প্রসঙ্গ নজরুল : কিছু কথা

শান্তি সিংহ

বাংলার কবি নজরুল ইসলাম (২৪ মে, ১৮৯৯-২৯ আগস্ট, ১৯৭৬)। বাংলা-কবিতার ইতিহাসে চিরকাল ভাস্কর থাকবে তাঁর নাম। স্বাধীনতাপ্রিয়, অন্যায়-প্রতিবাদী, প্রেমময় এ-পুরুষ দীর্ঘকাল শরীরধারণ করলেও তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির কাল মাত্র বাইশ বছর (১৯২০-৪২)।

বর্ধমান জেলায়, রানিগঞ্জের কাছে সিয়ারসোল স্কুলে নজরুল পড়েছেন। বিপ্লবী যুগান্তর দলের নিবারণ ঘটক ছিলেন নজরুলের স্কুলশিক্ষক। শেখ গোদার লেটোর দলে লেটোর গানবাঁধা ও গাওয়ায় দক্ষ নজরুল রাঢ় বাংলার রুক্ষবন্ধুর নিসর্গপ্রকৃতির বুকে মুক্ত জীবনানন্দে তখন উদ্দীপ্ত। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, দশম শ্রেণির প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে যোগ দেন ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। সাধারণ সৈনিক থেকে ‘কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার’ হন। অথচ সেই সৈন্য দলটিকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হয়নি। করাচি-সেনাবাস থেকে তিনি কলকাতার নানা পত্রিকায় পদ্য ও গদ্য লেখা পাঠাতে শুরু করেন। সে-সময়, সওগাত পত্রিকায় ‘বাউন্ডেলের আত্মকথা’ কিংবা বঙ্গীয় মুসলমান পত্রিকায় ‘মুক্তি’ নামে কবিতা প্রকাশ পায়। তাঁর ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’ গল্প সে-সময় প্রকাশিত হয়।

১৯২০ সালের মার্চ মাসে, ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে যায়। নজরুল ফিরে আসেন কলকাতায়। তাঁর প্রথম দিকের আস্তানা ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সমিতির দফতর (৩২ কলেজ স্ট্রিট)। মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন সেখানে। সে-সময় নজরুলের বাঁধনহারা উপন্যাস মোসলেম ভারত পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকে। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই থেকে প্রকাশিত হয় সান্ধ্য দৈনিকপত্র নবযুগ। পত্রিকাটির সম্পাদনায় ও লেখালেখিতে মুখ্য ভূমিকা নেন নজরুল। পত্রিকার অন্যতম সহযোগী লেখক মুজফ্ফর আহমদ। রাজরোষে পত্রিকাটি বন্ধ হয়।

ভারতজুড়ে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল সংঘটিত হয়েছ জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ড। ইংরেজের হত্যালীলা ও দমননীতির প্রতিবাদে কলকাতায় বিশেষ অধিবেশন হয় ১৯২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। নাগপুরে সাধারণ অধিবেশনে কংগ্রেস সহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। আন্দোলনে জোর দেওয়া হয় চরকা-খদ্দর, অস্পৃশ্যতা ও মাদকবর্জন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য।

কবি নজরুলের প্রথম মুদ্রিত (অক্টোবর, ১৯২২) কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা। প্রথম সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন স্বয়ং গ্রন্থকার। ঠিকানা : ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেন, কলকাতা। দু’হাজার কপি ছাপা হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের পর, নজরুল ‘রাজদ্রোহ-অপরাধে’ কারাগারে বন্দি। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ পরের বছর করে কলকাতা কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে আর্য পাবলিশিং হাউস। দু-হাজার কপি ছাপে। প্রকাশক শরচ্চন্দ্র গুহ নিবেদনে জানান : ‘অগ্নি-বীণার দ্বিতীয় সংস্করণ বার হল। প্রথম সংস্করণের দু’হাজার বই ক’মাসের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।… কবি নজরুল ইসলাম আজ রাজদ্রোহ-অপরাধে বন্দী। তাঁর অবর্তমানেই বর্তমান সংস্করণটি আমাদের বার করতে হ’ল।’

