ফিরে যাওয়া

হ রি শং ক র জ ল দা স

‘আমি একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতে চাই।’
চিত্রগুপ্ত অতিশয় পুরনো বালামের একটি পৃষ্ঠায় গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছিলেন। পৃষ্ঠাটি নানা সংখ্যায় ভর্তি। মঘি, শকাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ – এসবের হিসেবপত্তর আছে তাতে। চিত্রগুপ্তকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো একটা সন-তারিখের গরমিলে তিনি উদ্বিগ্ন। এ-কারণেই বোধহয় বক্তার আর্জি চিত্রগুপ্তের কানে ঢোকেনি।
বক্তা সেটা বুঝতে পারলেন। তাই গলা একটু উঁচু করে আবার বললেন, ‘প্রণাম গুপ্তমশাই। আমি একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতে চাই।’
এখানে বয়স নির্বিশেষে সবাই চিত্রগুপ্তকে গুপ্তমশাই বলে সম্বোধন করেন। তবে সবাই যে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে সম্বোধন করেন, এমন নয়। অতি বয়সী এবং সামাজিক আর রাজনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা, তাঁরা তাঁকে চিত্রগুপ্তই ডাকেন। নামের শেষে মশাইটশাই বলেন না। কিন্তু বর্তমানের আর্জিকারী বয়সে নবীন। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়স তাঁর। তুলনামূলকভাবে কণ্ঠও নবীন। প্রণাম, মশাই – এসবে মুগ্ধ হয়েই হয়তো চিত্রগুপ্ত বক্তার দিকে মুখ তুললেন। পাকা মোটা ভ্রƒর নিচ দিয়ে পুরু লেন্সের চশমার ওপর দিয়ে বক্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে অদ্বৈত, কেমন আছো তুমি?’
‘আজ্ঞে ভালো আছি। স্বর্গে এমন কিছুর কি অভাব আছে যে, খারাপ থাকা যায়! সুখ আর ঐশ্বর্যের মধ্যেও যে বেদনা আছে, তা আমার স্বর্গজীবনে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’ বিনীত কণ্ঠে বললেন অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ।
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘তোমাদের নিয়ে বাপু আর পারা গেল না। মর্তে তোমরা আহাজারি করো এটা নেই, ওটা নেই বলে; আবার স্বর্গে এসেও অতৃপ্তিতে ভোগো তোমাদের চারপাশে সবকিছু আছে বলে।’
ডান হাত দিয়ে চশমাটা খুললেন চিত্রগুপ্ত। বাঁহাতের তালু দিয়ে কপালটা একবার মুছলেন। চিরবসন্তের স্বর্গে চিত্রগুপ্তের কপাল যে ঘেমে গেছে, এমন নয়। তবে তাঁর মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠলে তিনি অকারণে বাঁহাতের তালু দিয়ে কপাল মোছেন। এটাকে তাঁর অভ্যাসও বলা যায়, আবার মুদ্রাদোষও বলা যায়।
একটা তৃপ্তির শ্বাস ত্যাগ করে চিত্রগুপ্ত অদ্বৈতকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তা তুমি কী যেন একটা বলছিলে?’
‘আমি একবার আমার জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতে চাই।’
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়!’ কপাল কুঁচকে বললেন চিত্রগুপ্ত।
অদ্বৈত বললেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাটে আমার জন্ম। জন্মভিটে ছেড়েছি পঁচাশি বছর হয়ে গেল। জন্মস্থানটা দেখার জন্য প্রাণটা বড্ড আকুলিবিকুলি করছে। তিতাসপাড়, মালোপাড়া, আনন্দবাজার, জগৎবাজার, কাল ভৈরবীর মন্দির, চেপা শুঁটকি…।’ বলতে বলতে থেমে গেলেন অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ। প্রবল একটা আবেগ অদ্বৈতের চোখে-মুখে ঝকমক করতে লাগল।
অদ্বৈতের আবেগী কণ্ঠ চিত্রগুপ্তকে ছুঁয়ে গেল বেশ; কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলেন তিনি। বললেন, ‘যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতে চাইছো তুমি, সেখানে তো ভীষণ অস্থির অবস্থা এখন।’
‘অস্থির অবস্থা!’ শঙ্কিত গলায় বললেন অদ্বৈত।
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কেন, তুমি জানো না?’ প্রশ্নটি করেই একটু থমকে গেলেন চিত্রগুপ্ত। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘ও হো, ব্যাপারটা তো তোমার জানার কথা নয়। তুমি তো পৃথিবী ছেড়ে এসেছো অনেকটা বছর হয়ে গেল। স্বর্গ-মর্ত-পাতাল – ত্রিজগতের অনুপুঙ্খ খবর আমাকে রাখতে হয় বলে আমি জানি।’
অদ্বৈত উদ্বিগ্ন চোখে বললেন, ‘আমি আপনার কথা ভালো করে বুঝতে পারছি না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ছোটখাটো দু-একটা বর্ণগত দ্বন্দ্ব ছিল বটে, তবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, সেরকম তো কিছু ছিল না ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়!’
‘তুমি কি হলফ করে বলছো, এরকম কিছু ছিল না?’
এবার একটু থতমত খেলেন অদ্বৈত। আমতা আমতা করে বললেন, ‘সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্বটা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। যেমন ধরেন উঁচুজাতের লোকেরা আমাদের একটু ঘৃণাটিনা করতেন, আমাদের পাড়াকে গাবরপাড়া বলতেন, এক হুঁকাতে আমাদের তামাক খেতে দিতেন না, এই যা। কিন্তু আপনার উদ্বিগ্নতা দেখে আমার মনে হচ্ছে, এর চেয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়া।’
চিত্রগুপ্ত ডান কাঁধের উত্তরীয় বাঁ-কাঁধে ফেলে বললেন, ‘তুমি যথার্থ ধরতে পেরেছো অদ্বৈত। সেদিন ভোরসকালে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তো স্বর্গ-উদ্যানেই রবিশংকরের সঙ্গে দেখা। রবিশংকরকে চেনো তো? আরে বাবা, তোমাদের শিবপুরের উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য। গুরুর মুখে সেও নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুরবস্থার কাহিনি শুনতে পেয়েছে। খাঁ সাহেব নাকি বলেছেন – তাঁর নামে দেওয়া আলাউদ্দিন সংগীত ভবনটি তছনছ করে দিয়েছে উগ্র জঙ্গীগোষ্ঠীরা। তাঁর স্মৃতিমাখা সকল কিছুতে আগুন দিয়ে ছাই করে ফেলতে দ্বিধা করেনি ওরা।’
‘আর আমার গোকর্ণঘাট! মালোপাড়া! আমার জন্মপাড়ার কী অবস্থা গুপ্তমশাই?’ আকুল গলায় জিজ্ঞেস করেন অদ্বৈত।
চিত্রগুপ্ত আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘গোকর্ণঘাটের কিছু হয়নি, তবে নাসিরনগর রেহাই পায়নি।’
‘কোন নাসিরনগর?’
