প্রাণিজগতের গন্ধ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

কনস্টেবল সুবল যখন আম্বর আলির গল্পটা বলছিল চার ইয়ার-দোস্তকে, একটা চৌকির ওপর বসে, ঘরের দরজাটা যে সে লাগাতে ভুলে গিয়েছিল, সে-কথা তার মনে পড়েনি। গল্পের শুরুটাতে হাসি ছিল। একটুখানি খোলা দরজা দিয়েও, আমরা দেখেছি, হাসির আওয়াজ বেগে ধায়। ওসি শুনে কপাল কুঁচকে ছিলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু সুবলদের হাসিটা শিগগির মিলিয়ে গেল, ওসির কপালের ভাঁজও সমান হয়ে গেল। কিন্তু সুবলের গল্পের দু-এক টুকরা শোনার জন্য কেন জানি তিনি তার কানটা পেতে রইলেন। তিনি শুনলেন, সুবল জিজ্ঞেস করছে তার ইয়ার-দোস্তদের, যারা তার মতোই কনস্টেবল, ‘মানুষ মরে গেলে আস্তে আস্তে তার শরীর কেন শক্ত হয়ে যায়?’ এ-কথার উত্তর কনস্টেবলরা জানে না, তারা বলল ‘খোদা জানে’, কিন্তু ওসির মনে হলো তিনি উত্তরটা জানেন। ‘রাইনার
মার্টস’, তিনি মনে মনে বললেন, কিন্তু এটি আসলে কেন হয় সে-বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। ‘রক্ত বোধহয় একসময় শক্ত হয়ে যায়, তাই না, ফলে শরীরও শক্ত হয়ে যায়,’ তিনি নিজেকেই যেন বললেন, বলতে বলতেই তিনি শুনলেন। সুবল বলছে, ‘আম্বর মিয়ার ধনটা এমন খাড়া হয়ে শক্ত হয়ে ছিল যে তাকে গোসল দেওয়ার সময় সমস্যা হয়েছিল।’ সুবলের ইয়ার-দোস্তরা এবার একচোট হাসল, ‘ধন কেন খাড়া হয়ে ছিল?’ একজন জিজ্ঞেস করল। ‘কেন আবার’, সুবল বলল, কিন্তু ওসির মোবাইল ফোনে রিং হলো। সুবল কী বলেছিল তা তার আর শোনা হলো না। আমাদেরও না।
ওসির ফোনের রিং টোন ‘আমি বাংলায় গান গাই।’ সেটি এতো জোরে বাজল যে সুবল মিয়া চমকে খোলা দরজার দিকে তাকালো। তারপর চৌকি থেকে উঠে পেছনের দরজা দিয়ে পালালো। তার চার ইয়ার-দোস্তও। ওসিকে ফোন করেছিলেন আলাউদ্দিন মৃধা এমপি। দুদিন ধরে ওসিকে তিনি মনে মনে খুঁজছিলেন, কিন্তু ফোন করার সময় হয়নি। তিনি জানতে চেয়েছেন, আম্বর আলিকে যারা কুপিয়ে মারল তাদের হদিস ওসি পেয়েছেন কিনা। আম্বর আলি একসময় ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন, যখন মৃধাও সেই ইউনিয়নের মেম্বার ছিলেন। বেশি না, আট-নয় বছর আগে। এই আট-নয় বছরে মৃধার আকাশে চাঁদ শুধু হেসেছে। জ্যোৎøা ঝরে পড়েছে তার সকল কাজ অথবা অকাজের ওপর। মেম্বার থেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন, দলের জেলা পর্যায়ের নেতা বনে যাওয়া খালেক মুন্সির ল্যাংড়া মেয়ে নাঈমাকে বিয়ে করার পুরস্কার হিসেবে, পরে জেলা দলের সদস্য হয়েছেন। তিন বছর আগে মুন্সি তাকে উপজেলা চেয়ারম্যান করেছেন, মেয়েকে একটা ছেলে উপহার দেওয়ার জন্য। এবার নির্বাচনে এমপি হওয়ার জন্য মুন্সির নামটা ছিল প্রথমে, যেহেতু এতদিন যে লোক এমপি ছিলেন, প্রদীপ দস্তিদার, তিনি হঠাৎই দেহরক্ষা করলেন। কিন্তু মুন্সির আকাশে বলা নেই কওয়া নেই, মেঘ জমে ঝড় উঠল, এক জনসভার মঞ্চ ভেঙে তিনি নিচে পড়ে গেলেন। তার কোমর দুইখানে ভেঙে গেল। যাক যেসব কথা। আট-নয় বছরে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে একেবারে এমপি হয়ে যাওয়ায় মৃধার চলনে-বলনে এলো বিরাট পরিবর্তন। এমপি হয়েই বিনাশুল্কে তিনি এক প্রাডো গাড়ি কিনলেন, তিনটি স্যামসং মোবাইল ফোনও, যেহেতু একটা ফোনে মানুষের মর্যাদাটা ঠিকমতো ধরা পড়ে না। যাক যেসব কথা। কিন্তু অন্যসব ভুলে গেলেও যা বা যাদের মনে রাখা উচিত আমাদের, তা বা তারা হলো তার চারপাশে ঘিরে থাকা ভয়ানক চেহারার কিছু লোকজন। আম্বর আলি একদিন গুনে দেখেছিলেন, ১৭ জন। মৃধা যখন ওসিকে ফোন করেন, ওই ভয়ানক চেহারার একজনই তাকে ফোনটা লাগিয়ে দিয়েছিল। ‘নেন, এমপি সাবের লগে কথা কন,’ লোকটা প্রায় ধমকের সুরেই বলেছিল ওসিকে। অথচ এমপি হওয়ার আগে মৃধা যথেষ্ট সম্মান করতেন ওসিকে। ওসি তখন নতুন এসেছেন এই থানায়। একদিন এক টুকরি আম তাকে পাঠিয়ে দিয়ে দুইবার ফোনে মৃধা জানতে চেয়েছিলেন, আম পছন্দ হয়েছে কিনা ওসি সাহেবের।
আমের স্মৃতি নিয়ে কোনো কাতরতা নেই ওসির। তার কাতরতা বরং তার বর্তমান অসহায়ত্ব নিয়ে। মৃধা জানতে চেয়েছেন, ওসি কেন আম্বর আলির খুনিদের ধরতে পারেননি। ‘বাহাত্তর ঘণ্টা তো পার হয়ে গেল ওসি সাহেব,’ ভয়-ধরা গলায় মৃধা জানতে চাইলেন, ‘প্রোগ্রেস নাই কেন? নাকি টাকা খেয়ে বসে আছেন খুনিদের থেকে, নাকি ধরেও ছেড়ে দিয়েছেন? ছেড়ে না দিলে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন?’ মৃধা এরপর সাত-আটটি নাম দিলেন ওসিকে। ‘ধরেন, হাতে কড়া লাগান, থানায় এনে প্যাঁদানি দেন। সব কথা পেট থেকে বেরিয়ে আসবে।’ মৃধা উপদেশ দিলেন, রশিদ মিয়ার তিন ছেলে আর বরুণ দস্তিদারের দুই ভাতিজাকে ধরে এনে তাদের পশ্চাৎদেশ দিয়ে বংশদণ্ড ঢুকিয়ে দিলে তারা কথা বলবে। ওসি শুধু ‘জি স্যার, হ্যাঁ স্যার’ ইত্যাদি বলছিলেন। তিনি জানেন, তার ওপর মৃধা বেশি নাখোশ হলে তার জন্য খবর আছে।
‘আমার পেছনে মিডিয়া লাগছে, বুঝলেন ওসি সাহেব,’ মৃধা বললেন। ‘কিছু একটা করেন। মিডিয়ায় লেখালেখি হইতাছে। টক শোতে শোরগোল উঠতাছে। আম্বর আলি ছিল আমার আপন ভাইয়ের মতো। ভুল বললাম, আপন ভাই থেকেও আপন। কিছু বুঝলেন?’
কথা বলতে বলতে ওসির বিমর্ষ লাগছিল। আম্বর আলির বউটাকেও খুনিরা ধরে নিয়ে গেছে। সেরকমই তার এবং তার থানার ধারণা। কিন্তু মৃধা একশ ভাগ নিশ্চিত সে বেঁচে আছে। আম্বর আলির খুনিদের ধরার পাশাপাশি এখন তার বউটাকে খুঁজে বের করার কাজটাও ওসিকে জোরেশোরে করতে হবে। এ তিনদিন তিনি এ-কাজটি যে করেননি তা নয়, কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিলো : আম্বর আলিকে মারতে গেল যে পাঁচ-ছয়জন, তারা কেন তার বউটাকে পালাতে দেবে? মেরে ফেলাটাই ছিল যুক্তিযুক্ত, কিন্তু বউয়ের লাশটা যেহেতু কোথাও পাওয়া যায়নি; আম্বর আলির শোবার ঘরে, উঠানে কোথাও যেহেতু আম্বর আলি ছাড়া আর কারো জখম বা খুন হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি, ওসি নিশ্চিত হয়েছেন, মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মৃধা জোরের সঙ্গে এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলে ওসিও একটু ধন্ধে পড়লেন। ব্যাপারটা কী?
ওসির ধন্ধে পড়ার মূল কারণ, যারা আম্বর আলিকে খুন করেছে, তারা কে সে সম্পর্কে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত। মোটামুটি কেন, তিনি শতভাগ নিশ্চিত। তাদের নামও তিনি জানেন Ñ মোতালেব, পনির, মাছুম, কালা বদি। আরো এক-দুজন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত হলেও, তাদের নাম জানলেও তিনি তাদের ধরতে পারবেন না।
কারণ তারা মৃধার ওই ১৭ জনের পাঁচ-ছয়জন।

দুই
ওসির ধন্ধের আরেকটি কারণ, আম্বর আলির বউটা যদি পালিয়েই গিয়ে থাকে তাহলে মৃধা তো তাকে খুঁজে বের করার জন্য নিজের লোকজনকেই লাগাবে। ওসিকে তার প্রয়োজন হবে কেন? তাছাড়া যে পাঁচ-সাতজন খুনির নাম ওসি জানেন, তারা পাকা খেলোয়াড়। একটি মেয়ে হাত গলিয়ে বেরিয়ে যাবে, হাওয়া হয়ে যাবে, বিশ্বাস করা যায়? তাছাড়া, মৃধা যখন আম্বর আলির বউয়ের কথা বললেন, তার কথায় একটা তাড়া ছিল, একটা ব্যক্তিগত আবেগের বিষয় যেন ছিল। অথচ আম্বর আলির খুনিদের পাকড়াও করতে যখন বললেন মৃধা, তার গলাটা শোনালো আর দশটা এমপির মতো, অথবা ঢাকার কোনো পুলিশকর্তার মতো। যেন আম্বর আলি তার পার্টির এক মাঠকর্মী আর তার বউটা তার নিজের মানুষ, খালাতো বোন অথবা দাইমার মেয়ে, না হয় স্ত্রী নাঈমাকে যে সেলাই শেখায়। আম্বর আলির বউ অবশ্য সত্যি সত্যিই সেলাই শেখাত নাঈমাকে, কিন্তু সেজন্যেই কি মৃধার গলায় এতটা উদ্বেগ ঢালতে হবে? ‘কোথায় যে আছে মেয়েটা, কী কষ্ট পাচ্ছে, ওসি সাহেব। খুঁজে বার করেন, খুঁজে বার করেন। গতকাল হলে ভালো হতো, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন পরশু পর্যন্ত না যায়।’ তিনি বললেন। অর্থাৎ আজকে।

তিন
আম্বর আলির বউয়ের নাম মিনারা। বয়স ত্রিশের মতো, যদিও দেখতে মনে হয় চব্বিশ, বেশি হলে পঁচিশ। শ্যামলা রং, ছিপছিপে শরীর, চোখ দুটি একটু কটা। আম্বর আলির বয়স পঞ্চাশ ছুঁতে যাচ্ছে। একটা বউ ছিল। সন্তান না দিয়েই একদিন পরপারে চলে গেছে। মিনারাকে আম্বর আলির চোখে পড়েছে এই বছর তিনেক আগে। মেয়েটি পোড়-খাওয়া, নানা ঘাটের পানি খাওয়া। একদিন ভাসতে ভাসতে এসেছে আম্বর আলির ঘাটে। মিনারা যখন বুঝল, লোকটা তাকে সত্যিই পছন্দ করেছে, ভালোবেসেছে, সে তাকেই আঁকড়ে ধরল। এবং ধরে থাকতে থাকতে দেখল, লোকটার মনটা ভালো। মিনারার অতীত নিয়ে, ঘাটবদলের ইতিহাস নিয়ে তার কোনো উৎসাহ নেই, প্রশ্ন নেই, তখন সে নিজেকে উজাড় করে আম্বর আলির সেবায় নামল। তাদের দেখে লোকজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করত, আম্বর আলির বড় বোন হেনা বুবুর এমনও সন্দেহ ছিল যে, মেয়েটি ডাইনি, কিন্তু তিনি কিছু বলতেন না। ভয়ে। একে তো মিনারা ডাইনি। তার ওপর তিনি বেঁচে আছেন আম্বর আলির দয়ায়। কিন্তু তলে তলে মিনারা থেকে ভাইটাকে বাঁচাতে তিনি যতটা পারতেন, করতেন। একদিন মৃধাকে বলেছেন, ‘ভাই, দুইজনে রাজনীতি করতেন, ভালোই তো করতেন। এখন মাঝখানে একটা ডাইনি ঢুকছে। ও আম্বরকে খাইবো, আপনাকেও।’
মৃধা হেসে বলেছেন, ‘আম্বর ভাই সুখ পাইছে। আপনে ওর জন্য দোয়া করেন।’
কথাটা উনি বললেন বটে, কিন্তু মিনারাকে নিয়ে তার একটা বিরাট ক্ষোভ আর হীনমন্যতা ছিল। নাঈমার চেহারাটা মন্দ না। চোখ দুটি বেড়ালের মতো Ñ তাও সই। কিন্তু তার শরীর ছিল চালভর্তি দুইমণি বস্তার মতো। তারপর সে খোঁড়ায়। সারাক্ষণ তার কাটে ছেলেটাকে নিয়ে। নাঈমার কাছে মৃধা ছিল ল্যাংড়ার মৌসুমে কইট্টা আমের মতো। অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু আম যেহেতু পেড়ে খাওয়া যেতে পারে, নেহায়েত ল্যাংড়া না পেলে।
নাঈমার জীবনেও ল্যাংড়া আম ছিল একজন। কিন্তু তার কথা বলে লাভ নেই। সে থাক।
আম্বর আলি একসময় কিছুটা দূরে সরে গেল মৃধা থেকে, যখন মৃধা দলের জেলা পর্যায়ে উঠে গেল। তারপর এমপি হওয়ার পর সম্পর্কে টান পড়ল। আম্বর বলল মিনারাকে, ‘মৃধা এখন আসমানের তারা। তারে আঁকশি দিয়ে পাড়তে হয়। তার এখন অনেক ডাঁট।’ কিন্তু ওই পর্যন্তই।
কিন্তু আম্বর আলির বোনের কারণে হোক, দলের লোকজন আম্বর আলিকে নিয়ে তার কান ভারী করার কারণে হোক, তার সঙ্গে মৃধার দূরত্বটা খুব বাড়ল। একদিন মৃধা শুনল, আম্বর হাত মিলিয়েছে প্রদীপ দস্তিদারের ছেলে বরুণের সঙ্গে, যে কিনা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হয়েছে, এখন উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে।
সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। জানলেও আমাদের তাতে আগ্রহ নেই। সেসব থাক। আমরা বরং ওই খুনের রাতে যাই, সরাসরি ওই ভয়ানক আধা ঘণ্টাতে যাই, কারণ সন্ধ্যা থেকেই মৃধা ফোন করছিলেন মোতালেবকে, গ্রামের লোক যাকে গাট্টা মোতালেব বলে, তার স্বাস্থ্যের কারণে। মৃধার কেন জানি মনে হয়েছে খুনটা সে-রাতেই করতে হবে। তার একটা ঠিকঠাক আদেশ ছিল। সেই আদেশটা এতবার তিনি মোতালেবকে দিচ্ছিলেন যে, মোতালেবের মনে একটা ধন্ধ দেখা দিয়েছিল, খুনটা বড় আদেশ? না ওইটা?
ওই আদেশটা কী, সেটা না হয় একটু পরেই জানানো যাবে।

চার
রাত এগারোটা এখন আর গণ্ডগ্রামেও নিকষ অন্ধকার নামায় না, আম্বর আলির গ্রামে তো নয়ই। কোনো না কোনো ঘরে টেলিভিশন চলে, লাইট জ্বলে। আম্বর আলির ঘর বিদ্যুতায়িত, তার টেলিভিশন আছে। তিনি ও মিনারা বসে টেলিভিশন দেখেছেন। তার গ্রামে ডিশ লাইন আছে। মিনারা সনি টিভি দেখে। তারা একসঙ্গে রণবীর কাপুর আর দীপিকা পাড়–কনের একটা সিনেমা দেখেছেন, কিছুটা বুঝেছেন, বাকিটা আন্দাজ করেছেন। কিন্তু দুজনই সিনেমাটা দেখে উত্তেজিত হয়েছেন। ছবির শেষ দিকে রণবীর দীপিকাকে নিয়ে বিছানায় ঝাঁপ দিয়েছে, একটু পরে ক্যামেরা বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে স্থির হলে ক্যামেরার সামনে দুজনে জামা-কাপড় পরতে লাগল। প্রথমে রণবীরের শার্ট, দীপিকার শাড়ি। এইসব।
টেলিভিশন বন্ধ করে শোবার ঘরে যেতে যেতে দুজনের উত্তেজনার মাঝখানে মেঝের দৃশ্যটা একটা জায়গা করে নিল। মৃধা টানলেন মিনারাকে, বিছানার দিকে। মিনারাও ঝাঁপ দিলো। মেঝেতে অবশ্য এরপর প্রথম পড়ল মিনারার শাড়ি, তারপর মৃধার পাঞ্জাবি এবং শেষ পর্যন্ত মিনারার সায়া।
এর আগে যে দুজন রতির কাজ করেননি, তা নয় Ñ অবশ্যই করেছেন, কিন্তু আজ সে-কাজে একটা আলাদা আনন্দ আর উত্তেজনা জড়ো হলো। এমনই, যে, তিনটা ঘর পরে যে একটা খুট করে শব্দ হলো, তাও তাদের কানে এলো না। উত্তেজনা তীব্র, আম্বর আলির ধন শক্ত, মিনারার শরীরে ঢেউ। কিন্তু খুট করে যারা শব্দ করল, তারা বেড়ালের মতো ক্ষিপ্র। তারা চলে এলো। লোকগুলোর আসার ব্যাপারটা অবশ্য শিগগির টের পেল মিনারা। সে প্রথমে ভাবল চোর। বিছানা থেকে একলাফে সে উঠে দাঁড়াল। ঘরটাতে ঘন অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকার মিনারার চোখে বহু আগেই সয়ে গেছে, বস্তুত অন্ধকারের ভেতরেই সে আম্বর আলির ধনটার ঝলক দেখেছে, সেটিকে হাত দিয়ে একটুখানি আদর করে দিয়েছে। দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে টের পেল, চোর নয়, অন্য কিছু। অন্য কেউ। সে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমের দরজা খোলা ছিল। বাথরুম থেকে ঘরের পেছনে যাওয়ার যে-দরজাটা ছিল সেটাও খোলা ছিল। মিনারা হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমে থাকা একটা টুল থেকে তার শাড়ির খোঁজ করল, যেটি বিকেলের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় সে বদলেছিল। মিনারার ইচ্ছা ছিল, বাইরে বেরিয়ে সে শাড়িটা পরবে, তারপর দৌড়ে প্রতিবেশী রমিজ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চাইবে। আগেভাগে চিৎকার করে যে কোনো লাভ নেই, সে-কথা সে বুঝেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সে শাড়িটা পরে বাকি কাজটা করতে পারবে, ততই মৃধার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাটা বাড়বে। মিনারা বাথরুমে ঢোকার আগে দেখেছে, মৃধা গড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে খাটের নিচে ঢুকেছে। ঘাটের নিচে একটা দা সবসময় থাকে। সেটি আছে।
কিন্তু টুলে শাড়ি নেই। মিনারার ধক করে মনে পড়ল, শাড়িটা একসময় সে বালতিতে ডুবিয়ে রেখেছে।
ফলে সে বাথরুম থেকে বের হলো বটে, কিন্তু রমিজ সাহেবের বাড়ির দিকে আর গেল না। কারণ তার গায়ে একটা সুতাও নেই, বাঁকা চাঁদটার মতো তারও পরণে জন্মদিনের পোশাক। সে বরং পুকুরের ঘাটে গিয়ে পানিতে নেমে পড়ল। কচুরিপানার নিচে নেমে সে ভাসতে থাকল। মিনারার জীবনের একটা সময় কেটেছে নদীতে; নদীর পারে ছিল তাদের বাড়ি। যখন-তখন নদীতে পড়ে থাকা ছিল তার স্বভাব। নদীকে ভালোবাসত, যেন নদী ছাড়া তার কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু Ñ অথবা বান্ধবী Ñ ছিলও না কেউ, একজন ছাড়া। সে-কথা থাক, মিনারার এক অদ্ভুত শক্তি ছিল, পানিতে শুয়ে থাকতে পারত। যেন পানিটা, নদীটা তার বিছানা। একেবারে চিৎ হয়ে অনেকক্ষণ ভেসে থাকতে পারত।
