প্রকাশকের গল্প

কৌশিক জোয়ারদার

 

পিওন থেকে প্রকাশক

বাদল বসু

আনন্দ পাবলিশার্স

কলকাতা, ২০১৬

৬০০ টাকা

 

 

ব ই কিনতে গিয়ে দুটো জিনিস আমরা খেয়াল রাখি – বিষয় আর লেখক। সাধারণত গল্প বা কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে লেখকের নামই তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিষয়। কিন্তু যে-মানুষটি রক্তমাংসের বইটিকে সম্ভব করে তোলেন, লেখার টেবিল থেকে টেনে এনে পা-ুলিপিকে শত-হাজার বই করে তুলে দোকানে পৌঁছে দেন, লেখক আর পাঠকের মাঝে সেতু হয়ে দুদিকে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, সেই প্রকাশকের অসিত্মত্ব আমরা পাঠকেরা টের পাই না। আমরা খেয়াল করি না। কিন্তু এঁদেরই মধ্যে কেউ-কেউ এমন মহীরুহ হয়ে ওঠেন যে, খেয়াল না করে আর উপায় থাকে না তাঁকে। দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু তেমনই একজন, বাদল বসু নামেই যিনি অধিক পরিচিত। ‘তাঁর নিজের কথায় মৃণাল যেমন জলের তলায় ডুবে থেকে জলের ওপরে ভাসিয়ে রাখে পদ্মফুলটিকে, একজন ভালো প্রকাশকও তেমনই নিজেকে আড়ালে রেখে তুলে ধরেন লেখককে।’ ‘ভালো প্রকাশক’ তো তিনি বটেই, কিন্তু ততটা আড়ালেও থাকেননি তিনি। তার কারণ শুধু এই নয় যে, তিনি একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সমর্থনের বলে বলীয়ান ছিলেন। নিজের কাজের গুণে লেখকদের এতটাই কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁদের লেখাতেও বাদল বসুর বারবার উপস্থিতি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার

দেশে বইটিতেই তো আমি ‘আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার’ বাদল বসুর সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্বের কথা প্রথম জানি। চমৎকার এই ভ্রমণবৃত্তান্তটির প্রকাশকও বাদল বসু। ক্ষুদ্র পত্রিকাগুলোর জীবনীশক্তির অন্যতম উৎস বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটা বিরোধিতার মনোভাব। অথচ আসানসোলের সাহিত্য ভাবনা পত্রিকা ২০১০ সালে বাদলবাবুর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। এমন সৌভাগ্য আর কোনো প্রকাশকের হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। সেই বিশেষ সংখ্যাটিতে মলিস্নকা সেনগুপ্ত এবং শ্রীজাত বাদল বসুর যে-ছবি এঁকেছেন তাতেই স্পষ্ট যে, তিনি

নবীন-প্রবীণ সব লেখকের কাছেই কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। এই জনপ্রিয়তা তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া নয়। মেদিনীপুরের দহিজুড়ি গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে গৌরাঙ্গ প্রেসের সাইকেল-পিওন হিসেবে তাঁর বইয়ের জগতে প্রবেশ। সাইকেল-পিওন মানে সাইকেলে করে লেখকদের বাড়ি-বাড়ি প্রম্নফ পৌঁছে দেওয়া কাজ ছিল তাঁর। সেখান থেকে ধাপে-ধাপে ছাপাখানা এবং প্রকাশনার সব রকমের কাজ
শিখতে-শিখতে আনন্দ পাবলিশার্সের প্রবাদপ্রতিম প্রকাশক। হাতেকলমে সব রকমের কাজ শিখেছিলেন বলেই বোধহয় প্রকাশনাজগতে তাঁর এমন প্রতিষ্ঠা। লেখক-শিল্পীদের নিয়েই তাঁর কারবার, ফলে পিওন থেকে প্রকাশক বইটিতে বাদল বসুর কাছে পাঠক তাঁদের প্রিয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেক কথা, অনেক গল্প শুনবেন। লেখকদের লেখা গল্পের থেকে গল্পের লেখকদের জীবনের নানা কীর্তিকাহিনি কম আকর্ষণীয় নয়। শিবরাম চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু, আশাপূর্ণা দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কমল মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, নবনীতা দেবসেন – এরকম অনেকানেক বাঙালির প্রিয় লেখকের সঙ্গে কাজের সূত্রে যে-গল্পগুলো উঠে এসেছে, আমাদের শুনিয়েছেন বাদল বসু। সুনীল-শক্তির গল্পে বাঙালি পাঠকের আগ্রহের শেষ নেই। এ-বিষয়ে বাদলবাবু কার্পণ্য করেননি। নিজের বই প্রকাশ না করলে অন্য জায়গা থেকে প্রকাশকের নামেই সেই বইটি ছেপে দেওয়ার হুমকি কেবল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব। কালাপাহাড় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে শিবমন্দিরে প্রণাম ঠুকতে দেখে ফেলার গল্পে বেশ অবাক হয়েছি। মজাও পেয়েছি। সন্দীপন কি জানতে পেরেছিলেন এই কথা?  জয় গোস্বামী এবং তসলিমা নাসরীন সম্পর্কে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। অন্য আরো দু-একজনের প্রসঙ্গেও তিনি এমন কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকদের শুনিয়েছেন। হয়তো এই সুযোগে মনের ভেতরে জমে থাকা কিছু ক্ষোভ উগরে দিলেন আমাদের কাছে, দিয়ে হালকা হলেন কিছুটা। সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার উপায় তো আমার নেই, কিন্তু কুৎসা করছেন বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। জয় এবং তসলিমার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাও গোপন থাকেনি। ওঁরা যে বাংলা ভাষার দুই প্রধান লেখক সেটা তো অনস্বীকার্য। বেশিরভাগ কথাই এসেছে বই প্রকাশের প্রসঙ্গে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর নাতনি কঙ্কাবতী দত্তের কথাগুলো না বললেই পারতেন। কোনো ‘স্নেহের পাত্রী’র চিঠিতে যদি আপনার প্রতি অন্য রকম ভালোলাগার ইঙ্গিত থাকে (বলে আপনার মনে হয়ে থাকে), তা যদি আপনাকে না ছুঁয়ে পিছলে যায়, তা যদি আপনার তিক্ততা কিংবা ভালোলাগা – কোনোটারই কারণ না হয়ে থাকে, তা হলে সেই কথা প্রকাশ করা ‘স্নেহের পাত্রী’র প্রতি অবিচার মনে হয়। বড় প্রকাশনা সংস্থা বড় লেখকদের বই ছাপতে থাকবে, কালের নিয়মে প্রকাশক আসবেন-যাবেন – এর মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই। বাদল বসু কিন্তু গতের বাইরে বেরিয়ে এমন কিছু কাজ করে গেছেন, যে-কারণে একটা আলাদা পরিচয় তাঁর গড়ে উঠেছে। যেমন অর্থনীতি গ্রন্থমালা ও ইতিহাস গ্রন্থমালার পরিকল্পনা, শিল্পকলা-বিষয়ক বই প্রকাশের উদ্যোগ ইত্যাদি। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর একটি বই পাওয়ার জন্যে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েছেন তাঁর অক্সফোর্ডের বাড়িতে। অবশেষে ছাপাতে পারলেন আমার দেবোত্তর সম্পত্তি। বই মুদ্রণ সম্পর্কে নীরদবাবুর জ্ঞানের পরিধি শুনলে তাক লেগে যায়। সত্যজিৎ রায় আর নীরদচন্দ্র ছাড়া মুদ্রণশিল্পের এত জ্ঞান আর কোনো বাঙালি লেখকের ছিল না। সত্যজিৎ অবশ্য হাতেকলমে কাজ জানার ব্যাপারে সবার থেকে এগিয়ে ছিলেন। তা ছাড়া বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-শিল্পে সত্যজিৎ যে-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, লেখক হিসেবে তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন কেবল পূর্ণেন্দু পত্রী। পূর্ণেন্দুর দক্ষতার স্বীকৃতি সত্যজিতের মুখ থেকেও বেরিয়ে এসেছে। বাদল বসু কেবল সত্যজিতের বইয়ের প্রকাশকই ছিলেন না, তাঁর শিষ্য ও পারিবারিক বন্ধু হিসেবেও তিনি গর্বিত। বাদলবাবুর আর একটি অভিনব উদ্যোগ কলেজ স্ট্রিটপাড়ায় হইচই ফেলে দিয়েছিল – এক এবং দুই খ– শরৎ রচনাবলি ব্যাংকের মাধ্যমে বিপণনের পরিকল্পনা। বই প্রকাশের আগেই গ্রাহকের সংখ্যা শুনে সারা ভারতেরই প্রকাশকদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। বাংলা বইকে বিশ্ববাজারে জনপ্রিয় করার কাজটিও তাঁর আমলেই শুরু হয়। কর্তৃপক্ষের উদার সমর্থনে ফ্রাঙ্কফুর্ট, প্যারিসসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলা বইকে নিয়ে পৌঁছে যেতেন তিনি। বাংলাদেশে আনন্দ পাবলিশার্সের স্বনির্ভর শাখা খোলার তাঁর উদ্যোগটি নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব পেয়েছিলেন দুই বাংলার মানুষের কাছেই প্রিয় বেলাল চৌধুরী। বাংলাদেশের জাল বইয়ের অসাধু ব্যবসায়ীরা দুই বাংলারই লেখক ও প্রকাশকদের উদ্বেগের কারণ। পাঠকরা সচেতন না হলে অবশ্য এই চক্রের বিনাশ সম্ভব নয়। টিনটিনের বইয়ের বাংলায় আত্মপ্রকাশ তাঁর আমলের এক বিরাট কীর্তি। এ-বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর কর্ণধার অভীক সরকারের কাছে বাঙালি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি স্বয়ং ব্রাসেলসে গিয়ে অ্যার্জের সঙ্গে চুক্তি করে এসেছিলেন। দুঃখের বিষয়, টিনটিনের অনুবাদকদের নাম বাদলবাবুর মনে নেই। আমি যেন শুনেছিলাম অন্যতম অনুবাদক ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। অসাধারণ অনুবাদ কোনো সন্দেহ নেই। পৌলোমী সেনগুপ্তের অনুবাদে অ্যাস্টেরিক্সও কিন্তু লা জবাব। আমি তো এই কথা জানার পর থেকে পৌলোমীর ভক্ত হয়ে গেছি।

তাঁর প্রকাশক জীবন যে শুধুই সাফল্যের ইতিহাস নয়, সে-কথা নিজেই কবুল করে গেছেন বাদল বসু। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় প–ত সুখময় ভট্টাচার্যের সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ বইটির পা-ুলিপি ফেরত দিয়ে দিলেন। শঙ্খবাবুর উদ্যোগে পরে বইটি অরুণা প্রকাশনী বের করে এবং বইটি রবীন্দ্র পুরস্কার পায়। আবার সুকুমার সেনের কথায় সুভাষ ভট্টাচার্যের আধুনিক বাংলা প্রয়োগ অভিধান প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে ওই বইটিই আনন্দ পুরস্কার পায়। বাদলবাবু কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসসমগ্র, গল্পসমগ্র প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রবন্ধসমগ্র প্রকাশ করতে পারেননি। সেটা অবশ্য ঠিক ওনার ব্যর্থতা নয়। অজ্ঞাত কারণে দয়াময়ী মজুমদার প্রবন্ধ সংগ্রহের পা-ুলিপি প্রমা প্রকাশনার হাতে তুলে দেন। প্রমার কর্ণধার সেই পা-ুলিপি হারিয়ে ফেলে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন! অবশ্য এ-বিষয়ে দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য অন্যরকম হতেই পারে। স্মৃতিকথনে বিস্মৃতির সম্ভাবনা কিছু অস্বাভাবিক নয়। যেমন ৪৯০ পৃষ্ঠায় দেখছি শরদিন্দু অমনিবাসের ‘অমনিবাস’ নামটি পুনেতে বসে সুকুমার সেন দিয়েছেন। আবার ৫৪২ পৃষ্ঠায় পেলাম ‘অমনিবাস’ কলকাতায় বসে অভিধান দেখে স্বয়ং শরদিন্দুবাবুরই দেওয়া। এমন কিছু স্বাভাবিক ভ্রামিত্মর কথা মাথায় রেখেই বইটি পড়তে হবে। এবং পড়তেই হবে। বই যারা ভালোবাসে, লেখকদের যারা ভালোবাসে, কলেজ স্ট্রিটপাড়া যারা ভালোবাসে – এ-বই তাদের ভালো লাগবেই। এসব গল্প যখন বাদল বসু আমাদের শোনাচ্ছেন, তখন তিনি দুরারোগ্য কর্কটরোগে আক্রান্ত। জানেনও না আগামীকালের সূর্যোদয় তিনি দেখবেন কিনা। অথচ তখনো বাংলা বই নিয়ে তাঁর কত স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছেন আমাদের! বাদলবাবু ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর আত্মজীবনীমূলক বই আমার কথার অনুলেখক শুভময় ঘোষের (সাগরময় ঘোষের ছোটভাই) অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। পিওন থেকে প্রকাশকের অনুলেখক সিজার বাগচীর কাজও কিন্তু অসামান্য। চমৎকার এ-বইয়ের প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্সের পক্ষে সুবীরকুমার মিত্র – এ-কথা উলেস্নখ না করলে বাদল বসুর শ্রম বৃথা। প্রচ্ছদে কুট্টির আঁকা বাদলবাবুর কার্টুনটি উপরি পাওনা। তবে শব্দসংখ্যা অপরিবর্তিত রেখেও বইটি আকারে আর একটু ছোট এবং দামে আর একটু কম হতেই পারত।