জিহ্বা – না, ছুটে আসা পলায়নপর মানুষের পদধ্বনি!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.