তার ধারণা ছিল, তার শরীরের ভেতর রক্ত-মাংসের বদলা যেন বাতাস বেশি ছিল। সেজন্যে খুব আরামের সঙ্গেই ভাসতে, শুয়ে থাকতে পারত পানিতে।
মৃধার মোতালেব বাহিনী যখন ঘাটের নিচ থেকে টেনে বের করে মেঝেতে আম্বর আলিকে কোপাচ্ছে, তখন মিনারাও পানিতে ভাসছে। তার গায়ে কচুরিপানার শাড়ি। তার লজ্জা ঢেকেছে। একটু আগে যে ভয়ানক আতঙ্ক তাকে চেপে ধরেছিল, এক ভয়ানক আশঙ্কার ছবি তার চোখ দুটি খোদাই করে তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল, সেই আতঙ্কটা এখন তরল হয়েছে। আশঙ্কাটা যত সত্য হচ্ছে ততো তার ভেতরটাকে শূন্য করে দিয়েছে। মিনারা জানে, গাট্টা মোতালেব তাদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়ার অর্থ কী, এই নির্জন রাতে চার সঙ্গী নিয়ে। গাট্টা মোতালেবকে না চিনে উপায় নেই। আজ রাতে সে যে জল্লাদ হয়ে হাজির হয়েছে, তাতে কাল ভোরে যে আম্বর আলি মিনারাকে জাগিয়ে তুলে বলবে, আরেকটা নতুন দিন এসেছে বউ, দেখো, দিনটাকে সালাম করো, ওপরওয়ালাকে শুকরিয়া জানাও, সে-সম্ভাবনা একেবারে শূন্য।
পানির নিচে শুয়ে থেকে মিনারার মনে হলো, আজ রাতটার মতো রাত অনেকদিন আসেনি তাদের জীবনে। তারা তৈরি হচ্ছিল একটা মহামুহূর্তের জন্য। মিনারা জানে, আম্বর আলির নোংরায় একটা বিরাট অভাব রয়ে গেছে, একেবারে তার বয়ঃপ্রাপ্তি থেকেই Ñ সেটি হচ্ছে এই : যে-বিন্দু থেকে জীবন হয়, যে-জীবন সন্তানের চেহারা নিয়ে মূর্ত হয়, সেই বিন্দুটি সেখানে নেই। যে নোংরা বেরোয় তার ধন থেকে, জায়গা করে নেয় মিনারার ভেতরে, তা মরা। তাতে ওই রক্তবিন্দু নেই, যা থেকে মিনারা একটি কচিমুখ পাবে ন’মাস-দশমাস পর। কিন্তু আজ রাতে কেন জানি মিনারার একটা বিশ্বাস জন্মেছিল, ওই সিনেমাটার উত্তেজনা তাকে ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়ার পর, আর আম্বর আলির চোখ দুটি গাঢ় কিছু চাহনিতে বদলে যাওয়ার পর, যে আজ রাতে আম্বর আলির নোংরায় রক্তবিন্দুর পদ্ম ফুটবে।
সিনেমাটা তাদের দুজনকে তীব্র সুখ দিয়েছে Ñ আরো তীব্র সুখে এর রেশটা নিশ্চয় শেষ হতো, কিন্তু কপাল! গাট্টা মোতালেব তা হতে দিলো না। তবে এও তো ঠিক, এই সিনেমার জন্য একদিকে আম্বর আলি মরল, অন্যদিকে মিনারা বাঁচল। কীভাবে? আম্বর আলির ভেতরের উত্তেজনা, তার ধনে বান ডাকা, তাকে এমনই অসতর্ক করে দিয়েছিল যে সবগুলো দরজায় আড়কাঠ দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সে ভুলে গিয়েছিল। একটি মাত্র দরজায় আড়কাঠ পড়েনি। আর সেই দরজাটাই মোতালেব বেছে নিয়েছিল। ওই বেহুলার বাসরঘরের ছিদ্রের মতো। আর উত্তেজনায় সে বাথরুমের পেছনের দরজাটায় খিল লাগাতেও ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটি যে একসময় দিত, রতিশেষের ক্লান্তিসুখ তাকে ঘুমে টেনে না নিয়ে গেলে।
সে যাই হোক।
মিনারা কচুরিপানার নিচে নিশ্চল শুয়ে থাকল। পিঠটা পুকুরের বিছানায়, চোখ দুটি ওপরের কালো আকাশে, বুকটা চুল আর কচুরিপানায় ঢাকা, শরীরের বাকি অংশও। তার ভয়ানক কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু কাঁদলে পানি কাঁপবে। শরীরটা অসাড় হচ্ছিল, কিন্তু বেশি অসাড় হলে তলিয়ে যাবে। সেজন্যে সে নিজেকে ধরে রাখল। একই সঙ্গে ভাবল, পানি কাঁপলে অবশ্য মন্দ হয় না, কষ্টটা শেষ হয়। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তাকে একটা প্রার্থনা করে যেতে হবে। সেই প্রার্থনা শুনে ওপরওয়ালা যদি…
