পথের পাঁচালী : কিছু ভাবনার কোলাজ

মোস্তাক আহমেদ

‘জানেন, ভরা বর্ষাতে শ্যুটিং করেছিলাম আমরা। মাঝেমধ্যেই শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যেত টাকার অভাবে। তারপর বিধান রায় ব্যবস্থা করে দিলেন। উনি না থাকলে বোধহয় ‘পথের পাঁচালী’ হত না। আজও মনে আছে, দিদি আর আমি ল্যাম্পপোস্টে কান দিয়ে যখন ট্রেনের আওয়াজ শুনছি, ওই সিনটার সময় কাদায় দু’জনের পা-ই বারবার ঢুকে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই শ্যুটিং হল। কী অবস্থা তখন আমার আর দিদির,’…

একজন শিশু-অভিনেতা বড়ো হয়ে ক্রমে প্রায় সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন – গুটিয়ে নিতে একপ্রকার বাধ্য হন। সারাটা জীবনে নানা দুর্ঘটনার অভিঘাতে তিনি ভারাক্রান্ত। জীবনের কাছে চাওয়া ছিল অনেক। অথচ কাল্পনিক চরিত্রটি শুধুই তাড়া করে বেড়াল। কী দিল জীবন! কী পেলেন কুঁদঘাটের সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়! বাস্তবের ৬৮ বছরের একজন প্রৌঢ়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম এক শিশু-অভিনেতা। পথের পাঁচালীর অপু। এখন শুধুই কি স্মৃতি-কাতরতা! ‘নিশ্চিন্দিপুর যখন সাদার্ন অ্যাভেনিউ’, ইন্দ্রনীল রায় এবং আরো অনেকের সঙ্গে এভাবেই স্মৃতি ভাগ করে নেওয়া! ২১ এপ্রিল, ২০১৪ আনন্দ প্লাসের পাতাজুড়ে উঠে আসে টুকরো টুকরো কথা। কিছু কথা দুর্গার, বেশিটা অপুর।

অপুর পাঁচালী শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর অবদান স্মরণীয়। নামকরণের ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বন্ধু হিসেবে দেওয়া তাঁর পরামর্শ শব্দটির সঙ্গে আমাদের সংযুক্তি ঘটায়। আবার ১৩৮১ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র একটি গ্রন্থ প্রকাশ পায় এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড প্রকাশনা সংস্থা থেকে। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের সে-গ্রন্থের নাম অপুর পাঁচালী। ‘অপুর পাঁচালী অবশ্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের মূল্যায়ন নয় – তাঁর জীবন ও সাহিত্যের গতি অনুসরণ করে উভয়ের অভিন্নতা প্রদর্শনের প্রয়াস। – জীবন-উপন্যাস। যদিও এই আখ্যা দিয়ে একে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেল না। আঁদ্রে মরোয়া যেমন শেলি বা ভলটেয়ারের জীবন নিয়ে উপন্যাসের মত চিত্তাকর্ষক বই লিখেছেন বা সম্প্রতি আর্ভিং স্টোনকে দেখি ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ, আর পিয়েরে লা মুর তুলুজ লোত্রেক্কে অথবা একদা শিবনাথ শাস্ত্রীমশাইয়ের ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজে’ একটা স্বতন্ত্র স্বাদের মেজাজ ফুটে উঠতে দেখেছি। অপুর পাঁচালীকে ঠিক সেই ধরনের ছকেও ফেলা যাবে না। বর্তমান গ্রন্থটি স্মৃতি ও শ্রুতি এবং প্রকাশিত-অপ্রকাশিত দলিলের ওপর নির্ভর করেই পরিকল্পিত।’ গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ‘ভূমিকা’ লিখতে গিয়ে এসব তথ্যই জানাচ্ছেন। এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ‘বিভূতিভূষণের জন্মদিনে সার্থকতম জীবনভাষ্যধর্মী শিল্পী সত্যজিৎ রায়কে।’ ১৪০০ বঙ্গাব্দের দেশ পূজা সংখ্যায় প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের নিবন্ধ প্রকাশিত হয় অপুর পাঁচালী নামেই। আর ২০১৪-য় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুভূতির অতলে অর্ধেন্দু মিশে গেছেন চরিত্রের সঙ্গে। তিনিই কৌশিকের ছবির ভরকেন্দ্র – তিনিই মূল সম্পদ। শিশু অপু ক্রমশ বড়ো হয়। তার ডাগর চোখে দেখা জগৎ একটু-একটু করে বদলায়। বদলের নাড়িনক্ষত্রে এসে মেশে নানা অভিঘাত, আপস চিনে নেয় রাত্রি-শীতলতা। আমরা প্রত্যেকেই তখন এক একজন অপু – একসূত্রে বাঁধা। অপু – বিভূতিভূষণ, নীরদচন্দ্র, গৌরীশঙ্কর, কৌশিক, অর্ধেন্দু – ৬৮ বছরের সুবীর। আমরাই খুঁজে ফিরি আজো দক্ষিণায়ন ফ্ল্যাটের ন-তলা। খুঁজি উমা দাশগুপ্তকে, আজকের উমা সেনকে। তিনি পথের পাঁচালীর দুর্গা। আমরাই খুঁজে ফিরি ফেলে আসা স্মৃতি-নুড়ি – এক একটা যাপনের কত না ইতিবৃত্ত। পথ ডেকে নিয়ে যায় পথের কাছে। কানের কাছে ফিসফিসানি। যাবতীয় অভিমান জমা হয়। আমরা কড়া নাড়ি সুবীরের অন্দরে।

