পাললিক বাংলার রূপাঞ্জলি

জাহিদ মুস্তাফা
শিল্পে আধুনিকতার বড় সুবিধা হলো – আমরা যেভাবেই তাকে দেখি, প্রকাশ করি তাতে শিল্পসম্মত ভাব ও উপস্থাপনা করা হলে এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও শিল্প-পদবাচ্য বলতে কেউ দ্বিধা করবেন না। চারুশিল্পের দৃশ্যচিত্রের ক্ষিত্র বেড়েছে, উপাদান প্রয়োগও বিসত্মৃত হয়েছে। গত শতকের আশির দশক থেকে আমাদের চিত্রকলায় দেখতে পাচ্ছি চিত্রপটে রং ছাড়াও নানা উপাদানের সংযুক্তি। শিল্পী কালিদাস কর্মকার এক্ষিত্রে অগ্রণী। তাঁর ক্যানভাসে আমরা বরাবর দেশীয় অনেক উপাদানের সংযুক্তি দেখি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি তিনি পাললিক বাংলার বিষয়-আশয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, ছবি আঁকছেন।
বাংলা ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে নদীবাহিত পলিমাটি জমে-জমে। এজন্যই আমাদের দেশের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাললিকতা। এই সত্যটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার। কৃষিভিত্তিক এই দেশের সর্বংসহা মাটির বৈচিত্রময় রূপ আর তার শরীরে প্রোথিত ফলবান বীজ থেকে বৃক্ষির উদ্গম, মাটির বুকে নানা আচার-অনাচার, আরোপ-বিলোপের সবকিছু যেন উঠে আসে কালিদাসের চিত্রপটে।
ঢাকার প্রগতি সরণিতে গ্যালারি অ্যাথেনায় চলেছে ‘পাললিক অনুভব’ শিরোনামে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের একক চারুকলা প্রদর্শনী। এটি তাঁর ৭১তম একক প্রদর্শনী। বিশেষ এ-সংখ্যাটির সঙ্গে মিল রেখে শিল্পী এতে বিভিন্ন মাধ্যমে করা তাঁর ৭১টি শিল্পকর্ম স্থান দিয়েছেন। অ্যাক্রিলিক, মিশ্রমাধ্যম, ছাপচিত্র, ডিজিটাল
লিথোগ্রাফ, ড্রইং ও অন্যান্য মাধ্যমসহ শিল্পীর একটি স্থাপনাও প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
শিল্পী কালিদাস কর্মকার ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর শহরের নিলটুলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২-৬৪ – এ তিন বছর তৎকালীন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে দুই বছরের সূচনা কোর্স শেষ করে, ১৯৬৯ সালে কলকাতায় সরকারি আর্ট কলেজ থেকে
কৃতিত্বের সঙ্গে চারুকলায় সণাতক করেন। দেশে-বিদেশে আয়োজিত শিল্পী কালিদাসের একক চিত্রপ্রদর্শনীর সংখ্যা এদেশের চারুশিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক। এ ছাড়া তিনি বহু আমত্মর্জাতিক দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও আমত্মর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। বাংলাদেশে ছাপচিত্র-শিল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে গ্রাফিক্স আঁতেলিয়ার-৭১-এর মাধ্যমে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকাতে আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন।
চলমান এ সময়ের জটিল ও বিচিত্র মানবিক সম্পর্কের ভাষা মূর্ত হয়ে ওঠে শিল্পী কালিদাসের ছবিতে। তাঁর ছবির শেকড় প্রোথিত এ-জনপদেরই মাটিতে। এ-ভূখ–র জীবনযাপনপ্রণালি, নানা ধর্মের সমন্বয়, লোকশিল্পের নানা প্রতীক উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের চিত্রকলায়। তাঁর চিত্রকলায় এ-জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আন্দোলনের অনুষঙ্গে এসেছে তাবিজ, কবজ আর কড়ি। কাগজের ম–র পটভূমিতে কখনো চকিতে ধরা পড়েছে মৃত্যুমুখে পতিত মুক্তিযোদ্ধার যন্ত্রণাকাতর হাতের ইঙ্গিত।