দুচোখ ছাপিয়ে একসময় কান্না অবশ্য এলো। কিন্তু মিনারা নিঃশব্দে কাঁদতে জানে। সারাজীবন একরকম অনেক নিঃশব্দ কান্না সে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ তার শরীর কাঁপল। না, এ-কাঁপন কান্নার নয়, এ কাঁপন তার শরীরের সেইখান থেকে শুরু, যেখানে একটা হাত রেখে আম্বর আলি বলেছিল, তার ভাষায়, ‘তোমার ওই ভূগোল আজ বুঝবে আম্বর আলির তলোয়ার কতটা ভেতরে ঢুকে কোপ দিতে পারে।’ কাঁপনটাতে শব্দ নেই, কিন্তু গন্ধ আছে Ñ গন্ধটা ভালো না, কিন্তু নেশা ধরায়; গন্ধটা আম্বর আলির তলোয়ারের। বীরের তলোয়ারে রক্তের গন্ধ থাকে। আম্বর আলির তলোয়ারে আজ এক ফোঁটা রক্তবিন্দু পরিচিত গন্ধটাকে বদলে দিয়েছে। সে যাই হোক। একসময় মিনারা টের পেল, আম্বর আলির তলোয়ারটা যেন আকাশ থেকে নেমে এলো। সেটি ঢুকে গেল মিনারার ভেতরে, যেমন তার বানানো পুডিংয়ে ঢুকে যায় আম্বর আলির ক্ষুধার্ত চামচ। এবং ওই তলোয়ার বেয়ে ঝরে পড়ছে একটি নয়, অসংখ্য রক্তবিন্দু।
একটা ভয়ানক কাঁপন। তারপর রতিশ্রান্তি এবং অসাড়তা। সেই অসাড়তায় কোনো কষ্ট নেই, বরং এক অদ্ভুত তৃপ্তি যেন আছে। মিনারা জানল তার কোলজুড়ে একদিন এই রক্তবিন্দুগুলির একটি পদ্ম হয়ে ফুটবে। তার অসাড় শরীর তলিয়ে যেতে থাকল পুকুরের বিছানার নিচে। কিন্তু মিনারার মুখ দেখলে আপনারা একটুও বিচলিত হতেন না, মিনারার মুখে এক ফোঁটা ভয়-দুঃখ এসব নেই। তার মুখে একটা ক্লান্ত হাসি বরং।

পাঁচ
গাট্টা মোতালেব ঘরের লাইট জ্বালিয়ে মেঝেতে চিৎ করে শোয়ানো আম্বর আলির গলা বরাবর কোপ মেরেছিল। তখন তার খেয়াল পড়েনি, অন্যদের যদিও পড়েছে, আম্বর আলির ধনের দিকে। যেটি এক বিরাট বেগুনের মতো জেগে আছে, শক্ত দাঁড়িয়ে আছে ঘরের চালের দিকে তাকিয়ে, যেন খাটের নিচ থেকে দা নয়, একটা তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে আম্বর আলি। মোতালেবের দা এক কোপে প্রায় দুই টুকরা করে ফেলেছিল আম্বর আলির গলা। গলা থেকে একটা গোঙানি উঠল। শরীর কাঁপল। আর তখনই তার ধনের দিকে নজর পড়ল মোতালেবের। ধনটা আরো সোজা আর শক্ত হয়েছে যেন সেটি এখনই উড়াল দেবে, ছাদ ফুটো করে আকাশে উড়ে যাবে। মোতালেব জোরে হেসে ফেলল। বাকি চারজনও হাসল। হাসতে হাসতে হঠাৎ তারা দেখল, সেই শক্ত তলোয়ারের মাথা থেকে হঠাৎ যেন সাদা-লাল কিছু পদার্থ ছিটকে বেরিয়ে এসে চাল ফুটো করে চলে গেল। মোতালেব ভয় পেল। গাট্টা মানুষ, কিন্তু ভয়টা প্রচুর। সে বুঝল পদার্থটা কী। কিন্তু সাদার সঙ্গে লাল কেন? অবশ্যই, কেন? কেন আবার রক্ত। আম্বর আলির শরীরের সব রক্ত এখন মুখ খোলা কলের পানির মতো গলগল করে বেরোচ্ছে। ঠিক আছে, লালের রহস্য না হয় মিটল। কিন্তু এই পদার্থ কীভাবে উড়ল? উড়ল যদি, এক হাত দেড় হাত নয়, একেবারে চাল ফুটো করেই চলে গেল।
যদি জানতে চান : আম্বর আলিকে তার রক্তের কলতলায় ফেলে চলে যাওয়ার আগে লাইট নিভিয়েছিল মোতালেব। তাতে হঠাৎ চালের ফুটোটা তার চোখে পড়েছিল। বেশ বড়সড়। দু-তিন আঙুল, অথবা একটা লম্বা শক্ত বেগুন সেই ফুটো গলে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারে।
তার আগে অবশ্য আম্বর আলির ঘরে যাওয়াটা নিশ্চিত করেছে মোতালেব। সে হঠাৎ দেখেছে, মোতালেব নিস্তেজ হওয়ার আগে একটা হাত অল্পখানি বাড়িয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা একটা শাড়ির একটা অংশ ধরেছে তার মুঠোয়। শাড়িটা দেখে হঠাৎ মোতালেবের মনে পড়েছে দ্বিতীয় আদেশটি। যেটি মিনারাকে জীবিত করে নিয়ে যাওয়ার।
কেন? না, মৃধা মিনারাকে তার হৃদয় সঁপে দিতে চেয়েছে। নাঈমাকে সেলাই শিখিয়েছে মিনারা, আর তাকে দেখে চোখ জুড়িয়েছে মৃধার। একসময় মিনারার জন্য সে পাগল হয়েছে। কিন্তু মৃধা চালাক মানুষ। সে জানে, এসব ব্যাপারে পা ফেলতে হয় মেপে মেপে, বিশেষ করে যখন কারো পেশা হয় রাজনীতি এবং নেশা থাকে ওপরে ওঠার। মৃধা যখন এমপি হলো, কনুই পর্যন্ত ডুবে গেল টাকায়, সে শহরে একটা বাড়ি ভাড়া নিল। তার আশা ছিল, ওই বাড়িতে মিনারাকে এনে সে তুলবে। সারাজীবনের জন্য। আম্বর আলিকে সে সত্যি একসময় আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসত Ñ লোকটার দিলে দয়া ছিল, বড় কোমল ছিল প্রাণ, মৃধাকে দুহাতে আগলে রাখত সব সমস্যা, বিপদ-আপদ থেকে। কিন্তু ভাই, প্রেম, Ñ মৃধার ক্ষেত্রে কাম-প্রেম-মানুষকে অন্ধ করে দেয়। রাজনীতি মৃধাকে অমানুষ করেছে অনেক আগেই, এখন সে একটা দৈত্যের চেহারা ধরল।
সে যাই হোক।
ছয়
কনস্টেবল সুবল যখন আম্বর আলিকে দেখে তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে, তার হাতের মুঠো থেকে মিনারার শাড়িটা কিছুতেই আলগা করা যাচ্ছিল না। আম্বর আলির চোখদুটি কিছুটা খোলা, সে-দুটিতে কষ্টের বা আতঙ্কের চাইতে বিস্ময়ের চাহনিটাই যেন বড়। সুবলের ওপর ওসির আস্থা প্রচুর, ছেলেটা কাজ জানে। সেজন্য বাকিদের বাইরে রেখে তিনি সুবলকে নিয়ে ঢুকেছিলেন। এএসআই নিজামও ছিল। আম্বর আলির পুরুষ্ট, শক্ত, আকাশমুখো ধন দেখে তিনিও অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু তার অনেক কিছুই দেখতে হচ্ছিল। তিনি বুঝলেন, আম্বর আলির স্ত্রী পালিয়েছে। তার প্রথম সন্দেহ হয়েছিল সে-ই খুন করিয়েছে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার সেই সন্দেহ গেছে। তিনি বুঝেছেন, খুনটা সাধারণ নয়। এখানে রাজনীতির খেলাটাই বড়। হয়তো মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেছে, অথবা যারা আম্বর আলিকে খুন করেছে, তারা। দু-একদিনের মধ্যে যখন তার সোর্স তাকে খবর দিলো, তিনিও তদন্ত করলেন, দেখলেন, বুঝলেন, তার মনে কোনো সন্দেহ রইল না যে, আম্বর আলিকে খুন করিয়েছেন আলাউদ্দিন মৃধা।
সুবল আম্বর আলির ধন নিয়ে অন্যকিছু আর ভাবেনি, শুধু হেসেছে। পড়াশোনা তেমন হয়নি সুবলের, কী করে বুঝবে এই ধনটি শুধু ধন নয়, এটি ছিল আম্বর আলির তলোয়ার, যা এক চরম মুহূর্তে নিজের ভেতরে ঝরতে থাকা রক্তে নিজেকে ভিজিয়েছে। তারপর রতি-রহস্যঘরের গভীরে ঢুকে নিজের অস্তিত্ব থেকে কিছু রক্তবীজ ছিনিয়ে এনেছে এবং সেগুলোকে আকাশে পাঠিয়ে দিয়েছে মিনারার উদ্দেশে, এবং মিনারা কচুরিপানার চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে সেই তলোয়ারের মুখ থেকে উগড়ে পড়া রক্তবীজের রেণুগুলি রক্তবিন্দুর মতো যতেœ ধারণ করেছে তার গোপন গভীর ভূগোলে। পড়াশোনাটা ভালোমতো করলে সুবল সেসব বুঝত। তাহলে আর সে এত হাসাহাসি করত না আম্বর আলির ধন নিয়ে। সে যাই হোক।

সাত
গাট্টা মোতালেবও বলেছিল, অথবা বলতে শুরু করেছিল, ওই ধনের গল্প। কিন্তু যাকে সে বলছিল, আলাউদ্দিন মৃধা, তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না ওই গল্পে। তার প্রশ্ন তার দ্বিতীয় আদেশ নিয়ে। মিনারা কোথায়?
একমাস ধরে মিনারাকে খুঁজল মৃধার বাহিনী, থানার ওসি, তার অনুগত ছাত্রনেতারা, ব্যবসায়ী, এমনকি তার এলাকার এনজিওকর্মীরা। একসময় মৃধা ভেঙে পড়ল। তার ধারণা হলো, হয় মিনারা সত্যি সত্যি পালিয়ে ঢাকা চলে গেছে। অথবা মোতালেব তাকে মেরে ফেলেছে। মৃধা ক্ষিপ্ত হলো, পাগল হয়ে গেল। মিনারাকে সে যে এতটা ভালোবেসে ফেলবে, কল্পনাও করতে পারেনি। তার দিনের কাজ রাতের ঘুম অথবা রাজনীতির নানা খেলাধুলায় মিনারা বাগড়া দিতে থাকল। একটা ছায়ার মতো তাকে জগতের সব আলো থেকে আড়াল করে দিলো।
একদিন মোতালেবকে পাওয়া গেল নাগর বিলে। বুকে তিনটি গুলি। মানুষটা এতো গাট্টা যে, তিনটির দুটি গুলি পিঠ দিয়ে বেরোতে পারেনি।
থানার ওসি বদলি হলেন। তার জায়গায় যিনি এলেন, তার সুনামের চেয়ে দুর্নামই বেশি। কিন্তু তিনিও মিনারার খোঁজ দিতে পারলেন না। সারা থানা এলাকা চষলেন, কোনো লাভ হলো না।

আট
ছ-মাস পর আম্বর আলির বাড়িটা তার ভাতিজা থেকে কিনে নিলেন আলাউদ্দিন মৃধা। আম্বর আলির বংশধর বলতে ছিল ওই ভাতিজাটা Ñ সে মৃধা যা দিলো, তা হাত পেতে নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুলে পালালো।