‘নাসিরনগর তুমি চিনবে না। তোমার সময়ে অন্য নাম ছিল, সাতচল্লি­শের দেশভাগের পর নতুন নামকরণ হয়েছে স্থানটির।’ একটু থামলেন চিত্রগুপ্ত। চাপা একটা শ্বাস ত্যাগ করলেন। তারপর আবার বললেন, ‘ওই নাসিরনগরে তোমার সম্প্রদায়ের একটা পাড়া আছে। বর্বররা সেই পাড়াটি কুপিয়ে জ্বালিয়ে ছারখার করে ছেড়েছে।’
অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ হঠাৎ আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলেন। দুই হাতের তালু দিয়ে দুই কান চেপে ধরে বললেন, ‘আর শুনতে চাই না গুপ্তমশাই। কৈবর্তদের দুর্দশার কথা আর শুনতে চাই না, শুনতে চাই না!’ বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।
চিত্রগুপ্ত বাধা দিলেন না। মনে করলেন, কাঁদুক ছেলেটা। কেঁদেকেটে একটু হালকা হোক। যা আয় করত তার থেকে সামান্য অংশ রেখে বাকিটুকু দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মালোদের সাহায্য করে যেত যে, সে তো নিজ গোষ্ঠীর মানুষের লাঞ্ছনার সংবাদ শুনে কাঁদবেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে অদ্বৈত বললেন, ‘আমাকে যেতে দিন গুপ্তমশাই। আমি আমার জন্মভূমিটা, আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খেটে-খাওয়া মানুষগুলোর দুরবস্থা নিজ চোখে দেখতে চাই।’
চিত্রগুপ্ত স্থির চোখে অদ্বৈতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, ‘যেতে চাইছ যখন, যাও। আমি যমরাজকে বলে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নেব। ছুটি মঞ্জুর করাতে একটু কাঠখড় পোড়াতে হবে আমায়। ইদানীং পৃথিবীর কথা শুনলেই মহারাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বলেন, নষ্ট হয়ে গেছে পৃথিবীটা, একেবারে নরক হয়ে যাচ্ছে।’
চিত্রগুপ্তের কথা শুনে যাওয়া ছাড়া অদ্বৈতের আর কোনো উপায় নেই। তিনি শুধু ভাবতে থাকেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তিতাস নদী, কিশোর, সুবল – এদের কথা।
এবার চিত্রগুপ্ত একটু আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন, ‘যাও, কালকেই যাও তুমি। আগামীকাল তোমার জন্য বিশেষ একটা দিনও বটে।’ বলে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
অদ্বৈত বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘বিশেষ দিন! বুঝলাম না গুপ্তমশাই। আর আপনি মৃদু মৃদু হাসছেনই বা কেন?’
‘শোনো ছোকরা, স্বর্গে এসে দিন-তারিখ সব ভুলে বসে আছো। আজ ডিসেম্বর মাসের শেষদিন। আগামীকাল নতুন বছরের প্রথম দিন।’
‘শেষদিন বা প্রথম দিন – বিশেষ দিন হতে যাবে কেন?’
চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘মাথাটা দেখি একেবারে গেছে তোমার! পহেলা জানুয়ারি কি তোমার জন্মতারিখ নয়?’
‘হ্যাঁ, তাই তো! ১৯১৪ সালের পহেলা জানুয়ারিতেই তো আমি জন্মেছিলাম!’
‘তাহলে! কী একটা বই লিখে তুমি নাকি হইচই ফেলে দিয়েছিলে? একটু ভুল বললাম। তুমি তো সেই হইচই দেখে আসতে পারোনি। তোমার মৃত্যুর পরেই তো বইটি বের হয়েছিল। বইটি নাকি বাঙালিরা লুফে নিয়েছে। খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে তোমাকে নাকি সবাই মান্যিগণ্যি শুরু করেছে। যাও, যাও, গিয়ে দেখে এসো সেই মানিগণ্যির ব্যাপার-স্যাপারগুলো। আর তোমার পাড়ার লোকরাই বা তোমাকে নিয়ে বর্তমানে কী ভাবছে জেনে এসো।’
তৃপ্তিতে অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চিত্রগুপ্তকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমি আপনাকে প্রণাম করবো গুপ্তমশাই।’
‘প্রণাম করবে? আচ্ছা করো।’ বলে পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দিলেন চিত্রগুপ্ত।
‘তবে হ্যাঁ ছোকরা, মর্তের কেউ তোমাকে দেখতে পাবে না, তোমার কণ্ঠও শুনতে পাবে না কেউ। এটাই স্বর্গের বিধান।’ প্রণাম গ্রহণ করতে করতে চিত্রগুপ্ত বলে গেলেন।

দুই
গোকর্ণঘাট দেখার আগে শহরটা একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করল অদ্বৈতের। টাউন হলের পাশ দিয়ে এগোচ্ছেন তিনি। পায়ে তাড়া তাঁর। সকালে আসতে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। আগের দিন যমরাজের কাছ থেকে ছুটিটা মঞ্জুর করানো যায়নি বলে চিত্রগুপ্ত ছাড়ছিলেন না তাঁকে। যমরাজ আবার আজকে সকালে শয্যাত্যাগ করতে বিলম্ব করলেন। গত রাতে ইন্দ্রসভায় গীতনৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল। সোমরসের বিপুল আয়োজন ছিল। স্বর্গ-নর্তকী উর্বশী নেচে ছিলও গভীর রাত পর্যন্ত। অন্যান্য দেবতা কোন ছার, খোদ যমরাজের মতো নিষ্ঠুর, নির্মোহ, বৃদ্ধ দেবতাও মজে গিয়েছিলেন আব্রহ্মতালু। তাই ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা যমরাজের। মনটা তাঁর ফুর্তিতে ভরে ছিল বলে অদ্বৈতের সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর করতে দোনামনা করেননি যমরাজ।
