ওয়াকিলুর রহমান, আমি ও আমরা একই সময় ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি। জগৎকে দেখার ও বোঝার ক্ষেত্রে ভাবনার যে-আদিকল্প আমাদের মধ্যে কাজ করেছিল, তার ধরন প্রায় এক। ফলে আমাদের চিন্তা, উপলব্ধি ও বিশ্লেষণে মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রারম্ভিক সময়ে আমরা যূথবদ্ধভাবে শিল্পচর্চা করেছি। ব্যক্তিস্বভাব অনুযায়ী শিল্পের ভাষা ও প্রকাশের ধরনে গোড়া থেকেই আমাদের ভিন্নতা ছিল। তা সত্ত্বেও শিল্পচর্চার গতিপথের বৃত্তান্ত থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।
ওয়াকিলকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারার যে-বাধা, তাঁর কাজ নিয়ে বলার ক্ষেত্রেও সেই একই বাধা। কারণ আমরা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গীভূত। নিজের শরীর যেমন পরিপূর্ণভাবে অবলোকন করা এবং তার সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া যায় না, ওয়াকিলের কাজ সম্পর্কে বলতে গেলেও বিষয়টা একই দাঁড়ায়।
‘মনন খনন’ প্রদর্শনীটি আমি কয়েকবার দেখেছি। নিভৃতে এসে দিনের আলো সন্ধ্যায় গড়ানো পর্যন্ত আলোর পরিবর্তনে বস্তুগুলোর অবয়বে কী ভাব ও প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করে, তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। লক্ষ করেছি, অন্ধকারের মধ্যে আলো কীভাবে প্রধান চরিত্রগুলোর একটি হয়ে ওঠে। বস্তুসমূহ, আলো আর অন্ধকার সবই একে অপরের অস্তিত্বের অংশ।
ওয়াকিলের চারুকলায় প্রথম শিক্ষাগ্রহণ ঢাকায়। এরপর বেইজিং সেন্ট্রাল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে তাঁর দীক্ষা। পরে প্রায় দুই যুগের বেশি সময় জার্মানিতে বসবাস। বাংলাদেশে তিনি ফিরেও এসেছেন এক যুগের অধিক হয়ে গেল। আলাদা তিনটি পরিমণ্ডলের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে নিজের ভাবনাকাঠামো তাঁকে পুনর্নির্ধারণ ও প্রাসঙ্গিক করতে হয়েছে। এসবের গভীরে আগের চিন্তা এবং অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই প্রবহমান ছিল।
ওয়াকিলের যেখানে জন্ম, তার পাশেই বংশী নদী। পানি ও জলযানের যে-আখ্যান এই প্রদর্শনীতে প্রধান চরিত্র হিসেবে হাজির হয়েছে, তার সঙ্গে শৈশব থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রদর্শনীটি দেখতে দেখতে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আমার চোখে পড়েছে। অতিসম্প্রতি পশ্চিমের ভাবুকদের অনেকেই নির্মাণ-প্রতিনিধিত্বের (নন-হিউম্যান এজেন্সি) কথা বলছেন। এটি মানুষ ছাড়া জৈব-অজৈব দুই ধরনের বস্তুই বোঝায়। অধুনা শিল্পীদের মধ্যে এই ভাবনার প্রভাবও লক্ষ করার মতো। ‘মনন খনন’ প্রদর্শনীতে যেসব অজৈব বস্তুসামগ্রী হাজির করা হয়েছে, সেগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রাত্যহিক জীবনযাপনের উপাদান হিসেবে মানুষের আখ্যানের কথক, অথচ তাদের বস্তুসত্তা মানবকেন্দ্রিকতার প্রতিনিধিত্ব করে না। একই সঙ্গে এগুলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নৃতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞানকাণ্ডের অংশ। এসব বস্তুসামগ্রী যেসব প্রতিনিধিত্বকারী উপাদানে বেষ্টিত মানুষের সঙ্গে সেগুলোর সম্পর্ক কী, কীভাবে সেগুলো ব্যক্তি ও সমাজে পরিবর্তন এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে, স্বল্পপরিসরে তা পর্যালোচনা করা কঠিন। এ এমন আত্মবিরোধী এক সংশ্লেষ যে, নিজেদের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে মানবনির্মিত এসব বস্তুসত্তা পরিমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে মানুষের
মন-মানচিত্র নির্মাণের বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভিন্নতর এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ‘মনন খনন’ প্রদর্শনীর এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শিল্পচর্চার যাত্রাপথে ওয়াকিলের প্রথমদিকের চর্চা ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক। পরে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অপ্রতিনিধিত্বমূলক ভাষাভঙ্গির চর্চা করে আসছেন। এ-প্রদর্শনীর লক্ষণীয় বিষয় এর নতুন বাঁক, যেখানে দুই ভাষাভঙ্গির অভিজ্ঞতারই সংমিশ্রণ ও প্রতিফলন রয়েছে। এরকম বস্তুসামগ্রীনির্ভর উৎক্রান্তি তাঁর মধ্যে প্রবহমানই ছিল। সেটিরই পরিপূর্ণ রূপ বর্তমান প্রদর্শনীতে স্পষ্ট হলো। মানুষ কেন উৎসের সন্ধান করতে চায়, তার নানা কারণ থাকতে পারে – আত্মপরিচয় উদ্ঘাটন, ইতিহাস বা পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ অথবা গভীর আকাক্সক্ষায় ধরিত্রীর অস্তিত্বকে অনুধাবন করা কিংবা তার মধ্যে নিজের অবস্থানটি বোঝা, যৌথ অবচেতনাকে উন্মোচন করা ইত্যাদি।
প্রদর্শনীটিতে মাধ্যমের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা ও ভাবনারও পরিবর্তন হয়েছে। সেসব দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। ‘মনন খনন’-এর বিষয় নির্বাচনের কিছু সম্ভাব্য কারণের কথা আমরা বললাম। কেন তাঁর কাছে এরকম একটি বিষয় এসে হাজির হলো, তার বহু যূথবদ্ধ কারণও থাকতে পারে। ‘মনন’ আর ‘খনন’ শব্দ দুটির মধ্যে ধ্বনি ও রূপগত অদ্ভুত মিল-অমিলের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থের দিক থেকে শব্দ দুটি বিপরীতধর্মী। ‘মনন’ স্পর্শাতীত, ‘খনন’ বাস্তবতায় ধরা।
প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত বস্তুসামগ্রী এবং তাদের সত্তার অনুসন্ধানকে এই বদ্বীপের মানুষ ও জনপদকে বোঝার একটি প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। শিল্পী হয়তো এই পানি/ জল, কাদামাটি, জলযান এবং মানুষনির্মিত বস্তু এবং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রাত্যহিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে উন্মীলিত করতে চেয়েছেন। ভাবনা ও উপলব্ধি প্রকাশের ক্ষেত্রে উপাদান, উপকরণ ও প্রকরণকে ভাষাকাঠামোর অংশ হিসেবেই বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়েছেন। এতে রয়েছে কাঠের নৌকার ভগ্নাংশের সঙ্গে রূপান্তরিত খণ্ডবিখণ্ড অংশ, আলকাতরা, দোমড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র, বাদ্যযন্ত্রের অঙ্গ, কাদামাটি থেকে রূপান্তরিত পোড়ামাটির রিলিফ ভাস্কর্য এবং কাঠের তৈরি বিশেষভাবে নির্বাচিত শব্দমালা বা টেক্সট। নৌকা বা জলযান এই বদ্বীপের প্রাচীনতম পরিবহন-ব্যবস্থাপনার অংশ। মানুষনির্মিত বিশেষ এই বস্তু ব্যক্তি ও জনপদের মনের গভীরে যে-অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, ওয়াকিলুর রহমান ‘মনন খনন’-এ তারই খোঁজ করতে চেয়েছেন। প্রদর্শনীটি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও শিল্পধারণারও প্রতিনিধিত্ব করছে।
প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত বস্তুসামগ্রী বাংলাদেশের যে বিশেষ অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সে-জনপদের নিজস্ব যাপনের বয়ান রয়েছে। এই বস্তুসামগ্রী সংগ্রহ করার সঙ্গে খননের অন্তর্নিহিত একটি সম্পর্ক আছে। ব্যবহারোপযোগিতা হারিয়ে যাওয়া সামগ্রীর ভগ্নাংশের সংগ্রহ, সেসবের ব্যবচ্ছেদ, পুনর্নির্মাণ এবং তাতে অ্যালুমিনিয়ামের সন্নিবেশ, কেবলই কালো রঙের ব্যবহার, আলো-অন্ধকারের বিশেষ চরিত্র নির্মাণ – বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো রূপক সৃষ্টিতে সক্ষম। যোগাযোগের প্রক্রিয়ায় রূপক আমাদের অর্থ উৎপাদনের সম্প্রসারণ ঘটায়। কোনো কিছু সহজ করে বোঝার জন্য সাদৃশ্য খোঁজার যে মানসিক প্রচেষ্টা, তার মধ্যে তথ্য ও চিন্তার সংশ্লেষ ঘটে। নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি আমলে নিয়ে যে-কোনো দর্শক তাঁর নিজস্ব চিন্তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে প্রাসঙ্গিক রূপক তৈরি করে থাকেন।
খোদ ‘খনন’ শব্দটি এবং বস্তুসামগ্রী সংগ্রহের ধরন এই প্রদর্শনীটির মধ্যে একটি প্রত্নতত্ত্বের অনুষঙ্গ যুক্ত করে। আমরা জানি, জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞান এবং প্রত্নতত্ত্বের প্রায় সমান্তরাল বিকাশ ঘটেছে উপনিবেশের কালে, উপনিবেশ-ব্যবস্থাকে সুসংহত করার প্রয়োজনে। মেসোপটেমিয়া ও গ্রিসের মতো প্রাচীন সভ্যতায় প্রত্নচর্চার উদাহরণ থাকলেও উপনিবেশের আমলে প্রত্নতত্ত্ব একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে বিকাশ লাভ করে। পশ্চিমে বিকশিত এই জ্ঞানকাণ্ড জবরদখল করা জনপদের অস্তিত্ব ও মনোজগতের ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করার প্রক্রিয়া হিসেবে তা বিদ্যাচর্চার অন্তর্গত করে। আধুনিকতা-উত্তর চিন্তাকাঠামোয়, বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে নানা জ্ঞানকাণ্ডের মতো প্রত্নবিদ্যাও বিষয়ভাবনা প্রকাশের পথকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে শিল্পভাষায় অঙ্গীভূত হয়। উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় বি-উপনেবিশায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিল্পের ভাষাকাঠামোতেও প্রত্নবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। ‘মনন খনন’ প্রদর্শনীতে সেরকম একটি সাদৃশ্য লক্ষ করা যাবে। মানুষের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক উদ্ঘাটনে অতীত ইতিহাসের পুনর্বিবেচনা এখানে সূত্রের ভূমিকা গ্রহণ করে।
‘মনন খনন’ প্রদর্শনীর বস্তুসামগ্রী নিরেট অবলোকনের জন্য নয়, বরং বস্তুসত্তা ও মানুষের পরস্পর সম্পর্কের সংস্কৃতি বুঝতে চাওয়ার এক প্রক্রিয়া। বস্তুসামগ্রীর আকারের বিভিন্নতা আলো-আঁধারের পরিবেশনায় দর্শককে প্ররোচিত করে এবং জিজ্ঞাসার মধ্যে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে প্রদর্শনসামগ্রী তার উপকরণ প্রকরণসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গের বিন্যাস-কাঠামো আনুষ্ঠানিকতার (ফর্মালিজমের) ভারও বহন করে।
পরিবেশনা ও উপস্থাপনার নকশা এবং এর পেছনের ভাবনা এই প্রদর্শনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ওয়াকিলের ভাবনাকাঠামোরও প্রতিনিধিত্ব করে। আলো-আঁধারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুসামগ্রীর অবলোকনে রূপান্তর ঘটে এবং অর্থ ও বয়ান উভয়ই পাল্টে যায়। আলোর ব্যবহার ও ভূমিকা এই প্রদর্শনীতে বস্তুসামগ্রীকে দেখানোর জন্য নয়, বরং তা নিজেই চরিত্র। আলো এখানে স্থির থাকে না, তাঁর রূপ ক্রমশ বদলাতে থাকে। দিন গড়িয়ে অন্ধকার স্থিত হওয়া পর্যন্ত দিনের আলোতে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আলোর মধ্যে টানাপোড়েন থাকে। আলো ও অন্ধকারের এই ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতা প্রদর্শিত বস্তুর স্বভাব-চরিত্র এবং দর্শকের সঙ্গে তাদের আলাপচারিতা পাল্টে দিতে থাকে। আলোর এই ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অন্ধকারও প্রচলিত ধারণার বাইরে। প্রচলিত ধারণার প্রভাবে অন্ধকারে এই প্রদর্শনী আমাদের বিষণ্ন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে; কিন্তু ক্রমেই আমরা অনুভব করি, অন্ধকার এখানে আমাদের নিমজ্জিত করে না, বরং আলোর বিপরীতে বস্তুসামগ্রীর প্রান্তসীমা অস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে তা প্রচলিত ধারণার সীমানা অতিক্রম করে।
শিল্পী এই প্রদর্শনীর পরিবেশনায় মেঝে ও সিলিংকে যেমন বিবেচনায় নিয়েছেন, তেমনই দেয়ালের ব্যবহারকে এড়িয়েও গেছেন। এভাবে পরিসরকে আয়তক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে একটি সুবিন্যস্ত ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। বস্তুসামগ্রীর অংশবিশেষের উল্লম্ব উপস্থাপন টেনশন সৃষ্টির মাধ্যমে বিশেষ সংবেদন তৈরি করে। প্রদর্শনীকক্ষে উপাদানের বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। এই প্রদর্শনী নিছক নিরেট বস্তুসামগ্রী দেখার নয়, বরং বস্তুসামগ্রীর উপস্থাপন ও বিন্যাসের টানাপোড়েনে নতুন কোনো বয়ানের পক্ষে নতুন সীমানা নির্মাণে প্ররোচনাময়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.