প্রথম মুহূর্তের স্মৃতির অভিঘাত বেশি। মাঝবয়সী এ-নারীকে এখন ঠিক মেলাতে পারছি না। ঘণ্টাখানেক আগে আর এই মুহূর্তের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কৃষ্ণা সম্ভবত একটি কথাও সহজে বলতে পারে না। যাই জিজ্ঞেস করি বলে, কেন পত্রিকায় দিবেন? দুপুরে ভাতের সঙ্গে তরকারি কী ছিল জানতে চাইলেও সম্ভবত একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। অবশ্য তার দুপুরের মেন্যু নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এতো ঝড়-বাদলের মধ্যে এই সন্ধ্যায় সে কেন পথে ছিল তাই জানতে চাইছিলাম। নাকি সে দুপুর থেকেই অনুসরণ করেছিল? আমি যে সংবাদকর্মী ব্যাপারটা সম্ভবত তার আন্দাজে বলা। কিছু কিছু মানুষ শুধু অন্যদের চমকে দিতে পছন্দ করে।

ঘরে ঢুকে একটু থিতু হয়ে বসতে বসতে দেখেছিলাম টিনের বেড়ার একপাশে নীল রং দেওয়া। সেখানে টাঙানো দড়িতে ঝুলছে দুটো রঙিন শাড়ি। সৌরবিদ্যুতের হলুদ আলো জ¦লছে। বেড়ার সঙ্গে বড় একটা আয়না রাখা ঠেস দিয়ে। অখ্যাত কোনো ওষুধ কোম্পানির ক্যালেন্ডারের পাতাটা ওল্টানো হয়নি দুমাস ধরে। ঘরের ওদিকটা একটু নিচু। সম্ভবত মাটি দেবে গিয়েছে খানিকটা। এখানকার নদী স্বাদু-নোনা পানির মিথস্ক্রিয়া নিয়ে বয়ে চলে। যেমন খরখরে আবার সামান্য পানি পেলেই কাদায় থকথকে হয়ে ওঠে বাদাবনের মাটি। সেখানে বসে চটের ব্যাগ পেতে আনাজ কাটছে কৃষ্ণা। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। খাটের পাশে রাখা হাতলওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসে আমি জানালার বাইরের উঁচু পথটার দিকে তাকিয়ে আছি। যদি কেউ আসে।

কৃষ্ণার ঘরে আসার সময় বৃষ্টির ভেতর দৌড়ে এলেও এটুকু বুঝেছি, আশপাশে বসতি নেই। বস্তুগত উপস্থিতি থাকলে তা বুঝতে হাঁ করে তাকিয়ে দেখার দরকার হয় না। ঘরবাড়ি থাকলে কারো না কারো সঙ্গে ঠিক দেখা হতো। অবশ্য যেমন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঝাপসা হয়ে গিয়েছে চারপাশ। আমি আর কিছু নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছি না বলেই মনে হয় এবার আগ্রহ এলো অপরপক্ষ থেকে। মূর্তির খবর কার কাছ থেকে পেলাম, এরপর কী করবো ইত্যাদি প্রশ্ন। দায়সারা এটা-সেটা বলে জানতে চাইলাম, বৃষ্টি সহসা থামবে মনে হয়?

– বৃষ্টি আমি খবর দে আনিছি?

– আপনি এ-অঞ্চলের মানুষ। মনে হলো, ধরনটা দেখে ধারণা করতে পারেন।

– মানুষির মতো সবতার অত ধরন অয় না। সুমায় অলি ধইরে আসপে। অত তাড়া করতিছেন কেন? ছিলেন তো পথির মধ্যি। এহন তো ভিজা লাগতিছে না। 

এমন জায়গায় সে একা কেমন করে থাকে জানতে চেয়েছিলাম। ওরকম পাল্টা তির্যক প্রশ্ন শুনে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। যদিও এই নারী কিছুক্ষণ আগে আমাকে উদ্ধার না করলে বিপদ ছিল; কিন্তু প্রহসনমূলক আচরণ খানিকটা বিব্রত করছে। চুপচাপ বসে অপেক্ষাই নিরাপদ। নিত্য কানাইকে খবর দিয়ে আমার অবস্থান জানানো জরুরি। একমাত্র ভরসা কানাই। মোবাইলের চার্জ শেষ না হলে এতোক্ষণে সে ঠিক খুঁজে বের করত আমাকে। ওই তো সরু সরু হাত-পায়ের একটা মানুষ; কিন্তু তার করিৎকর্মা ভাবটা দেখার মতো। সকালে মোংলা ফরেস্ট বাংলো থেকে কানাই নদী পার করে এপারে এনেছে। তার ভাড়া করা উড়ন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে মাটির রাস্তার প্রতিটি গর্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে পানিঘাট থেকে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে লাউডোবে প্রণব বাওয়ালের বাড়িতে। প্রণব বাওয়ালের মা সূর্য বালার রঙ্গটাও শেষ পর্যন্ত দেখার মতোই হলো। এতো কাকুতি-মিনতির পরও ফলাফল শূন্য। আজ তার ঠাকুরের বিশ্রাম দিন। দুপুরে স্নান করিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। চেয়ারম্যান এলেও সময়ের আগে নাকি ঘুম ভাঙানো যাবে না। মহিলার গজগজ শুনতে শুনতে দুবার পথে গিয়ে শলাকা পুড়িয়ে এসেছি।

