বঙ্গবন্ধুর অন্য গুণ

আনিসুল হক
বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন স্বাধীনতা। এটা তিনি দিয়েছেন তাঁর প্রতিজ্ঞা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, দূরদর্শিতা, পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, আত্মদানের মাধ্যমে। তিনি কখনো মৃত্যুভয় পেতেন না, দেশের জন্য নিজের জীবন, সুখ, পরিবারের সুখ উৎসর্গ করে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা তাঁর ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অবদান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, হবে। এখানে তাঁর কতগুলো কম আলোচিত গুণের ওপর আলোকপাত করতে চাই।

গায়ক বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু গান পছন্দ করতেন, গায়কদের পছন্দ করতেন, এটা আমরা কমবেশি জানি। তাঁদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে যেমন, তেমনি ৩২ নম্বরের বাড়িতেও গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল। গান বাজত। তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা গান শুনতেন। বেগম মুজিব তাঁর ছেলেমেয়েদের ছায়ানটে দিয়েছিলেন। সবাই কমবেশি গান শিখেছেন, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছেন। শেখ রেহানা নাচও শিখেছিলেন। শেখ কামাল মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন, টেলিভিশনেও অভিনয় করেছেন।

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’

কিন্তু তিনি নিজে গান গাইতেন, পারিবারিক আসরে গান গেয়ে শুনিয়েছেন, এই খবরটা কি আমরা জানি?

বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী (প্রথমা প্রকাশন) শীর্ষক বইয়ে কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন : ‘মে মাসের শেষের দিকে, তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই, একদিন শেখ মুজিবের স্ত্রী টেলিফোন করে বলল, ‘ভাইসাহেব, আমাদের বাসায় দশটার সময় আপনাকে আমাদের সঙ্গে নাশতা খেতে হবে।’ আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ডাক্তারের অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে আমার খাবারের ব্যাপারে।আমি অন্য এক সময়ে তোমাদের বাড়িতে আসব।’ কিন্তু বউমা নাছোড়বান্দা। তাই আমাকে যেতে হলো। মুজিব দু-তিনটি গান গাইল। তারপর সেতার বাজাল মুজিবের বড় ছেলে কামাল। সেতারে তার হাত ভালোই মনে হলো।’

পাঠক বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন :

একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।

ছাত্রলীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নেতাদের নেননি, নিয়েছিলেন কবি-সাহিত্যিকদের। এটা কিন্তু আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক।

কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুখস্থ ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন :

বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তাঁর পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাঁদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দেলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু-একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের  ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন।

১৯৫১ সাল। বঙ্গবন্ধুর বয়স ৩১। তিনি জেলখানা থেকে চিঠি লিখেছেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে।

আমার জন্য কিছুই পাঠাবেন না। আমার কোনো কিছুরই দরকার নাই। নূতন চীনের কিছু বই যদি পাওয়া যায় তবে আমাকে পাঠাবেন।

১৭ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে লেখা তাঁর কারাগারের রোজনামচায় আছে :

আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে ReaderÕs Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। … কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই  মহাজ্ঞানী ও গুণী!

২৪ জুলাই ১৯৬৬ কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন :

মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।

বিপদে মোরে রক্ষা করো

এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

১৮ জুন ১৯৬৬-তে শেখ মুজিব জেলখানায় বসে ডায়েরিতে লিখছেন :

এমিল জোলার লেখা তেরেসা রেকুইন পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র – জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আইজাক আসিমভের, নাজিম হিকমতের। এসব কথা তিনি তাঁর বইয়ে লিখে রেখে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ – আবৃত্তি করতেন। ষাটের দশকে তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠেছিল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী। ১৯৫৬ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নেতারা। অনেকেই উর্দুভাষী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে তাঁদের সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সংগীত-নাটক-নৃত্য ভালোই হলো। কিন্তু শেখ মুজিব বলে বসলেন, ‘এত নাটক হলো, গান হলো, কিন্তু তোমরা ‘আমার সোনার বাংলা’ শোনাবা না?’

