বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রপ্রীতি প্রসঙ্গে

সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে শুধু চলচ্চিত্রশিল্প নয়, শিল্পের সকল শাখার প্রতিই বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ ছিল। তবে বর্তমান রচনায় শুধু তাঁর চলচ্চিত্রপ্রীতি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছুটা ধারাবাহিকভাবে তাঁর চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টতা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। শুরুতেই বলা দরকার যে, বক্ষ্যমাণ রচনার বেশিরভাগ অংশই আমার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি ভাবনা, পূর্বে প্রকাশিত কয়েকটি বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রভাবনা বিষয়ক প্রবন্ধ ও অন্য লেখকগণের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনা থেকে নেয়া।

আমরা জানি যে, ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই মন্ত্রিসভার শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন। সেইসময় ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন নাট্যজন-চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান, পূর্ববাংলার পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক ড. আবদুস সাদেক, নুরুজ্জামানসহ অনেকে। তিনি তাঁদের ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেশ করতে বলেন। 

সেইসূত্রে আবদুল জব্বার খান ও তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দীন যৌথভাবে সরকারের কাছে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তার পূর্বে ১৯৫৫ সালের শেষ দিকেই ইতালি থেকে একটি চলচ্চিত্র মিশন ঢাকায় এসেছিল। ওই মিশন পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পরামর্শ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক সরকার এ-অঞ্চলে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রসারের লক্ষ্যে পাঁচ বছরমেয়াদি একটি পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদা রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এরই মধ্যে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পুরান ঢাকায় অবস্থিত ‘মায়া’ সিনেমা হলে উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত শাপমোচন চলচ্চিত্রটি দেখেন বলে জানা যায়। এটি দেখার কয়েকদিন পর পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্পের অবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসে চলচ্চিত্র সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা এরকম :

সিনেমা করার জন্য যে অবকাঠামো দরকার তা কোথায় এখানে? বঞ্চনা তো সর্বক্ষেত্রেই, পার্টিশনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সবাই ছিল বোম্বেতে। এখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো চলচ্চিত্রশিল্পই তো তখন ছিল না। অথচ এই ন’বছরে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রের সহযোগিতায় পশ্চিম পাকিস্তানেও গড়ে উঠেছে চলচ্চিত্রশিল্প। … এখানে তো কিছুই নেই। লোকের হাতে না আছে মূলধন, না আছে উপকরণ, না আছে সেরকম কোনো স্টুডিও। পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও না থাকলে কোনো মতেই দর্শনীয় ছবি করা সম্ভব না।

উদ্ধৃতি দৃষ্টে বলা যায়, এ-অঞ্চলের চলচ্চিত্রশিল্পের দুরবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিবের ধারণা ছিল। তাই তিনি মন্ত্রী থাকাকালে সুযোগ পেয়েই ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে The East Pakistan Film Development, 1957 উপস্থাপন করেন, যার ভিত্তিতে ‘ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ-অঞ্চলে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রসার ঘটে। উল্লিখিত বিল পেশ করার পূর্বে ১৯৫৭ সালের ৮-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ছিলেন।

সেখানে ভারতীয় সাংস্কৃতিক দল কর্তৃক সত্যজিৎ রায়-নির্মিত পথের পাঁচালী (১৯৫৫) দেখানো হয়। তবে সম্ভবত চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে সেটাই মুজিবের প্রথম পরিচয় নয়। এর আগে ১৯৫৬ সালেও চলচ্চিত্রশিল্পের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ লক্ষ করা যায়, যার কথা ইতোমধ্যে ওপরে উল্লিখিত হয়েছে। আবার এ-ও হতে পারে, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কলকাতাবাসের সময় তিনি চলচ্চিত্র দেখেও থাকতে পারেন। অবশ্য সে-বিষয়ে কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত আমাদের জানা নেই।

যাই হোক, ইপিএফডিসি তথা ‘ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এখানে চলচ্চিত্র একইসঙ্গে ‘আর্ট’ এবং ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৫৭ সালে প্রাদেশিক পরিষদে বিলটি উত্থাপনের সময়ই এই শিল্পটির বয়স বাষট্টি (১৮৯৫-১৯৫৭) এবং বিশ্বব্যাপী রীতিমতো একটি ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। শুধু চলচ্চিত্র নয়, শিল্পের নানা আঙ্গিকই তখন ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পুঁজির দাসত্ব মেনে চর্চিত হতে শুরু করে।

বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিকদের বীক্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে, তখনই। বিশেষ করে জার্মানির ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল’ সংস্কৃতি যে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হওয়ার ফলে সংস্কৃতির লোকায়ত রূপটি হারিয়ে ফেলছে, তা গবেষণার আওতায় নিয়ে আসে। ১৯২০-২৩-এর দিকে ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল’ যখন সংস্কৃতি-ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে তাত্ত্বিক পর্যায়ে গবেষণা করছে, ততোদিনে সমাজতান্ত্রিক কয়েকটি দেশ ছাড়া সব দেশেই ব্যক্তি বা বহুজাতিক মালিকানাধীন পুঁজির আওতাধীন হয়ে পড়েছে সংস্কৃতির নবতর চলচ্চিত্র মাধ্যমটি। সোভিয়েত ইউনিয়ন একে জাতীয়করণ করেছে লেনিনের জমানাতেই। বঙ্গবন্ধুও হয়তো সে-পথেই যেতেন। কারণ তিনি স্বাধীনতার পর ব্যাংক-বীমাসহ কিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছিলেন।

আমরা শুনেছি যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান কলকাতায় বসে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে কীভাবে জাতীয়করণ করা হবে সে-সম্পর্কিত একটি খসড়া প্রস্তাব রচনা করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই তাঁর নিখোঁজ বড়ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি এবং তাঁর রচিত সেই প্রস্তাবও আলোর মুখ দেখেনি। যাই হোক, চলচ্চিত্রশিল্পে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে এক রচনায় লিখেছিলাম :

ভারতবিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের জনসংযোগ বিভাগের তত্ত্বাবধানে সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রচার-প্রচারণার জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্যের সংবাদচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য তেজগাঁও-এ অবস্থিত বি.জি. প্রেসের ভেতর স্থাপিত হয় প্রাদেশিক সরকারের চলচ্চিত্র শাখা। তখন স্বল্প বা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কোনো ফিল্ম স্টুডিও বা ল্যাবরেটরি পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এখানে পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের দাবি ওঠে। তবে সত্য এই যে, অবাঙালি চলচ্চিত্র আমদানিকারক ও পরিবেশকরা চাননি যে এ-অঞ্চলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠুক। এরকম অবস্থায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের পরাজয় ঘটে। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন করে। … বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিলটি পেশ করার সময় অনেকগুলো ‘পূর্বশর্ত’ তৈরি হয়েই ছিল … যেমন এ-অঞ্চলে অনেকগুলো সিনেমাহল চালু ছিল, যেগুলোতে অন্যদেশে নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো এবং হলমালিকরা ভালো ব্যবসাও করতো; চলচ্চিত্র পরিবেশকরা-বুকিং এজেন্টরাও ভালো আয় করতো। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডও সক্রিয় ছিল। চলচ্চিত্র তখন ধীরে ধীরে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। আমরা দেখি যে, ঐ সময়ে চলচ্চিত্রবিষয়ক কিছু পত্রিকা যেমন চিত্রালী, সিনেমা প্রভৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। সবমিলিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশের পূর্বশর্তসমূহ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। … প্রকৃত প্রস্তাবে ইতিহাসে পূর্বশর্ত তৈরি না-থাকলে কোনোকিছুই নিজে থেকে সংগঠিত হয় না। বিলটি পেশ করার জন্য একজন শেখ মুজিবুর রহমানের যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি একজন নাজীর আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা না-হলে অতো দ্রুত সব কাগজপত্র তৈরি হয়তো হতো না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, চলচ্চিত্রমাধ্যমটি ধীরে ধীরে আমাদের এখানে ইন্ডাস্ট্রি ও আর্ট হয়ে উঠেছে। ইন্ডাস্ট্রি হওয়ার পেছনে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন যেমন প্রেরণা হিসেবে সক্রিয় ছিল, তেমনি আর্ট হওয়ার পেছনের ইতিহাসও একই। পশ্চিমা শাসকরা ভাষাসহ সংস্কৃতির নানাক্ষেত্রে যখন নেতিবাচক মনোভাব দেখায় তখন এর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতির সকল শাখার চর্চাকারীরা। চলচ্চিত্রমাধ্যমে উৎসাহীগণও বসে থাকেননি। সেই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আইয়ুবশাহির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠা, পরোক্ষভাবে হলেও। এ-প্রসঙ্গে সংগীতজ্ঞ ও ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’-এর প্রতিষ্ঠালগ্নের সদস্য ওয়াহিদুল হকের কথা উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে :

গত শতাব্দীর পাঁচ-ছয়ের দশক পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক নবজাগরণের জন্ম দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা তখন নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দাবিয়ে রেখে শোষণ করে চলেছে। বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ করেছে, রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে বাধা দিয়েছে – বাঙালি সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কবিতা-গল্প-উপন্যাস, গান, নাটক, পোস্টার, নৃত্য প্রভৃতি হয়েছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। ছয়ের দশকের শুরুতে আনোয়ারুল হক খান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ চলচ্চিত্রকেও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের একটি আঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়োজন অনুভব করলেন এবং সেই সূত্রে চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেন। ওয়াহিদুল হক এ-প্রসঙ্গে বলেছেন – ‘আমি কাজটিকে নিলাম ‘ছায়ানট’-এর আরব্ধ কর্মেরই প্রসারণ হিসেবে – গান দিয়ে ছায়ানট যা করতে চেষ্টা করছে, সংসদ তাই করবে চলচ্চিত্র চর্চার মধ্য দিয়ে। কাজটি হল পাকিস্তানী অচলায়তনের পাঁচিলে ধস ধরানো, সুস্থতা, উদারতা, সংস্কৃতি মনস্কতার পথ কাটা। … দেশ-বিদেশের সার্থক মহৎ চলচ্চিত্রের প্রদর্শন, তার রস ও মর্মগ্রহণ আমাদের মধ্যযুগীয় মফস্বলীপনার খুব দক্ষ উৎসাদন হবে – এই ছিল হিসেব।’ [ওয়াহিদুল হক, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, মন্তাজ, ৪র্থ সংখ্যা, তানভীর মোকাম্মেল ও অন্যান্য (সম্পাদক), ঢাকা, ১৯৯২, পৃ ৬৭]।

ইতোমধ্যে উল্লিখিত হয়েছে যে, চলচ্চিত্রশিল্পও ১৯৫২ সালে সংঘটিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে প্রেরণা নিয়েছে। আমরা জানি যে, ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান পর্বে আবদুল জব্বার খাঁ মুখ ও মুখোশ নির্মাণ করেন। এই নির্মাণ-প্রচেষ্টার পেছনে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনজাত বাঙালির স্বাধিকার চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল। এ-বিষয়ে ড. শাহাদৎ রুমন চলচ্চিত্রবিষয়ক গবেষকদের সহায়তা নিয়ে লিখেছেন :  

দেশভাগ পরবর্তীসময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি তথা লাহোরের চলচ্চিত্র বাজারের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিপরীতে বাঙালি তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীদের চলচ্চিত্র নির্মাণের দুঃসাহসিক যাত্রার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল বায়ান্নর একুশ-উত্তর সাংস্কৃতিক প্রকাশের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। [মফিদুল হক (১৯৮৯), ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের চলচ্চিত্র’, ইন্টারকাট, ৪র্থ সংখ্যা, ১৯৮৯, চট্টগ্রাম, পৃ ৯৬]। … বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাব ক্রমেই সে-সময়ের নির্মাতাদের মননে ক্রিয়া করতে শুরু করে। … বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বীরত্বগাথাকে আশ্রয় করে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৭)। পরবর্তীসময়ে ইবনে মিজান (১৯৩৭-২০১৭) শহিদ তিতুমীরের জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেন ‘শহীদ তিতুমীর’ (১৯৬৮) নামক চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রসমূহ আক্ষরিক অর্থে তৎসময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান স্বাধিকার আন্দোলন তথা এদেশের মানুষের স্বাধিকার চেতনাকে নবমাত্রায় উজ্জীবিত করে। কেননা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তিতুমীর উভয়েই দেশমাতৃকার জন্য নিজেকে বলিদান দিয়েছেন। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রের আলোকে সমালোচক লিখেন, ‘গণতন্ত্রহীন নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বাঙালিরা ছবিটি দেখে সিরাজের অভিনয়, সংলাপ ও দেশপ্রেমের মধ্যে মুক্তির স্বাদ পায়।’ [অনুপম হায়াৎ (২০১১), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, পৃ ২৫]। … অর্থাৎ বাঙালির স্বাধিকারের চেতনাগত স্ফুরণ এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তৎসময়ে প্রবাহিত হয়েছিল বলে মনে করা যায়। চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানও একটি লেখায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সেসময়ের বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতীকরূপে চিত্রায়ণ করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন। [মাহবুব আজাদ (২০০০), খান আতাউর রহমান (জীবনীগ্রন্থ), বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০০, পৃ ১৯৬-১৯৯ দ্রষ্টব্য]। … এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় এদেশের প্রথম ‘গণ-চলচ্চিত্র’ তথা ‘গণ আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র’ ‘জীবন থেকে নেয়া’। ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাঙালির ইতিহাস অন্বিষ্ট আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনানির্ভর চলচ্চিত্র। [আহমেদ আমিনুল ইসলাম (২০০৮), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : আর্থসামাজিক পটভূমি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ ৩৫।]। চলচ্চিত্রের নির্মাতা জহির রায়হান সমকালীন রাজনীতি এবং তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে রূপকের আশ্রয়ে চলচ্চিত্রে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। উক্ত চলচ্চিত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালন, এবং ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে মুক্তি পাওয়ায় এদেশে চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন তথা স্বাধিকার আন্দোলনে তীব্রতাদানে সক্ষম হয়েছিল।