এই গ্রন্থভুক্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পূর্বে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়, নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে সম্মানিত হন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (মাঘ ১৩২৯) গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে লেখে : ‘…এতদিন বাংলার কাব্যকুঞ্জে প্রেমের কবিতাই অজস্র ফুটিত; বীর-বীণার ঝঙ্কার ক্বচিৎ শুনা যাইত। কিন্তু ‘অগ্নিবীণা’র প্রতিটি কবিতাই বীরত্বব্যঞ্জক – মরণোন্মুখ জাতির প্রাণে নব উদ্দীপনার সঞ্চার করিবে। নৃত্যদোদুল ছন্দের লীলায়িত ভঙ্গিমা-বিকাশে কবি অপূর্ব গুণপনা দেখাইয়াছেন।… হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্র-সিন্ধু মন্থন করিয়া কবি যে-সব অনুপম উপমা সংযোজন করিয়াছেন, তাহাতে মুগ্ধ হইতে হয়। জাতীয় জাগরণের দিনে অগ্নিবীণার বীরোদাত্ত বাণী বাঙালি জাতি আদরের সহিত গ্রহণ করিবে বলিয়াই বিশ্বাস।… শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত প্রচ্ছদখানি পুস্তকের শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে।’

প্রবাসী পত্রিকায় (মাঘ, ১৩২৯) লেখা হয় : ‘এই কবির বিশেষত্ব তাঁহার ছন্দের বৈচিত্র্যে, উপল-বিষম ঝর্ণাধারার মতন শব্দের ঝঙ্কারে, অগ্নিগিরির উচ্ছ্বাসের মতন আবেগময় ভাবের উদ্দাম প্রবাহে, বন্যাস্রোতের মতন প্রবল আগ্রহে, বলিবার শক্তিমান ভঙ্গিতে এবং হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্য-ইতিহাস-ধর্ম ও সভ্যতার ধারার ও চিন্তাপ্রণালীর সঙ্গে সুপরিচয়ে দুইয়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাইবার অসাধারণ শক্তিতে। এই বইখানির নাম অগ্নিবীণা সার্থক হইয়াছে -।’

অথচ ছিদ্রান্বেষী-বাঙালি স্বভাবে, কিছু মানুষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হিন্দু-পুরাণের অত্যধিক প্রয়োগে কবির প্রতি রুষ্ট হয়েছেন                 সে-সময়। আবার ওজোধর্মী ‘বিদ্রোহী’ কবিতার হাস্যকর প্যারোডি লিখেছেন কোনো বিদূষণকারী।

দোলন-চাঁপা নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল : ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (আশ্বিন, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ)। সাম্যবাদী পত্রিকায় (১৩৩০ ফাল্গুন) লেখা হয় : ‘দোলন-চাঁপার কবিতাগুলি করুণরসপ্রধান হওয়াতে, তাহাতে কবির প্রতিভা যতখানি সার্থক হইয়াছে, তাহা অপেক্ষা অনেকখানি ব্যর্থ হইয়াছে।… নজরুল ইসলামের যাহা বিশেষত্ব – এসলামী তেজ, তাহা এগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না।’

বিষের বাঁশী নজরুল ইসলামের তৃতীয় মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল : আগস্ট ১৯২৪। প্রকাশক স্বয়ং গ্রন্থকার। হুগলির ঠিকানা। পরিবেশক ডি.এম. লাইব্রেরি। প্রচ্ছদশিল্পী দীনেশরঞ্জন দাশ।

উৎসর্গপত্রে কবি লেখেন : ‘বাংলার অগ্নি-নাগিনী মেয়ে, মুসলিম-মহিলাকুলগৌরব, আমার জগজ্জননীস্বরূপা মা – মিসেস এম রহমান সাহেবার পবিত্র চরণারবিন্দে -।’ ‘কৈফিয়ত’ শিরোনামে কবি স্পষ্টভাবে লেখেন : ‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খন্ড নাম দিয়ে, তাতে যে-সব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশী’ নামকরণ করলাম।’

বিদ্রোহ-বহ্নির মাঝে কবি ‘স্বরাজ-সিংহদুয়ারে’র স্বপ্ন দেখে  লেখেন ‘চরকার গান’ – ‘তোর ঘোরার শব্দে ভাই/ সদাই শুনতে যেন পাই/ ওই খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।/ ঘুরে আসল ভারত ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর।’

কবি আরো বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর/ তাঁদের মিলন সূত্র-ডোর রে/ রচলি চক্রে তোর,/ তুই ঘোর ঘোর ঘোর।’  ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্’ (আবির্ভাব) কবিতায় কবি বলেন – ‘মস্ তা ন!/ ব্যস থা ম্!/ দেখ্ মশগুল আজি শিস্তান-বোস্তান/ তেগ গর্দানে ধরি দারোয়ান রোস্তাম/ কাজে কাহর্বা বাজা গুল্জার গুল্শান/ গুল্ফাম!’

‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্’ (তিরোভাব) কবিতায় কবি লেখেন –

রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান?

তারও বুক বেয়ে অাঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান!

জমিন্-আস্মান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্রাক্

চিখ্ মেরে কাঁদে ‘আরশে’র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক!

 

বিষের বাঁশীর বিখ্যাত কবিতা ‘অভিশাপ’। তার প্রথম দু-লাইন –

আমি    বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!

মম     চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।

‘শিকল-পরার ছল’ কবিতায় যৌবনদৃপ্ত কবি বলেন –

এই    শিকল-পরা ছল মোদের, এ শিকল-পরা ছল।

এই    শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবির রাজবন্দীর জবানবন্দি ডি.এম. লাইব্রেরি থেকে ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত। তৎকালীন একাধিক পত্রিকায় রচনাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। মুজফ্ফর আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘নজরুল একটি লিখিত বিবৃতি আদালতে দাখিল করেছিল।’ (পৃ ১৬৫)। তবু ইংরেজ সরকার ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি, সুইনহোর আদালতে নজরুলকে এক বছর মেয়াদে কারাদন্ড দেয়।

রাজবন্দীর জবানবন্দি থেকে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করা যায় :

আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।

একধারে রাজার মুকুট। আর ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদন্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দন্ড।… আমার পক্ষে – সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অন্তকাল ধরে সত্য – জাগ্রত ভগবান।… রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে – রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ। রাজার বাণী বুদ্বুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র। আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান-কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী।…

নজরুল ইসলামের চতুর্থ মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ ভাঙার গান। (প্রচ্ছদে আছে : ‘ভাঙ্গার গান’) প্রকাশকাল : আগস্ট, ১৯২৪। প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে, ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর, সরকারি নির্দেশে গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয়। (ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয় ১৯৪৯ সালে)

‘ভাঙার গান’ শীর্ষক গান/ কবিতা স্বদেশিযুগে/ স্বদেশ-চেতনাযুক্ত সবার মুখে মুখে শোনা যেত। যথা – ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট/ ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট,/ রক্ত জমাট শিকল পূজার               পাষাণ-বেদী,/ ওরে ও তরুণ ঈশান/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’

‘ঝোড়ো গান’ কীর্তন-সুরে বেশ মজাদার –

আমি   দামোদরের বান/ খোশখেয়ালে উড়াই ঢাকা, ডুবাই বর্ধমান।

আর,   শিবঠাকুরকে কাঠি করে বাজাই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ড্রাম

আমরা জানি, ১৯২২ সালে কামাল পাশা তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। বিদেশি শাসন থেকে তুরস্ককে মুক্ত করার সঙ্গে তিনি খলিফার পদ তুলে দেন। নজরুল ‘কামাল পাশা’ কবিতায় দৃপ্ত আবেগে লেখেন – ‘মার্ দিয়া ভাই মার্ দিয়া/ দুশ্মন্ সব হার গিয়া!/ কিল্লা ফতে হো গিয়া!’ সেইসঙ্গে যোগ করেন, ‘আজ    স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্তও না চাই!’

