প্রকৃতি অন্বেষণ

ভূমিকা

প্রকৃতিবিষয়ক আলোচনার শুরুতে জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির কিছু কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘তোমার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কী (নদী, বৃক্ষ, পাখি, মাছ, ভূগর্ভস্থ খনিজসম্পদ, জলপ্রপাত ও পুকুর)? আমাদের অনেকেই এই সম্পর্ক সম্পর্কে সজাগ নয়। আমরা বৃক্ষের দিকে তাকাই না, যদিও তাকাই তবে তা বৃক্ষকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেকথা মনে করে। এর ছায়ায় বসার কথা ভাবি, কাঠ পাওয়ার জন্য একে কেটে ফেলার কথা ভাবি। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা বৃক্ষের দিকে তাকাই উপযোগবাদী উদ্দেশ্যে। আমরা নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে বৃক্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করি না। পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় উৎপন্ন আমরা একইভাবে প্রত্যক্ষ করি।

পৃথিবীর জন্য কোনো ভালোবাসা নয়, পৃথিবীকে কীভাবে ব্যবহার করা যাবে সেটাই আমাদের লক্ষ্য থাকে। যদি কেউ পৃথিবীকে ভালোবাসতো তাহলে তার উৎপন্ন ব্যবহারের পেছনে সাশ্রয়ী মনোভাব থাকতো। অর্থাৎ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রকৃতার্থে বুঝতে পারলে আমরা তার উৎপন্ন ব্যবহারে আরো সচেতন হতাম।

প্রকৃতির সঙ্গে একজনের সম্পর্ক বোঝা সত্যই কঠিন যেমন কঠিন প্রতিবেশী, স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অনুধাবন করা। আমরা কদাচিৎ এ-ব্যাপারে চিন্তা করি অথবা শান্ত হয়ে বসে আকাশের তারা, চাঁদ বা বৃক্ষরাজি প্রত্যক্ষ করি। আমরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। আসলে এ-ধরনের ব্যস্ততা আমাদের নিজের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। যারা প্রকৃতি-পূজা করে তারাও আত্মপলায়নের ফাঁদে পড়ে। আমরা সবসময় প্রকৃতিকে ব্যবহার করছি নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য অথবা প্রকৃতির কাছে থেকে উপযোগ আদায়ের জন্য। আমরা কখনো পৃথিবীকে অথবা পৃথিবীর সম্পদকে ভালোবাসার জন্য সুস্থির নই। আমরা ফসলের মাঠকে অনুধাবন করি না, যা আমাদের খাবার জোগায় অথবা আচ্ছাদন দেয়। আমরা নিজের হাতে কর্ষণ করি না কারণ নিজের হাতে কাজ করতে লজ্জা পাই। নিজের হাত ব্যবহার করলে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটতো; কিন্তু বাস্তবে নিম্নবর্গের লোকেরা কৃষিকাজ করে। আমরা উচ্চশ্রেণির লোকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ-কাজে নিয়োজিত হই না। সুতরাং প্রকৃতির সঙ্গে আমরা সম্পর্ক হারিয়ে ফেলি।’

‘ন্যাচার’ শব্দটি পুরনো ফরাসি শব্দ থেকে এলেও ল্যাটিন ভাষায় ‘ন্যাচার’ বলতে মূল গুণাগুণ বা অন্তর্নিহিত গুণ বোঝাতো। আবার গ্রিক ভাষা থেকে ফিসিস শব্দটি অনূদিত হয়ে ল্যাটিন ভাষায় আসে। গ্রিক ফিসিস বলতে অবশ্য উদ্ভিদ, প্রাণী ও সকল কিছু বোঝাতো যা নিজের থেকে জন্ম নেয়। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে প্রকৃতি বর্তমান অর্থ লাভ করে। বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতি হলো প্রাকৃতিক, ভৌত, বস্তুগত বিশ্ব। তবে আজকের দিনে প্রকৃতি বলতে বোঝায় ভূতাত্ত্বিক জগৎ ও বন্যজীবন (wilderness)। প্রকৃতির সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ প্রাকৃতিক পৃথিবী এবং এর ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও অন্যান্য বস্তুকে বুঝিয়েছেন। বৃক্ষ, বন, পাখি, পশু-প্রাণী প্রকৃতির অঙ্গীভূত। প্রকৃতি অর্থনীতি, সমাজ ও আমাদের সার্বিক অস্তিত্বকে ধারণ করে। আমরা প্রকৃতিকে মূল্য দিই, কারণ সে আমাদের জীবনধারণ ও জীবনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি সম্ভব করেছে। মানবীয় বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছুই অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের মধ্যে দেখা যায়। আমরা সবাই জীবতাত্ত্বিকভাবে শরীরসমৃদ্ধ ও প্রতিবেশতাত্ত্বিকভাবে আবদ্ধ। আমরা প্রশ্বাস নিই, খাই ও অক্সিজেন গ্রহণ করি, যা আমাদের শারীরিক বৃদ্ধির কাজে লাগে। উদ্ভিদ, প্রাণী, বন, বন্যতা সবকিছুই এখন প্রকৃতির। আমরা ক্রমাগত প্রকৃতির সীমিত, ভঙ্গুর অথচ মূল্যবান গুণ প্রত্যক্ষ করি, কারণ অস্থায়িত্বশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে ত্বরান্বিত করছে। তবে বেশসংখ্যক মানুষ প্রকৃতিকে জীবনরক্ষাকারী ও মানবিক ঐতিহ্য মনে করেন। পরিবেশ ও পরিবেশবাদ আমাদের প্রকৃতিবিষয়ক রাজনীতির কথাও বলে। মানবসমাজসমূহ এবং বৈশ্বিকভাবে সম্পর্কিত অর্থনীতিসমূহ বায়োস্ফিয়ারের অংশবিশেষ। এই অবস্থা সামাজিক বিকাশের ধারাকে ধরে রাখা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিবেশতাত্ত্বিক সমর্থন প্রদানের জন্য পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাসব্যাপী মানুষ প্রকৃতিকে যেমন রূপ দিয়েছে তেমন প্রকৃতিও মানবসমাজকে বিকশিত করেছে। মানবীয় কর্মকাণ্ডের মাত্রা বিবেচনা করলে দেখা যায় – প্রযুক্তি, পুঁজিবাজার এবং শাসনব্যবস্থা মানবসমাজসমূহকে আন্তঃসম্পর্কিত করেছে। সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশব্যবস্থা এতোটাই পরস্পরসম্পর্কিত ও নির্ভরশীল যে, এক জায়গায় যে-কোনো পরিবর্তন সাধন করলে তা অন্যত্র সমাজ ও পরিবেশব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এক জায়গায় নবায়নযোগ্য সম্পদের সরবরাহের তারতম্য হলে অন্যত্র নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। পরিবেশব্যবস্থার স্থানিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনে মানুষ প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই বলা যায়, সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা মানুষের আন্তঃসম্পর্ক অধ্যয়ন শুধু নয়, বিশেষ পরিসরে মানুষের আন্তঃসম্পর্র্ক অধ্যয়ন বোঝায়। এই পরিসরই পরিবেশ, প্রকৃতি এবং ভূগোল। প্রকৃতিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, এটি হলো প্রাকৃতিক পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে – যেমন মানুষ ও তার সারবস্তুও – প্রকৃতির মধ্যে পড়ে। বৃক্ষ, বন, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী প্রকৃতির উদাহরণ বলা য়ায়। যদি কেউ অসভ্য হয়ে থাকে তবে তাকে অসভ্য প্রাকৃতিক মানুষ বলতে হবে। প্রকৃতি আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, এমনকি সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। আমাদের বন, নদী, সাগর, মহাসাগর ও মৃত্তিকা আমাদের খাদ্য, বাতাস, সেচের পানি দেয়। আমরা আমাদের স্বাস্থ্য, সুখ ও উন্নতির জন্য প্রকৃতির বিবিধ পণ্য ও সেবার ওপর নির্ভর করি। সে কারণে প্রকৃতিকে মূল্য না দিয়ে উপায় নেই।

প্রকৃতি কী

প্রকৃতি কী? – এমন প্রশ্ন দার্শনিক বটে। রেমন্ড উইলিয়ামস বলেন, ÔIt is relatively easy to distinguish three areas of meaning : (i) the essential quality and character of something; (ii) the inherent force which directs either the world or human beings or both; (iii) the material world itself, taken as including or not human beings.Õ তিনটি ধারণাই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রথমটি ত্রয়োদশ শতকে ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারণা-দুটি অপেক্ষাকৃত বিমূর্ত। দ্বিতীয়টি চতুর্দশ শতকে এবং তৃতীয়টি সপ্তদশ শতক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে এটি স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃতি শব্দটির প্রেক্ষাপট নির্ধারিত হয়ে আসছে, তবে বর্তমানে প্রকৃতি শব্দটি বহুবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন – শক্তি, স্থান, অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য। এছাড়া স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন বাস্তবতার নিরিখে প্রকৃতিকে জানার সুযোগ হলেও সংস্কৃতির বিবর্তনের মাধ্যমে এটি অনেক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আজকে প্রকৃতির ধারণাকে অস্বীকার না করেও আমরা যখন পরিবেশ বা প্রতিবেশকে আলাদাভাবে অধ্যয়ন করছি তখন এক অর্থে আমরা প্রকৃতির সুপ্ত ব্যবচ্ছেদ করে চলেছি। উন্নত বিশ্বে শহরগুলির বাস্তবতা এতো বেশি বিশেষত্ব লাভ করেছে যে, প্রকৃতির বিপরীত অভিধায় তা জানার চেষ্টা চলছে। অনুরূপভাবে নাগরিক সমাজকে গ্রামীণ সমাজ থেকে আলাদাভাবে ভাবার চেষ্টা করা হয়। বিনয় ঘোষ তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছেন মেট্রোপলিটন মন : মধ্যবিত্ত-বিদ্রোহ অর্থাৎ শহর আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গঠনও পাল্টে দিচ্ছে। এটি আর প্রাকৃতিক চক্রে প্রশাসিত বা নোঙরকৃত থাকছে না। সমাজবিজ্ঞানও আজকের দিনে পশ্চিমা বিশ্ব ও শহুরে সমাজ নিয়ে ব্যস্ত। বন্য প্রকৃতি যেন একটি অবহেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, প্রকৃতির বৃহত্তর অর্থ ভৌত, বাস্তবিক ও প্রাকৃতিক তথা বিশ্বকে বোঝায়। যদিও মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ, মানুষের কাজকে আলাদা প্রপঞ্চ হিসেবে দেখা হয়।

