বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

রামায়ণে দেখি রামের অনুপস্থিতিতে রাজার দায়িত্ব পেয়ে ভরত সিংহাসনে দাদার পাদুকা রেখে তাঁর হয়ে অযোধ্যা শাসন করেছিলেন। ঘটনাপ্রবাহে আকস্মিকভাবে রাজ্যভার হাতে পেয়ে অপ্রস্তুত মানুষটির মনে হয়েছিল, এটাই কার্যকর পন্থা হবে। অনুপস্থিত হলেও রামই তাঁর বংশের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি – তিনি প্রতীক ও প্রেরণা।

পরিস্থিতি এবং ব্যক্তির ভূমিকা মিলে ইতিহাসে কেউ কেউ কোনো জাতির বিশেষ কালের প্রতীক ব্যক্তিত্ব ও অবিনশ্বর প্রেরণায় উন্নীত হন। বলার অপেক্ষা রাখে না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই জাতির কাছে মুক্তি ও স্বাধীনতার অক্ষয় প্রতীক ও অফুরন্ত প্রেরণা। রাজনীতিতে তাই এ-কথাটা চালু আছে যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আদতে অনোন্যনির্ভর। এককে বাদ দিয়ে অন্যকে ভাবা যায় না।

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের পথরেখা ধরে যদি আমরা এগোই তাহলে দেখব ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় যিনি ছিলেন একজন কর্মী তিনি ১৯৪৮-এর ভাষা-আন্দোলনের সময় একজন অগ্রসর সংগঠক, ১৯৫২ সালে কারান্তরালে থেকেও তিনি একজন প্রখর রাজনৈতিক পথনির্দেশক। ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ কেবল বুঝতে পারছেন তা নয়, সেভাবে দল এবং কর্মীদের গড়ে তোলার জন্যেও পরিকল্পনা আঁটছেন। চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় মুজিব তরুণ নেতা, কিন্তু তখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দ্ব্যর্থহীন মতামত দিয়েছেন। এই সময় এবং পরবর্তী কয়েক বছর জ্যেষ্ঠ বাঙালি নেতাদের আপসকামিতা ও দোদুল্যমানতার মধ্যে রাজনীতিতে যেসব গ্লানিকর ঘটনা ঘটেছে তা তরুণ নেতাকে জাতির কল্যাণে নিজের বিশেষ দায়িত্ব বুঝে নিতে সাহায্য করেছিল। সামরিক শাসনের সময় শেখ মুজিব অনেকের সঙ্গে কারাবন্দি এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত। কিন্তু সুযোগ পেয়েই তিনি ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠন করে কাজের পরামর্শ দেন। এর মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে শেখ মুজিবকে অনিবার্যভাবে স্বাধীনভাবে নেতার ভূমিকা নিতে হয়। তিনি সেই দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীনতার পথরচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। জেল ও জনসভা, পোড়খাওয়া জননেতায় রূপান্তর ও মানুষের ভালোবাসায় বাঁধা পড়ার এক স্বকীয় প্রক্রিয়া তখনই শুরু হয়। এই সময় জেলে এবং বাইরে তিনি কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহসহ অনেকের সঙ্গেই স্বায়ত্তশাসনের দাবিসংবলিত ছয় দফা নিয়ে আলোচনা করেন। এর সারবত্তা ও যৌক্তিতা অনুধাবন করলেও কেউই কিন্তু তা গ্রহণে সাহস পাননি। তাঁদের মনে হয়েছে, দাবিটি নিয়ে মাঠে নামার সময় এখনো আসেনি, তবে কেউ কেউ এতে পাক-সরকারের সঙ্গে কঠিন সংঘাতের আশঙ্কাও নিশ্চয় করেছেন। মুজিব নির্দ্বিধায় এই দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন থেকে তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে সেই অমর রবীন্দ্রবাণী – যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

হ্যাঁ, এই এক সিদ্ধান্তে শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে অনেক জ্ঞানী, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং এমনকি অনেক বেশিদিন জেলখাটা নেতা ও রাজনীতিবিদকে পেছনে ফেলে জনমানসে এগিয়ে থাকলেন। দেশের দরিদ্র-নিরন্ন মানুষ বারবার রাজনীতিকদের কথায় ঠকেছেন, তাঁদের ওপর আস্থা রেখে ভোগান্তিতে পড়েছেন। নেতারা তাঁদের ছেড়ে ক্ষমতার প্রসাদ নিয়েছেন বা মাঠ ছেড়েছেন, কিন্তু মুজিবের মধ্যে তারা পেলো একজন সাহসী খাঁটি মানুষ, যিনি জনতাকে ছেড়ে ক্ষমতায় বসবেন না, যিনি চরম নির্যাতনেও মাঠ ছেড়ে যাবেন না, সবার সঙ্গে থেকে সকলকে নিয়েই পথ চলবেন। মানুষের এই আস্থা, এই বিশ্বাস একদিনে তৈরি হয়নি, এ কেবল বক্তৃতা, মন্ত্রিত্ব বা গণমাধ্যমের তৈরি কিছু নয়। এটি ঘটেছে বহুদিনের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড ও যার মধ্যে নিজের জন্যে কিছু পাওয়ার-করার আকুলতা একটুও ছিল না। নিজের প্রাপ্তির মধ্যে জনগণের কল্যাণ দেখতে পাননি মুজিব। তিনি মানুষের ওপর হুকুমের সর্দার নন, তিনি তেমন নেতা যিনি মূলত জনসেবক, তাদের ছেড়ে বাদ দিয়ে তাঁর কোনো কাজই নেই। ফলে কেবল দলীয় নেতা নয়, কর্মী নয়, দেশব্যাপী ছড়ানো সমর্থক ও সাধারণ মানুষের আপনজন হয়ে ওঠেন মুজিব।

ছয় দফার আন্দোলনের সময় যে জেল-মামলার নির্যাতন চলেছে তা তাঁর নেতৃত্বকে যেন পুড়ে পুড়ে সোনা করেছে। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যেভাবে যে-পৌরুষের দৃপ্ত বলিষ্ঠতায় মোকাবিলা করেছেন তা তাঁকে ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে অনন্য উচ্চতায় তুলেছে।  রাজনীতির মাঠে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ থাকল না, সমকালের প্রেক্ষাপটে তিনিই যেন এক মহীরূহ। একদিক থেকে তাঁর নেতৃত্ব তখন পর্যন্ত অনন্য, অতুলনীয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জনগণের আন্দোলন ও দাবির মুখে যিনি মুক্ত হয়ে সেনানিবাসের বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি ইতিহাসের নায়ক, জাতির নয়নের মণি, জনগণের আস্থার প্রতীক, তাদের সংগ্রামের অনন্ত প্রেরণা।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বাংলাদেশের যাত্রাপথকে দিলো শক্ত ভিত্তি। তরুণরা জাতির হয়ে তাদের সময়ের মহানায়ককে বরণ করে নিল – প্রীতির ডোরে বাঁধল বঙ্গবন্ধু ডেকে, আর শ্রদ্ধার উচ্চাসনে বসালো এক দেশের এক নেতার সম্মান দিয়ে। তাঁর সমসাময়িক, বয়োজ্যেষ্ঠ, তরুণ, নিজ দল ও অন্য দলের, নিজ মত ও ভিন্ন মতের সকল বাঙালির একমাত্র নেতা তখন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দিকে তাকিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, পেশাজীবী এবং হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, শহুরে-গ্রামীণ সকলে বঙ্গবন্ধুকেই চিনেছে মেনেছে তাদের নেতা হিসেবে। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকেও মানুষ চিনে নিল আরেক নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে। তাজউদ্দীন এবং মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান হলেন বঙ্গবন্ধুর চার নির্ভরযোগ্য অনুসারী নেতা। সত্তরের নির্বাচন আসতে আসতে এই যৌথ নেতৃত্বে মানুষের আস্থা এবং উদ্দীপনা আরো বাড়ল। আন্দোলন আর থামল না, কোনোভাবেই থামানো গেল না। লৌহমানব আইয়ুবের পতনের মাধ্যমে কিছুটা বিরতিতে গেল মাত্র। কারণ আন্দোলনের ফলে যেমন ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হলো ও বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিদের মুক্তি ঘটল, তেমনি সাধারণ নির্বাচনের তারিখও পাওয়া গেল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বাঙালি পাকিস্তানকে চূড়ান্ত জবাব দিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনায় নিল। ফলে পাকিস্তানিদের সকল অনুমান ও হিসাব পালটে দিয়ে এ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঘটল বিপুল বিজয়। এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসা বাঙালিকে আর দাবায়ে রাখার উপায় ছিল না।

পরাজিত পাকিস্তানপন্থিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যত ষড়যন্ত্রই করল, সামরিক শক্তি প্রদর্শনও যত করল তাতে কিছু লাভ হলো না। মহান নেতার অঙ্গুলি হেলনেই জাতি তাঁর প্রত্যাশা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলে একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতার জবাবে বাঙালি শুরু করেছিল সর্বাত্মক অসহযোগ – নেতারই নির্দেশে তাজউদ্দীন ও সহকর্মীদের পরিকল্পনায়। এই পরিস্থিতিতে জনতার কাছে বারতা পৌঁছানো দরকার। সবারই প্রাণচঞ্চল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়, যাত্রাপথের শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর ফলে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু দিলেন স্মরণকালের অবিস্মরণীয় ভাষণ, দিলেন স্বাধীনতার ডাক –    ঐতিহাসিক এই ভাষণ আজ বিশ্বঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো, সেই থেকে বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা, মুক্তির প্রতীক ও প্রেরণা।