অগ্নিবীণা কাব্যের বিশিষ্ট কবিতা ‘কামাল পাশা’।

লক্ষণীয়, ১৯২০ থেকে ১৯২৪ – এই চার বছরেই বাংলা কবিতার প্রদীপ্ত কবিব্যক্তিত্ব নজরুল ইসলাম। পরাধীন বাংলা তথা ভারতের ঘন তমসার বুকে জ্বলন্ত অগ্নিমশালের লেলিহান শিখার দীপ্তি তাঁর কবিতায়। জন্মসালের বিচারে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) নজরুলের সমকালীন কবি। ঝরা পালক কাব্যে (১৯২৭) জীবনানন্দ নজরুলের কাব্যবিভামুক্ত হতে পারেননি। জীবনানন্দের স্বাতন্ত্র্য কবিব্যক্তিত্ব প্রথম চিহ্নিত হয় ধূসর পান্ডুলিপি কাব্যে (১৯৩৬)। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত বনলতা সেন কাব্যে জীবনানন্দ স্বয়ম্প্রভ। কবি নজরুলের কাব্যপ্রতিভা শারীরিক অসুস্থতার কারণে তখন অস্তাচলে। অথচ কালের বিচারে, সেই স্বল্প পরিসরে, নজরুল নানা ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নানা ছন্দে, নানাভাবে বিপুল  পরিমাণ সংগীত-রচনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ষাট বছরের অধিককাল সৃষ্টিশীল থেকে যে-পরিমাণ সংগীত রচনা করেছেন, সংখ্যার বিচারে তার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক নজরুলগীতি কবি রচনা করেছেন মাত্র কুড়ি-বাইশ বছরের কালসীমায়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আলোয়ভরা বেদনার শতদল। সেখানে নেই শরীরী কামনা-বাসনার তীব্রতা। তাঁর বিরহের বীণাপাণি অশ্রু শতদলের পেলব পাপড়িতে সুরের অনুরণন জাগায়। অথচ নজরুলের প্রেমের গানে সুতীব্র আবেগ (passion) কামনাসংরক্ত ব্যথায় পদ্মার ঢেউ হয়, স্মৃতি হাস্নুহানার মদির গন্ধে উন্মনব্যাকুল, বিরহবিধুর হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

 

দুই

নজরুল ইসলামের প্রথম মুদ্রিত গদ্য রচনাসংকলন যুগবাণী। তা প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের অক্টোবরে। প্রকাশক গ্রন্থকার।              পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২+৯২। মূল্য এক টাকা। মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় : লেখাগুলি ১৯২০ সালে নবযুগে ছাপা হয়। রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ লেখার অভিযোগে ইংরেজ সরকার ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর যুগবাণীর সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে।

আমরা জানি, ১৯২০ সালের ১০ মার্চ, মহাত্মা গান্ধী খিলাফত আন্দোলনের সমর্থনে অসহযোগের বিশেষ কর্মসূচি প্রকাশ করেন। তিলক, মোতিলাল নেহরু, মালব্য যোগ দেন গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মহম্মদ, শওকত আলী, সৈফুদ্দীন কিচ্লু অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। কবি নজরুল ইসলাম সে-সময়ে অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। কুমিল্লার জনসভায় যোগদানের সঙ্গে প্রতিবাদী গানও লেখেন নজরুল। ১৯২০ সালে হিজরতকারীদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে তীব্র ভাষায় নজরুলের লেখার জন্য নবযুগের জামিনের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়। নজরুল ইসলাম লেখেন, ‘আজ মহা বিশ্বে মহা জাগরণ, আজ মহা মাতার মহা আনন্দের দিন, আজ মহা মানবতার মহা যুগের মহা উদ্বোধন! … এসো ভাই হিন্দু! এসো মুসলমান! এসো বৌদ্ধ! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ (নবযুগ)।