শিল্পী কালিদাসের চিত্রকলায় এসেছে আবহমান বাঙালির টোটেম বিশ্বাস। যুগ-যুগামত্মরের পূর্বপুরুষের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন ছড়িয়ে আছে তাঁর চিত্রপটে। শিল্পীর উচ্ছ্বাস, অভিব্যক্তি, শুদ্ধতা, বেদনা, স্মৃতি আর একাকিত্ব – এ সবকিছু নিয়েই যেন তাঁর এই পাললিক অনুভব।
কালিদাস কর্মকারের এ-প্রদর্শনীতে বেশ কয়েকটি সিরিজের কাজ স্থান পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে – পাললিক অনুভব, পাললিক আত্মা, পাললিক প্রতীক, পাললিক ছন্দ, পাললিক মাত্রা, পাললিক উৎসব, পাললিক পাল, পাললিক স্মৃতি, পাললিক মৌনতা, পাললিক অবয়ব, পাললিক অমত্মর্দৃষ্টি প্রভৃতি। বালিয়াড়ি বা কাদামাটির গভীরে কিংবা মাটির উপরিভাগে মাটিকে ঘিরে যত স্বপ্ন আর বাস্তবতা, যত রূঢ়তা-ক্রূরতা, হাসি-কান্না, হিংসা-হানাহানি, প্রেম-অপ্রেম প্রায় সব যেন ক্রমান্বয়ে চলে আসে কালিদাসের হাত ধরে তাঁর চিত্রপটে।
কৃষক যেমন মাটি তৈরি করে বীজ বা চারা বপন করেন, কালিদাস যেন সেই পদ্ধতিতে কাগজে-ক্যানভাসে রঙে রঞ্জিত মাটি আর বালির প্রলেপে প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিজের চিমত্মা আর অনুভবকে তুলে ধরেন।
‘পাললিক অনুভব-৬’ তাঁর এরকম একটি কাজ। শৈশবে আমরা যেমন নদীর কাছে কাদামাটি নিয়ে খেলেছি, আঁচড় কেটে আঁকিবুঁকি করেছি, সেই অনুভূতি ফিরে আসে শিল্পীর এই নির্মিতিতে।
‘পাললিক আত্মা-২’ শিরোনামের চিত্রে শিল্পী পটকে প্রথমত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। ওপর ভাগে বাঁকাচাঁদসহ পরিচিত প্রতীক, নিচের অর্ধাংশ কোনাকুনি বিভক্ত করে কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন বৃত্তাকার ফর্ম, আর চারটি ত্রিভুজের মুখোমুখি দুটিতে গোলাকার জিলিপির প্যাঁচ এবং অন্য দুটিতে কড়ি ও নুড়িপাথর প্রয়োগ করেছেন।
‘পাললিক ছন্দ’ শিরোনামে আঁকা ছবিতে শিল্পী বর্ণলেপন করেছেন তাঁর হাত দিয়ে।
গ্যালারি-অভ্যমত্মরে সংগীত মূর্ছনার তালে-তালে রং ঢেলে হাতে মেখে এরকম ছবি আঁকতে দেখেছি তাঁকে। শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য প্রক্রিয়াটা বেছে নিয়েছেন শিল্পী। এই সিরিজের কিছু কাজ এভাবেই করেছেন কালিদাস কর্মকার।
এ-প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া অনেকগুলো ড্রইংয়ে দেখলাম নারী-পুরুষের নানারকম অবয়ব এঁকেছেন শিল্পী। এগুলোর শিরোনাম দিয়েছেন ‘পাললিক অবয়ব’। মিশ্রমাধ্যমে কোলাজযুক্ত গ্রাউন্ড তৈরি করে কালির অঙ্কনে অবয়ব এঁকেছেন এবং
কালি-কলমে এঁকেছেন, আবার শুধু কাগজের বুকে কালি-কলম চালিয়ে অবয়ব তুলে ধরেছেন।
এসব অবয়বের মধ্যে রেখার খেলা বিচিত্র। কখনো রেখা মুখাবয়ব নির্মাণ করছে, আবার রেখা ঘুরতে-ঘুরতে লতাপাতা তৈরি করেছে অবয়বের ভেতরেই।
গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৫ থেকে শুরু এ-প্রদর্শনী চলেছে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যমত্ম, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা অবধি।