টাউন হল ছাড়িয়ে একটু এগোতেই মাইকের আওয়াজ শুনতে পেলেন অদ্বৈত। আওয়াজের প্রতি কান দুটো তুললেন তিনি। মাইকে ভরাট কণ্ঠে কে যেন বলছে, গতকাল থেকে আমাদের তিনদিনব্যাপী অদ্বৈতমেলা শুরু হয়েছে। উদ্বোধন করেছেন মাননীয় এমপি মহোদয়। তিনি বলেছেন, ঘরে ঘরে অদ্বৈতকে পৌঁছে দিতে হবে। অদ্বৈতের পাড়ার লোকদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বক্তা একটু থামল।
মানে! এই পঁচাশি বছর পরও আমার পাড়ার মালোরা শিক্ষিত হয়ে ওঠেনি তাহলে! ভাবলেন অদ্বৈত। মাইকে আবার বলা হচ্ছে, আজ পহেলা জানুয়ারি। আজ আমাদের জন্য এক পবিত্র দিন, আজ অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের জন্মদিন। এই দিনে আমরা অদ্বৈতকে নিবিড়ভাবে স্মরণ করব, শ্রদ্ধা জানাব। আজ বিকেলে একজন সাহিত্যিককে অদ্বৈত-সম্মাননা জানানো হবে। অদ্বৈতের মতো মালো সম্প্রদায়েই জন্ম তাঁর। বক্তা দম নেওয়ার জন্য আরেকটু থামল।
অদ্বৈত ভাবলেন – অদ্বৈত-সম্মাননা! অদ্বৈত-সম্মাননা আবার কী! আমার সম্প্রদায়ের লেখক কে! তাহলে জেলেরা একেবারে অশিক্ষিত থেকে যায়নি! কেউ কেউ লিখছে তাহলে!
বক্তা আবার শুরু করল, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অমূল্য সন্তান আমাদের অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ। এই মহান সাহিত্যিকের নামে তিন বছর ধরে আমাদের বিবেচনায় সেরা সাহিত্যিককে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এই অদ্বৈত সম্মাননার মাধ্যমে আমরা প্রতিবছর যেমন অদ্বৈতকে স্মরণ করছি, তেমনি তাঁকে নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করছেন তাঁদেরকেও মাননীয় করে তুলছি।
এক দম নিল ঘোষণাকারী। তারপর আবার বলতে লাগল, আর এখন আমরা, মানে আমাদের সংগঠনের সবাই মিলে গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ায় যাব। অদ্বৈতের মূর্তির পাদদেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করব। আনন্দের সংবাদ এটা যে, আমাদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন এ-বছর অদ্বৈত সম্মাননাপ্রাপ্ত লেখক শিবদয়াল জলদাস। যাঁরা বাইরে অহেতুক ঘোরাঘুরি করছেন, তাঁদেরকে অতিসত্বর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বরের মঞ্চের কাছাকাছি চলে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ দ্রুত পা চালালেন। মঞ্চের নিকটে গিয়ে দেখলেন, গোটা দশেক মানুষ জড়ো হয়েছে। নেতা গোছের একজন নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্যরা তাঁর নির্দেশনা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। একটু তফাতে দুজন দাঁড়িয়ে। একজনের গায়ে শার্ট-প্যান্ট, অন্যজন পরেছেন পাজামা-পাঞ্জাবি। শার্ট-প্যান্টপরা ভদ্রলোকের নাম আইয়ুব সৈয়দ। ছড়া-কবিতা লেখেন। কবিতা লিখলে কী হবে, তাঁর চোখ-মুখ-চুল-পরিধেয় কিন্তু কবিদের মতো নয়। প্রাবন্ধিকের মতো। ছোট করে ছাঁটা চুল, পারিপাট্যের ছাপ তাঁর চলনে-বলনে। পাঞ্জাবিপরা লোকটি দেখতে বাবুবাবু। যে-কোনো অপরিচিত মানুষ দেখে বলবে, ভদ্রলোক কবিতা লেখেন। লম্বা চুল, পরিপাটি করে বাঁদিকে সিঁথি কাটা। দেহটা দীর্ঘ তাঁর। গৌরবর্ণ। এই লোকটি কিন্তু কবিতা লেখেন না, লেখেন গল্প-উপন্যাস। তিনি শিবদয়াল জলদাস। এবারের অদ্বৈত-সম্মাননাপ্রাপ্ত লিখিয়ে।
এই দুজনের কাউকে অদ্বৈত চেনেন না, শুধু এই দুজন কেন, মঞ্চের পাশে সমবেত কাউকেই চেনার কথা নয় অদ্বৈতের। তিনি হালকাচোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। দেখলেন – ধীরেন্দ্রনাথ চত্বরটি আয়তক্ষেত্রিক। পূর্বদিকে উঁচু পাঁচিল, দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে ছোট ছোট কক্ষ। এগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা সংগঠনের জন্য বরাদ্দকৃত। উত্তর দিকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে উঁচু সিমেন্টের স্থায়ী মঞ্চ। দেখতে দেখতে অদ্বৈত একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন। একজনের কথায় সংবিতে ফিরলেন, ‘শিবদয়াল স্যার, আমরা এখনই রওনা দেব।’
‘আমরা তৈরি মনিরভাই।’ বললেন উদ্দিষ্ট শিবদয়াল জলদাস।
মনির হোসেন সামনে এসে বললেন, ‘বলছিলাম কী স্যার, মালোপাড়াটা খুব বেশি নিকটে নয়। আপনি যাবেন? কষ্ট হবে কিন্তু।’
অদ্বৈত বুঝলেন – এই-ই শিবদয়াল জলদাস। এই জলদাসবাবুই তাহলে এবারের অদ্বৈত-সম্মাননা পাচ্ছে! এই শিবদয়ালই তাহলে জলপুত্র! সব তো বোঝা গেল। কিন্তু ওই মনির, যাঁর বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, কেন শিবদয়ালকে স্যার সম্বোধন করছেন? জলদাস কি মনিরসাহেবের শিক্ষক?
এই সময় শিবদয়ালের কণ্ঠ অদ্বৈতের কানে এলো, ‘কী যে বলেন না মনিরসাহেব! অদ্বৈতের জন্মপাড়ায় যেতে আমার কষ্ট হবে কেন? বরং ভীষণ ভালো লাগবে আমার। অদ্বৈত যে আমার পূর্বপুরুষ। তাঁর কাছে যেতে পারলে আমার যে পুণ্য হবে।’
আইয়ুব সৈয়দ বললেন, ‘জলদাসবাবু যথার্থই বলেছেন। আমিও খুব এক্সসাইটেড বোধ করছি। জলদাসবাবুর তো আরো বেশি শিহরিত হবার কথা। চলেন শিবদয়ালবাবু, আমরা এগোই।’ জলদাসবাবুর দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন আইয়ুব সৈয়দ।
গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ায় পৌঁছে বেশ নাড়া খেলেন অদ্বৈত।

তিন
গোকর্ণঘাটের একেবারে গা-ঘেঁষেই মালোপাড়াটি। ঘরে ঘর লাগানো। বেড়ার দেয়াল, ছনে ছাওয়া। কালো মাটি। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পাড়াটিতে ঢোকবার আর বেরোবার একটি পথ। দুজন মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে পারে ও-পথ দিয়ে। অদ্বৈত অবাক হয়ে দেখলেন – প্যাচপেচে কাদার ওই পথে ইট বিছানো। গলির মুখে
ত্রিকোনাকৃতির একটা উঁচু বেদিতে কার যেন সিমেন্টের মূর্তি স্থাপিত। কার মূর্তি এটা? ভাবলেন অদ্বৈত। দেখলেন মূর্তির ডানপাশের দেয়ালে তাঁর নাম লেখা। একটু রোমাঞ্চিত হলেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ এত ভালোবাসে তাঁকে! পাড়ায় ঢোকার মুখেই তাঁর মূর্তি স্থাপন করে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে তাঁরা! অদ্বৈতের হঠাৎ মনে হলো – তিনি অধরচন্দ্রের বড় ছেলে অদ্বৈত নন, তিনি সারদা বালার আদরের ছাওয়াল অদু নন, তিনি যেন এই জেলেপাড়ার অভিভাবক, যেন মালোদের পরিচিতির অভিজ্ঞান। এই পাড়ায় ঢুকতে-বেরোতে নিশ্চয়ই তাঁর দিকে তাকায় মালোরা, টুপ করে দু-একজনে নমস্কারও করে বোধহয়। শেষের কথাটি ভেবে একটু লজ্জা পেলেন যেন অদ্বৈত। এদিক-ওদিক তাকালেন। মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলে গেলেন – তাঁকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
মূর্তির সামনে জড়ো হওয়া মানুষজনের মধ্য থেকে মনির হোসেন বলে উঠলেন, ‘অদ্বৈতের জন্মভিটাটা দেখবেন স্যার?’
শিবদয়ালবাবু উত্তর দেওয়ার আগে আইয়ুব সৈয়দ বললেন, ‘দেখব মানে! তাঁর পাড়া, তাঁর জন্মস্থান আর এই গোকর্ণঘাট দেখার জন্যই তো চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসা।’ বিভোর চোখে চারদিক তাকাতে তাকাতে কথা শেষ করলেন কবি।
আইয়ুব সৈয়দের কথা শুনে মুচকি হাসলেন শিবদয়ালবাবু। তিনি যে অদ্বৈত-সম্মাননা গ্রহণ করতে এসেছেন, সে-কথা চেপে গিয়ে বললেন, ‘সৈয়দসাহেব যথার্থ বলেছেন। আমারও এরকম বাসনা।’
এ-সময় পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠলেন, ‘চলেন, আমি লইয়া যামু আপনাগো। আমার বাড়ির পাশেই তেনার ভিডাটা।’
শিবদয়ালবাবু লোকটির দিকে তাকালেন। দেখলেন – মাঝারি উচ্চতার লোকটির বয়স পঁয়ষট্টির কম হবে না। সারা মুখম-লে বলিরেখা। পাকা চুল, ছোট করে ছাঁটা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শিবদয়ালবাবুর তাকানো দেখে লোকটি হাত জোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে বাবু, আমার নাম নির্মল মল্ল­বর্মণ। এই পাড়ার সর্দার। আমার লগে চলেন। আমি সব দেখাইতাছি।’
শিবদয়ালবাবু আট বছর পেছনে ফিরে গেলেন। আট বছর আগে সন্ধের আগে আগে তিনি এই পাড়ায় একবার এসেছিলেন। তখন নির্মল সর্দারের মতো করেই তাঁকে আরেকজন অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সে লালমোহন বর্মণ। মল্ল­বর্মণ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে সে নারাজ ছিল। বলেছিল, আমরা হগলে অহন মল্ল­বর্মণ পদবি লিহি না, শুধু বর্মণ লিহি। মানুষরা আমাগোরে মালাউন বইলে গাইল পাড়ে।
লালমোহন সেবেলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখিয়েছিল। অদ্বৈতের জন্মভিটে, ভিটের ওপর দাঁড়ানো জরাজীর্ণ ছনের ঘরটি, একপাশের পড়ো-পড়ো বরইগাছটি, ঘরটির সামনে ছোট্ট উঠানটি আকুল চোখে দেখে গিয়েছিলেন শিবদয়ালবাবু। পরিচয় হয়েছিল মনোমোহিনী আর সুনীলের সঙ্গে। সুনীলের মা বৃদ্ধা মনোমোহিনী বলেছিল, ‘আমি অদ্বৈতের দূরসম্পর্কের বউদি হই। তাই অদ্বৈতের ভিটায় থাকবার অধিকার পাইছি।’
হঠাৎ শিবদয়ালবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা লালমোহন কোথায়? মনোমোহিনী বেঁচে আছে তো?’
