বনসাই

কৃষ্ণেন্দু পালিত

আসব স্যার?

পরিচিত কণ্ঠস্বর। ফাইভ থেকে ইলেভেন, সাত বছর দেখছেন। এখনো ছেলেকে স্কুলে নিয়ে আসেন, নিয়ে যান। কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজের হাতে টিফিন খাইয়ে দিতেন। ভদ্রমহিলা যে আসবেন চন্দ্রশেখরবাবু জানতেন।

কিছুক্ষণ আগে ইলেভেনের বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। বাইরের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে পরবর্তী কর্তব্যগুলোর বিসত্মারিত বিবরণ। তবু অনেকে আসছে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে। সবাইকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সবুজসাথি প্রকল্পের একগাদা ফরম নিয়ে এখন ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত নেই। কাগজের তোড়া থেকে মুখ না তুলেই – বললেন, দুটোর পরে আসুন।

– স্বাধীনের নাম নেই স্যার।

একগোছা ফরম শেষ করে আর একগোছা টেনে নিলেন সই করার জন্য। সবমিলে আড়াইশো ছাত্র। তিনদিন আগে সার্কুলার এসেছে, জমা করার আজ শেষ দিন। সব ব্যাপারেই এরা এরকম। উঠল বায় তো কটক যাই। স্কুলগুলোর সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাববে না। মাত্র একজন ক্লার্ক নিয়ে স্কুল চালানো দিনদিন দুরূহ হয়ে উঠছে। শূন্য পদগুলোতে কবে লোক পাওয়া যাবে কে জানে!

– এটা কি মিস্টেক স্যার?

– না। চোখ না তুলেই উত্তর দিলেন তিনি।

– তার মানে স্বাধীন পাশ করতে পারেনি?

– অর্থ তাই দাঁড়ায়।

– হতে পারে না স্যার। স্বাধীনের মতো ছাত্র স্কুলে কেন, এ-শহরে নেই।

চন্দ্রশেখরবাবু এবার মুখ তোলেন। মুহূর্তে বদলে-যাওয়া ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরের মতোই তার চোখ-মুখ। উত্তেজনায় কাঁপছেন। এত বড় আঘাতের কথা কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। ভদ্রমহিলার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু অসহায়, সত্যিই দেওয়ার মতো সময় তার হাতে নেই। তাই অনুরোধের সুরে বললেন, দুটোর পরে আসুন আপনি, তখন কথা হবে।

স্বাধীনের মা অপ্রস্ত্তত। মুহূর্তখানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরপায়ে বেরিয়ে যান।

চন্দ্রশেখরবাবু স্বসিত্মর নিশ্বাস ফেলেন। কলম রেখে পানের ডিববা খোলেন। সঙ্গে এক টিপ জর্দা। প্রথম অ্যাটাকটা হওয়ার পর সিগারেট ছেড়ে পান ধরেছেন। পানের রসে মুখ ভিজিয়ে ভাবার চেষ্টা করেন ভদ্রমহিলার নাম। সম্ভবত চন্দ্রা। চন্দ্রা সরকার। অনেক ভেবেচিমেত্ম, সহশিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিয়েছেন স্বাধীনের মঙ্গলের জন্য, ওর পরিবারের মঙ্গলের জন্য। সত্যিই স্বাধীনের মতো এত ভালো রেজাল্ট স্কুলের ইতিহাসে নেই।

ঠিক দুটোতেই চন্দ্রাদেবী এলেন। উদ্ভ্রামেত্মর মতো চেহারা। মুখ দেখে বোঝা যায় ভেতরে ঝড় বইছে। মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন তিনি। সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন।

ভারী শরীরটা চেয়ারের ওপর কোনোরকমে ছেড়ে দিয়ে বললেন, স্বাধীন সত্যিই পাশ করেনি?

– আপনাকে মিথ্যে বলব কেন।

– অবিশ্বাস্য! কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?

– আমি নিজে ওর সমস্ত খাতা দেখেছি।

– আমাকে একবার দেখাবেন?

– নিশ্চয়। তবে কাল। দুটো নাগাদ আসবেন। স্বাধীনের বাবাকে সঙ্গে আনবেন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। হাতে সময় নিয়ে আসবেন।… স্বাধীনকে দেখছি না?

– আসেনি।

– কেন?

