বলাই ডাক্তারের ভিটেমাটি

‘যম নাকি শহরে আইসা গেছে, ডাক্তারবাবু…?’

‘সে-তো এক মাসের বেশি। এপ্রিল মাসের তিন তারিখেই শহরের দখল নিয়েছে …।’

‘গাঁও-গেরামেও নাকি ঢুকছে …?’

‘হ্যাঁ। যাকে যেখানে পায়, পাখি-মারার মতো করে মারছে। ঘরবাড়ি পোড়াইয়া ছারখার করছে। শিবপুর জমিদারবাড়ি এখন দেখতে যেন ঠিক শ্মশানঘাট …।’ 

‘তাইলে এহন বাঁচার উপায় কী, ডাক্তারবাবু? মাগ-ছাওয়াল নিয়া তো জানে মরণ লাগবো …।’

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলি ও আগুন পানির দরের মতো সস্তা, বেহিসেবি ব্যবহারের বেশুমার সুযোগ, হানাদাররা করছেও তাই; এই গুলি ও আগুন থেকে বাঁচার কোনো পথ জানা নেই ডা. বলাইচন্দ্র পালের। পরেশ দাসের সামনে কিছুক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়ে থেকে সাইকেলে উঠলেন বলাই ডাক্তার। তাঁকে দ্রুত পৌলি কলুপাড়া যেতে হবে। বাহেজ ব্যাপারীর বউ-মেয়ের কলেরা হয়েছে …।

ডা. বলাইচন্দ্র পাল রসুলপুর কি সাদুল্লাপুর, পৌলি, গালা কি শালিনা, আরো কিছু দূরের গ্রাম পাছবেথইর, খলদবাড়ি, আকুয়া, মহেলা, হিন্নাইপাড়া, বাসালিয়া, পিচুরিয়া – সব গ্রামেই ‘বলাই ডাক্তার’ হিসেবে সুপরিচিত। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে এলএমএফ পাশ করে নিজের বাড়িতে চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করছেন। সরকারি চাকরির খুব সুযোগ ছিল, কিন্তু গাঁ-ঘরের হা-ভাতে মানুষের সেবা করতে ও-পথে পা দেননি। ভগবানের কৃপায় বলাই ডাক্তারের খুব হাতযশ। সময়মতো রোগীর পেটে তাঁর দাওয়াই পড়লে, সময় কিছুটা হয়তো লাগে, কিন্তু রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক – যে-রোগীর যে-ওষুধ কাজে লাগবে বলে মনে করেন – তিনি তাকে সেই ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করেন। সকালে বাড়ির চেম্বারে রোগী দেখেন। ভোর থেকেই রোগীর ভিড়। বেশিরভাগই গরিব। দুস্থ। বলাই ডাক্তার এদের কারো কাছ থেকে ফি নেন না। কাউকে কাউকে ওষুধ দেন বিনাপয়সায়। দু-চারজনের হাতে পথ্য কিনে খাওয়ার টাকাও তুলে দেন। … আর কোনো রোগী গুরুতর অসুস্থ, চেম্বারে নিয়ে আসার জো নেই, ডাক্তারকেই রোগীবাড়ি যেতে হবে, ডাক এলে, তা সকাল কি দুপুর, সন্ধ্যা কি রাত, এমনকি ঝড়বৃষ্টি, বর্ষা-বন্যা উপেক্ষা করে বলাই ডাক্তার সাইকেল নিয়ে ছোটেন রোগীবাড়ি। বলাই ডাক্তার এসেছেন, রোগীর স্বজনরা যেন প্রাণ ফিরে পায় হাতে। তাই তো বলাই ডাক্তার দশ-গাঁয়ের মানুষের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান …!

বলাই ডাক্তার সেদিন সকালে পৌলি কলুপাড়া যাচ্ছিলেন। বাহেজ ব্যাপারীর বউ-মেয়ের দাস্ত-বমি শুরু হয়েছে। ব্যাপারী পড়িমরি দৌড়ে এসেছিল। বর্ষা এখনো তেমন করে শুরুই হয়নি, এর মধ্যেই কলেরা! কলুপাড়ায় যেরকম ঠাসাঠাসি ঘর, মানকচুর পাতার মতো একচিলতে উঠোন, সেখানেও রোদ পড়ে না; স্যাঁতসেঁতে, খালপাড়ে খোলা পায়খানা, গেরস্থালির কাজে এই খালের পানি কলুপাড়ার লোকেরা ব্যবহার করে, কলেরা একবার ছড়িয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই …।

তখন ভোর কেটে গেছে। মেঘলা আকাশ। ছাইরঙা-সকাল। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। সুনসান পরিবেশ। দেশে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাস্তায় লোক কমতে শুরু করেছে। ঘাড়ের ওপর বিপদ। চারদিক থেকে বাতাসে ভেসে আসে

গা-কাঁপানো সব দুঃসংবাদ। তাই তো, যতোটা সম্ভব ঘরেই থাকে মানুষ। অন্তত ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার চেয়ে জেলে বন্দি থাকা ভালো। চেম্বারেও রোগীর তেমন ভিড় নেই। হানাদারদের গুলি আর আগুনের ভয়ে রোগের জীবাণুরাও বুঝি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ মাত্র সাতজন রোগী এসেছিল। সবাই বৃদ্ধ নারী। হানাদাররা যেন বৃদ্ধ-নারীদের অসম্মান করবে না, তাদের কোনো ক্ষতি করবে না, খুন-ধর্ষণ তো নয়ই – এই সাহস নিয়েই বলাই ডাক্তারের চেম্বারে এসেছিল তারা। পঞ্চম রোগী দেখার সময়ই বাহেজ ব্যাপারী হাঁপাতে হাঁপাতে আসে। খবর শুনে বলাই ডাক্তার বললেন – ‘তুমি তো দৌড়ে এসেছো, দৌড়ে যাবে। আমি সাইকেল চালিয়ে যাবো। তোমার আগেই আমি পৌঁছে যাবো। তুমি বাড়িতে চলে যাও …।’

বাহেজ ব্যাপারী বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করলো। আল্লাহ জানে, বাড়িতে ফিরে বউ-মেয়ে কাউকে সে জীবিত পাবে কি পাবে না! কোনো বাড়িতে কলেরা লাগলে, বাহেজ ব্যাপারী ইতিপূর্বে দেখেছে তো, কলেরার চিকিৎসা নেই, রোগীর গলায় একটু  পানি  দেওয়া,  পির-ফকিরের পড়া-পানি, সেই সুযোগও মেলে না, তার মা-বাবাও বছরদুই আগে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, বিনা চিকিৎসায়, এখন বুঝি বউ-মেয়েও মরে …!

রমানন্দ সাহার পোড়োবাড়ির সমুখের রাস্তায় পরেশের বড়দা নরেশ দাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বলাই ডাক্তারের…।

ডাক্তার দ্রুতবেগে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। খানাখন্দে-ভরা সরু রাস্তা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই সাইকেলসহ খালে পড়ার আশঙ্কা। বলাই ডাক্তার রাস্তার রুগ্ণ চেহারার দিকে খেয়াল না-করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। নরেশ দাস হঠাৎ বদনা-হাতে ডাক্তারের সমুুখে এসে দাঁড়ালো …।

‘ডাক্তারবাবু …।’

বলাই ডাক্তার সাইকেলের ব্রেক কষে দাঁড়ালেন।

‘কী হে নরেশ? এই, এতো বেলায়, এখানে …?’

‘প্যাট চলতেছে বাবু। এই সকালে চাইরবার আইলাম…।’

‘বলো কী নরেশ! রাতে কী খেয়েছিলে…?’

‘যা নিত্তি খাই, তাই খাইছিলাম। কচুপাতা ভর্তা আর ডাইল-ভাত। পুঁটি মাছের শুঁটকিও আছিল সাথে …।’

বলাই ডাক্তার ওষুধের বাক্স খুলে ছয়-পুরিয়া ওষুধ দিলেন নরেশ দাসকে। ‘একসাথে দুই-পুরিয়া করে দিনে তিনবার খাবে …।’

‘ডাক্তার বাবু …।’

‘আবার কী? আমার হাতে সময় নাই। পৌলি কলুপাড়া যাবো। বাহেজ ব্যাপারীর বাড়িতে কলেরা লেগেছে …।’

‘শুনলাম, যমের বাচ্চারা নাকি গাঁও-গেরামে ঢুকছে। বাড়িঘর পোড়াইয়া দিতাছে…।’

‘হ্যাঁ। শিবপুর জমিদারবাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করেছে …।’

‘আগুন শিবপুর আইছে, রসুলপুর আইতে কতক্ষণ …?’

‘যে-কোনো সময় আসতে পারে …।’

‘তাইলে এহন বাঁচার উপায় কী …?’

পরেশ যে-প্রশ্ন করেছিল, নরেশও একই প্রশ্ন করলো। এখন বাঁচার উপায় কী? আসলে এই একই প্রশ্ন এপ্রিলের শুরু থেকেই, রাজালি মণ্ডল, হাতেম সরকার, অধীর চক্রবর্তী, সুবল ঘোষ, সীতাধর হালুই – সবার। প্রশ্নটি হলো – এখন বাঁচার উপায় কী – বলাই ডাক্তারের মনেও কখনো-সখনো বাইন মাছের মতো মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পান না। অথচ দেখেন, পথে-ঘাটে পরেশ-নরেশের মতো কারো সঙ্গে দেখা হলেই, বলাই ডাক্তার একই প্রশ্নের মুখোমুখি  হন।   কারো   মুখে  ঘর-গেরস্থালি, ক্ষেত-খোলা, গরু-বাছুর, ব্যবসা, বাজারঘাট – এইসব নিয়ে কোনো কথা নেই। কথা একটাই – যমের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? পাকিস্তানি যমের বাচ্চারা নাকি সুন্দরবনের বাঘের চেয়েও হিংস্র। তাদের আক্রমণের ভয়ে দেশগ্রামের মানুষের শরীরের রক্ত রাতারাতি বরফজলের মতো শীতল হয়ে যাচ্ছে …।

‘দ্যাশত্যাগ ছাড়া বাঁচনের উপায় নাই, ডাক্তারবাবু …।’

বলাই ডাক্তার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ভেবে ভেবে হয়রান, গলদঘর্ম; পাকিস্তানি নরপশুদের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? কোনো উত্তর খুঁজে পাননি, অথচ দেখো, নরেশ দাস কেমন অবলীলায় বলে দিলো – ‘দ্যাশত্যাগ ছাড়া বাঁচনের উপায় নাই…।’

দেশত্যাগ! মাতৃভূমি ছেড়ে, পৈতৃক ভিটেমাটি ফেলে, বেঁচে থাকার জন্য, তুচ্ছ এ-জীবন রক্ষার জন্য পালাতে হবে! তাছাড়া, বলাইচন্দ্র পাল তো ডাক্তার। যুদ্ধময়দানেও ডাক্তাররা বধ্য নহে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কাশীনাথ বৈদ্য তাঁর শিষ্যসাবুদ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দুই পক্ষের আহত যোদ্ধাদের, এমনকি আহত খচ্চর ও অশ্বেরও সেবাশুশ্রƒষা করেছেন – এ-কাহিনি তো সর্বজনবিদিত। তাহলে বলাই ডাক্তার নিশ্চয়ই নিরাপদ …।

‘কিছু কন না যে, ডাক্তারবাবু …?’

নরেশ দাসের কথা শুনে বলাই ডাক্তার যেন গুলিবিদ্ধ পানকৌড়ির মতো বিলের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। হানাদাররা যেভাবে পাখি-মারার মতো করে মানুষ মারছে, সেখানে তিনি কি ডাক্তার বলেই নিরাপদ? তিনি তো শুধু ডাক্তার নন, মানুষ নন, তিনি যে হিন্দুলোক। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাই হানাদারদের মূল শত্রু। গুলির প্রথম লক্ষ্যবস্তুও তারাই। মনে মনে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য, বুকে একটু সাহস জাগিয়ে তোলার জন্য বলাই ডাক্তার যদি ধরেও নেন যে তিনি কিছুটা নিরাপদ, তাঁর বউ অনিতা পাল, চতুর্দশী কন্যা বিমলা, কিশোর ছেলে বিমল – তারা কেউ কি নিরাপদ? বড়ো  ছেলে  বরুণ  মুক্তিযুদ্ধে  গেছে, মোল্লাবাড়ি-মুন্সিবাড়ির রাজাকাররা এসে শাসিয়ে গেছে – বরুণকে ফিরিয়ে আনো। সময় বেঁধে দিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বরুণ ফিরে না-এলে তারা বাড়ির সবাইকে কোরবানির গরু জবাই করার রামদা দিয়ে কচুকাটা করবে। গুলি খরচ করে পবিত্র পাকিস্তানের অর্থ নষ্ট করবে না …।

যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে, জীবনপণ করেই গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ বাড়ির টানে, মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা স্ত্রী-সন্তানের মায়ায় পড়ে কিংবা প্রাণ হারানোর ভয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে আসবে না – ‘অবতীর্ণ সত্যে’র মতো এই কথাটা রাজাকারদের মনে রাখা উচিত। বরুণ ফিরবে না। তার বন্ধুরা – কামাল, শাজাহান, রতন, কৃষ্ণ, জুলহাস – কেউ ফিরবে না। কেউ না …।

‘ডাক্তারবাবু …।’

‘ও, নরেশ! কী যেন বলছিলে তুমি …?’

‘দ্যাশত্যাগ ছাড়া বাঁচনের উপায় নাই…।’

‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মতো হিসাব করে কথাটা বললে। তোমার কথাও হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার হিসাব ভিন্ন। মৃত্যুভয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে, পৈতৃক ভিটেমাটি অরক্ষিত রেখে আমি পালাতে পারবো না …।’

‘আপনি শিক্ষিত মানুষ, বুঝমান মানুষ; ডাক্তারবাবু। আপনে অবুঝের মতো কথা কন কেন? প্রাণে বাঁইচা থাকলে নিজের ভিটায় ফিরা আইতে পারবেন। প্রাণটাই যদি না-থাকে…।’

‘আমি যে ডাক্তার, নরেশ। রোগীর চিকিৎসা করাই আমার ধর্ম। রোগী যদি শত্রুও হয়, তাকেও দেখতে হবে। এই যে, তোমার পেট চলছে, ছয়-পুরিয়া দাওয়াই দিলাম। আমি না-থাকলে এখন তোমার কী হতো? শহরে যেতে হতো, না-হয় বিনাচিকিৎসায় কষ্ট পেতে। মৃত্যুও অস্বাভাবিক কিছু না। নরেশ, আমি গাঁয়ে না-থাকলে এই রসুলপুর, সদুল্লাপুর, পৌলি, গালা, শালিনার হতদরিদ্র মানুষেরা অসুখ-বিসুখে পড়ে কার কাছে যাবে? দাওয়াই না-খেয়ে শুধু খোদা বা ভগবানকে ডাকলে তো রোগ সারে না …।’

নরেশ দাস মুখ্যসুখ্য গেরস্থ-মানুষ। বলাই ডাক্তারের মতো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে কথায়, যুক্তিতে সে পারবে কেন? পারবে না। চেষ্টা করাই বৃথা। নরেশ হাল ছেড়ে দিয়ে বদনা হাতে নিল। বাড়ি যেতে হবে। পালানোর পথ খুঁজে বের করাটাই এখন প্রকৃত কাজ। বলাই ডাক্তার মরে মরুক …।

রাস্তার বাঁ-পাশে সাহাবাড়ি। দ্বিজেন সাহা, অনিল সাহা, সুকুমার সাহা – সাহাবাড়ির সবাই ব্যবসায়ী। বাজারের চাল-ডাল-লবণ-তেলের আড়ত, পাটের আড়ত, গুড়ের আড়ত, তামাকের আড়ত, কাপড়ের আড়ত, মনোহারি দোকান – সবই সাহাদের। সাহাবাড়ির সব ঘরই দক্ষিণমুখো। ঘরগুলো সারিবদ্ধ, যেন সুতা টেনে তোলা। হঠাৎ বলাই ডাক্তারের চোখ আটকে গেল সাহাপাড়ার ঘরগুলোর ওপর। সব ঘরের দরজায় ঝুলছে বড়ো বড়ো তালা…।

দুই

দেশে বর্ষা নেমেছে। নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়, আমনধানের চক – সব পানিতে টইটম্বুর। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামারও বিরাম নেই। এর মধ্যেও থেমে নেই হানাদারদের পৈশাচিকতা। বর্বরতা। ওরা সব যেন হালাকু খানের ছোট ভাই। রক্ত দেখার তিয়াস মেটে না কোনোকালে। যে-বাড়িতে ঢোকে – হিন্দু কি মুসলমান কিছুই দেখে না, ওরা বাংলাদেশের মুসলমানদেরও মালাউন-কাফের মনে করে; বাড়ির দুধের বাচ্চা, অশীতিপর বুড়ো-বুড়ি সবাইকে এক এক করে গুলি করে কিংবা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। ‘পবিত্র পাকিস্তানের’ শত্রুনিধন করে। অগণিত লাশ ভাসে নদীর পানিতে, খালের পানিতে। লাশের ওপর বসে থাকে বিমর্ষ শকুন …।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তো ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগের আগে বলে গেছেন – ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না। শুধু মাটি চাই। রক্তে-ভেজা উর্বর মাটি।’ হানাদাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, জোশসহকারে তার হুকুম পালন করছে। ‘পবিত্র পাকিস্তান’ রক্ষা বলে কথা…!

মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশক্তি অপ্রতুল, স্বল্পপরিসরের প্রশিক্ষণ; তাঁদের পক্ষে ভারী সমরাস্ত্রসজ্জিত, উচ্চমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে যুদ্ধ করছেন। বেছে নিয়েছেন গেরিলা পদ্ধতি। তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই, অস্ত্র নেই। তাতে কী? মুক্তিযোদ্ধাদের আছে অপরিমেয় দেশপ্রেম, অপার সাহস। দেশপ্রেম আর সাহস থাকলে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আর কী লাগে? কিছুই লাগে না। তাছাড়া অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ-দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ’ – শুকতারার মতো জ্বলজ্বলে এই উচ্চারণকে বেদবাক্যের মতো মেনে যুদ্ধ করছেন। দেশের জন্য তাঁরাও বুকের রক্ত ঢালতে সদা প্রস্তুত …।

পাঞ্জাবি, বিহারি, বেলুচ, সিন্ধি হানাদাররা ঊষরভূমির মানুষ। ওরা পানি দেখে ভয় পায়। হানাদারদের সিংহভাগই বিহারি। ওরা আরো বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে পানি দেখে। পানিতে নিজের ছায়া দেখেও শত্রু ভেবে আঁতকে ওঠে। অপারেশনের শুরুর দিকে ওরা পানিপথ এড়িয়ে চলতো। ডাঙায় ডাঙায় আক্রমণ করতো। নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রধান যানবাহন নৌকা। সেই নৌকায় তো নয়ই, লঞ্চ, স্টিমার, স্পিডবোটেও ওরা নদীপথে বেরুতে চাইতো না। তবে এখন বেরোয়। গানবোট ব্যবহার করে। রাজাকাররা ওদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর ওরা জলভীতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে …।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বলাই ডাক্তারের চেম্বারে রোগী কমতে শুরু করে। বর্ষা নামার পর আরো কমেছে। রসুলপুর, সাদুল্লাপুর, গালা, শালিনা, পৌলির বেশিরভাগ ঘরবাড়ি ফাঁকা। মানুষজন নেই। প্রাণের ভয়ে কেউ কেউ, বিশেষত হিন্দুরা, দেশত্যাগ করেছে; মুসলমানরা দূরের কোনো অজগাঁয়ে আত্মীয়বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। অপরিচিত, অনাত্মীয় লোকজনের বাড়িতে উঠলেও, দেশের এই দুর্দিনে, দু-চারদিনের জন্য আশ্রয় মেলে …।

বলাই ডাক্তারের চেম্বারে রোগী কমেছে, তা ঠিক। কিন্তু ডাক্তারের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সারাদিন গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে, ওষুধের ব্যাগ নিয়ে সাইকেলে কি নৌকায় ছোটাছুটি করতে হয়। বেরোতে হয় রাতেও…।

ডাক্তারের ব্যাগটা বদলাতে হয়েছে। আগের ব্যাগটা ছোট আকৃতির ছিল। দুই ফুট বাই দেড় ফুট। নতুন ব্যাগের আকার চার ফুট বাই আড়াই ফুট। এখন তো এই ব্যাগে শুধু ওষুধপত্র, কাটাছেঁড়ার যন্ত্রপাতি, সুচ-ব্যান্ডেজ থাকে না, এসবের ভেতরে লুকানো থাকে গুলি-গ্রেনেড …।

বরুণের একটা চিঠি ডা. বলাইচন্দ্র পালের জীবন-

প্রকৃতি আমূল বদলে দিয়েছে। যুদ্ধ, যে-কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধ এরকমই, কিশোর-যুবক নেই, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ নেই; মানুষের জীবনাচরণ বদলে দেয়। তখন কেউ, দেশের জন্য কোনো কাজকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে না। বলাই ডাক্তারও এই প্রৌঢ় বয়সে এসে যুবক-ছেলেদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ, তা এতোটাই যে, ডাক্তারি ওষুধের ব্যাগে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি-গ্রেনেড – ঘটনা ফাঁস হলে হানাদাররা গুলি করে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করবে, নাকি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে, ভগবান জানে। সত্যিই কি জানে ভগবান? হানাদারদের নৃশংস কার্যকলাপ তো ভগবান আগে থেকে নাও জানতে পারে …!

বরুণ মধ্য-এপ্রিলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ে। কোন পথ দিয়ে, কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, বলাই ডাক্তার কিছুই জানতেন না। কোথায় ট্রেনিং সেন্টার তারও কিছুই জানা ছিল না। বরুণ একরকম নিখোঁজই ছিল। ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল বলাই ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর। ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল বিমলা ও বিমল। বাড়ির সবাই পথপানে চেয়ে থাকতো – যদি ডাকপিয়ন আসে, যদি বরুণের চিঠি আসে …!

মাসখানেক পর, একদিন মধ্যদুপুর, বলাই ডাক্তার রোগী দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড রোদ। বাতাস নেই। বলাই ডাক্তারের মাথার চুল বেয়ে, কপাল বেয়ে, কপোল বেয়ে ঘাম ঝরছে। একটা বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি! এরই মধ্যে ডাক্তারের সাইকেলের সামনের চাকার টিউব ফেটে গেছে, সাইকেল অচল, ঠেলে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বলাই ডাক্তার সাইকেল ঠেলে চলছেন। ধূলিধূসর রাস্তা। সাইকেল ঠেলাও কঠিন। সাইকেলের চাকা ধুলায় দেবে যায়। আটকে যায়। কিন্তু কিছুই করার নেই। বলাই ডাক্তার দাঁত-মুখ খিঁচে ঘর্মাক্ত শরীরে সাইকেল ঠেলছেন। বাজার ও গাঁয়ের মাঝামাঝি ফাঁকামতো জায়গায় হঠাৎ সুপারিগাছের মতো একহারা, ছিপছিপে এক তরুণ, পরনে পাটের ছালার মতো মোটা-কাপড়ের প্যান্ট, গায়ে গেরস্থবাড়ির ছেলেদের মতো হাতাওয়ালা কোড়া গেঞ্জি, গলায় জোড়াতালি দেওয়া চেক গামছা জড়ানো, বলাই ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়ালো …।

‘ডাক্তারবাবু, একটা কথা বলবো …।’

হঠাৎ কোত্থেকে এলো এই ছেলে! এতোক্ষণ তো ধারেকাছে কেউ ছিল না। আজব কাণ্ড! মাটি ফুঁড়ে বেরুলো নাকি? যুদ্ধকালে  কত  কিছুই  তো  ঘটে! লৌকিক-অলৌকিক। সত্য-মিথ্যা। কী বলতে চায় এই ছেলে …?

‘তুমি কে বাবা? বাড়ি কোথায় …?’

‘নাম-ঠিকানা বলার অনুমতি নাই। আমি যা বলি – দয়া করে শুনুন …।’

বলাই ডাক্তার হতভম্ব। ছেলে বলে কি না – নাম-ঠিকানা বলার অনুমতি নেই …।

ছেলেটি বললো – ‘বরুণদার জন্য আপনারা চিন্তা করবেন না। দাদা ভালো আছে। খালেদ মোশাররফ স্যারের ক্যাম্পে ট্রেনিং নিচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই দাদার চিঠি পাবেন …।’

‘বাবা, তুমি কে …?’

‘বলেছি তো – পরিচয় দেওয়ার অনুমতি নাই। আপনি এবার চোখ বুজুন…।’

বলাই ডাক্তার এক মিনিটেরও কম সময় চোখ বুজে ছিলেন। চোখ খুলেই দেখেন ছেলেটি হাওয়া! ভূতের মতো অদৃশ্য …।

ছেলেটি নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা। বলাই ডাক্তারের কানে এসেছে, মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনমতো অদৃশ্য হতে পারে। এতোদিন ছিল শোনা কথা। আজ নিজের চোখেই দেখলেন। ছেলেটি হয়তো বরুণের ক্যাম্পেই ছিল। দেশে ঢুকবে জেনে বরুণ খবর পাঠিয়েছে – সে ভালো আছে। খবরটা শিগগির বাড়িতে জানানো দরকার। বলাই ডাক্তার অচল সাইকেল কাঁধে তুলে বাড়ির পথে ছুটলেন …।

বরুণ ভালো আছে, খবর শুনে অনিতা পালের কপোল বেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগলো। তুলসীতলায় পূজায় বসলেন তিনি। বিমলা আর বিমল বসলো মায়ের দুই পাশে…।

জুন মাসের মাঝামাঝি বরুণের চিঠি এলো …।

সেদিন বিকেল থেকে ঝুমবৃষ্টি। কখন সন্ধ্যা নেমেছে, রাত নেমেছে আঁচ করা যায়নি। রাতের একপ্রহর কেটে গেছে, বৃষ্টি ছুট দেওয়ার নাম নেই। এমনিতেই চারদিকে থইথই বর্ষার পনি। গাঁয়ের রাস্তাগুলো শুধু জেগে ছিল। যে-ঢলবৃষ্টি, রাস্তাও বুঝি তলিয়ে গেল …!

‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু …।’

হারিকেন জ্বালিয়ে সবাই খেতে বসেছিল। মুড়ি-কাঁঠাল। উনুন জ্বালাতে পারেনি অনিতা পাল। কিন্তু এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে, এতো রাতে কে এলো …?’

বলাই ডাক্তার এঁটো-হাতেই দরজার কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন – ‘কে…?’

‘দরজা খুলুন। বরুণদার চিঠি …।’

বরুণের চিঠি! কথাটা সবার কানেই গেছে। অনিতা পাল, বিমলা, বিমল – সবাই খাওয়া রেখে দরজার কাছে এলো। বলাই ডাক্তার দরজা খুলে একপাশে দাঁড়িয়েছেন, যেন আগন্তুক ঘরে ঢুকতে পারে। কিন্তু লোকটি ঘরে ঢুকলো না। চিঠি ডাক্তারের হাতে দিয়ে, ‘যাই ডাক্তারবাবু, নমস্কার’ – বলেই বৃষ্টি ও অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল …।

হায় ভগবান! মুক্তিযোদ্ধারা কেমন মানুষ? ভয়-ডর বলে কিছু নেই। কোনো বিপদ-আপদেরই তোয়াক্কা করে না। বরুণও বুঝি এখন এরকমই হয়েছে …!

তখন কেউ আর খেতে বসলো না। হাত-মুখ ধুয়ে সবাই গোল হয়ে বসলো। বরুণ চিঠিতে কী লিখেছে, শোনার আর তর সইছে না …।

চিঠি বিমলার হাতে দিয়ে বলাই ডাক্তার বললেন – ‘তুই পড় বিমলা। রাতের বেলা তো আমি চোখে ভালো দেখি

না …।’

বিমলা চিঠির ভাঁজ খুলে চুমু খেলো। কপালে ছোঁয়ালো। তারপর পড়তে শুরু করলো …।

পরম পূজনীয়

বাবা,

আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নিও। মাকেও প্রণাম জানিও। বিমলা আর বিমলের জন্য স্নেহাশিস। আমি ভালো আছি। চারদিন আগে দেশে ঢুকেছি। এখন গেরিলা ইউনিটে ঢাকায় আছি। তোমরা কেমন আছো জানি না। অবশ্য ভালো থাকার সুযোগই তো নাই। পাকিস্তানি হানাদাররা হায়েনার চেয়েও হিংস্র। ওরা সারাদেশে রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় এখন রক্তে পরিপূর্ণ। ডাঙায় লাশ, জলে লাশ। তবে, আশার কথা এই যে, আমরাও পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করেছি। ইন্ডিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে দেশে ঢুকছে। আর কিছুদিনের অপেক্ষা মাত্র। হানাদাররা পালাবার পথ খুঁজে পাবে

না …।

বাবা, এখন গ্রামে থাকা কোনোভাবেই নিরাপদ না। যে-কোনো মুহূর্তে তোমরা রাজাকার-হানাদারদের হামলার শিকার হতে পারো। বিমলাকে নিয়েই বেশি ভয়। যুবতী-মেয়ে দেখলে হানাদাররা আর মানুষ থাকে না। পশু বনে যায়। অবশ্য, ওরা কোনোদিন মানুষ ছিল কি না, এ-ব্যাপারে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। যা হোক, বাবা, তুমি দেখো, সবাইকে নিয়ে পালাতে পারো কি না…।

বাবা, তোমাকে পালাতে বললাম বটে, কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, তোমার রোগীদের ফেলে রেখে কোথাও পালাবে না। নিতান্তই যদি তুমি কোথাও যেতে না-চাও, মা, বিমলা আর বিমলকে নিরাপদ কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করো। … আর একটা কথা, বাবা, আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা গোপনে তোমার সঙ্গে দেখা করবে। নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তুমি ওদের সহযোগিতা করো …।

শেষকথা বলি, বাবা। রক্ত ব্যতিরেকে কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় না। তোমাদের বরুণের রক্তও চাইতে পারে বাংলাদেশ …।

জয় বাংলা …।

বিমলা চিঠি পড়ছিল, চিঠি শুনে সবার চোখে পানি এসে গেছে। চোখ ছলছল করছে। বিমলার চিঠি-পড়া শেষ হতেই অনিতা পাল হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রক্ত-ছাড়া নাকি স্বাধীনতা আসে না। বরুণ ফিরে আসবে তো …?

বৃষ্টি ধরে এসেছে। ওই মুক্তিযোদ্ধা বরুণের চিঠি নিয়ে আসবে, তার পথ নিরাপদ করতেই হয়তো বিকেল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছিল …।

কাপড়ের আঁচলে চোখ-মুখ মুছে অনিতা পাল বললেন – ‘যুদ্ধ শুরুর পর থিকাই তো তোমারে কইতাছি, গাঁয়ের প্রায় সব হিন্দু, ক’ঘর ঢুলি-মালি-বেহারা ছাড়া, সবাই ঘরে তালা দিয়া দ্যাশ ছাড়ছে, আমরাও ইন্ডিয়া চইলা যাই, কলিকাতা আমাগো আত্মীয়স্বজন আছে, তারা ফালাইয়া দিবো না, তুমি আমার কথা কানেই তোল না। রাজাকাররা সাতদিনের টাইম দিয়া গেছিল, বরুণরে ফিরাইয়া আনন লাগবো, সেই সাতদিন গেছে কবে; আবার আইলে সবাইরে তো কচুকাটা কইরা ছাড়বো। বরুণও তো চিঠিতে লেখছে …।’

‘বরুণের মা, তুমি বরুণের চিঠির মর্ম বোঝ নাই’, বলাই ডাক্তার বললেন, ‘চিঠিতে তিনটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। এক. বরুণ আমাদের পালাতে বলেছে, দুই. তোমাদের নিরাপদ কোথাও পাঠাতে বলেছে, এবং তিন. বরুণের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের সহযোগিতা করতে বলেছে। তিন নম্বর পয়েন্টটাই কিন্তু সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি পালিয়ে গেলে ওরা কার কাছে সহযোগিতা পাবে …।’

‘তাইলে এহন কী করবা …?’

‘তোমাদের ইন্ডিয়া পাঠাবার ব্যবস্থা করি …।’

‘না …।’

‘না, মানে …!’

‘সিঁথির সিঁদুর মোছে তো স্বামীর কাছে থাইকাই মুছুক। তোমারে যমের মুখে রাইখা আমি কোথাও যামু না …।’

‘বাবা, তোমাকে রেখে আমিও যাবো না’, বিমলা বললো, ‘দাদা চিঠিতে লিখেছে না, রক্ত ছাড়া স্বাধীনতা অর্জিত হয় না। দরকার হলে দেশের স্বাধীনতার জন্য আমিও রক্ত দেবো …।’

বলাই ডাক্তারের চারপাশে তখন শুধু রক্ত আর রক্ত। হিন্দুর রক্ত, মুসলমানের রক্ত। ডাক্তার যেন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন সেই রক্ত-সমুদ্রে …।

তিন

ডাক্তারবাড়িতে একতলা দালান। তিনকক্ষ বিশিষ্ট। এক কক্ষে বলাই ডাক্তার আর তাঁর স্ত্রী, একটিতে বিমলা আর বিমল থাকে। বাকি কক্ষে থাকতো বরুণ। বরুণ মুক্তিযুদ্ধে গেছে। তার কক্ষটি এখন খালি। দালানে বারান্দাও আছে। দালানের পুবপাশে ছোট আকারের আলাদা রান্নাঘর। বারবাড়ি আধাপাকা দোচালাঘরে ডাক্তারের চেম্বার। গাঁয়ে দু-চারটি বনেদি পরিবারের একটি বলাই ডাক্তারের। যদিও সংসারে তেমন সচ্ছলতা নেই। অর্থাৎ নগদ টাকাকড়ি নেই সিন্দুকে। বাড়ির পাকা-দালানটি দেখলেও সংসারের অসচ্ছলতা চোখে পড়ে। দালানটি জরাজীর্ণ, দালানের গায়ে কোথাও কোথাও ফাটল ধরেছে। বট-অশত্থের চারা গজিয়েছে শেওলা-ধরা ফাটলে। বহুদিন সংস্কার করা হয়নি। চুন-রং পড়েনি দেয়ালে…।

বলাই ডাক্তারের ঠাকুরদা গণেশ পাল বড়ো ব্যবসাদার ছিলেন। কুচবিহার, কলকাতা, আসামে তাঁর ব্যবসা ছিল। সিন্দুক-ভরা টাকা ছিল তাঁর। তিনিই গাঁয়ে প্রথম দালানঘর তুলেছিলেন। বংশপরম্পরায় বলাই ডাক্তার এখন সেই দালানবাড়ির মালিক। ডাক্তার ভেবেছিলেন – তিনি বেশিরভাগ রোগী দেখেন বিনাপয়সায়, আয়রোজগার কম, সামান্য যা আসে, সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে সঞ্চয় কিছু থাকে না; দালানের সংস্কার বা চুন-রং করা সম্ভব হয়নি। যা করার বরুণ করবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ে বরুণ। আর বছরখানেক লাগবে এমবিবিএস পাশ করে বেরুতে। কিন্তু যুদ্ধই যে সবকিছু ওলটপালট করে দিলো। কে মরে, কে বাঁচে – ঠিক নেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই – জীবিত বরুণ যদি আর ফিরে না আসে …!

ডাক্তারবাড়ির কাছাকাছি, পাড়ার অন্য বাড়িগুলো যে-রকম, একটির গা ঘেঁষে আরেকটি দাঁড়িয়ে আছে, তেমন কোনো বাড়ি নেই। একটু ফাঁকামতো জায়গায় বাড়িটা। বাড়ির চারপাশে প্রচুর আম-কাঁঠাল, জাম-জামরুল, চালতা-কামরাঙা, নিম-শিরীষ-কড়ই ও গাবগাছের সমারোহ। দূর থেকে শুধু গাছগাছালিই চোখে পড়ে, দালান চোখে পড়ে না। নেহায়েত ডাক্তারবাড়ি বলেই বাড়িটি সুপরিচিত, না-হলে বনজঙ্গল বলে ভুল করে বসতো যে-কেউ …।

গাছগাছালি-ভরা বলাই ডাক্তারের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি হয়ে উঠেছে …।

চারদিকে হানাদারদের কল্পনাতীত পৈশাচিক তাণ্ডব, খুন-ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পোড়ানোর খবর, এমনিতেই প্রাণটা হাতে নিয়ে থাকতে হয়, তদুপরি বলাই ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, ডাক্তারের স্ত্রী অনিতা পাল, মেয়ে বিমলা পাল মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলের মতো, ভাইয়ের মতো যত্নআত্তি করে। পোয়াতি মুরগি যেভাবে তার ছানাদের আগলে রাখে, সেভাবেই মা-মেয়ে দুজনে তাদের আগলে রাখেন। অনিতা পাল ভাবেন, তাঁর ছেলে বরুণ এসেছে বাড়িতে; বিমলা ভাবে, তার বড়দা এসেছে …।

মুক্তিযোদ্ধা-ছেলেরা দিনে ঘর থেকে বেরোয় না। কেউ কেউ সারাদিন ঘুমিয়ে পার করে। কেউ কেউ তাস খেলে। বোবার মতো। নিঃশব্দে। ইশারা-ইঙ্গিতে খেলা পরিচালনা করে। তাদের হাঁচির শব্দটিও যেন  দরজা-জানালার  খিল  গলে  বের না-হয়। রাত এগারোটা-বারোটার দিকে তারা অপারেশনে বের হয়। অপারেশনশেষে কোনো কোনো রাতে তারা বলাই ডাক্তারের বাড়িতে ফিরে আসে, কোনো কোনো রাতে চর এলাকায় গোপন ঘাঁটিতে চলে যায় …।

বরুণ মুক্তিযুদ্ধে গেছে, ওর বন্ধু কামাল, শাজাহান, রতন, কৃষ্ণ, জুলহাসও মুক্তিযুদ্ধে গেছে – এসব এখন আর লুকাছাপা নেই। রাজাকার-হানাদাররা খবর জেনে গেছে। সবার বাবাই তাদের চক্ষুশূল। কামাল আর শাজাহানের বাবাকে বাজারের রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে বটগাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে। হাতের নখ, পায়ের নখ তুলে ফেলেছে। কেটে ফেলেছে দুজনেরই অণ্ডকোষ। এখন শুধু আজরাইল এসে তাঁদের নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। রতন-কৃষ্ণ-জুলহাসের বাবা ঘরসংসার, গরু-বাছুর ফেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে  পালিয়েছেন, তাতেই তাঁদের হাত-পায়ের নখ কি অণ্ডকোষ হারাতে হয়নি। কিন্তু বলাই ডাক্তার? হয়তো ডাক্তার বলেই, এখনো পর্যন্ত শাসানির ওপর রেখেছে, বিমলাকে হানাদার-ক্যাম্পে উপঢৌকন দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, বটগাছের ডালে তাঁকে উল্টো করে ঝোলায়নি। এখন, যদি ফাঁস হয়, বলাই ডাক্তারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি গেড়েছে, কী শাস্তি ভোগ করে যে মরতে হবে, তা একমাত্র বলাই ডাক্তারের ভগবানই জানে …।

সকাল থেকেই বলাই ডাক্তারের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। চেম্বারে দু-চারজন রোগী যারা আসে তাদের দেখে বিদায় করে নামতে হয় প্রকৃত কাজে। কোন গাঁয়ে, কার বাড়িতে আহত মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িকভাবে অবস্থান করছে, এ-খবর ‘গুপ্তলোক’ মারফত ডাক্তারের কাছে আগেই আসে। ডাক্তার দুটো পান্তাভাত কি মুড়ি খেয়ে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে, নতুন ব্যাগ হাতে বের হন। ব্যাগে ওষুধপত্রের ভেতরে গুলি-গ্রেনেডও থাকে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার পাশাপাশি বলাই ডাক্তার এসবও তাদের কাছে পৌঁছে দেন।  ঘটনা  ফাঁস  হওয়ার  কিংবা  গুলি-গ্রেনেডসহ ধরা পড়ার আশংকা আছে, আর ধরা পড়লে রাজাকার-হানাদাররা ডাক্তারকে গুলি করে না-মেরে শরীরের চামড়া ছিলে, লবণ-মরিচ মেখে কুকুর দিয়ে খাওয়াতে পারে; তারপরও বরুণের চিঠি পাওয়ার পর থেকেই সানন্দে এই কাজ করছেন বলাই ডাক্তার …।

গুদারাঘাটে কোশা নৌকা বেঁধে বলাই ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে ময়নাল মাঝি। ডাক্তার প্রতিদিন তাকে নিয়েই বের হন …।

‘ময়নাল, তোমাকে একটা কথা বলি…?’

‘কন ডাক্তারবাবু, কী কবেন …?’

‘তুমি তো এতোদিনে সবই জেনে গেছো …।’

‘হঁ। জানি তো। আপনে আহত মুক্তিদের চিকিৎসা করেন। আপনের ওষুধের ব্যাগে গেনেড আছে …।’

‘ভয় পাও না …?’

‘ভয় পামু ক্যান …?’

‘ধরা পড়লে আমাকে তো মারবেই, তোমাকেও বাঁচাবে না …।’

‘যুদ্ধে যাবার চাইছিলাম ডাক্তারবাবু। পাহাড়ে কাদেরিয়া বাহিনীর ক্যাম্পেও গেছিলাম। বয়স বেশি দেইখা নেয় নাই। এহন আপনের লগে আছি। দ্যাশের জন্যে জানটা যদি যায় তো যাবে। সব আল্লার ইচ্ছা …।’

বলাই ডাক্তার ময়নাল মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুড়ো মানুষ, কিন্তু মাঝির চোখদুটো ভীষণ উজ্জ্বল। রঙিন মার্বেল পাথরের মতো চকচকে। … আর দেশের প্রতি এই অশিক্ষিত বুড়ো-মানুষটির যে-প্রগাঢ় ভালোবাসা, সেই ভালোবাসাই বুঝি তার চোখ ঠিকরে বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারদিকে …।

সেদিন রোজার ঈদ …।

যুদ্ধকালে ঈদ, নদী-নালা, খাল-বিলে ভাসে লাশ, পথেঘাটে লাশ; কোনো বাড়িতে ঈদের আনন্দ-উল্লাস নেই, কোনো বাড়িতে সাজবাতি বা মরিচবাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়নি, মসজিদ কি গোরস্তানে লোকসমাগম নেই; সেমাই-জর্দা কি পোলাও-কোর্মার সুবাস নেই গাঁয়ের বাতাসে, হই-হুল্লোড় নেই শিশু-কিশোরদের, ঈদের নামাজ জামায়াতে পড়তে হয় বলেই পড়া; নামাজ পড়েই সবাই যার যার ঘরে ঢুকে পড়েছে; হানাদাররা যদি গুলি করা শুরু করে …!

ঈদের দুদিন আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট ঘাঁটিতে, এই যেমন বলাই ডাক্তারের বাড়ির ঘাঁটি, বার্তা এসেছিল – ‘তোমরা সবাই চর এলাকার ঘাঁটিতে এসে সমবেত হও। আমরা প্রকাশ্যে ঈদের নামাজ পড়বো। হানাদারদের জানিয়ে দেবো – আমরা তোমাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ছাড়ছি …।’

সেলিম, শামীম, ওসমান, সাদিক, রঞ্জু – বলাই ডাক্তারের বাড়িতে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা গোপনে ঘাঁটি গেড়েছিল। চরাঞ্চলের কমান্ডারের বার্তা পেয়ে ওরাও চলে গেছে। তবে, সেলিম বিমলাকে বলে গেছে, পাওয়ার হাউস আক্রমণ করতে গিয়ে ওদের বেড়াডোমার সহযোদ্ধা মিজান গুরুতর আহত হয়েছে, সে এখন বাসালিয়ার কদ্দুস ব্যাপারীর বাড়িতে আছে। ডাক্তারবাবু যেন মিজানকে দেখে আসেন …।

বলাই ডাক্তার দুপুরের আগে আগে বেরিয়েছেন। যথারীতি ময়নাল মাঝির কোশা নৌকায়। ময়নাল ঈদের নামাজ পড়বে, এজন্যেই ডাক্তার সকালে বের হননি। ময়নালকে ঈদ উপলক্ষে নতুন লুঙ্গি কিনে দিয়েছেন ডাক্তার, সেই লুঙ্গি পরেই ময়নাল এসেছে …।

চারদিকে থইথই পানি। গ্রামগুলো দেখতে দ্বীপের মতো। ময়নাল বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললো – ‘কোন গাঁয়ে যামু ডাক্তারবাবু …?’

‘বাসালিয়া। কদ্দুস ব্যাপারীর বাড়িতে। চেনো তো …?’

‘কী যে কন ডাক্তারবাবু! বাসালিয়ার কদ্দুস ব্যাপারীরে ক্যারা না চিনে! সঙযাত্রার অধিকারী …।’

‘চলো। তার বাড়িতেই যাবো …।’

রসুলপুর গুদারাঘাট থেকে নৌকা ছেড়েছে ময়নাল মাঝি। নদীর পাড় ডোবা। নদী আর চকের পানি সমান সমান। কোনটুকু নদী আর কোনটুকু চক – বোঝা মুশকিল। কিন্তু ময়নাল মাঝি বোঝে। নদী পার হলেই বিশাল চক। চকে আমন ধান গলা উঁচিয়ে জেগে আছে। পানি যতো বাড়ে ধানগাছও ততো বাড়ে। যা-হোক ময়নাল মাঝি আমনধান বিলি কেটে কেটে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামনে টেপি বিল। সাগরের মতোই বড়ো। বাতাস উঠলে বিলে উথাল-পাথাল ঢেউ ওঠে। বাতাস না-থাকলে শান্ত, নীরব, নিস্তব্ধ। যেন মৃত জলাশয়। টেপি বিল পার হলেই বাসালিয়া। ময়নাল মাঝি বাসালিয়ার কদ্দুস ব্যাপারীর বাড়িমুখে নৌকা চালাচ্ছে …।

তখন সদ্য-প্রস্ফুটিত দুপুর। ঋতুচক্রে, যে-কোনো সময় আকাশে মেঘ-করার কথা, বৃষ্টি নামার কথা, কিন্তু সেদিন আকাশ ঝকমক করছে, কোথাও মেঘের একটা টুকরো পর্যন্ত ভেসে নেই, বৃষ্টি নামার নামগন্ধও নেই, ময়নাল মাঝি অবাক, বিস্মিত; এরকম তো সে কোনোদিন দেখেনি; বলাই ডাক্তারও আবহাওয়ার এই দোদুল ভাবভঙ্গি দেখে বিস্মিত, কিন্তু তিনি ময়নাল মাঝিকে কিছু বলছেন না; তাঁর চিন্তা বাসালিয়া কদ্দুস ব্যাপারীর বাড়িতে কত দ্রুত পৌঁছানো যায়, আহত মুক্তিযোদ্ধা মিজানকে কখন চিকিৎসা দেওয়া যায় …।

হঠাৎ বিলের পূর্বদিক থেকে গানবোটের শব্দ শোনা গেল। রসুলপুর ও পৌলি সেতুর রাজাকার-হানাদাররা টেপি বিল ঘিরে ফেলেছে। লক্ষ্য – বেইমান, বিশ্বাসঘাতক বলাই ডাক্তারকে পাকড়াও করা। মালাউনটাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া …।

‘ডাক্তারবাবু, এখন উপায়? আমি মরলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আপনেরে বাঁচাই ক্যামনে। শালারা তো আমাগোরে ঘিরা ফালাইছে…।’

‘কোনো চিন্তা নাই, ময়নাল। তুমি নৌকা চালাও আর তোমার আল্লাহকে ডাকো। আমি আমার ভগবানকে ডাকি। তোমার আর আমার ললাটে যা লেখা আছে তাই হবে …।’

কথা বলতে-বলতেই বলাই ডাক্তার তার ওষুধের ব্যাগটি, যে-ব্যাগে শুধু ওষুধ নয়, গুলি-গ্রেনেডও আছে, নিঃশব্দে বিলের পানিতে ছেড়ে দিলেন …।

‘হেই মাঝি, নৌকা থামাও …।’

ময়নাল মাঝির কোশা-নৌকার চারপাশে চারটি গানবোট। সব বোটেই পাঁচ-ছয়জন রাজাকার, হানাদার। এখন পালাবার কিংবা বাঁচার কোনো উপায় নেই, পথ নেই। বলাই ডাক্তার ময়নাল মাঝিকে বললেন, ‘ময়নাল, নৌকা

থামাও। ওরা খবর জেনেই এসেছে…।’

রসুলপুর বাজারের রাজাকার কমান্ডার ইজ্জত আলী নিজের গানবোট থেকে লাফ দিয়ে বলাই ডাক্তারের কোশা-নৌকায় নামলো। ডাক্তারের গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই মালাউনের বাচ্চা, তর ওষুধের বাক্স কই …?’