নির্মল সর্দার চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এগোরে চিনেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, চিনি।’ মৃদু কণ্ঠে বললেন শিবদয়াল।
‘কেমনে চিনেন?’
শিবদয়াল পূর্ণচোখে নির্মল সর্দারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘থাক ওসব কথা। চলেন আমাদেরকে অদ্বৈতের বাড়িতে নিয়ে চলেন।’
সে-সময় শিবদয়ালবাবু নবীনগরে চাকরি করতেন। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাঝারি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। সকালের দিকে কাজ-দায়িত্ব শেষ হয়ে যেত, বিকেলবেলায় করার কিছুই থাকত না। ওই সময় অফিসের কর্মচারী খলিলকে নিয়ে কোনোদিন শিবপুর, কোনোদিন দৌলতপুর যেতেন শিবদয়ালবাবু। এইভাবে একদিন নবীনগর ঘাটে নিয়ে গোকর্ণঘাটগামী জলগাড়িতে উঠে বসেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল খলিল।
সাত-আটজনের একটা দল নির্মল সর্দারের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। শিবদয়ালের পাশে পাশে অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ। নালার কর্দম থেকে পা বাঁচিয়ে, এর-ওর চালা থেকে মাথা বাঁচিয়ে দলটি এক সময় অদ্বৈতদের উঠানে এসে দাঁড়াল। উঠান তো নয়, যেন এক খাবলা ভূমি। সাত আটজন মানুষেই ভরে গেল জায়গাটি।
অদ্বৈত হা-হা করে তাঁর জন্মভিটার দিকে ছুটে গেলেন। তাঁর ভিটায় এখন টিনের ঘর। চারদিকে কিলবিলে বাচ্চাকাচ্চা। ঘরের পাশ ঘেঁষে নারকেল গাছটি দাঁড়িয়ে আছে এখনো। অদ্বৈত যখন ছোট, সেই সময়ের একদিন আনন্দবাজার থেকে নারকেল চারাটি কিনে এনেছিলেন অদ্বৈতের বাবা অধরচন্দ্র। পুত্রকে বলেছিলেন, ‘ওই খালি জায়গায় গাছটা পুঁতে দেও অদ্বৈত।’ বাপে-বেটায় পুঁতে দিয়েছিলেন গাছটি। এই সেই গাছ, যার গায়ে তাঁর বাপের ছোঁয়া আছে। ‘বাবা’ বলে গাছটিকে জড়িয়ে ধরলেন অদ্বৈত। অনেকক্ষণ পর উঠানে ফিরে এলেন তিনি।
তখন শিবদয়ালবাবু উঠানে জড়ো হওয়া মালোদের উদ্দেশে বলছেন, ‘অদ্বৈতের বই তিতাস একটি নদীর নাম পড়েছেন আপনারা? সুনীল তুমি দেখেছো বইটি?’
একজন মালোতরুণ বলল, ‘আমরা মুরুক্ষ মানুষ, আমরা কি কইরে পইড়বো! অদ্বৈত নামে আমাগো পাড়ার একজন লেখক আছিল, হেইডা শুধু জানি।’
শিবদয়ালবাবু বললেন, ‘তোমরা লেখাপড়া করো না কেন? এই দেখো, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমিও একজন মালো; জেলে আমি তোমাদের মতো। লেখাপড়া করেছি বলে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাকে সম্মান জানাতে নিয়ে আসা হয়েছে। অদ্বৈতও পড়ালেখা করেছেন বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষরা বছর বছর অদ্বৈতমেলা করছেন।’
হঠাৎ রান্নাঘরের ভেতর থেকে একজন নারীর রূঢ় কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ভাষাণ দিয়েন না, ভাষাণ দিয়েন না। বহুত ভাষাণ হুনছি। অনেকে আইস্যা শুধু ভাষাণ দিয়া যায়। হুনতে হুনতে কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করতাছে।’
নির্মল সর্দার ধমক দিয়ে বলল, ‘সুনীলের পুতের বউ, কী কইতাছ তুমি এই সব! অদ্বৈত আছে বইলাই তো আমাগো পাড়ার এত সর্মান। বলি – কোথায় বাস করতাছ তোমরা, হ্যাঁ! যে অদ্বৈত সম্বন্ধে উল্টাপাল্টা কথা কইতাছ, হে অদ্বৈতর ভিডাতেই তো আছো।’ নির্মল সর্দারের চোখ-মুখ দিয়ে ক্রোধ ঝরে পড়তে লাগল।
শিবদয়ালবাবু একেবারে চুপ মেরে গেলেন। অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক করতে পারলেন না।
নত মুখে দলটি অদ্বৈতের মূর্তির পাদদেশে পৌঁছাল। আসার সময় দেখল, আঠারো বিশ বছরের ছয়-সাতজন মালোসন্তান মূর্তির অদূরে দাঁড়িয়ে জটলা করছে।
এর মধ্যে অদ্বৈতের মূর্তির সামনে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন। এসেছেন গোকর্ণঘাট প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামসুন্দর পারমানিক, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবদুর রহমান, এসেছেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। পুষ্পস্তবক অর্পণ করার আগে এঁরা একটু একটু করে বললেন। সবশেষে বললেন শিবদয়াল জলদাস। তাঁর শেষের লাইনটি ছিল এরকম – ‘আমার কাছে এই গোকর্ণঘাটের জেলেপাড়াটি গয়া-কাশীর চেয়েও পুণ্যময় স্থান।’
সবাই আনন্দে-উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়ে উঠলেন। এর একটুক্ষণ পর গলির ভেতর থেকে আচমকা হাততালির আওয়াজ ভেসে এলো, সঙ্গে উপহাসের ধ্বনিগুচ্ছ। অদ্বৈত গলির ভেতরে গলা বাড়িয়ে দেখলেন – গলির মালোসন্তানরা বিকট দেহভঙ্গি করতে করতে ধিক্কারের হাততালি দিয়ে যাচ্ছে। একজন সম্মানিত মানুষকে অপমান করার জন্য মানুষ যেরকম করে হাততালি দেয় বা দেহভঙ্গি করে, ঠিক তেমনিই এই মালোতরুণদের আচরণ।