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার – ট্রিলজির ছোট-ছোট কোলাজে সুবীরের পদচারণা – কৌশিকের নির্মাণ। বোড়ালের সেই চেনা বাড়ি কত না দাবি রেখে যায়! কোনখানে পিসিমার ঘর, কোনখানে উঠোন, কোনখানে বাঁশবাগান – চড়–ইভাতির সেই দুপুরবেলা, আরো কত কী যে! জানালায় ঝড় কথা বলে। তছনছ করে দিয়ে যায় চেনা সব ছক। জীবন তো এরকমই। যাপনে এসে মেশে সময় – সময় চলে যায় নিঃশব্দে। নিঃশব্দ বোনে একাকিত্ব। সব হারানোর বেদনা আজো কাশফুল খোঁজে, পদ্মপাতায় বৃষ্টি নামার শব্দ শুনতে চায়। মেঠো আলপথ ধরে বোড়াল এখনো সান্ত¡না-বাজি। বারবার ফিরে-ফিরে তাই যাওয়া পথের পাঁচালীর কাছে। সে উপন্যাসই হোক কিংবা চলচ্চিত্র। অপুর পাঁচালী আরো একবার উসকে দিল। নস্টালজিক অনুঘটকীয়তার ক্ষেত্রে তার যে জুড়ি মেলা ভার।

বিভূতিভূষণের উপন্যাসে ইন্দির ঠাক্রুন মারা যান উপন্যাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে। বিভূতিভূষণ লেখেন – ‘ইন্দির ঠাক্রুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল।’ সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এই মৃত্যু ঘটে অনেকটা পরে। অপু-দুর্গার রেললাইন দেখার পরিস্থিতিতেই যেন নতুন দিনের সূচনা। শেষ হয় পুরনো যুগ। মাটিতে গড়িয়ে পড়েন ইন্দির ঠাকরুন। অপুর পাঁচালী ঠিক এভাবে নির্দিষ্ট কোনো সময়ক্রমের কথা বলে না। বরং বারবার সে ভাঙতে চায় সময়ক্রমের ছক। জীবনের ভাঁজে-ভাঁজে মিশে যায় সময়। ছবির ভেতরে ছবি সারাক্ষণ কথা বলে যায়। একই ফ্রেমে গাঁথা হয় অতীত-বর্তমান, বর্তমান-অতীত – রূপরেখা ভবিষ্যতের। একাকার ট্রিলজি অপুর পাঁচালী। রেললাইনের মতো সমান্তরালভাবে এগিয়ে যায় সুবীরের জীবন। আমরা তো কান পেতে আছি। কান পেতে আছি রেললাইনে, রেলের খাম্বায় – বহুদিন, বহু বহু অপেক্ষা ক্ষণ। ট্রেন আসবে, চলে যাবে – আসবে, চলে যাবে। অপেক্ষা জমতে থাকবে পুনরায়।

আদিগন্ত ধানক্ষেত বরাবর হেঁটে যায় উদাসী মন। বিভাজিত সত্তা অপু হাত বাড়িয়ে ডাকে – কাছে পেতে চায়, কাছে হতে চায়। উপন্যাস, চলচ্চিত্র, জীবন – তিনের আর এক সমাহার, মিলেমিশে তারা একশা। শুধু মনই পৌঁছায়। পা সরে না। চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শেকড়। শেকড়ে টান পড়ে। পা সরে না। মন বাঁধ মানে না। আদিগন্ত সবুজ। সবুজে পাতা আছে কান।

 

দুই

পথের পাঁচালী উপন্যাসটি পড়ার আগে টিভিতে চলচ্চিত্রটি দেখে ফেলি। সে তো অনেক দিন আগের কথা। তখন সেভেন বা এইটে পড়ি। উড়– উড়– মন। দু-চারটে কবিতা লিখি সে-সময়। যা দেখি, যা শুনি, শুধু কবিতা খুঁজি। অপুর ডাগর চোখের বিস্ময়, দুর্গার স্বাভাবিক আচরণ-অভিনয়, ঝড়-বৃষ্টির খেলা, উন্মুক্ত মাঠ আর পথ আমারই গ্রামজীবনকে যেন সরাসরি চোখের সামনে তুলে আনছিল। একটা ভালো লাগার আবেশ কাজ করেছিল। মনে হয়েছিল এই তো কবিতা! তারপর স্কুলের পাশের লাইব্রেরি থেকে বই তুলে পড়ে ফেলি। আবেগে, রুদ্ধশ্বাসে। কোনটা যে বেশি ভালো লেগেছিল এখন আর তা বলতে পারব না। তারপর বহুবার উপন্যাসটি পড়েছি – প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, ভেতরের তাগিদে – চলচ্চিত্রটিও দেখেছি বারবার। আজো বলতে পারি না কোনটা বেশি প্রিয়। বইটি পড়ার পর বা চলচ্চিত্রটি দেখার পর এখনো এক নিঃসীম নীরবতা এসে গ্রাস করে। আবেগের ঘোর কেটে গেছে কবে! বিস্ময়ের ঘোর আর কাটতেই চায় না। বিস্ময়ে এসে মেশে তথ্য, তত্ত্ব।

ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে সত্যজিতের স্বীকৃত শিল্পীজীবনের সূত্রপাত। মূলত বিজ্ঞাপন সংস্থার ছবি। এছাড়া ছিল সিগনেট প্রেসে বইয়ের প্রচ্ছদ করার কাজ। সিগনেট প্রেসের পক্ষ থেকে সত্যজিৎ রায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয় পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশনের। সেই প্রথম পথের পাঁচালীর সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয়। সেই প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম। তারপর বহুবার – বারবার পড়ে ফেলা। এমন উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র হতে পারে এর আগে কেউ ভাবেননি। ভাবার দুঃসাহস কেউ দেখাননি। সত্যজিৎ ভাবলেন। অথচ এর আগে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো শিক্ষানবিশি তিনি কখনো করেননি। ঝুলিতে ছিল শুধু অসংখ্য চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা। ‘আম-আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশনের মাঝেই কখন যেন সঙ্গোপনে শুরু হয় চিত্রনাট্য তৈরির কাজ!

শুধু কি তাই, ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সত্যজিতের সহকারীরাও ছিলেন মূলত নবীন এবং অনভিজ্ঞ। আলোকচিত্রের দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত মিত্র। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ। তিনি এর আগে কখনো মুভি ক্যামেরা ব্যবহার করেননি। বাইরে থেকে আলোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রকৃতিতে যখন যেমন আলো পাওয়া গিয়েছিল সেই অনুযায়ী ছবি তোলা হয়। পথের পাঁচালীর শিল্প-নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন বংশী চন্দ্র গুপ্ত। এটাই তাঁর প্রথম কাজ। স্টুডিও চত্বর তাঁর কাছে ছিল অচেনা জগৎ। ছবির সম্পাদনা করেন দুলাল দত্ত। কাহিনি-চিত্র সম্পাদনার কোনো প্রাক-অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। এরকম আনকোরা লোকজনকে নিয়েই কাজ করতে হয়েছে সত্যজিৎকে। আসলে প্রথাগত নিয়মকে তুড়ি মেরে পথের পাঁচালীর নির্মাণ। ঝকঝকে কোনো স্টুডিও চত্বরেও শুটিং হয়নি। বিখ্যাত কোনো চোখধাঁধানো আউটডোরেও নয়। বরং বেছে নেওয়া হয় অজপাড়াগাঁ। বেছে নেওয়া হয় অখ্যাত বোড়াল গ্রাম। আবার ছবির অন্যতম অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা। গণনাট্যে একসময় অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সার্বিক অর্থে তিনি পেশাদার অভিনেত্রী নন। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কথা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় (অপু), উমা দাশগুপ্ত (দুর্গা) – দুজনেই তখন একেবারে স্কুলপড়–য়া সাধারণ ছেলেমেয়ে। অভিনয়ের সঙ্গে ছিল না কোনো সংযোগ। আজকের মতো তখন খুব স্বাভাবিক কারণেই মিডিয়ার এত বাড়বাড়ন্তও ছিল না এবং রিয়্যালিটি শোও ছিল না। ফলে এসবের কোনো প্রভাবই কাজ করেনি সুবীর কিংবা উমার মধ্যে। এঁরা সকলে আসলে সত্যজিতের আবিষ্কার। আর এক অন্যতম আবিষ্কার অবশ্যই ইন্দিরা ঠাক্রুন – চুনীবালা দেবী –  প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী নিভাননীর মা। একসময় পাবলিক স্টেজে অভিনয় করলেও এই বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় ছিল অসম্ভবের ভাবনা। এঁদেরকে নিয়েই সত্যজিৎ অসাধ্য সাধন করলেন।

সত্যজিতের অসাধ্য সাধন খুব সহজে ঘটেনি। পরিকল্পনা মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেয়েছে। অর্থের অভাব থমকে দিয়েছে কাজ। বিরুদ্ধ সমালোচনা ছিল বিষাগ্র তীরের মতো। বারবার বন্ধ হয়েছে শুটিং। পথের পাঁচালীর নেপথ্য কাহিনিতে চ-ীদাস চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন – ‘বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে যাঁরা জিনিসটাকে ভাল চোখে দেখতেন না তাঁরা বাঁকা হাসি হাসলেন। অনেকেই বললেন, ‘কেমন বলেছিলাম না নবিশের হাতে ‘পথের পাঁচালী’ তুলে দেবেন না! ওসব ব্যাঙ, ঘুঘুর ডাক, পাখির কিচিরমিচির নিয়ে কি আর ছবি হয় ভাই!’

