পাখি হতে চেয়েছিল ডানা ছিল না

আমার বড় চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বন্ধু ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমার আব্বার বাসা ছিল তখন (১৯৫১-১৯৫৬) স্বামীবাগে। সেখানে আব্বা, আম্মা, আমি ছাড়াও থাকতেন আমার বড় ও মেজো চাচা মহীউদ্দিন খান আলমগীর ও আমার ছোট ফুপু নীলুফার বেগম। সে-বাসায় আমার বড় চাচার বন্ধুরা – হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী থেকে মুর্তজা বশীরের ছিল নিত্য আসা-যাওয়া। এঁরাই গড়ে তুলেছিলেন শিল্প-সাহিত্যের উজ্জ্বল সময় পঞ্চাশের দশক। সেই হিসেবে এঁরা সবাই আমার চাচা, যদিও যৌবনে যখন তাঁদের সঙ্গে পরিচয় – সবাই হয়ে গেলেন ভাই। চাচা হিসেবে এঁরা আমাকে কোলে-কাঁখেও নিয়েছেন।
মুর্তজা বশীর নামের সঙ্গে আমার পরিচয় আরো পরে। যখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি, তখন বাসার স্টোররুমে পেলাম কাচে বাঁধানো একটি ছাপচিত্র। রমনার, ১৯৫০-এর দশকে করা। শিল্পীর নাম মুর্তজা বশীর। সেই ছবিটি এখনো আছে আমার সংগ্রহে। আরো পরে মুর্তজা বশীর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার একটা পোর্ট্রেট ছিল তোমাদের বাসায়, সেটা কোথায়?’ সেই পোর্ট্রেটের কথা আরো শুনেছি। পাইনি। উপহার দিয়েছিলেন আমার চাচাকে। হারিয়ে গেছে কোথাও।
মুর্তজা বশীরকে বাইরে থেকে বোহেমিয়ান মনে হলেও ছিলেন খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কারো কাগজপত্র এত গোছানো আছে কি না জানি না। রবীন্দ্রনাথের লোকজন ছিল। মুর্তজা বশীরের তা ছিল না। পঞ্চাশের দশক থেকে যেসব ছবি এঁকেছেন তার তালিকা ছিল, বা মনে রেখেছেন। আমাকে একবার বেগম বাজারে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, দুটো ট্রাঙ্ক দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘সেখানে আছে আমার আঁকা সব পুরনো ছবি।’ তার ওপর গত ৬০ বছরে পত্রপত্রিকায় যা লেখা হয়েছে তার কাটিং ছিল তাঁর কাছে, ডায়েরি-পাণ্ডুলিপি সবই গোছানো ছিল।
আমি সবসময় শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রাণশক্তিতে মুগ্ধ হয়েছি। জীবনকে তাঁর মতো ভালোবাসতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। আমি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের সবসময় বলেছি, জীবনকে ভালো না বাসলে বড় কিছু করা যায় না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে হয়। জীবনকে ভালোবাসতেন বলে কৌতূহল ছিল তাঁর নানা বিষয়ে। তাঁর ডাকটিকেট, মুদ্রা, কারেন্সি নোট, দেশলাইয়ের বাক্সের সংগ্রহ ছিল দেখার মতো। আমি বিদেশে গেলে তাঁর জন্য এসব আইটেমের নিদর্শন নিয়ে আসতাম। আমাকে মনেও করিয়ে দিতেন। তাঁর মতো প্রতিভাবান মানুষ খুব কমই জন্মেছেন। গদ্য ছিল অনবদ্য। কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। গবেষণার জন্য ভাষা লিখেছিলেন। তাঁর মুদ্রাবিষয়ক গবেষণাপত্রগুলি প্রথম শ্রেণির। বাংলার মন্দির বিষয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। দু-দশক চেষ্টা করেও তাঁকে দিয়ে তা সম্পন্ন করাতে পারিনি। এটি আফসোস। তবে তাঁর মৃত্যুর আগে আমি ও তারিক সুজাত ‘জার্নিম্যান’ থেকে তাঁর চিত্রকলাবিষয়ক বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি।
আমার প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অফুরান। গত পাঁচ দশকে তিনি তাঁর জীবনের অনেক কাহিনি আমাকে বলেছেন যা কাউকে বলেননি। আমাকে এত স্নেহ করতেন যে, প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি হবে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক।’ বলা বাহুল্য, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। আমাকে অকাতরে বিভিন্ন মাধ্যমের যত ছবি উপহার দিয়েছেন তা আর কাউকে দিয়েছেন কি না সন্দেহ। এর মধ্যে দুষ্প্রাপ্য হলো বেগম বাজারের ট্রাঙ্ক থেকে দেওয়া পঞ্চাশের দশকে করা একগুচ্ছ লিথোগ্রাফ।
মাসকয়েক আগে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বাসায় ফিরেছি। প্রথমেই পেলাম তাঁর ফোন। জানালেন, কী উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। বললেন, ‘মুনতাসীর, মনটা আমার খুব খারাপ। আমার দুজন প্রিয় বন্ধু বোরহান (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর) ও আনিস (আনিসুজ্জামান) চলে গেল। আমি তাদের বয়সে বড়, আমি রয়ে গেলাম এখনো। মনটা বড় খারাপ।’
বললাম, ‘যদি বেঁচে থাকি দুজন এ-বছর, তাহলে করোনাকাল গেলে প্রথমেই তারিককে নিয়ে যাবো আপনার বাসায়। আপনার আত্মপ্রতিকৃতি বইটি বের করতে চাই।’
আর যাওয়া হবে না, গত ৫০ বছরে যাঁদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি এ-বছরই দেখছি তাঁরা একে একে চলে যাচ্ছেন। কেমন ফাঁকা লাগে চারপাশ। এত দুর্বিষহ সময় কি আগে এসেছে আমাদের জীবনে? হ্যাঁ, একবার এসেছিল ৫০ বছর আগে, ১৯৭১ সালে। যদিও তা তুলনীয় নয় অন্য কোনো সময়ের সঙ্গে।
তাঁর মৃত্যুর পর হাসনাতভাইয়ের অনুরোধে পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে পেলাম তাঁর ওপর আমার লেখা ১৯৭৮ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত একটি প্রচ্ছদকাহিনি, যা তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা আর শিল্পচর্চাকে তুলে ধরেছে ১৯৭৮ সাল অবধি। আশ্চর্য যে এই লেখার কর্তনী তাঁর কাছে ছিল না, আমারও মনে ছিল না। তবে মনে ছিল, ১৯৭৪ সালে নেওয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের, যেটির কর্তনী তাঁর কাছে ছিল, আমার কাছে ছিল না। সে-দুটি লেখা এখানে মুদ্রিত হলো।

মুর্তজা বশীর : শিল্প ও জীবন
‘সে পাখি হতে চেয়েছিল’ – বলেছিলেন তিনি, আবেগে ঠোঁট কাঁপছিল, শূন্যে একটি হাত থরোথরো, শীতসকালের রোদ শরীরে, ‘আমার এপিটাফে, বুঝলে কী লেখা থাকবে সেটা আগেই ঠিক করে ফেলেছি – লেখা থাকবে, ‘সে পাখি হতে চেয়েছিল কিন্তু তার ডানা ছিল না।” কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগ স্তিমিত হয়ে গেল। ফের শান্তভাবে স্মিত মুখে বসে রইলেন।
তাঁর লেখা একটি গল্পের নায়ক স্বপ্ন দেখে, ‘লাল সবুজ আর হলুদ কাঁচের পাখি সারা আকাশময় উড়ছে। একটা পাখি অন্য একটা পাখির ডানায় যখন লাগে শব্দ হয় গানের মতো! কাঁপা কাঁপা চিকন সুরের শিস সারা বাতাসকে ছেয়ে।’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের নামও কাঁচের পাখির গান।
তাঁর আঁকা বেশকিছু ছবির নাম এরকম, ‘বালক ও পাখি’, ‘মেয়ে ও পাখি’, ‘পাখির খাঁচা হতে বালক’ ইত্যাদি।
আরেকদিন, শীতসন্ধ্যায় তিনি আমাকে পাখির গল্প শোনাচ্ছিলেন। ঠিক সেই রকম আবেগতাড়িতভাবে বলছিলেন – ‘ফুল ঠোঁটে পাখি – এ কথা শুনে অনেকে হাসে। কিন্তু আমি নিজে লাহোরে দেখেছি গোধূলিতে একটি টিয়ে ঠোঁটে একটি হলুদ গাঁদা ফুল নিয়ে নীড়ে ফিরছে।’
ইদানীং ছবি আঁকা, গল্প-উপন্যাস লেখা ছাড়াও বাঁধানো একটি সুন্দর খাতায় চীনে কালি দিয়ে কবিতার পর কবিতা লিখছেন। এবং সেইসব কবিতায়ও বারবার ফিরে আসে হলুদ পাখি, নীলকণ্ঠ পাখি, অচিন পাখি।

তিনি মুর্তজা বশীর, পাখি ভালোবাসেন। পাখি হতে চান কিন্তু তাঁর ডানা নেই। পাখির স্পিরিটটি তিনি গ্রহণ করেছেন সচেতন বা অবচেতনভাবে। পাখি তাঁর কাছে একটি বিশেষ প্রতীক। সেই প্রতীকের অর্থ হতে পারে অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতা বা অতি রোমান্টিকতা।
লাহোরে ১৯৬১ সালে তাঁর এক প্রদর্শনী দেখে জনৈক সমালোচক লিখেছিলেন – ‘তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবিতে একটি পাখির প্রতীক দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ কি জীবন, না সৃষ্টিক্ষমতা, না কল্পনা?’
এই পরিপ্রেক্ষিতে মুর্তজা বশীর বলেছিলেন, ‘আমি নিজেও জানি না এই পাখিরা কখন আমার ক্যানভাসে এসে ধরা দিয়েছে। তাদের জন্ম ওখানেই। আমার অবচেতন মন মায়ের ভূমিকা পালন করেছে এখানে। হতে পারে পাখি এসেছে সুন্দর বা স্বাধীন জীবনের প্রতীক হিসেবে। আমি নিজেই জানি না।’
ছোটখাটো, কোঁকড়া চুল, চোখে চশমা মুর্তজা বশীর পাখির মতোই অস্থির, পাখির মতোই সুন্দর, স্বাধীন জীবন যাপন করতে চান তিনি। কিন্তু সমাজ, পরিবেশ জীবন যাপনপ্রণালি তাঁকে ঘিরে রাখে। তাই বোধহয় নিজের এপিটাফে তিনি লিখতে চান – ‘পাখি হতে চেয়েছিল কিন্তু ডানা ছিল না।’
ঢাকার রমনায়, ১৯৩৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান এ. কে. এম. বশীরউল্লাহ ওরফে মুর্তজা বশীরের জন্ম। জন্মের প্রাক্কালে অন্নদাশঙ্কর রায় নাকি তাঁর এতো বয়সে সন্তান জন্ম সম্পর্কে ঠাট্টা করেছিলেন। জবাবে নাকি শহীদুল্লাহ্ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার শেষ ছেলেটিই যে জিনিয়াস হবে না তা কে জানে?’
শহীদুল্লাহ্ সাহেবের কথার ভুল হয়নি। তাঁর শেষ সন্তানটি ঠিক ঠিকই জিনিয়াস হয়ে উঠেছে। অস্থির আবেগতাড়িত রোমান্টিক নিঃসঙ্গ এক জিনিয়াস।
মনে হয় তাঁর মনের এই রোমান্টিক গড়নের জন্যে মুর্তজা বশীর অস্থিরচিত্ত। কোনো কিছুতেই তৃপ্তি পান না। সেজন্যেই দেখা গেছে, সহজ-স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের চাইতে অচেনা শহরে শহরে বন্ধুর জীবন যাপন করছেন; শিক্ষকতা থেকে কুলিগিরি কোনো পেশা গ্রহণেই পিছপা হননি। এবং তাঁর চিত্রকলায়ও এই পরিবর্তন দেখা গেছে। অবশ্য এ-ধরনের জীবন যাপন, পরিশ্রম করার পেছনে এক ধরনের ক্রোধ ও জেদ কাজ করেছে। তা হলো ভালো ছবি আঁকার জেদ। বা ফরাসি ইমপ্রেশনিস্টদের জীবন যাপন তাঁকে অবচেতনভাবে প্রভাবিত করেছিল – এমনও হতে পারে।
কিন্তু মজার ব্যাপার মুর্তজা বশীর আদতেই আর্টিস্ট হতে চাননি, আর্টিস্ট হয়েছেন ঘটনাচক্রে।
১৯৪৯ সালে বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বাবা চেয়েছিলেন তাঁকে আলীগড়ে পাঠাতে আর মুর্তজা বশীরের ঝোঁক চেপেছিল শান্তিনিকেতনে যাওয়ার।
বগুড়ায় স্কুলের ছাত্রাবস্থাতেই নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাঁর মোহ জন্মেছিল। সাতচল্লিশের দিকে তিনি ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ছাত্র ফেডারেশন তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে পরিচালনা করতেন শহীদুল্লা কায়সার। মুর্তজা বশীরের বড়ভাই তকীউল্লাহ ওই আমলের একজন নামকরা কমিউনিস্ট নেতা। বগুড়াতে এই ভাইয়ের সঙ্গে থাকার সময় মুর্তজা বশীর তাঁর ন্যাওটা হয়ে পড়েন। ঢাকায় যখন তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তখন তকীউল্লাহ বললেন, ‘আর্ট কলেজে ঢুকে পড়।’
এর আগে, ১৯৪৮-এর শেষের দিকে, পুরনো ঢাকার জনসন রোডে ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের নিচে দুটি কামরায় স্থাপিত হয়েছে ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’। জনা-আঠারো ছাত্র দিয়ে এই ইনস্টিটিউটের শুরু। আর্টিস্ট হতে না চাইলেও এক-আধটু ঝোঁক ছিল ছবি আঁকার দিকে, ছাত্র ফেডারেশনের পোস্টার-ব্যানারও লিখে দিতেন তখন। ‘তা তকী ভাই বললেন’, মুর্তজা বশীর বলেন, ‘ঢুকে পড় আর্ট কলেজে। ওখানে ছাত্রদের মধ্যে আমাদের কাজ করবি।’ অর্থাৎ সোজা কথায় আর্ট কলেজে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে অনুপ্রবেশ করতে হবে।
সুতরাং আর্ট কলেজের সেকেন্ড ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়ে গেলেন মুর্তজা বশীর। পুরো আর্ট কলেজে তখন শুধুমাত্র ফার্স্ট ব্যাচের ছাত্র আমিনুল ইসলামই বামপন্থীদের সিমপ্যাথাইজার। বাকিরা ডান-বাম নিয়ে মাথা ঘামান না। ‘কিন্তু’ মুর্তজা বশীর বলেন, ‘আর্ট কলেজে আমরা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন সংগঠন অনুষ্ঠানের জন্যে ব্যানার-ট্যানার আঁকা আমরাই শুরু করেছিলাম। জয়নুল আবেদিনের সঙ্গেও এ নিয়ে মন-কষাকষি হয়েছে।’
আর্ট কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আজকের সব প্রতিষ্ঠিত শিল্পী – কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। কাইয়ুম চৌধুরী সম্প্রতি সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত এক স্মৃতিকথায় মুর্তজা বশীর সম্পর্কে লিখেছেন –
‘[প্রথমদিন] ক্লাসে ঢুকলাম। দেখলাম একটা কলসিকে ঘিরে কয়েকজন না টুল না চেয়ার এরকম একটা আসনে বসে আছে। সামনে বোর্ড আর কাগজ। আমিও বসলাম। পরে জেনেছি ওগুলোকে ডঙ্কি বলে। পাশে তাকিয়ে দেখি ছোটখাটো একজন ডঙ্কিতে বসে পা দোলাচ্ছে আর নিবিষ্টমনে কলসি আঁকার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে ডঙ্কিতে বসতে বলল। আলাপ হলো। তিনি মুর্তজা বশীর। … বামপন্থী রাজনীতির গোঁড়া সমর্থক সে সময়। আবার সিনেমার হিরো হবার দারুণ শখ ছেলেবেলা থেকে। হঠাৎ চোখ থেকে চশমা খুলে অশোক কুমার, দিলীপ কুমারের ঝটতি পোজ – অবাক হতাম। মুগ্ধ হতাম। হিন্দি গানের কলি মুখে মুখে। ছবি আঁকছে, গুনগুন গাইছে।’
একই সঙ্গে মার্কসিস্ট ও হিন্দি ছবির নায়ক হওয়ার শখ – এ ধরনের স্বপ্ন সব সময়ই তাঁকে অবসন্ন করেছে। তিনি আজো সেই স্বপ্ন থেকে মুক্ত হতে পারেননি। এ-কথা তিনি নিজেও অকপটে স্বীকার করেন।
আর্ট কলেজে পড়ার সময়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান। এবং ওই সময়ই, ১৯৫০ সালে, তিনি গ্রেফতার হন।
ওই সময় হাজং তেলেঙ্গানা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। মুর্তজা বশীর বলেন, ‘জানো, আমি ওই সময় হাজং এলাকায় লড়াই করতে যেতে চেয়েছিলাম। ভাই যেতে দেননি।’ যা হোক ১৯৫০ সালের ৭ই জুন ভোরবেলায় চকবাজারের মোড়ে তিনি পোস্টার লাগাচ্ছিলেন। পোস্টারগুলো ছিল তাঁরই আঁকা। পোস্টার লাগানোর সময় তাড়াহুড়োতে একটি পোস্টার ছিঁড়ে গেল। ‘জেগে উঠলো শিল্পীমন’, বলেন বশীর, ‘ওই পোস্টার ছেড়ে তখন আমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ফের তা জোড়া লাগাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল, ধরা পড়ে গেলাম। ধরা পড়ার পর প্রথম মনে পড়েছিল জুলিয়াস ফুচিকের কথা। ফুচিক তখন আমাদের মতো কর্মীদের অবশ্যপাঠ্য। সে-সময় জীবনের জন্যে ভয় করিনি। কারণ তখন আদর্শ ছিল বিশ্বাস। জেলে এতো মার খেয়েছি, কিন্তু কখনো কিছু বলিনি। কারণ ওই আদর্শের প্রতি বিশ্বাস।’
ছ-মাস জেলে ছিলেন তিনি এবং ওই সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় আবদুল্লাহ আল মুতী, আলী আকসাদ, ডা. আমজাদ, মনু মিয়া প্রমুখ তৎকালীন কমিউনিস্ট কর্মীদের সঙ্গে।
যা হোক জেল থেকে ফেরার পর ফের ফিরে গেলেন আর্ট কলেজে। ওই সময় তিনি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হন। ক্লাসের ফল বেরোবার ঘটনাটি এখনো স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। ফল ঘোষণা করার জন্যে জয়নুল আবেদিন ঢুকেছেন ক্লাসে। যারা যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের নাম বলে যাচ্ছেন। কিন্তু ‘আমার নাম নেই। শেষ নামটা ছিল আমার। লজ্জায় চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। বোধহয় ড. শহীদুল্লাহ্র ছেলে বলে বা ফেল করলে একজন ছাত্র কমে যাবে – এ জন্যেই বোধহয় প্রমোশন দিয়ে দিলেন।’
‘যাক’, মুর্তজা বলেন, ‘ফিরে এসে দেখি ক্লাস অনেকদূর এগিয়ে গেছে। জয়নুল আবেদিনকে জানালাম, আমার দ্বারা বোধহয় আঁকা-টাকা হবে না। তিনি তখন আমিনুল ইসলামকে ডাকলেন। আমিনুল ইসলাম ছিলেন তখন আর্ট কলেজের সেরা ছাত্র, আমাদের কাছে ডেমিগডের মতো। তাছাড়া সিনিয়রদের ওই সময় আমরা সমীহ করে চলতাম। এখন বোধহয় সে-পাট উঠেই গেছে। আমিনুলকে ডেকে জয়নুল বললেন, ‘ওকে দেখো।’ আমার মনে হলো এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বলতে গেলে আমিনুল আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন সফিউদ্দীন আহমেদও।
আমিনুলের সঙ্গে বাইরে যেতাম। যদিও দ্বিতীয় বর্ষ। কিন্তু জলরং করিনি। কারণ জলরংয়ে জল দ্রুত গড়িয়ে যায়। পায়জামা, কাগজ পানি আর রংয়ে মাখামাখি। আসলে জলরং আমার মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। আমিনুলের সঙ্গে বসে বসে তেলরং আঁকতাম। আমিনুল বলতেন, ওগুলো কি আঁকছো? ব্রাশিং কোথায়? ব্রাশিং ব্যাপারটাই বুঝতাম না। আমিনুল উপদেশ দিতেন ভ্যান গ’ সফিউদ্দীনের কাজ দেখার জন্যে।’
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটি ঘটনা ঘটে। তিনি গিয়ে বসেছেন কমার্শিয়াল ক্লাসে, কারণ তখন তিনি চিত্রাঙ্কনকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু কমার্শিয়াল ক্লাসে গিয়ে দেখলেন তাঁর নাম ডাকা হলো না। জয়নুল আবেদিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি ফাইন আর্টস পড়বে।’ তখন শিক্ষকরাই ছাত্রের হয়ে সব নির্ধারণ করতেন।
পঞ্চম বর্ষ থেকে চিত্রাঙ্কনের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ জেগে ওঠে। এবং এ-সময়ই তিনি রাজনীতি থেকে সরে আসেন। তার কারণ বিবিধ। কিছুটা সেন্টিমেন্টালও বটে। কারণ জেল থেকে ফেরার পর দেখলেন পার্টির কর্মীরা তাঁকে এড়িয়ে চলে। তাছাড়া তাঁর মনে হলো নাম না হলে কেউ তাঁর কথা শুনবে না। ছবি আঁকার প্রতি আরেকটি কারণে ঝোঁক বেড়ে যায়। তাহলো ছোটবেলায় মৃত্যু তাঁকে অভিভূত করেছে। মৃত্যুকে তিনি অতিক্রম করতে চেয়েছেন যশের দ্বারা, এমন কিছু করে যেতে যাতে মৃত্যুর পরও তাঁর কথা মনে থাকে।
সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার আরেকটি সেন্টিমেন্টাল কারণ আছে। ‘ফজলে লোহানী তখন বোহেমিয়ানদের রাজা। আমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। তাই আমাকে পার্টি থেকে কৈফিয়ত তলব করা হলো। আমি অবশ্য জবাব দিয়েছিলাম। এ সময়ে আবদুল্লাহ আল মুতী দ্বিতীয়বার জেল থেকে মুক্তি পেলে পার্টি তাঁকে অভিযুক্ত করে বহিষ্কৃত করে। এবং সে বহিষ্কারাদেশটি আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় যা আমি চাইনি। কারণ মুতী ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক ছিল। আমার জন্যে এ ব্যাপারটি ছিল খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এইসব কারণে পার্টির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।’
১৯৫৪ সালে তিনি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরোন। এর মাঝে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনটি গ্রুপ শোতে। মুর্তজা বশীরের আঁকা প্রথমদিককার ছবি সম্পর্কে এখনকার আলোচকদের আলোচনা করা মুশকিল। শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর তিরিশ বছরের কাজের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখানেও তাঁর প্রথমদিককার আঁকা ছবির সংখ্যা কম। অধিকাংশ বিক্রি হয়ে গেছে। সেজন্যে তাঁর পুরনো ছবি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ওই সময়কার চিত্র-সমালোচকদের প্রবন্ধের আশ্রয় নিতে হবে।
তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর অধিকাংশই ড্রইং দেখলে বোঝা যায় একজন উঁচুদরের শিল্পীকে ড্রইংয়ের ক্ষেত্রে কত অনুশীলন করতে হয়। তিনি বলেন, ‘জয়নুল আবেদিন হাত ধরে ড্রইং শিখিয়েছেন। যখন আমরা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তখন ড্রইং ক্লাসে ঢোকার সময় দেখতাম স্যার দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। সবার পকেট থেকে তিনি রবার রেখে দিতেন। যাতে ছেলেরা বেশি কাটাকুটি না করে। এভাবে ড্রইংয়ে হাত পাকা হয়ে ওঠে। তাছাড়া জেদ ছিল ড্রইং ভালো করতে হবে।’
সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে তাঁর ড্রইংগুলো দেখার মতো, বিশেষ করে ইতালিতে করা ড্রইংগুলো। ছন্দোবদ্ধ রেখাগুলো চোখ মুগ্ধ করে।
আর্ট কলেজ থেকে বেরুবার পর তিনি কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি কোর্স করেন। কলকাতার পটভূমিকায় পরে
তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন আলট্রামেরীন।
কলকাতা থেকে ফেরার পর নবাবপুর সরকারি স্কুলে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ওই সময় আমিনুল ছিলেন ফ্লোরেন্সে। তাঁর এক চিঠি পেয়ে মুর্তজা বশীর ফ্লোরেন্স যাওয়ার মনস্থ করেন। ফ্লোরেন্সে তিনি অ্যাকাডেমিয়া বেল্লি অর্তিতে অধ্যয়ন করেন কিছুদিন। তারপর চলে যান লন্ডনে।
লন্ডনে এই সময় জীবিকার জন্যে তাঁকে হোটেলে কাজ করতে হয়েছে। আলু ছিলতে হয়েছে। কিন্তু মুর্তজা বশীর দমেননি। লন্ডনে তিনি এচিং ও ড্রইং শিক্ষার জন্যে সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড ক্রাফটসে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৯ সালে চলে আসেন করাচিতে এবং প্রথম (পাকিস্তানে) একক প্রদর্শনী করেন। ২৪টি ক্যানভাস স্থান পেয়েছিল ওই প্রদর্শনীতে।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি যেসব ছবি এঁকেছেন তার বিষয়বস্তু ছিল সাধারণ মানুষ, তাদের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন – ‘ওই সময়কার ছবির বৈশিষ্ট্য হলো ড্রইং এবং স্পেসের মিনিমাইজেশন। ফ্ল্যাট স্পেসে তিনি কাজ করেছেন এবং প্রধান রং হলো ধূসর, সবুজ, নীল এবং হলুদ আভার। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ফর্মের কালো বহিঃরেখা।’
ওই সময় করাচির আর্ট নোটসে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি মনে করেন ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতকের শিল্পীরা আপনাকে প্রভাবান্বিত করেছে?’ উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁ করেছে, তবে রেনেসাঁর শিল্পীদের আমার পছন্দ নয়। পছন্দ ইটালির প্রিমিটিভ পেইন্টারদের। কারণ তাদের সিম্পল ফর্ম, আলো এবং স্পেসের সিম্পলিফিকেশন, কম্পোজিশন এবং সাধারণ রং ব্যবহার।’ তিনি আরো বলেন, ‘রেনেসাঁ শিল্পীরা মানুষের শরীর এঁকেছেন শরীরের সৌন্দর্যের জন্যে। আমি ফিগার আঁকি তাদের নাটকীয় ভঙ্গির জন্যে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমি ফিগারেটিভ পেইন্টার। কলেজে পড়াকালীন আঁকতে চেয়েছি ভ্যান গ’র মতো। কারণ আমি মূলত একজন কালারিস্ট।’
১৯৬০ থেকে ’৬৩-এর বেশিরভাগ সময়ই তাঁর কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এবং লাহোরে। বিশেষ করে লাহোরে দিন কেটেছে তাঁর নিদারুণ অর্থাভাবে। খেতেন তিনি ভিখিরিদের সঙ্গে। কাপড় কাচার পয়সা না থাকায় থাকতেন নোংরা পোশাক পরে। ব্লেডের অভাবে দাড়ি রেখেছিলেন তখন। কিন্তু ছবি আঁকা ছাড়েননি। ইতালিতে যখন ছিলেন তখন তাঁর ছবির বিষয়বস্তু ছিল সাধারণ মানুষ : করাচিতে আঁকা তাঁর ছবি সম্পর্কে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘রেখার বদলে জোর দিয়েছেন তিনি ফর্মের স্ট্রাকচারের ওপর। এ-কারণে ফর্মে ব্যবহত হয়েছে হালকা এবং গাঢ় রং একই সঙ্গে। এ ধরনের ফর্ম জ্যামিতিক ভাব এনেছে; ছবির ইমোশনাল পাওয়ার হ্রাস পেয়েছে।’
যদিও বশীর বলেছেন, ওই সময় তিনি ফিগারেটিভ শিল্পী কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্যানভাসে ফিগারের রূপ বদলে যাচ্ছে; বালকের মাথা হয়ে উঠছে বিশাল। ওই সময়কার ছবি দেখলে বোঝা যায় মানসিকভাবে তিনি ডিসটার্বড।
এছাড়া লাহোরে থাকার সময় দারিদ্র্য তাঁর রোমান্টিক মনকে আবেগতাড়িত এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ককতোর মতো তাঁর মনে হয়েছিল, বুর্জোয়া সমাজ একজন জিনিয়াসকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করে দেয় না।
তাঁর কাছে লাহোরে থাকার সময় মনে হয়েছে, আত্মহত্যা করবেন অথবা পাগল হয়ে যাবেন। সমাজ এবং তার মেশিনারি যেন একেকজনকে পিষে ফেলে। মনে হয় আপনি কোনো উপন্যাসের একজন নায়ক। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আপনি নায়ক হতে চান না। জীবন উপন্যাস নয়। জীবন জীবনই। আপনি মানুষ হিসেবে বাঁচতে চান কিন্তু মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার উপায়গুলি আপনাকে দিচ্ছে কে?
‘১৯৬০ সালে’, তিনি বলেন, ‘এক নিদাঘ দুপুরে শুয়ে আছি ছাদের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ মনে হলো দেয়ালে অজস্র রেখার আঁকিবুকি। সেই অজস্র রেখার মাঝে ভেসে উঠলো একটি মুখ, নিঃশব্দে কাঁদছে।’ সেই অবরুদ্ধ ক্রন্দনের যন্ত্রণাই ফুটে উঠেছে লাহোরে আঁকা ছবিগুলিতে।
ওই সময় এক সাক্ষাৎকারে মুর্তজা বশীর জানান, ‘আমার ছবি আমার ব্যক্তিগত রোজনামচা। প্রতিটি ছবিতে আছে আমার আবেগ এবং অনুভূতি। আমি শিল্পের জন্যে আঁকি না। নিজেকে আমি মানুষের অবস্থা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে মনে করি।’
এখনো তিনি তা মনে করেন যদিও তাঁর সাম্প্রতিক ছবি তা প্রমাণ করে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘শিল্পীকে অবশ্যই সমাজ সচেতন হতে হবে। জনগণের রুচি উন্নত করে তুলতে হবে। তাদের কথা তুলে ধরতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যদি তা না করি তা হলে জনগণ আমাদের ক্ষমা করবে না। বিপ্লব হবেই এবং সত্যিকার বিপ্লব হলে বিপ্লবী মানুষরা আমাদের কচুকাটা করবে।’
যা হোক মুর্তজা বশীর অর্থাভাব কি তা জানেন। লাহোর এবং করাচির শো তাঁর ফ্লপ করেছিল। এক মহিলা কার্পেটের সঙ্গে রং মিলিয়ে তাঁর ছবি কিনতে চেয়েছিলেন। তখনই তিনি ওই ছবি মহিলার কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন। তিনি কি তাদের পছন্দমতো আঁকবেন? এক বন্ধু বলেছিলেন, কিছু সমঝোতা করা দরকার নয়তো রাস্তা খুঁড়তে হবে। মুর্তজা বশীর শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ তা তো খুঁড়ছি, অনেকদিন ধরে। শিল্পীর এই বন্ধুর রাস্তা যা আমাকে ফতুর করে দিচ্ছে।’
১৯৬৩ সালে করাচিতে তাঁর আরেকটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রদর্শনী চলাকালীন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘খোলা মন নিয়ে এসেছি আমি ছবি আঁকতে। আমি ফ্যানাটিক নই যে ডগমায় বিশ্বাস করে। আমি মনে করি শিল্পীর সব মাধ্যম পরস্পর সংযুক্ত। তাই যখন যে মাধ্যম প্রয়োজন তখন সেই মাধ্যম ব্যবহার করি। আর্ট হ্যাজ টু প্রগ্রেস টু লিভ।’ এই কারণেই তিনি কখনো গল্প, কখনো কবিতা লিখেছেন। আর ওই উত্তর দেবার কারণও ছিল। কারণ ওই সময় তাঁকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছিল, তাঁর ছবি কি পাকিস্তানি সংস্কৃতির পরিচায়ক? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ১২০০ মাইলের দুটো অঞ্চল। তাদের সংস্কৃতি নিরূপণ হবে কীভাবে?
১৯৬৬ সালে মুর্তজা বশীর তাঁর বিখ্যাত সিরিজ ‘দেয়াল’ আঁকা শুরু করেন। তাঁর মনে হয়েছিল প্রতিটি মানুষের সম্পর্কের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য দেয়াল। সে-দেয়াল হয়তো অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর চতুর্দিকে দেয়াল এবং তা থেকে মুক্তি নেই। দেয়াল বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়ী সীমিত ব্যবস্থার প্রতীক। মুর্তজা বশীরের ছবিতে প্রকৃতি নেই। কারণ তিনি মনে করেন মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতি। কিন্তু সে মানুষ তো বন্দি সামাজিক শৃঙ্খলে। তাই শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষের আর্তি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ‘দেয়ালে’।
এ পর্যন্ত দেয়াল সিরিজের ৯২টি ছবি এঁকেছেন তিনি। এ-সিরিজে ব্যবহৃত প্রধান রং হলো ধূসর, কালো এবং লাল।
‘দেয়াল’-এর পর মুর্তজা বশীরের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম ‘এপিটাফ’ সিরিজ। তিনি কখনো পুরনো হতে চান না এবং যেহেতু তিনি রোমান্টিক সেজন্যে নতুনের প্রতি মোহ তাঁর তীব্র এবং সে-প্রয়োজনে অনায়াসে প্রিয় ফর্ম ছেড়ে দিয়ে নতুন ফর্ম খোঁজেন। তিনি বলেন, ‘একটি সিরিজ এঁকে আমি স্বস্তি বোধ করলেই তা ছেড়ে দিই।’ ১৯৭২-এ তিনি ‘দেয়াল’ সিরিজ আঁকা ছেড়ে দেন। কারণ প্যারিসে তাঁর এক শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন আর একজন ফরাসি শিল্পী তাঁর আগে এ-ধরনের কাজ করে গেছেন। সুতরাং তিনি ‘দেয়াল’ আঁকা ছেড়ে দেন।
১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে ৩৫টি ক্যানভাসের একটি প্রদর্শনী সাজিয়েছিলেন। এর জন্যে উচ্চকিত কোনো রং বা বিষয়বস্তু তিনি বেছে নেননি। ‘শহীদ শিরোনাম’-এর জন্যে তিনি বেছে নিয়েছেন নুড়ি বা পাথরের ফর্ম। এবং ওই ফর্মকে তিনি ইচ্ছেমতো বিশ্লেষিত করেছেন, করেছেন খণ্ডিত। কিন্তু ছবির আবহ কখনো উচ্চকিত হয়নি, সব সময় থেকেছে নমিত।
‘শহীদ শিরোনাম’-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য পঁয়ত্রিশটি ক্যানভাসের জমিনই সাদা। সাদা জমিন দুই অর্থে হয়তো তিনি ব্যবহার করেছেন। এক কাফনের শুভ্রতা, দুই চ্যালেঞ্জ; কারণ সম্পূর্ণ সাদা জমিতে ছবির দ্বিমাত্রিক ভাব অক্ষুণ্ন রেখে ছবি আঁকা কষ্টকর। মনে হয়, শেষোক্ত কারণেই মুর্তজা বশীর প্ররোচিত হয়েছেন এ-ধরনের জমিন ব্যবহারে।
তারপর সাদা জমিনের ওপর গড়ে তুলেছেন তিনি পাথরের বিভিন্ন ফর্ম। পাথর আচমকা ভেঙে গেলে যে বিচিত্র ফর্মের সৃষ্টি হয় বা রঙিন নুড়িতে যে বিচিত্র রং দেখা যায় তা-ই তিনি তুলে ধরেছেন।
এ অঞ্চলে স্মৃতি মানেই বিষাদ, শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান মানেই তার আবহ হবে ধূসর। কিন্তু বশীর মনে করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদরা তাঁদের আত্মার বদলে আমাদের দিয়ে গেছেন আনন্দ। স্বাধীনতা। সুতরাং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি কখনোই ম্লান হতে পারে না।
‘শহীদ শিরোনাম’-এর প্রতিটি ক্যানভাসে তিনি জ্যামিতিক প্যাটার্ন ব্যবহার করেছেন। কখনো সে-প্যাটার্ন উচ্চকিত, কখনো নমিত। রঙের পরিমিত, উজ্জ্বল কিন্তু স্নিগ্ধ ব্যবহার দর্শককে ক্যানভাসটি দেখতে বাধ্য করে।
‘শহীদ শিরোনাম’-এর পর তাঁর আঁকা নতুন সিরিজের নাম ‘জ্যোতি’। এ-সিরিজের ক্যানভাসের বৈশিষ্ট্য সোনালি ও রুপালি রংয়ের পাশাপাশি ব্যবহার। জ্যামিতিক কম্পোজিশন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার। আরবি ক্যালিগ্রাফির আলো সার্থকভাবে ক্যানভাসে ব্যবহার করেছেন – সাদেকান। এ জিনিস পুরনো। তবে রংয়ের ব্যবহার নতুন, ’৬২ সালে আঁকা ছবিতেও তিনি ওই রং ব্যবহার করেছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘৬২-তে ছবিতে দুটো রং এলো – সোনালি ও রুপালি। কারণ তখন আমি বিয়ে করেছি। জীবন অত্যন্ত সিস্টেমেটিক। তার ইমপ্যাক্ট পড়েছিল ছবিতে। কিছুদিন পর মনে হলো ভুল করেছি, তাই ওই রং ব্যবহার করা ছেড়ে দিলাম।’
তার মানে কি ধরে নেব তিনি এখন জীবনে পরিতৃপ্ত; তিনি বলেন, ‘ইসলামি শিল্পকলায় আছে সিরিনিটি। ইসলামি পাণ্ডুলিপি বর্ণিল। আমার এ ছবিগুলি সুখী মানুষের ছবি, কারণ আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। এবং ওই সুখের উৎস ওই ডিভোশন।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি কোনো খ্রিষ্টান শিল্পী যিশুকে আঁকতে পারেন, যদি নীরদ মজুমদার কালীর ছবি আঁকতে পারেন, এবং ফ্যানাটিক বলে পরিচিত না হন, তবে আমি এ ধরনের ছবি আঁকলে তা হবে কেন?’
মার্কসে বিশ্বাসী শিল্পী ধর্মে বিশ্বাস করেন। কিন্তু আগেই বলেছি, মুর্তজা কষ্টে ভুগছেন এবং এ দ্বন্দ্ব থেকে তিনি মুক্তি পাননি। তিনি আরো বলেছিলেন, শিল্পকলা জনগণকে সার্ভ করবে; কিন্তু সম্প্রতি প্রদর্শিত তাঁর ওই ‘জ্যোতি’ সিরিজ কি জনগণের কথা তুলে ধরেছে? এ-প্রশ্নের জবাবে তিনি অকপটভাবে বললেন, “জ্যোতি’ জনগণকে সার্ভ করছে না। ব্যক্তিগত তৃপ্তি থেকে এই ছবি আমি এঁকেছি। বোধহয় আমি ফ্রাসটেটেড হয়ে যাচ্ছি।” কিন্তু মুর্তজা বশীর এখন নামি চিত্রশিল্পী; আর যাই হোক অর্থাভাব তাঁর নেই। তবে এ ফ্রাসটেশন কেন? বোধহয় রোমান্টিক মনের গড়নের জন্যেই এ নৈরাজ্যের উৎপত্তি। এ প্রসঙ্গে মুর্তজা বশীর যা বলেছেন তাতে ‘জ্যোতি’ আঁকার কারণ ও তাঁর মানসিক বৈপরীত্য হয়তো তুলে ধরে। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম রক্ষণশীল পরিবারে। তাই অবচেতনভাবে ঈশ্বর আমার মনে গেঁথে গেছে। এবং তাই আমি মার্কসিস্ট হতে পারিনি। এ দ্বন্দ্ব থেকেই বোধহয় পার্টি করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই বোধহয় আমি সোশ্যালিস্ট। এই সমাজ জনগণের। আমি জানি যখন বিপ্লব হবে তখন জনগণ আমাকে নিকেশ করবে কারণ তাদের চোখে আমি বুর্জোয়া। যতোই আমি শিল্পে তাদের কথা বলি না কেন।
কিন্তু আমি অনায়াসে সব সুখ সম্ভোগ ত্যাগও করতে পারি। একবার এক প্রদর্শনীর কারণে সস্ত্রীক লাহোর গিয়েছিলাম। ফাইভ স্টার হোটেলে উঠিয়েছিল তারা আমাকে। আমার খুব মজা লাগছিল।
এই কয়েকদিন আগে লাহোরের ফুটপাতে বসে খেয়েছি আর এখন ফাইভ স্টারে। আপন মনে হাসছিলাম। স্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তাকে বললাম, ‘মাই ডিয়ার, এটা হলো জীবন। আবার হয়তো আমাকে ফুটপাতে শুতে হবে। আমি মানসিকভাবে এ পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত। এখানেই অন্যদের সঙ্গে আমার পার্থক্য।’
‘এই যে এখন’, তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের আমি চেয়ারম্যান। কিন্তু আমি কি তৃপ্ত? না। কারণ আমি মনে করি বিভাগীয় চেয়ারম্যান হলো পুলিশ। তার কাজ হলো পোজপাজ করা এবং শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করা। ডিসগাসটিং।’
আসলে ঝড়ো, অস্থির মুর্তজা বশীর একই সঙ্গে তা ত্যাগ করতেও আকাঙ্ক্ষী এবং তা পেলে অনায়াসে তিনি তা ত্যাগ করতেও প্রস্তুত। তিনি একই সঙ্গে বলেন, তাঁর ছবি জনগণের জন্যে এবং আবার বলেন, তাঁর ছবি [‘জ্যোতি’ সিরিজ] নিজের জন্যে। এই দ্বন্দ্ব তাঁকে আবার যশ ও অর্থের মাঝে বিক্ষুব্ধ করে তোলে, ক্রুদ্ধ করে তোলে। করে তোলে অস্থির। তবে এই অস্থিরতা উপকারীও বটে। কারণ এই অস্থিরতাই তাঁকে বৃত্তাবদ্ধ করেনি।
খ্যাতি মানুষকে প্রায়ই সুখী ও বৃত্তাবদ্ধ করে তোলে। আমাদের অনেক শিল্পী ও লেখকের বেলায়ই একথা প্রযোজ্য; মুর্তজা বশীর বৃত্ত ভাঙতে ভাঙতে মার্কসবাদ থেকে ঈশ্বর অবধি এসে পৌঁছেছেন। তারপর? তিনিও কি বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়ছেন। মুর্তজা বশীর বলেন, ‘ফজলে লোহানী আমাকে একবার বলেছিলেন যশ ও খ্যাতি হলো শ্যাওলা পড়া রাস্তা তোমার ক্রেপের জুতো, ওই রাস্তা পেরুতে পার তো ভালো নয়তো …। আমি এখনো ওই কথা মনে রেখেছি।’
মুর্তজা বশীরের সাম্প্রতিক কিছু ক্যানভাস দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, পুরনো কাজের তুলনায় এতে পরিশ্রমের স্বাক্ষর কম। তিনি উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা সেই পরিশ্রমকে পূরণ করেছেন।
এ মন্তব্য মুর্তজা বশীরকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বলেন, ‘এ কথা ঠিক নয়। আমি মেথডিক্যালি কাজ করি। আগে আমি কালার লে-আউট করে ফেলি। তাই দ্রæত কাজ করতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘একজন শিল্পীর প্রধান সমস্যা কোথায় তিনি থামবেন। এটা শিল্পীর নিজের জাজমেন্টের ওপর নির্ভর করে। তাই অনেক সময় মনে হবে অনেকের ছবি দেখে তা ওভার ওয়ার্কড বা আন্ডার ওয়ার্কড। আবেগ দিয়ে আমি ছবি আঁকিনি। আমি ছবি এঁকেছি একটি থট প্রসিডিউরের মাধ্যমে। তাই ছবিতে আমাকে সিরিজের আশ্রয় নিতে হয়েছে। একজন শিল্পীর কাজ হলো নতুন সত্যকে অন্বেষণ করা। যে পিরিয়ডে আমার তৃপ্তি এসেছে সেই পিরিয়ডই ত্যাগ করেছি। যেমন আমি এখন আবার পরিকল্পনা নিয়েছি ১৯৭৪-৭৭ সালের বাংলাদেশের ওপর একটি সিরিজ আঁকব, যার বিষয়বস্তু হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।’
মুর্তজা বশীর তাঁর শিক্ষক জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে কী মনে করেন? তিনি বলেন, ‘জয়নুল আবেদিন একজন শক্তিশালী শিল্পী কিন্তু পরিস্থিতি তাঁকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের এখানে অনেকে খ্যাতিমান হলে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েন। যেটা বিদেশে হয় না। একবার প্যারিসে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু এক রেস্তোরাঁয় জনৈক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন ওই যে সার্ত্র। আমার অবস্থা তো কাহিল। দাঁড়িয়ে পড়েছি সার্ত্রকে দেখার জন্যে। ফরাসি বন্ধু অবাক হয়ে বললো, আরে দাঁড়ালে কেন? তাঁর কাজ তিনি করছেন আমাদের কাজ আমরা করি। আমাদের এখানে প্রায় ক্ষেত্রেই তা হয় না।
১৯৫৫ সালে জয়নুল একবার আমার স্টুডিওতে এসেছিলেন। খুব ক্যাজুয়ালি তাঁকে ছবি দেখাচ্ছিলাম। মনে তখন প্রচণ্ড অহমিকা, ভাবছি, পারবেন নাকি জয়নুল এরকম আঁকতে। স্টুডিও থেকে ফেরার পথে রিকশায় জয়নুল আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, বশীর তুমি কি ভাবো তুমি একলাই ছবি আঁকতে পারো? আমি পারি না। পারি। কিন্তু ডিপিআই ইত্যাদি কলমের খোঁচার জন্যে আঁকা হয় না।’ মুর্তজা বশীর বলেন, ‘জয়নুল শক্তিশালী সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর আর্টিস্টিক ডেথ অনেক আগেই হয়েছিল। এর জন্যে দায়ী আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও আচার। তবে আমি বিশ্বাস করি জয়নুল আবেদিন না থাকলে এদেশে শিল্প-আন্দোলন হতো না। এ জন্যে আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এছাড়া আবেদিন সাহেবের একটি কথা আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, তোমাকে একটি কথা বলি বশীর, নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো যেন যখন লোকে প্রশংসা করবে তখনো হাসতে পারো। যখন সমালোচনা করবে তখনো হাসতে পারো। আর এ অবস্থা অর্জন করতে আমার পনেরো বছর লেগেছে।’
বাংলাদেশের শিল্পী সম্পর্কে তাঁর মত কী? তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিল্পকলা এখন বাজার। শিল্পীরা সওদা নিয়ে বসে থাকে। ব্যবসা করে। ’৫০-এর পর এখানে আর শিল্প-আন্দোলন হয়নি। ওই সময় দর্শক টিকেট কেটে লাইন দিয়ে ছবি দেখতে আসতো। আর শিল্পীরাও মুখে ফেনা তুলে তাঁদের ছবি বোঝাতেন। আর এখন শিল্পীরা দর্শক বিচার করে। ভদ্রলোক হলেই ইমপ্রেস করার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে যাতে তিনি একটি ছবি কেনেন।’ তাঁর কথায় রীতিমতো রাগ ফুটে উঠছিল। বললাম, তা শিল্পীরা ছবি বিক্রি না করলে খাবেন কী? তিনি বলেন, ‘আর্টিস্ট ক্যান নট বি সেলসম্যান।’
বললাম, আপনার ছবি তো প্রচুর বিক্রি হয় এবং দর্শকরা যে মুগ্ধ হয়ে কালেকশনের জন্যে সব ছবি কিনে এমনও তো নয়।
তিনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন, ‘আমার ছবি বিক্রি হয় কারণ বন্ধুরা প্যাট্রোনাইজ করে। অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছেন, তাঁদের ছবি বিক্রি হয় না, কারণ তাদের প্যাট্রোনাইজ করার মতো কেউ নেই।’
বাংলাদেশের কোন শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রিয় – মুর্তজা বশীর বিন্দুমাত্র না ভেবে বললেন, ‘রশিদ চৌধুরী। কারণ আমার মনে হয় সে পেইন্টিং বোঝে ভালো। কারণ সে এমন একটি মাধ্যম (ট্যাপেস্ট্রি) নিয়ে কাজ করে, যেখানে কনস্ট্রাকশন নিখুঁত না হলে বিপদ। আমি যে মোজাইকের কাজ শিখেছিলাম তাও এই কারণে এবং রশিদের কথায়।
এছাড়া ভালো লাগে আমিনুল ইসলামের কাজ। কারণ তাঁর কাজে ডিনামিজম আছে। ভালো লাগে কিবরিয়ার কাজও। যদিও তিনি বৃত্তাবদ্ধ। কিন্তু তাঁর কাজ প্রিসাইজ। একটা বাড়তি বিন্দুও তাঁর কাজে নেই। আর ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগে, কোনো কারণ ছাড়াই সৈয়দ জাহাঙ্গীরের কাজ।’ তরুণদের মধ্যে তিনি চন্দ্রশেখর ও কাইয়ুমের কাজ পছন্দ করেন।
জিজ্ঞেস করলাম, মাঝে যে অনেক বাদ পড়ে গেল। মুর্তজা বশীর বললেন, ‘মাঝে জেনারেশন গ্যাপ এবং তার প্রধান কারণ নিষ্ঠার অভাব।’
আগেই বলেছি, মুর্তজা বশীর বিশ্বাস করেন শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এবং নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে যখন যে-মাধ্যমের প্রয়োজন তখন তিনি সে-মাধ্যম ব্যবহার করেন। তিনি আমাদের দেশের একজন প্রধান চিত্রশিল্পীই নন একজন গদ্য-লেখকও বটে। তাঁর ছোটগল্পগ্রন্থ কাঁচের পাখির গান সাড়া জাগিয়েছিল। কবিতাও লেখেন তিনি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ত্রসরেণু। চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এক সময় না এক সময় আমি ছবি তৈরি করবোই। প্রথমে ডকুমেন্টারি, তারপর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।’ তাঁর আঁকা প্রচ্ছদ পুরস্কৃতও হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস আলট্রামেরীন।
কিন্তু মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের লেখকদের লেখা পড়েন না। অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি পড়েছেন এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় লেখকও। তাঁর প্রিয় কবি লোরকা। এখন এপুলিনিয়ার।
মুর্তজা বশীরের কাছে আমাদের শেষ দুটি প্রশ্ন ছিল তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ও তাঁর লেখা সম্পর্কে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে এতো আত্মপ্রতিকৃতির ছড়াছড়ি কেন? আপনি কি নার্সিসাস? তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম পরিবারের ছোট। চাকর-বাকরের কাছেই দিন কাটতো। নিজেকে খুব নেগলেকটেড মনে হতো। সে থেকে আমি নিঃসঙ্গ। আয়নায় যখন নিজেকে দেখতাম তখন মনে হতো কোনো বন্ধুকে দেখছি। রেমব্রা বা ভ্যান গ’র বেলায়ও তাই ঘটেছে।’
শেষ প্রশ্ন ছিল, আপনি কি লেখক না চিত্রশিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকবেন? পাঠক, আস্তে আস্তে ভেবে বললেন তিনি, ‘আমার মনে হয় আমি লেখক হিসেবেই বেঁচে থাকব।’

রমণী ও মুর্তজা বশীর

  • রমণীরা কীভাবে এসেছে আপনার ক্যানভাসে? জীবনযাত্রা থেকে, না শিল্পের ঐতিহ্য থেকে?
