পাললিক যন্ত্রণা-২

কালিদাস কর্মকারের বহুমুখী সৃজনধারা ও সাধনার মধ্যে আমরা এক কল্পনাপ্রবণ ও অজস্র সৃষ্টির ধারায় নিমগ্ন এক চিত্রীকে প্রত্যক্ষ করি। তাঁর শিল্পিত প্রবণতা মূলত রেখাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। রেখায় সাবলীল গতি নির্মাণ করে ব্যঞ্জনাধর্মী এক প্রতীক সংকেতময় হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টিগুচ্ছে। তাঁর অভিব্যক্তি ও ব্যঞ্জনার মধ্যে যে-দৃশ্যরূপ দেখা যায়, সেখানে অন্তর্লীন আমিকে জানবার আকাঙক্ষা বেশ তীব্র হয়ে ওঠে। কখনো এই ধরনের সৃষ্টির অভিপ্রায়ে প্রতিফলিত হয় তান্ত্রিক ভাবজগতের সুরধ্বনি। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে অবলম্বন করেও তিনি সৃষ্টিতে নিমগ্ন হন।
তেলচিত্র, অ্যাক্রিলিক, জলরং, ছাপচিত্র ও মিশ্রমাধ্যমে তিনি অজস্র কাজ করেছেন। তাম্রতক্ষণে পোল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তিনি ছাপাইছবিরও অনন্যসাধারণ এক শিল্পী হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ছাপাইছবির অগ্রণী শিল্পী হেটারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকায় আতিলিয়া-৭১ গড়ে তোলেন। এই মাধ্যমে করণকৌশলকে আয়ত্ত করে আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয়ও দিয়েছেন তিনি। তাম্রতক্ষণে পারদর্শী বলে তাঁর এই মাধ্যমে সৃষ্ট যে-কোনো শিল্পকর্মই পরিশীলিত ঐশ্বর্য ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
সরাসরি বিমূর্ত নয়, আধা-বিমূর্ত তাঁর সৃষ্টি। নানা প্রতীককে অবলম্বন করে তিনি এ-অঞ্চলের মানুষজনের সংগ্রাম, আশা-আকাঙক্ষা ও উদ্যোগকে প্রতিফলিত করবার জন্য সর্বদা প্রয়াসী ছিলেন। সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় তাঁর কাছে পীড়াদায়ক বলে তাঁর চিত্রের বিষয় হয়ে ওঠে সমাজ ও ব্যক্তিমানুষকেন্দ্রিক। রূঢ় ও বিক্ষত বাসত্মবতার রূপায়ণে তিনি নানা ধরনের প্রতীক ব্যবহার করেন। তা কখনো হয়ে ওঠে কবিতার লাবণ্যের মতো পেলব, কখনো খুবই রুক্ষ।
কালিদাস নদীবিধৌত দেশের মানুষ, সেজন্য তাঁর ছবিতে পাললিক অনুষঙ্গ মর্যাদার সঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে।
কালিদাস কর্মকার ১৯৪৬ সালে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। গত ১৮ অক্টোবর ২০১৯-এ তিনি পরলোকগমন করেন।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত চিত্রকর্মটি ২০১৫ সালে অ্যাক্রিলিকে অঙ্কিত।
সংগ্রাহক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।