যুগবাণীর ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’ প্রবন্ধে নজরুল গভীর বিশ্বাসে লেখেন – ‘আমাদের বাংলার মুসলমান সমাজ যে বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, এবং অত্যল্পকাল মধ্যে আশাতীতভাবে উন্নতি দেখাইয়াছেন, ইহা সকলেই বলিবেন;… বাংলা সাহিত্যে পাকা আসন দখল করিবার জন্য সকলেরই মনে যে একটা তীব্র বাসনা জাগিয়াছে, এবং ইহার জন্য আমাদের এই নূতন পথের পথিকগণ যে বেশ তোড়জোড় করিয়া লাগিয়াছেন, ইহা নিশ্চয়ই সাহিত্যে আমাদের জীবনের লক্ষণ।… বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাদের লেখার জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝরনার মতো ঢেউভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি আনিতে হইবে।’

‘ছুতমার্গ’ প্রবন্ধে নজরুল স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সত্যিকার মিলন আর স্বার্থের মিলনে আসমান জমিন তফাত। প্রাণে-প্রাণে পরিচয় হইয়া যখন দুইটি প্রাণ মানুষের গড়া সমস্ত বাজে বন্ধনের ভয়-ভীতি দূরে সরাইয়া সহজ সংকোচে মিশিতে পারে, তখনই সে মিলন সত্যিকার হয়; আর যে মিলন সত্যিকার, তাহাই চিরস্থায়ী, চিরন্তন।’

‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ প্রবন্ধে নজরুল লেখেন – ‘আজ আমাদের এই নূতন করিয়া মহা জাগরণের দিনে আমাদের সেই শক্তিকে ভুলিলে চলিবে না – যাহাদের উপর আমাদের দশআনা শক্তি নির্ভর করিতেছে, অথচ আমরা তাহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছি।’

নজরুল ইসলাম নিজের সম্পর্কে কবিতায় একদা লিখেছেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী।’ অথচ তাঁর আবেগ-স্পন্দিত কথায় বিনয়ের ভাবও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা না হলে, তাঁর কবিতা ও গদ্যরচনা পরবর্তীকালে, বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলনে তথা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাসঞ্চারী হতো না। তাঁর লেখা ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’ প্রবন্ধটি সমকালীন প্রেক্ষিত ছাপিয়ে কালোত্তীর্ণ।

পরিশেষে, নজরুলের ‘মুশকিল’ প্রবন্ধের একটি বাক্য উদ্ধৃত করছি, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক শাহবাগ আন্দোলন অবধি আলোকবর্তিকারূপে প্রেরণাসঞ্চারী : ‘আজ এ দেশের প্রত্যেকের প্রাণের প্রদীপ মুক্তির অগ্নিস্পর্শে জ্বলে-ওঠা চাই, সমস্ত দেশে আজ নতুন করে নবজাগরণের বিপুল সাড়া জাগিয়ে তুলতে হবে, আজ এমন প্রচন্ড আগুন-জ্বালা চাই, স্বাধীনতার শান্তিবারি ছাড়া যার প্রশমন হতে পারে না।’

‘তোমার পণ কী’ প্রবন্ধে নজরুলের কণ্ঠস্বর আজো উদ্দীপ্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের। নজরুল বলেন, ‘শত্রুরা একবার শেষ চেষ্টা করিতেছে, দেশে-দেশে দানবরাজেরা ভীষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে।’ তাই ‘নিশান-বরদার’ প্রবন্ধে উদাত্তকণ্ঠে সৈনিককবি নজরুল যুব সম্প্রদায়কে ডাক দেন আজো : ‘এসো দলে দলে নিশানধারী ভাইরা আমার। নিজেকে সৈনিক বলে প্রচার করি, এসো। এসো, শয়তানকে অর্ধেক পুঁতে ফেলে, তার মাথার উপর তাদেরই মাথার মগজের চর্বি দিয়ে চেরাগ জ্বালাই। শয়তানকে দগ্ধ করে মারতে হবে।’ স্পষ্টত বোঝা যায় : যাবতীয় অন্যায়, অবিচারের প্রতিকারে কবি নজরুল আজো যৌবনের দূত।