পাপিয়ার বিয়ের দিন শুকদেবের শরীরটা বিশেষ ভালো ছিল না, কিন্তু যার বিয়ের জন্য ও এত দৌড়ঝাঁপ করল তার বিয়েতে উপস্থিত থাকতে না পারুক অন্তত কাছ থেকে বিয়ের আয়োজন, ধুমধাম একটু না দেখে থাকতে পারল না ও। আর সেজন্যই অঞ্জলি শেষ পর্যন্ত ওদের দেবনগরের বাড়ির ঠিক উলটোদিকের বাড়ির চিলেকোঠায় শুকদেবের জায়গা করে দিলো একদিন-একরাতের জন্য। এ-ব্যবস্থা করার আগে অবশ্য অঞ্জলি একটা কঠিন শর্ত রেখেছিল শুকদেবের সামনে – বিয়ের পরের দিন ভোরে পাপিয়ার বিদায়পর্ব সমাপন হওয়ার আগে শুকদেব ওর চিলেকোঠার ‘ওয়াচ টাওয়ার’ থেকে বাইরে বেরোতে পারবে না। অঞ্জলির ভয় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ওর আত্মীয়স্বজন, বরপক্ষের লোকজন আর পাড়াপড়শিদের কাছে শুকদেবের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ফাঁস হয়ে গেলে বিয়েটা প- হয়ে যাবে।
যে-বাড়ির চিলেকোঠায় কাকভোরেই একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে শুকদেব এসে উঠল, সে-বাড়ির গৃহকর্ত্রী মৃদুলার সঙ্গে অঞ্জলির ভালো পরিচয় ছিল। অঞ্জলি ওকে জানিয়েছিল পাপিয়ার এক দূরসম্পর্কের কাকা আসছেন লখ্নৌ থেকে। মাসখানেক আগে কাকার হার্টের অপারেশন হয়েছে, বিয়ের হই-হট্টগোল ওনার বরদাশত হবে না, তাই চিলেকোঠায় বসেই বিয়েটা দেখবেন তিনি।
অতিথিপরায়ণ মৃদুলা নিজে এসে সকালে শুকদেবকে জলখাবার – আলু পরোটা, টকদই আর লেবুর আচার দিয়ে গেলেন। শুকদেব দেখল স্থূলকায়া মহিলা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন। ও একটু লজ্জিত হয়েই বলল, ‘আপনি কেন এতটা তকলিফ করলেন বেহেনজি, আমি নিচে চলে আসতাম নাশতা করতে।’
‘মোটা মানুষের একটু ওপর-নিচ করা দরকার, ভাইসাব’, হেসে বললেন মৃদুলা। ‘যা-হোক, বারবার তো আমাকে ওঠানামা করতে হবে না। আপনার দুপুর আর রাতের খাবার অঞ্জলিই পাঠাবে বিয়েবাড়ি থেকে। অঞ্জলি আমার ছোট বোনের মতো, কুড়ি বছরের ওপর একসঙ্গে এ-পাড়ায় আছি আমরা। যখন যেটা দরকার হয় বলবেন, নিজের ঘর মনে করে থাকবেন ভাইসাব। একটু পরে আমার ঝি রাধাকে পাঠিয়ে দেবো চা দিয়ে, ও এসে প্লেট সরিয়ে নেবে, ঘরে ঝাড়–-পোঁছা লাগিয়ে দিয়ে যাবে। আমি একটু পরই ও-বাড়ি যাব, এখন আসি।’
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বেহেনজি।’ শুকদেব হাতজোড় করে নমস্কার জানাল মৃদুলাকে।
একটু পরে চা-জলখাবার খেয়ে ইকোস্প্রিনের একটা ট্যাবলেট মুখে ফেলে জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসল শুকদেব। পশ্চিম দিল্লির করোলবাগের লাগোয়া দেবনগর অঞ্চলে এখনো বেশকিছু বাঙালি পরিবার বাস করে। দরিয়াগঞ্জের যে পুরনো হাভেলিতে ছোট দুটি কামরা নিয়ে শুকদেব একা পড়ে আছে, তার আশপাশে এখন আর কোনো বাঙালি পরিবার নজরে পড়ে না। যারা এককালে ছিলেন ওই এলাকায় তারা চিত্তরঞ্জন পার্ক বা দক্ষিণ দিল্লির কোনো আবাসনে ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছেন অনেককাল হলো। শুকদেব হরিয়ানার মানুষ, কিন্তু ব্যবসার প্রয়োজনে ওর বাবা প্রায় সত্তর বছর আগে দরিয়াগঞ্জে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। কেননা