মৃধা ততদিনে মিনারার শোক কিছুটা সহ্য করে নিয়েছেন। তার ইচ্ছা হলো এই বাড়িতে যেহেতু মিনারা ছিল, সপ্তাহের দুটো দিন অন্তত এখানে থাকবেন। নাঈমা তাকে এড়িয়ে চলত, ধারেকাছে না থাকলেই যেন খুশি হতো। মৃধা ভাবলেন, মাঝে মধ্যে একা তিনি এই বাড়িতে থাকবেন। তার ধারণা হলো, মিনারাকে কিছুটা হলেও তিনি পাবেন।
পুকুরটা দেখে তার রাগ হলো। একি পুকুর, না এঁদো ডোবা? তিনি মানুষ লাগালেন, পুকুরটা পরিষ্কার করাতে। মানুষেরা ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পানির নিচ থেকে তুলে আনলো একটি কঙ্কাল। কঙ্কালটি বেশ তাজা, যেন মাংস ঝরে গেলে, মাছে খেয়ে ফেললে সমস্যা নেই। হাড়গুলো চকচক থাকলেই হলো।
আম্বর আলির মৃধার উঠানে কঙ্কালটি শোয়ানো হলো। মৃধা ছিলেন ঘরের ভেতরে। মানুষের চিৎকারে তিনি বাইরে এলেন। শোয়ানো কঙ্কালটা দেখলেন। কিন্তু সব মানুষের মতো তারও চোখ দুটি ঠিকরে বেরুলো যখন দেখলেন কঙ্কালটার পেটের কাছে, পাঁজরের গর্তের আটকে থাকা যেন দারুণ কোনো আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কোনো কারিগর Ñ এক ক্ষুদ্র কঙ্কাল। ক্ষুদ্র মানে এইটুকু Ñ হাত-পা, পাঁজর, করোটি, হয়েছে কি হয়নি। যেন কঙ্কালটা অজন্মা কোনো প্রাণীর। প্রাণীটি মানুষ না অন্য কিছু, বোঝা মুশকিল। যারা দেখল তাদের অর্ধেক বলল, মানুষ, অর্ধেক অন্য কিছু।
মৃধা বুঝল ওই নারীটি Ñ নারী যে সেটি বোঝা যাচ্ছে আশ্চর্য তাজা কিছু চুলের জন্য, চুলগুলি কীভাবে থেকে গেল, আলাদা হয়ে গেল না করোটি থেকে, বরং করোটি পেঁচিয়ে রয়ে গেল যেন রয়ে যাওয়াটা তাদের মানসম্মানের বিষয় Ñ এ-বিষয়টি কিছুতেই পরিষ্কার হলো না মৃধার কাছে। তিনি দেখলেন বড় কঙ্কালের একটা হাত রাখা ছোট্ট, প্রায় চোখে না পাড়ার মতো অনিশ্চিত কঙ্কালটার ওপর, যেন এটি তার একান্ত অধিকারের বিষয়, যদিও এটি মানুষ না অন্য কোনো প্রাণীর ঠিকঠাক বলে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। মৃধা দেখলেন ছোট্ট কঙ্কালটিকে। তার মনে হলো, এটি কোনো জলজ প্রাণীর। হয়তো ভেসে ভেসে এসে আটকে গেছে নারীটির পাঁজরের গর্তে। কিন্তু যদি মানুষের হয়? যদি হয়? তার বুকটা ধক করে উঠল কঙ্কালটা দেখতে দেখতে। তিনটি প্রশ্ন এরপর খেলে গেল মৃধার মাথায় : এক. শেষ যেদিন তিনি দেখলেন এবং স্পর্শ করলেন মিনারাকে তার প্রবল প্রতিরোধের মুখেও Ñ এবং Ñ আম্বর আলির মারা যাওয়ার দুদিন মাত্র আগে Ñ মিনারার পেট তো ছিল একটা স্লেটের মতো সমান, একফোঁটা চর্বি ছিল না সে-পেটে। তার হাত বরং পিছলে পড়েছিল দড়িটানা ওই পেটের গর্তে এবং মিনারা প্রচুর ঘৃণা নিয়ে হাতটা সরিয়ে দেওয়ার আগে, তিনি কিছুটা হলেও টের পেয়েছিলেন ওই সুঠাম পেটের নিচের শূন্যগর্ভের কষ্ট। তাহলে এই ছোট্ট ইনিমিনি কঙ্কালটা কার, যদি ধরে নেওয়া হয় এটি কোনো পুরুষের ভ্রƒণ থেকে জাগা মানুষের? তাহলে? দুই. আম্বর আলি যে সন্তান উৎপাদনে অপারগ, সে তো তার হেনাবুই মৃধাকে বলেছেন। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এই আঙুলসমান কঙ্কালটা, ধরে নেওয়া হলো সেটি মানুষের, তাহলে কোন পিতার সন্তানের? আর তিন. বড় কঙ্কালটা যদি মিনারার হয়, তাহলে সেটির যে-বয়স, কুচি কঙ্কালটার বয়স কেন আরো কম, যেন কুচি কঙ্কালটা মাত্র এক মাসের পুরনো, বড়টা যেখানে প্রায় ছ-মাসের? একটা কঙ্কাল কি আরেকটি কঙ্কালের ভেতর বড় হতে পারে, অথবা একটি ছোট্ট শরীর, কোনো কঙ্কালের ভেতর? নাহ্। এটি নিশ্চয় কোনো ইতর প্রাণীর। জলের গভীরের। মৃধা হুকুম দিলেন, কঙ্কালটি Ñ কঙ্কাল দুটি Ñ পুকুরে ফেলতে, এবং ফেলে, পুকুরটা ভরাট করে দিতে। তার হঠাৎ মনে হলো, ছোট্ট একটা গ্রামে এত পুকুর কেন থাকবে?