ঘণ্টাখানেক পর নিত্য কানাইয়ের ধৈর্য রইলো না। একপাশে ডেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আর কতক্ষণ লাগতি পারে? রাত হলি নদী পারোতি ঝামেলা হতি পারে। কানাই আসলে ইঞ্জিনের নৌকা পাওয়া-না পাওয়ার মতো সহজ ঝামেলার কথা বলছে না। ব্যাপার আরো গুরুতর।  জেলেদের লোকজন চিনে ফেললে গভীর বনের ভেতর নিয়ে বেঁধে রেখে ফেলে আসতে পারে আমাদের। কানাইয়ের গল্প শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। ভাঙা চোয়াল আর গর্তে বসা চোখ নিয়ে কথা বলে দুই হাত একসঙ্গে নেড়ে। সে-দৃশ্য একেবারে মঞ্চনাটকের মতো। এই তালপাতার সেপাই নাকি যাবে ঘাটের এক গোপন চালান আটকাতে।

দাকোপের এই লাউডোবে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকটা মানুষ নাটকীয় আচরণ ছাড়া স্বাভাবিক কিছু করতেই পারে না। গোপন খবর আছে, মোংলা ঘাটে অবৈধ কাঁকড়ার একটা বড় চালান আসবে। চালানের জেলেদের সঙ্গে ক্রেতা হিসেবে দামদর করবে কানাই। এই ফাঁকে কোমরে গুঁজে রাখা মোবাইলটা নিয়ে টুক করে একটা মিসড কল দিতে হবে তাকে। পরের অংশে আর বিশেষ ভূমিকা নেই। ঝামেলা শুরু হয়েছে দেখে যেন আগ্রহ হারিয়েছে ভাব করে সটকে যাবে ওখান থেকে। সময়মতো তার মামলাটা হাপিস হলেই হবে। বছরখানেক ধরে একটা খুচরা মামলা তাকে ভীষণ ত্যক্ত করছে। এক যুগের বেশি হলো কানাই বনের গাছ কাটে বা মধু আনে। মাঝেমধ্যে চুনকুড়ি বা ভূতের গাঙ ধরে ধরে সে রায়মঙ্গল নদীতে চলে যায়। সেখান থেকে ঢুকে যায় ভারতীয় অংশের বনে। পাশ-পারমিট ছাড়া অন্য দেশের বন থেকে মধু নিয়ে আসে ছোট নৌকা ভাড়া করে। তস্করদের সহযোগিতার জন্য ঘাটের কাছাকাছি নৌকাও থাকে আন্দাজমতো। আর কিছু আনার বিশেষ সুবিধা না করতে পারলে খরচে পোষায় না। তখন সাঁতারই ভরসা। বছরখানেক আগে কাঠ ভাসিয়ে আনার সময় টহল ফাঁড়ির কাছে ধরা পড়েছে। এক যুগের তস্কর জীবনে এটা খুবই অসম্মানের ব্যাপার কানাইয়ের জন্য।

ঘটিবাটি বেঁচে শুধু জামিনটুকু হয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে মাঝেমধ্যে তাকে বিভিন্ন ধান্দায় চলে আসতে হয় পূর্বদিকের সুন্দরবনের কাছে। অবশেষে গত সপ্তাহে এদিকের বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়েছে তার। পশ্চিমের মামলার তদবির হবে এদিক থেকে। নিজের এলাকায় ঝামলো হতে পারে বলেই এতো জটিলতা। এই মুহূর্তে কানাই একজন গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমার। তাই রাত্রিবেলা পশুর নদী পার হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। জেলেদের লোকজন ধরে তাকে বানান দিতে পারে। এই বানান মানে ‘উত্তম-মধ্যম’। এসব বুঝিয়ে আবারো জানতে চাইল, ওই মূর্তি আদৌ আছে নিশ্চিত কি না। থাকলে শুধু চোখের দেখা দেখেই বা কী লাভ?

কানাইয়ের মতো মানুষকে আমার পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয় এ-মূর্তির মাহাত্ম্য। অগত্যা তাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, তোমার মিসড কল দেওয়ার কাজ হলে দেরি করো না। পঙ্খিরাজটা চালিয়ে উড়ে এসে নিয়ে যেও। ততক্ষণে নিশ্চয়ই সূর্য বালার ঠাকুরের ঘুম ভাঙবে। দায়িত্ব ফেলে ঠাকুর দেবতাদের অত ঘুমানোর কী আছে বলে গজগজ করলো কানাই। কিন্তু এ যে লাউডোব তা কি আর আমিও বুঝেছিলাম! সূর্য বালা আমাকে কত গল্পই না শোনাল বাতাসা আর দুই মুঠ খই খেতে দিয়ে। বুড়ি অবশ্য আতিথেয়তা করতে পারছে না বলে একটু লজ্জাও পেল। তার বউ গিয়েছে বাপের বাড়ি। রাতে ফেরার পথে প্রণব বাওয়ালি বাজার থেকে খাবার কিনে আনবে দুজনের। মহিলার চোখে কদিন আগেই খুলনা সদরে নিয়ে ছানি কাটিয়ে আনা হয়েছে, তাই আগুনের কাছে যাওয়া নিষেধ। খই-বাতাসাতেও খিদে না মিটলে গাছ থেকে কলা ছিঁড়ে খেতে পারি বলে যেন আমাকে বর্তে দিলো। সারাটা দুপুর বুড়ির রাজ্যের আবোলতাবোল গল্প শুনে গেলাম। অবশ্য আমার কাজও খানিকটা হয়েছে গল্পের ছলেই। বউটা যে একটা ছোটলোক ঘরের মেয়ে, সেই নিন্দামন্দ করতে করতে উন্নাসিক নারীর পিতৃকুলের অহংকারের মতো সূর্য বালা বলে ফেলল মূর্তি পাওয়ার ঘটনাটা। তাকে আর একটু উসকে দেওয়া দরকার। আসার পথে বেলতলায় নীল রঙা টিনের ঘরে দেখা মাটির মূর্তি আর তার বাহিনীর নিন্দামন্দ করার চালটা কাজে লাগল। ওই মূর্তির কোনো ছিরিছাঁদ নেই। পায়ের কাছে কে এক হতভাগা ডাব আর নতুন একটা গামছা রেখে হাজত মানত করে গিয়েছে। সে-গামছার কী ছিরি। ও দিয়ে তো হাতও মোছা যায় না। এসব শুনে বুড়ি নড়েচড়ে বসলেন। এই মুখ খুলে খুলে আবার সেই বউয়ের বাপের বাড়ির কীর্তন গাইতে বসেন। উপায় না পেয়ে  শেষ তুরুপটা ছাড়লাম।

লাউডোবের ওই থানের দেখভাল তো দেখি এক মুসলমান নারী করে। সে-ই তো ডাক শুনে এসে আঁচলে বাঁধা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলো। এদিকে মনে হয় সব ধর্মের মানুষই বনবিবির মানত করে না? অনেকটা কাজ হলো। আশি বছরের বুড়ি ছ্যা ছ্যা করতে করতে তেতে উঠেছেন। বাপরে কী তেজ! খনখনে কণ্ঠে ফতোয়া দিলেন, ‘বাছা সব ফুল দে কি সব ঠাকুরের পুজো দেওয়া যায়, না তা হয়? এসব অনাচারের জন্যি তো বন আর এখন আমাগেরে দেকতিছে না। শুকোয় যাচ্ছে, সব শুকোয় যাচ্ছে।’ এই বিলাপের পর শুরু হলো শৈশবে এ-বাড়িতে বউ হয়ে আসার স্মৃতিচারণা। সূর্য বালার দাদাশ্বশুর সেন হাটির দিক থেকে এসে বেশি জমিতে আবাদের লোভে বসতি করেছিলেন এই বনের ভেতর। তাও সে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। এ-অঞ্চলের মানুষ বেশিদিন এক জায়গায় থাকে না। তবে তারা রয়ে গিয়েছে পাঁচ পুরুষ ধরে। তখন বসতি ছিল ঢাংমারি খালের ওপাশে। পবন বাওয়ালি নামের মানুষটি ছিলেন কড়া ধার্মিক। এই বনের ভেতর স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বসতি করতে আসার বড় সাহস ছিল তার ধর্মে আস্থা। বনও ছিল তার কাছে পবিত্র স্থান। বনের মাটিতে আগুন জ¦ালাতেন না, কাটার আগে গাছের গায়ে হাত রেখে ক্ষমা চেয়ে নিতেন; কিন্তু তরুণী স্ত্রী আর পুত্র নিয়ে বেশি আবাদের লোভে এলেন তো ঠিকই, এরপর শুরু হলো বিপদ। এই দুজন মানুষকে রেখে তিনি বনের ভেতর ঢুকে যান। দূর থেকে নৌকায় করে আসে অন্য বাওয়ালিরা। তারা নৌকা বোঝাই করে কাঠে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আবার বন থেকে বেরিয়ে আসেন পবন; কিন্তু ধারেকাছে কোনো প্রতিবেশী না   থাকায় সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা থাকে ঘর নিয়ে। বনের পশু তো আর নিরীহ বা অপরাধী বিবেচনা করে না।

