ফ্রিদা কাহলোর দিনপঞ্জি শব্দ, রেখা ও রঙের নীরব মূর্ছনা

The Diary of Frida Kahlo

Abradale Press

Harry N. Abrams, Inc.

New York.

First edition : 1999

Second edition : 2001

US. $ 1997

নেই চাঁদ, সূর্য, হীরক, হাত

আঙুল ডগা, বিন্দু, রশ্মি, অতি সূক্ষ্ম জাল,

সমুদ্র পাইন সবুজ, গোলাপী কাঁচ,

চোখ আমার, ইরেজার…অথবা

শাখা প্রশাখা, সমুদ্র,

চলে যায়

তিক্ততায়

বহু দূরের দৃষ্টিতে,

সপ্তর্ষিম-ল কণ্ঠ…হয় স্তব্ধ,

জীবন, ফুল…

চোখ স্পর্শ করে যায় কতগুলো শব্দে যাদের নেই কোনো বাঁধন, অর্থপূর্ণ শব্দের যোগসাজশে নেই বাক্য গঠনের কোনো অভিপ্রায়। মনের চোখ খোঁজে আরো কিছু এমন উদ্দেশ্যবিহীন শব্দযাত্রা কিংবা কোনো লুকিয়ে থাকা অর্থ।

জীবনে মগ্ন হয় না সে/অথচ আছে জীবন/উত্তাপ আর শুভ্রতার/ কণ্ঠস্বর তার।

অস্তিত্বে ছিল সে, অথচ আসেনি কখনো/চলে যাচ্ছি আমি।

বার বার এই শব্দের বিন্যাসে চোখ খেলা করে, একসময়ে রিনরিন করে ধ্বনিত হয় এক ধরনের কাব্যশিল্প, যা নিঃসঙ্গ শব্দ দিয়ে ছবি আঁকে মানসপটে। শব্দের কায়ায় অর্থহীন শব্দগাথা যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরের মতো তৈরি করে এক সম্মোহনী সুরের শব্দযাত্রা। শব্দযাত্রার সাথে পাশাপাশি পথ চলে রেখা ও রঙের আঁচড়ে তৈরি নতুন মেজাজের চিত্র। এই শব্দযাত্রার স্বনিত পঠন আর রেখা-রঙের বিন্যাস পাঠককে নিয়ে যায় লেখিকার তৈরি করা এমন এক ক্ষেত্রে যেখানে উপলব্ধি বিচরণ করে জ্ঞাত আর অজ্ঞাত- এই দুয়ের মিশ্রণে সৃষ্ট এক অলৌকিক পরিম-লে। আর এই পরিম-লে পাঠকের প্রবেশ ঘটে নিউ ইয়র্কের হ্যারি এন আব্রামস প্রকাশিত দ্য ডায়েরি অব ফ্রিদা কাহলো নামের একটি অন্যরকম প্রকাশনার মাধ্যমে। প্রকাশনাটির নাম থেকেই স্পষ্ট, বইটি একটি দিনলিপি, অর্থাৎ, লেখিকার একটি একান্ত ব্যক্তিগত জগৎ যেখানে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা কিংবা আয়নায় নিজেকে দেখা। ১৯৪৪ সালে ডায়েরিটির যাত্রা শুরু। ফ্রিদা কাহলো এই ডায়েরির স্রষ্টা। কে এই ফ্রিদা কাহলো? ডায়েরি, জার্নাল কিংবা দিনলিপি, যেই নামেই সম্বোধন করি না কেন, বিষয়টা অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির অনুরণনে আবিষ্ট, আর নিঃসন্দেহে কৌতূহলের উদ্রেক করে বিশেষ করে তা যদি হয়   কোনো সেলিব্রিটির। শিল্পীমহলে পরিচিত হলেও আমাদের দেশে অনেকের কাছেই ফ্রিদা কাহলো নামটি অচেনা। অবশ্য গত অস্কার নমিনেশনে ফ্রিদা নামের চলচ্চিত্রটি স্থান পাওয়ায় শিল্প বা চলচ্চিত্র রসিকদের কেউ কেউ এই নামের সাথে পরিচিত হয়ে থাকবেন ইতোমধ্যে।