অধুনা প্রকৃতিবিষয়ক ধারণা মানুষের সংস্কৃতি ও কর্মজগতের বাইরে একটি স্বাধীন ও বাহ্যিক সত্তা হিসেবে পরিগণিত হয় না। বরং বিশ্ব মানবসমাজের দ্বারা এটি প্রতিনিয়ত নির্ভরশীল ও পরিবর্তিত হচ্ছে – এমন ধারণাই অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবেশ ও পরিবেশগত সংকটের দ্বারা নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে। পূর্বে মনে করা হতো, প্রকৃতি একটি সুশৃঙ্খল, অক্ষয় ও উপকারী জগৎ। অনেক ধরনের রচনা ও ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষণ প্রকৃতির এমন ধারণাকে ধূলিসাৎ করেছে। প্রকৃতি এখন বিশৃঙ্খল, ক্ষয়িষ্ণু ও ঝুঁকিপূর্ণ। এটি এখন সীমিত ও ভঙ্গুর। প্রয়াত কবি রফিক আজাদ সত্তরের দশকে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল সীমিত জলে সীমাবদ্ধ সবুজে। আজকের শহরজীবনের এক অনবদ্য প্রতিবিম্ব। প্রকৃতিকে সীমাহীন ভাবতে গেলে বিশ্বের প্রসারিত প্রকৃতির ভাবনা চলে আসে। পরিবেশ হিসেবে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে আমরা আমাদের গ্রহের ওপর বেশি নজর দিয়েছি। মানুষ ও তার সংস্কৃতি বিজ্ঞান ও সমাজপাঠের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমান্বয়ে প্রকৃতি আর স্বাধীন বাহ্যিক চলক ও নির্ভরযোগ্য সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে থাকেনি। এখন প্রকৃতি গার্হস্থ্য, সামাজিকীকৃত ও রাজনৈতিকীকৃত বিবেচিত হচ্ছে। আমরা প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা, স্থায়িত্বশীলতা ও শৃঙ্খলা নিয়ে ভাবিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বস্তু হিসেবে বাতাসকেও অন্যান্য উপযোগ, যেমন – রাস্তা, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মতো ভাবতে শিখেছি। সুতরাং সামাজিকভাবে উপরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, ও শৃঙ্খলায়ন দরকার হয়ে পড়েছে।

পানি উনিশ শতকেই সামাজিকীকৃত হয় এবং পানি ব্যবস্থাপনাকে নৈতিক কর্তব্য জ্ঞান করা হয় যদিও ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহ তখন মানুষের জানা ছিল না। পরিবেশবাদ আজকে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ স্পিসিসকে, প্রাকৃতিক অঞ্চলকে, বনাঞ্চলকে এবং বন্যজীবনকে সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকৃতির এসব জিনিসকে সীমিত ও ভঙ্গুর মনে করেছে। মানুষ মনে করে প্রকৃতি তাদের জীবনপ্রবাহের ভিত হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ব্যক্তির কাছে এসবের ঐতিহ্যিক মূল্যও কম নয়। কিন্তু এসবের পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনীতির দিকটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ শতকের আশির দশক থেকে কেন এতো গ্রন্থ পরিবেশ ও পরিবেশবাদের ওপর লেখা হলো? প্রকৃতির সামাজিকীকরণের এই সাধারণ রূপ ও পরিবেশবাদের উত্থান চমকপ্রদ তো বটেই, সেই সঙ্গে এটি যথেষ্ট পরিষ্কার নয় যে, মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক এতোটা গুরুত্ব বহন করে কেন? এমন ধারণা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত যে, প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রকৃতির ওপর সাংস্কৃতিক অধিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা একমুখী পরিবেশবাদের রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়। গত দশ বছরে প্রকৃতির ওপর লেখা গ্রন্থের সমাহার প্রমাণ করে যে, সেগুলি পরিবেশবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিক বিজ্ঞানের বীরত্বপূর্ণ কাজে এগুলির ভূমিকা অনবদ্য মনে করা হয়। পরিবেশের আলোচনায় সামাজিক আন্দোলন ও পরিবেশবিষয়ক বিতর্কের একটা পরিসরও গড়ে ওঠে। তবে এসব লেখালেখি পরিবেশের বিশ্বজনীন রূপকে তুলে ধরতে পেরেছে মনে করা হলেও বাস্তবে প্রাকৃতিক বিষয়ের বা সামাজিক বিষয়ী একটা ক্ষুদ্র পরিসর ছুঁতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বন্যজীবন, বনাঞ্চল, উচ্চভূমি অথবা নিম্নাঞ্চল গুরুত্ব পেয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বেছে নেওয়ার কারণ হলো, পরিবেশবাদ নিজেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মেট্রোপলিটান সিটি বা ছোট শহর পরিহার করা হয়েছে কারণ এসব অঞ্চল যেনবা বিপ্রাকৃতিক, অপরিচ্ছন্ন ও হারিয়ে গেছে। সেদিক থেকে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে রোমান্টিক আন্দোলনের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়, কারণ তারাও একই ধরনের প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে।

প্রকৃতি ও সমাজ

মানুষ জন্মগতভাবেই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মস্তিষ্কের উন্নততর বিবর্তন ও কৌশলগত উন্নতি মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করেছে। ইতোমধ্যে কৃষির আবির্ভাব মানুষকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়। এ থেকেই ধীরে ধীরে সামাজিক বা সাম্প্রদায়গত যৌথবদ্ধতার সূচনা হয়। সব দেশে সব জায়গায় সমানভাবে না হলেও মানুষ তার জীবনযাপনের উপযোগ মেটাতে প্রকৃতিকে কাজে লাগায়। যাবতীয় রসদ সংগ্রহের জন্য তারা প্রকৃতির ভাণ্ডার ব্যবহার করে। এভাবেই প্রকৃতি ও সমাজ আলাদা অবয়ব গ্রহণ করতে থাকে। গত ৩০০ বছরে প্রকৃতি, খনিজসম্পদ, মাটি ও জলপ্রবাহ, এমনকি আকাশ মানবসমাজের আধিপত্যের শিকার হয়। সুতরাং প্রকৃতি ও সমাজ দুটি বিচ্ছিন্ন স্বাধীন সত্তা হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করে। প্রকৃতির ক্রমাগত অবনয়ন মানবসমাজের উন্নয়নকে নিশ্চিত করে। আগে মানুষের পরিবেশ-প্রতিবেশ বলে কিছু ছিল না, কারণ তারা পরিবেশেরই অংশ ছিল। কিন্তু গত ৩০০ বছরে তারা পরিবেশের ধারণা লাভ করল।

প্রকৃতিকে তারা জীবন ধারণের নানাবিধ উপায় থেকে নান্দনিক শিল্পের মাধ্যম হিসেবে আত্মস্থ করল। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও কলাকৌশলের অভূতপূর্ব উন্নতি সম্পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও স্থায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

এছাড়াও অনেক ধরনের পণ্য ও সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পাই। প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদকে ‘ন্যাচারাল ক্যাপিটাল’ বা প্রাকৃতিক পুঁজি বলা হয়ে থাকে। কৃষি থেকে বনায়ন ও বিনোদন থেকে পর্যটন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে এসব সুবিধা কাজে লাগানো হয়। একটি হিসাবে বলা হয়েছে যে, বছরে ন্যূনপক্ষে ১২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সম্পদ সবার জন্য না হলেও মুক্ত। সে-কারণে আমরা একে আমাদের জন্য প্রদানকৃত এবং ইচ্ছামতো আত্মসাতের বিষয় মনে করি। বন বিনষ্ট, বেশি করে মাছ ধরা, নদীগুলোকে দূষিত করা ও পলিমাটি দিয়ে ইট তৈরি করার পূর্বে এর ফলাফলের কথা চিন্তা করি না। উপকার বা আর্থিক মূল্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে যে বিপুল সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতির জন্ম দিচ্ছি, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বর্তাবে। সুতরাং সরকারকে এ-ব্যাপারে বাস্তবিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

That there is a balance of nature is one of the most deepseated assumptions about the natural world, the world we know on planet Earth. For as long as we humans have had the ability to think seriously about our world we have attempted to find order in chaos. The world is vast and surely appeared vaster when our collective knowledge was far less than it is today. Humans living, say, 10,000 years ago, at the dawn of agriculture, must have perceived nature as impossibly complex, perhaps beautiful, very mysterious, and surely fairly scary. These perceptions have changed to various degrees. Today Homo sapiens has emerged as the dominant species on the planet, as measured by its collective effects on Earth’s ecosystems. No single species in Earth’s history has caused more changes on the planet than what we are doing today. We need to understand and act on this reality. But why? Begin by allowing me to take you on a journey beyond Earth, through a bit of space and time, and you’ll soon see “why it matters.”