এক-একবার মন চায় নৌকায় সব তুলে দিয়ে মনুষ্যবিহীন জায়গার আবাদের রাজ্যপাট গুটিয়ে ফেলতে। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মন নিয়ে কুড়াল চালান গাছের ডালে। এক দুপুরে সেদিন বসতির কাছাকাছি ঝোপেই পেয়ে যান তিনি আশ্চর্য এক বর। গাছের গুঁড়িটা টেনে তোলা কঠিন কিছু ছিল না। কতটুকু আর সেটা। কিন্তু নরম মাটির বাঁধন আলগা হয়ে কয়েক হাত দূরেই একবার উঁকি দেয় কালো এক টুকরো খণ্ড। পবন বাওয়ালি নরম কাদায় হাত দেন। উঠে আসে এক গজের সমান লম্বা এক দেবীর মূর্তি। বাড়ি ফিরে বউকে দেখিয়ে সামলে রাখতে বলেছিলেন; কিন্তু নিজের মনেই তো বুদ্বুদ উঠল বেশি। এই দেবী তার অচেনা। রাজা প্রতাপাদিত্যের ঘটনা মনে পড়ে তার। আঁতকে ওঠেন পবন। প্রতাপাদিত্যকে অভিশাপ দিয়ে কালী যেমন উল্টোবাহিনী হয়ে নদীর গতি বদলে দিয়ে চলে গিয়েছিল, শেষে যদি তেমন কিছু ঘটে! দুদিন ধরে মনের সেই বুদ্বুদ চেপে রেখে আর সহ্য হলো না পবন বাওয়ালির।

বাওয়ালি নৌকার আরোহীদের বনে ঢোকার আগেই ডেকে এনে দেখালেন নিজেই। দেবীর পরিচিতি নিয়ে হলো মতান্তর। এক পক্ষের ধারণা, এটি বনদেবী। অন্যপক্ষের যুক্তি, বনদেবীর বাহন বাঘ কোথায়? রাজা দক্ষিণ রায় বশ হয়ে আছে দেবীর পায়ের কাছে বাঘের রূপে। এ-দৃশ্য সম্পূর্ণ না হলে দেবীর কৌলীন্য থাকে? আর কে কবে শুনেছে বনদেবীর মূর্তি এমন কষ্টিপাথরে হয়েছে? এ নিশ্চয়ই যোগিনী মা তারার কোনো রূপ। বাহাস করতে করতে আবার তারা ফিরে চলল বনের দিকে। মূর্তির পরিচয় নিয়ে মতবিরোধের মীমাংসা হলো না। ওই রাতেই পবন বাওয়ালির স্বপ্নে এলেন দেবী। নির্দেশ দিলেন, তাকে অপ্রকাশ্য রাখতে। প্রতিদিন ঠিক যত্নআত্তি করে সামলে রাখবে বাড়ির মানুষ। বাইরের মানুষের সামনে তাকে প্রকাশ করা চলবে না। তাই অন্য কোথাও অধিষ্ঠার আয়োজনের কথা যেন না ভাবে। এর সঙ্গে এলো ভবিষ্যতের নির্দেশনা। পবন যেন তার পরবর্তী পুরুষকে বলে যান, বন ছেড়ে বাড়ি ঢাংমারির এপাশে নিয়ে আসতে। এ-নদী খাল হয়ে যাবে একদিন।

গল্প শুনতে শুনতে মুগ্ধ হলেও ওই মুহূর্তে চট করে মনে হলো, এই গল্প সূর্য বালা বহু যুগ ধরে বলে আসছেন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। আবারো বলতে বললে তিনি দাঁড়ি-কমা একই রাখবেন। আসল গল্প প্রতিবার একটু একটু করে বদলায়। সূর্য বালার গল্প থাকবে অপরিবর্তিত। নিজে এ-গল্পতে কতটা বিশ্বাস করেন তা জানতে চাওয়ার সাহস হলো না। আমার বোঝাপড়ায় ভুল থাকতে পারে। বউয়ের ওপর খেপে থাকা নারী বাড়িতে এখন একাকিত্বের মধ্যে আছেন। হঠাৎ কোন প্রতিক্রিয়ায় কোন ঘটনা ঘটে। চুপ করে রইলাম। মুখে তেলতেলে হাসি ধরে রেখে বললাম, তাহলে এমন একটা রহস্যময় মূর্তি দেড়শো বছর ধরে আপনাদের কাছে বংশ পরম্পরায় আছে। না দেখে তো যাওয়াই যাবে না। আমার ধারণা সূর্য বালা আসলে মূর্তিটা দেখাতে চান না। স্পষ্ট কিছু বললেন না, তবে ঠাকুর এখন ঘুমাচ্ছে জানিয়ে বিরস বদনে কোমর ঝুঁকিয়ে ভেতরবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

কানাইকে ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে ফিরে আসার অনুরোধ করে আবার এসে বসেছিলাম প্রণব বাওয়ালির আধাপাকা ঘরের বাইরের সিঁড়িতে। সূর্য বালা হয়তো প্রত্যাশা করেছিলেন ফিরব না। আপদ বিদায় হয়নি দেখে বেচারীর মন খারাপ হয়েছে। আসার পথে দেখা বেলতলার মাটির ঘরের বনবিবির থানের যে কোনো গুরুত্বই নেই জানালাম তাকে।

বুড়ি আচমকা জানতে চাইলেন, ‘তা বাবা তোমার পুরো নামটা তো শুনতি পালাম না। চেহারা দেইখে তো আর বুজতি পারা যায় না কিছু।’ একেবারে লক্ষ্যভেদী তীর। আমি যে রাজধানী থেকে মূর্তির খবর পেয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছি, সামান্য আঁচ পেলে বুড়ির কাছেও অনিরাপদ হতে পারি। বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব জড়িয়ে থাকে বলে নিরীহ মানুষ আকস্মিক তালজ্ঞানহীন হতে পারে আঘাত পেলে।

সূর্য বালাকে একের পর এক ভুল তথ্য দিতে হলো। খুলনার দৌলতপুর কলেজে ছাত্রদের ইতিহাস পড়াই। পাঠের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই প্রাচীন মূর্তির সম্পর্ক আছে। এতে তাদের বাড়ির মান-মর্যাদা বাড়তে পারে – এসব বানিয়ে বলতে ভাবতে হয়নি। দ্বিধাগ্রস্ত সূর্য বালার ছানিপড়া চোখ মুহূর্তে চকচকে হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। হাজার হোক বয়সের অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে। বুড়ি ভীষণ সেয়ানা। ঠাকুর এখন ঘুমাচ্ছেন – সেই গান গেয়ে কিছু একটা করতে এবার মনে হয় একেবারের মতো রওনা হলেন ভেতরবাড়িতে। ঠাকুরের ঘর সেখানে। এখন তো রীতিমতো সন্দেহ হচ্ছে, আসলেই কোনো মূর্তি এ-বাড়িতে আছে কি না। এতো ভক্তি যে-নারীর যাপনে, তিনি এজমালি গ্লাসে হলেও একটু জল দেন পথিককে।

কোথাও একটা কিন্তু আছে। সেই কিন্তু সূর্য বালার ঘরের সিঁড়িতে একবেলা বসে থেকে যে জানা অসম্ভব এটুকু বুঝেছি। আশপাশের মানুষ বরং ভালো বলতে পারে। দূর থেকে শোনা গল্পের রংটা বদলাতেই পারে। সারাদিনের ধকল আর ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় সব কঠিন মনে হচ্ছে এখন। অচেনা পথঘাট না হয় একে-তাকে প্রশ্ন করে জানা গেল; কিন্তু সুন্দরবনঘেঁষা এদিকের গ্রামে সড়কপথের কোনো বাহন নেই। ঘাট থেকে আরোহীসহ মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে হয়। তা সে আমার নিত্য কানাই যে কোন আঘাটায় এখন খাবি খাচ্ছে কে জানে। তার  তো পঙ্খিরাজ নিয়ে উড়ে আসার কথা ছিল। এদিকে আকাশের রং গাঢ় হয়ে আসছে। সূর্য বালার উপেক্ষা অবাক করেনি, শুধু কাজের ধকলটা বাড়ালো। ঢাকায় ফিরে রিপোর্ট দেওয়ার সময় সব গুছিয়ে লিখতে হবে। প্রয়োজনে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে কাল আবার আসতে হবে। সূর্য বালার জন্য আরো কিছুক্ষণ বৃথাই অপেক্ষার পর এবার পথ মাপতেই হলো। বাজার পর্যন্ত নিশ্চয়ই যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনকি কানাইয়ের সঙ্গে পথেই দেখা হতে পারে। ফোনে সামান্য চার্জ হলেই ঝামেলা মেটানো যাবে। আসার সময় পানি ঘাটে কয়েকটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান দেখেছিলাম। 

লাওডোবে প্রণব বাওয়ালির বাড়ি থেকে কিছুটা হতাশা-বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে আসতে আসতেই ভারি হয়ে এলো আকাশ। কতক্ষণ হেঁটেছি!  বেশি হলে মিনিট কুড়ি। হাঁপ ধরে গিয়েছে এরই মধ্যে, পেটের খিদের জন্য। ভারি বাতাসের জন্য শ্বাস নিতে জোর দিতে হচ্ছে বেশি। রূপসা নদীটা সামনের দিকে। দুপাশে সুন্দরবনের আচ্ছাদন। সাদা বক উড়ে গেল ডানা ঝাপটে। ঝুপ করে আলো নিভে সন্ধ্যা হলো বেরসিকের মতো। মাথায় ধামা নিয়ে হেঁটে যাওয়া একমাত্র পথচারীকে ঘাটে যাওয়ার সহজ উপায় জিজ্ঞেস করেছিলাম। অবিশ্বাসের চোখ-মুখ নিয়ে বললো, আপাতত গাছতলা খুঁইজে আশ্রয় নেন। আশ্চর্য মানুষ!