অকস্মাৎ অদ্বৈতের মুখের ভেতরটা তেতোতে ভরে গেল। মাথাটা কি একটু চক্কর দিলো? বুঝতে পারলেন না অদ্বৈত মল্লবর্মণ। শুধু কিছুক্ষণের জন্য চোখে ঝাপসা দেখলেন তিনি। শিবদয়ালের দিকে চেয়ে দেখলেন অদ্বৈত। দেখলেন – তাঁর সারা মুখে স্বেদবিন্দু। এই শীতসকালে শিবদয়ালবাবু ঘর্মাক্ত হবার কথা নয়। তাহলে ঘামছেন কেন তিনি? মালোতরুণদের উপহাস করার ব্যাপারটি তাহলে তিনিও টের পেয়েছেন? দেখলেন, অন্যরা স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ। বুঝলেন, ওঁরা টের পাননি ব্যাপারটি। মনে মনে অদ্বৈত শিবদয়ালবাবুর উদ্দেশে বললেন, ‘দোহাই আপনার শিবদয়ালবাবু, যা বুঝেছেন তা জনসমক্ষে খোলসা করবেন না। এ যে আমার-আপনার অসম্মান! এই বেদনা আমার-আপনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। সুনীলের পুত্রবধূর দুঃসহ মন্তব্যটি, মালোসন্তানদের উপহাসের ব্যাপারটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষরা জানতে পারলে বড় কষ্ট পাবেন তাঁর।’
মনির হোসেন বললেন, ‘আমাদের সকালের প্রোগ্রাম এখানেই শেষ। আজ সন্ধেয় শিবদয়াল স্যারকে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। কাল সমাপ্তির দিন। আপনারা সবাই উপস্থিত থাকবেন আশা করি।’

চার
সমাপ্তি দিনের সন্ধ্যায় তৃপ্তিময় মন নিয়ে অনুষ্ঠানের দর্শকসারিতে বসেছিলেন অদ্বৈত। সামনের সারির একটা খালি চেয়ারেই বসেছিলেন তিনি। বিশেষায়িত অতিথিবর্গ মঞ্চে উঠে গেলে সামনের সারির বেশ কয়েকটি চেয়ার খালিই পড়ে ছিল। শিবদয়াল জলদাস, আইয়ুব সৈয়দ, ত্রিপুরার কবি দীপ্তেন্দ্র ভৌমিক, ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্য, বাচিক শিল্পী পিনাকপাণি চৌধুরী প্রমুখ সামনের সারির শ্রোতা। গতকালকের অনুষ্ঠানটা ভীষণ ভালো লেগেছে অদ্বৈতের। বক্তাদের মুখে তাঁর নাম এবং খ্যাতির কথা শুনতে শুনতে একধরনের বিভোরতা চলে এসেছিল অদ্বৈতের মধ্যে। একটা সময়ে তিনি বুঝতে পারলেন – তাঁর দুচোখের কোনা ভিজে গেছে। সকালের যত অপমান, যত গ্ল­ানি তাঁর মন থেকে সরে যেতে লাগল। সম্মাননার উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পর সঞ্চালক শিবদয়ালকে তাঁর অনুভূতি প্রকাশের জন্য অনুরোধ করেছিল। শিবদয়াল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। এই বলে শেষ করেছিলেন তিনি, ‘জীবনে অনেক পুরস্কার সম্মাননা পেয়েছি আমি। কিন্তু তিতাসপাড়ের অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের নামের সঙ্গে যুক্ত এই সম্মাননা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম পাওনা। কারণ এই সম্মাননার সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষের নাম জড়িত। আমি অদ্বৈতের কাছে, তিতাসপাড়ের মানুষজনের কাছে আজীবন ঋণী থাকলাম।’
আজ সকালে আনন্দবাজারটা দেখার খুব ইচ্ছে জেগেছিল অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের। বাপ অধরচন্দ্রের সঙ্গে কতবার এই বাজারে মাছ বিকাতে গেছে ছোট অদ্বৈত! এই বাজারের কথা মনে হতেই রামপ্রসাদ জেঠার কথা মনে পড়ে গেল অদ্বৈতের। রামপ্রসাদ জেঠা মালোপাড়ার মোড়ল ছিলেন। বড় ভালোবাসতেন তিনি জেলেদের। মালোদের স্বার্থের ওপর কখনো নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখেননি। এই রামপ্রসাদ জেঠাই তো জগৎবাবুর প্রলোভনে সাড়া দেননি। আনন্দবাবু আর জগৎবাবুর কথা বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে আজ। ছোটবেলায় বাপ অধরচন্দ্রের কাছেই শুনেছিল রামপ্রসাদ জেঠার নিঃস্বার্থ শক্তমনের গল্পটি। আনন্দবাবু ও জগৎবাবু – দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদার। দুজনেই তিতাসপাড়ে নিজেদের নামে বাজার বসাবার জন্য চেয়েছিলেন। মাছবাজার ছাড়া যে কোনো বাজার জমে না, সেটা উভয়ে জানতেন। জগৎবাবু রামপ্রসাদ জেঠাকে কিনে নিতে চেয়েছিলেন। তিনশো টাকা উৎকোচ দিয়ে তাঁকে নিজের দলে ভিড়াতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ের তিনশো টাকা মানে অনেক টাকা। টাকা দেওয়ার প্রস্তাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রামপ্রসাদ জেঠা আনন্দবাবুর বাজারে গিয়ে বসার আদেশ দিয়েছিলেন মালোদের। আনন্দবাজার জমে উঠেছিল, পাশের জগৎবাজার খোঁড়া পায়ে পথ চলেছিল।
একদিনের কথা মনে পড়ে যায় অদ্বৈতের। সেদিন ইয়াবড় একটা কাতলা ধরা পড়েছিল অধরচন্দ্রের জালে। মাছটা আনন্দবাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন অধর। সঙ্গে অদ্বৈতও ছিল। আনন্দবাবুর বাজারসরকার মাছটা নিতে চেয়েছিল। বলেছিল, ‘জমিদারবাবু এই মাছ দেইখকে বড় আনন্দ পাইবেন।’ অধরচন্দ্র মূল্য নিতে না চাইলে মস্ত একটা ধমক দিয়েছিল বাজারসরকার, ‘তুমি কি পাগল অইয়া গেইছ অধর! বাবু কি আমার ঘাড়ে মাথা রাইখবেন! তিনি বলে দিছেন – মালোদের হাতে উচিত দাম গছাইয়া তবে মাছ হাতে নিবা।’
ভোরে আনন্দবাজারের তিতাসঘাটে উপস্থিত হয়েছিলেন অদ্বৈত। সামনে শিবদয়াল ও আইউব সৈয়দকে দেখে ভীষণ চমকে উঠেছিলেন তিনি। আরে, এরা এখানে কেন! এত সকালে!