ফ্রিদা কাহ্লো – ব্যক্তিত্বের কায়ায় এক বিস্ময়কর উপাখ্যান, জীবন ক্যানভাসের এক পরাবাস্তব শিল্প, আত্মপ্রকাশের পরিসরে একজন শিল্পী, যার অন্তর্ভেদী প্রভাব শুধু জন্মভূমি মেক্সিকো নয় সমগ্র লাতিন আমেরিকা তথা পৃথিবী জুড়ে। ১৯১০ সালের মেক্সিকো বিপ্লবের তিন বছর আগে, ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই ফ্রিদা জন্মগ্রহণ করেন হাংগেরিয়ান-জার্মান বংশোদ্ভূত বাবা গিয়ারমো এবং মা মাতিল্ড কাহলোর ঘরে, যদিও পরবর্তীকালে জন্মদিবস হিসেবে পালন করেছেন ৭    জুলাই। ঔপনিবেশিক, রাজনৈতিক,

সামরিক ও আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাধারী ধূম্রজালে আবদ্ধ আর শোষণের আঘাতে জর্জরিত মেক্সিকো যেমন সময়ের স্রোতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি করেছে সেই দেশের ইতিহাস, দশ বছর স্থায়ী বিপ্লব-পরবর্তী দেশটি সাহিত্য, শিল্প, সংগীত-এর মাধ্যমে যেভাবে খুঁজে নিয়েছে তার সুপ্ত ও অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে, ঠিক তেমনই যেন মেক্সিকোর এই কন্যাটি জন্মভূমির মাটি, বাতাস আর অস্থির এক বিপর্যস্ত রুদ্র সময়ের প্রতিভূ হয়ে তার শিল্পকর্মে প্রতিবিম্বিত করেছেন বিংশ শতাব্দীর মেক্সিকোকে। শুধু তা-ই নয়, ফ্রিদা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিপন্নতার টানাপোড়েন, শারীরিক অসুস্থতা, পঙ্গুত্বের অক্ষমতা আর না-পাওয়ার বেদনার নীলে আচ্ছন্ন এক বিষাদময় জীবনকে মূর্ত করেছেন রং আর নিঃশব্দ শব্দের স্পর্শে। ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে এককভাবে রচিত হয়েছে আরো কিছু বই, আবার স্বামী, মেক্সিকোর বিখ্যাত শিল্পী দিয়েগো রিভেয়েরেকে নিয়ে যুগলভাবে প্রকাশিত হয়েছে এমনই কিছু প্রকাশনা। কিন্ত্ত আত্মজীবনীমূলক এই ডায়েরিটি অনন্য। এটি কথা বলে শব্দ, রেখা, কাগজের পাতায় আবদ্ধ হিমায়িত সংগীত আর চিত্রের সমন্বয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত দ্য ডায়েরি অব অ্যানি ফ্রাঙ্ক-এর মতো সর্বজনবিদিত না হলেও ফ্রিদা কাহলোর ডায়েরির আবেদন অন্য এক বোধের উদ্রেক করে- যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত হলেও সার্বজনীন। ডায়েরির উপরের ঝকঝকে প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছে ফ্রিদারই আঁকা ডানাসহ আত্মপ্রতিকৃতি ্লঝবন আক্ষষযনশ ঠভশফড়শ্, যা ডায়েরিটির শেষের দিকে এঁকেছিলেন শিল্পী। চিত্রটির উপরে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেছিলেন, ্লতুমি কি ছেড়ে চলে যাচ্ছশ্? আবার নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন, ্লনাশ্। ভাঙা ডানাশ্। ডায়েরিটির ঔজ্জ্বল্যকে বৃদ্ধি করেছে সাহিত্য অঙ্গনের এক জ্বলন্ত তারকা, মেক্সিকোর বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক কার্লো ফুয়েন্তেস লিখিত ভূমিকা। জীবনে সামনাসামনি একবার মাত্র দেখা ফ্রিদা কাহলোকে নাটকীয়ভাবে ফুয়েন্তেস উপস্থাপন করেছেন তাঁর এই ভূমিকায়। শুরুতেই বলেছেন, ্লফ্রিদা কাহলোকে আমি একবারই দেখেছিলাম, কিন্ত্ত তাকে শুনেছি আগে।শ্ মেক্সিকো সিটিতে অবস্থিত দ্য প্যালেস অব ফাইন আর্টস-এর বর্ণাঢ্য স্থাপত্য লিপিবদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন ফুয়েন্তেস এক সংগীত সন্ধ্যার বর্ণনায়, যার অতিথি হয়ে এসেছিলেন ফ্রিদা, লেখকের উপস্থিতির কিছু পরে। নানা অলঙ্কারে সজ্জিত ফ্রিদার প্রবেশক্ষণে অনুষ্ঠানের সকল আড়ম্বর ও আকর্ষণ যেন হয়েছিল নিষ্প্রভ, নিঃশব্দ। হাতের ধাতব ও কাচের কঙ্কন, দীর্ঘ কানের দুল, গলায় নানা বর্ণের পুঁতির মালা প্রভৃতি অলঙ্কারের সম্মিলিত ধাতব শব্দ আর সুসজ্জিত এই রমণীর প্রবেশ সেই বৃহৎ হলঘরে যেন উপস্থাপন করেছিল এক নীরব চৌম্বকত্ব। কার্লো ফুয়েন্তেসের ভাষায় ফ্রিদা যেন ইতিহাস থেকে উঠে আসা আজটেক দেবী, কিংবা বিদীর্ণ ক্লিওপেট্রা।