 শিল্পীরা আবার মঞ্চে উঠলেন। সবাই মিলে গান ধরলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

 ১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিবকে বাংলার মানুষ মুক্ত করে এনেছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিশ্চিত ফাঁসির রজ্জু থেকে। তিনি এখন বঙ্গবন্ধু। শিল্পীরা তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। এঁদের মধ্যে তাঁরাও আছেন, যাঁরা ১৯৬৭ সালে রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। দালাল শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সংবর্ধনায় যেতে বঙ্গবন্ধুকে মানা করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমিও যাব, আপনিও যাবেন।’ সংবর্ধনায় তাঁরাই রবীন্দ্রপ্রীতি দেখালেন, বঙ্গবন্ধুর স্তাবকতা করলেন, কিছুদিন আগেও যাঁরা বিবৃতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের সমালোচনা করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আপনাদের রবীন্দ্রপ্রীতিতে আমি মুগ্ধ হয়েছি, আপনারাই কিছুদিন আগে রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। যাক, আপনারা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটা এবার গেয়ে শোনান।’ জাহিদুর রহিমকে খুঁজে-পেতে আনা হলো। সব শিল্পী মিলে গান ধরলেন – ‘আমার সোনার বাংলা’।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বাংলার মানুষ যখন তাঁকে মুক্ত করে আনল, রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেওয়া হলো, তখন তাঁর ভাষণে তিনি বলেছিলেন : ‘জ্ঞান আহরণের পথে কোনো সরকার বাধা দিতে পারে, তা আশ্চর্যের ব্যাপার। মোনেম সরকার তো হাই সাহেবকে বলেছেন, কী করেন আপনারা। রবীন্দ্রসংগীত রচনা করতে পারেন না। হাই সাহেব বলেছেন, পারি, তবে তাতে মুশকিল বাড়বে, তা রবীন্দ্রসংগীত হবে না, হাই সংগীত হয়ে যাবে।

আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়র, অ্যারিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য, আর দেউলিয়া সরকার আমাদের রবীন্দ্রনাথ পাঠ নিষিদ্ধ করতে চায়। যিনি একজন বাঙালি কবি, বাংলায় কবিতা লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গাওয়া হবেই।’

১৯৭১ সাল। ৩ জানুয়ারি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা। বঙ্গবন্ধু সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের শপথ করালেন, কেউই ছয় দফা থেকে এক অক্ষরও সরবে না, সরতে পারবে না। সভার শেষে দুটো গান পরিবেশিত হয়। ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ আর ‘আমার সোনার বাংলা’।

খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধু

 ‘আমি খেলাধুলা করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এটা তিনি লিখেছেন। ১৯৩৭ সালের কথায় এটা পাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু ফুটবল খেলতেন। গোপালগঞ্জে তাঁর আব্বার দলের সঙ্গে তাঁর দলের ম্যাচ হতো। এই বিষয়ে তিনি লিখেছেন :

লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি।স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম।আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।

১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বৎসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, ‘কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।’ আমি বললাম, ‘আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা’। গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, ‘তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।’

আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন।আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন, ‘মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান।আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।’ আমি বললাম, ‘স্যার আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব।’ এ বছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর ‘এ জেড খান শিল্ডের’ এই শেষ ফাইনাল খেলা। এ. জেড. খান এসডিও ছিলেন, গোপালগঞ্জেই মারা যান। তাঁর ছেলেদের মধ্যে আমির ও আহমদ আমার বাল্যবন্ধু ও সাথী। আমির ও আমি খুব বন্ধু ছিলাম। আমিরুজ্জামান খান এখন রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করেন। ওর বাবা মারা যাবার পর যখন গোপালগঞ্জ থেকে চলে আসে তখন ওর জন্য আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম।

হেডমাস্টার বাবুর কথা মানতে হল। পরের দিন সকালে খেলা হল। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।

প্রকৃতি ও প্রাণীপ্রেমিক বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে মিনি চিড়িয়াখানা ছিল। ৩২ নম্বর বাড়িতেও হাঁসমুরগি ছিল, গরু ছিল, কবুতর ছিল, কুকুর ছিল, বিড়াল ছিল। একটা বিড়াল তিনি নিয়ে এসেছিলেন জেলখানা থেকে।

কারাগারে হলুদ পাখির জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন :

সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আমগাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।

 বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।

কারাগারের রোজনামচা এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে গাছ নদী চাঁদ অন্ধকার ফুল বাগান নিয়ে অনেক সুন্দর বিবরণ আছে। তিনি নিজে বাগান করতেন। গাছ লাগাতেন। আগাছা পরিষ্কার করতেন। তিনি লিখেছেন :

দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দুর্বল বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলি আমি নিজেই তুলে ফেলি।আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ – যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে অনেকগুলি তুললাম।

 আমার মোরগটা আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে। ছোট মুরগির বাচ্চারা ওকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলছে না। কাক যদি ওকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। এক সাথে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেঈমানী করে। পশু কখনো বেঈমানী করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধহয় মানুষের চেয়ে একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।

সুন্দরবন

এবারো নিজের বুক পেতে সব আঘাতকে ধারণ করে, সাইক্লোনের তীব্রতাকে মন্থর করে দিয়ে সুন্দরবন বাঁচাল বাংলাদেশকে। ২০১৯ সালের ৯ ও ১০ নভেম্বর ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখানো হয়েছিল বাংলাদেশের উপকূলে, শঙ্কা করা হয়েছিল প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ধেয়ে আসছে। তবে আবহাওয়া-বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুন্দরবনই এবারো রক্ষা করেছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবনের গাছের বাধায় কমে এসেছে বাতাসের বেগ।

এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

২০০৭ সালের সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন প্রথম আলোয় সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইফতেখার মাহমুদের লেখা সিরিজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : বিরক্ত না করলেই বাঁচবে সুন্দরবন। সুন্দরবনে গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত নেয় বন বিভাগ। এক বছরের মধ্যেই আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় সুন্দরবন।

দুই

অনেকদিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম, নাম ছিল ‘সুন্দরবন’। প্রথম আলোয় সেটা প্রকাশিত হলে একটা ই-মেইল পেয়েছিলাম। লিখেছিলেন জিয়া জিয়াবুল করিম। তিনি তখন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। এক দিন আগেও জিয়ারা ছিলেন বাঁশখালীতে, তাঁর নানাবাড়িতে। মৃত্যু যেন তাঁদের টেনে আনল নিজেদের বাড়িতে, কুতুবদিয়ায়।

সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘলা, আবহাওয়া ছিল গুমোট আর বৃষ্টি হচ্ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধ্যার পর বাতাসের বেগ গেল বেড়ে। ভয়ংকর হয়ে উঠল প্রকৃতি। যেন ইস্রাফিলের শিঙা বাজছে। ভয়ে জড়সড় সাড়ে চার বছরের জিয়া আর তাঁর আরও দুই ভাই দুই বোন আশ্রয় নেন মায়ের আঁচলের তলায়।হঠাৎ বক্ষবিদারী আওয়াজ, পানি আসছে, পানি। বাবা তাঁদের সবাইকে ঘরের চালের ওপরে তুলে দেন। নিজেও আশ্রয় নেন অ্যাসবাস্টাসের চালে। জিয়া আমাকে ই-মেইলে লিখেছিলেন, ‘মায়ের কোলে তখন আমি আর আমার দেড় বছরের ভাই রবিউল আর তিন বছরের বোন রহিমা। আমার আর দুই ভাই বাবার সঙ্গে আমাদের পাশে।’ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, সুচের মতো বৃষ্টি এসে লাগছে গায়ে, পানি ধেয়ে আসছে, বাঁকা জল, ক্রূর জল। ভয়ানক আওয়াজ হচ্ছে। বজ্রবৃষ্টি হচ্ছে ভীষণ! সাগর থেকে ধেয়ে আসছে পাহাড়ের সমান ঢেউ। পানি বাড়ছে। চালে-জলে একাকার। অনেকেই চালের পাশের গাছে উঠে যেতে সক্ষম হলো। জিয়া লিখেছেন, ‘আমরা গাছে উঠতে পারিনি। আমাদের অ্যাসবাস্টাসের চাল ভেঙে যায় সহজেই। কিন্তু কাঠের তৈরি খিলানি ধরে আমরা টিকে থাকার চেষ্টা করছি। জলে ডুবছি আর ভাসছি। একটা ভাসমান ট্রাংকের মধ্যে বাবা আমার ছোট ভাইবোন দুটোকে রেখে সেটা আঁকড়ে ধরে আছেন। আমি চালের খিলানি ধরে আছি ভেসে। আমার একটা জ্যাঠাতো বোন মাকে ধরে আছে বাঁচার শেষ চেষ্টায়। একটা প্রচণ্ড ঢেউ এলো। আমার বড় ভাই দুটোকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। দূরে কয়েকটা গাছ দেখা যাচ্ছে। ভাবছি সেটায় উঠে পড়া যায় কি না। কিন্তু কোত্থেকে একটা বাঁশের বেড়া এসে পড়ল আমাদের ওপর। সবকিছু ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। মনে হলো, সব শেষ। মিনিট কুড়ি পরে বাবা আবিষ্কার করলেন, আমি তাঁর গলা ধরে আছি। তিনি তখন একটা গাছে উঠে পড়লেন আমাকে নিয়ে। ভীষণ শীতে আমার সমস্ত শরীর অবশ। বাবার পরনে ছিল একটা সোয়েটার। বাবা সেই সোয়েটারের ভেতরে আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি গাছ ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। আর আমি তাঁর পেটের সঙ্গে সোয়েটারঘেরা হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙল।