তারপর বিধানচন্দ্র রায়ের উৎসাহ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় কীভাবে পথের পাঁচালী ছবি হয়ে ওঠে সে ইতিহাস অনেকেরই জানা। কিন্তু ব্যাপারটা এরকমও নয় যে, ডা. রায় অর্থনৈতিক সুবিধে করে দিলেন, আর ম্যাজিকের মতো পথের পাঁচালী জন্ম নিল। চারদিকের বিরুদ্ধ ভিড়ে তখন তিরস্কার, উপহাস, গুঞ্জন, হাসাহাসি। পূর্বোক্ত গ্রন্থেই চ-ীদাস জানাচ্ছেন – ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েও দীর্ঘদিন লাগল ‘পথের পাঁচালী’ ছবি হয়ে বেরুতে। মাঝেমধ্যে কলকাতার কবি ও সাহিত্যিক এবং প্রকাশক মহলে রসিকতা শুনতাম ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে। রাজ্য সরকারের কোন দপ্তরের অধীনে থাকবে তাই নিয়ে মহাকরণে তুমুল বিরোধ। প্রায় রোজই ডা. রায়ের কাছে বিভিন্ন বিভাগীয় সেক্রেটারিরা ধরনা দিচ্ছেন এবং তুমুল তদ্বির চালাচ্ছেন। শিক্ষা দপ্তরের দাবি প্রবল। তাঁরা বলছেন, ছবি তাঁদের খবরদারিতে হোক। প্রচার বিভাগের দাবি অনেক আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার রাজ্যের পিডব্লিউডির দাবি : ছবির নাম যখন ‘পথের পাঁচালী’ তখন এটা পিডব্লিউডির আওতায় পড়ে যায়। অতএব তাঁদের দাবিই সব চেয়ে বেশি জোরদার এবং সোচ্চার। বুঝুন ব্যাপার! ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’ দাবি তুললেন : এসব তদ্বির তদারকের ভার তাঁদের ডিপার্টমেন্টকেই দেওয়া হোক। তাঁরা আরো বললেন, ‘পথের পাঁচালী’ ছবির সঙ্গে আরো খানিকটা এক্সট্রা রিল দেখাতে হবে। বোঝাতে হবে : ‘পথের পাঁচালী’ ছবির মত আগে গ্রামের অবস্থা ছিল। এখন স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ সুজলা সুফলা হয়েছে।’

১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট বীণা, বসুশ্রী ইত্যাদি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় পথের পাঁচালী। অনেক বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে এই মুক্তি বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে নতুন বাঁক নিয়ে আসে। শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রকেও তা প্রভাবিত করে। একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে কীভাবে সাফল্যের চূড়াকে স্পর্শ করে তার উদাহরণ সত্যজিৎ। গ্রামীণ জীবনকে এত বাস্তবোচিত মাত্রায় ফুটিয়ে তোলা তখনকার প্রযুক্তিতে সহজ ছিল না। স্বপ্নময় মায়াবী জগৎ ছেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে তুলে আনা পথের পাঁচালীতেই সম্ভব হলো। কোনো উচ্চকিত প্রতিবাদ নয়, সরল-গরিব মানুষের কথা সহজে ধরা পড়ল সত্যজিতের ক্যামেরায়। তখন দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে, দেশভাগের যন্ত্রণায় কাতর ছিন্নমূল অজস্র মানুষ। এই সময় সত্যজিৎ বিভূতিভূষণকে নতুন করে চেনাচ্ছেন চলচ্চিত্রে। যে-উপন্যাসটি লেখা ১৯২৯-এ। কাশফুল আর কাশফুল – ঢেউ আর ঢেউ – এসব পেরিয়ে রেললাইন –  রেল ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাওয়া। প্রকৃতি, জীবন আর শুধুই কি নতুন দিনের বার্তা! না, আরো কিছু! কান পেতে শোনা পুঁজিবাদের পদধ্বনি।

পথের পাঁচালী গতানুগতিক চিত্রভাবনায় বড়োসড়ো আঘাত হেনেছিল। প্রথম ভারতীয় সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণ যথার্থ চলচ্চিত্রের নাম পথের পাঁচালী। সত্যজিৎ সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে এক ফ্রেমে বন্দি করেছেন। প্রথাগত কোনো নিয়মে বাঁধা না থেকেও যে চলচ্চিত্রকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব তা দেখিয়েছেন। অকারণ-অবাস্তব স্বপ্ন প্রদর্শন নয়, মানুষকে চিনিয়েছেন তার পায়ের তলার মাটি, অনুভব করিয়েছেন প্রতি-সত্তার আত্মা-অবস্থানকে। কোনো অনুকরণ ছাড়াই তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে ‘নব্যবস্তুবাদে’র ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা। হয়তো এসব কারণেই শত বিতর্কের মধ্যেও পথের পাঁচালী মানবতার শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের সমর্থ রাখে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সত্যজিৎ প্রথম চিত্রনাট্য রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে বাইরে উপন্যাসের। অথচ তিনি প্রথম ছবি করেছেন পথের পাঁচালী। পথের পাঁচালী তখন সত্যজিৎকে যেভাবে নাড়া দিতে পেরেছিল আর কোনোকিছু তা পারেনি। শত বাধা উপেক্ষা করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক দুর্নিবার টানে। যে-টান এসেছিল ভেতর থেকে। এসেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন নবীন ও অনভিজ্ঞ সহকর্মীদের মধ্যে – অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে। আর আজ মনে হয়, দর্শকদের মধ্যেও।

 

