পর্দার আড়ালের কথা

কে আছো ওখানে, কে হে

হয়তো আমার চেয়ে ছোটো

গাছের ফুলগুলি ফুটে ওঠো।

– ‘কেউ নেই’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

পর্দার আড়ালে কে আছো? শিল্পী জানতে চায় কে আছো ওখানে? এমন অনুসন্ধানী দৃষ্টি তাসাদ্দুককে তাড়িয়ে বেড়ায়। এ-ঘরে যা কিছু আছে দৃশ্যমান তার পাশেই ঝুলে থাকে একটি বড় আড়াল – পর্দা।

সচরাচর তাসাদ্দুক হোসেনের অনুসন্ধিৎসু মন আরো এক পর্দার ভেতরেই অবস্থান করে। কলাকেন্দ্রের চোদ্দোটি ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের মাঝে তিন ধরনের কাজ দর্শক দেখতে পান। একটি হলো জলরং ও ড্রইং, বড় ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক, কাগজে ড্রইং। সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি এমনকি তাঁর নিজের ঘরদোরকেও যখন শিল্পী কাজের বিষয় করে নেন তখন বোঝা যায় ছবির ভাষ্যে রয়েছে ক্ষতচিহ্ন নির্ণয়ের চেষ্টা। ইতিপূর্বে তাসাদ্দুকের কাজে আমরা বিষয় হিসেবে পর্দার ভেতর-বাইরের কথাগুলোকে জানতে চেষ্টা করছি। এবারের প্রদর্শনীতে পূর্বের কাজের ধরনের রেশ দেখা যায়। সঙ্গে নতুন আরো তিনটি কাজে খবরের কাগজের অবয়ব দেখতে পাই। খবরের কাগজে ছাপানো সংবাদের হুবহু রূপ আমরা দেখতে পাই না। সংবাদগুলোর সঙ্গে চলমান বাস্তবতার যোগসূত্র খুঁজে কিছু বাক্যকে স্যাটায়ার করতে দেখা যায়। কৌতুকাশ্রয়ী ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে সংশিস্নষ্ট অবয়ব নির্মাণ করে ক্যানভাস রচনা করা বাংলাদেশের শিল্পকলায় নতুন নয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাসাদ্দুক তাঁর শিল্পের বিষয় রচনা করেন। বর্তমান প্রদর্শনীতে রাখা কাজগুলোতে এর ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়।

নিজের কাজ সম্পর্কে বয়ান – ‘জগতের সর্বত্রই একটা পর্দা থাকে, মূল ঘটনার বাইরে বা অন্তরালের কথা আমরা জানি না। সে-অন্তরালের কথা আমি নিজেও বলে দিই না, আমার ছবিতে শুধু সে-অন্তরালের ইঙ্গিত দিয়ে যাই।’ সমাজের কোথাও কেউ একজন অপেক্ষা করে থাকেন ক্ষতচিহ্নের কথা বলে যেতে। তাসাদ্দুক শেষ পর্যন্ত সেসব কথা সম্পূর্ণ না করে শুধু ইঙ্গিত দিয়ে যান। এতে তাঁর সাহসের কমতি আছে এমনটি বলা যায় না। এটুকু বলা যায়, তাঁর কাজ অন্তর্গত ভাষণের দৃশ্যরূপ হয়ে ওঠে। তাসাদ্দুকের নিরলস শিল্পযাত্রায় বিভিন্ন ধাপ তিনি অতিক্রম করেছেন।