বইটিতে শিল্পী ফ্রিদা ও তাঁর এই ডায়েরিটি নিয়ে আরো একটি রচনা স্থান পেয়েছে যার রচয়িতা বিখ্যাত গ্রন্থকার সারা এম লোয়্যি। রচনাটির পরপরই শুরু হয়েছে মূল ডায়েরিটি, একপাশে নিজস্ব সাজ ও ভঙ্গিতে দ-ায়মান ব্যক্তিত্বময়ী ফ্রিদা সাদা-কালো আলোকচিত্রে উপস্থাপিত, অন্যপাশে পৃষ্ঠাজুড়ে মূল ডায়েরির চামড়া বাঁধানো কভার, উজ্জ্বল লাল রঙের মাঝখানে শিল্পীর নামের আদ্যাক্ষর দুটি খোদাই করা সোনালি বর্ণে। পুরো পৃষ্ঠা যেন নস্টালজিয়ার গভীর আবরণে আবৃত। এরপর মূল ডায়েরিটিকে সরাসরি ছেপে দেয়া হয়েছে নিখুঁতভাবে, নানা রঙের কালিতে মেক্সিকান ভাষায় শিল্পীর মন থেকে উদ্ভূত নানা আবেগ, নানা কথা, সেই সাথে শিল্পীর আঁকা নানা ধরনের বেশ কিছু মৌলিক চিত্র। এই অংশটি পুরোটাই রঙিন। মনে হয় হাতে বুঝি প্রকৃত জার্নালটি, মিউজিয়াম থেকে তুলে আনা, শুধুমাত্র সময়ের বিবর্ণতা থেকে সুরক্ষিত ঝকঝকে ছাপা মনে করিয়ে দেয় এটি অনুকরণ। প্রায় ১৬৭টি রঙিন প্লেটের এই প্রকাশনাটির বাকি অংশ মূল লেখার ইংরেজি অনুবাদ ও ডায়েরির বিভিন্ন পাতার অন্তর্নিহিত পটভূমি কিংবা বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনায় ভরপুর, সেই সঙ্গে রয়েছে ডায়েরিটির প্রতিটি পাতা- লেখা, রেখা, রেখাচিত্র ও ফ্রিদার অঙ্কিত বিচিত্র ধরনের চিত্রকর্ম। সাদা-কালোয় ছাপা এই অংশটি আন্তর্জাতিক পাঠকদের পাঠের জন্য আর সব মিলিয়ে পৃষ্ঠাবিন্যাস গ্রাফিক্সে নতুন একটি মাত্রা যোগ করে। ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৫৪ এই দশ বছরব্যাপী সময়কালে রচিত ডায়েরিটি ১৭১ পৃষ্ঠার হলেও, অনুবাদসহ আলোচ্য বইটিতে রয়েছে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠা ও ৩৩৮টি ইলাসট্রেশন। তবে মূল ডায়েরিটিতে এখন রয়েছে মাত্র ১৬১ পৃষ্ঠা, কেননা জীবনের শেষ পর্বে ফ্রিদার বন্ধুরা কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, কেন তা আমরা জানতে পারিনি।

নিউ ইয়র্কের এক দুর্লভ বইয়ের দোকান থেকে বন্ধুর কিনে দেওয়া এ ডায়েরিটিতে ফ্রিদা লেখা শুরু করেন ১৯৪৪-এর মাঝামাঝি সময়ে। তখন তাঁর বয়স ছত্রিশ কি সাঁইত্রিশ। সময়টা রুদ্র, এলোমেলো। যদিও বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছে ইতোমধ্যেই। ছয় বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হবার ঘটনায় ফ্রিদার শৈশব-উচ্ছলতা খানিক ম্লান হলেও তার জীবনপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়নি। কিন্ত্ত ১৯২৫ সালের মারাত্মক বাস দুর্ঘটনা তরুণী ফ্রিদাকে তার নির্ধারিত বাস্তব থেকে উপড়ে ফেলেছিল। দুর্ঘটনায় মেরুদ-ের হাড় ভেঙেছিল তাঁর কটিদেশের তিন জায়গায়, ডান পায়ের পাতা স্থানচ্যুত হয়ে থেঁতলে গিয়েছিল, বাম কাঁধ সরে গিয়েছিল সন্ধিস্থল থেকে, এমনকি পেলভিস ভেঙেছিল তিন জায়গায়। লোহার রড তলপেটের বামদিক দিয়ে ঢুকে ভ্যাজিনা দিয়ে বেরিয়ে আসায় কুমারিত্ব হারিয়েছে বলে ফ্রিদা কাতরভাবে আক্ষেপ করেছিলেন সেই ক্লান্ত বিপন্ন অচেনা সময়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা ফ্রিদা বিষাদের অন্তহীন সায়রে প্রায় নিমজ্জিত হয়েও অন্তরের এক আশ্চর্য শক্তিতে নতুন জীবনের স্বপ্ন ও আলোর ছোঁয়ায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিলেন। যার কথা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের, অমোঘ নিয়তি তাকে নিয়ে গেল শিল্পচর্চার এক অনন্য জগতে, জীবনটাই যেন হয়ে উঠল পরাবাস্তবতার এক মূর্ত প্রতীক। দুর্ঘটনা থেকে আমৃত্যু, এই ২৯টি বছর সময়কালে ফ্রিদার দেহে ৩৫টিরও বেশি অস্ত্রোপচার হয়। এ ছাড়াও একাধিকবার গর্ভপাতের অসহনীয় অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন ফ্রিদার মাতৃহূদয় সারাজীবন নীরবে কেঁদে গেছে একটি সুস্থ ভ্রূণকে ধারণ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়। কিন্ত্ত বাস্তব শারীরিক অবস্থা তার সেই বহু ঈপ্সিত স্বপ্নকে কখনোই পূরণ করতে দেয়নি। ১৯৩২ সালের মাঝামাঝি প্রথম গর্ভপাতের মানসিক আঘাতের ঝড় সইতে না সইতেই হারিয়েছিলেন মাকে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামলাতে সামলাতে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল প্রিয় স্বামী দিয়েগোর সাথে ১৯৩৯ সালে, আবার দিয়েগোর সাথেই পুনর্বিবাহের ঘটনাও ঘটেছিল ১৯৪০ সালে। এরই মধ্যে প্রিয় বাবাকে হারিয়েছিলেন ১৯৪১ সালে। নিয়তির কাছে পরাজয় মেনে না-নেওয়ার প্রত্যয়ে ফ্রিদা ক্রমেই শারীরিক অসহ্য কষ্ট আর মানসিক নিপীড়নকে অবয়বের আড়ালে লুকিয়ে সকলের কাছে হয়ে উঠেছিলেন সদা প্রাণবন্ত, অথচ একান্তে নিজের পরিসরে যন্ত্রণাবিদ্ধ আহত পাখির মতো কাতর। তাই ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতায় পাতায় কিংবা কখনো কোনো আপনজনের কাছে লেখা চিঠিতে ফুটে উঠেছে মানসিক ও দৈহিক বেদনার অনুভব।

ডায়েরিতে ফ্রিদা শুধু পরাবাস্তব আঙ্গিকে শব্দচয়নই করেননি, তিনি কাব্যিক ঢঙে লিখেছেন চিঠি, কখনো ব্যক্তিগত গ-ি ছাড়িয়ে তিনি চলে গেছেন সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক দর্শনের মুখোমুখি এক ক্যানভাসে; অথবা নারী হিসেবে সামাজিক অবস্থানের প্রতিকূলতায় দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে, কখনো বা প্রতিবাদের দ- হাতে। ফ্রিদার সত্তায় রিভেয়েরা ছিলেন অবিচ্ছেদ্য, অস্তিত্বের গভীরে একাত্ম হয়ে যাওয়া এক দুর্নিবার ধ্রুবতারা। দিয়েগো ছিলেন তার স্বপ্ন, তার বাস্তব। মমতা, ভালোবাসা, সংশয়, প্রেম কিংবা সন্তানের বাৎসল্যে আপ্ল্লুত অন্যরকম অনুভূতি। ডায়েরিতে তাই সব কিছুকে ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দিয়েগোর প্রতি তার অনন্য ভালোবাসা, আকর্ষণ, আর তাঁদের দাম্পত্য জীবনের নির্ভরশীলতা, দ্বন্দ্ব ও অনুভূতির প্রবল বৈপরীত্য। পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে, শব্দ কিংবা রেখা ও রঙের ছন্দে তাই ভেসে আসে মমতা ও কামোদ্দীপ্ত প্রেমে আচ্ছাদিত দিয়েগোর নাম। ডায়েরির একটি পাতা জুড়ে তাই দিয়েগোর কাছে ফ্রিদার কাব্যিক নৈবেদ্য-

দিয়েগো উৎস

দিয়েগো স্থপতি

দিয়েগো আমার শিশু

দিয়েগো ছেলেবন্ধু

দিয়েগো চিত্রশিল্পী

দিয়েগো প্রেমিক আমার

দিয়েগো স্বামী

দিয়েগো বন্ধু…

দিয়েগো-আমি-

দিয়েগো বিশ্ব

এককত্বে বিচিত্রতা

কেন আমি তাকে ডাকি

আমার দিয়েগো বলে?

সে কোনোদিনই ছিল না আমার

কিংবা হবেও না

সে শুধুই তার নিজের।

দিয়েগোকে লেখা একাধিক চিঠির মধ্যে লক্ষণীয় দীর্ঘ আট পৃষ্ঠা জুড়ে এক প্রেমঘন চিঠি। কখনো কখনো ঠাট্টার ছলে লেখা গভীর বোধের এই চিঠিগুলো এক ধরনের প্রেমপত্র হলেও অধিকাংশই প্রকাশ করে ফ্রিদার অনুভূতিতে অন্তর্নিহিত অসহনীয় বেদনা, প্রবল আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত মনস্তাপ। আবার কখনো ব্যক্ত করে তাঁদের দুজনকে ঘিরে থাকা গভীর ও অক্ষয় বন্ধন, স্বল্পস্থায়ী বিবাহবিচ্ছেদ আর দাম্পত্য অবিশ্বস্ততা যেখানে গৌণ।

ফ্রিদা কাহলোর ডায়েরিটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, তার তারিখ বা সময়কালের অনুপস্থিতি। দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত পৃষ্ঠাগুলোতে তারিখের ব্যবহার একেবারেই অবর্তমান। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত এই বিষয়টি রহস্যময়ী এই নারী সম্পর্কে কৌতূহল কমায় না, বরং অনেকাংশেই বাড়িয়ে তোলে। সৃষ্টিতে মৌলিকতা নিয়ে কাজ করা ফ্রিদার ডায়েরিটিও এর ব্যতিক্রম নয়। সম্পূর্ণ ডায়েরিটির উপস্থাপনে রয়েছে পরাবাস্তবতার এক প্রচ্ছন্ন ছায়া। কিন্ত্ত সচেতনভাবে নিজেকে পরাবাস্তব শিল্পী হিসেবে প্রকাশ করেননি তিনি, বলেছিলেন, ্লআমি কখনো জানতাম না আমি পরাবাস্তববাদী, আঁদ্রে ব্রেতো (ফরাসি পরাবাস্তববাদী কবি, লেখক যাকে বলা হতো পরাবাস্তববাদীদের পোপ) মেক্সিকোতে এসে আমাকে না বললে…আমি শুধু জানি আমি আঁকি, কারণ আমার প্রয়োজন…। …আমি কখনো স্বপ্নকে আঁকিনি, আমি এঁকেছি আমার নিজের বাস্তবকে।শ্

জীবনের একটা সময় শিল্পী-সাহিত্যিক ও কম্যুনিস্টদের সাহচর্য এনে দেয় তাঁকে নতুন উপলব্ধি, বন্ধু হিসেবে সঙ্গ লাভ করেন ট্রটস্কি, আঁদ্রে ব্রেতো, ইসামু নোগুচি, জ্যাকুইলিন লামবা, নিকোলাস মারে কিংবা আরো অনেকের। এভাবে ফ্রিদার উপলব্ধির পরিসর ব্যক্তিগত অঙ্গন থেকে ছড়িয়ে পড়ে শৈল্পিক অভিজ্ঞতা আর রাজনৈতিক সচেতনতার এক বিশাল প্যালেটে। সেই সুপ্ত অনুপ্রেরণা ও অভিজ্ঞতার আলোই ডায়েরির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়ে, অন্য বোধে উন্মোচিত হয় তার আনন্দ, বেদনা, কল্পনা ও বাস্তবতার পরশে সৃষ্ট শব্দযাত্রা আর রেখা ও রঙের শব্দহীন প্রকাশ। এভাবে ডায়েরির কাগজের পাতার মধ্য থেকে মূর্ত হয়ে ওঠে ব্যক্তি ফ্রিদা, শিল্পী ফ্রিদা, ঐতিহ্য, সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতায় আবিষ্ট ফ্রিদার নানা বোধ।

এই বোধ প্রকাশে ফ্রিদা কখনো কল্পনার চরাচরে ভাসমান সজীবতা, কখনো মাতৃত্বের ব্যাকুলতায় মগ্ন মমতা, কখনো বা প্রেম আর কামনার সংমিশ্রণে সৃষ্ট নারীমূর্তির অপার মোহনীয়তা আবার কখনো বা না-পাওয়া বেদনার অভিমানী কাতরতা। আমিত্বের অভিনব আধিপত্যে ফেমিনিজমের মূর্ত প্রতীক ফ্রিদা কখনো আত্মমগ্নতায় একাত্ম। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তাঁর ভাবনা, কল্পনার নীল জমিন, কাব্যিক স্বগতোক্তি- আছে রাজনৈতিক বিশ্বাস, চেতনা, দুশ্চিন্তা। কখনো বা ফুটে ওঠে ভালোবাসার পাওয়া-না পাওয়া, একাকীত্ব, ব্যথা-বেদনা এমনকি মৃত্যুচিন্তা।

১৯৫৩ সালে নিরুপায় হয়েই ফ্রিদার গ্যাংগ্রিন আক্রান্ত ডান পাটি কেটে ফেলতে হয়েছিল। ঝড়ে ভেঙে পড়া ডাল, তবু যেন আত্মপ্রত্যয়ের শেষ অবলম্বনটুকু আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই সারাজীবনের একাকী ফ্রিদা খুব নিঃসঙ্গভাবে চলে গিয়েছিলেন রহস্যময় পরলোকে। অনেকের ধারণা তিনি হাসপাতালের কক্ষে আত্মহত্যা করেছিলেন। মৃত্যুর মাত্র ১১ দিন আগেও অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি মেক্সিকোর রাস্তায় গুয়েতেমালায় আমেরিকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে হুইল চেয়ারে বসে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ডায়েরির ১৭১ পৃষ্ঠায় এঁকেছিলেন তাঁর সর্বশেষ প্রতিকৃতি। ধারণা করা হয় এটিই ছিল তার আঁকা সর্বশেষ শিল্পকর্ম। সবুজ পাখাযুক্ত কোনো এক প্রতিকৃতি যেন দেবলোকের দিকে ধাবমান, অথচ প্রতিকৃতিটি অন্ধকারাচ্ছন্ন, তার জড়ানো পদযুগল আর রত্ত্কের চলনছাপ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত করে ফ্রিদারই প্রতিকৃতি। যেই মৃত্যুকে সকলের সম্মুখে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন অথচ সকলের অলক্ষে হয়েছেন ভীত, বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া মনে যেই অন্তিমকালকে মনেপ্রাণে আকাঙ্ক্ষা করেছেন আবার প্রতিপক্ষ মেনে আজীবন যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সেই মৃত্যুকেই যেন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আহ্বান করছেন। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় আঁকা শিল্পীর এই শেষ নিস্তব্ধ চিহ্ক তাই এঁকে যায় অভিমানী সুরের এক চিরবিদায়ী গান। ডায়েরির ভূমিকার শেষে কার্লো ফুয়েন্তেস উল্লেখ করেছেন, ফ্রিদা কাহলো ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রতীকী ব্যক্তিত্ব, একজন আইকন। তাঁর মতে ফ্রিদা কখনো চোখ বন্ধ করেননি। ফ্রিদারই ভাষায়, ্লআমি লিখছি তোমাদের জন্য আমার দুচোখ দিয়ে।শ্ আর তাই চিরদিনের বুঁজে যাওয়া চোখ আজো প্রচ্ছন্ন হয়ে বেঁচে আছে ডায়েরির পাতায় পাতায়। প্রচ্ছন্ন সেই চোখের মধ্য দিয়েই ফ্রিদা কাহলো পাঠকের স্পর্শকাতরতার অনুভবে প্রবেশ করেন, আর সূক্ষ্ম অনুভূতির দরজায় আঘাত দেওয়া সেই জীবনবোধ এনে দেয় এক শৈল্পিক ঐশ্বর্যময়তা, এখানেই ডায়েরিটি অনন্য।