পিয়ানো শিক্ষকের ছাত্র

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ

শিক্ষক বললেন : ‘ব্রামস১? আমরা কি ব্রামস চেষ্টা করে দেখব?’

মিস নাইটিংগেলের কাছে এই প্রথম অনুশীলন ছেলেটির, কিছু বলল না ও, নীরব মেট্রোনোমের২ দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসল, যেন মৌনতাই ওর ভালো লাগছিল! তারপর পিয়ানোর চাবি স্পর্শ করে সুর

তুলতেই মিস নাইটিংগেল বুঝলেন এ-বালক প্রতিভাবান।

পাতলা গড়নের, শান্ত সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত, মৃদুভাষী মিস এলিজাবেথ নাইটিংগেল পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন। নিজেকে তিনি ভাগ্যবতী বলেই জানেন। বাড়িটা পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এবং পিয়ানো শিক্ষক হিসেবে নিজের উপার্জনে কার্পণ্য না করেও তাঁর সচ্ছলতা ছিল। আবেগঘন প্রেমের সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছিল।

বিয়ে করতে পারতেন; কিন্তু পরিস্থিতির

 কারণে তা সম্ভব হয়নি। একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এবং দীর্ঘ ষোলো বছর স্থায়ী হয়েছিল সেই সম্পর্ক; স্ত্রীর প্রতি উদাসীন প্রেমিক নিজেকে একদিন মুক্ত করে আসবে বলে যে-বিশ্বাস ছিল তা হয়নি এবং প্রেমের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর যন্ত্রণাদগ্ধ অনুতাপ ছিল; কিন্তু প্রেমিকের প্রতি কোনো রকম অমঙ্গল কামনা পোষণ করেননি কারণ, যাই হোক সুখের স্মৃতি তো ছিল।

মিস নাইটিংগেলের পিতা চকলেট কারখানায় কাজ করতেন, কন্যার জন্মের সময় তার স্ত্রী-বিয়োগ হয় এবং তিনি যে একাই সন্তানটিকে মানুষ করে তুলেছিলেন তাই নয়, আমৃত্যু তার সঙ্গী ছিলেন। কন্যার দীর্ঘদিনের প্রেমিক যে তার অনুপস্থিতির সময়টাতে আসত তা তিনি কখনো জানতে পারেননি। সেই প্রেম ও পিতার একাগ্র স্নেহের স্মৃতি মিস নাইটিংগেলের জীবনের একটি রূপ রচনা করে দিয়েছিল আর তা বর্তমান নিঃসঙ্গতাকে প্রফুল্লময় করে রাখত; কিন্তু নতুন ছাত্রটি বাজিয়ে যে-উত্তেজনার অভিজ্ঞতা সঞ্চার করল তা বর্তমানের; একেবারেই নতুন, গভীর ও অভিনব : আগে কখনো কোনো বালকের মধ্যে তিনি প্রতিভার উপস্থিতি অনুভব করেননি।

‘কেবল একটু দ্রুত হয়েছে’, প্রস্তাবিত অংশটা বাজানোর শেষে শিক্ষক মন্তব্য করলেন। ‘মৃদুভাবে বাজানোর অংশগুলো মনে রাখবে’, সুরের কোন কোন অংশ বোঝাতে চেয়েছেন পেন্সিলের অগ্রভাগ স্পর্শ করে তা নির্দেশ করে দিলেন।

ছেলেটি উত্তর দিলো না, আগের মতোই শুধু হাসল। সামান্য বড় করে রাখা কালো চুল ওর কপালের ওপর এসে পড়েছিল। কাগজের মতো সাদা আর মসৃণ ও নিখুঁত ওর ত্বক। ওর ব্লেজারের বুকপকেটে একটি ব্যাজ – লম্বা ঠোঁটের এক পাখি বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। ব্লেজারটা নেভি ব্লু, ব্যাজটা লাল, মিস নাইটিংগেলের মতে বিশ্রী।

‘এই অংশটা সামান্য ধীরে বাজানোর অভ্যাস করবে, তাই তো?’ শিক্ষক বললেন।

তিনি লক্ষ করছিলেন মিউজিক স্ট্যান্ড থেকে কাগজটা নেওয়ার জন্য ছেলেটিকে উঠে দাঁড়াতে হলো। তারপর কাগজটা ও নিজের মিউজিক কেসে ফেলে দিল।

মিস নাইটিংগেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আবার শুক্রবারে? একই সময়ে?’