এখানে উল্লেখ্য, কিছু পরিবেশবিজ্ঞানী পরিবেশের ক্ষেত্রে আন্তঃশাস্ত্রীয় অ্যাপ্রোচ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। পরিবেশ আসলে সমস্যাকীর্ণ প্রকৃতি। আর এই সমস্যাগুলি ব্যাপকভাবে মানুষেরই তৈরি। বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানীরা সে-কারণে প্রকৃতির সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আংশিক ভূমিকা রাখতে বাধ্য। দুরখা সামাজিক নৃতত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে এই তাত্ত্বিক ধারা চলমান আছে। পশ্চিমা বিশ্বে নৃবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক জগৎকে তাদের গবেষণার বিষয় হিসেবে বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক অবস্থা, আদিম অথবা বন্য দশাকে বিবৃত করে এসেছেন। একথা আমরা সবাই জানি যে, তখন থেকেই প্রকৃতিকে শিল্প ও জীবনের বিকাশের জন্য ব্যাবহার করা হয়েছে। আদিম মানুষেরা প্রকৃতি ও সমাজজীবনকে আলাদা করে দেখতে অভ্যস্ত ছিল না। সুতরাং প্রকৃতি এক অর্থে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ। আমরা প্রাকৃতিক বস্তুকেই সামাজিক বিষয়ের অন্তর্গত ধরে নিয়েছি। দুরখার টোটেমবার মানুষের গোত্রীয় জীবনের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। কোনো সময় বিশেষ প্রস্তর, সমগ্র পাহাড়, নদী অথবা চাঁদ, অথবা সূর্যকে তারা পূর্বপুরুষ হিসেবে মেনে এসেছে। সুতরাং জীবনযাপনের লক্ষ্য ও নির্ধারক প্রকৃতির মধ্য থেকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় ও আচার-অনুষ্ঠানে প্রকৃতির এই প্রতীকী ব্যবহার সম্প্রদায়গত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্রমাগতভাবে সম্প্রদায়গত জীবনের আকার বড় হলেও সকল আস্থা ও শক্তির প্রতিভূ হিসেবে টোটেমকে মান্য করা হয়েছে।

পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও কলাকৌশলের অভূতপূর্ব উন্নতি এতোটাই সাধিত হলো যে, পরিবেশগত রূপান্তর প্রকারান্তরে পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করতে থাকে। এই পরিবেশগত সমস্যার উপলব্ধি খুব বেশিদিনের নয়। শিক্ষিত মানুষ, বিজ্ঞানী, সমাজসেবী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিবেশগত সমস্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে অবগত হতে থাকলো এবং তথ্যের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তা অবহিত করতে সমর্থ হলো। নোয়েল কাস্ট্রি সূচনাতে বলেছেন, ন্যাচার নামক তাঁর লেখা গ্রন্থটির পাঁচটি অধ্যায় আছে। সেগুলি একত্রে একটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রদান করে। অধ্যায় ১ ও ২ বর্ণনা করেছে কীভাবে ভূগোলবিদরা প্রকৃতিপাঠ করেন এবং প্রকারান্তরে কীভাবে তা ভূগোলের প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। অধ্যায় ৩ ব্যাখ্যা করেছে মানবিক ভূগোল পঠন-পাঠনে প্রকৃতি গত দশকে কীভাবে এসেছে। এ-ধরনের পাঠ তুলে ধরেছে যে ‘বি-প্রাকৃতিকীকরণ’ কীভাবে ঘটছে। লেখক বলেন যে, আসলে প্রকৃতির ধারণা সামাজিক নির্মাণ ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের দৈহিক পার্থক্য কি তাহলে একাধিক ভূগোলের আভাস দেয়? সে-ব্যাপারে জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনাও তিনি করেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে প্রকৃতি-উত্তর চিন্তা যা সমাজ-প্রকৃতি দ্বৈতবাদ নিয়ে আলোচনা করে। মোটকথা বইটিতে ভূগোলের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিকে সংজ্ঞায়িত ও বিশ্লেষণ করা হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান থেকে প্রকৃতিকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে আবার পুনর্সংযুক্ত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা একদিকে পুরনো ভুলগুলি পুনর্বার করতে থাকে; অপরদিকে পরিবেশকে যারা সমাজবিজ্ঞানের বিষয় নয় বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে তাদের মধ্যে সমঝোতা করা। বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাজের বিশ্লেষণ করতে পারে এবং বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের নিজেকে নিয়োজিতকরণ ও আলাদা থাকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

প্রকৃতির শেষ সময় এসে গেছে?

আমরা যখন সমসাময়িক সমাজ ও প্রকৃতির সম্পর্কের দিকে দৃষ্টিপাত করি তখন কিছু ভ্রান্তি চোখে পড়ে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রযুক্তি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা বাজারের জন্য সম্পদ সরবরাহ করে যা প্রতিবেশতাত্ত্বিক ব্যবস্থায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কেন ঘটছে না তার উত্তর এ থেকে পাওয়া যায় না। এখান থেকেই আমাদের প্রশ্ন জাগে, কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন করা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের কথা উঠলেই আমরা পরিবেশ আন্দোলন ও পরিবেশ রাজনীতির মধ্যে নৈতিক সংহতি প্রয়োজনের কথা বলি। গত তিরিশ বছর ধরে কেউ এ-ব্যাপারে আন্তরিকভাবে ভাবেনি। প্রতিবেশতাত্ত্বিক পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। গত ১২০ বছর ধরে প্রতিবেশকে বৈশ্বিক সমাজের বিষয় বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। গত ৩০ বছরে বৈশ্বিক প্রতিবেশতাত্ত্বিক সংকট গভীরতর হয়েছে, বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে এবং ক্ষতিকর গ্যাসের বৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবেশসংক্রান্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা উঠেছে। বিজ্ঞান ও রাজনীতির বিষয়ে আন্তঃসরকারি জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসি) ও জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশব্যবস্থা পরিষেবা সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিবিইএস) গঠিত হয়। মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান থেকে তেমন অংশগ্রহণকারীকে বিতর্কে দেখা যায়নি। অর্থনীতি অবশ্য একটি ব্যতিক্রম। অর্থনীতিবিদরা প্রকৃতি ও পরিবেশের উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে অবদান রেখে এসেছেন।

এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, ‘প্রকৃতির শেষ’ হয়ে এসেছে, প্রকৃতিকে না বাঁচালে আমরা বাঁচবো না। সুতরাং যে-কোনো মূল্যে প্রকৃতির অসুন্দরতাকে দূর করতে হবে। এসব কথা থেকে এটি অনুমান করা যায় যে, আমাদের আলোচনায় ও বিবেচনায় প্রকৃতি অতিশয় প্রাধান্য পাচ্ছে। আসলে বিশ্বজুড়ে সকল সমাজে প্রকৃতি একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিরাজমান ছিল এবং আছে। তবে যাকে আমরা প্রাকৃতিক বলে ভেবে এসেছি সে-ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। সত্য কখনো নিজের কথা বলে না। প্রকৃতি এমন কথার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃতি সম্পর্কীয় আমাদের ধারণা সদাশয় পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে আমাদের ধারণা ও প্রত্যক্ষণ।

প্রকৃতির বহুমুখী ধারণা দর্শনে, বিজ্ঞানে, ইতিহাসে, সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃত ধারণা ছাড়া প্রকৃতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা যে প্রকৃতিকে যথার্থ অর্থে বুঝতে সমর্থ হইনি তা আজকের প্রকৃতি-ভাবনা ও প্রকৃতি-সংশয় থেকে বোঝা যায়। ভূগোল একটি শাস্ত্র যা প্রকৃতির সামাজিক অভিধাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করেছে। পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি উনিশ শতকের শেষের দিকে ভূগোল প্রকৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের রসদ জোগাতে সাহায্য করে।

বর্তমান সংস্কৃতি আমাদের প্রকৃতির জন্য কী করছে তা অনুধাবন করা কঠিন। প্রকৃতির ওপর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতিকে ব্যবহার অথবা অপব্যবহার করছে এবং প্রকৃতিকে বিমূর্ত বিষয় হিসেবে দাঁড়া করাচ্ছে। নোয়েল কাস্ট্রির মেকিং সেন্স অব ন্যাচার এটা দেখানোর চেষ্টা করেছে যে, আমরা যাকে প্রকৃতি বলি তা আমাদের অনুধাবন করতে শেখায় যে, প্রকৃতি সমাজব্যবস্থা, সমাজ পরিবর্তন ও সামাজিক বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয়। নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক পাঠ, মানবীয় ভূগোল, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান পাঠের অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োগ করলে আমরা একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় অভিধা লাভ করি যে, আমাদের নিজের জন্য প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞান আরো পরিচছন্ন হচ্ছে এবং পৃথিবীর মানব ও অমানব প্রজাতির ভবিষ্যতের জন্য অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। প্রকৃতিকে প্রাকৃতিকতামুক্তভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে। এর অর্থ হলো, প্রকৃতিকে কীভাবে, কেন এবং কোন ধারণায় বোঝা দরকার। প্রকৃতি আমাদের বাইরের কিছু নয়। অন্তত দুটি কারণে আমরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা প্রতিবেশব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত এবং প্রতিবেশব্যবস্থাকে প্রভাবিত করি। আমরা হোমোসেপিয়েন্স হোমোনিডের একটি অংশ যারা কথা বলতে পারি। অন্যান্য প্রাইমেটের মধ্যে থেকে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ মাধ্যমে বর্তমান পর্যায়ে এসেছি বলে বিজ্ঞান দাবি করে। বিজ্ঞানীদের মতে, অতি সম্প্রতি আমাদের পূর্বপুরুষদের ঠিকানা পাওয়া গেছে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায়।

প্রকৃতির তিনটি প্রধান অর্থ আছে বলে নোয়েল কাস্ট্রি মনে করেন। প্রথমত, এটি ননহিউম্যান জগৎকে বোঝায়।

প্রকৃতির এই অংশটি মানুষের ছোঁয়া পায় না এবং মানুষের দ্বারা প্রভাবিতও হয় না (প্রাকৃতিক পরিবেশ বলা হয়ে থাকে)। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতি বলতে আমরা এমন ধারণা পাই যা সমগ্র ভৌত জগৎকে বোঝায়। এক্ষেত্রে জীব হিসেবে মানুষ ও বিবর্তনের ফলে প্রাপ্ত সব উৎপন্নকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তৃতীয়ত, প্রকৃতি নিজস্ব গুণ অথবা কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্যগত ধর্মেরও দিক নির্দেশ করে (যেমন, পাখিরা প্রকৃতিগতভাবেই উড়তে পারে, মাছেরা সাঁতার কাটে, মানুষ দু-পায়ে হাঁটে)। শেষত, প্রকৃতি বলতে একটি সক্ষমতা বা শাসক শক্তি বোঝায় যা কিছু অথবা সকল জীবন্ত বস্তুর ওপর ক্রিয়াশীল (যেমন, মাধ্যাকর্ষণ, সংরক্ষণ শক্তি, মানবীয় ডিএনএ কর্তৃক সংরক্ষণকৃত নির্দেশ)। সংক্ষেপে এদেরকে আমরা বলতে পারি বাহ্যিক প্রকৃতি, বিশ্বজনীন প্রকৃতি, অন্তঃস্থিত প্রকৃতি এবং উপরিস্থ প্রকৃতি। তবে সব অর্থেই প্রকৃতি মানববর্জিত। প্রকৃতি পরিস্থিতিভেদে বিশেষ্য, ক্রিয়া, ক্রিয়া-বিশেষণ, অথবা বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি অবজেক্ট বা সাবজেক্ট, প্যাসিভ বা অ্যাক্টিভ হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে। যেমন, আমরা বলে থাকি ‘nature reserve’, ‘natural beauty’, ‘naturally destructive hurricane’, ‘natural order’ being disrupted|