– জানি না স্যার। কিছুতেই এলো না। সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীত শুনছে।

– অর্থাৎ ও জানত। সেজন্যই আসেনি।

– কী বলছেন স্যার! ভদ্রমহিলা আঁতকে ওঠেন।

– আপনি এখন বাড়ি থেকে আসছেন?

– হ্যাঁ স্যার।

– ওকে রেজাল্টের খবর জানিয়েছেন?

– জানিয়েছি। বললে বিশ্বাস করবেন না, শুনে একটা কথাও বলল না। যেমন গান শুনছিল, তেমন শুনতে লাগল। এত নির্বিকার আগে কখনো দেখিনি। মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না, বেশ করে পিটিয়েছি। কী বলব স্যার, ভদ্রমহিলা ডুকরে কেঁদে ওঠেন, তাতেও বিকার নেই। মুখ বুজে মার খেল। একবারের জন্যও ঠেকানোর বা পালানোর চেষ্টা করল না। ছেলেটার কী হল স্যার?

– আমরাও তো সে-কথা ভাবছি।

– ও কি সাদা খাতা জমা দিয়েছে?

– কাল আসুন। কাল দেখবেন। আর হ্যাঁ, স্বাধীনকে বকাঝকা করবেন না। ছেলেটার মনের অবস্থা ভালো নেই। পারলে চোখে চোখে রাখবেন। ভুলে যাবেন না আপনাদের ওই একটাই ছেলে…

ভদ্রমহিলাকে বিদায় করে একটা পানের খিলি মুখে পোরেন তিনি। ডিআই অফিসের জরুরি তলব, এখনই একবার দেখা করতে হবে। দফতরি শিবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। পথে যেতে যেতে স্বাধীনের মুখটাই চোখে ভাসে। মাধ্যমিকে সামান্য নম্বরের জন্য প্রথম কুড়ির মধ্যে ঢুকতে পারেনি। শুধু স্কুল নয়, স্বাধীন এই শহরের গৌরব। হায়ার সেকেন্ডারিতেও ভালো রেজাল্ট করবে। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আলাদা করে গুরুত্ব দেন। অথচ ইলেভেনের মতো আপাত-গুরুত্বহীন পরীক্ষায়… পরীক্ষা গুরুত্বহীন হলেও ফেল করলে ফেল। বোর্ডের নিয়ম অনুসারে আরো একটা বছর থাকতে হবে। পাশ করলে নাম্বারের গুরুত্ব নেই।

বিষয়টা প্রথম নজরে আসে ম্যাথমেটিকসের শিক্ষক বিকাশ চৌধুরীর। পরীক্ষার দুদিন বাদে স্বাধীনের খাতা হাতে হন্তদন্ত হয়ে চন্দ্রশেখরবাবুর ঘরে এসে ঢোকেন।

– দেখুন কী সর্বনেশে কা-! আমি তো মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারছি না।

খাতাটা টেবিলের ওপর মেলে ধরেন তিনি। প্রতিটি পৃষ্ঠা উলটে উলটে দেখান। সবকটা পৃষ্ঠা আগামাথা ক্রস চিহ্ন দেওয়া। অথচ সেন্ট পারসেন্ট কারেক্ট উত্তর করেছে। একশয় একশ পাওয়ার কথা।

চন্দ্রশেখরবাবু নড়েচড়ে বসেন। প্রায় ছোঁ মেরে খাতাখানা কেড়ে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন।

– এত বড় সর্বনাশ কে করল?

– জানি না স্যার। ওইদিন অলকবাবুর গার্ড ছিল, তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। পরীক্ষা-হলে সেদিন বিশেষ কিছু ঘটেছিল বলেও মনে করতে পারলেন না।

– ঠিক আছে, খাতাটা রেখে দিন। এখনই নম্বর বসাতে হবে না। বাকি খাতাগুলো আসুক তারপর সিদ্ধান্ত নেব।

সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ডেকে চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে খাতা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরদিনই সমস্ত খাতা জমা পড়ল। সবার অভিজ্ঞতা একরকম। সঠিক উত্তর লিখে কেটে দেওয়া হয়েছে। লাল কালিতে নয়, নীল কালিতেই। বিষয়টা তখনই অনুমান করেছিলেন। কিন্তু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছু বলা চলে না।

ঠিক দুটোয় এলেন। আগে ঢুকলেন স্বাধীনের মা, পেছনে মাঝবয়সী সাধারণ চেহারার একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোককে এই প্রথম দেখছেন চন্দ্রশেখরবাবু।

– স্বাধীন এলো না স্যার। অনেক বলেও আনতে পারলাম না। জেদ ধরে বসে রয়েছে।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অভিযোগ করলেন ভদ্রমহিলা।

– ঠিক আছে, ওকে না হলেও চলবে। আপনারা বসুন।

ভদ্রলোক বসতে বসতে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি স্বাধীনের বাবা। মিলন সরকার। রাইটার্সে আছি। এখন অবশ্য নবান্ন। সিনিয়র ক্লার্ক।

– ডেইলি প্যাসেনজারি করেন?

– হ্যাঁ। সকাল সাতটায় বেরিয়ে যাই, ঘরে ফিরতে রাত আটটা।

– ছেলেকে সময় দেন কখন?

– সেভাবে আর দিতে পারি কই! ওর মা-ই সব করে।

চন্দ্রশেখরবাবু স্বাধীনের মায়ের দিকে তাকান। এক রাতেই চোখের নিচে কালি পড়েছে। সারারাত ঘুমায়নি হয়তো। কান্নাকাটি করেছে। চোখের কোল ফোলা। চন্দ্রশেখরবাবু মুহূর্ত খানিক সময় নিলেন। তারপর বললেন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তবু কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব। তার আগে স্বাধীনের খাতাগুলো দেখুন।

ড্রয়ার থেকে খাতাগুলো বের করেন। প্রতিটা খাতার প্রতিটা পৃষ্ঠা খুলে খুলে দেখান। স্বাধীনের মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন, এত বড় ক্ষতি কে করল স্যার?

– শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কেউ করেননি নিশ্চয়। স্বাধীনকে তারা সন্তানের মতো ভালোবাসেন। অন্য কারো পক্ষেও সম্ভব নয়।

– তবে স্বাধীন…

– অসম্ভব নয়।

– কী বলছেন স্যার, ও কেন এভাবে নিজের ক্ষতি করবে?

– সেটাই তো ভয়ের কারণ। আমাদের জানতে হবে কেন এমন কাজ করল? স্বাধীনের মঙ্গলের জন্যই জানতে হবে।

– ছেলেটাকে জিন-পরিতে ধরল না তো? ওঝা দেখাব?

– অবাস্তব ভাবনা বাদ দিন। এখন ওসবের সময় না।

– কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েনি তো? যে ওর মাথাটা খাচ্ছে…

– মাথা ঠান্ডা করুন। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। সামনে কিন্তু বড় বিপদ আসছে। এখনই সাবধান না হলে…

– ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে স্যার।

– এ-কথা ঠিক, ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। না হলে এমন একটা কাজ করবে কেন!

– আপনি যাই বলুন স্যার, আমি কিন্তু এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। স্বাধীন এ-কাজ করতে পারে না।

– শান্ত হন মিসেস সরকার, বিষয়টা অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। যে-কথা বলার জন্য আপনাদের ডেকেছি… কয়েক দিন আগেই আমরা স্বাধীনকে ডেকেছিলাম। এখানে বসেই দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে কেঁদে ফেলে।      কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। টুয়েলভে তুলে দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করেছিল।

– কিন্তু এমন একটা কাজ ও কেন করল?

– সে-কথা পরে বলছি। তার আগে আপনাদের কাছে কিছু প্রশ্ন আছে। মূলত আপনার কাছে মিসেস সরকার। অন্যভাবে নেবেন না।

আঁচলে চোখ-মুখ মুছে ভদ্রমহিলা সম্মত হন, বলুন কী জানতে চান?

– আপনি কতদূর পড়াশোনা করেছেন?

এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন না, একটু থমকালেন। দু-মুহূর্ত সময় নিলেন। চন্দ্রশেখরবাবুর উদ্দেশ্য অনুমান করার চেষ্টা করলেন। জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হলো না। পাছে কিছু মনে করেন। যতই হোক স্বাধীনের মাস্টারমশাই। বললেন, বিএ পার্ট ওয়ান দেওয়ার পর বিয়ে হলো, ফাইনাল আর দেওয়া হয়নি।

– কেন?

চন্দ্রাদেবী মিলনবাবুর দিকে তাকান। বিব্রতবোধ করেন ভদ্রলোক। এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। শুনছিলেন। এবার প্রথম মুখ খুললেন, আসলে মা তখন বেঁচে ছিলেন। সেকেলে মানুষ, ঘরের বউ রোজ বাইরে বেরোবে মেনে নিতে পারেননি।

– প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে পারতেন।

– বলেছিলাম। রাজি হয়নি। মায়ের ওপর রাগ করে।

– এসব পারিবারিক কথা থাক। আমরা স্বাধীনের প্রসঙ্গে আসি। স্বাধীন আর পাঁচটা ছেলের থেকে অনেক ব্রিলিয়ান্ট। নিশ্চয় সেজন্য বিশেষভাবে কেয়ার নিতে হয়?

– সে তো হয়ই। শহরের ভালো ভালো মাস্টারের কাছে কোচিং নেয়। পয়সার দিকে তাকাই না। নিজেদের শখ-আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়েছি। এখন আটজন শিক্ষকের কাছে পড়ে, মাধ্যমিকের সময় ছিল দশজন। তাদের মধ্যে একজন ড্রয়িং, একজন গিটারের…

– স্কুল করে এতজন টিচারকে অ্যাটেন্ট করার সময় পায় কীভাবে?

– হয়ে যায়। অধিকাংশ সপ্তায় একদিন।

– বাড়িতে পড়াশোনা করে কখন?

– রাতে। তাছাড়া ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় পায়।

– খেলাধুলা?

ভদ্রমহিলা আঁতকে ওঠেন, কী বলছেন স্যার, এটা খেলার সময়! সামনে হায়ার সেকেন্ডারি।

– আমাদের কিন্তু ওই বয়সে বিকেলে মাঠে না গেলে পেটের ভাত হজম হতো না। যেদিন যেতে পারতাম না কোনো কারণে, সেদিন কিছুতেই পড়ায় মন বসত না। তাছাড়া শরীরচর্চার প্রয়োজন আছে। শরীর সুস্থ না থাকলে কোনো কাজই ঠিকভাবে করা যায় না।

– জানি স্যার, সেজন্যই তো শরীরের দিকে সবসময় খেয়াল রাখি। ঠিক সময়ে স্নান, খাওয়া, ঘুম… হাবিজাবি একদম খেতে দিই না।

– আর বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা?

– কী বলছেন স্যার! ও ভালো ছেলে, নিজের ছেলে বলে বলছি না, সত্যিই ওর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। মিশতে দিই না। কাগজ খুললেই দেখেন না…! সময় পেলে টিভিতে আমি ক্রাইম পেট্রল দেখি। দুনিয়াটা নষ্ট হয়ে গেছে, কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। ওই জন্যই তো সবসময় চোখে চোখে রাখি।

– কীভাবে?

– কীভাবে বলব স্যার, ঠিক বুঝতে পারছি না।

– বেশ, আপনি সোমবার সারা দিনের রুটিনটা বলুন।

– স্বাধীনের?

– আপনার।

হেড স্যারের কথাবার্তার তাল পান না চন্দ্রাদেবী। সমস্যা স্বাধীনকে নিয়ে, পড়েছেন তাকে নিয়ে। কী লজিক আছে কে জানে! জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হয় না। পাছে অসন্তুষ্ট হন! সেই রাগ পড়ে স্বাধীনের ওপর। ছেলেটার ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করতে পারবে না। দিনকাল খারাপ, কার মনে কী আছে কে জানে…

– পাঁচটায় অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ওর অফিস, ট্রেন ধরার তাড়া থাকে। সময়ের মধ্যে রান্না, টিফিন গোছানো, অনেক কাজ। ছটায় স্বাধীনকে তুলি। ছেলেটা বড় ঘুমকাতুরে। কিছুতেই বিছানা ছাড়তে চায় না। চোখে জলের ঝাপটা মারতে হয়। শীতকালে গায়ের লেপ কেড়ে নিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিই, উঠতে বাধ্য হয়।

– রাতে ঘুমাতে যায় কখন?

  বেশি রাত করে না, একটা-দেড়টার মধ্যে শুয়ে পড়ে।

– ঘুম থেকে ওঠার পর?