    ** যদি আমি আমার বিশ বছরের ছবি আঁকা জীবন তলিয়ে দেখি তখন দেখি রমণীরা নানা সময়ের মানসিকতায় নানাভাবে আমার ছবিতে এসেছে। আমার ছবি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। বলতে গেলে আত্মজীবনীর একেকটি পাতা। ১৯৫৪ থেকে ’৫৬ পর্যন্ত আমার ছবির রমণীরা ছিল আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ ইটালি প্রবাসকালে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ এবং জীবনযাত্রা ছিল আমার বিষয়বস্তু। এবং ১৯৫৯ সালে করাচি থাকাকালীন আমার ছবিতে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দৈন্যের বদলে তাদের জীবনের প্রেম অবসর বিনোদন প্রসাধন এই ছিল মূলত বিষয়। এ পর্যন্ত কোনো ধরাবাঁধা দেশীয় ধাঁচ আমার কাজে ছিল না। তার কারণ আমি বিশ্বাস করি দেশ কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নয়, এটা মেজাজে, রক্তে। ১৯৬০-৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন রমণীরা আমার ছবিতে এসেছে একটা অস্থিরতা এবং জ্বালা থেকে। সেটা ছিল নিঃসঙ্গতার। তাই রমণীর মুখ বিশাল। সেসব ফসিলাইজড, বীভৎস। আর সব ছবিতে ছিল সুন্দর একটা পাখি। কখনো উড়ন্ত, কখনো হাতে ধরা। জীবনের প্রতীক ছিল পাখি। সে-পাখি আমি নিজে। মেয়েরা আমার কেন জানি মনে হয় শব্দ পূরণের জটিল ধাঁধায় ঘেরা। ক্রসওয়ার্ড পাজল।
    ১৯৬২ থেকে ’৬৩-র মাঝামাঝি মেয়েরা এসেছে জ্যামিতিক বন্ধনে। সব মাপাজোখা। ক্যালকুলেটেড। জীবন তাই আমার কাছে মনে হয়েছিল। হতে পারে বিয়ে করার জন্যে সেই সময় সব কিছু অর্গানাইজড মনে হয়েছিল। কিন্তু ’৬৩-র শেষের দিকে আবার তারা দুর্বোধ্য হয়ে গেল। তাই বহু মুখ আমি এঁকেছি। একেকভাবে। আমার অনুভূতিতে কখনো মনে হয়েছে দুঃখে ঘেরা সেসব চেহারা কখনো নিঃসঙ্গ দুর্বোধ্য বা বীভৎস। এবং বীভৎসতার প্রকাশ পেয়েছিল আমার শেষ ছবিটায় ‘মহিলা হাতে গিরগিটি’ নিয়ে। এরপর ’৬৪ থেকে ’৬৬-র শেষ অবধি আঁকিনি। আঁকতে ইচ্ছে করলো না। সিনেমাজগতে জড়িয়ে ছিলাম। ’৬৭ থেকে আমি মহিলার ছবি বিক্রি করা ছাড়া আর আঁকিনি। আমাকে আকর্ষণ করে না। সৃষ্টির জন্যেও করে না, অনেক মেয়েই তাদের ছবি আঁকতে বলে। আমি আঁকি না। ইচ্ছে করে না।
  • এই সময়কালের মধ্যে কোন সময়ে আপনি রমণীদের এঁকে তৃপ্তি পেয়েছেন?
    ** কখনো তৃপ্তি পাইনি।
  • তবে কেন বারবার রমণীদের এঁকেছেন?
    ** কর্মের ভ্যারিয়েশনের জন্যে। অবচেতন মনে সব সময় জৈবিক আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। মেয়েদের সৌন্দর্য সে-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। এটা এক ধরনের জৈবিক তৃপ্তি।
  • তাহলে কি শুধু জৈবিক তৃপ্তির জন্যে রমণীদের এঁকেছেন?
    ** সাধারণভাবে বলতে গেলে কোনো মেয়ের ছবি এঁকে তৃপ্তি পাইনি।
  • আপনার অন্যান্য ছবির বেলায়ও কি এটা প্রযোজ্য?
    ** হ্যাঁ, কারণ আমি সব সময় নিজেকে বদলেছি। কারণ শিল্পীর কর্তব্য সৃষ্টি করা। অনুকরণ নয়। তাই একই ধরনের মধ্যে আটকে থাকা উচিত না।
  • বাঙালি মেয়েরা কি প্যাশোনেট?
    ** সাময়িকভাবে। তার কারণ হলো সামাজিক থেকে বড় তাদের প্রকৃতি, তাদের স্বভাব। তাই সাধারণত বেশিরভাগ বঙ্গ রমণী সাদামাটা, টাকা আনা পাই বোঝে, বাইরের রূপ-বিত্ত এবং চাকচিক্য তাদের আকর্ষণ করে বেশি। হৃদয়-প্রতিভা এসবের কোনো মূল্য নেই। তা সত্ত্বেও দু-একজনকে কদাচিৎ ভালো লেগেছে। তার কারণ বঙ্গ রমণী বলে নয়, তারা রমণী তাই। সেরকম আমার ভালো লেগেছে ভিন্নদেশী মেয়েদেরও। তবে বিদেশিরা প্রতিভার স্বীকৃতি দেয়, অন্তর দেখার সূক্ষ্ম দৃষ্টি আছে। যেটা আমাদের মেয়েদের নেই।
  • আপনার স্ত্রী কোন দেশি?
    ** আমার স্ত্রী বাঙালি। এটা নিয়তি। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি। হোয়াট দ্য হেল আই ক্যান ডু?
  • মেয়েদের ফর্ম কি আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
    ** মেয়েরা ফর্ম হিসেবে অনুপ্রাণিত করার চেয়ে বেশি করে তারা রমণী বলে। পুরুষও সুন্দর হয়। বতিচেল্লির ভেনাসের চেয়ে মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিড কোনো অংশে কম সুন্দর নয়। আসলে শিল্পীদের মেয়েরা আকর্ষণ করে মেয়ে বলে। জৈবিক কারণে। ছন্দ-ভঙ্গি-রেখা এসব বাজে কথা। নিজের ট্রাউজার হ্যাঙ্গারে প্রতিদিন দেখার বদলে শাড়ি অনেকাংশে ভালো লাগে। এটা বায়োলজিক্যাল রিজন। এছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের নেই। তাই আকর্ষণ সাময়িকভাবে করলেও গভীরভাবে করে না।
  • মডেল হিসেবে বাঙালি মেয়েরা কি আদর্শ মডেল?
    ** সব মেয়েই মডেল হলে এক রকম দেখায়। শুধু দেহের রঙে আর গঠনে প্রভেদ। এছাড়া কিছু তারতম্য নেই। মেয়েরা মেয়েই।