প্রত্যাবর্তনের এক প্রদর্শনী

১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার চারুকলায় পাঠ শুরু করা চারুশিল্পীদের দ্বিতীয় দলগত প্রদর্শনী সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে। তাঁদের প্রথম প্রদর্শনী হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এবার ২৩ জন শিল্পী অংশ নিয়েছেন প্রদর্শনীতে।

এই শিল্পীদলটির সদস্যরা নানা পেশায় নিয়োজিত। টেলিভিশন, খবরের কাগজ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও নকশাকেন্দ্রে সম্পৃক্ত আছেন বেশ কয়েকজন। কেউ কেউ শিক্ষকতা করছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞাপন সংস্থা ও প্রকাশনা শিল্পে আছেন কয়েকজন। চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের অভিনেতা ও মডেল হয়েছেন কেউ কেউ, পেশাদার শিল্পচর্চায় নিয়োজিত আছেন অন্যরা।

ইউনেস্কো-ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য – পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণা প্রথম এসেছে যশোর চারুপীঠের উদ্গাতা ভাস্কর মাহাবুব জামাল শামিম ও শিল্পী হিরণ্ময় চন্দের মাথা থেকে। এই দুই কৃতীশিল্পী ১৯৭৯ ব্যাচের। এ-দলের ছয়জন শিল্পী ২০১৩ সালে ৫৫তম ভেনিস বিয়েনালে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন – চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক লালারুখ সেলিম, ভাস্কর মাহাবুব জামাল শামিম, শিল্পী মোখলেসুর রহমান, রোমপ্রবাসী শিল্পী উত্তম কুমার কর্মকার, শিল্পী অশোক কর্মকার ও জাহিদ মুস্তাফা। আশির দশকে আলোচিত শিল্পীদল ‘সময়ে’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভাস্কর সেলিম আহ্মেদ।

প্রদর্শনীতে নিজের গড়া মৃৎশিল্পকর্ম ‘রাজাহাতি’ নিয়ে অংশ নিয়েছেন চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্পের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন কুমার সিকদার। শিল্পী টেপামাটির পুতুল তৈরির ঐতিহ্যকে ধরে রেখে শিল্পিত সুষমায় তিনটি হাতির বহর ও
ছোট-বড় চারটি পুতুলের একটি সেট উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী রুস্তম
আলী বড় দুটি সিরামিক পাত্রে  প্রকৃতির নানা উপকরণ প্রয়োগ করে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে সহজভাবে তুলে ধরেছেন।

শিল্পী আফরোজা জামিল কংকা এবং মিনি করিম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। আফরোজা তাঁর দুটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে সুন্দরবনের গহন রূপটি তুলে ধরেছেন আলোছায়ার পর্দা তৈরি করে। সবুজ, হলুদ ও সাদা বর্ণের স্বচ্ছন্দ প্রয়োগ করে দৃষ্টিনন্দন দুটি ছবি এঁকেছেন মিনি করিম। শিল্পী ধনঞ্জয় ম-ল তিন দশক ধরে ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের আঁকা শেখান, নিজেও আঁকেন। এ-প্রদর্শনীতে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে নানা রঙের মিশ্রণে আঁকা তাঁর দুটি কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে।

দশম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র‍¨vন্ড পুরস্কার পেয়েছিলেন শিল্পী মোখলেসুর রহমান। পৃথিবীর নানা দেশে তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এ-প্রদর্শনীতে মিশ্রমাধ্যমে বাস্তবানুগ করে আঁকা তাঁর ‘শাপলার বন’ শিরোনামে কাঠখোদাই ছাপচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এটি  বাংলার জলমগ্ন প্রকৃতির মিষ্টি রূপকে আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

নানা মাধ্যমে কাজ করে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন এক দৈনিক পত্রিকায় কাজ করা তিন শিল্পী। তাঁরা হলেন শিল্পী অশোক কর্মকার, মাসুক হেলাল ও মাহবুবর রশিদ মজনু। অশোক কর্মকার ত্রিশ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। মাটি ও প্রাকৃতিক রং দিয়ে ক্যানভাসের কেন্দ্রস্থলে সরার বৃত্তাকার সারফেসে এক বংশীবাদকের ছবি এঁকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী চিত্রধারাকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। মাসুক কলম দিয়ে মোটারেখায় দুজন বিশিষ্ট মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। পত্রিকার পাতায় প্রায়শই তাঁর আঁকা নানা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর প্রতিকৃতি মুদ্রিত হতে দেখা যায়। মজনু জ্যামিতিক ও ঘুড়ির স্কয়ার ফর্ম নিয়ে নানাবর্ণে ক্যানভাসে নিজের শৈশবের স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন।

জ্যামিতিক বর্গ নিয়ে শিল্পী সৈয়দ সাইফুর রহমানও তাঁর চিত্রপটে নয়নরঞ্জক ছবি এঁকেছেন। তাঁর আরেকটি চিত্রের জ্যামিতিতে রাতের বেলায় নগরকেন্দ্রের ধোঁয়া-রঙিন আলোয় মাখামাখি রূপ উঠে এসেছে। আনোয়ার আরিফ ‘মাছের ভয়’ শিরোনামে নীল জলাশয়ে ও জালে আটক রঙিন একদল মাছের দুটি দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন।

শিল্পী হিরণ্ময় চন্দ অংকনপ্রধান কাজ করেন। এবার জলরঙে প্রকৃতির মুগ্ধতাকে এঁকেছেন। অলস বসে থাকা গরুর গায়ে আলতো বসে থাকা চঞ্চল এক পাখির চিত্রটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পশ্চাৎপটে ফেলে আসা গ্রাম, প্রাণ আর নিসর্গের মিলেমিশে থাকা জীবনকে।

বাংলার নিসর্গ নিয়ে বাস্তবানুগ ছবি আঁকেন আলতাফ হোসেন শরীফ। তিনি নদীর ধারে খুঁটির ওপর বসে থাকা বক ও অনতিদূরে নদীবক্ষক্ষ নৌকায় মানুষের পারাপারের চিত্র দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মিজানুর রহমান চিত্রপটে নদীর আবহ তৈরি করে একদল রঙিন মাছের অনুকৃতি যুক্ত করেছেন। মনোজ পাল আঁকেন আলোছায়াময় ফিগারেটিভ ছবি। শাহিন আকতার অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে জ্যামিতিক নানা বর্গ ও আয়ত নিয়ে খেলেছেন। ইশরাত শেখ জলাশয়ে শাপলার রূপকে শিশুর সারল্যে জ্যামিতিক ফর্মের মাধ্যমে বিশেস্নষণ করেছেন।

মানুষ ও প্রাণিজগতের প্রেম শিল্পীদের একটি প্রিয় বিষয়। ভাস্কর হাবিব কাঠখোদাই করে ফুল ও লতাপাতার আবহে দুই জোড়া পাখির পারস্পরিক আকর্ষণ তুলে ধরেছেন। রেজা লোহার রড প্রয়োগ করে গড়া তাঁর ভাস্কর্যে দুই দম্পতিকে তুলে ধরেছেন। সায়মা টাইলসে করা তাঁর দুটি চিত্রের একটিতে দম্পতির অবয়ব গড়েছেন। এই শিল্পীদের কাজে ভালোবাসার টান প্রতিফলিত হয়েছে।

নাকভিন খন্দকার অনুরূপ পোড়ামাটিতে দুটি পাখির অবয়ব ও বাঁশঝাড়ের গোড়ার আকৃতি গড়েছেন। মনে পড়ছে – আমাদের এই সহপাঠীর কল্যাণে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে খুব কাছ থেকে দেখা ও কথা বলার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি।

সেলিম আহ্মেদ টিভি নাটকের অভিনেতা, প্রচ্ছদশিল্পী, লেখক ও ভাস্কর। তিনি মাইক্রোফোনের নানা মুখ গড়েছেন রাজনীতি, টকশোর পক্ষ-বিপক্ষ উপলক্ষ করে। সহপাঠীদের সঙ্গে শিল্পী হিসেবে আমার অংশগ্রহণ বসন্ত ঋতুর বর্ণিলতার সঙ্গে প্রকৃতির পরিবর্তন, মেঘ-বৃষ্টির প্রভাব এসবকে কেন্দ্র করে আঁকা দুটি চিত্রকর্ম নিয়ে।

এ-প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের তিনজন বিশিষ্ট চিত্রকর। তাঁরা হলেন – অধ্যাপক শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী সৈয়দ আবুল বারক আলভী ও চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন। আমাদের কাজ দেখে শিক্ষক-শিল্পী রফিকুন নবীর অভিমত – অঙ্কনে ও কর্মসাধনায় এই শিল্পীদলের অনেকেই এগিয়েছে। বছরে একবার করে এই শিল্পীদলটির এক হওয়াকে অন্যদের জন্য অনুকরণীয় বলে তিনি এই শিল্পীদলকে অভিনন্দিত করেছেন।

চারুকলার জয়নুল গ্যালারি ১-এ আট দিনব্যাপী আয়োজিত এ-প্রদর্শনী চলেছে গত ১৫ মার্চ শুক্রবার পর্যন্ত।