প্রকৃতি আমাদের প্রতিদিনের কথা, তর্ক-বিতর্ক, ও বাক্য তৈরির ক্ষেত্রে নানা অর্থ প্রকাশ করে। কাস্ট্রি অবশ্য প্রকৃতি প্রত্যয়টির জটিল দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। নিচের উক্তিগুলো প্রকৃতির পরিচিতি ও জটিলতা বুঝতে সহায়ক হবে।

1.  It’s complexity is concealed by the ease and regularity with which we put it to use in a wide variety of contexts. It is at once both very familiar and extremely elusive … an idea which most of us know, in some sense, to be so various and comprehensive in its usage as to defy our powers of definition. (Soper 1995 : 1)

2.  The word nature is perhaps the most complex in the [English] language. (Williams 1983 : 219)

3.  An immediate problem with the word “nature” is that it has multiple and overlapping meanings … Context can tell us a great deal about the shade of meaning intended. (Habgood 2002 : 1)

4.  We cannot fall into the trap that this word has laid for us. (Cronon 1996: 36)

5.  Nature is a word which nowadays must be compulsively draped in scare-quotes. (Eagleton 2000 : 83)

6.  The concept of nature has accumulated innumerable layers of meaning … Nature is material and it is spiritual, it is given and made, pure and undefiled; nature is order and it is disorder, sublime and secular, dominated and victorious; it is a totality and a series of parts, woman and object, organism and machine. (Smith 1984 : 1)

7.  The idea of nature contains, though often unnoticed, an extraordinary amount of human history. (Williams 1980 : 67)

8.  We part company with [other geographers] by acknowledging the possibility of identifying and studying “real” … processes. (Slaymaker and Spencer 1998 : 248)

9.         The naturalness of nature is, in one sense, inherently self-evident. (Adams 1996 : 82)

বি-প্রাকৃতিকীকরণ, বি-নির্মাণ ও বি-আবশ্যিকীকরণ (De-Naturalisation, De-Construction and De-Essentialisation) বলতে কি বোঝায়? প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ প্রকৃত অর্থে সার্বিকভাবে প্রাকৃতিক। বি-প্রাকৃতিকীকরণ এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ শব্দ। এটি দুটি অর্থ ব্যক্ত করে, প্রথমত, প্রকৃতিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। একটি অংশকে আমরা ‘প্রাকৃতিক’ বলে দাবি করি এবং যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। দ্বিতীয়ত, এটি কোনো বিশেষ প্রপঞ্চ হিসেবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে পারে না। যেমন, মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে জিন দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। বি-নির্মাণ একটি বিশেষায়িত শব্দ যা তত্ত্বায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেমন, উত্তর-কাঠামোবাদ। প্রকৃতি কী, এটি কীভাবে কাজ করে, এটি কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে – এমন ধারণা এই দ্বিতীয় অর্থের মধ্যে পড়ে। শেষত, বি-আবশ্যিকীকরণ তিনটির দ্বিতীয়টির অর্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ÔA de-essentialising argument is a specific form of de-naturalisation. It questions the idea that any given phenomenon has a fixed and ‘essential’ by virtue of its naturally given or determined properties. castree nature.Õ

রোলফ্ লিডসএকাগ মনে করেন, আজকের দিনে একটি আহত পৃথিবীর জরুরি মানবীয় অ্যাকশনের প্রয়োজনীয়তার দরকার। উৎপাদন ও ভোগের ধরনের কারণে আমরা সম্পদহীনতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বন-উজাড়করণ ও মরুকরণ প্রভৃতি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আগামী প্রজন্মের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশতাত্ত্বিক স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন দরকার। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক দুর্যোগের কথা উঠেছে। পরিবেশগত আন্দোলন ও আন্তঃসরকারি সংস্থা বিশ্বায়নের ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ বিশেষ অধিবেশন নেতিবাচক মূল্যায়ন দিয়েছে। সার্বিকভাবে কাজের অগ্রগতি তেমন আশাব্যঞ্জক নয় বলে বিভিন্ন মহল মত প্রকাশ করেছে। অ্যাকাডেমিক শাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের অপরাধ হলো, প্রকৃতি বা পরিবেশকে এটি যথেষ্ট অবহেলা করেছে। অথচ আমরা জানি যে, ১৭৪৮ সালে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী মঁতেস্কু, ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ টমাস বাকল্ ও ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার যথেষ্টভাবে পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রকৃতির সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। আঠারো শতক থেকে সমাজকে প্রকৃতি থেকে আলাদা ভাবার চেষ্টা হয়ে আসছে। স্কটিশ অভিজ্ঞতাবাদী অ্যাডাম ফারগিউসন, জন মিলার ও অ্যাডাম স্মিথ যুক্তি দেখান যে, সমাজের একটি স্বাধীন সত্তা রয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা পিতা দাবি করেন যে, সমাজ আংশিকভাবে স্বাধীন এবং এর একটা বিশেষ চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ক্রমান্বয়ে সমাজের ‘বি-প্রকৃতিকীকরণ’ শব্দটি প্রকট রূপ লাভ করে আর সমাজ তার নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান থাকে। ধ্রুপদী সমাজবিজ্ঞানের প্রারম্ভকালে একটি প্রেক্ষাপট পরিদৃষ্ট হয় যে, সামাজিক সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক থেকে আলাদা। মার্কস্, ওয়েবার ও এমিল দুরখা আধুনিক শিল্পায়নের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে (বাটেল, ১৯৮৬; গিডেন্স ১৯৯১; রেডক্লিফ্ট ও উডগেট ১৯৯৪)। তাঁরা সামাজিক জীবনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রকৃতিকে স্বীকার করলেও এই দুয়ের নির্ভরশীলতা সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আসেনি। প্রকৃতিকে নেতিবাচক অর্থে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নন-সোশ্যাল, সমাজ-বহির্ভূত এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়নি। সামাজিক ঘটনা ও প্রাকৃতিক ঘটনাকে বিভক্ত করার ফলে সমাজবিজ্ঞানে অ্যাকাডেমিক বিভাজন প্রকটভাবে ধরা পড়ে। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে পরিবেশ মূল্যায়নের সুষ্ঠুু পন্থা না থাকার কারণটি তাই বোধগম্য। তবে সত্তর দশক থেকে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে এবং পরিবেশ-সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী টিমোটি লিউকের Capitalism, Democracy and Ecology (১৯৯৯) গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়। যেখানে লেখক বলেছেন, গণতন্ত্র আরো জনপ্রিয় ভিত্তির ওপর স্থাপিত হওয়া দরকার। প্রলেতারিয়েত অথবা মিলিট্যান্ট দেশপ্রেমিকদের দিয়ে তা সম্ভব নয়, বরং ‘প্রতিবেশতাত্ত্বিক সুবিচার’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত শক্তিশালী পুঁজিবাদবিরোধী শক্তির উত্থান দরকার। প্রতিবেশতাত্ত্বিকভাবে স্থাপিত জনপ্রিয়তার সে-শক্তি আছে, যা দিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে বিকেন্দ্রীভূত ও সমতাভিত্তিক করা যায়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ক্লোস এডার The Soial Construction of Nature – A Sociology of Ecological Enlightenment (১৯৯৬) শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, পরিবেশবাদের জন্য মানবসমাজের উদ্বর্তন প্রধান নয়; কিন্তু আধুনিক সমাজের সামাজিক শৃঙ্খলার সাংস্কৃতিক ভিত্তি জরুরি। প্রতিবেশতাত্ত্বিক রাজনীতি হিসেবে পরিবেশবাদের রূপান্তর আধুনিকতার কেন্দ্রীয় মেকানিজম, যা মানুষ আয়ত্ত করেছে। এই রূপান্তরের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নীতি যথেষ্ট সাংস্কৃতিক ভিত্তি পাওয়া যায়, যা শিল্পবাদকে প্রতিবেশতত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়। সমাজবিজ্ঞানে সে-কারণে পরিবেশবাদ ও প্রতিবেশতাত্ত্বিক রাজনীতির সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০-এর দশক থেকে কিছু সমাজবিজ্ঞানী দাবি করে আসছেন যে, প্রতিবেশতাত্ত্বিক উৎকণ্ঠা মোকাবিলার জন্য পরিবেশবাদকে সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে যথেষ্ট আলোচনার প্রয়োজন আছে। বরং সামাজিক বিজ্ঞানীদের উচিত অ-সামাজিক (যেমন, জীবতাত্ত্বিক ও প্রতিবেশতাত্ত্বিক) চলকসমূহ তাদের বিশ্লেষণে সংযুক্ত করা। তাঁদের মতে, সামাজিক বিজ্ঞান বস্তুত সমাজে ‘পুনর্প্রকৃতিকীকরণ’ করা উচিত যাতে সমাজজীবনের প্রতিবেশতাত্ত্বিক মূল্যায়ন সমাজ বিশ্লেষণে আসে। সমাজের পুনর্প্রকৃতিকীকরণ সমস্যার কিছু নয়। প্রকৃতি গত কয়েক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে তার মূল প্রত্যয়গত অভিধা ও মর্যাদা হারিয়েছে। প্রকৃতির প্রকৃতি নিয়ে দুটি দল হয়েছে – বাস্তববাদী ও নির্মাণবাদী। সমজবিজ্ঞান শাস্ত্র হিসেবে পরিবেশ সমস্যাকে কীভাবে দেখছে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।

দুই প্রকৃতি

স্টেমেকার ও স্পেন্সার, উভয়ে জিওমারফোলোজিস্ট, অস্বীকার করেন না যে, যাকে আমরা প্রকৃতি বলি তা একটা পর্যায়ে ‘অপ্রাকৃতিক’। তবুও তাঁরা মনে করেন যে, এমন উপায় আছে যখন প্রকৃতিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বোঝা সম্ভব। অন্যভাবে বলা যায়, প্রকৃতিকে সামাজিক প্রতিনিধিত্বের পর্যায়ে সংকোচন করা সম্ভব নয়। একইভাবে অ্যাডামস্ (১৯৯৬) মনে করেন যে, প্রকৃতি এবং এর যে-কোনো অংশই প্রাকৃতিক হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। মানুষ প্রকৃতি রক্ষার যে-কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে যদি তা নির্ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এঁরা তিনজনেই প্রকৃতির সামাজিক নির্মাণের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ। প্রথমত, যে-কোনো নন-হিউম্যান জগৎ আমাদের ইচ্ছার বাইরে অস্তিত্বমান থাকতে পারে। যেমন, মহাদেশীয় প্লেট বা মাউন্ট এভারেস্ট। প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যে সবসময় ভুল হবে এমন নয়, যদি তা নির্ভুল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। তৃতীয়ত, মার্কসীয় ভূগোলবিদরা সঠিক যে, মানুষ প্রকৃতির কোনো অংশকে ভৌতভাবে পরিবর্তন করতে পারে। তবে সামাজিকভাবে হলেও এমন পরিবর্তিত প্রকৃতিকে প্রকৃতিই বলতে হবে।  শেষত, আমরা ‘সামাজিক নির্মাণকে’ সামগ্রিকভাবে মেনে নিতে পারি না। অ্যাসিড বৃষ্টি বা ওজোন লেয়ারের ক্ষয়ের পেছনে মানুষের ক্রিয়াকর্ম কিছুটা দায়ী কিন্তু এগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবেশগত সমস্যা, যা আমাদের অযাচিত কর্মফল। এসব সমস্যার নিজস্ব জীবনপ্রণালি আছে। এসব পরিবর্তনকে বেক ‘সামাজিক নির্মাণ’ না বলে ‘মানুফ্যাক্চার্ড রিস্ক’ বলেছেন। অনেক ভূগোলবিদের মতে, বেকের প্রত্যয়টি মানবীয় ইচ্ছার ও নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু অনেক পরিবর্তন মানুষ করে যেগুলিকে সামাজিক নির্মাণ না বলে উপায় নেই। এই চারটি কারণে ভৌত ভূগোলবিদ ও পরিবেশ ভূগোলবিদরা ‘প্রকৃতি-সমর্থক’, সামাজিক নির্মাণবাদী পক্ষের চেয়ে। তাঁরা মনে করেন, (১) নন-হিউম্যান জগৎ নিজ গুণেই আমাদের কর্মকাণ্ডের থেকে স্বাধীন; (২) নীতিগত ও অনুশীলনের প্রশ্নে বিষয়টি যথার্থ বলে মেনে নেওয়া দরকার। এ বিষয়টি আরো আলোচনার দাবি রাখে যে, ভৌত ভূগোলবিদরা কেন নন-হিউম্যান জগৎকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বোঝা সম্ভব মনে করেন। ধরা যাক, এঁরা সত্যই বাস্তববাদী অর্থাৎ প্রথমত তাঁরা অনটোলজিক্যাল রিয়ালিজমে বিশ্বাসী, দ্বিতীয়ত জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বাস্তববাদী। এই গুণ ভৌত ভূগোলের বিজ্ঞান দাবির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতি নয় বরং বস্তুজগৎ নিয়ে ব্যস্ত বিধায় স্টেমেকার ও স্পেন্সারের মতো সামাজিক নির্মাণবাদী হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। স্বাভাবিক কারণে ভৌত ভূগোলবিদের প্রকৃতিবাদ বর্তমান মানবিক ভূগোলের বি-প্রাকৃতিকীকরণের চেয়ে আলাদা। অবশ্য ক্যাস্ট্রি মনে করেন, প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও সামাজিক নির্মাণবাদের মধ্যে পড়ে। ভৌত ভূগোলবিদরা জীবভৌত জগতের নির্ভুল জ্ঞান অন্বেষণ করেন না বলেই সামাজিক নির্মাণবাদকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে শেষ বিচারে কাস্ট্রি মনে করেন, নির্মাণবাদী ও বাস্তববাদীদের সহ-অবস্থান ভূগোলে রয়েছে। যখন উত্তর-আধুনিকতাবাদ বা উত্তর-কাঠামোবাদের আলোকে পরিবেশগত সমস্যাকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে তখন অযথা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এমনো বলা হয়েছে যে, উত্তর-কাঠামোবাদ পরিবেশ সংক্রান্ত আমাদের অনেক ধারণা ও ভবিষ্যদ্বাণীকে ঐতিহাসিক বিচারে বিপদাপন্ন করে। পরিবেশ ইতিহাসবিদরা মনে করেন, পরিবেশের অন্তর্নিহিত শক্তি কাঠামোবাদী ধারণাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। বাস্তবতাকে পাঠ্যের অনুগামী করার অর্থ হলো বাস্তবতাকে সংকীর্ণ করা এবং মনে রাখা দরকার যে, শব্দচয়িত বাস্তবতা প্রকৃত বাস্তবতার চেয়ে সত্য নয়।

এখন দেখা যাক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সামাজিক নির্মাণ বলতে কী  বোঝায়। আসলে এক্ষেত্রে ভৌত ভূগোলবিদদের কর্মপদ্ধতির আলোচনা প্রয়োজন। ভৌত ভূগোলবিদরা তাঁদের পদ্ধতিগত ব্যাপারে খুব একটা স্পষ্ট নন। ভৌত ভূগোল কী ধরনের বিজ্ঞান সেটি না বলে ভূগোলবিদরা অনেকটা ধরেই নেন যে, তাঁদের কাজ বৈজ্ঞানিক। দুটি কারণে এটি ভ্রমাত্মক। গত দু-দশক ধরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমাজতত্ত্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড বিচার করে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, তাদের কাজই রূপকথা বা শিশুদের ছড়ার শামিল। স্বাস্থ্যবিষয়ক বেশ কিছু দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের সুপারিশ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর যাঁরা নিজেদের কাজকে নির্ভেজাল সঠিক মনে করেন তাঁদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। হয়তো বিজ্ঞানীরা এসব বিতর্ক নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। সাম্প্রতিক মানবীয় ভূগোলের বি-প্রাকৃতিকীকরণে বাঁক নেওয়ায় ভৌত ভূগোলবিদরা একে অবহেলার চোখে দেখেছেন। তাছাড়া, একটি আলাদা শাস্ত্রে নিমগ্ন থাকার ফলে জীবভৌত বাস্তবতার তৈরি নির্মাণবাদী জ্ঞানের প্রতি তাঁদের বাধিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

প্রকৃতি ও পরিচর্যা

দুটি এক জাতীয় যমজ শিশুকে জন্মলগ্ন থেকে যদি আলাদা রাখা হয় তবুও তাদের আচরণের ও মনস্তাত্ত্বিক প্রলক্ষণের যথেষ্ট মিল দেখা যায়। আবার দুটি শিশু যদি একসঙ্গে থাকে তবুও যথেষ্ট মিল দেখা যায়। পরিবেশগত প্রভাব এখানে কোনো সিস্টেমেটিক পরিবর্তন আনে না। সংস্কৃতির প্রভাবও দৈবিক, সিস্টেমেটিক নয়। সুতরাং প্রকৃতি ও পরিচর্যার বিতর্ক ধোপে টেকে না। একজন মানুষ কতটা প্রকৃতির সন্তান বা কতটুকু পরিচর্যার ফল এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়ে থাকে The nature versus nurture debate involves whether human behavior is determined by the environment, either prenatal or during a person’s life, or by a person’s genes. The alliterative expression “nature and nurture” in English has been in use since at least the Elizabethan period and goes back to medieval French|

এই বিতর্কে প্রকৃতি বলতে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ বোঝায় (নেটিভিজম) আর পরিচর্যা বলতে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা বোঝায় (ইমপিরিসিজম বা বিহ্যাবিওরিজম)। ন্যাচার হলো আমাদের জিন। জিন আমাদের শারীরিক ও ব্যক্তিত্বের প্রলক্ষণ বোঝায়, যদিও আমরা যে-কোনো জায়গায় জন্মগ্রহণ ও প্রতিপালিত হই না কেন। পক্ষান্তরে নারচার বলতে আমাদের বড় হওয়া ও শৈশব বোঝায় যা পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