সাগ্রহে ছেলেটি মাথা নাড়ল, হতে পারত একেবারেই বিনয়বশত; কিন্তু শিক্ষকের তা মনে হলো না। ওর লাজুক ভঙ্গিটাই আরামপ্রদ ছিল। অনিঃশেষ বকবক-করা বিরক্তিকর ছাত্রদের চাইতে একেবারেই আলাদা। ছেলেটির মা বলেছিলেন, আগে ওর বেশ কয়েকজন সংগীত-শিক্ষক ছিলেন। ভদ্রমহিলা এতো দ্রুত বকে যাচ্ছিলেন যে ছেলেটিকে বারবার কেন শিক্ষক বদল করতে হয়েছিল তা বোঝা গেল না। পেশাগত কারণে বিষয়টা জানতে চেয়েছিলেন মিস নাইটিংগেল; কিন্তু সদুত্তর মেলেনি। ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে করিডোরের দীর্ঘ দণ্ডের আংটা থেকে টুপিটা নামিয়ে ওর হাতে দিলেন। টুপিতেও পাখির সেই একই প্রতীক। ভেতরের খোলা দরজায় মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে দেখলেন ছেলেটি বেরিয়ে গিয়ে ওর পেছনে গেট লাগিয়ে দিলো। ওর পরনে ছিল খাটো ট্রাউজার; ছাই রঙের উলের মোজার ওপর অনাবৃত হাঁটুদুটো মনে হলো অরক্ষিত, দুর্বল – যেন ঠান্ডা লেগে যাবে সহজেই। হাত নাড়ল ছেলেটি, হাত নাড়লেন মিস নাইটিংগেলও।

সেদিন সন্ধ্যায় আর কোনো শিক্ষার্থী যে আসছে না তাতেই স্বস্তি পেলেন মিস নাইটিংগেল। পুরো সপ্তাহের অতিথিদের অগোছালো করা বসার ঘর যথাস্থানে আনতে লাগলেন। সোমবার সকাল দশটায় ফ্রান্সিস মরফিউ আসবে; সে পর্যন্ত তো নিজের মতো থাকা যাবে! পিয়ানো, আর্মচেয়ার আর সোফায় ঠাসাঠাসি এ-ঘরটা। ম্যান্টেলপিসে রাখা ছিল চাকাওয়ালা গাড়িতে কেসে বসানো, মাথায় হাতল দেওয়া ঘড়ি – দুপাশ দিয়ে প্যারেড করে চলেছে স্ট্যাটফোর্ডশায়ারের সৈনিকেরা। দেয়ালে সাজানো ছিল পিতার সংগৃহীত চকলেটের ছাঁচ বসানো হাঁড়ির ঢাকনা আর ফ্রেমে বাঁধানো ট্রে, ছিল জলরং ছবি আর ফটোগ্রাফি। সোফা টেবিলে আর দরজার কাছের কোণের তাকে সাজানো ছিল ড্যাফোডিল। গোছগাছশেষে নিজের জন্য এক গ্লাস শেরি ঢাললেন মিস নাইটিংগেল। মা যদি ফোনে জানতে চান, ছেলে কতটা এগিয়েছে, কিছুই বলবেন না তিনি। গোপন তথ্যটা এই বালক ছাড়া আর কারো সঙ্গে আলোচনা করবেন না, দিকে দিকে রটনা নয়, শুধু দুজনের মধ্যেই থাকবে কথাটা। স্থূলবুদ্ধির মানুষ ওর মা।

শীত করছিল এপ্রিলের সন্ধ্যায়। বৈদ্যুতিক আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসলেন মিস নাইটিংগেল। আনন্দিত মনে ভাবছিলেন, কত বছর ধরে কত ছেলেমেয়েকে তিনি শিখিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না, সহজাত কোনো গুণ ছিল না, শেষ পর্যন্ত এবার যেন তিনি পুরস্কৃত হলেন। এই বিনয়ী বালকটির মধ্যে কত যে অলিখিত সিম্ফনি৩, সুইটস৪, কনসারটো৫ আর অরেটোরিও৬ ছিল তা অনুভব করতে পেরেছিলেন মিস নাইটিংগেল, সিদ্ধান্তে পৌঁছতে এতোটুকু চিন্তা করতে হয়নি।

গাঢ় হয়ে নামছিল অন্ধকার, দ্বিতীয় গ্লাস শেরিও শেষ হয়ে গেল বসে বসেই। প্রায়ই মনে হতো, এই ঘরেই কেটে যাচ্ছে ওর জীবনটা। এই ঘরেই শৈশবে পিতা বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন নিয়েছেন তাঁর প্রতি। এ-ঘরেই তিনি বয়ঃসন্ধির ঝড়ে আন্দোলিত কন্যাকে দেখেছেন আর সে-অস্থিরতা প্রশমিত করার জন্য নতুন নতুন চকলেট উদ্ভাবন করে সরাসরি রান্নাঘর থেকে এনে তাকে দিয়েছেন। এ-ঘরেই প্রেমিক তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, কানে কানে বলেছে, ‘তুমি সুন্দর’; শপথ করে বলেছে, ওকে ছেড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় তার। আবার এ-ঘরেই ঘটে গেল পরম বিস্ময়কর এই ঘটনাটি।

অন্ধকারে অনুমান করে দরজার পাশের আলোর সুইচের কাছে গেলেন মিস নাইটিংগেল। ধ্বনি আর স্মৃতিতে সমৃদ্ধ এই ঘর নিশ্চয়ই বিকেলের ঘটনায় প্রভাবিত হয়েছিল – একই রকম থাকা তো সম্ভব নয়!

কিন্তু আলো জ্বালানোর পর দেখলেন কিছুই বদলায়নি। কেবল পর্দা টেনে দেওয়ার সময় একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল। জানালার পাশের টেবিলে রাখা ছোট নস্যির কৌটোটা নেই। কৌটোর ওপর কোনো একজনের ঢালে কুলচিহ্নের ছাপ ছিল।

পরের শুক্রবারে চিনেমাটির হাঁস চলে গেল। তারপর গেল ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশনে’র একটি দৃশ্যখোদাই করা ঢাকনা। কানের একটি দুলের হুকে খুঁত ছিল তাই খুলে রেখেছিলেন, ওটা পরের বার গেল। করিডোরের হ্যাঙ্গারে ঝোলানো ছিল একটা হালকা স্কার্ফ, ছেলেদের ব্যবহার-উপযোগী নয়, শনিবারে নিতে গিয়ে দেখলেন, নেই। দুটো স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ার সৈনিক চলে গেল।

মিস নাইটিংগেল বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে ও করছে কাজটা। লক্ষ রাখছিলেন; কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না, বললেনও না কিছু, তাছাড়া ছেলেটির ভাবভঙ্গিতে এতোটুকু পরিবর্তন দেখা গেল না আর ব্যবহারে একটুও বিচলিত মনে হলো না ওকে; তখন মিস নাইটিংগেল ভাবলেন, কী জানি তাঁর নিজের কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

হতেও তো পারে অন্য কোনো বালক, যার গুণ তেমন নেই কিন্তু হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে, তেমন কেউ কি? হতে পারে জিনিসগুলো বহুদিন আগে থেকেই চলে যাচ্ছিল; কিন্তু তখন তাঁর নজরে পড়েনি! কিন্তু অর্থহীন এবং হালকা এই অজুহাতগুলো টিকল না একেবারেই। ছেলেটি যখন শে্যাঁপার আলাপ বাজাতে শুরু করেছিল, তখনো গোলাপের পাপড়ি ঢোকান পেপারওয়েটটা ছিল; কিন্তু ওকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে দেখলেন নেই।

 মিস নাইটিংগেল ছেলেটির সঙ্গে শিক্ষকের মতো বসতেন না, কারণ ওকে শেখানোর বিশেষ কিছু ছিল না; কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর উপস্থিতি ছেলেটির কাছে মূল্যবান, তাঁর মন্তব্যের জন্য নয়, দর্শক-শ্রোতা হিসেবে। কি জানি পারিশ্রমিক মনে করে তুলে নিচ্ছে না তো জিনিসগুলো? এরকম ছেলেমি কল্পনা অস্বাভাবিক না-ও হতে পারে : তিনি নিজেই তো আত্মপ্রবঞ্চনা মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু না, তা কীভাবে সম্ভব!