তিন

তখন গ্রাম ত্যাগ করে আসা মানুষের ক্লান্তিকর ভিড় শহর কলকাতায়। শহুরে যাপন দিচ্ছে অনেক নিশ্চয়তার হাতছানি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালপর্বে লেখা হয় পথের পাঁচালী। আর চলচ্চিত্র নির্মিত হয় দুই বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীতে। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই দুর্ভিক্ষ, উপবাস, মৃত্যু। ভারতবাসী ততদিনে দুটি মহাযুদ্ধের ফলে ধ্বংস, মৃত্যু ও মহামন্বন্তরের রক্তাক্ত আস্বাদ পেয়েছে। বাংলার গ্রামীণ জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। সেই অস্থির সময়ে গ্রামীণ জীবনে যখন তোলপাড় সর্বত্র, ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি, তখন প্রচুর মানুষ, কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে চলে আসে কলকাতায়। গড়ে ওঠে একের পর এক আস্তানা, গড়ে ওঠে মেসবাড়ি, নতুন-নতুন আশ্রয়। মাঝে-মাঝে ছুটিতে গ্রামে ফেরে মানুষ, পল্লির কোমল পেলব ছোঁয়ায় আশ্রয় নেয়। এভাবে চলতে-চলতে অনেকে ক্রমে কলকাতায় থিতু হয়। শুরু হয় আর এক যাপন। তারপর আবার আসে দেশভাগ। কোটি কোটি বাস্তুত্যাগী মানুষ শহর-মফস্সলে ভিড় করে – খুঁজে বেড়ায় নিজেদের অস্তিত্ব। এসব মানুষের ভেতরে ভেতরে বাসা বাঁধে এক ধরনের নস্টালজিয়া। গ্রাম ডাকে, ডাকে সুস্থিত জীবন। এরা স্বাভাবিকভাবেই পথের পাঁচালীতে পেয়ে যায় হারানো সম্পদ, ফেলে-আসা সময়। ফলে, পথের পাঁচালীকে তারা আপন করে নেয়। সে উপন্যাসই হোক কিংবা চিলচ্চিত্র।

জীবন চলমান। সভ্যতা থেমে থাকে না। মানুষ বিজ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে খুঁজে পায় আরো অজ্ঞাত শক্তির উৎস। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে আরো শক্তিধর। বানায় নতুন নতুন অস্ত্র। এরই অনিবার্য ফলে বিশ শতকেই ঘটে দুই ভয়াবহ মহাযুদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮ ও ১৯৩৯-৪৫ খ্রিষ্টাব্দ)। এই দুই যুদ্ধ অতীতের সব যুদ্ধকে ছাপিয়ে যায়। কারণ এই দুইয়ের বিস্তৃতি ঘটেছিল বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একই মারণযজ্ঞে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল বোমারু বিমান ও আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ। নিহত ও বিকলাঙ্গ হয়েছিল সামরিক ও অসামরিক স্তরের অসংখ্য মানুষ। সীমাহীন সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের নাৎসি-ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলোর ধনবাদী সংকট উত্তরণের জন্য সমরবাদী প্রয়াসের বিনাশী ফসল। সমর আয়োজনের দিক থেকে, বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধ-সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে, প্রাণ ও সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে এই যুদ্ধের ব্যাপকতা এর আগের যে-কোনো যুদ্ধের চেয়ে বেশি। এই সর্বগ্রাসী মহাসমর একদিকে যেমন বিশ্বের আর্থ-সামাজিক জীবনকে বিধ্বস্ত করে দেয়, তেমনি সংকটগ্রস্ত করে মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের জগৎকে।

এই বৈশ্বিক পরিবেশে ব্রিটেনের উপনিবেশ ভারতবর্ষেও নানাভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তরঙ্গ এসে লাগে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ এই সময় ভারতের রাজনৈতিক-পরিচালন ব্যবস্থায় দেশীয়দের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তার দাবি, উচ্চপদস্থ চাকরির ক্ষেত্রে দেশীয়দের অধিকতর সুযোগ-সুবিধা, শিল্পের বিকাশের অনুকূল পরিবেশের দাবি দৃঢ়তার সঙ্গে উত্থাপন করেন। যুদ্ধের সময়ে নানা ধরনের উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠন ব্রিটিশ উচ্ছেদের সশস্ত্র কর্মপন্থা গ্রহণ করে।

ঊনবিংশ শতকের আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে-আন্দোলন নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের সম্পর্ক ছিল না। অন্যদিকে যে-আন্দোলন গ্রামীণ পটভূমিতে গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে নাগরিক গণমানুষ সংশ্লিষ্ট ছিল না। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের সমসাময়িক আন্দোলনগুলো নগরের অধিকতর সচেতন শ্রেণির উদ্যমে সৃষ্ট হলেও বৃহত্তর গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে গভীর আলোড়ন সঞ্চারিত করে।