তবে, প্রকৃতি ও পরিচর্যার সম্পূরক অবদান অনেক প্রাচীন। প্রকৃতির ধারণা জেনেটিক বংশগতি ও জীবতাত্ত্বিক ফ্যাক্টরকে তুলে ধরে। কিন্তু পরিচর্যা শুধু বাহ্যিক বিষয়সমূহের ইংগিত দেয়। যেমন, এক মানুষের অভিজ্ঞতা, শিক্ষণ, উপলব্ধি কীভাবে হয়। ১৬৯০ সালে জন লক বলেন, মানুষ জন্মগ্রহণের পর একটা পরিষ্কার মন নিয়ে আবির্ভূত হয়। সেখানে কিছুই লেখা থাকে না বলে একে ‘টাবুলা রাসা’ বা সাদা সেøটের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সুতরাং বংশগতির প্রভাব সাদা সেøট একেবারে অস্বীকার করছে। এই সাদা সেøইটিজম ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রলক্ষণ নিয়ে দুটি দলের সৃষ্টি হয়। আর এটা স্বাভাবিক যে, ১৬৯০ সালে লকের সময় বা বিশ শতকের প্রথমার্ধে মানব জেনেটিক্স অতটা অগ্রসর হয়নি ফলে একটা দীর্ঘ সময় প্রকৃতি ও পরিচর্য়ার বিতর্ক চলতে থাকে। একুশ শতকে এসে বিতর্কটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রতিবেশতত্ত্ব ও আচরণগত জেনেটিক্স বিষয়ক গবেষকরা একমত হয়েছেন যে, প্রকৃতির ওপর পরিচর্যার একটা আবশ্যিক প্রভাব রয়েছে। জন লক তাঁর অহ An Essay Concerning Human Understanding গ্রন্থে টাবুলা রাসার উল্লেখ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সরাসরি অস্বীকার এবং মনোবিজ্ঞানের একতরফা আধিপত্য মেনে নেওয়ার শামিল বলে মনে করেন। বিশ শতকে পরিবেশ নিয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পায় বিশেষত চার্লস্ ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব এজন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। ফ্রানজ্ বোয়াসের The Mind of Primitive Man (১৯১১) অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে পরবর্তী কিছু সময়। তিনি বলেন, জনসংখ্যা, জীববিজ্ঞান, ভাষা ও বস্তুগত ও প্রতীকী সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়। এরপর জন বি ওয়াটসন সংস্কৃতির ব্যাপক আধিপত্যের কথা বলেন। মানুষের জীবতাত্ত্বিক গুণাবলি সংস্কৃতির কাছে কিছুই নয়। মানুষ মানুষই কারণ তাঁর কোনো সহজাত প্রবৃত্তি নেই। সে যা তার সবকিছুই আয়ত্ত করা, শেখা ও সংস্কৃতিজাত। ১৯৫১ সালে ক্যালভিন হাল বলেন, প্রকৃতি-পরিচর্যা বিতর্কটি নিরর্থক। African Genesis (১৯৬১) ও The Territorial Imperative (১৯৬৬) গ্রন্থদ্বয়ে রবার্ট আরড্রে মানুষের অন্তর্গত গুণাবলি সম্পর্কে আবার সোচ্চার হয়েছেন, বিশেষ করে আবাসস্থলের ব্যাপারে। ডেসমন্ড মোরিস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Naked Ape (১৯৬৭)-এ একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেন। On Human Nature (১৯৭৯) গ্রন্থে ই. ও. উইলসন ‘সাদা সেøটের’ বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আচরণগত প্রলক্ষণের দাবিদারদের বাদ দিয়ে যমজ শিশু গবেষণা শুরু হয়। একটি বিশেষ জনসংখ্যায় বিশেষ প্রলক্ষণের ভিত্তিতে পরিবেশ ও জেনেটিক তারতম্য দেখার জন্য এরূপ গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যমজ গবেষণা প্রমাণ করে যে, তাৎপর্র্যপূর্ণ বংশগতীয় উপাদান রয়েছে। ডোনাল্ড ব্রাউন ১৯৮০-এর দশকে অনেক সংখ্যক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিশ্বজনীন রূপ আবিষ্কার করা। তিনি প্রায় ১৫০টি ফিচার লাভ করেন এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, বাস্তবিকভাবে  ‘বিশ্বজনীন মানবীয় আচরণ’ আছে।

১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে বিতর্কটি অদর্শগত রূপ লাভ করে। Not in Our Genes : Biology, Ideology and Human Nature (১৯৮৪) শীর্ষক গ্রন্থে রিচার্ড লিওনটিন, স্টিভেন রোজ ও লিওন কামিন মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদের’ সমালোচনা করে বলেন যে, ‘বিজ্ঞান মূলত বুর্জোয়া মতাদর্শের সিদ্ধতা দিতে চায়। ব্যাপারটি এমন দাঁড়ায় যে, বিতর্কটি হেরিটেবল্ প্রলক্ষণ থেকে রাজনৈতিক বা নৈতিক দিকে মোড় নেয়। ১৯৯০-এর দশকে উত্তরাধিকার বিষয়ক গবেষণা অনেক সহজ হয়ে আসে। সোজা কথায় এই দশকের শেষ সময়ে সাদা সেøটের বিরুদ্ধে ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায়। বিশ শতকের সমস্ত তথ্য স্টিভেন পিনকারের The Blank Slate : The Modern Denial of Human Nature (২০০২) গ্রন্থে সংক্ষেপিত করা হয়।

স্থায়িত্বশীলতার প্রবক্তারা নিজেদের ও অপরের পরিবর্তন চায়, সুতরাং পরিবেশ পাঠ আচরণের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ। প্রকৃতি কতটা ও পরিচর্যা কতটা – এমন প্রশ্ন বিজ্ঞানে উন্নয়ন সংক্রান্ত জনপ্রিয় বিতর্কের একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠতেই পারে। বিষয়টি প্রকৃতি-পরিচর্যা বিতর্কের জন্য একটি সমালোচনামূলক ভিত্তি প্রদান করতে পারে। চারটি স্তরে আমরা এ-আলোচনার সূত্রপাত করতে পারি। প্রকৃতি সম্পর্কীয় ধারণা সমাজচিন্তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত। প্রকৃতির পরিবর্তনশীল অর্থ ও সহ-অবস্থানকারী অর্থসমূহ দেখায় যে, সামাজিক শৃঙ্খলা যেভাবে রক্ষিত বা উন্নীত হচ্ছে তার ইতিহাসকে জানা দরকার, অবিকৃত স্থান বা আবেগময়তার রোমান্টিক আদর্শ (যেমন মানুষ প্রকৃতি থেকে আলাদা) পুঁজিবাদ ও শিল্পায়নের বিকাশের এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। শিল্পায়ন নিঃসন্দেহে মানুষ ও প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, যা জনগণ ও প্রকৃতির আন্তঃনির্ভরশীলতা তৈরি করে। শোষণের ওপর থেকে সনাতন বাধা দূরীভূত করার জন্য ব্যক্তিক স্বাধীনতার প্রাকৃতিক নীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবারিত ধারা বজায় রাখার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের শ্রম নিংড়ানোর ইতিহাসকে দলিত করার জন্য প্রকৃতির বিমূর্ত সংজ্ঞার প্রয়োজন হয়। সমাজচিন্তার অতীত ও বর্তমানে প্রকৃতির ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। প্রকৃতির পরিবর্তনশীল অর্থ সামাজিক শৃঙ্খলাকে রক্ষা ও উন্নীত করে এসেছে। প্রকৃতির রোমান্টিক ধারণা (যেমন, অবিনষ্ট স্থান অথবা মানুষের থেকে প্রকৃতি সম্পূর্ণ পৃথক) প্রাথমিক পুঁজিবাদের সময় শিল্পায়নের প্রতিক্রিয়া রূপে উত্থিত হয়। পুঁজিবাদ এসময় দ্রুত শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণে লিপ্ত হয়, যা জনগণ ও প্রকৃতির অভূতপূর্ব আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রকাশ ঘটায়। প্রকৃতির সনাতন আত্মরক্ষার নিয়ম দূরীভূত হয়।

প্রকৃতির অর্থনৈতিক ব্যবহার অবারিত হয়। ফলে মানবীয় শ্রমের ইতিহাস প্রকৃতির বিমূর্ত ধারণাকে তিরোহিত করে। নিচের ছকটি দ্রষ্টব্য।

General Historical Trends in Ideas of Nature

From                                         Towards

  1. Multipal of nature process,        1. Organized around a single principal

Attributes, sperits                         (unitary single nature)

  • Specific (nature = essential         2. Abstract (nature the whole material

Quality of something)                    material world) personified (nature =

  • Fixed place                           inherent process)     

                                           3. Changing place increased intervention.

সংস্কৃতিকে প্রকৃতির বিপরীতার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নানাভাবে যা ক্রিটিক্যল মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে। সে সঙ্গে বিমূর্ত ও অনন্য ভাবার প্রবণতা তো আছেই। কোনো কোনো সময় মানবসমাজের পরিবর্তন ও হস্তক্ষেপের বিরোধী হিসেবেও প্রকৃতিকে দাঁড় করানো হয়েছে। অন্য সময় সংস্কৃতিকে এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেন প্রকৃতি থেকে মানবসমাজকে দূরে রাখার জন্য এটি বাধার সৃষ্টি করে। এ-ধরনের বিরোধপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা যায়। এই বিতর্কের পেছনে দু-ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। একদিকের প্রশ্নগুলি নতুন পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়ন সম্পর্কীয়, যা মানব আচরণের অজানিত বিষয় জানতে চায়। অজানিত বিষয়ের মধ্যে পড়ে বুদ্ধি, আবেগ ও নিয়ম সংক্রান্ত মানব অভিজ্ঞতা। অন্যদিকের প্রশ্ন হলো, সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ কতটা এ সম্পর্কীয় সমস্যা উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। এ-ব্যাপারে জেনেটিকস্, বায়োটেকনোলজি ও নিউরোসায়েন্স বিশেষ তথ্য দিতে পারে। জেনেটিক সায়েন্স ও নিউরোসায়েন্স নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে থাকে, যা মানব আচরণের আন্তঃশাস্ত্রীয় মূল্যায়নের ওপর জোর দেয়।

প্রকৃতির সামাজিক নির্মাণ

আমরা কীভাবে প্রকৃতির ‘নির্মাণ’ বুঝবো? যখন বিশ্বজুড়ে প্রকৃতি তার শক্তিশালী ‘প্রাকৃতিকতা’ জাহির করছে যা মানবীয় কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রকৃতির প্রাকৃতিকতা গ্রহণ করার বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। বন্যজীবনভিত্তিক পার্ককে প্রাকৃতিক বলা হলে প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এর স্রষ্টা? অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদিবাসী ও তাদের সমাজ-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয় যাতে একটি সংরক্ষিত এলাকায় তাদের প্রাকৃতিকতা বজায় থাকে। অনেক সময় প্রকৃতির গুণাগুণ ধরে রাখার জন্য প্রতিবেশতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন উপায় গ্রহণ করা হয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। কারণ মানবসমাজ প্রকৃতির প্রতিবেশতাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন অথবা উন্নতি করতে পারে। তবে বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ‘প্রাকৃতিক’ আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারটি এতো সহজ নয়। ইউরোপীয়রা ঔপনিবেশিক আবাস স্থাপনের আগে সমস্ত উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের উৎখাত করেছিল এই ভেবে যে, তারা সভ্য নয় এবং বসতি স্থাপনকারীদের চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক। ৪০ বছর আগে পণ্ডিতগণ উদ্ভাবন করেন, প্রকৃতি ‘সামাজিক নির্মাণ’। পরিবেশবাদ ও অবিচারকে ঢাকার জন্য এটি একটি চালাকি বই কিছু না। ÔThe phrase social construction refers to how different social groups create and fabricate the worlds they inhabit, experience and represent. মূলত প্রকৃতির সামাজিক নির্মাণ বলতে বিশ্বকে ভৌত ও কাল্পনিকভাবে তৈরি করা বোঝায়, শহরের infrastructure ও পার্কের গঠন হোক বা শিশুদের গ্রন্থে প্রকৃতির বর্ণনা তুলে ধরা হোক। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় এই অভিগমটি বেশ প্রভাব ও গতি পেয়েছিল। তার প্রভাব এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ও গবেষণায় রয়ে গেছে। এই ধারায় দোষ-গুণ সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা হবে।