বাতাসের বেগ আর অন্ধকার দুটোই বাড়ছে। বনটা আরো কাছে এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। বৃষ্টিরও আসার একটা ব্যাকরণ আছে। প্রথম কয়েক মিনিট হেসেখেলে ঝিরঝির। ততক্ষণে কোথাও আশ্রয় খুঁজে নিতে পারলে বেশ। আমার ভাগ্য আজ অপ্রসন্ন। এরপরই শুরু হলো বড় বড় ধারা। মনে হচ্ছে একেবারে নদীর জল টেনে নিয়ে আজ ভাসিয়ে দেবে সব। একবেলার জন্য ছোট ব্যাকপ্যাক এনেছিলাম। রক্ষা করা গেল না বৃষ্টি থেকে। যেদিকেই এগোতে চাই পা দেবে যাচ্ছে লাওডোবের মাটিতে। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি বুঝতেও পারছি না। এমন সময় অনন্তকাল মনে হয় মানুষের। বৃষ্টির বাতাস আসছে বনের ভেতরের গাছপালা জড়িয়ে নিয়ে। স্যান্ডেল প্যান্ট কাদায় মাখামাখি। একটা বড় গাছ পেলেও হতো। ওই তো ঢাংমারির ওপাশেই লক্ষ কোটি মহীরূহ অথচ এপাশটা একেবারে ন্যাড়াছাড়া। এদিকের বসতিতে বনের গাছের অদ্ভুত মিশ্রণ। জোয়ারের পানিতে বীজ ভেসে এসে কখনো গরান বা সুন্দরী জন্মেছে। কোথাও আবার গৃহস্থের লাগানো ফলের গাছ। গাছপালার একেবারে অসাম্প্রদায়িক অবস্থান যাকে বলে। তবে এদিকে নব্য বসতির জন্য ঘন হয়নি গাছ। মাটির উঁচু পথটা থেকে নামা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। আশপাশে ছোট ছোট ঝোপ ছাড়া কিছু তো নেই। দুপুরে চলতি পথে দেখা সেই নীল রঙা টিনের ঘরের বনবিবির থানটা সম্ভবত কাছাকাছি। ওটুকু যেতে পারলেও অন্তত মানুষ পাওয়া যেত। হতবিহ্বল লাগছে। সূর্য বালার সঙ্গে মিথ্যে বলার ফলাফল হাতেনাতে পাচ্ছি কি না কে জানে।

একটা গাছ দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। তবে ন্যাড়া মতো এসব গাছ এমন বৃষ্টিতে আরো বিপজ্জনক। শেষটায় পুতুল নাচের ইতিকথার হারু ঘোষের মতো হলে কেউ জানবেও না অঙ্গার হয়ে যাওয়া আমি মানুষটির পরিচয়। এ-অঞ্চলের মানুষের মতো আমারও এখন মনে হয়, বনবিবির কাছে প্রার্থনার সময়। জনমানবহীন এমন জনপদে নিজেকে এখন ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। বাজার যে কতদূর আন্দাজে আসছে না। বৃষ্টির প্রকোপ দূরত্বের মাপ এলোমেলো করে দিয়েছে। বনটা কি আরো এগিয়ে এসেছে আমার কাছে! দৃষ্টি বিভ্রম হয় মানুষের এমন সময়ে। আমার তেমন হবে না। হলে এই গাছের কাছে আরেকজন মানুষের উপস্থিতি দেখে চমকে যাওয়ার কথা ছিল। হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সঙ্গে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলে বিশ্বাস হলো, শাড়ি পরা নারী বাস্তব এবং আমি কল্পনা করিনি কিছু। কোথা থেকে কেমন করে উপস্থিত হলো জানতে চাওয়ার ইচ্ছে হলেও এখন সে-সময় না। সে কোথায় নিয়ে চলেছে টানতে টানতে আমাকে! কতক্ষণ দৌড়েছিলাম তার ভেজা হাত ধরে বৃষ্টির ভেতর জানি না। পেছন থেকে মানুষটাকে স্পষ্ট বুঝতেও পারছি না অন্ধকারে। কয়েক মিনিট অথবা অনন্তকাল ধরে দৌড়েছি আমরা। কতবার কাদায় পা হড়কে গেল, স্যান্ডেল প্যান্ট এখন কাদাময়। পা বসে গেল বাদাবনের বন্য কাদায়। তবুও আমরা চলেছি বিরতিহীন। সে আমাকে বনের ভেতর নিয়ে চলেছে কি না তাও জানি না। ঝড়-জল-বাতাস আর অন্ধকারে যেন কথা বলে উঠলো বাদাবনের গাছেরা। মাথা নাড়িয়ে এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে হাসলো ওরা। উড়ে যাওয়া সেই সাদা বকেরা হয়তো এতোক্ষণে ডানার তলায় ছানাগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে। নাহ্ অবশেষে এ-নারীর গতিপথ বদলালো। সাপের মতো বেঁকে যাওয়া উঁচু মাটির পথটা থেকে এবার সামান্য বাঁয়ে ঘুরে নিচুতে নামতে হলো তাকে অনুসরণ করে। নদীর শব্দ শুনছি এখন। ঘাটের কাছাকাছি না হলেও নদীর পাড়ে তার ঘর।

ভেজানো দরজা খুলেছিল সে। ঘরে ঢুকে নতুন গামছাটা দিয়েছিল গা মুছতে। তখনো ঘোর কাটেনি আমার। সৌরবিদ্যুতের আলোয় দেখলাম, নারী মাঝবয়সী। ভেজা খোঁপা খুলে দিতেই কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে নামলো কোঁকড়া চুল। বসতে দিয়ে শুকনো একটা কাপড় নিয়ে ঘরের ভেতর পর্দা টাঙানো ওপাশে চলে গেল বদলাতে। অল্প আলোয় তখনই দেখেছিলাম টিনের ঘরের একপাশে নীল রং করা। অপরিচিতা এমন দুর্যোগে কেন পথে নেমেছিল জিজ্ঞেস না করে পারিনি। মানুষের হাসিমুখ এতো নির্মল হয়! নিষ্পাপ মুখ নিয়ে জানতে চাইলো

– দেখা পালেন তিনার?

– কার?

– যারে খুঁজতি আলেন এতদূর।

– কে বললো আপনাকে?

– সব কতি অয়? দেকতি দিলো বুড়ি? কেউ দ্যাকেনি আজ পর্যন্ত।

– তার মানে নেই?

– কীরম করে কবো? দেকতি না পালি নেই তো কতি পারি না।

– এমন দুর্যোগের রাতে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?

উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করলো না সে। দ্বিতীয়বার জানতে চাওয়া যায় না। কিন্তু এ-জায়গাটা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না। আশপাশে কোনো ঘর আছে বলে মনে পড়ছে না। আচ্ছা দুপুরে দেখা বেলগাছটার পাশ দিয়ে দৌড়েই কি এ ঘরে এসে ঢুকলাম? আমাকে বসিয়ে রেখে আনাজ কাটতে বসেছে। ঝুঁকে বসায় একদলা চুল এপাশের দিকে মাটি ছুঁইছুঁই। মুখটা ঢেকে গিয়েছে নারীর। ঠিক পেছনে টিনের বেড়ার সঙ্গে হাতে সেলাইয়ের একটা ছবি। বাঘ আর নারীর অবয়ব ফুটে উঠেছে সেখানে। তলায় সুইয়ের ফোঁড়ে লেখা ‘বনদেবী প্রণাম জানাই, তুমি ছাড়া রক্ষা নাই’।  দু-পা এগিয়ে গেলাম। ছোট করে এক কোনার দিকে লেখা নাম ‘কৃষ্ণা’। ঘুরে দাঁড়াতেই কৃষ্ণার মুখোমুখি। মায়া আর কঠোরতার সহাবস্থান নিয়ে কী তীব্র দৃষ্টি নারীর। যেন মাতা ও মৃত্যু রূপ। এই প্রথম খুব কাছ থেকে স্পষ্ট দেখলাম মুখ। হালকা একটা ঘ্রাণ আসছে কৃষ্ণার শরীর থেকে। কোন ফুলের ঘ্রাণ! একবার মনে হলো, চেনা কোনো সাদা ফুলের ঘ্রাণ। না, এটা কোনো জংলি ফুলের গন্ধ। তার শরীর থেকে আসছে, না আশপাশে কোথাও গাছ আছে, জানি না। সে তাকিয়ে হাসছে। বিরামহীন বৃষ্টির শব্দের ভেতরও শোনা যাচ্ছে রূপসার ঢেউ টুকরো টুকরো হয়ে এগিয়ে আসার শব্দ। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। একটা নেশার মতো লাগছে কিন্তু মনে হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। এরপর এমন কিছু ঘটতে পারে যা হয়তো নিতে পারব না আমি। ঠিক তখনই ছোট টুলটার ওপর চার্জে দেওয়া ফোনটা বেজে উঠলো। কানাইয়ের ফোন। কানাইকে দুপুরে দেখানো বেলগাছটার কথা বলে অনুমানে এগিয়ে আসতে বললাম। আমিও এদিক থেকে রওনা হবো। একটাই তো পথ, নিশ্চয়ই দেখা হবে মুখোমুখি। ব্যাকপ্যাকটা হাতে তুলে আসছি বলতে চেয়েছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার হাত ধরে ফেলল কৃষ্ণা। কী আশ্চর্য শক্তি নারীর এ-হাতে! এ-হাত দিয়েই শক্ত করে ধরে সে দৌড়েছিল কিছুক্ষণ আগে দুর্যোগের ভেতর।

– ভাত হইয়ে গেছে। সারাদিনে দুই মুঠো খই আর কয়টা বাতাসা গেছে পেটে।

– কেমন করে জানলেন?

– অতো কথায় কাজ নেই। না খাইয়ে গেলে বনের অমঙ্গল হবে। আসন কইরে দিতিছি। ভাত নে বসেন।

কৃষ্ণার পেতে দেওয়া আসনে বসে ভাত খেয়েছিলাম আমি। সারাদিনের রোদ-জল, চতুরতা, ব্যর্থতা, বনের গাছ, সাদা বকের ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া, বিস্ময়করভাবে দুর্যোগে পরিত্রাণ পাওয়া – সবকিছু মিলেমিশে যাচ্ছে সামনে কাঁসার থালায় সাজিয়ে রাখা জুঁই ফুলের মতো গরম ভাত থেকে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার সঙ্গে। মনে হয়েছিল, আজন্ম ক্ষুধার্ত মানুষ অন্ন পাওয়ার পর এমনই অনুভব হয়। বাতাস আর বৃষ্টি দুটোই ধরে এসছে তবুও মনে হচ্ছে মাথা নাড়িয়ে চলেছে বাদাবনের বড় গাছেরা। নদীর ঢেউয়ের শব্দকে হেসে হেসে ছোট গাছগুলো বলছে, দ্যাখো দ্যাখো, নগরের মানুষ এসেছে। কৃষ্ণা বসে আছে একটু দূরে। শেষ দানাটি মুখে তোলার পর সে উঠলো গুছিয়ে নিতে। কানাই হয়তো কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে কোথাও। ফোনে রিং হচ্ছে। আমি ব্যাগটা তুলে রওনা হলাম। কৃষ্ণা দরজা পর্যন্ত এসেছিল। একটি বাক্যও বললো না। ওই তো দেখা যাচ্ছে মাটির পথটা। বিপদে থাকলেও ভুল দেখিনি, বেলগাছটা ধারেকাছেই ছিল।

