দূরলোকে নক্ষত্রেরা পরস্পরকে বিদীর্ণ করে
ঊর্ধ্বাকাশে আগুন জ্বালায়।
পৃথিবীর কালপথে বিবশ স্নায়ুপুঞ্জের ঘুম
বক্ররেখায়
বিধুর নিঃশ্বাস।
– ‘অবিনাশের সঙ্গে’, জাফর আহমদ রাশেদ
সব কালেই শিল্পের নিজস্ব ভাষারীতি তৈরি হয়। শিল্পের ভাষাই নির্ণয় করে কালিক চরিত্র। ঐতিহ্যমন্থনের সঙ্গে নিসার হোসেন সময়কে নির্মাণ করেন রেখায়। বলা যায়, তালপাতায় চিত্রিত পুঁথির বর্ণনা আমরা দেখি পাল-চিত্রকলায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ, অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পা-ুলিপির বারোটি রঙিন চিত্র বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত। নিসার হোসেনের তালপাতায় আঁকা রেখাচিত্রে মিথের সংশ্লিষ্টতা নেই, আছে তালপাতার সারি সারি জমিনের মধ্যে রেখার উদ্ভাসন। নতুন এক সিম্ফনি। কৃত্রিম শহুরে জীবনপ্রণালির মধ্যে গড়ে ওঠা অসভ্যতা, ধোঁয়ার নগরীতে জমতে থাকা মানুষের হানাহানি, বীভৎসতা এবং বিকারগ্রস্ত সময়কে রেখায় উৎকীর্ণ করতে গিয়ে শিল্পী নিসার হোসেন তালপাতার শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁর লিখনে বলেন, ‘অতি চমৎকার এবং দীর্ঘস্থায়ী এই মাধ্যমটির উপকরণ আর কৌশলগুলো হাতে-কলমে শিখে নেয়ার পাশাপাশি কিছু পত্রফলকও সংগ্রহ করে নিয়ে এলাম। দাফতরিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোহার কণ্টক (লোহার কাঁটা দিয়ে) দিয়ে পত্রফলকগুলোতে আঁচড় কাটবারকালে আপনা থেকেই উদ্ভট, বিকট, অমার্জিত, বর্বর, হিংস্র, জঘন্য, নোংরা সব চেহারা আর অঙ্গভঙ্গিগুলো রূপ পেতে থাকে, যার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমারও জানা নেই।’
পুঁজিবাদ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক, আধিপত্যের আগ্রাসন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অন্তর্চাপে মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচরণে বৈকল্য দেখা দেয়। চিন্তায় দৈন্য সৃষ্টির পাশাপাশি শুভ মানসে তৈরি হয় বাধা। নিসার হোসেনের রেখাচিত্রে যে-বর্ণনা বা আখ্যান দেখা যায় তা সময়েরই বর্ণনা। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মগুলোকে বয়ান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। শিল্পীর মানসলোকের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রকাশকে তিনি রৈখিক বয়ান বলে চিহ্নিত করেন। মনোজগতের রক্তপাতে অবসন্নতা তৈরি না হয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও ঘৃণা। এ-ঘৃণা বিকলাঙ্গ পরিকল্পকের প্রতি। এ-সৃষ্টিকর্ম আমাদের সৃজন-চেতনার সুন্দর বোধের সম্ভাবনাকে নাড়া দেয়, শিল্পাঙ্গনে নতুন নতুন সৃষ্টিসম্ভারের সঙ্গে বোধেরও উন্মেষ ঘটেছে।
এ-প্রদর্শনীতে তিন ধরনের কাজ উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথমত, তালপাতার ফলকে কালো সূক্ষ্মরেখায় আঁকা চিত্রমালা; দ্বিতীয়ত, মিনিয়েচারধর্মী, ধাতব পাতে করা এচিং থেকে নেওয়া প্রিন্ট; তৃতীয়ত, কালো জমিন রেখে খোদিত রেখার প্রিন্ট। একই বিষয়কে তিনটি মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তিনভাবে। ফলে রেখার শক্তিমত্তার সঙ্গে বিষয় বর্ণনা উঠে এসেছে সাবলীলভাবে। বিবর্ণ একরঙা এ-ধরনের রেখায় কোনো সুর-ছন্দ নেই, কৌণিক, উল্লম্ব আড়াআড়ি রেখার গতি বিষয়ের মধ্যে তীক্ষèতা সৃষ্টি করে। মানুষের কিংবা জন্তুর শরীরে যেন জান্তব ভাষা দেখা যায়। নিসারের কাজে অসভ্যতার ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্পের করণকৌশলের সঙ্গে বিষয়বর্ণনার মিল রেখে তাঁর সৃষ্টিকর্ম এক নতুন ভাষার খোঁজ দেয়। বলা যেতে পারে, পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকার’ প্রতিবাদী রূপের মধ্যে শিল্পের মূল রচনাশৈলীর উপস্থিতির মতো কাজগুলোতে নির্দিষ্ট একটি কেন্দ্রে দৃষ্টি থমকে যায়। নিসার হোসেনের কাজের শক্তি এখানেই।
রেখার মধ্যে গতি আর ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলা রেখার দ্রুতগতি দর্শককে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।
তালপাতার খ-গুলোকে একসঙ্গে জোড়া দিয়ে দীর্ঘ যে-জমিন তিনি তৈরি করেছেন, তাতে ছবির মধ্যে তালপাতার বিভাজন রেখা মূল রেখার গতিতে ছেদ তৈরি করে বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। এচিং বা অ্যাকুয়াটিন্ট প্রিন্টের ক্ষুদ্র আকৃতির রেখাচিত্রের মধ্যে অল্পসংখ্যক রেখার চলাচল ছবিতে স্বস্তি তৈরি করেছে। কালো জমিনের মধ্যে সাদা রেখার দ্যুতিময়তা দর্শকের মধ্যে বিদ্রƒপাত্মক ভাষা জাগিয়ে তোলে।
বিকারগ্রস্ত, দুর্বিনীত সময়ের কাছে আমরা অসহায় হয়ে আকাশে তাকাই, ঊর্ধ্বলোকের এ-দেহভঙ্গির সঙ্গে ছুটে চলে রেখাগুলোও। নিসার হোসেনের ছবির রেখা আমাদের পথ বাতলে দেয় না, শুধু অবস্থার কথা বলে।
চলতি সময়ের শ্বাপদসংকুল আস্ফালন মানুষের জন্য শোক বয়ে আনে। সেই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পক্ষে এ-কাজগুলো এক অনবদ্য বয়ান, যা সভ্যতার দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় আবারো। রাজধানীর কলাকেন্দ্রে গত ১০ জুলাই শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ১৪ আগস্ট।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.