১৯৮৪ সালে নিল স্মিথ এমন ধারণার প্রকাশ ঘটান যখন প্রকৃতিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত করা হয় এবং মনে করা হয়, বস্তুগত ভূবিন্যাস নিজেকে উপস্থাপন করে প্রকৃতির নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। স্মিথ তখন যুক্তি দেখান যে, আমরা যে-কোনো ভূমি, কৃষির মাঠ, পার্ককে বিশ্লেষণ করতে পারি তার গড়ে ওঠার বিবিধ কারণের মধ্য দিয়ে। স্মিথ ও অন্যরা শ্রমের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন, যা শারীরিক ও মানসিক। ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাপক অঞ্চলকে জনগণের শ্রম প্রয়োগে কৃষিযোগ্য করা হয়েছে, যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এটিকে শুধু কৃষি উৎপাদনের সাফল্য বলা যাবে না। কারণ, এটি অর্থের বিনিয়োগ এবং প্রকৃতির নির্মাণ, যা লাভজনক ফল দিয়েছে।

এখানে গভীর অর্থে পুঁজির ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লাভালাভের এমন অনেক বিষয় আছে যার পেছনে অর্থের সম্বন্ধ রয়েছে। জীবদেহ, পরিসম্পদ, অবকাঠামো, ও পণ্য তৈরির পেছনে পুঁজির সংকুলান দেখা যায়। যেমন, বিটুমিন উত্তর আলবার্টায় উত্তোলিত হয় এবং নানাবিধ উপায়ে বিশ্ববাজারে বিক্রি হয়। এর ব্যবহারের একটা খারাপ দিক হলো, কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন যা বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়াচ্ছে। এতে প্রকৃতির যে ক্ষতি হচ্ছে তাকে প্রকৃতির সামাজিক নির্মাণ ছাড়া কিই বা বলা যায়। এলিজাবেথ বার্ড বলেন, প্রথমে দেখা যাক পরিবেশ সমস্যা কীভাবে এলো এবং আমরা কীভাবে এই সমস্যার বিস্তার প্রতিরোধ করতে পারি। আমরা বরং দেখতে চাই পরিবেশ ইতিহাসবিদগণ বিজ্ঞানকে কীভাবে দেখছেন। পরিবেশ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সবসময় গ্রাহ্য করা হয় না। সামাজিকভাবে নির্র্মিত ন্যাচারাল-টেকনিক্যাল বিষয়বস্তু অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বশীল। ঐতিহাসিক সত্যাসত্য যাচাই করার আগে আমাদের দেখা উচিত ইতিহাসবিদরা কীভাবে সমাজ-প্রকৃতির আন্তঃক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের নির্মাণের ব্যপারে সামাজিক বিশ্লেষণ কী বলে? কারণ অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি পরিবেশের সমস্যা তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রকৃতি এমন একটি বিষয়বস্তু যার বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান লাভ সম্ভব। কিন্তু ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞানের মতো শাস্ত্রসমূহ দাবি করে যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান গত ২৫ বছর ধরে প্রকৃতি সম্পর্কে যা বলে এসেছে তা আপেক্ষিক, সবটা সত্য নয়। টমাস কুনের The Structure of Scientific Revolutions প্রকাশিত হওয়ার পর বিজ্ঞানের পক্ষে প্রকৃত সত্য দাবি করা বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। খুব বেশি হলে তাঁরা প্রকৃতি সম্পর্কে আপেক্ষিক সত্য দাবি করতে পারে। কুনের মতে, প্রকৃতিকে আংশিকভাবে জানা যেতে পারে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিশেষ সময়ে। বিজ্ঞানীরা যদিও তাঁদের প্রকৃতি সম্পর্কীয় সত্যের আপেক্ষিতা ইদানীং স্বীকার করেন, তবুও তাঁদের কাজের বৈজ্ঞানিকতার দাবি ছাড়েননি। অপরদিকে, সাম্প্রতিক সামাজিক নির্মাণবাদীরা বিজ্ঞানীদের এমন দাবি সম্পর্কে বলেন যে, এগুলি আমাদের আওতায় পড়ে না। তাঁরা বলেন যে, প্রকৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করা অসম্ভব। কারণ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিজেই সামাজিক নির্মাণের ফসল। বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম সামাজিক-ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত, প্রকৃতি প্রদত্ত নয়। বরং সামাজিক অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোপ্রসূত। দ্বিতীয়ত, অনেক লেখক দেখিয়েছেন যে, সত্যিকারের অনুসন্ধানের বিষয় কী। তৃতীয়ত, প্রশ্নের উত্থাপন ও সংজ্ঞায়ন কীভাবে হতে পারে। চতুর্থত, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মিথিক কাঠামো সামাজিক নির্মাণ বটে। পঞ্চমত, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সকল দিক এবং অনুশীলন সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থ, সাংস্কৃতিক চিন্তা, ব্যক্তিগত আন্তঃক্রিয়ার প্রকাশ। ষষ্ঠত, বিশ্বে নামকরণের জন্য পেশাগত বৈধতার প্রয়োগ। সপ্তমত, সামাজিকভাবে উৎপাদিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে প্রকৃতির  বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে কীভাবে মিলিত করা যায়, যখন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে সামাজিক নির্মাণ হয়, তবে কি সব ধরনের বিষয়কে সমতুল্য ভাবা সম্ভব? অথবা একটিকে আরেকটির চেয়ে সঠিক ভাবার ফুসরত থাকে কি? আমাদের অস্তিত্বের বাইরের কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব না করলে আমরা তাকে বিজ্ঞান বলবো কীভাবে? এটা পরম বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বিজ্ঞানের সমাজবিজ্ঞানী এমনকি কট্টর সামাজিক নির্মাণবাদীদের মধ্যেও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পর্কে তেমন উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যায় না। প্রকৃতিকে বিশ্লেষণকারী প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের পূর্বানুমান সম্পর্কে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের অনুসন্ধান করা দরকার যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, যা সামাজিকভাবে নির্মিত, আসলে প্রকৃতিবিষয়ক কি না। পরিবেশগত সমস্যার অস্তিত্ব আসলে আমাদের পূর্বানুমানের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ দিয়েছে আর তা হলো, বিজ্ঞান যা জানে তাই প্রকৃতি। তাই যদি হয় তবে প্রকৃতির অবনয়নের ব্যাপারে বিজ্ঞানকে দায়ী করার মানে কি?

পরিবেশের ইতিহাস জানতে হলে বিজ্ঞান কীভাবে পরিবেশ অধ্যয়ন করেছে সেটি জানা দরকার। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত ও পথ লক্ষ করা যায়। পদার্থবিদ ও প্রতিবেশতত্ত্ব দারুণ বিরোধিতায় আক্রান্ত। আবার প্রতিবেশতত্ত্ববিদ ও পরিবেশবাদীদের মতে, পৃথিবীর প্রতিবেশতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীর সামাজিক কর্মকাণ্ড ‘প্রকৃতির’ অনেক পরিবর্তন সাধিত করেছে। দার্শনিক বিতণ্ডা সত্ত্বেও অধিকাংশ পদার্থবিদ ও প্রতিবেশতত্ত্ববিদ তাঁদের গবেষণা ও তার ফলাফলকে বৈজ্ঞানিক মনে করেন, কারণ প্রকৃতির অস্তিত্ব বাহ্যিক ব্যাপার। এছাড়া, অনেক বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ববিদ ও মার্কসীয় তত্ত্ব মনে করে যে, শুধু প্রকৃতির মতো বাহ্যিক কেন মানুষের অন্তরস্থিত বিষয় নিয়েও গবেষণা করা যেতে পারে। মার্কসের শ্রম পক্রিয়া বলতে মানব প্রকৃতি ও বাহ্যিক প্রকৃতি উভয়ের পারস্পরিক গঠনমূলক দ্বন্দ্ব কাজ করে। দ্বান্দ্বিক আন্তঃক্রিয়া ছাড়া সমাজ বা উৎপাদন পদ্ধতি ও ঐতিহাসিকভাবে অভ্যুদয়প্রাপ্ত প্রকৃতি জানা সম্ভব নয়। প্রকৃতি একরকম থাকেনি এবং পৃথিবীর কোনো কিছুই একতরফাভাবে জানা যায় না।

প্রকৃতির ওপর প্রভাব আছে বলেই তার পরিবর্তন হচ্ছে।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ডকে তত্ত্বায়নের জন্য বিজ্ঞানকে একটি শ্রম প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা দরকার, যাকে পুঁজিবাদের আওতাধীন যে-কোনো উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে আলাদা করা যায় না। বিজ্ঞানের শ্রম প্রক্রিয়াকে বুঝতে হলে কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখা দরকার২৭ :  (১) উদ্দেশ্যমুখী মানবীয় কর্মকাণ্ড; (২) বিষয় বা রসদসামগ্রী যার ওপর শ্রম কাজ করে; এবং (৩) উৎপাদনের উপায় বা কলাকৌশল যার মাধ্যমে শ্রম নিয়োজিত হয়। সুতরাং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান একটি সামাজিক উৎপাদন। আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ববিদগণ বলেন, আদৌ কি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিষয়বস্তুর ওপর এর কোনো কর্তৃত্ব আছে?