পথের পাঁচালীতে কোনো আন্দোলনের কথা নেই। বৃহত্তর সমাজ নিশ্চিন্দিপুরের খোলনলচে একেবারে বদলে ফেলছে এমনটাও নয়। বরং যে-পরিস্থিতিতে মানুষ পথের পাঁচালীকে পাচ্ছেন সেই পরিস্থিতিতে অমন প্রথাগত গ্রামীণ জীবনই কাক্সিক্ষত। এতদিন এই জীবনই তো মানুষ লালন করে এসেছে। হরিহর ব্যতিক্রমী চরিত্র। পৃথিবীকে তিনি অনেকখানি দেখেছেন। কিন্তু পথের পাঁচালীর বাকি নির্মাণ একেবারেই সাধারণ মানুষের যাপনের নির্মাণ। সাধারণ মানুষ গ্রামের বাইরে যাওয়ার কথা একসময় ভুলেই গিয়েছিল। বৈবাহিক কারণে বা তীর্থে যাওয়া ছাড়া তার গ্রামের বাইরে বেরোনোর প্রয়োজনই হতো না। সভ্যতার আদিপর্বের অরণ্যচারী যাযাবর মানুষের মনে আত্মরক্ষা, সুস্থ-স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ সম্মিলিত জীবন ও যাপনের প্রয়োজনে গোষ্ঠী-চেতনার উদ্ভব ঘটে। এর ফলে বাসযোগ্য মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে একের পর এক গ্রাম। পল্লির পরিবেশে হাটে-মাঠে-ঘাটে শ্যামলতার প্রাচুর্য ফুটে ওঠে। আম-জাম-পেয়ারা-কাঁঠালের বাগানে শোনা যায় নানা ধরনের পাখির কলগীতি। আকাশে ফুটে ওঠে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ বহুল মনোমুগ্ধকর বর্ণচ্ছটা। অনেক না-পাওয়া সত্ত্বেও শ্যামল-শোভন ছায়া-সুনিবিড় ছোট-ছোট গ্রামগুলো যেন এক একটা শান্তির নীড় – নিরাপদ আশ্রয় – নিশ্চিন্দিপুর, নিশ্চিন্তিপুর। পথের পাঁচালীতে আছে এসবেরই অনুরণন। ধ্বংস-মৃত্যুর মাঝেও সে যেন বাঁচবার অক্সিজেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা, সম্পত্তির ক্ষতি সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে। এই মহাযুদ্ধেই মানব-সভ্যতার ঘৃণ্যতম অস্ত্র আণবিক বোমা ব্যবহৃত হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। হিরোশিমায় ‘খরঃঃষব ইড়ু’ এবং নাগাসাকিতে ‘ঋধঃ গধহ’। চোখের পলকে দাউ দাউ আগুনে জ্বলে যায় দুটি অতিসমৃদ্ধ জনপদ। তেজস্ক্রিয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে শহরে-গ্রামে সর্বত্র। ধ্বংসের প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখে শিহরিত হয় সমস্ত পৃথিবী। এখনো সেখানে জন্ম ঘটে পঙ্গু শিশুর।

১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস বা ভারত সচিবের বার্তা বিভাগ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে যে ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ১৯৩৯-১৯৪৫ সালের তথ্য ও ঘটনাবলির যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা তুলে ধরতে গিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় জানান :

ভারতের ৪০ কোটি অধিবাসী ছড়াইয়া রহিয়াছে ১৫ লক্ষ ৮১ হাজার ৪১০ বর্গমাইল এলাকা জুড়িয়া। আঙ্গিকগত দিক দিয়া ভারতের আয়তন ব্রিটেনের ১৭ গুণ, একত্রিতভাবে ফ্রান্স ও স্পেনের ৪ গুণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট এলাকার দুই-পঞ্চমাংশ।

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যদিও তার পক্ষে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে অন্ন যোগানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার। তবে যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন ভারতের বিভিন্ন এলাকা ও শহরগুলি শান্তিপূর্ণ অবস্থায় উৎপাদনের জন্য ধীরে ধীরে উন্নত হইতেছিল। আধুনিক কোন যুদ্ধের জন্য ভারত সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ভারতে সেই সময় একটি নতুন বিমানক্ষেত্র তৈরি করিতে পশ্চিমী দুনিয়ার মত চলতি অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিলেই চলে নাই; বরং এ জন্য সব কিছুর গোড়াপত্তন করিতে হইয়াছিল।

যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আগে যেখানে ছিল গ্রাম, ধানক্ষেত এবং রৌদ্রদগ্ধ মরুভূমি সেখানেই গড়িয়া তোলা হয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা, রাস্তা, রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাড়িঘর, বিদ্যুৎ ও শক্তিকেন্দ্র, পয়ঃপ্রণালী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সবকিছু।’

 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে একদিকে নাৎসি-ফ্যাসিস্ট অন্যদিকে মিত্রবাহিনী ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ব্রিটিশ ছিল এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অন্যতম অংশীদার। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ এই যুদ্ধে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাপানের সরাসরি সামরিক অভিযানের শিকার হয় পূর্ব-ভারত। এই যুদ্ধ বাংলার মানুষকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা যায়। নিরন্ন গ্রামবাসী ভিটেমাটির আশ্রয় ছেড়ে অন্নের খোঁজে শহরে এসে ভিড় জমায়। এই চরম সংকটের ফলে গ্রামীণ মানুষের আর্থ-ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। সাধারণ কৃষক জমিজমা-ভিটেমাটি হারিয়ে পরিণত হতে থাকে ভূমিহীন সর্বহারায়।