‘নাই …।’

‘নাই মানে …?’

‘জলে ছেড়ে দিয়েছি …।’

‘ক্যান …?’

‘মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি-গ্রেনেড যাতে দেশের শত্রুর হাতে না-পড়ে …।’

‘কয় কী রে মালাউনের পুত! আমরা দেশের শত্রু …।’ ইজ্জত আলী রাইফেলের বাঁট দিয়ে বলাই ডাক্তারের ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মারলো। ডাক্তার মুখ থুবড়ে পড়লেন নৌকার পাটাতনের ওপর …।

বলাই ডাক্তার রাজাকার-হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছেন, ডাক্তার আর ময়নাল মাঝিকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে আসছে ওরা, এই খবর যেন পাখির মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে গাঁয়ে। যুদ্ধকালে ভয়ে গাঁও-গেরামের বেশিরভাগ পাখিও দেশ ছেড়েছে। অল্পবিস্তর যা আছে, ওরা এতোক্ষণ কী তারস্বরে যে কিচিরমিচির করছিল …!

বিমলা অনিতা পালকে বললো – ‘মা, তুমি আর বিমল বাংকারে ঢুকে পড়ো …।’

‘তুই …?’

‘আমার কাছে স্টেনগান আছে। যে কয়টাকে পারি মেরে তারপর মরবো …।’

‘এইটা পাইলি কোথায় …?’

‘সেলিম ভাইর কাছ থেকে রেখেছি…।’

সেলিমরা ঘরের ভেতরেই বাংকার খুঁড়েছে। বাংকারেই থাকতো ওরা …।

অনিতা পাল বললো – ‘বাংকারে লুকাইলেও বাঁচন নাই। জালিমরা আমাগো খুঁইজা বাইর কইরা মারবো। তার থিকা দেখি, তুই কীরকম অস্ত্র চালাবার পারস…।’

রাজাকার-হানাদাররা উঠোনে পা দিতেই ঘরের বারান্দার মোটা একটা খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে বিমলা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে লাগলো। গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো

পাঁচ-ছয়জন রাজাকার-হানাদার। এভাবে আক্রমণের শিকার হবে – এটা ওদের কল্পনায়ও ছিল না। রাজাকার-হানাদারদের কাছে পাকা খবর ছিল – মুক্তিরা ঈদ উদ্যাপন করতে চরের দিকে চলে গেছে। ওরা ‘মুক্তি, মুক্তি’ চিৎকার করতে করতে কিছুটা পিছিয়ে এসে গাছের আড়াল নিল …।

গুলি করতে-করতেই হঠাৎ বিমলার স্টেনগানের ট্রিগার আটকে গেল। গুলি বেরুচ্ছে না। মরতে যে হবে, জানতো বিমলা। ওর পরিকল্পনা ছিল – শেষ গুলিটা করবে নিজের বুকে, যাতে এই নরপশুরা জীবিত বিমলাকে ছুঁতে না-পারে। কিন্তু ওর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেল। ধপাস করে বসে পড়লো বারান্দায়। মনে মনে বললো – ‘এই তোমার অন্তরে ছিল, ভগবান …।’

এক হানাদার চিৎকার করে উঠলো – ‘স্যার, মুক্তি জেনানা হ্যায়। পরির মতো সুন্দরী …।’

কমান্ডিং অফিসারও চিৎকার করে উঠলো – ‘জেনানা …?’

‘জি স্যার। ওর স্টেনগানের ট্রিগার আটকে গেছে …।’

‘পাকড়াও মাগিকো …।’

তিন-চার রাজাকার-হানাদার বিমলাকে টেনেহিঁচড়ে উঠানে নিয়ে এলো। রাজাকার কমান্ডার ইজ্জত আলী বললো – ‘মাগি ডাক্তারের কন্যা, স্যার। বহুত খুব সুরুত। কাঁচামিঠা আমের মতো সুস্বাদু হবে। লবণ ছাড়াই খেতে পারবেন …।’

বলাই ডাক্তার, ময়নাল মাঝি, অনিতা পাল, বিমল – সবাই চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকলো। যা ঘটছিল ডাক্তারের উঠানে তা কোনোভাবেই মানুষ চোখ মেলে দেখতে পারে না …।

অতঃপর কমান্ডিং অফিসার নির্দেশ দিলো – ‘সবার হাত-পা বেঁধে ঘরে ঢোকাও। তারপর গান পাউডার ছিটিয়ে, কেরোসিন ঢেলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দাও। পাকা ঘর তো, পুড়তে সময় নেবে …।’

ঘর পাকা, কিন্তু বয়সের ভারে ন্যূব্জ। বৃদ্ধ মানুষের লাশ চিতায় ওঠালে গনগনে আগুনের তাপে শরীরের হাড়গোড় যেভাবে মটমট করে ফোটে, সেভাবেই ফুটতে ফুটতে বলাই ডাক্তারের পাকাঘর ভেঙে পড়তে লাগলো …।

বিস্ময়কর কাণ্ড! বলাই ডাক্তার কি ময়নাল মাঝি, অনিতা পাল কি বিমলা-বিমল – কারো মরণচিৎকার শোনা গেল না …।

পাদটীকা

বরুণ উন্মাদের মতো ঘরের ধ্বংসস্তূপের ভেতর মা-বাবা, ভাই-বোন ও ময়নাল মাঝির মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড়, চোখের মণি খুঁজছে। তিনটি খুলির অর্ধেক, দুটি খুলির সিকিভাগ, কিছু হাড়গোড়, একটি গলিত চোখের মণি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে বরুণ। কিন্তু কোনটি কার খুলি, হাড়গোড়ের কোন অংশ কার শরীরের, আর গলিত চোখের মণিটিই বা কার – বরুণ কিছুতেই মেলাতে পারছে না। একবার দ্রুতহাতে সব এক জায়গায় জড়ো করছে, আবার পৃথক করছে। এই করতে করতেই বলাই ডাক্তারের বাড়িতে সন্ধ্যা নেমে এলো…।

হঠাৎ ত্রস্তপায়ে উঠানে নেমে এলো বরুণ। সে তো বাড়িতে যাবে। শ্মশানে নেমেছে কেন? বাড়ি আর কতদূর? বরুণ যত দ্রুত হাঁটে কিংবা দৌড়ায়, বলাই ডাক্তারের বাড়ি যেন ততো দূরে সরে যায়…।