ওনার ইলেকট্রিক্যাল গুডসের দোকানটা ছিল চাঁদনীচকের মুখেই, ভাগীরথ প্যালেসে, যেটা একসময় বেগম সমরুর হাভেলি নামেই পরিচিত ছিল। শুকদেবের সমস্ত জীবনটাই কেটে গেল দরিয়াগঞ্জের এই ভাড়া বাড়িতে; কিন্তু ওর একমাত্র ছেলে নরেশ পুরনো দিল্লিতে থাকতে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভাব করে নিজের অফিসের সিমরান নামে একটি পাঞ্জাবি মেয়েকে বিয়ে করে দক্ষিণ দিল্লির বসন্তকুঞ্জে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে গেল নরেশ দু-বছর আগেই।
‘একা একা এই ভুতুড়ে বাড়িটাতে কেন পড়ে থাকবেন পিতাজি, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে’, বলেছিল সিমরান; কিন্তু লালকেল্লা, জামা মসজিদ আর চাঁদনীচকের অতিপরিচিত ঐতিহাসিক গলিঘুঁজি, ভিড়ভাট্টা ছেড়ে শুকদেব নতুন দিল্লির সাফসুতরো বহুতল কোনো আবাসনে যেতে রাজি হয়নি। ভাগ্যচক্রে এই মাঝবয়সে এসে যার সঙ্গে ওর ভাব হলো সেই অঞ্জলিও থাকে দেবনগরের মতো একটি পুরনো, ঘিঞ্জি এলাকায়।
নিচে তাকিয়ে শুকদেব দেখল দশ-বারোজন পুরুষ এবং মহিলা – সম্ভবত অঞ্জলির আত্মীয়স্বজন – বাড়ির সামনের বাঁধানো উঠোনে দুটো চারপাইতে বসে গালগল্প করছে আর কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ছোটাছুটি করছে ওদের চারপাশে। ডেকোরেটরের লোকরা বাচ্চাদের মাঝেমধ্যে তাড়া করে ভাগিয়ে দিচ্ছে। কেননা ওদের ছোটাছুটিতে খুঁটি পুঁতে শামিয়ানা তুলতে ওদের অসুবিধে হচ্ছিল। অঞ্জলি আর মৃদুলা চায়ের কেটলি আর প্লাস্টিকের গ্লাস নিয়ে ঘর থেকে বেরোলে শুকদেব চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। এক বয়স্ক মহিলা অঞ্জলিকে দেখে ফোকলা দাঁতে হাসলে শুকদেবের অশীতিপর নানিকে মনে পড়ে গেল। শুকদেবের আরো ভালো লাগল যখন ওই মহিলা আদর করে অঞ্জলির গাল টিপে দিলেন আর ও বয়স্ক আত্মীয়ার তোবড়ানো গালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল। প্লাস্টিকের গ্লাসে চা বিতরণ করে অঞ্জলি আর মৃদুলা চলে গেলে পাপিয়া ঘর থেকে বেরোল বেগুনি রঙের সালোয়ার-কুর্তা পরে। পাপিয়া জানত শুকদেব ওপরে চিলেকোঠায় বসে সব দেখছে, তাই ও ওপরে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দুই আঙুল তুলে ‘ভি’ সাইন দেখিয়ে আত্মীয়স্বজনকে নমস্কার করতে লেগে গেল।
পাপিয়া তো ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার আগেই শুকদেবকে বলেছিল, ‘এতসব রাখঢাকের কী দরকার আংকল, তোমরা দুজন মন্দিরে বা রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে এসো, তারপর আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো।’
কিন্তু শুকদেবের আপত্তি না থাকলেও অঞ্জলি এ-প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পাপিয়ার হবু বর বিক্রমের মা-বাবা নেই তো কি হয়েছে, মামা-কাকা, মাসি-পিসিরা তো আসবেন ওর বিয়েতে। বিয়েবাড়িতে এসে যদি শোনেন মেয়ের মা সদ্য বিয়ে করেছেন এবং তাও কোনো বাঙালি ভদ্রলোককে নয়, হরিয়ানার এক জাটকে কে জানে এত ছোটাছুটি করে পাপিয়ার জন্য শুকদেব যে-সম্বন্ধটা নিয়ে এলো সেটা যদি ভেঙে যায় শেষ মুহূর্তে?

দুই
শুকদেব আর অঞ্জলির প্রথম দেখা হয়েছিল ছ-মাস আগে একটা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। অফিস ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময় হামদর্দ নার্সিং হোমের কাছে আসফ আলি রোডের ওপর একটা ভিড় জমা হয়েছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল শুকদেব। ভিড়ের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করে ও জানতে পেরেছিল যে, লিমকার ক্রেট মাথায় নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি ছেলে লরির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেছে। আরো কয়েকজন কৌতূহলী দর্শকের মতো শুকদেবও ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনার দৃশ্যটা দেখল। জীবনে আরো কয়েকটা রাস্তার দুর্ঘটনা এর আগে দেখেছে শুকদেব, কিন্তু এবার যে ভয়াবহ দৃশ্যটা ও দেখল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তাতে ওর গা গুলিয়ে উঠল, শরীরে দরদর করে ঘাম বেরোতে লাগল। ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে একটা তালাবন্ধ ওষুধের দোকানের সামনে ও ধপ করে বসে পড়ল। বসে পড়ার সময় ওর খেয়াল হলো যে ওর থেকে একটু দূরেই ক্যানভাস ব্যাগ হাতে এক মহিলা হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছেন। চোখ বুজে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে শুকদেব বসে রইল প্রায় দশ মিনিট। তারপর ও যখন চোখ খুলল, দেখতে পেল ওর কাছে বসা মহিলাও হাঁটু থেকে মাথা তুলেছেন। ততক্ষণে পুলিশ এসে লাঠির গুঁতো দিয়ে জনতাকে হটিয়ে দিয়েছে, ছোট একটা অ্যাম্বুলেন্সও এসে গেছে শবদেহ তুলে নেওয়ার জন্য।
‘আপনিও কি ওই ডেডবডিটা দেখেছেন?’ মহিলা প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন শুকদেবকে।
শুকদেব মাথা নাড়ল। ‘না দেখলেই ভালো করতাম, অত রক্ত দেখেই হঠাৎ গা-টা কেমন গুলিয়ে উঠল আর ঘাম ছুটল।’
‘আমারও ঠিক একই অবস্থা।’
শুকদেব মাথা ঘুরিয়ে এবার তাকাল মহিলার দিকে। বেশ সুগঠিত চেহারা মহিলার, রংটা কালোর দিকেই কিন্তু মুখশ্রী সুন্দর। মহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে, চোখদুটো বেশ বড় আর সেই চোখ জুড়ে রয়েছে এক বিষণœতা, যা শুকদেবকে নাড়া দিলো ভেতর থেকে। সিঁথিতে সিঁদুর না থাকায় শুকদেব অনুমান করল মহিলা বিধবা অথবা অবিবাহিত। চোখণ্ডমুখ দেখে শুকদেবের মনে হলো মহিলা বাঙালি হলেও হতে পারেন, যদিও ওর হিন্দি বলার মধ্যে কোনো জড়তা বা উচ্চারণে কোনো ত্রুটি ছিল না। হয়তো প্রবাসেই আছেন তিনি অনেক কাল, ভাবল শুকদেব। ‘আমার মনে হয় আমাদের একটু চা খেয়ে নিলে ভালো হতো’, শুকদেব বলল। ‘গা গোলানো ভাবটা ওতে কেটে যাবে।’
‘আমার এক গ্লাস জল হলেই চলবে’, বললেন মহিলা।
‘চলুন কাছের কোনো চায়ের দোকানে যাই, দুটোই পাওয়া যাবে ওখানে।’ আসফ আলি রোড থেকে দিল্লিগেট পার হয়ে দরিয়াগঞ্জ দশ মিনিটের রাস্তা, কিন্তু অপরিচিত এক মহিলাকে বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে সাহস পেল না শুকদেব।
কমলা মার্কেটের এক চায়ের দোকানে চা-জল খেয়ে ওরা একটু সুস্থ বোধ করলে শুকদেব মহিলাকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য মিন্টো রোড বাসস্টপে নিয়ে এলো। ‘আপনি কোথায় কাজ করেন?’ শুকদেব জিজ্ঞেস করল মহিলাকে।
‘আমি ব্রিলিয়ান্স নামে একটা ওয়াশিং পাউডারের ক্যানভাস করি পুরনো দিল্লির বিভিন্ন অঞ্চলে’, বললেন মহিলা।
শুকদেব জানাল ব্রিলিয়ান্সের নাম এর আগে কখনো শোনেনি ও। বহুবিজ্ঞাপিত অন্যান্য ওয়াশিং পাউডারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেমন চলছে ব্রিলিয়ান্স জানতে চাইলে মহিলা জানালেন, নতুন কোম্পানি হিসেবে ব্রিলিয়ান্স ভালোই ব্যবসা করছে। পুরনো দিল্লিতে এটা ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুকদেব এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল ওর অফিসের স্টোরস অফিসারের সঙ্গে ও ব্রিলিয়ান্সের ব্যাপারে কথা বলে দেখবে। শুকদেবের অনুমানকে সত্য প্রমাণিত করে মহিলা এবার জানালেন উনি বাঙালি, ওনার নাম অঞ্জলি বিশ্বাস, থাকেন দেবনগরে, ওনার দাদার পরিবারের সঙ্গে। ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে ব্রিলিয়ান্স পাউডারের একটা আধা কিলোর প্যাকেট আর কাঁধে ঝোলান ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে শুকদেবের হাতে দিয়ে অঞ্জলি বলল, ‘আপনার স্টোরস অফিসারের সঙ্গে ব্রিলিয়ান্সের ব্যাপারে কথা বলার সময় ওনাকে জানাবেন অন্যান্য ভালো ওয়াশিং পাউডারের মতো আমরাও ল্যাব ইউজ করে থাকি।’
‘এই ল্যাবটা কী জিনিস যদি একটু খুলে বলেন … ’
‘এটা একটা কেমিক্যাল। পুরো নামটা হলো লিনিয়ার অ্যালকাইল বেনজিন, সংক্ষেপে ল্যাব।’
বাস এসে গেলে অঞ্জলি বাসে উঠে জানালার সিটে বসে ওর দিকে তাকালে শুকদেব হাসিমুখে হাত তুলে ওকে বিদায় জানাল।

তিন
নভেম্বরের এই ঠান্ডা সকালে মৃদুলার চিলেকোঠায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল শুকদেব। ভারী বাসন-কোসনের আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে গেল। একটু পরই হলুদ আর শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে এলে শুকদেব বুঝতে পারল রাঁধুনিরা এসে রান্না শুরু করে দিয়েছে। উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা সেদিনের হিন্দি সংবাদপত্র তুলে নিল শুকদেব। খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ আর রাজনৈতিক কোন্দলের খবরে ভরা প্রথম পাতাটায় চোখ বুলিয়ে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলো শুকদেব। ওর এখন একটু একটু খিদে পাচ্ছিল, আর সেজন্যই ও জানালাটা বন্ধ করে এলো। কেননা ও জানে মশলার গন্ধে খিদেটা বেড়ে যাবে। নিচ থেকে অঞ্জলি খাবার পাঠাবে ওকে; কিন্তু সেটা কে আনবে আর কখন এসে পৌঁছবে তার কোনো হদিস দেয়নি অঞ্জলির বন্ধু মৃদুলা। নিচে হাঁকডাক আর চেঁচামেচির ক্রমবর্ধমান আওয়াজ থেকে শুকদেব বুঝতে পারল আরো লোকজন, পাড়াপড়শি এসে হাজির হয়েছে বিয়েবাড়িতে। অঞ্জলি কী করছে এখন? একবার কয়েক মিনিটের জন্য যদি ও চলে আসত এই চিলেকোঠায় ওর সঙ্গে দেখা করতে, তবে ওর খুব ভালো লাগত। যা-হোক অঞ্জলি যে ওকে ভোলেনি সেটা টের পেল শুকদেব যখন ঘণ্টাখানেক বাদে গোলাপি লেহেঙ্গা-চোলি পরা, সালঙ্কারা এক কিশোরী এসে ওকে একটা বড় থালায় সাজানো খাবার দিয়ে গেল – ভাত, ডাল, রুটি, পনিরের সবজি, টক দই আর দুটো রসগোল্লা।
‘কী নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করল শুকদেব।
‘প্রেরণা’, মুচকি হেসে বলল মেয়েটি। ওর হাসির ধরন দেখে বোঝা গেল অঞ্জলির সঙ্গে শুকদেবের সম্পর্কটা কী তা ও জেনে গেছে।
‘অঞ্জলি তোমার কে হন?’
‘উনি আমার পিসি, পাপিয়া আমার পিসতুতো বোন।’
পাপিয়ার কাছেই শুকদেব শুনেছিল যে, মামাতো-পিসতুতো দুই বোনের মধ্যে খুব ভাব, কাজেই পাপিয়ার কাছেই প্রেরণা শুনে থাকবে ওর মায়ের সঙ্গে শুকদেবের প্রণয়ের কাহিনি। ওর মাধ্যমে অঞ্জলির খবর নিতে কোনো বাধা নেই, ভাবল শুকদেব।
‘কোন ক্লাসে পড়ো তুমি প্রেরণা?’
‘আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, আংকল।’
‘খুব ভালো। তোমার পিসি তো এখন খুব ব্যস্ত তাই না?’
‘হ্যাঁ অনেক আত্মীয় আর পাড়ার লোক এসেছেন আমাদের বাড়িতে।’
‘খুব ভালো। পাপিয়ার বিয়েটা মিটে যাক তারপর তোমার সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ করা যাবে, কেমন?’
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল প্রেরণা, তারপর মিষ্টি হেসে ‘এখন আসি আংকল’, বলে বিদায় নিল।
খাবার খেতে খেতে শুকদেবের মনে পড়ে গেল অঞ্জলির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পরের সেই বিষাদাচ্ছন্ন সন্ধ্যাটি। শুকদেবের অনুরোধেই জয়প্রকাশ নারায়ণ হাসপাতালের উলটোদিকে শিশু উদ্যানে দেখা হয়েছিল ওদের। এপ্রিল মাসের সেই সন্ধ্যায় নিজেদের পরিচয়পর্বটা ভালোভাবে সেরে নিতে গিয়ে দুজনেই আবিষ্কার করেছিল যে, ওদের অতীত খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। বাবা-মা অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় স্কুলের গ-ি পেরোবার পরেই আঠারো বছর বয়সে অঞ্জলির দাদা অনিল হুট করে ওর বিয়ে দিয়ে দিলো এমন একটি ছেলের সঙ্গে, যে পাপিয়ার জন্মের দু-বছর পরই এক ধর্মীয় গুরুর নির্দেশে সংসার ত্যাগ করে চলে যায় উত্তর কাশীতে ওঁর আশ্রমে। দাদার সংসারে পাপিয়াকে নিয়ে অঞ্জলির খুব সুখে সময় কাটেনি; না হলে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে ওয়াশিং পাউডার বিক্রি করতে দরিয়াগঞ্জ, চাঁদনীচক, কাশ্মিরিগেট আর সিভিল লাইনসের ছোট-বড় অফিসে আর দোকানগুলোতে ঘুরতে হবে কেন ওকে?
শুকদেবের অবশ্য আর্থিক কষ্ট সহ্য করতে হয়নি, তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ও বাবার ভাগীরথ প্লে­সের দোকানে বসতে রাজি না হওয়ায় বাবা অখুশি ছিলেন। কেননা ব্যবসা সামলাবার জন্য শুকদেবের আর কোনো ভাই ছিল না, ছিল তিন বোন। শেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের জায়গায় এক জামাইকে ব্যবসাটা দিয়ে দিতে হলো ওনাকে মৃত্যুর আগে। বিএ পাশ করেই সরকারি চাকরিতে ঢুকে যায় শুকদেব; কিন্তু বিয়ের পর ওর স্ত্রী মীনার সঙ্গে মনের মিলমিশ ছিল না প্রথম থেকেই। ঝগড়া-ঝাঁটি, মনোমালিন্য হলে মীনা ছেলে নিয়ে চ-ীগড়ে ওর বাপের বাড়িতে গিয়ে কাটিয়ে আসত দু-চার মাস। দশ বছর আগে পতœীবিয়োগ হলে ছেলে নরেশকে নিয়ে শুকদেবের অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারণ নরেশ মাকে ভালোবাসত আর বাবাকে ঘৃণা করত। ওকে শেষ পর্যন্ত হোস্টেলে রাখতে বাধ্য হলো শুকদেব। কলেজের পড়া শেষ করে চাকরি জোগাড় করে নিজের পছন্দের মেয়ে বিয়ে করে ও যে আলাদা হয়েছে তাতে শুকদেব অনেকটা স্বস্তিবোধ করেছিল।

চার
সন্ধ্যার দিকে অঞ্জলির বাড়ির সামনে ঝোলানো রঙিন টুনি বাল্বগুলো জ্বলে উঠলে শুকদেব আবার চেয়ারটা টেনে নিয়ে জানালার কাছে বসল। মাইকে সানাইয়ের সুর বেজে উঠল। ক্ষণিকের জন্য হলেও শুকদেবের ত্রিশ বছর আগে সোনিপাতের কাছে নিজেদের গ্রামে ওর বিয়ের কথা মনে পড়ল। গাঁয়ের লোক তিনদিন ধরে ফুর্তি করেছিল ওর বিয়েতে। বিয়ের কদিন ওদের বৈঠকখানায় সন্ধের দিকে মদের আসর জমিয়েছিল গাঁয়ের গণ্যমান্য লোকেরা। শুকদেব নিচে তাকিয়ে দেখল উঠোনে বিশাল শামিয়ানার নিচে এখন অনেক লোক জড়ো হয়েছে, কিন্তু ওদের মধ্যে অঞ্জলিকে দেখতে পেল না ও। নিচ থেকে টুকরো কথাবার্তার যেটুকু ওর কানে এসে পৌঁছল তাতে ও বুঝতে পারল বর আসার সময় হয়ে এসেছে, যে-কোনো মুহূর্তে বরযাত্রীরা এসে হাজির হবে বিয়ের আসরে। পাপিয়ার বর বিক্রমকে বরণ করতে বরণকুলো নিয়ে অঞ্জলি নিশ্চয়ই এসে দাঁড়াবে বাড়ির সামনে ফুল দিয়ে সাজানো গেটে আর এই প্রতীক্ষায়ই শুকদেব গেটের দিকে চোখ রেখে বসে রইল চেয়ারে।
পাপিয়ার বিয়ের জন্য ছেলে খোঁজার কথাটা অঞ্জলি প্রথমবার তুলেছিল শুকদেবের দরিয়াগঞ্জের বাড়িতে। একটু আগেই শুকদেবের সঙ্গে দৈহিক মিলনের সময় অঞ্জলির মনে হয়েছিল রেলওয়ে ইয়ার্ডে বহুকাল পরিত্যক্ত একটি কোচকে পুরনো কিন্তু সমর্থ একটি স্টিমইঞ্জিন আজ টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো রেললাইনের ওপর। দেহ-মন আচ্ছন্ন করে দেওয়া তীব্র আনন্দের মুহূর্তটি কেটে যাওয়ার পর অঞ্জলি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। একটু অবাক হয়ে শুকদেব বলেছিল, ‘তুমি যদি আগেই বলে দিতে অঞ্জু তা হলে তোমাকে বিছানায় নিয়ে আসতাম না আমি।’
‘সেজন্য কাঁদছি না আমি’, অঞ্জলি চোখ মুছে বলেছিল। ‘আমি শুধু ভাবছি পাপিয়া তেইশে পড়ল, এখনো ওর বিয়ে দিতে পারলাম না আর মা হয়ে এখানে আমি তোমার সঙ্গে বিয়ে করা বউয়ের মতো আনন্দ-ফুর্তি করছি।’
অঞ্জলির ঠোঁটে চুমু খেয়ে শুকদেব বলেছিল, ‘আমি পাপিয়ার বর খুঁজতে সাহায্য করব তোমাকে, তুমি আমাকে ওর ফটো আর বায়োডাটা দিও। একটা ম্যাট্রিমনিয়াল ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রি করিয়ে দেখা যাক কী রকম রেসপন্স আসে।’
পাপিয়ার গায়ের রং একটু চাপা হলেও মায়ের মতোই ওর মুখশ্রী সুন্দর, তার সঙ্গে বিএ পাশ, কাজেই সম্বন্ধ এসেছিল বেশ কয়েকটা। কিন্তু পাত্রীর বাবা সন্ন্যাসী আর পণ দেওয়ার ক্ষমতা নেই অঞ্জলির, এ-কারণে অনেকেই পিছিয়ে গেল। শুকদেব তাই রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বিহার, ঝাড়খন্ডের হিন্দি কাগজগুলোতে বিজ্ঞাপন দিলো পাপিয়ার বর খুঁজতে। দিল্লির অনেক প্রবাসী বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতো পাপিয়া হিন্দিতেই কথা বলে, বাংলা লিখতে-পড়তে শেখেনি, তাই প্রবাসী বাঙালি পরিবারেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অঞ্জলি। শেষ পর্যন্ত ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে
কর্মরত বিক্রম সেন রাজি হয়ে গেল পাপিয়াকে বিয়ে করতে। বিক্রম ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের বিলাসপুর ফিল্ড অফিসে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাটেরোলজিস্ট। ওর বাপ-মা নেই, পণ নেবে না আর বিয়ের ব্যাপারে শেষ কথাটা বলার অধিকার নিজের কাছেই রেখেছে।
পাপিয়ার জন্য ছেলে খোঁজা শুরু করার সময়ই অঞ্জলি ওর সঙ্গে শুকদেবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ওরা তিনজন ছুটির দিনে একসঙ্গে মল, সিনেমা, রেস্তোরাঁয়ও ঘুরে এসেছে বেশ কয়েকবার। অঞ্জলির দাদা-বউদি পাপিয়ার বিয়েতে নিজেদের খুব একটা জড়াতে চাইছিলেন না, তাই মেয়ে দেখতে বিক্রমকে বাড়িতে না ডেকে কনট প্লেসের কফিহাউসে ডেকে পাঠিয়েছিল শুকদেব আর অঞ্জলি। ছবি দেখেই বিক্রম রাজি হয়ে গিয়েছিল পাপিয়াকে বিয়ে করতে, এখন চাক্ষুষ দেখার পর ও মত পালটাল না। অঞ্জলি খুশিতে ডগমগ হলেও পাপিয়া প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল। ‘আংকল, এত দেখছি একটা কংকাল, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, এর সঙ্গে জুতে দেবে তুমি আমাকে?’ বিক্রমের চেহারা দেখে নাক সিঁটকালে পাপিয়ার গালে টোকা মেরে শুকদেব বলেছিল, ‘বেচারা ওখানে সেদ্ধ ভাত খায়, গায়ে মাংস লাগবে কোত্থেকে? এখন তুই গিয়ে মাছ-মাংস রেঁধে খাওয়াবি ওকে, তবে তো হাড়ে মাংস লাগবে ওর। বিলাসপুরে পুরো একটা দিন কাটিয়েছি আমি বিক্রমের সঙ্গে। ছেলেটা খুব ভালো রে, না করিস না।’
সরকারি চাকুরে, ভালো মাইনে পায়, চাকরিতে আরো উন্নতি হবে, মাইনে বাড়বে এবং ভবিষ্যতে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরে পোস্টিং হবে, এসব শুনে অঞ্জলি আর শুকদেবের চাপে পড়ে শেষে রাজি হয়ে গেল পাপিয়া।
‘আমার বিয়ের আগেই তোমরা দুজন নিজেদের বিয়েটা সেরে নাও না’, আবদার করেছিল পাপিয়া।
