বরিস পাস্তেরনাক : রাজনীতির ডামাডোলে হারিয়ে যাওয়াএক কবিসত্তা

বরিস লিওনিদোভিচ পাস্তেরনাকের জন্ম ১৮৯০ সালে মস্কোর এক সাংস্কৃতিক পরিম-লে। পিতা লিওনিদ পাস্তেরনাক ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত এক শিল্পী এবং মা ছিলেন বিশিষ্ট পিয়ানোবাদক। পরিবারের বন্ধুদের দলে ছিলেন তলস্তয়, রাখমানিনোভ, স্ক্রিয়াবিন এবং রিলকের মতো সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের অগ্রণী ব্যক্তিত্বরা। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে লেখাপড়া করার আগে থেকেই পাস্তেরনাক স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি হওয়ার।

রাশিয়ার ইতিহাসে ১৯১৭ সালটি ছিল নানাদিক থেকে এক সন্ধিক্ষণ। ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ চলতে থাকা অবস্থায় নতুন সংকটের মুখে পড়তে হয় সর্বময় কর্তৃত্ব হাতে ধরে রাখা জারের রুশ প্রশাসনকে। রণক্ষেত্রে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া রুশ সামরিক বাহিনীর সৈনিক ও নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসমেত্মাষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে সে-বছর ফেব্রম্নয়ারি মাসেই ঘটে যায় প্রথম বিপস্নব, রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জারকে যে-বিপস্নবের ফলে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়েছিল। সেই বিপস্নব শ্রমিক-কৃষকের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার মতো আরেকটি বিপস্নবের সম্ভাব্য আগমন ঠেকিয়ে রাখার জন্য সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির ষড়যন্ত্রের ফলাফল ছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক

থেকে গেলেও এর ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। বিপস্নব-পরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে বছর শেষ হওয়ার আগেই বলশেভিকদের নেতৃত্বে ঘটে যায় দ্বিতীয় বিপস্নব, যার মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।

সেরকম এক অনিশ্চিত সময়ে এবং এর আগে যেসব কবিতা পাস্তেরনাক লিখেছিলেন, সেগুলো নিয়ে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যসংকলন জীবন আমার বোন। গুচ্ছবদ্ধ রূপকের উপস্থিতি, অস্বাভাবিক অমত্ম্যমিল এবং হঠকারী ছন্দ – এরকম সব চমকে ভরা সেসব কবিতাকে তখন দেখা হয়েছিল কবির জীবনে দেখা দেওয়া প্রেম, কাব্যিক সৃষ্টি আর বিপস্নবের চোখ-ধাঁধানো অভিজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে। সময়টা তখন সার্বিক অর্থে ছিল রাশিয়ার জন্য দুর্যোগে পরিপূর্ণ এক কাল। হঠাৎ করে মোটা দাগে বিভক্ত হয়ে পড়া দেশজুড়ে চলছিল পছন্দ-অপছন্দের দ্বন্দ্ব, যার জের ধরে কবি-সাহিত্যিক আর সংস্কৃতিকর্মীদের বড় একটি দল দেশত্যাগ করলেও পাস্তেরনাক থেকে গিয়েছিলেন রাশিয়াতেই। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যদের দেশত্যাগও সেই পথে তাঁকে নিয়ে যায়নি। সহিংসতার ব্যাপকতা তাঁকে ব্যথিত করলেও রাশিয়াকেই তিনি নিজের একমাত্র নিবাস হিসেবে দেখেছিলেন। তখন থেকে জীবনের পুরো সময় তিনি কাটিয়েছেন মস্কো এবং শহরতলির পেরেদেলকিনো লোকালয়ে। বিভ্রান্তির সেই সময়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করে গেলেও রাজনীতি তাঁর পিছু ছাড়েনি। নানাভাবে চেষ্টা করেছে কবিকে এর নিজস্ব বলয়ে নিয়ে আসার। তবে পাস্তেরনাক থেকে গেছেন অনেকটাই নির্লিপ্ত।