পথে উঠে আসতেই দেখি দূর থেকে হেঁটে আসছে একটা মানুষ। নিত্য কানাই ছাড়া আর কার হবে ওরকম কাঠামো। কে জানে সে সময়মতো মিসড কল দিতে পেরেছিল কি না। অনেক রাত হয়ে গেছে। কানাইয়ের চোখেমুখে আমাকে নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না, শুধু একবার জানতে চাইলো, প্রণব বাওয়ালির বাড়ি থেকে এতোদূর কেমন করে এলাম। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। এখন আর কোনো শব্দই তৈরি হচ্ছে না আমার ভেতরে। অনিশ্চয়তা থাকলেও ঘাটে ইঞ্জিনের নৌকা পাওয়া গেল। বিছানা টানছে সারা শরীর। আমার শুধু ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে একা হওয়া দরকার। সূর্য বালার মায়ের মূর্তির খবর না নিয়ে এ-অঞ্চল থেকে ফিরব না। মিথ্যে গল্প হলে সেও এক প্রতিবেদন। সুন্দরবনের ভেতর থেকে পাওয়া প্রণব বাওয়ালির বাড়ির দেড়শো বছরের পুরনো মূর্তির খোঁজেই এবার এতোদূর এসেছি সত্যি। কিন্তু জীবন সবসময় শুধু প্রয়োজন লক্ষ্য করেই ছোটে না। আমি এখন কৃষ্ণাকে নিয়েই বেশি ভাবছি বোধহয়।

পরের দিন একটু বেলা করেই বের হলাম কানাইয়ের সঙ্গে। রূপসার ওপর তখন তাতানো রোদ। ঘাটে এসে মোটরসাইকেল ভাড়া করলো কানাই। গতকালের ওরকম বৃষ্টি-কাদার পর এ- পথে টানতে পারবে কি না সন্দেহ। আজো যদি সূর্য বালার ঠাকুর ঘুমিয়ে থাকে তবে তাকে আইনগত ভয় দেখানোর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে ব্যক্তিগত করে রাখার অধিকার নেই – ব্যাপারটা বুড়ি কতটা বুঝবেন জানি না। তবে তার ছেলে তো আর রোজ রোজ আরেক গ্রামে যাবে না। আজ তার বাড়ি থাকার কথা। তবে তার আগে এ-গ্রামের মুরব্বিগোছের কারো সঙ্গে কথা বলা দরকার। ওই বিগ্রহ নিয়ে গল্প কতদূর সত্যি জানা দরকার। পানিঘাট থেকে কানাইয়ের ভাড়া করা পঙ্খিরাজে উঠে আসতে আসতে অবাক হয়েছিলাম। একবেলার রোদে এই মাটির পথ পুরো খটখটে হয়ে গিয়েছে। একেই বলে চৈত্রের গরম। বেলতলা হয়ে যাওয়ার সময় কানাইকে বলেছিলাম থামতে। গতকাল দুপুরে দেখা বনবিবির থানটা একইরকম থাকার কথা। তাই আছে। গতকাল ডাক শুনে এসে তালা খুলে দিয়েছিল এক নারী। আজো সে-ই এগিয়ে এলো কানাইয়ের ডাকে। একটু অস্বস্তি নিয়েই নিচু কণ্ঠে জানতে চাইলাম, কাছাকাছি কোথাও কৃষ্ণা নামের এক মাঝবয়সী নারীর ঘর আছে, সেটা কোনদিকে? গতকাল রাতে ঝড়ের মধ্যে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। একবার দেখা করে যেতে চাই। থানের পাহারাদার নারীটি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন বুঝতে পারেননি কথা। জানালেন, এখানে কৃষ্ণা নামের কোনো নারী আছে বলে তিনি জানেন না। গতকাল রাতে কখন ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে এ এলাকার কোনো মানুষই বলতে পারবে না। কানাই তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। বনবিবির থানের কাছে দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় দেখে বুঝলাম, গতকাল রাতের পথটা আর এখন নেই কোথাও।  মনে হচ্ছে সূর্য বালা আমাকে তার দেবীর মূর্তিটি আসলে কখনোই দেখাতে পারবে না। মাস দুয়েক আগেই হারিয়ে গিয়েছে তার কাছ থেকে। কৃষ্ণার ঘরের ক্যালেন্ডারে পাতাটা ছিল কয়েক মাস আগের। সত্যটা কাউকে বলতে পারছেন না সূর্য বালা। বিকল্প বা সমান্তরাল জগতের বাসিনীর মন আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষ বুঝেছে কে কবে!