অ্যাকাডেমিক ধারার কাজে আশির দশকের শেষভাগে তিনি বাস্তবধর্মী চিত্র রচনার ধরন থেকে সরে আসতে থাকেন। চিত্রকলায় ব্যাকরণের প্রথা বাদ দিয়ে তিনি গড়তে শুরু করেন নিজস্ব রীতি। নিজস্বতায় ক্যানভাস গড়ার সময় তিনি দৃষ্টিনন্দন ক্যানভাস তৈরির কথা মাথায় রাখেননি। ক্যানভাসে স্নিগ্ধ-মায়াময় রূপ বাদ দিয়ে সাদাকালো রঙে তিনি সমাজের প্রকৃত রূপনির্ভর বক্তব্যপ্রধান শিল্প সৃষ্টি শুরু করেন। প্রায় প্রতিটি ক্যানভাসে আত্মপ্রতিকৃতি স্থাপন করে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। শিল্পীর হাজিরা দর্শকদের কাছে আরো আন্তরিক করে তোলে। এবারের প্রদর্শনীতে রাখা কাজগুলোর শিরোনাম ‘বিয়ন্ড দ্য ইনসিগনিফিকেন্ট’ বা ‘অসম্ভব’। শিল্পী যা ভাবেন সেটি সত্যি অতিকথন বা সম্ভব নয় এমন। কিন্তু সত্য ভাষণের মাঝে যে-তৃপ্তি সেটি তাসাদ্দুক খুঁজে পান। পর্দার আড়ালে সিরিজের কাজের বিষয়গুলোতে দেখা যায় – জানালায় পর্দা ঝুলছে, দুই পর্দার মাঝে শিল্পীর প্রতিকৃতি রাখা, বসার ঘরে সোফায় রাখা বালিশের নকশায় জিভ বের করা বাঘের মুখোশ। সোফার কোণে পেস্নটে রাখা আপেল। জানালায় ঝোলানো পর্দায় নকশা হিসেবে দেখা যায় হাঁ করা কুমির আর বাঘের মুখ। এ-প্রতীকী শিল্পকর্মে কুমির, বাঘ, খানিক দেখতে পাওয়া কুকুরকে চলতি সমাজের অসংগতি বলা যায়। আরেকটি ছবিতে বসার ঘরের সোফায় অবস্থান নিয়েছে একটি কালো বেড়াল, জানালায় ঝুলছে তিনরঙা পর্দা। পর্দার নকশায় নিস্তব্ধতার রেশ। ঘরের মেঝেতে রাখা রঙিন ফ্লোরম্যাট মলিন হয়ে উঠেছে।

দুটি কাজের বর্ণনায় আমরা বুঝতে পারি শিল্পী সমাজ রূপান্তরের  এই হতাশ খেলায় অসহায় হয়ে উঠেছেন। সমাজের উঁচু-নিচুতলার ব্যবধান, সম্পদ আর চাকচিক্যের জীবনপ্রণালির পাশাপাশি কিছু মানুষের হাহাকার শোকে পরিণত হয়। তাসাদ্দুক তাঁর শিল্পকর্মে সরাসরি এ-কথাগুলো বলেন না, শুধু ইঙ্গিত দিয়ে যান।

শিল্পকর্মের করণপদ্ধতির দিকে তাসাদ্দুকের ঝোঁক নেই। তাঁর শিল্পকর্ম বিষয়নির্ভর। বক্তব্য আর বিষয় নিয়ে গড়ে ওঠা ক্যানভাস তাসাদ্দুককে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

রং, রেখা, ছবির বিন্যাস, সব মিলিয়ে তাসাদ্দুক হোসেনের কাজে যে ঐক্য দেখা যায়, তাতে একটি দৃষ্টিনন্দন ক্যানভাস গড়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে বক্তব্যনির্ভর ক্যানভাস। গ্রিক পুরাণে থাকা শিল্পতত্ত্বের বর্ণনায় স্যাটায়ার বা কৌতুকাশ্রিত শিল্পকর্মে দেখা যায়, নির্দিষ্ট রং ও রচনাশৈলীতে এটি গড়ে ওঠা একটি শিল্পকর্ম। প্রাচীন গান্ধারা শিল্পরীতিতেও দেখা যায় একটি ছন্দনির্ভর আকৃতি বা অবয়ব তাঁরা গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের প্রথাগত শিল্পরচনার ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আশির দশকের শুরুতে একদল শিল্পী যে বৃত্ত ভাঙার পথে এগিয়েছেন তাসাদ্দুক সে অগ্রগামী তরুণদের একজন। সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যক্তিক পরিবর্তনের যে-ধাপ, সে-ধাপে পা রেখেই তিনি নির্মাণ করে চলেছেন তাঁর শিল্পকর্ম। ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর কলাকেন্দ্রে শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে জানুয়ারির ১৬ তারিখ। একই প্রদর্শনী চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারিতে ফেব্রুয়ারির ১৫ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে।