পাহাড়ি নির্বাচনের রাত

আসমা বীথি

 মাঘ-নিশীথে চু’য়ের পাত্র হাতে বিষণ্ণ বসে আছে এ-পাড়ার কারবারি লং টয়। সামনে ন-ইঞ্চি টেলিভিশনের পর্দায় চলছে ধর্মীয় সিনেমা; যেখানে ডিম হতে ফুটে বেরুবে মানুষের ছানা। উদগ্রীব-উৎকণ্ঠিত শিশু-বুড়োর চোখগুলো সব স্থির সেখানে। অস্থির কেবল টয়। শুধু ঠকে যেতে হয়, ঠকানো হয়! এ-অপমানে বাকিটা চু নিঃশেষ করে তাকায় আমাদের দিকে – ‘ওরা কেন্দ্রটি সরিয়ে নিল, সরিয়ে নিল তো জানাইল না কেন?’ পাড়ার একমাত্র শিক্ষক অংসাই, কোনো চু বা তামাকে যার জ্বালা জুড়াবে না; নির্লিপ্তে সে বলে, ‘ওরা চায় নাই আমরা ভোট দিই, ওরা চায় নাই প্রসন্ন জিতুক।’

আমরা যারা ভ্রামণিক, পাহাড়ের অতিথি তাদের একজন বলে ওঠে – ‘প্রসন্নকে ভোট দিতেন কেন? সে আপনাদের লোক?’ এ-প্রশ্নে অটল পাহাড় যেন তার জমাটবদ্ধ সমস্ত কান্না উগড়ে দিতে চায়। বলে, বাবু আমাদের লোক কেউ না, জিতে গেলে কেউ ভাবে না। ততক্ষণে ঋষির ধ্যানে, অলৌকিক শক্তির গুণে ডিম ফুটে এক মানুষের ছানা বেরিয়ে এলো পৃথিবীতে। গৌতম বুদ্ধের আশীর্বাদপুষ্ট ঋষিকে জিজ্ঞেস করে ড্রাগন – ‘হে মহামানব তুমি কী চাও?’ ঋষি বলে, ‘বুদ্ধের আশীর্বাদ রেখে যেতে চাই এ-পৃথিবীর মানুষদের জন্য।’ কিন্তু সেজন্য তো পবিত্র পাথর দরকার, তা কোথায় পাওয়া যাবে! পাহাড় থেকে বয়ে আনা পাথর, বালুচর থেকে বয়ে আনা পাথর… দেখা যাচ্ছে কোনো পাথরই পবিত্রতার পরীক্ষায় টিকে যাচ্ছে না!

টয়ের চোখ নেশাতুর। টয়ের স্ত্রী, আরো কজন নারী আগুনের উষ্ণতায় ঝিমিয়ে গেছে, ভোটের উৎসবে যোগ দিতে আসা অন্য পাড়ার বুড়ো লিংপং ম্রো-ও যেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রবঞ্চনার ইতিহাসে। পাঁচ-ছ মাইল পাহাড়-ডিঙানো ক্লান্ত শরীরগুলোর ব্যথা ভোলাতেই কী; কারবারির মাচাংঘরের ঠিক বাঁ-পাশে, অন্ধকার আর কুয়াশা ফুঁড়ে ফুটে উঠেছে এক ম্লান চাঁদ।

দূর থেকে পাহাড় চিরকাল নীল জাদুকরী, মখমল সৌন্দর্যের অপূর্ব আধার!