১৯৩৪ সালে ওসিপ মান্দেলেশ্তাম স্তালিনকে ব্যঙ্গ করে লেখা তাঁর কবিতা অল্প যে-কজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শুনিয়েছিলেন সেই দলে পাস্তেরনাকও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পাস্তেরনাক অবশ্য তাঁর কবিবন্ধুকে তাৎক্ষণিক সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন যে, দেয়ালেরও কান থেকে যাওয়ায় অন্যদের সামনে এসব কবিতা পড়ার বেলায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে মান্দেলেশ্তামকে। এর কিছুদিন পর সংক্ষেপে চেকা নামে পরিচিত গোয়েন্দা পুলিশ মান্দেলেশ্তামকে তুলে নিয়ে গেলে পাস্তেরনাক চেষ্টা করেছিলেন প্রভাবশালী মহলে তাঁর পরিচিতদের মাধ্যমে তাঁকে ছাড়িয়ে আনার। এমনকি স্তালিনের কাছেও সে-খবর পৌঁছে যাওয়ায় স্তালিন একদিন পাস্তেরনাককে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছিলেন কবি হিসেবে মান্দেলেশ্তাম আসলেই উচ্চমানের কিনা। মান্দেলেশ্তামকে নিয়ে পাস্তেরনাক ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কথা বলতে শুরু করায় স্তালিন তাঁকে বলেছিলেন – তিনি বুঝতে পারছেন যে একজন কমরেডকে সমর্থন করে যাওয়ার মতো সৎসাহস পাস্তেরনাকের নেই।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই সময়ের অন্য অনেক

কবি-সাহিত্যিকের মতো পাস্তেরনাককেও সময়ে সময়ে এমন কিছু বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছে যা ছিল সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মার্শাল তুখাচেভস্কি ও সামরিক বাহিনীর অন্য কয়েকজন ঊর্ধ্বতন জেনারেলকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করা হলে তাঁদের মৃত্যুদ- চেয়ে জানানো আহবানে স্বাক্ষর করতে পাস্তেরনাক অস্বীকার করেছিলেন। তবে তাঁর সেই অস্বীকৃতি সত্ত্বেও পরবর্তীকালে প্রচারিত বিবৃতিতে পাস্তেরনাকের স্বাক্ষরের উল্লেখ করা হলে সরাসরি স্তালিনকে লেখা এক চিঠিতে পাস্তেরনাক বলেছিলেন, ছেলেবেলায় তলস্তয়ের শিক্ষায় তিনি মানুষ হয়েছিলেন বলে জীবন ও মৃত্যুর বিচারক হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার সে-সময়ের গতানুগতিক ধারার বিরোধিতা করা সত্ত্বেও পাস্তেরনাককে কিন্তু স্তালিনের সরাসরি বিরাগভাজন হতে হয়নি। কেন – সে-প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বলে থাকেন, পাস্তেরনাককে নিয়ে কী করা দরকার সে-বিষয়ে স্তালিনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘এই মেঘে বসবাসকারীদের আমরা স্পর্শ করি না।’ এরকম বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এটা নিশ্চিত যে, কবি এবং মানুষ হিসেবে পাস্তেরনাককে তেমন অপছন্দ স্তালিন করতেন না।

কবিতা লেখার পাশাপাশি এর অনুবাদের কাজও পাস্তেরনাক করেছেন। বিশেষ করে তাঁর শেক্সপিয়রের অনুবাদ রাশিয়ায় যথেষ্ট প্রশংসিত। শেক্সপিয়র ছাড়াও শিলার, পল ভার্লেন এবং রাইনার মারিয়া রিলকের কবিতার অনুবাদও তিনি করেছেন।

রাশিয়ার বাইরে পাস্তেরনাকের পরিচয় কবি হিসেবে নয়, বরং মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবে। এর পেছনে আছে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে ডক্টর জিভাগোর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই উপন্যাস প্রকাশনার আবেদন বাতিল হয়ে গেলে এর পা-ুলিপি গোপনে ইতালিতে পাচার করা হয় এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর আর্থিক সহায়তায় মূল রুশসহ উপন্যাসের অন্য কয়েকটি ভাষার অনুবাদও সেখানে প্রকাশিত হয়। পাস্তেরনাকের খ্যাতি এর মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়লেও দেশে তিনি হয়ে পড়েন অনেকটাই একঘরে। ১৯৫৮ সালে নোবেল পুরস্কার কমিটি ডক্টর জিভাগো উপন্যাসের জন্য পাস্তেরনাককে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে রাশিয়ায় আরো বেশি চাপের মুখে পাস্তেরনাককে পড়তে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক একটি বিবৃতি প্রচার করে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকার করেন।

এই ঘটনা পাস্তেরনাকের জন্য হয়ে উঠেছিল খুবই বিব্রতকর। একদিকে তিনি সরকারি মহলে হয়ে উঠেছিলেন অনেকটাই অপাঙ্ক্তেয়, অন্যদিকে গোপনে সক্রিয় থাকা ভিন্ন মতাবলম্বীরা তাঁকে লুফে নিয়েছিল আপন দলের নেতৃস্থানীয় একজন হিসেবে। শেষ বয়সে পাস্তেরনাকের জীবনে অনাকাঙিক্ষত যে-অস্থিরতা এই বিতর্ক নিয়ে এসেছিল, তাঁর শারীরিক অবস্থার ওপরও সেটা প্রভাব ফেলে। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত পাস্তেরনাক ১৯৬০ সালে মস্কোর শহরতলির পেরেদেলকিনোতে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন

এবং সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর জীবনের সবচেয়ে

বড় ট্র্যাজেডি সম্ভবত আজীবন কবিতা লিখে যাওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর পরিচয় ছড়িয়ে পড়া, যেটা তাঁর কবিসত্তাকেও অন্তত দেশের বাইরে

অনেকটা হলেও ঢেকে দিয়েছে।

এখানে সংযোজিত নয়টি কবিতার সবকটি মূল রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। পাস্তেরনাক তাঁর অধিকাংশ কবিতা শিরোনামহীন রেখে দিলেও সেরকম কয়েকটি কবিতায় শিরোনাম বসিয়ে নেওয়া হয়েছে অনুবাদকের নিজস্ব বিবেচনায়।

 

ঘরে কেউ থাকবে না

 

ঘরে কেউ থাকবে না,

গোধূলির আলো ছাড়া, নিঃসঙ্গতা ছাড়িয়ে

চোখে পড়বে শীতার্ত দিন

ঝুলে-থাকা পর্দার ফাঁক দিয়ে।

 

সাদা ভেজা তুষারকণার কেবলই

মুহূর্তের দেখা দিয়ে দ্রম্নত হারিয়ে যাওয়া।

শুধু ছাদ, তুষার – সেই ছাদ আর তুষার ছাড়া

নেই তো কোথাও আর কারো কোনো ছায়া।

 

তুষার আবারো রাখে ছাপ

আবারো ফিরিয়ে আনে মনে লুকিয়ে থাকা ব্যথা,

সেই বিগত সময়ের

অন্য কোনো এক শীতার্ত দিনের কথা।

 

যেন হানা দেয় আবারো এক পাপ

প্রশমিত না হওয়া,

জানালা চেপে ধরে এর কাঠামো,

হয়তো উষ্ণতার জন্য ক্ষুধার্ত সেই চাওয়া।

 

পর্দা জুড়ে হঠাৎ দেখা যায়

অপ্রত্যাশিত কম্পন।

ভবিষ্যতের মতোই নিঃশব্দে ঢুকে যাও তুমি

যেন ফেলে মাপা পদচারণ।

 

দরজার সামনে উঠে আসো তুমি

সাদা উজ্জ্বলতাহীন কিসে যেন ঢেকে নিয়ে দেহ,

সে যেন সেরকম কিছু,

যা দিয়ে তৈরি এই তুষারদিনের আবহ।

 

তুষারপাত

 

পড়ছে তুষার, পড়ছে দিনভর,

চরাচর জুড়ে তুষারের মাতামাতি।

টেবিলের ওপর মোমবাতি পুড়ে যায়,

পুড়ে যায় মোমবাতি।

 

গ্রীষ্মে যেমন পতঙ্গের ঝাঁক

উড়ে যায় অগ্নিশিখার ডাকে,

দলবাঁধা তুষার যেন তেমনি ছুটে আসে

জানালার কাচের দিকে।

 

কাচ জুড়ে দ্রম্নত আঁকা হয়ে যায়,

বৃত্ত আর তীরের নকশাভরা কত কী,

টেবিলের ওপর মোমবাতি পুড়ে যায়,

পুড়ে যায় মোমবাতি।

 

ঝুলে থাকে যেন অপচ্ছায়া এক

আধো অন্ধকার ছাদ ছাপিয়ে,

ভাঁজ করা হাত, ভাঁজ করা পা,

ভাঁজ করা ভাগ্য নিয়ে।

হঠাৎ আওয়াজ তুলে ঘর জুড়ে

মেঝেতে পতন হয় জোড়া পাদুকার,

মোমের গলে যাওয়া ফোঁটা এসে পড়ে পোশাকে,

যেন মিশে থাকে অশ্রম্ন তাতে রাতের কান্নার।

 

ধবল-ধূসর তুষারের আড়ালে

হারায় সবকিছু রাতারাতি,

টেবিলের ওপর মোমবাতি পুড়ে যায়,

পুড়ে যায় মোমবাতি।

 

ঘরের কোণ থেকে উড়ে আসা প্রলোভন

মোমের শিখায় তোলে কাঁপন,

মেলে ধরে দেবদূতের মতো ডানা তার

ঠিক ক্রুশ-চিহ্ন যেমন।

 

পড়ছে তুষার বিরামহীন

সারা ফেব্রম্নয়ারি জুড়ে নেই বিরতি,

টেবিলের ওপর মোমবাতি পুড়ে যায়,

পুড়ে যায় মোমবাতি।

 

 

হ্যামলেট

 

কোলাহল মিলিয়ে যায়। মঞ্চে উঠে আসি আমি।

দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে,

দূরের প্রতিধ্বনি থেকে আঁচ করে নিতে চাই

কোন সে-অপবাদ দেবে এরা আমার নামের।

রাতের ছায়া তাকিয়ে আমার দিকে

সহস্র অপেরা গস্নাসে রেখে চোখ।

আববা, পিতা, বুঝি তাই,

দেখে নেন এই বিরক্তির যেন হয় শেষ।

তোমার একগুঁয়ে পরিকল্পনা আমার পছন্দ,

এই দৃশ্যের অভিনয়ে তৃপ্ত আমি।

তবে কল্পনায় আছে আমার আরো এক ভাবনা :

যেজন্য দরকার আমার আপন সত্তায় বিকশিত হওয়া।

তবে তা সত্ত্বেও অভিনয়ের পরম্পরা হয়ে আছে ঠিক,

পথের শেষ যাচ্ছে দেখা।

একা আমি : শর্ত হয়েছে পূরণ।

বেঁচে থাকা তো হচ্ছে প্রান্তর পার হয়ে না যাওয়া।

 

ফেব্রম্নয়ারি

 

ফেব্রম্নয়ারি। খুঁজে নাও কালি আর কাঁদো!

কান্নায় ভেঙে পড় – ফেব্রম্নয়ারিকে নিয়ে লিখতে আর লিখতে

গর্জে ওঠা ভাবপ্রবণতা যখন

পুড়ে যায় কালো বসন্তের মতো।

 

আধ রুবলে ভাড়া করে ট্যাক্সি,

সুরেলা ঘণ্টাধ্বনি আর চাকার কান্না শুনে

চলে যাও সিক্ত বর্ষণ যেখানে কালো,

অনেক বেশি জোরালো যে-কান্না কিংবা কালির চেয়ে –

 

পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া হাজার নাশপাতির মতো

কালো কাক যেন গাছপালা ভেঙে উড়ে যাবে

সোজা ডোবার দিকে, যেন হিমপ্রপাত,

শুকিয়ে যাওয়া শোক মাটির চোখে।

আরো নিচে – বরফ গলার কালো দাগ,

আর চিৎকারে সব বাতাস হয়ে যায় ফুটো,

এলোমেলো আর বিশ্বস্ত কবিতা তখনই পায় আকার,

ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না যখন বের হয়ে আসে প্রচ- বেগে।

 

(শিরোনামহীন কবিতা)

 

আগুনে পোড়া তাম্র অঙ্গারের মতো

ঘুমন্ত উদ্যানের পতঙ্গের উড়ে যাওয়া।

আমার আর মোমের একই উচ্চতায়,

পুষ্পিত এক বিশ্বের ঝুলে থাকা।

 

যেন নজিরবিহীন বিশ্বাস নিয়ে

ঢুকে যাই আমি এই রাতের অন্তরে,

পপলারের জীর্ণ ধূসরতা যেখানে

ঢেকে রাখে চাঁদের বলয় চোখের আড়ালে।

 

পুকুর যেখানে উন্মোচিত এক রহস্য,

আপেল গাছ শোনায় ঢেউয়ের কথা চুপিচুপি,

বাগান যেখানে ঝুলে থাকে স্তম্ভের ওপর,

আকাশকে ধরে রেখে মুখোমুখি।

 

 

মারিনা ৎসভিতায়েভার স্মরণে

 