আসলে একক বাস্তবতা বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো বহুবিধ বাস্তবতা; যে গবেষণা করে তার পেশার ওপর নির্ভর করে বাস্তবতার রূপ কী হবে। সামাজিক নির্মাণবাদীরা অর্থ, অর্থকরণ, তত্ত্ব, প্যারাডাইম, গণসংখ্যা প্রভৃতি ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ক্ষমতা ও উপায় জানতে চান। বিজ্ঞানীরা সাধারণ্যে তাঁদের সাফল্য আলোচনা করে থাকেন। তাই বিজ্ঞানীরা যখন বাস্তবতাকে আত্মস্থ করেন, সে-সময় তার তাত্ত্বিক নির্মাণকেও তা করেন। সুতরাং বাস্তবতা ও তার অর্থকরণ শুধু সামাজিক নির্মাণ থাকে না। বিজ্ঞানীদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রকৃতি বস্তুগতভাবে নতুন কিছু সৃষ্টি করে, যা তাত্ত্বিক কল্পনাকে বাধা দেয় অথবা অভিযোজনের সহায়ক হয়। যেমন, প্ল্যান্ট ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃতি নতুন বাস্তবতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

প্রাকৃতিক ইতিহাস এর অনুধ্যানমূলক (পরীক্ষণমূলক নয়) অ্যাপ্রোচে শক্তিশালীভাবে তাত্ত্বিক প্রত্যাশা পূরণে ভূমিকা রাখে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ‘বিজ্ঞান’ অন্য সামাজিক উৎপাদনমূলক কাজের চেয়ে কোনো অংশে পৃথক নয়। পরিবেশবাদী ইতিহাসবিদদের বিজ্ঞানকে যে-কোনো সামাজিক উৎপাদনের সমার্থক বিবেচনা করা উচিত। আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যদি সঠিকভাবে প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করতে না পারে, তবে তাকে সমন্বিত ও ভবিষ্য বলা ঠিক হবে না। বিজ্ঞান ল্যাবরেটরির বাইরে তার সঠিকতা বজায় রাখতে পারে না। যেমন, সবুজ বিপ্লবের বৈজ্ঞানিক সূত্র যতই শুদ্ধ হোক না কেন বাস্তবে সবুজ বিপ্লব কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনতে পারে না। লাটোর মনে করেন, বিজ্ঞান ট্রেনের মতো। রেললাইন ছাড়া চলতে পারে না। সুতরাং মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। লাইন জুড়ে দিলে ট্রেন অনেক অগ্রসর হতে পারবে।

পরিবেশগত সমস্যা বিজ্ঞানের পক্ষে সমাধান করা বেশ কঠিন। সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে। যেমন, পরিবেশগত সুবিচার আমাদের মূল্যবোধ, কল্যাণবোধ, আদর্শবোধ প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং পরিবেশ প্রত্যয়টির গঠন, আত্মস্থকরণ ও ধারণায়িতকরণ ছাড়া তার সমস্যার দিক আয়ত্তে আনা কঠিন। পরিবেশগত সমস্যা প্রকৃতির ভুল ধারণার ফলাফল নয়। বরং নতুন সমাজপ্রতিবেশতাত্ত্বিক বাস্তবতা প্রদানের লক্ষ্যে ভুল ফলাফলের ভিত্তিতে প্রকৃতির নির্মাণই সমস্যা। সমাজ অনুশীলনের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভুল থেকেই এমনটা হতে পারে। পরিবেশগত সমস্যা এমন অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে সমাজের একটি অংশ কাজ করে যারা অন্য সদস্যদের খারাপভাবে প্রভাবিত করে, যা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ গুণ ও স্থায়িত্বশীলতাকে আক্রান্ত করবে। পরিবেশ সমস্যা সাধারণত ‘চয়েস’-এর ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়।

পরিবেশ বিনাশকারী প্রযুক্তি নিয়েও কথা আছে। তবে, প্রকৃতিবিরোধী বলে নয়, কারণ এক্ষেত্রে নিপুণ বস্তুগত প্রভেদ-রেখা টানা অসম্ভব। ভালো যুক্তি হতে পারে যদি মনে করা হয়, এসব প্রযুক্তি আমাদের আকাক্সিক্ষত প্রকৃতি দিতে পারে না, যা বর্তমানে আছে। তাছাড়া, সেগুলি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ফলে উৎপন্ন, যা মানুষের মধ্যে বিতরণ করে অনৈতিক কাজ। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সামাজিক-ঐতিহাসিক নির্মাণের প্রাথমিক ফোকাস হওয়া দরকার পরিবেশগত সমস্যার কারণ অনুসন্ধান। পরিবেশগত সমস্যার সমাধান ও প্রতিরোধ মানে এই নয় যে, আমরা প্রকৃতিকে যথেষ্ট জানি, বরং আমরা প্রকৃতির সব বিষয়ের সঙ্গে কতটা আন্তঃক্রিয়া করতে পারি। বিজ্ঞান ও প্রকৃতির মধ্যকার আন্তঃক্রিয়ার বিষয়বস্তু সব সময় পরিবর্তমান। পরিবেশগত সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে জুতসই আন্তঃক্রিয়া দরকার। পরিবেশগত-ইতিহাসবিদরা এ-ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন। পরিবেশগত সমস্যার ইতিহাস আমাদের দরকার এজন্য যে, তা সামাজিক সম্পর্ক, কাঠামোগত অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিথ, মেটাফোর ও নৈতিক পূর্বধারণা জানতে সাহায্য করে, যা প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সামাজিক অভিযোজন সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রাখে। ইতিহাসবিদরা পরিবেশ গঠনের স্তর অধ্যয়ন করছে। নিউ ইংল্যান্ডের প্রতিবেশতত্ত্বের সামাজিক নির্মাণ প্রকৃতিকে অ্যাক্টর হিসেবে দেখাতে সফল হয়েছে।

এসব বিভিন্ন গবেষণা থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতির সঙ্গে সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার নীতিমালা জানতে পারলে পরিবেশগত অবনয়ন রোধ করা সম্ভব। প্রকৃতি সম্পর্কে যথার্থ সামাজিক প্রত্যাশা কী? আমরা কী প্রসঙ্গে আলাপ করতে চাই? আমাদের অনুসন্ধানকে নির্দেশ করতে পারে এমন নীতিবোধগুলো কী? সম্মিলিতভাবে আন্তঃক্রিয়া করা বলতে কী বোঝায় যা স্থায়ী ও বন্ধুত্বপূর্ণ উৎপাদনশীল সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে? প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী ধরনের মতাদর্শ কাজ করে? কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কে সামাজিক নীতিবোধ আমাদের জানা নেই; প্রকৃতির সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী আন্তঃক্রিয়া যা পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করে তাও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। বৈজ্ঞানিক অনুশীলন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা জানি না বৈজ্ঞানিক অনুশীলন প্রকৃতির শোষণের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখে। প্রতিবেশতত্ত্বের বিজ্ঞান প্রকৃতির সঙ্গে সম্পকের্র ব্যাপারে যা বলছে তাই কি আমরা মেনে নেবো, নাকি প্রতিবেশতত্ত্বের সামাজিক নির্মাণ পরীক্ষা করবো? আমরা বিজ্ঞানের হেজিমোনি ও মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি।

টীকা ও তথ্যনির্দেশ

১.1. Krishnamurti, J. On Nature and the Environment, HarperCollins Publishers (Australia) Pty. Ltd. http://www.harpercollins.com.au

   2.   Wilderness is generally defined as areas that have not been significantly modified by human activity. Wilderness areas can be found in preserves, estates, farms, conservation preserves, ranches, national forests, national parks, and even in urban areas along rivers, gulches, or otherwise undeveloped areas.

   3.   Woodgate, Graham. ‘Introduction’  to Woodgate, Graham (ed.) 2010, The International Handbook of Environmental Sociology, Edward Elgar, Cheltenham, UK,   p 2.

   4.   Franklin, Adrian. ‘Thinking about Nature 1 Disciplinary Beginnings’ in Franklin, Adrian 2002. Nature and Social Theory, Sage Publications Ltd., London,  p 16.

   5.   Williams, R. 1983, Keywords. Fontana Paperbacks, London, p 269.

   6.   Franklin, Adrian, 2002, op cit.

   7.   Dunlap, R. and Catton, W. ‘Environmental Sociology’, Annual Review of Sociology, 5,  243-73 http://dx.doi.org/10.1146/annuarev.so.05.080179.001331.

   8.   Castree, Noel, 2005. Nature, Routledge, New York.

   9.   Grundmann, Reiner and Stehr, Nico ‘Social science and the absence of nature : uncertainty and the reality of extremes.’

10.   Jetzkowitz, Jens, 2019. Co-Evolution of Nature and Society Foundations for interdisciplinary Sustainability Studies, Palgrave-Macmillan.

  11.   Csatree, Noel, 2005. op cit. p 7.

12.   Castree, Noel, 2014.  Making Sense of Nature, Routledge, London.

13.   Castree, Noel, 2005. Ibid 19.

14.   Lidskog,  Rolf, 2001.  ‘The Re-Naturalization of Society? Environmental Challenges for Sociology’, Current Sociology, vol. 49, No. 1 (January) p113-136.

১৫.     দেখুন, ক্যাটন ও ডানল্যাপ ১৯৮০; ডিকেন্স ১৯৯২; ফ্রডেনবার্গ ও গ্রামলিং ১৯৮৯; মারটেল ১৯৯৪; রেডক্লিফ্ট ও উডগেট ১৯৯৪।

16. Castree, Noel. 2005. Nature, op cit. 177-179.

17.   The nature of theory : A theory of nature.

18.   Demeritt 1996, p 484.

19.   Castree, Noel. 2005. Nature, op cit. p 187.

20.   Taylor, Peter J. 2018. ‘Nature and Nurture’ in Castree, Noel; Mike Hulme, James D. Proctor (eds)  2018. Companion to Environmental Studies, Routledge. London, p 243.

21.   Taylor, Peter J. in Noel Castree, Mike Hulme, & James D. Proctor (eds) 2018. Companion to Environmental Studies,  Routledge, London.

22.   Felice, Deborah De. 2014. Communication between Nature and Nurture: A Sociological Perspective.

23.   Ekers, Michael. 2018. ‘The social construction of nature’, Castree, Noel; Mike Hulme, & James D. Proctor (eds) Companion to Environmental Studies, Routledge. London. p 243-247.

24.   Evans, 2018, see ibid

25.   Castree, Noel and Braun, Bruce 2001. Social Nature : Theory, Practice and Politics, Wiley-Blackwell, London

26.   Bird, Elizabeth Ann R. 1987. The Social Construction of Nature: Theoretical Approaches to the History of Environmental Problems, Environmental Review, Winter,  Vol. 11, No 4.

27.   Kuhn, Thomas S. 1970. The Structure of Scientific Revolutions 2nd ed. Chicago.

            28.       Latour, Bruno and Woolgar, Steve 1979. Laboratory Life : The Social Construction of Scientific Facts, Beverly Hills, London.