জাহিদ মুস্তাফা
আমাদের প্রকৃতিজুড়ে কত রং, কত ফর্ম, কত বৈচিত্র্যের সমাহার! শিল্পিত চোখ দিয়ে সেসব দেখলে আরো অবাক, আরো আশ্চর্য হয় মানুষ। চারদেয়ালের ভেতর যখন চিত্রপটের সামান্য পরিসরে আমরা আমাদের চেনা প্রকৃতির অন্যরকম রূপ দেখি, তখন আমাদের দৃষ্টিজুড়ে বিস্ময় খেলা করে।
শিল্পী রেজাউল করিমের চিত্রপটে প্রকৃতি আসে তাঁর অন্তরের গভীর ভাবালুতা ও অপার সৌন্দর্য নিয়ে। এই প্রকৃতিও আমাদের মুগ্ধ করে। বর্ণের বুনটে বোধের ভেতরে যে-নিসর্গচেতনা, তাকে অকপটে তুলে আনেন তিনি নিজের চিত্রপটে। সেখানে বৃষ্টি আছে, বৃষ্টির ভাবালুতা আছে; আছে শীতের কুয়াশা, হেমন্তের বিরান শস্যক্ষেত কিংবা আছে পাকা ফসলের সমারোহ, বসন্তের রংবাহার ও শরতের মুগ্ধতা। আছে ভরা বর্ষার দুকূল-ছাপানো জলের কুলকুল ধ্বনি, জ্যৈষ্ঠের তপ্ত হাওয়া। বৈশাখের উদ্দাম দ্রোহ।
রেজাউল করিম সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সেন্টারে আয়োজন করেছিলেন তাঁর নবম একক চিত্রকলা প্র্রদর্শনীর। ২২ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ‘বোধের বুনট’ শিরোনামে শিল্পী রেজাউল করিমের এ- প্রদর্শনী হয়ে গেল। এতে শিল্পীর আঁকা সাম্প্রতিকালের অনেকগুলো চিত্রকর্ম আমরা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেলাম। শিল্পী কাজগুলো করেছেন কাগজে এবং ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে। কাগজে কিংবা ক্যানভাসে যে-চিত্রপটেই এঁকেছেন, তাতে রংকে তিনি প্রয়োগ করেছেন হাল্কা জলরঙের মতো করে। জলরঙের অস্বচ্ছ দেয়ালের গায়ে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে কাছাকাছি বর্ণের প্রলেপ এক ধরনের বিভাজন এসেছে চিত্রপটে বর্ণের ভেতরে ভেতরে। নোনা ধরা দেয়ালের অবয়বও ভালো লাগে। তাকে চিত্রপটে তুলে আনলে সে-ভালোলাগা আরো তীব্র হয়। এই অনুভূতিটা পেয়েছিলাম শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাছ থেকে।
রেজাউল করিম সেই গুরুর কাছ থেকেই শিখে নিয়েছেন প্রকৃতি দেখার পাঠ। সাদা চোখে দেখা প্রকৃতি নয়, এই প্রকৃতি তারই কোলে বেড়ে ওঠা ধুলোমাটি-কাদায়-বালুতে ভরা, কিংবা মেঘমেদুর আকাশ আর বৃষ্টির কলতানে মুখর। কিবরিয়া ছাড়াও আরেক গুণী শিল্পী গিয়াসউদ্দিনের চিত্রপটে আমরা নিসর্গের এসব ব্যঞ্জনা পেয়েছি। পেয়েছি মনিরুল ইসলামের চিত্রপটে প্রকৃতিকে তুলে ধরার নানা প্রচেষ্টা। রেজাউল করিমকে ওয়াশনির্ভর কাজ করতে দেখছি একযুগের বেশি সময় ধরে। জলরং ও মিশ্রমাধ্যমে তিনি চিত্রপটে ওয়াশ ছাড়েন, রং গড়াতে দেন, রঙের প্রবহমানতাকে একসময় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এ-ধারাটি আরো প্রাণবান হয়েছে অ্যাক্রিলিক রঙের ব্যবহার বৃদ্ধিতে। প্রথমে হ্যান্ডমেড পেপারে শুরু করেছিলেন। খণ্ড-খণ্ড কাগজে সেঁটে কিংবা তামাটে বর্ণের প্রাধান্যে সেসব কাজ করতেন শিল্পী। এখনো তাঁর চিত্রকর্মে লক্ষ করি ওইসব বর্ণেরই আধিক্য।
কারণ বোধকরি মাটির প্রতি শিল্পীর টান। গভীর মায়া। জন্ম থেকে শৈশব কেটেছে গ্রামে। হুরাসাগর নদীতীরের একটি গ্রাম। এই গ্রামের গভীরে, পথের ধুলোয় মাটির বুকে, আকাশের ওপর, নদীর বুকের প্রাকৃতিক নানা রং আর ইমেজের ছড়াছড়ি। এসব তো তাঁর চিত্রকর্মে চলে আসা বিচিত্র নয়! বরং এসবের আভাস না থাকলে আমরা আশ্চর্য হতাম।
শিল্পী রেজাউল করিমের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৪৩ সালে। পাঠ নিয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। ১৯৬৩ সালে প্রবেশিকা পাশ করে ঢাকার তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি নেন টেলিভিশনের শিল্প-নির্দেশনা শাখায়। পরিচালক হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে অবসর নেন। এরপর তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে চিত্রকলা চর্চা।
১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহ টাউনহলে রেজাউলের প্রথম একক অনুষ্ঠিত হয়। সে-কাজগুলো ছিল একজন শিক্ষার্থী-শিল্পীর অনুশীলন ধরনের। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে তাঁর দ্বিতীয় একক অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় একক জাতীয় জাদুঘরের ১৯৯১ সালে। ১৯৯৬ সালে গ্যালারি টোনে চতুর্থ এবং ২০০৭ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় শিল্পীর পঞ্চম একক আয়োজিত হয়। শেষ পাঁচ বছরে শিল্পীর চারটি একক হলো। ২০০৮-এ জয়নুল গ্যালারি এবং ২০০৯ সালে ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে তাঁর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ-বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে তাঁর অষ্টম একক এবং বছরের শেষার্ধে ঢাকা আর্ট সেন্টারের আয়োজনে শিল্পীর নবম একক অনুষ্ঠিত হলো।
পঁয়তাল্লিশ বছরের শিল্পীজীবনে নয়টি একক প্রদর্শনী বেশি নয়। তবে ১৯৯১ সাল থেকে আজ একুশ বছরে সাতটি একক বলে দিচ্ছে শিল্পীজীবনের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে প্রচুর এঁকেছেন। এই সময়টায় আমি নিজে দেখেছি, শিল্পী রেজাউল করিম চিত্রচর্চা করছেন একজন নবীন শিল্পীর নতুন অভিজ্ঞতালাভের আনন্দ নিয়ে। একজন সাধকের মতো ধৈর্য ধারণ করে। এই সাধনার সুফল তিনি পেতে শুরু করেছেন। গত শূন্য দশক থেকে। গত পাঁচ বছরে রেজাউলের পাঁচটি একক প্রদর্শনী হয়েছে, যা তাঁর মোট প্রদর্শনীর অর্ধেকের বেশি!
ঢাকা আট সার্কেল নামে সমমনা চারুশিল্পীদের একটি গ্র“প আছে। আবু তাহের, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, বীরেন সোম, আবদুস শাকুর, চন্দ্রশেখর দে, রফি হক ও রেজাউল করিম এর সদস্য। গ্রুপটির এক প্রদর্শনীতে এসেছিলেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। তাঁকে দেখেছি, চন্দ্রশেখর দে ও রেজাউল করিমের কাজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। এ দুজনের কাজ সম্পর্কে প্রশংসাসূচক উচ্চারণ করেছিলেন কিবরিয়া – আমাদের দেশের চারুশিল্পীদের এক নমস্য শিক্ষক।
রেজাউলের কাজের ধরনটা কিবরিয়া স্কুলের নিকটবর্তী। তাঁর প্রকাশবাদী বিমূর্ততার ধারা আমাদের শিল্পীদের কাছে বেশ গ্রহণীয় ও পছন্দের। সে-ভালোবাসা নিয়েই এ-পথে হাঁটার চেষ্টা রেজাউল করিমের।
বোধের বুনটে শিরোনামের প্রদর্শনীতে শিল্পীর কাজগুলো তাঁর বিগত দুই দশকের চিত্রচর্চার ধারাবাহিকতা। তবে তাঁর ইদানীংকালের কাজগুলোকে আরো পরিণত, আরো সমৃদ্ধ মনে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে শিল্পী এমন একটি জায়গায় এসেছেন, যাতে এ-অর্জন এসেছে, তাঁর চিত্রপর্বকে ঋদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের নানা ঋতু, পরিবেশ ও প্রকৃতির নানা পরিবর্তনশীলতার বিরূপ উঠে আসে তাঁর চিত্রকর্মে।
এবারের প্রদর্শনীর শিরোনামগুলোও বলে দিচ্ছে তাঁর আগের কাজগুলোর কথা। যেমন ব্যালাড অব অ্যা ব্রান্ট সয়েল অর্থাৎ পোড়ামাটির গাঁথা। এটি শিল্পীর ১৯৭১ কেন্দ্রিক একটি চিত্রকর্ম। এই শিরোনামে তিনি অতীতেও বেশকিছু চিত্ররচনা করেছেন। এবারও এঁকেছেন ডিজাস্টার বা দুর্যোগ। এঁকেছেন জেনোসাইড বা হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধজীবন, পোড়া বনাঞ্চল, আলোর নির্যাস, প্রকৃতির গান এসব শিরোনামের চিত্রকর্ম।
তার মানে আমরা দেখছি, শিল্পী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর চিত্রপটে তুলে আনছেন তাঁর অনুভূতি প্রকাশের উপায় করে। আবার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়গুলো নিয়েও তাঁর চৈতন্যে যে-নাড়াচাড়া, সেটিকেও তিনি তুলে আনেন। প্রকাশবাদী বির্মূততার মধ্যেও যে সমাজ-সচেতন মুক্তির বারতা, যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে আনা যায় সেটি আমরা নতুন করে উপলদ্ধি করি শিল্পী রেজাউল করিমের শিল্পভাবনা ও প্রকাশের ধরনে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.