যুদ্ধ মানেই অকারণ ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ, উপবাস, মৃত্যু – অনেক অনেক ক্ষতি। বাংলার জীবনে তা আনে ভয়াবহ পরিবর্তন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথার মতো বদলে যায় গ্রামীণ জীবন। তখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। শুধু বাঁশবাঁদি গ্রাম কিংবা হাঁসুলি বাঁক নয়, তখন বদল ঘটে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর। বদলে যাচ্ছে ইতিহাসের রূপরেখা। হাঁসুলি বাঁকের ‘বাঁক’ কথাটি যেন সেই বদলের সমার্থক। ঠিক এখানেই ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে পথের পাঁচালী। নিশ্চিন্দিপুরে একটা কল্পনারাজ্য গড়ে তোলেন বিভূতিভূষণ (এবং সত্যজিৎ)। সেখানে অভাব-অনটন আছে। প্রাত্যহিক বেঁচে থাকার লড়াই আছে। বিনা চিকিৎসায় দুর্গার চলে যাওয়া আছে। পরিত্যক্ত নীলকুঠি আছে। আছে রেললাইন। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাব কই! পরাধীনতার যন্ত্রণা কই! ইন্দির ঠাক্রুনের মৃত্যুর সঙ্গে সেকালের যে অবসান ঘটে গেল সেই সেকাল কতটা আছে উপন্যাসে! রেললাইনই শুধু বলে যাবে একালের কথা! আসলে নিশ্চিন্দিপুরের যাপনে আছে এক স্বাভাবিকতা। অপুর চোখ দিয়ে প্রকৃতি-সম্পৃক্ততায় সেই স্বাভাবিকতা আমাদের রোমান্সে আবিষ্ট করে। নিকটকে নতুন করে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয় মন। অথবা স্বাভাবিক সেই বাংলার গ্রামীণ যাপন খুঁজে পেতে, খুঁজে পেয়ে সহজে উদাস হয় আলুথালু জীবন। আর অপুদের নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাওয়া সেও তো বহু বহু মানুষের প্রাত্যহিক লড়াইয়ের

প্রাক-ইতিহাসের দিকেই আঙুল তোলে।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এলো স্বাধীনতা। হলো দেশভাগ। ঘটল দেশত্যাগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ইংরেজ সরকার বুঝতে পারে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিতেই হবে। বিশ্বযুদ্ধ অবসানের সনদেও ছিল উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা প্রদানের অঙ্গীকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজের হয়ে যে সকল ভারতীয় লড়াই করেছিল তারা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ওদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ইংরেজদের যথেষ্ট ভয়ের কারণ হয়। ততদিনে কংগ্রেস-মুসলিম লিগ বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ঘটে মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। জের চলে নোয়াখালী, রংপুর, বিহারে। মুসলিম লিগ-কংগ্রেসের বিরোধ চূড়ান্ত মাত্রা পায়। ক্রমে ঘটনা পরম্পরায়, রাজনীতির অন্ধগলি বেয়ে দেশভাগের সিদ্ধান্তই স্বীকৃত হয়।

শানিত হয় রাজনীতির নতুন হাতিয়ার। রাজায় রাজায় যুদ্ধ জমে। কিন্তু উলুখাগড়ার কী দশা? কোটি কোটি বাস্তুত্যাগী মানুষ নিজেদের ভিটে কি খুঁজে পেল! কোথায় তারা! তাদের যন্ত্রণা, কষ্ট, ক্ষোভ সব কি নিরসন হলো। তাদের ছিন্নমূল অস্তিত্বের কী দশা আজ! এসব নিয়েই সুনন্দা সিকদার লিখেছেন দয়াময়ীর কথা, মায়ের কষ্টভরা জেদের মুখখানি মনে পড়েছে হাসান আজিজুল হকের – তিনি লিখেছেন আগুনপাখি, শান্তা সেনের কলমে জন্মেছে পিতামহী, মিহির সেনগুপ্ত লেখেন বিষাদবৃক্ষ! দেশভাগকেন্দ্রিক সমস্যা আজো বাংলা প্রাত্যহিকতায় বহন করে চলেছে। ছিন্নমূল মানুষ এখনো তাঁদের অস্তিত্ব খুঁজতে ব্যাকুল। শহরের পাশাপাশি বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। নিজস্ব পরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের লড়াই কবে শেষ হবে কে জানে! এসব মানুষের মনে নস্টালজিক ভাবনা খুব স্বাভাবিক কারণেই কাজ করবে। অপু সেই নস্টালজিক ভাবনা জ্বালিয়ে রাখার উপযুক্ত সলতে। ফেলে-আসা মাটি অপুর চোখে নতুন করে দেখা, নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার। একটা সাধারণ পরিবার, গ্রামীণ পরিবার, বাংলার অধিকাংশ পরিবারেরই যেন মুখ। পথের পাঁচালী ভেতরের অব্যক্ত বেদনা-কথারই প্রকাশ।

আসলে আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে গ্রাম। জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে তা প্রকাশও পায়। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামবাঙলার গড়ন ও ইতিহাস গ্রন্থে সেকথাই লিখেছেন – ‘শহরকে নিয়ে আমরা যতই গর্ব করি না কেন, মানুষের আদি বসতির যে বিগ্রহরূপ আমাদের মনে আঁকা আছে, তা গ্রামই। যে শিশু গ্রাম দেখেনি, সে-ও ঘর আঁকে গ্রাম্য কুটিরের আদলেই। তার কল্পনার ঘর একটি দো-চালা বা চারচালা কুঁড়ে, তার চারপাশে গাছপালা আছে, চাষের খেত আছে। ছবির এক ধারে আঁকাবাঁকা রেখায় সে টেনে দেয় একটি পুকুর বা নদীর সীমানাও। গাছপালা, জমি-খেত, পুকুর-নদী, হাল-বলদ, চাষি-জেলে – এই সব কিছু নিয়েই তো গ্রাম। এই অর্থকারক চিহ্নগুলির কোনো একটিকে বাদ দিয়ে আমরা যেন গ্রামকে কল্পনাই করতে পারি না।’

খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘এই অর্থকারক চিহ্নগুলি’ শব্দগুচ্ছ। সারাটা উপন্যাসে বিভূতিভূষণ চিহ্নের পর চিহ্ন সাজিয়েছেন। সত্যজিৎও। আমার মনে হয়, উপন্যাসে বা চলচ্চিত্রে সে চিহ্নগুলো কাব্যিক আবেদন তৈরি করেছে। আমরা হয়ে উঠেছি এক একজন অপু। হারিকেন-চাটাই হাতে যে এখনো গুরুমশাইয়ের পাঠশালায় যায়। বিভিন্ন চরিত্রে সে আজো প্রকাশোন্মুখ। কাশবনের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় অপু-দুর্গা। দুর্গাপুজো আর কাশফুল এখন তো প্রায় সমার্থক। সে তো পথের পাঁচালীর দৌলতেই। এমনকি আজকের ই-প্রজন্মও কাশফুল-অপু-দুর্গার ছবি দিয়ে ফেসবুকে শারদীয়ার শুভেচ্ছা জানায়।

বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী বাংলার গ্রামের সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় ঘটায়। নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম ফিরিয়ে নিয়ে আসে আমাদের স্মৃতিভরা অতীতকে। পরিত্যক্ত পোড়ো জংলা গ্রাম, হতদরিদ্র নিত্য অভাব-অনটনে জর্জরিত মানুষ। অথচ লাবণ্যে ভরা প্রাণ। বাঁশবনে শতচ্ছিদ্র ঘরে সর্বজয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে জীবন কাটায়। গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাদের যোগ আছে, কিন্তু গ্রামসমাজে তারা প্রাধান্য পায় না। তার মা গরিব, তারা যে গরিব – একথা অপুও জানে। অথচ পরিবারের দৈন্যদশা অপুর মনকে খুব কম সময়ই স্পর্শ করে। গ্রামের নিসর্গপ্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য অসামান্য হলেও অপু ছাড়া পথের পাঁচালী উপন্যাসের আর কারো মনে তার প্রভাব পড়েছে মনে হয় না। বরং প্রভাব পড়ে পাঠকের মনে, দর্শকের মনে। পথের পাঁচালী হয়ে ওঠে সকলের প্রাণের সম্পদ।

বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির দৌলতে, অন্তত মোবাইল-ইন্টারনেটের কারণে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। ভালোর পাশাপাশি মন্দেরও রমরমা। পণ্য-সভ্যতা, চূড়ান্ত ভোগবাদ সর্বগ্রাসী মায়া বিস্তার করছে – বিস্তার করছে প্রতিনিয়ত। আগে সমাজনিয়ন্তা ছিল পাঁজি, এখন পুঁজি। আমার জন্মগ্রামে দেখেছি বিজ্ঞাপনী সভ্যতা মাটির দেয়ালকেও রেয়াত দেয়নি। মাটির ঘরের বাইরের দেয়ালজুড়ে দেখেছি ভোগ্যপণ্যের রঙিন বিজ্ঞাপন। সাধারণ মানুষ আজ যে বড়ো অসহায়! সত্যিই অসহায়। বড়ো ভয় হয়।

গ্রাম বদলে যাচ্ছে দ্রুত। রাতারাতি সে শহর হতে চাইছে। প্রযুক্তির কৃপায় গ্রামে এখন ভোগ্যপণ্য, আধুনিক বিনোদনের হরেক ছড়াছড়ি। আঞ্চলিক লোকশিল্প, আঞ্চলিক বিনোদন পুরনো কিছু টিকে থাকলেও তা নিভু নিভু। নতুন ভাবনার জন্ম কোথায়! চুরি হয়ে যাচ্ছে দিগন্তবিস্তৃত খেলার মাঠ, নির্ধারিত মেলার মাঠ। অথচ মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন সে পাথরের গায়ে আপনমনে ছবি এঁকেছে। শুকনো পাতা-কাঠে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে তালে-তালে সুখ-দুঃখের গান গেয়েছে। নেচেছে। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে আজো গুহার গায়ে সেসব ছবি দিব্যি টিকে আছে। তারা কত না কথা বলে।

আদপে মাটির কাছাকাছি হতে চায় মন। খুঁজে ফেরে হারানো শিকড়-বাকড়। পথের পাঁচালী হতে পারে সেই সান্ত¡না-বীজ –  নিশ্চিন্দিপুর। তাই তার আজো কদর।

ক্রমশ বদলে যাচ্ছে শৈশবের ছবি। প্রযুক্তির হাত ধরে আমরা প্রতিদিন অবগাহন করছি ‘ভারচুয়াল’ জগতে। গুলিয়ে যাচ্ছে

আছে- নেই-এর ধারণা। পাঠক এখন সাইবার ক্যাফের পথে, ইন্টারনেটের ফাঁসে বন্দি। জানা নেই পথের পাঁচালী নতুন এই প্রজন্মের কাছে ভবিষ্যতে আদৌ কোনো আবেদন নিয়ে আসবে কিনা! ‘ভারচুয়াল’ জগৎ নষ্ট করে দেবে কিনা অনুভূতির সব সূক্ষ্মতাকে! তবু ভরসা, এই আকালেও অপুর পাঁচালী দেখতে দর্শক হলে ভিড় করেছে।