– চোখ-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলে এক গেলাস হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট। কোনোরকমে সেটুকু খেয়ে ছুটতে শুরু করে। সাড়ে ছটায় পড়া।

– সাইকেল নেই?

– কিনে দিইনি। সাইকেল পেলে অকারণ ঘুরতে ইচ্ছা করবে। মাথার ওপর এত বড় সিলেবাস, তারপর রাসত্মাঘাটের যা অবস্থা…

– স্বাধীন বেরিয়ে যাওয়ার পরপর নিশ্চয় মিলনবাবুও বেরিয়ে যান। তারপর তো আপনার হাতে অফুরন্ত সময়…

– কী বলছেন স্যার! চন্দ্রাদেবীর চোখ কপালে ওঠে, নিশ্বাস নেওয়ার সময় থাকে না। উনি বেরিয়ে গেলেই বাথরুমে ঢুকি। সকালে স্নান করা বরাবরের অভ্যাস। আটটা পনেরো থেকে অন্য জায়গায় পড়া থাকে স্বাধীনের। কোনোরকম নাকে-মুখে দুটো গুঁজেই বেরিয়ে পড়ি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে তো। মাসকাবারি রিকশা ভাড়া করা আছে। তবু সঙ্গে থাকি। স্বাধীনকে বিশ্বাস নেই, বখাটে ছেলেগুলোর সঙ্গে হয়তো গল্প জুড়ে দেবে কিংবা সঙ্গে জুটিয়ে নেবে একটাকে। তাছাড়া মাধববাবুর কাছে মেয়েরাও পড়ে। মাধববাবু মানে অংকের টিচার, সপ্তায় দুদিন পড়ান। ওনাকে অনেকবার বলেছি ছেলেমেয়ে আলাদা ব্যাচ করতে। তিনি হাসেন। ঘুরিয়ে আমাকেই বলেন, কোন যুগে পড়ে আছেন বলুন তো! আর একদিন বলেছিল, মেয়েদের প্রতি আপনার এত বিতৃষ্ণা কেন! আপনি নিজেও একজন মহিলা, মেয়ে হয়ে মেয়েদের এমন চোখে দেখলে আপনার ছেলে কী শিখবে! তাছাড়া আমি ব্যাচ করি মেধার ভিত্তিতে, ছেলেমেয়ে দেখে নয়। সমমেধার ছেলেমেয়েগুলো এক জায়গায় থাকলে পড়াতে সুবিধা হয়।

– উনি ঠিকই বলেছেন। চন্দ্রশেখরবাবু সমর্থন করেন।

– জানি স্যার, কিন্তু মেয়েগুলো পড়াশোনায় ভালো হলে কী হবে, খুব পাকা। সবসময় বড়দের মতো কথাবার্তা। স্বাধীনকে বারণ করেছি, ওদের সঙ্গে মিশবি না, পাশে বসবি না, কথা বলবি না। এমনকি পড়াশোনার বিষয়েও না। কিছু জানার থাকলে স্যারকে জিজ্ঞাসা করবি।

– শোনে আপনার কথা?

– আমাকে খুব ভয় পায়। হলে কী হবে, বয়সটাকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না। সেজন্যই চোখে চোখে রাখি। মাধববাবু পড়ান, আমি বাইরে বসে থাকি। বাইরে থেকে পড়ার ঘরটা দেখা যায়। পড়ানো শেষ হলে সঙ্গে নিয়ে ফিরি।

– তাহলে তো আর সমস্যা রইল না।

– আছে স্যার, মেয়েগুলোকে জানেন না। বড্ড গায়ে পড়া। সবসময় হা-হা, হি-হি, এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, ছেলেমেয়ে বাছবিচার নেই। তারপর ছোট ছোট বিচ্ছিরি পোশাক পরে, শরীরের অর্ধেক দেখা যায়।

– আঃ তুমি থামবে! অনেকক্ষণ বাদে মিলনবাবু মুখ খোলেন, ছেলেটাকে নিয়ে কী করতে চাও বলো তো! সারাজীবন আঁচলে বেঁধে রাখবে! বড় হতে দেবে না?

– শুনলেন স্যার, শুনলেন কথা। আমি নাকি ছেলেকে বড় হতে দিচ্ছি না।

– না দিচ্ছ না। এই বয়সে মানুষের নিজস্ব জগৎ তৈরি হতে শুরু করে। ভালো-মন্দ বুঝতে শেখে। সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। এগুলো না শিখলে সামাজিক হবে কীভাবে! ভবিষ্যতে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে না। দুদিন বাদে যখন কর্মজীবনে ঢুকবে, পদে পদে ঠোক্কর খাবে। হাসাহাসির পাত্র হবে। এখনো সময় আছে, ছেলেটাকে একটু স্বাধীনতা দাও।

– আহা কী বুদ্ধি, এটুকু ছেলেকে বলছে স্বাধীনতা দিতে। ভাগ্যিস আমি হাল ধরেছিলাম, নইলে এতদিনে সর্বনাশ হয়ে যেত।

– সর্বনাশের কী দেখেছ, সবে তো শুরু। সামনে আরো খারাপ দিন আসছে।

আলোচনা ক্রমশ ঝগড়ায় রূপ নিচ্ছে দেখে প্রসঙ্গ ঘোরান চন্দ্রশেখরবাবু, আপনি মাধববাবুর কথা বলছিলেন। মাধববাবুর কাছে মেয়েরা পড়ে। এটা তো বয়েজ স্কুল, আপনি এখানেও সারাদিন নজরদারি করেন। আমাদের ওপর ভরসা করতে পারেন না…

– না না স্যার, কী বলছেন, আপনারা না থাকলে ও আজ এ-জায়গায় আসতে পারত না। আসলে একটু চাপে রাখার জন্য। লুজ দিলেই বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে। আজেবাজে বিষয় মাথায় ঢুকবে। পড়তে বসে সেসব মাথায় ঘুরবে। রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে।

– সংসারের কাজকর্ম কে করে?

– কাজের লোক আছে। তাছাড়া স্কুল শুরু হলে ফিরে যাই। কাজের লোক দিয়ে সব কাজ হয় না, কিছু তো নিজেকে করতেই হয়। টিফিনের আগে আবার চলে আসি। ছুটির পর সঙ্গে নিয়ে ফিরি। সাড়ে চারটে থেকে পড়া থাকে, সরাসরি সেখানে যাই। সাতটা নাগাদ ছাড়ে। একেবারে সঙ্গে নিয়ে ফিরি।

– সাতটা পর্যন্ত বসে থাকেন সেখানে!

– কী করব, সন্ধ্যার পর অতটুকু ছেলে একা ফিরবে! বাড়ি ফিরে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম। তখন টিভি দেখে, টিফিন করে। টিভি বলতে শুধু ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর অ্যানিম্যাল পস্ন­¨vনেট, আজেবাজে চ্যানেল দেখতে দিই না। বুঝতেই পারছেন আজকাল টিভিতে…

– নিউজ চ্যানেল?

– না স্যার, নিউজ মানেই তো সেই খুন আর ধর্ষণ, না হলে ভিআইপিদের কেচ্ছা…

– শোনে আপনার কথা?

– শুনতে কি চায়! পাহারা দিতে হয়।

– ঠিকই আছে, তবে চাপটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এটা অ্যাডোলেশন পিরিয়ড, এবার একটু ছেলের মন বুঝে চলতে হবে।

চন্দ্রশেখরবাবুর কথায় মিলন সরকার এবার একটু উৎসাহিত হন। বলুন তো স্যার, আমি বলে বলে ফেডআপ। ভয় হয়, ছেলেটা না পাগল হয়ে যায়!

– তুমি থামো, তোমার দৌড় জানা আছে। এমএ পাশ করলেই ছেলে মানুষ করা যায় না।

মিলনবাবুকে থামিয়ে দিয়ে হেডস্যারের দিকে ফেরেন চন্দ্রাদেবী। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলেন, আজকাল আরো একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। আপনাকে বলা উচিত কিনা বুঝতে পারছি না। বিষয়টা ওকেও জানিয়েছি, গুরুত্ব দেয়নি। বয়সের স্বাভাবিক প্রবণতা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আপনিই বলুন, ওর কি সে-বয়স এখনো হয়েছে। এসবের কুপ্রভাব আছে না…

মিলনবাবু বিরক্ত হন, আঃ থামবে তুমি! তিনি তোমার ছেলের মাস্টারমশাই…

– সেজন্যই তো বলছি। গুরুজন মানুষ, একটা সুপরামর্শ দিতে পারবেন। তোমার বোধ-বুদ্ধির ওপর আমার ভরসা নেই।

– তাহলে তুমিই কথা বলো। আমি আসছি স্যার…

মিলনবাবু উঠে দাঁড়ান।

– যাও। বিষয়টা মোটেও হেলাফেলার নয়। বুঝলেন স্যার, স্বাধীন আজকাল বাথরুমে অযথা অনেক সময় নষ্ট করছে…

চন্দ্রশেখরবাবুর কান লাল হয়ে ওঠে। ইশারায় থামতে বলেন। বলেন, আমার যা জানার জানা হয়ে গেছে। মিলনবাবু আর দুমিনিট বসুন। আর দু-একটা কথা আছে।

– স্বাধীনের কী হবে স্যার, চন্দ্রাদেবী তড়িঘড়ি বিষয়ে ফিরে আসেন, ও কি টুয়েলভে উঠবে না?

– আপনারা চাইলে উঠবে। ও তো লিখেছে। এটুকু আমাদের হাতে আছে। তবে আসল সমস্যার সমাধান কিছু হবে না। এ-ধরনের কাজ ও আবার করবে। হয়তো এর থেকেও ভয়ংকর কিছু করবে। আপনারা জানতে চাইছিলেন না, কেন এরকম করল?

– আপনাকে বলেছে?

– হ্যাঁ বলেছে। বলেছে বলতে, বলতে বাধ্য হয়েছে জেরার মুখে। এ-কাজ করেছে ক্ষোভে। আপনার ওপর।

– আমার ওপর! ভদ্রমহিলা শিউরে ওঠেন। এমনটা তিনি দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন কল্পনা করেননি বোধহয়। দুহাতে মুখ ঢেকে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকেন। তারপর হতাশায়-অভিমানে স্বগতোক্তি করেন, এ-কথা বলতে পারল! আমার থেকে আর বেশি ভালো কে বাসে ওকে! কে ওর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। একমাত্র ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সমস্ত শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি।

– ভুলটা সেখানেই। একটা স্বাভাবিক পরিবার, বাবা-মার স্বাভাবিক আচরণই বোধহয় একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সন্তানের জন্ম দিতে পারে। এতক্ষণ আপনি যে-কথাগুলো বললেন, স্বাধীনও সে কথাই বলেছে। মানে সেগুলোই ওর অভিযোগ। আপনার জন্য সহপাঠীদের কাছে উপহাসের পাত্র হতে হচ্ছে, আপনাকে নিয়েও ওরা হাসাহাসি করে। কোনো সন্তানের পক্ষেই এসব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আবার ভয়ে আপনাকে কিছু বলতেও পারে না। আপনার জন্যই ও আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। অদ্ভুত এক অবসাদে ভুগছে।

– কিন্তু স্যার আমি তো ওর ভালোর জন্যই…

– সেটা আপনার ধারণা। বাস্তবটা নিজে চোখেই দেখছেন।

মিলনবাবু বলেন, এরকম কিছু একটা যে হবে অনেক আগেই অনুমান করেছিলাম। হলে কী হবে, আমার কথার কোনো মূল্য নেই। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি।

– ভুল করেছেন। সেদিন ওর সঙ্গে কথা বলে আমি শিউরে উঠেছিলাম। সত্যি বলতে কী ভয় পেয়েছিলাম। যে-কারণে আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি। একটা মাত্র ছেলে আপনাদের… চন্দ্রশেখরবাবু টেবিলের ওপর ছড়ানো স্বাধীনের খাতাগুলো দেখিয়ে বললেন, ভাববেন না এটাই চূড়ান্ত আঘাত। বরং শুরু ভাবতে পারেন। স্বাধীনের কথায় আমি কিন্তু সেরকমই ইঙ্গিত পেয়েছি। এখনই সাবধান না হলে… মিসেস সরকার, সামনে বড় বিপদ আসছে। আপনার ছেলে ইতোমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

দুহাতে মুখ ঢাকেন চন্দ্রাদেবী। মাথা ঝাঁকান। বলেন, আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি এখন কী করব বলতে পারেন?

– একমাত্র আপনিই পারেন। মিলনবাবু ঠিকই বলেছেন, ওকে বড় হতে দিন। r