পরে আমার বড় দুই ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ছোট ভাই, বোন আর মাকে আর কোনো দিনও খুঁজে পাওয়া গেল না। বড় হয়ে শুনেছি, তিনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখন। মাকে আমার মনে পড়ে, আবার মনে পড়েও না। মনে না পড়ার সুবিধা হলো, আমার মনে হয়, আমার মা ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে মমতাময়ী মুখের অধিকারিণী।

‘মায়ের কোনো ছবি নেই আমার, মায়ের কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি নেই। আমি জানি না, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে কেমন লাগে, কেমন লাগে মা মা বলে ডেকে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। ২৯ এপ্রিল এলেই এই সব কথা বড় বেশি মনে বাজে, আর সারাটি ক্ষণই যে মায়ের মুখ আমি মনেও করতে পারি না, তাঁকে খুব মনে পড়ে।’

জিয়ার এই চিঠিটা আমি তুলে ধরেছিলাম প্রথম আলোয় ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪-এ।

সুন্দরবন কিন্তু আমাদের মায়ের মতোই। নিজে আঘাত সয়ে আমাদের বাঁচায়।

সুন্দরবন নিয়ে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুন্দরবনের এই অসাধারণ ভূমিকার কথা জানতেন, উপলব্ধি করতেন, আমাদেরও এ-ব্যাপারে সচেতন করে গেছেন।

১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই তিনি বৃক্ষরোপণ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :

আমার মনে আছে, একবার ১৯৬৭-৬৮ সালে তদানীন্তন সরকারে যাঁরা ছিলেন, আমি বলেছিলাম, আলাপ হয়েছিল চিঠির মাধ্যমে, আলাপ হয়েছিল যে সুন্দরবনকে রক্ষা করেন। না হলে বাংলাদেশ থাকবে না।তাঁরা বললেন, আমাদের রেভিনিউ নষ্ট হয়ে যায়, প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো, কী করে গাছ কাটা বন্ধ করে দিই? তাহলে চলবে কী করে? আমি তখন বললাম, আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই।স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায় – তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই।মেহেরবানি করে দেড় কোটি টাকার জন্য আমার এই বাংলার সর্বনাশ আপনারা করবেন না। কিন্তু কানে দেয় নাই এ-কথা। কারণ তারা দরদ নিয়া আসে নাই। কারণ তাদের প্রয়োজন ছিল বাংলার গাছ, বাংলার সম্পদ, বাংলার র ম্যাটেরিয়াল। লুট করে নিয়া যাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।

বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে সাত কোটি মানুষের অর্ধেক মানুষ, যারা সাবালক, সাড়ে তিন কোটি – তাদের প্রত্যেককে একটা করে গাছ লাগাতে আহ্বান জানান। তিনি ফলের গাছ লাগাতে বলেন। গাছের যত্ন নিতে বলেন। এবং তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণের কথাও জানান। তিনি বলেন, ছোটরা তাঁর কথা বেশি শোনে, বড়রা তেমন শুনতে চায় না।

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ভাষণটা অনলাইনে শুনতে পাওয়া যায়। শুনলে কেমন মায়া লাগে। মায়া বোধ হয় সুন্দরবনের জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, দেশের জন্য। এ-কথাটাও মনে দাগ কাটে, ছোটরা কথা শোনে, বড়রা তেমন শুনতে চায় না।

পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা

বঙ্গবন্ধু তাঁর আব্বা আর আম্মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনি লিখেছেন :

আমি জানি না আমার মতো এত স্নেহ অন্য কোনো ছেলে পেয়েছে কি না! আমার কথা বলতে আমার আব্বা অন্ধ। আমরা ছয় ভাইবোন। সকলে একদিকে, আমি একদিকে। খোদা আমাকে যথেষ্ট সহ্যশক্তি দিয়েছে, কিন্তু আমার আব্বা-মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই, কিছুই ভালো লাগে না। খেতেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না, তারপর আবার কারাগারে বন্দি।

বঙ্গবন্ধুর আব্বা তাঁকে সাহস দিয়েছেন, টাকাপয়সা দিয়েছেন, শাসন করেছেন, উপদেশ দিয়েছেন।প্রথমবার মারামারি করে জেলে যাওয়ার আগে তাঁর আব্বা জিগ্যেস করেছেন, ‘কী, মারপিট করেছ?’ তিনি মাথা নিচু করে থাকলেন। কিন্তু দেশের জন্য মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন, এই নিয়ে তাঁর পিতামাতার কোনো আপত্তি ছিল না। তাঁরাও বীরের মতোই ব্যাপারটাকে নিয়েছেন। যদিও মা জিগ্যেস করেছিলেন, ‘এত যে পাকিস্তান পাকিস্তান করলা, সেই পাকিস্তানে তোমাকে জেলে যেতে হয় কেন?’ তাঁর আব্বা তাঁকে বলেছিলেন শেরেবাংলা বা হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো কিছু না বলতে। তিনি পিতার আদেশ মানার চেষ্টা করতেন।

বাবুর্চি মুজিব

বঙ্গবন্ধু কারাগারে রান্নাও করেছেন। তিনি লিখেছেন :

একদিন হঠাৎ আমার পাকের ঘরের কাছে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, সেখানে খবরের কাগজে কালি দিয়ে লিখে কাঁঠাল গাছে টানাইয়া রেখেছে কোনো কয়েদিকে দিয়ে। তাতে লেখা আছে, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, খিচুড়ি দিতে হবে।’ নীচে লেখা ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ’। আমি তো নূরুল ইসলামের হাতের লেখা চিনি। বাইরে ও পোস্টার লেখতো। তারই হাতে লেখা। আমি তাদের ডেকে বললাম, এসব দাবিটাবি চলবে না। দরকার হলে জনাব মোনেম খানের পন্থা অবলম্বন করব। খুব হাসাহাসি চললো। মাঝে দুই-একজনে দুই একবার স্লোগানও দিয়েছে – ‘খিচুড়ি দিতে হবে’।

আজ সুযোগ হয়ে গেল। মালপত্র পাওয়া গেল। বিকালে তাদের বললাম, ‘যাহা হউক তোমাদের ভাবির দৌলতে তোমাদের খিচুড়ি মঞ্জুর করা গেল। আগামীকাল খিচুড়ি হবে।’

যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিমও পাঠাইয়াছে। কয়েকদিন না খেয়ে কয়েকটা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চাও জোগাড় করা হয়েছে। আমি তো জেলখানার বাবুর্চি, আন্দাজ করে বললাম কি করে পাকাতে হবে এবং আমার কয়েদি বাবুর্চিকে দেখাইয়া দিলাম। পানি একটু বেশি হওয়ার জন্য একদম দলা দলা হয়ে গেছে। কিছু ঘি দিয়ে খাওয়ার মত কোনোমতে করা গেল। পুরানা বিশ সেলে আটজন ডিপিআর, তাদের ফালতু, পাহারা, মেট চারজন করে দেওয়া হলো। আমার আশপাশেও ৮/১০ জন আছে সকলকেই কিছু কিছু দেওয়া হলো। ডিম ভাজা, ঘি ও অল্প অল্প মুরগির গোস্তও দেওয়া হলো। গোসল করে যখন খেতে বসলাম তখন মনে হলো খিচুড়ি তো হয় নাই, তবে একে ডাউল-চাউলের ঘণ্ট বলা যেতে পারে। উপায় নাই খেতেই হবে, কারণ আমিই তো এর বাবুর্চি। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম বলল, ‘মন্দ হয় নাই’। একটু হেসে বললাম, ‘যাক আর আমার মন রাখতে হবে না। আমিই তো খেয়েছি।’ যাহা হউক খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায় হলো, আমিও বাঁচলাম।

রসিক বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু খুব রসিক ছিলেন। তিনি যখন কথা বলতেন, গল্প বলতেন, লোকজন মগ্ন হয়ে শুনত। তাঁর কথায় নানা রসিকতা থাকত।

আমার লেখা এই পথে আলো জ্বেলে বই থেকে তুলে ধরছি :

শেখ মুজিব বললেন, ‘সিংহ, বাঘ আর পাতিশিয়ালের গল্পটা শুনেছিস তো? এক ছিল বন। সেই বনে থাকে এক বাঘ, এক সিংহ আর এক পাতিশিয়াল। তিনজনে মিলেমিশে থাকে। একদিন তিনজন মিলেই শিকার করে আনল একটা মোষ, একটা গরু আর একটা হরিণ।

শিকার শেষে বনের রাজা সিংহ তার প্রধান সহযোগী বাঘকে বলল, বাঘ মিয়া, বলো, এই তিনটা শিকার আমরা কীভাবে ভাগ করে নেব।

বাঘ বলল, আপনি পশুরাজ, আপনি নেবেন মোষটা, আমি বাঘ, আমি নেব গরুটা, আর শিয়াল নেবে হরিণটা।

সঙ্গে সঙ্গে সিংহ রেগে গেল। এক থাবা বসাল বাঘের ঘাড়ে। পাজি কোথাকার, এই তোর বিচার। সেই থাবায় বাঘ চিতপটাং। আর উঠতে পারে না।

এবার সিংহ শিয়ালকে বলল, বলো কীভাবে ভাগ করা হবে?

শিয়াল বলল, মোষটা হুজুর দুপুরে খাবেন, রাতে খাবেন গরুটা, আর কাল সকালের নাশতায় খাবেন হরিণটা। ভাগ খতম।

শুনে সিংহ বেজায় খুশি। তিনি পাতিশিয়ালকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, তুমি তো খুব সুন্দর ভাগ-বাটোয়ারা করতে পারো। কোথা থেকে শিখলে এই সুন্দর বণ্টনরীতি!

শিয়াল বলল, হুজুর, এই বণ্টনরীতি শিখতে আমাকে বেশি দূর যেতে হয়নি। ওই যে আমাদের সামনে পড়ে আছে বাঘ, তার দুরবস্থা দেখেই এই বণ্টনরীতি আমি শিখে ফেলেছি।’ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। শেখ মুজিব গল্প করছেন শাহ মোয়াজ্জেম ও অন্য সহবন্দীদের সঙ্গে।

এরই মধ্যে তাঁর চারপাশে আরও শ্রোতা এসে ভিড় করেছেন। তাঁরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।

শেখ মুজিব বললেন, ‘তোদের ওই মোনেম খানও বণ্টনরীতি ঠিকঠাক শিখে ফেলেছেন। তিনি জানেন, সবকিছু করতে হবে আইয়ুব খানের নামে। তাই তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।’

শাহ মোয়াজ্জেম বললেন, ‘আচ্ছা মুজিবভাই, বিরোধী দলের অনেক দাবি তো থাকে ন্যায্য। সেসব মেনে নিলেই তো রাষ্ট্রের উপকার হবে। সরকারের ক্ষতি কম হবে। জনগণের উপকার বেশি হবে। সেসব না মেনে সেই দাবি স্তব্ধ করতে কেন আয়োজন। এত ষড়যন্ত্র। কেন এত স্টিমরোলার?’

মুজিব বললেন, ‘তুই ঠিক বলেছিস। আমাদের দাবি মেনে নিলে জনগণের উপকার হবে। রাষ্ট্রের ক্ষতি কম হবে। তাই তো আমি সব সময় বলি, দাবি মেনে নাও। আমরা আর সংগ্রামের পথে যাব না। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনে না। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। ক্ষমতা মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে। ক্ষমতাসীনেরা সব সময় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকে। তারা মনে করে, চারদিকে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সব সময়। পশ্চিমারা দাবি মানতে দেরি করে ফেলছে। যখন দাবি মানবে, তখন জনগণ আরও এগিয়ে যাবে। ওই দাবি মানলেও তখন জনগণকে আর সন্তুষ্ট রাখা যাবে না। এটা ওরা বুঝছে না। ওদের অবস্থা হবে সেই উজানীর বউটার মতো!’

শাহ মোয়াজ্জেম আবারও গল্পের সন্ধান পেলেন। ‘মুজিবভাই, উজানীর বউয়ের গল্পটা কী। ওটা শোনান।’

শেখ মুজিবকেও যেন গল্পে পেয়েছে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এটা মিজান চৌধুরীর গল্প। ওর মুখে শুনলে তোরা বেশি মজা পেতি। এক বউ সব সময় উল্টো পথে চলে। স্বামী যা বলবে, শাশুড়ি যা বলবে, সে ঠিক তার উল্টো কাজটা করবে। ডানে যেতে বললে যাবে বামে। উত্তরে যেতে বললে যাবে দক্ষিণে। কিছুতেই সে কথা শুনবে না। একদিন বউটা নদীতে পানিতে ডুবে মরে গেল।

তখন তার মৃতদেহ খোঁজার কাজ চলছে। স্বামী লাশ খোঁজে। আরও লোক এসে জুটল। মাঝিমাল্লা, জেলেরা এসে নদীতে জাল ফেলতে লাগল।

স্বামী বলল, এইখানে সে নদীতে পড়েছে, তার লাশটা খুঁজতে হবে উজানে।

সবাই বলল, তা কী করে হয়? লাশ তো যাবে ভাটিতে।

স্বামী বলল, আমার বউ। আমি জানি। সে কোনো দিনও সোজাপথে চলে নাই। উল্টো পথে চলেছে। সবার লাশ ভাটিতে যাওয়ার কথা, আমার বউয়ের লাশ যাবে উজানে।

সবাই উজানে লাশ খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল না। শেষে ভাটিতে খোঁজা শুরু হলো। দেখা গেল, লাশ স্রোতে ভেসে বেশ নিচের দিকে চলে গেছে। লাশ পাওয়া গেল।

তখন স্বামী বেচারা ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপ করে বলতে লাগল, হায় রে উজানী, সেই তো ভাটিতেই গেলি! শুধু বেঁচে থাকতে গেলি না।’

শাসকদেরও একদিন চৈতন্যোদয় হবে। তারাও একদিন ভাটিতে যাবে। আমাদের কথা শুনবে। শুধু বেঁচে থাকতে যাবে না। যখন যাবে, তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রটা আর বেঁচে থাকবে না।

১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে মন্ত্রীদের স্ত্রীর জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠান শেষে ইন্দিরা গান্ধী ১৪ মন্ত্রীর প্রত্যেকের হাতে একটা করে শাড়ি তুলে দিলেন। বঙ্গবন্ধু ছোঁ মেরে মনোরঞ্জন ধরের শাড়িটি কেড়ে নিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরীর হাতে তুলে দিলেন। ইন্দিরা গান্ধী বিস্মিত। বঙ্গবন্ধু বললেন, মনোররঞ্জন ধর ব্যাচেলর, আর জহুর আহমদ চৌধুরীর দুই বউ।

এবং রেণু

বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ওরফে রেণুকে ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন, তাঁর ওপরে নির্ভর করতেন তুলনারহিতভাবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর আব্বা আর তাঁর স্ত্রীর অবদান খুব বেশি। বঙ্গবন্ধুর লেখার পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে রেণুর কথা, আব্বার কথা। আমরা যে আজ বঙ্গবন্ধুর লেখা বই পাচ্ছি, তার কারণও বেগম মুজিব। তিনি তাঁকে বাঁধানো খাতা দিয়ে বলেছেন, ‘লেখো।’

 বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :

আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’

… হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যত দূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কী? সময় তো কিছু কাটবে। … আমার স্ত্রী, যার ডাকনাম রেণু – আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেণু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।

বঙ্গবন্ধু স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন, পিতা হিসেবে কেমন ছিলেন, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, তাঁর একটা চিঠিতে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুদর্শন হবে।

ঢাকা জেল

১৬-৪-৫৯

রেণু,

আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কতো দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাসিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়মমতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি এঁকে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট, ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।

ইতি –

তোমার মুজিব

এ-চিঠিতে আমরা পাচ্ছি স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা এবং কর্তব্যবোধ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোই যে প্রধান কাজ সেই বোধ, সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা, স্ত্রীর কুশল চিন্তা, স্ত্রীকেও পড়তে বলা এবং ছবি আঁকার গুরুত্ব! আর তিনি নিজে কী করছেন? পড়ছেন। আর নিজের স্বার্থত্যাগ, আত্মদান, আত্মত্যাগ। একা থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে। চিন্তা নাই।

নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন :

তোমার পা একবারও টলে উঠলো না, চোখ কাঁপালো না।

তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়

বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য

একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের  চেয়ে বেশি।

কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি  গুলির মূল্য একজন শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখা  আনন্দের চেয়ে বেশি।