শিবদয়ালের কথা শুনতে পেলেন অদ্বৈত। শিবদয়াল বলছেন, ‘জানেন সৈয়দ সাহেব, এই-ই হলো আনন্দবাজার। তাঁর পাশে নিশ্চয়ই জগৎবাজার আছে। তিতাস একটি নদীর নামে সেই রকমই বিবরণ আছে। আর আছে মেঘনার পাড়ের ভৈরববাজারের কথা। আমি যখন নরসিংদীতে চাকরি করতাম, সেই ভৈরববাজারে গেছি বহুবার। কিন্তু আনন্দবাজারে আমার এই প্রথম আসা। এই বাজারে এসে আমি বালক অদ্বৈতকে দেখতে পাচ্ছি। তাঁর মতো করে আমিও একসময় আমার বাবার সঙ্গে কমলমুন্সির হাটে যেতাম মাছ বেচতে। আজ এই মাছবাজারের পাশে তিতাসতীরে দাঁড়িয়ে অদ্বৈতের বালকবেলা আর আমার শৈশবকে দেখতে পাচ্ছি।’ বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে এলো শিবদয়ালবাবুর।
সৈয়দ সাহেব বললেন, ‘এই এক অদ্ভুত ব্যাপার দয়ালবাবু! অদ্বৈত আর শিবদয়াল, মালো আর জলদাস, নদী আর সমুদ্র আজ এই সকালের আনন্দবাজারে যেন একাকার হয়ে গেল।’ শিবদয়ালবাবুর আবেগে আক্রান্ত আইয়ুব সৈয়দের গলা।
সাঁইত্রিশ বছরের অদ্বৈত ষাটোর্ধ্ব এই দুই প্রবীণের দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর আর আনন্দবাজার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করল না। তাঁর মনে হলো – এই বাজারে এসে তিনি যা পেতে চেয়েছিলেন, তা দুই প্রবীণের কথায় পেয়ে গেলেন। তিনি ফিরে আসার জন্য মনস্থির করলেন।

তো সেই প্রগাঢ় আনন্দটুকু নিয়েই অদ্বৈত আজ মঞ্চের সামনে বসেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। বক্তারা কী বলেন, তা শুনতে বড় ইচ্ছে জাগছে তাঁর।
মঞ্চে আজ বিশিষ্টজন। জেলা অধিকর্তা, নিরাপত্তাপ্রধান পদাধিকারের কারণে বিশিষ্ট, স্থানীয় বালিকা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, সাহিত্যিক হর্ষবর্ধন পাল নিজেদের গুণে খ্যাতিমান। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা রহিসউদ্দিন বাহুবলের কারণে মঞ্চে আসীন। অদ্বৈতমেলা আয়োজক সংস্থার মুখ্য আজকের সমাপনী অনুষ্ঠানের সভাপতি। জেলা অধিকর্তার নানা কাজ। জরুরি কাজ ফেলে তিনি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। মঞ্চে উঠেই সভাপতিকে নিচু কণ্ঠে বলে দিয়েছেন, তাঁকে আগে ছেড়ে দিতে হবে। প্রটোকল ভেঙে তাঁকেই প্রথমে বলতে দেওয়া হলো। অদ্বৈত ভাবলেন – জরুরি কাজের কাছে প্রটোকল গৌণ। জেলা অধিকর্তার কথা শুনবার জন্য তিনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। অধিকর্তা বললেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শান্তি বিরাজমান ছিল। কিন্তু কিছু বিপথগামী মানুষের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আজ উত্তুঙ্গ ঢেউয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অহংকারের জায়গা, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংগীত ভবনে লঙ্কাকা- চালানো হয়েছে।’ ভাষণ শুনতে শুনতে অদ্বৈতের মনে হলো – ভদ্রলোক নিশ্চয় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র এবং তাঁর ওপর বঙ্কিমচন্দ্রের যথেষ্ট প্রভাব আছে। নইলে কেন ভাষণে এত তৎসম শব্দের ছড়াছড়ি!
অধিকর্তা বলে চলেছেন, ‘মালোরা নিরীহ মানুষ। তারা কখনো কারো ক্ষতিসাধন করে না। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোও রেহাই পায়নি। সাম্প্রদায়িক করালগ্রাসে পতিত হয়েছে তারাও। নাসিরনগরে তাদের ঘরবাড়ি ছারখার করা হয়েছে, উপাসনালয়ও তা-বতা থেকে রেহাই পায়নি।’
শুনতে শুনতে অদ্বৈতের মনে হলো, এখনই ছুটে যান তিনি নাসিরনগরে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের পাশে দাঁড়ান। তিনি আবার ভাবলেন – নাসিরনগরে গিয়ে লাভ কী? তাঁকে তো কেউ দেখতে পাবে না, তাঁর কণ্ঠস্বর তো কেউ শুনতে পাবে না। শুধু শুধু যাওয়া তাঁর। গেলে বেদনার বিশাল এক জগদ্দল পাথর তাঁর বুকে চেপে বসবে। সর্বস্বান্ত মালোনারীদের হাহাকারে তাঁর সমস্ত অন্তঃকরণ বেদনায় চুর চুর হতে থাকবে।
অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ জোরে জোরে শ্বাস টানতে শুরু করলেন। তাঁর যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একসময় চোখ বন্ধ করে বুকটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন তিনি।
কখন জেলা অধিকর্তার বক্তৃতা শেষ হয়েছে, খেয়াল করেননি অদ্বৈত। তিনি যখন স্বস্তিতে ফিরলেন, তখন অধ্যক্ষ মহোদয় মাইকের সামনে কথা বলছেন। তিনি বলছেন, ‘অদ্বৈত মলবরমন আমাদের সম্পদ।’ পেছনে দাঁড়ানো সঞ্চালক চাপা স্বরে বলল, ‘মলবরমন নয় স্যার, মল্ল­বর্মণ।’
অধ্যক্ষ মাইকেই বললেন, ‘আমি মৃত্তিকাবিজ্ঞানের লোক। উচ্চারণে একটু ভুলচুক হতে পারে।’ এরপর তিনি দর্পিত কণ্ঠে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
অদ্বৈত মনে মনে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! মল্লকে মল, মানে বিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করেও ভদ্রলোকের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই।’
অধ্যক্ষ সাহেবের বক্তৃতা শেষ হলে প্রধান অতিথি নিরাপত্তাপ্রধান বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদেহী, পাতলা কাঠামো তাঁর।
মাইক-স্ট্যান্ডটা সর্বোচ্চ উচ্চতায় তোলা হলো। তারপরও তাঁকে মাথা নুইয়ে বলতে হচ্ছে। তাঁর বাড়ি বোধহয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে। উচ্চারণে ‘স’ ‘ছ’-এর সমস্যা আছে। তিনি বললেন, ‘ছবাইকে আমার ছালাম ছুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’ দর্শক-শ্রোতার মধ্য থেকে চাপাহাসির গুঞ্জরণ উঠল।
তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘আদিত্য মল্ল­বর্মণ একজন কবি মানুছ। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই কবি তিনি। তবে শেছ জীবনে একখানা কাহিনী লিখেছিলেন। সেই কাহিনীর নাম রেখেছিলেন – তিতাছ একটি নদীর নাম। বইখানা আমরা ছিনামায় দেখেছি।’
ভদ্রলোকের বক্তৃতা শুনে অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। তিনি আবার কবি হলেন কখন! প্রথম যৌবনের টানে আটদশখানা পদ্য লিখেছিলেন বটে, কিন্তু সেগুলো যে কবিতা হয়ে ওঠেনি, তা কলকাতার সুহৃদরা বলেছিল। তারা বলেছিল, অদ্বৈত, পদ্য লেখা ছাড়ো, অন্য কিছু লেখো। তাদের কথা শুনেই না একদিন কাহিনি লিখতে বসেছিলেন তিনি। প্লট খুঁজতে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি। নিজের জীবন, সেই জীবনকে ঘিরে গোকর্ণের মালোসমাজ, আশপাশের মানুষজনকে তিনি তাঁর লেখার বিষয়-আশয় করেছিলেন। তিতাস একটি নদীর নাম লেখার পর মানুষরা তাঁকে ঔপন্যাসিক বলা শুরু করেছিল। নিরাপত্তাপ্রধান এই বইখানা সিনেমায় দেখেছেন, পড়েননি কখনো! হায় রে দুর্ভাগ্য! আর আদিত্য মল্ল­বর্মণ কে!
ভদ্রলোক তখনো বলে চলেছেন, ‘এই আদিত্যের কাছ থেকে আমরা অছাম্প্র্রদায়িকতার ছিক্ষা নিতে পারি। বইখানা দিয়ে আদিত্য বলে গেছেন – ছব ছম্প্রদায়ের মানুছ মিলেমিছে থাকা ভালো। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর লেখাগুলি ছিল রাজনীতিবিদের লেখার মতন।’ বলে ঘাড় ঘুরিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাটির দিকে তাকালেন তিনি। নেতার মুখে তৃপ্তির হাসি।
নিরাপত্তাপ্রধান বলছেন, ‘রাজনীতিকরা যেমন ছর্ব ছম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে ছর্বদা ছচেতন থাকেন, কাজ করেন যেমন ছাধারণ মানুষের মধ্যে, আদিত্য মল্ল­বর্মণও তাঁর বইটি দিয়ে ছেরকম কাজ করে গেছেন।’
হঠাৎ অদ্বৈত মল্ল­বর্মণের গলা ফেটে বমি আসতে চাইল। এই দুঃসময়েও তাঁর চোখ চলে গেল শিবদয়াল জলদাসের দিকে। দেখলেন – শিবদয়াল দুই হাত দিয়ে কান দুটো ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছেন, আইয়ুব সৈয়দের চোখ-মুখ লজ্জায় বিবর্ণ। এরপর অদ্বৈত চোখ ঘোরালেন মঞ্চে বসা সাহিত্যিক হর্ষবর্ধনের দিকে। হর্ষবর্ধনের তখন কাঁদতে বাকি।
অনেক চেষ্টা করেও অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ বিববিষাকে আর দমন করে রাখতে পারলেন না। ছুটে গেলেন গেটের দিকে। গেটের বাইরে বড় একটা নালা। সেই নালার পাড়ে অদ্বৈত উপুড় হয়ে বসে পড়লেন।

পাঁচ
গভীর রাত। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। যে যাঁর ঘরে চলে গেছেন। খোলা মঞ্চটি পড়ে আছে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ। তাঁর মন বিষণœ, সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ।
বড় আশা নিয়ে সাতষট্টি বছর পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে দেখবার জন্য এই মর্তে এসেছিলেন অদ্বৈত। কিন্তু এই দুদিনে তাঁর মনের আশা মিটে গেছে। সাতদিনের ছুটি নিয়ে এলেও এখানে তাঁর আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। মালোপাড়ার মানুষজনের মন্তব্য-আচরণ, শিক্ষিত মানুষদের কথাবার্তা তাঁর মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। অদ্বৈতের মনে হলো, আর কিছুদিন এখানে থাকলে অস্থিরতায় আক্রান্ত হবেন তিনি।
অদ্বৈত মল্ল­বর্মণ ঠিক করলেন – আর নয় এই পৃথিবীতে। তিনি ফিরে যাবেন। সুখৈশ্বর্যের বেদনায় দীর্ণ স্বর্গে ফিরে যাবেন তিনি।