ওপরের উদ্ধৃতি থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্বে চলচ্চিত্রশিল্পে স্বাধিকার চেতনার প্রকাশ, গণনেতা শেখ মুজিবের সংগ্রামী চরিত্র প্রতিকায়িত করা, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রূপকের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো ইত্যাকার বিষয় অবগত হওয়া গেছে। এসবই পূর্ব পাকিস্তান পর্বের কথা যা থেকে তখনকার সময়ে চলচ্চিত্রমাধ্যমে জড়িতজনদের সংগ্রামী ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। এই পর্বে বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টতা সম্পর্কেও আমরা জেনেছি – তিনি ১৯৫৭ সালে   টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পথের পাঁচালী দেখিয়েছেন; ওই বছরই পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে The East Pakistan Film Development Bill, 1957 শীর্ষক বিলটিও উপস্থাপন করেন।

শুধু পূর্ব পাকিস্তান পর্বে নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ জারি ছিল। সূত্রমতে, ১৯৭৩ সালের দিকে চলচ্চিত্রকর্মীদের একটি প্রতিনিধিদল চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় চলচ্চিত্রের বাজার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। কারণ ওই সময় কিছু চলচ্চিত্র-প্রযোজক ও হলমালিক অধিক মুনাফা করার লক্ষ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েন। যে-দলটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন, সেই দলে ছিলেন ক্যামেরা-সঞ্চালক মাসুদ-উর-রহমান। তিনি ‘স্মৃতি ধন্য অন্তর’ শীর্ষক এক নিবন্ধে যা লিখেছেন তা থেকে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। তিনি লিখেছেন :

আমাদের প্রতিনিধিবৃন্দের অনেকেই কথা বলছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করছেন। বঙ্গবন্ধু নীরবে শুনছেন এবং মাঝে মাঝে তিনি কথাও বলছেন। এক সময়ে তিনি অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। উদাস দৃষ্টি মেলে চলচ্চিত্রকারদের উদ্দেশ্য করে তিনি তাঁর অন্তরস্থ কিছু কথা বললেন – আমি হয়তো আর বেশী দিন বাঁচবো না-রে! এই বাংলাদেশকে আমি বড়ই ভালবাসি। তোদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার সোনার বাংলা, তোরা যদি পারিস –    এই সোনার বাংলাদেশকে নিয়ে সোনার বাংলা ছবি তৈরি করিস …।

বঙ্গবন্ধুর কথাতে তিনি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে কী ধরনের চলচ্চিত্র প্রত্যাশা করেন তা প্রকাশিত। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবনবাস্তবতাকে প্রতিফলিত করবে, এমন ধরনের ‘ছবি’ তৈরির কথাই সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন। তাঁর ‘সোনার বাংলা’ যেহেতু প্রধানত তাঁর ভাষায় ‘দুঃখী’ কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির বাংলা, সেই বাংলা ও সেই বাংলার কৃষক-শ্রমিক জীবনকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র খুব কমই তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ ছিল বরাবরই। এ-বিষয়টিও জানা যায় মাসুদ-উর-রহমানের নিবন্ধ থেকে। উল্লিখিত প্রতিনিধিদলের একজন ছিলেন অভিনয়শিল্পী আনোয়ার হোসেন।

মাসুদ-উর-রহমান লিখেছেন : 

মধুর হাসি নিয়ে আরো এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে। সামনের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে তিনি বললেন – এই যে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। শিল্পী আনোয়ার হোসেনের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। থতমত অবস্থায় সহাস্যে আনোয়ার ভাই বললেন – না মুজিব ভাই, বাংলার নবাব তো আপনি। আনোয়ার হোসেনকে জড়িয়ে ধরলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর স্মিত কণ্ঠে বললেন তিনি – নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিটি আমি কয়েকবার দেখেছি। তোর অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে রে। এখন তো সময় পাই না। তবে, মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই সংলাপগুলো – ‘বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব আলিবর্দ্দী খান –    তোমার সে উপদেশ আমি ভুলিনি। তুমি বলেছিলে ইংরেজকে বিশ্বাস করো না, ওরা সুযোগ পেলে এদেশ কেড়ে নেবে।’ সংলাপগুলি বলতে বলতে বঙ্গবন্ধু হলের মাঝখানে রাখা সোফাতে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ উদাস হয়ে রইলেন।

শুধু খান আতাউর রহমান-পরিচালিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) নয়, শেখ মুজিব-সালাহ্উদ্দিন-পরিচালিত জনপ্রিয়      লোকগাথাভিত্তিক রূপবান (১৯৬৫) চলচ্চিত্রটিও দেখেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের সংগ্রাম (১৯৭৪) চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। এ-বিষয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক-গবেষক অনুপম হায়াৎ চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্নজনের বরাত দিয়ে লিখেছেন :

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যস্ততম রাজনৈতিক কর্মজীবনের অবসরে বাংলাদেশে নির্মিত ‘রূপবান’ এবং ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্র দুটি দেখেছিলেন। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন সূত্রে ‘রূপবান’ এবং চিত্রগ্রাহক মাসুদ-উর-রহমান সূত্রে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ দেখেছিলেন বলে জানা যায়। সৈয়দ হাসান ইমাম জানান যে, বঙ্গবন্ধু ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবির চরিত্রে রূপদানকারী আনোয়ার হোসেনকে ‘বাংলার নবাব’ বলে সম্বোধন করেছিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। এতে মনে হয় তিনি ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। চাষী নজরুল ইসলাম সূত্রে জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘সংগ্রাম’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

সংগ্রাম চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর অভিনয় তাঁর চলচ্চিত্রপ্রীতির একটি নমুনা। ‘অভিনয়’ বলতে একটি দৃশ্যে তাঁর অংশগ্রহণকেই বোঝানো হয়েছে। ঘটনাটা এরকম – এ-চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে যে, সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন জানাচ্ছে। নানা সূত্র থেকে জানা যায়, দৃশ্যটি ধারণ করার ব্যাপারে চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম ও এ-চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী ছাত্রলীগকর্মী-মুক্তিযোদ্ধা কামরুল আলম খান খসরু অনেক বলেকয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করান।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদারকিতে মার্চপাস্টের আয়োজন করা হয় পিলখানায়। শুটিং হয় ১৯৭৩ সালে। এক টেকেই শট ওকে করতে হবে, কারণ অনেক আয়োজন। দুবার দৃশ্যের আয়োজন করা কষ্টকর কাজ। যাই হোক, দৃশ্যে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু অভিবাদন গ্রহণ মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর পেছনে গিয়ে বসলেন জিয়াউর রহমান, কে এম শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফসহ সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় অনেক সেনা কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্যালুট দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর বঙ্গবন্ধু তা গ্রহণ করছেন কপালে হাত ঠেকিয়ে। এ-দৃশ্যটি তাঁর নিজ ইচ্ছায় চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণের একমাত্র নমুনা হিসেবে রয়ে গেছে তাঁর ‘সোনার বাংলা’য়!

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি কাজও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ-পোড়াদেশে। সেটি হচ্ছে, চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির বিকাশের জন্য প্রশাসনিক পর্যায়ে গৃহীত তাঁর একটি উদ্যোগ – বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলচ্চিত্রশিল্পকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রচার-প্রসারের জন্য কিছু উদ্যোগ উল্লিখিত পরিকল্পনায় তিনি নিয়েছিলেন। এ-প্রসঙ্গে অনুপম হায়াৎ লিখেছেন :

বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের জন্য ৪ কোটি ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ ফিল্ম স্টুডিয়োর সম্প্রসারণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে নতুন ফিল্ম স্টুডিয়ো স্থাপন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং সারা দেশে ১০০টি নতুন সিনেমাহল নির্মাণ এবং এর ফলে দেশে ৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। এই উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জনের জন্য তৎকালীন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রীকে ভারতের পুনা ফিল্ম (অ্যান্ড টেলিভিশন) ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।

বলারই অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ফলে এসব উদ্যোগের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত চলচ্চিত্রমাধ্যমের চর্চা যাতে নির্বিঘ্নে এদেশে করা যায়, তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সকল মেয়াদের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে চলচ্চিত্রবিষয়ক গবেষক লিখেছেন :

স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৩ এপ্রিলকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; ডিজিটাল প্রযুক্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণপ্রযুক্তি কেনা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে ৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ ঘোষণা করা হয়েছে। নতুনভাবে স্থাপিত সিনেপ্লেক্সকে পাঁচ বছরের জন্য ‘কর’ রেয়াত দেওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, চিত্রগ্রাহক, কলাকুশলীদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত চলচ্চিত্রকর্মী ও চলচ্চিত্রবিদ্যার বিস্তারের জন্য ‘চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ খোলা হয়েছে যা এদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীদের দীর্ঘদিনের একটি দাবী ছিল। ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮০’ সংশোধন করা হয়েছে যাকে চলচ্চিত্র সংসদকর্মীরা কালাকানুন বলে এতোকাল আখ্যায়িত করে আসছিলেন। অনুদানের অর্থ ও চলচ্চিত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ‘জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা’ বিল আকারে সংসদে পেশ করে আইনে পরিণত করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে একশত পাঁচ একর জমির ওপর ফিল্ম সিটি নির্মাণ যা অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে।১০

উল্লিখিত সকল উদ্যোগ চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়া বর্তমানে ‘ফিল্ম সেন্সর বোর্ড’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড’ করার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে – এ-পরিবর্তনটি ভারতে ১৯৮২ সালের দিকেই করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত এ-আইনে ‘সেন্সর’ শব্দটির পরিবর্তন দরকার, কারণ এই শব্দে নিবর্তন-নিয়ন্ত্রণের প্রকাশ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে শব্দটি তাঁর সংস্কৃতিচিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই আমাদের অভিমত। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন – কাজ করার জন্য আরো সময় পেলে দেশ গড়ার ক্ষেত্রে নব-নব পরিকল্পনাসহ চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নতির ব্যাপারে যে আরো উদ্যোগ নিতেন, সেকথা কথা তো বলাই যায়।    

তথ্যনির্দেশ

১. অনুপম হায়াৎ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস, প্রথম প্রকাশ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ ৫৭।

২. তানভীর আহমেদ সিডনী, বঙ্গবন্ধুর  সংস্কৃতি-চেতনা, প্রথম প্রকাশ, তাম্রলিপি, ঢাকা, ২০২০, পৃ ৪৯।

৩. সাজেদুল আউয়াল, ‘বিষয় : জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস’, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, সংখ্যা ১৩, সম্পাদক : শচীন্দ্র নাথ হালদার, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, ডিসেম্বর, ২০১৭, পৃ ৩৪।

৪. উদ্ধৃত : সাজেদুল আউয়াল। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর : অর্জন ও অতৃপ্তি’, সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত –    ১৯৬৩-২০১৩, সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন পরিষদ, সম্পাদক : সাজেদুল আউয়াল, ঢাকা, ২০১৪, পৃ ৩০৪।

৫. ড. শাহাদৎ রুমন, ‘চলচ্চিত্রে বাঙালির ‘স্বাধিকার’ চেতনার উপস্থাপন’, অপ্রকাশিত রচনা, ঢাকা, ২০২০।

৬. মাসুদ-উর-রহমান, ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে চিত্র প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ’, উদ্ধৃত : অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র,    তৃণলতা প্রকাশ,  ঢাকা, ২০১৭, পৃ ৭১।

৭. মাসুদ-উর-রহমান, ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে চিত্র প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ’, উদ্ধৃত : অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র,   তৃণলতা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭, পৃ ৭০-৭১।

৮. অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র, প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০২০, পৃ ২৯।

৯. অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র, প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০২০, পৃ ২৭। ১০. সাজেদুল আউয়াল, ‘বিষয় : জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস’, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, সংখ্যা ১৩, সম্পাদক : শচীন্দ্র নাথ হালদার, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, ডিসেম্বর, ২০১৭, পৃ ৮।