রাত কাটছিল জাগরণে। তাঁর বিপন্নতা আর বিভ্রান্তি পরবর্তীকালে নির্দয় স্বপ্নের সৃষ্টি করছিল। স্বপ্নে দেখছিলেন মর্মপীড়িত ছেলেটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, বলতে চেষ্টা করছেন, অনুশীলনশেষে ছেলেটি যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে। বারবার যেন বলতে চাইছেন যে, একবার তিনি বাবার বিশেষ একটি চকলেট বাক্স থেকে চকলেট নিয়েছিলেন; কিন্তু কিছুতেই বলা হলো না সে-কথা আর তারপর হালকা ঘুমটা ভেঙে গিয়ে অন্ধকারে এমনসব চিন্তা মনে আসত – আগে তা কখনো হয়নি – বাবাকে আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হতো তিনি কি তাই ছিলেন? যে-মানুষটার প্রতি দীর্ঘকাল তাঁর মুগ্ধতা ছিল, প্রেম ছিল, সে কি কেবলই ব্যবহার করেছে সেই ভালোবাসাকে? বাবার নিঃসঙ্গ জীবনে একই বাড়িতে তাঁর সঙ্গী হয়ে থাকবে বলেই কি চকলেটগুলো প্রণোদনা হিসেবে দিতেন তিনি? তবে কি সাজানো স্বার্থপরতা ও স্ত্রীকে প্রতারণা করেছিল যে-মানুষ সে প্রেমিকাকেও প্রতারিত করেছিল, তবে প্রতারণা কি তার চরিত্রেরই অংশ ছিল? মিথ্যায় জড়ানো ছিল প্রেম?

রাতের অন্ধকারে সব ঠেলে সরিয়ে দিতেন মিস নাইটিংগেল, বুঝতে পারছিলেন না কেন চিন্তাগুলো মনে আসছিল আর কেনই বা অতীতের ঘটনাগুলোকে বর্তমান ঘটনার সমগোত্রীয় মনে হচ্ছিল। বারবার ফিরে আসছিল অতীত আর সত্যের ছায়াঘেরা যে মিথ্যা ছলনাকে আগে অনুধাবন করেননি সেই ছায়ার ওপরই আলো বর্ষণ করছিল। ছোট ছোট জিনিস উঠিয়ে নিলে কি লঘু হয় চুরির দায়? এ-বিষয়ে কথা বললে – যদি বলে ওই সামান্য অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছে বা কিছু মনে করেনি – ছেলেটি আর আসবে না। ওর কথা তেমন জানা ছিল না তবু এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়; আর যেখান থেকে যা চলে গিয়েছিল তিনি সাধারণত সেদিকে দৃষ্টি দিতেন না।

বসন্ত গড়িয়ে গেল গ্রীষ্মে, শুষ্ক দিনের দাবদাহ চলল অক্টোবরের বর্ষণ পর্যন্ত। বিরতিহীনভাবে প্রতি শুক্রবার বিকেলে ছেলেটি এসে দরজার ঘণ্টা বাজাত, একই মৌনী ছেলে করিডোরের লম্বা সরু দণ্ডের অংশটায় টুপিটা ঝুলিয়ে রেখে পিয়ানো টুলে বসে শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে চলত তার স্বর্গযাত্রা।

মিস নাইটিংগেলের কাছে কত ছেলেমেয়ে এসেছে, চলেও গেছে; কিন্তু একমাত্র এই ছেলেটি কখনো অন্যদিন বা অন্য সময়ের অনুরোধ নিয়ে আসেনি। কখনো চিঠি আনেনি, অজুহাত কখনো দেয়নি, সত্য গোপন করে বিরক্তিকর কিছু কখনো বলেনি। বাড়িতে অনুশীলন করত না গ্রাহাম, এসে পোষা জীবের গল্প করে সময় কাটাতে চাইত। ডায়ানা কাঁদতে শুরু করত, করিমের আঙুলে ব্যথা হতো, অ্যাঞ্জেলা তো ছেড়েই দিলো। সময় গড়িয়ে আবার আসত শুক্রবার, মিস নাইটিংগেলের জীবনের কেন্দ্রে অপার শান্তির সম্ভার নিয়ে বিরাজ করত সেই অপরাহ্ণ। কিন্তু প্রতিবার ছেলেটি চলে যেতেই ওর সুরঝংকারে অস্পষ্টভাবে ঘোরাফেরা করত এক বিদ্রƒপ।

ঋতু বদলে যেতে লাগল প্রকৃতির সঙ্গে, আবারো বদলাল, তারপর একদিন ছেলেটি আর এলো না, এই স্কুলের অনুশীলন ওর সমাপ্ত হয়েছিল, অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল ও। ওর অনুপস্থিতি মিস নাইটিংগেলের চঞ্চলতার অবসান ঘটাল এবং সময়ের সঙ্গে অস্থিরতাও শান্ত হয়ে এলো। কত কষ্ট হয়েছিল যেদিন প্রথম মনে হলো নিঃসঙ্গ পিতা কৌশলে তাঁকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, এখন তেমন আর হয় না। প্রেমিক যদি তাঁর প্রেমকে ছোট করেই থাকে প্রশমিত অতীত স্মৃতিচারণে তাও আর তেমন ক্ষুব্ধ করে না। এই ছেলেটির হাতেও প্রতারিত হয়েছিলেন তিনি, কারণ অন্য দক্ষতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল ও। তিনি নিজেই নিজের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, কারণ অসতর্কভাবে এবং আপাতদৃষ্টকে বিশ্বাস করার প্রবণতা ছিল তাঁর। সবই সত্য মনে হতো; কিন্তু কী যেন একটা কেবল খুঁচিয়েই যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, তাঁর তো অবশ্যই অধিকার ছিল আর একটু বেশি উপলব্ধি করার।

বহুদিন পর ছেলেটি আবার এলো – লম্বা হয়েছে, সৌষ্ঠবহীন বয়ঃসন্ধিতে হারিয়ে গিয়েছিল বালকসুলভ কোমলতা। মিস নাইটিংগেলের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে আসেনি ও, সোজা ভেতরে হেঁটে গিয়ে পিয়ানো টুলে বসে শিক্ষককে বাজিয়ে শোনাল। বাদনশেষে ওর সুরলহরীর রহস্যে উদ্ভাসিত হাসিমুখে তাকিয়ে রইল শিক্ষকের অনুমোদনের অপেক্ষায়। ওর দিকে তাকিয়ে মিস নাইটিংগেল এতোদিন যা অনুধাবন করেননি তা এবার করলেন। এই যে রহস্য – এই এক বিষয়। এখানে তাঁর কোনো অধিকার নেই। ভালোবাসা বা সৌন্দর্য সৃষ্টির মতো মহৎ গুণের সঙ্গে নীতিহীনতা বা হীন দুর্বলতা কীভাবে যুক্ত হতে পারে তা উপলব্ধি করার প্রচেষ্টাই অতিরিক্ত দাবি ছিল। সামঞ্জস্য ওই দুয়ে মিলেই আর তাই তো যথেষ্ট।

১.        ব্রামস : ১৮৩৩ সালে জার্মানির হ্যামবুর্গে এই সুবিখ্যাত পিয়ানোবাদক জোহানেস ব্রামসের জন্ম। ১৮৯৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

২.       মেট্রোনোম : নির্দিষ্ট লয়ে সংগীতের তাল মাপার জন্য দোলকযুক্ত যন্ত্রবিশেষ।

৩.       সিম্ফনি : বৈচিত্রসমৃদ্ধ অথচ সুসংগতিপূর্ণ যন্ত্রসংগীত।

৪.       সুইটস : পাশ্চাত্য সংগীতে তিন বা ততোধিক পরস্পর সম্পর্কিত অর্কেস্ট্রার সুর।

৫.       কনসারটো : অর্কেস্ট্রার সঙ্গে এক বা একাধিক বাদ্যযন্ত্রে বাজানোর সুর।

৬.       অরেটোরিও : অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গাওয়ার জন্য রচিত সংগীত।

লেখক পরিচিতি

উইলিয়ম ট্রেভর একজন আইরিশ ছোটগল্প-লেখক ও ঔপন্যাসিক। ১৯৫০ সালের পর থেকে তিনি ইংল্যান্ডে বসবাস শুরু করেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেন।