প্রবহমান জীবন ও নারীর প্রতি ভালোবাসার কবিতা

আবুল হাসনাত
নুন-পূর্ণিমা  সৈয়দ শামসুল হক  বেঙ্গল পাবলিকেশন্ ঢাকা, ২০১৯ ২৪৫ টাকা

সম্প্রতি বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে রচিত এই গ্রন্থদুটি অপ্রকাশিত ছিল। সৈয়দ শামসুল হকের সৃজন-উৎকর্ষে খুবই আগ্রহ-উদ্দীপক হয়ে উঠেছে এ দুটি গ্রন্থ। একটির নাম নুন-পূর্ণিমা। অন্যটি অনুবাদ গ্রন্থ : আফ্রিকান ও অন্যান্য অনুবাদ কবিতা। দ্বিতীয় গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন পিয়াস মজিদ। গ্রন্থ-পরিচিতি বিভাগে আমরা নুন-পূর্ণিমা নিয়ে যৎসামান্য কথা বলব।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর সৃজন-উৎকর্ষ বহুমুখীন কর্মের যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে যে-কয়েকজন আধুনিকতার পথনির্মাণ করেছিলেন, সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘদিনের চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আবির্ভাবের প্রাথমিক লগ্নেই তিনি তাঁর সৃজন-প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, মৌলিক নাটক সৃজন, সাহিত্যের কলাম রচনায় ও
শেক্সপিয়র-অনুবাদে বৈশিষ্ট্যে ও জীবনের রূপায়ণে তাঁর সৃজন নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগকে তাঁর সৃজনবৈভব দ্বারা তিনি যে-উচ্চতায় স্থাপন করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর কবিতা ও গদ্য রচনার শৈলী উত্তরকালের জন্য অনুকরণযোগ্য হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের চর্চা ও সাধনা তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গিয়েছিল। তাঁর গদ্যের রীতি, নাটকের সংলাপ ও কাব্যভাষার বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যকে নবীন আবেগে উদ্দীপিত করেছে –
এ ব্যাপারে আজ আর সন্দেহ নেই।
সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণের পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিত্রচর্চায় ব্যাপৃত ছিলেন। এই সৃজনে ধরা আছে একজন সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয় ও মনের নানা স্তরের উন্মুখতা। কখনো মূর্ত ও কখনো বিমূর্ত রীতির প্রকাশে উজ্জ্বল হয়েছে তাঁর রচিত চিত্রগুচ্ছ। তাঁর শিল্পীমনও যে কত প্রাণময়, সজীব ও নানা ভাবনায় আলোড়িত ছিল এই চিত্রসমূহে তা অবলোকন করা যায়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি মননের প্রাখর্য ও মনীষার যে-স্বাক্ষর রেখেছেন – সেভাবে তাঁর চিত্রেরও সৃজনভূমি হয়ে উঠেছে নানাদিক থেকে তাৎপর্যময়।
সদ্য প্রকাশিত এই দুটি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পূর্বে। গ্রন্থদুটির পা-ুলিপি তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের কাছে রক্ষিত ছিল।
সৈয়দ শামসুল হকের নুন-পূর্ণিমা পাঠ করার পর আমরা মোহিত হয়েছি এবং বিস্মিত হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর শক্তিময়তা কত তীক্ষন ও তীব্র। ক্লামিত্ম, নৈরাশ্য ও বিতৃষ্ণার এবং নারীর জন্য আকুলতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর এই দীর্ঘ কবিতায়, তা আমাদের কাছে জীবনেরই বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে। কামনা ও বাসনা ডানা মেলে বটে তবে তা কোনো সীমা লঙ্ঘন করে না; জীবন তো বহুমাত্রিক, সূক্ষ্ম সংবেদন জলতরঙ্গের মতো হয়ে থাকে হৃদয়াবেগে।
প্রেমের কবিতার সমৃদ্ধ ভুবনে যে আবেগ, আকুতি ও ভাবনার জনম দেন সৈয়দ শামসুল হক তা হয়ে ওঠে নব-ভাবনায় সমৃদ্ধ। এই সৃজনে দেশপ্রেম ও সমকালীন জীবনযন্ত্রণাও মুখ্য হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ বিগত চার দশক ধরে যে সামাজিক সংকটের অন্তর্মুখীন চাপে বিপর্যস্ত হয়েছে তা যে-কোনো সৃজনশীল মানুষের জীবন
ও মননে হয়ে উঠেছিল এক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা। সেই
অভিজ্ঞতার বহুস্তর তাঁর কবিতার বিষয় এবং আমাদের যাপিত জীবন
তাঁর কবিতায় প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে। সময়ের আততি ও
দুঃখ-কষ্ট এবং যাতনার ছবি পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে উচ্চকিত এক বোধ তৈরি করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের হাতে যখন গুঞ্জরিত হয় এই বোধ তখন তা হৃদয়ে গেঁথে যায়। সেই কবে আমরা তাঁর ক্ষীণকায় একটি কাব্যগ্রন্থ বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা পাঠ করে স্পন্দিত হয়েছিলাম। আশা ও নৈরাশ্যের এবং দৈনন্দিনতার যে সরব উপস্থিতি আছে এই গ্রন্থে তা আমাদের কাব্যরুচিতে নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছিল। এখনো বহুল আলোচিত তাঁর বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা। অনন্য এই গ্রন্থটিতে হতাশা ও ক্লেদের মধ্যে জীবনযন্ত্রণার যে ছাপ আছে তা আমাদের কাব্যাঙ্গনে ভিন্ন মর্যাদাবান হয়ে আছে। এ ছাড়া তাঁর রচিত পরানের গহীন ভিতর এবং দীর্ঘ কয়েকটি কবিতা যে-কোনো কবিতাপাঠকের জন্য হৃদয়গ্রাহী আগ্রহের বিষয়।
মৃত্যুর আগে রচিত নুন-পূর্ণিমা কাব্যগ্রন্থে এই বহুগুণান্বিত কবি দীর্ঘ এক কবিতায় প্রবহমান জীবন ও নারীর প্রতি ভালোবাসার
যে-ছবি অঙ্কন করেছেন তা তীব্র, সূক্ষ্ম সংবেদনে বাংলা কবিতায় এক নবীন মাত্রা সংযোজন করবে বলে আমাদের প্রতীতি জনেমছে। ক্লেদ, গস্নানিও উপেক্ষেত হয়নি এই কাব্যগ্রন্থে, অন্যদিকে এই কবির নারীর জন্য গহন-গভীর আকুলতা ভিন্ন ভুবনের দরজা হাট করে খুলে দেয়। কবিতার সৃজন, মননধর্মে ও স্বাতন্ত্র্যে তিনি যে কত শক্তিমান
এ-কাব্যগ্রন্থে তার বিচ্ছুরণ আছে। এই দীর্ঘ কবিতা জীবনের বিশেষ রূপ প্রকাশে উজ্জ্বল; প্রেমধর্মের সুবিসত্মৃত বোধেও মহিমাময়। দীর্ঘ
এ-কবিতার প্যারা শুরু হয় এমন এক পঙ্ক্তি দিয়ে :
মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন,
চিকন লিকলিকে একটা সাপ যেমন ছিদ্রপথ গলিয়ে
টুক করে খসে পড়ে ঘরের মেঝেয়,
ওই পঙ্ক্তিটি হঠাৎ
হাসান চৌধুরীর করোটিতে হিলহিল করে ওঠে।
এই সেই হাসান চৌধুরী। তাঁর প্রেম কিংবা কোনো নারীর জন্য আকুলতা আমাদের নিয়ে যায় মগ্নচৈতন্যে কিংবা কখনো বাস্তবতায়।
তিনি বলেন, আমরা আবার দেখা পাব হরিষাল গ্রামে। কোথায় সেই হরিষাল গ্রাম? তাঁর ভাষায়,
জলেশ্বরী থেকে আধকোশা নদী পার হয়ে গো-গাড়িতে
প্রথমেই মান্দারবাড়ি,
তারপর হাগুরার হাট,
তারপর পাথারের পর পাথার,
পাথারের মধ্যে দু-একটি প্রাচীন গাছ,
সেইসব দিকচিহ্ন ধরে – নইলে পথ হারাবার ঘোর সম্ভাবনা –
মাইলের পর মাইল চলবার পর, এবং
পিপাসায় না পানি পেয়ে,
ক্ষুধায় না কোনো জলপানের দোকান,
ধুঁকতে ধুঁকতে একসময় পৌঁছে যাওয়া যায় হরিষাল গ্রামটিতে।
হরিষালের ওপারেই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
পিলার চিহ্নিত স্পষ্ট যদিও সীমান্ত, কিন্তু সীমান্তের চৌকি থেকে দূরে,
অনেক দূরে, এই পাথার, মাজার ও গ্রামের মানুষের পায়ে পায়ে
অনবরত সে লঙ্ঘিত।
এই কবিতাবলি আমাদের সীমান্তের সন্নিকটে হরিষাল গ্রামে নিয়ে যায়। গ্রামটির নিখুঁত বর্ণনা মানুষের দৈনন্দিন যাপন আমাদের আত্মসচেতনতার বোধকে প্রখর করে। পরাবাস্তবতার সীমাকে লঙ্ঘন করে হয়ে ওঠে জীবনের অনুষঙ্গে সজীব – সৈয়দ শামসুল হক
এ গ্রন্থে তা প্রমাণ করেছেন। নুন-পূর্ণিমায় আছে ব্যক্তির সুখ-দুঃখ। আর এ খুঁজবার গরজে তিনি প্রাণময় অবয়বে এমন রূপ দেন যা ভিন্নমুখ এক চলনে কল্পনালতায় হয়ে ওঠে আশ্চর্য এক একটি ছবি। তাঁর বর্ণনা নিখুঁত, এবং কিছুটা মন্তাজের সঙ্গে চলচ্চিত্রিক। একটি অনুষঙ্গ ভিন্ন অনুষঙ্গে প্রবেশ করে।
এই সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষজনের জীবন অভিজ্ঞতা এবং
কিংবদমিত্মতুল্য বাস্তবতা, মানুষের জীবন, সংগ্রাম, আবার ঘুরেফিরে আসা সেই পঙ্ক্তি, ‘মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন’ আমাদের অভিজ্ঞ করে তোলে। গল্প নিয়ে, ব্যাপ্তি নিয়ে ফিরে আসে তাঁর এই সৃজনে ফের জলেশ্বরী, তাঁর সৃজনভূমির এক বিসত্মৃত ভুবন, যেখানে নানা রূপে ও অবয়বে নানামাত্রিক জীবনকে তিনি উন্মোচন করেছেন অঙ্গীকারে ও মহৎ লেখকের দায়ে। হরিষাল বিসত্মৃত জনপদ নয় বটে তবে বেঁচে থাকার আর্তি ও মর্মযাতনা নিয়ে কতভাবেই না মানুষের জীবনসংগ্রামের রূপ ও স্তর গহন হয়ে ওঠে। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের কবিতার ভুবনে যে শক্তিমান কবি
এ গ্রন্থটিতে তিনি আর একবার তার স্বাক্ষর রেখেছেন।