ভেবে নেয়া কঠিন

তুমি নেই

ঠিক যেমন কঠিন তোমাকে কৃপণ এক কোটিপতি মনে করা

অনাহারী ভগিনীর দলে।

 

কী আমি করতে পারি তোমার জন্য? বলো।

যেভাবে চলে গেলে তুমি

নিজের পথে,

ছিল তা গালমন্দে ভরা।

 

পরাজয় যেন প্রহেলিকা। অযথাই

খুঁজে বেড়াই আমি

উত্তর।

মৃত্যুর নেই রূপরেখা।

 

অর্ধেক শব্দ, মুখ ফসকে যাওয়া, বিভ্রম –

শুধু কেবল

পথের নির্দেশনা পেতে

পুনর্জন্মে থাকে বিশ্বাস।

 

শীত তো হচ্ছে জমকালো স্মৃতিসৌধ –

ক্ষণিকের দেখা দেয়া গোধূলি,

মদের গেলাসে ঢেলে নেয়া শুকনো ফল

– আর এটাই হোক তোমার স্মরণে ভোজ!

 

বাতাসে কম্পমান আপেল গাছ,

তুষারে আবৃত শহর,

সারা বছর জুড়ে যেন

কবর তোমার, তোমার সমাধিফলক।

 

ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, পৃথিবী থেকে

ছুটে যাও তুমি তাঁর দিকে,

ঠিক যেমন আগের দিনগুলো তোমার

ছুঁয়েছিল চূড়ান্ত গন্তব্য।

 

(শিরোনামহীন কবিতা)

 

গোধূলিতে সোয়ালো পাখির থাকে না শক্তি

ধূসর নীল প্রশান্তিকে ধরে রাখার।

কণ্ঠ ভেদ করে বের হয়ে আসে কলরব,

যে-নির্গমন পারে না প্রশমিত হতে।

 

সোয়ালোর নেই সেই উঁচুতে,

মাথার ওপর, এর তীক্ষন ক্রন্দন

চেপে রাখার পথ : ‘হে বিজয়ী,

দেখো, দেখো তুমি, সরে যায় কীভাবে এই জগৎ।’

 

ফুটন্ত কেটলি থেকে নির্গত বাষ্পের মতো,

ছুটে যায় ক্রোধোন্মত্ত গতি নিয়ে –

‘দেখো, দেখো – নেই কোনো জায়গা আমাদের এই পৃথিবীর

আকাশ আর গিরিখাতের মাঝে।’

 

হাওয়া

 

আমার হয়েছে শেষ, আর তুমি বেঁচে আছো আজো।

হাওয়া তুলছে মাতম আর কাঁদছে,

তুলছে কাঁপন বনে আর কাঠের ঘরে।

প্রতিটি পাইনে ভিন্নভাবে নয়,

বরং বনের সবটা জুড়ে রেখে যায় ছাপ,

যেমন ঝড়ের পরে ছিন্ন পাল

পড়ে থাকে জাহাজের ভগ্ন কাঠামোয়।

তবে এর সবটাই অর্থহীন অহংকার

কিংবা আনন্দের পরিতৃপ্তি থেকে নয়,

বরং বিষণ্ণ সময়ে শব্দ খুঁজে পেতে শব্দ

তোমার জন্য লিখবে যা ছন্দময় গান।

 

 

নোবেল পুরস্কার

 

পালিয়ে বেড়াই আমি তাড়িত পশুর মতো।

কোথাও আছে মানুষ, মুক্তি আর আলো,

অথচ আমাকে তাড়া করছে কোলাহল,

নেই আমার পালাবার পথ কোনো।

 

অন্ধকার বন আর পুকুরপাড়,

পড়ে আছে গাছের নগ্ন গুঁড়ি।

পথ এখান থেকে পড়েছে কাটা,

হোক না যা কিছুই, ক্ষতি নেই তাতে।

 

কোন পাপে আমার এই সাজা,

আমি কি খুনি, অথবা ঘৃণিত মানুষ?

সারা পৃথিবীকে কাঁদিয়েছি আমি

আমার এই মাটির চমকে।

 

আর তাই, সমাধির প্রায় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে,

ভাগ্যে রাখছি আমি বিশ্বাস, আসবে সেই সময় –

বিদ্বেষ আর ঘৃণার শক্তিকে করবে পরাভূত

সদাচারী মনের চেতনা।