‘তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?’ আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে ছিল অঞ্জলি। ‘আমার কপালে এখন সিঁদুর উঠলে তোর কপালে সিঁদুর নাও উঠতে পারে, সেটা বুঝিস তুই? তোর বিয়ের দিন পাড়াপড়শির সামনে কপালে সিঁদুর নিয়ে মুখ দেখাতে পারব না আমি।’

সমবেত মহিলাদের উলুধ্বনি আর শঙ্খের আওয়াজের মধ্যে বিক্রম নামল গাড়ি থেকে, সঙ্গে ওর এক মামা আর এক খুড়তুতো ভাই, যাদের সঙ্গে শুকদেবের আলাপ হয়েছিল বিয়ের সম্বন্ধটা পাকা করার সময়। শুকদেব নিজেকে মেয়ের দূরসম্পর্কের কাকা হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিল। নীল সিল্কের শাড়িতে গা-ভরা গয়না আর মুখে হালকা মেকআপ নিয়ে অঞ্জলিকে বেশ সুন্দর লাগছিল শুকদেবের। ওর মুখে হাসি, চোখ উজ্জ্বল। এই শুভ দিনটিকে ত্বরান্বিত করতেই অফিসে ছুটি নিয়ে শুকদেব এত ছোটাছুটি করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত ওর একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল বিয়ের মাসখানেক আগে। এখনো শুকদেব ছুটিতেই আছে। বিক্রমকে বরণ করে মহিলারা ভেতরে নিয়ে গেলে শুকদেব জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাইকে তখন ‘মেরি ইয়ার কি শাদি হ্যায়’ বাজছে। বেশ কয়েকটা বাজি-পটকার আওয়াজও শুনতে পেল শুকদেব। অঞ্জলির উজ্জ্বল চোখ আর হাসিমুখ মনে করতে করতে শুকদেবের চোখের পাতা বুজে এলো একসময়।

পাঁচ
মাঝরাতের একটু পরে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলে শুকদেব উঠে দরজা খুলে দিলো। ওর সামনে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি, ওর হাতে খাবারের থালা, মুখে দুষ্টু হাসি। ‘তোমার খুব খিদে লেগে গেছে নিশ্চয়ই’, বলল অঞ্জলি ওর চোখে চোখ রেখে।
‘আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, অঞ্জু।’
অঞ্জলি ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর যে বড় স্টিলের থালাটি রাখল, তাতে মাঝখানে স্তূপাকৃত পোলাও আর ওর চারদিকে সাজানো রয়েছে পাঁচটি ছোট বাটি। শুকদেব শাকাহারি, কাজেই তিন রকম সবজি আর দুরকম মিষ্টি দিয়ে থালা ভরিয়ে নিয়েছে অঞ্জলি। কিন্তু খাবার নয়, অঞ্জলির মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল শুকদেব। খোঁপায় বেলফুল, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর মুখে হালকা মেকআপ নিয়ে অঞ্জলি অন্তত বছরদশেক বয়স কমিয়ে নিয়েছে আজ রাতের জন্য।
‘কী দেখছ অমন হাঁ করে?’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জলি মুচকি হেসে।
‘ভাবছি কার বিয়ে আজ রাতে, তোমার, না পাপিয়ার?’ শুকদেব বলল অঞ্জলির গালে টোকা মেরে। তারপর ওর দুই গালে আলতো করে চুমু খেল শুকদেব, যাতে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে ওর সুন্দর মেকআপটা নষ্ট না হয়ে যায়।
‘তুমি খাও, আমি বসে দেখব’, অঞ্জলি বলল খাটের এক কোণে বসে।
শুকদেব খেতে শুরু করলে অঞ্জলি সংক্ষেপে বিয়েবাড়ির সব ঘটনা শোনাল ওকে। বিক্রম আত্মীয়স্বজনসহ মাত্র বাইশজন বরযাত্রী সঙ্গে এনেছে। ওর মধ্যে জনাদশেকের একটু মদ খাবার ইচ্ছা হলে অঞ্জলির দাদা অনিল ওদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে একটি কামরায় নিয়ে গিয়ে হুইস্কি, সোডা আর বরফের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রান্নাঘর থেকে গরম গরম পাকোড়ার সাপ্লাইটা যাতে অব্যাহত থাকে সেদিকে নজর রেখেছে অঞ্জলির ভাইঝি প্রেরণা আর ওর প্রতিবেশী মৃদুলা। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ বিক্রমের পাটকাঠির মতো চেহারা আর মোটা লেন্সের চশমা নিয়ে মন্তব্য করেছে, তবে পাপিয়া শুভদৃষ্টির সময় যে মিষ্টি হাসিটি দিয়েছে তাতে বরপক্ষের সবাই খুশি হয়ে তালি বাজিয়েছে। আত্মীয়স্বজন, ঘরের লোক মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো লোক খেয়েছে পাপিয়ার বিয়েতে। করোলবাগের অশোক ক্যাটারারের রান্নার সবাই খুব প্রশংসা করেছে, বিশেষত পনির পসন্দ, রসমালাই আর মুগডালের হালুয়ার তারিফ করেছে সবাই। বরের মামা-মামি, খুড়ো-খুড়ি সবাই ‘সেই মিষ্টভাষী ঘটক কাকু’র খোঁজ নিলে অঞ্জলি কাঁচুমাচু মুখ করে জানিয়েছে, ঘটক কাকু তার দাদার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে কলকাতা গেছেন, তাই বিয়েতে হাজির হতে পারেননি, ফোনেই পাপিয়াকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। শুকদেবের দেওয়া চাঁদনীচকের বড় গয়নার দোকান থেকে কেনা মোটা প্রায় দুই ভরির সোনার হারের কথাটা অবশ্য চেপে গেছে অঞ্জলি ঘটক কাকুর সঙ্গে ওর আসল সম্পর্কটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
শুকদেবের ইচ্ছা ছিল অঞ্জলিকে আরো কিছু সময় ধরে রাখে; কিন্তু কাকভোরে মেয়ে-জামাইকে বিদেয় জানাতে হবে আর তার জন্য অঞ্জলিকেই জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে হবে। খাবারের থালা নিয়ে অঞ্জলি চলে গেলে শুকদেব আরেকটা ইকোস্প্রিন খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মাইকের আওয়াজ ততক্ষণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটু পরেই ও ঘুমিয়ে পড়ল।

শেষরাতে মেয়েদের কান্নাকাটির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল শুকদেবের। ও বুঝতে পারল বর-বধূকে বিদায় দেওয়ার সময় এসে গেছে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে আরেকবার জানালার কাছে গিয়ে বসল শুকদেব। বিয়ের পর বিদায়ের সময় মেয়েদের এই কান্নাকাটি শুকদেব একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তবু আনন্দানুুষ্ঠানের শেষে এই দৃশ্যটা দেখতে মহিলারা একত্রিত হন বিয়েবাড়িতে। শুকদেব লক্ষ করল অবাঙালি মেয়েদের তুলনায় বাঙালি মেয়েদের কান্নাকাটির ঘটা কিছুটা কম। তবু পাপিয়া আর বিক্রম গুরুজনদের নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালে অঞ্জলি পাপিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করল। চোখের জলে ওর সুন্দর মেকআপটা যে ধুয়ে যাচ্ছে তার কোনো খেয়াল নেই অঞ্জলির। মাথায় মুকুট পরে গোবেচারা বিক্রম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। ওর মামা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন, কেননা ওনাদের ট্রেন ধরার তাড়া আছে।
পাপিয়া আর বিক্রম শেষ পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে বসল আর বরযাত্রীরা উঠল একটা মিনিবাসে। ওরা চলে যাওয়ার পরও বাড়ির মহিলারা অঞ্জলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে উপদেশ, নির্দেশ এবং সান্ত¡না দিতে থাকলে শুকদেবের মনে হলো, ওর দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং সেই সঙ্গে ওর অজ্ঞাতবাসের সময় শেষ হয়েছে। এবার ওকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে অঞ্জলির পাশে।
জানালা ছেড়ে উঠে এসে বিছানা থেকে শালটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে শুকদেব বেরিয়ে এলো কামরা থেকে। তারপর সাবধানে সরু সিঁড়ি বেয়ে ও নেমে এলো নিচে। গেট পার হয়ে উঠোনের দিকে ওকে এগিয়ে আসতে দেখে মহিলারা অঞ্জলিকে ছেড়ে ওর দিকে তাকাল। সমবেত মহিলাদের – যার মধ্যে মৃদুলাও ছিল – অবাক করে দিয়ে শুকদেব এসে দাঁড়াল অঞ্জলির পাশে। পকেট থেকে রুমাল বের করে অঞ্জলির কান্নাভেজা চোখদুটো মুছিয়ে দিয়ে শুকদেব বলল, ‘আর কেঁদো না অঞ্জু, তোমার মেয়ে-জামাই সুখে ঘরসংসার করবে, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো তুমি। এবার এই অভাগার জন্য গরম গরম এক কাপ চা নিয়ে এসো তো দেখি।’