বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া হাজার বছরের পুরনো বলে বিবেচনা করা হয়। বাস্তবে কিন্তু এটি রূপলাভ করে মাত্র বিংশ শতাব্দীতে। ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের জন্যে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধে তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে চাপা পড়ে যায়। সাম্প্রদায়িক বিভেদ জাতিগঠনে ধর্মের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে মাত্র তিরিশ ও চল্লিশের দশকে। এই সময় বাংলাদেশ ভূখ-ের জনগণ পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তবে ঠিক ভারত বিভাগের প্রাক্কালে যুক্ত বাংলায় স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা। পাকিস্তানের তেইশ বছরের দুঃসহ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের উদ্ভবে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের উদ্ভব-প্রক্রিয়াটি পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই শক্তিসঞ্চয় করে। ১৯৪৭-এর জুন মাসেই বাংলা ভাষার দাবি ওঠে এবং পাকিস্তানের উদ্ধত ব্যবহারে    তা অচিরেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। একই     সঙ্গে রাজনৈতিক অবহেলা ও বঞ্চনার বিষয়টি পূর্ব ও পশ্চিম

পাকিস্তানে বিভেদ গভীরতর করে। তদুপরি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়াকে এদেশে খুবই শক্তিশালী করে তোলে। বাংলাদেশ কিন্তু শান্তিস্থাপনের জন্যে শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বিখ্যাত ছয় দফা ছিল এই প্রচেষ্টারই অন্তর্ভুক্ত। অবশেষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানি শাসকজান্তা যখন সামরিক বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো তখনই শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২৫ মার্চের কালরাতে (২৬ মার্চ) শুরু হয় একটি অতুলনীয় জনযুদ্ধ। নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গের ভাষায় ‘লাঠি, বর্শা এবং স্বহস্তনির্মিত রাইফেল নিয়ে পূর্ব    পাকিস্তানের লোকেরা বিমান, বোমা, ট্যাংক ও ভারি কামানে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে’ (২৮ মার্চ ১৯৭১)। পুলিশ, সীমান্তরক্ষী ও সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সশস্ত্র সদস্যের সম্পৃক্তি এই জনযুদ্ধে সবিশেষ উৎসাহ সঞ্চার করে। প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয়লাভ করে ও তাদের সহায়তায় রচিত হয় এক অনন্য প্রক্রিয়ায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস।

এই মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা বিবেচনা করতে হলে প্রথমেই তৎকালীন বিশ্ব-রাজনীতির কতিপয় মৌলিক দিক নজরে রাখা প্রয়োজন। পৃথিবী তখন দুটি সহ-অবস্থানকারী পরাশক্তি-বলয়ে বিভক্ত। পরাশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে বিশ্বের সব সমস্যা-সংকট বিবেচনা করে, ঠিক কোনো নীতিমালার ভিত্তিতে নয়। যদিও ১৯৪৮ সালে বিশ্ব মানবাধিকার মহাসনদ জাতিসংঘে গৃহীত হয় তবু মানবাধিকার নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা ছিল না। মানবাধিকার-লঙ্ঘন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে অনুষ্ঠিত হতো। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে যে-নীতি অনুসরণ করা হতো, তাতে নিজের ভৌগোলিক সীমানার ভেতর সরকারি জুলুম-নির্যাতন বা অন্যায়-অবিচারে বাইরের হস্তক্ষেপ ছিল অচিন্তনীয়। অবশ্য পরাশক্তির গোপন গোয়েন্দাবাহিনী নানাভাবে হস্তক্ষেপ করতো, সরকার বদলিয়ে দিতো বা সরকারপ্রধানকে হত্যা করতো বা সরিয়ে দিতো। পরাশক্তিরা মোটামুটিভাবে সামরিক শাসক বা শক্তিশালী স্বৈরশাসককে বেশি পছন্দ করতো ও আশকারা দিতো। গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারের জন্যে উপনিবেশবাদের অবসানে যতই বুলি আওড়ানো হতো না কেন এগুলোর তেমন কদর ছিল না। উপনিবেশবাদ বা শ্রেণি বা বর্ণবৈষম্য নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিক সনদ থাকলেও তা বাস্তবায়নে আগ্রহ ছিল অতি সামান্য। সর্বোপরি একটি দেশের কোনো অংশের মূল দেশ থেকে বিচ্ছেদের বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থন পেতো না। নাইজেরিয়া থেকে বায়াফ্রার ছেদনের আন্দোলন ১৯৬৭ সালে শুরু হয়, কিন্তু তিরিশ মাসের অনেক রক্তক্ষরণ ও ধ্বংসলীলার পর ১৯৭০ সালে ব্যর্থ হয়। ছেদন-প্রক্রিয়া নিয়ে একরকম জুজুর ভয় যেন বিরাজ করতো। যুদ্ধাপরাধের আইন থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে তার বিচার ছিল অচিন্তনীয়, বিচার হলে তা করবে জাতীয় সামরিক বাহিনী বা সরকার। যে-কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল অকল্পনীয়। মাত্র ১৯৭৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন জাতিসংঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ করে অথচ ১৯৪৭ সালেই স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রগঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল। দুস্থের সেবায় বা শরণার্থী মোকাবিলায় জাতিসংঘের অবশ্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু শান্তিরক্ষার বিষয়ে দুই পরাশক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে কিছুই করার কোনো অবকাশ জাতিসংঘের ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা নিয়ে তেমন বেশি গ্রন্থও রচিত হয়নি। ভারতকে এই বিবেচনা থেকে অবশ্য বাদ রাখা সমীচীন এবং এই প্রবন্ধে ভারতের বিষয়ে কিছুই লেখা হয়নি। যা কিছু লেখালেখি আছে তা আমেরিকা ও ব্রিটেনকে নিয়েই। অধুনা জাপানের ওপর কিছু কাজ হয়েছে এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ আরকাইভস থেকে অনেক দলিল-দস্তাবেজ প্রকাশিত হয়েছে বা গবেষণার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের অবস্থান সম্বন্ধে তেমন নির্ভরশীল বিবরণ খুব কম আছে। জাতিসংঘের নানা উদ্যোগ সহজেই জানা যায়। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার ফর্দ লেখার শেষে যোগ করা হয়েছে।

বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে বিবেচিত হয় বা প্রভাব ফেলে তা নির্ভর করে কয়েকটি উপাদানের ওপর। যেসব দেশে প্রবাসী বাঙালিরা ছিলেন তাঁরা সংগঠিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ব্রতী হন। তাঁরা গণমাধ্যমে প্রভাব ফেলেন এবং রাষ্ট্রনায়ক, বিশেষ করে সেই দেশের জনপ্রতিনিধিদের, সচেতন ও সমর্থক করতে প্রচেষ্টা নেন। মনে রাখা ভালো যে, ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাঙালি মূলত দুটি দেশেই ছিলেন – আমেরিকা ও ব্রিটেনে। মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। জাপান, সুইডেন বা অস্ট্রেলিয়ায় ছাত্র ও দু-চারজন কূটনীতিবিদ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। তবে প্রধান দুটি দেশ ছাড়াও অন্যত্র প্রবাসী ভারতীয়রা নানা দেশে ছিলেন এবং তাঁরা নিজেরা অথবা বাংলাদেশের প্রবাসীদের নিয়ে এই ধরনের লবি প্রতিষ্ঠা করেন। আরো একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত প্রভাবে সবিশেষ অবদান রাখে। যেসব বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা কূটনীতিবিদ বাংলাদেশে কোনো সময়ে কর্মরত ছিলেন, এমন কি যাঁরা পাকিস্তানে কর্মরত থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে প্রান্তিকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের পক্ষে মতামত-গঠনে সচেষ্ট হন।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র মানুষ-নিধনে ও সারাদেশের সম্পদ-লুণ্ঠনে যে-ভূমিকা ছিল তার বর্বরতা আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২৫ মার্চে ঢাকায় প্রায় পঁয়ত্রিশজন বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের ২৫ মার্চেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গৃহবন্দির মতো করা হয়। তবে দুজন সাংবাদিক – সাইমন ড্রিং এবং একজন ফরাসি আলোকচিত্রী হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে পালাতে সমর্থ হন এবং অতিরিক্ত একদিন বিধ্বস্ত শহরটি প্রদক্ষিণের সুযোগ পান। এইসব সাংবাদিককে ২৭ মার্চে বিমানে করাচিতে নিয়ে গিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তাঁদের কাগজপত্র, ক্যামেরা বা অন্যান্য সহায়ক যন্ত্র সব বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাই প্রথম পদক্ষেপেই পাকিস্তান বিদেশী সাংবাদিকদের বৈরী অবস্থানে ফেলে দেয়। অতঃপর সরকারই সমস্ত সংবাদ সরবরাহ করে এবং তা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তববিবর্জিত ও মিথ্যা। সীমান্ত-এলাকার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন তথ্য-সরবরাহকারী ব্যক্তি বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় বিশ্ব-সংবাদ মাধ্যম প্রকৃত খবর সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় এবং এই সংবাদ ছিল পাকিস্তানের জন্য খুবই নেতিবাচক। ছয় সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার নিজেদের পছন্দমতো কিছু বিদেশী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ করে বিপর্যস্ত এলাকা প্রদর্শনে নিয়ে যায়। এগুলো ছিল নির্ধারিত এলাকায় পরিচালিত পর্যবেক্ষণের সুযোগ প্রদান। কিন্তু এতেও হত্যা, অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিচয় লুকানো সম্ভব হয়নি। নয়টি মাসে কখনো পাকিস্তানি বর্বরতার কোনো প্রশমন পরিলক্ষিত হয়নি। তারা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে, নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, বাঙালি এলিট-গোষ্ঠীর অনেক সদস্যকে গুম করে ফেলে অথবা দীর্ঘদিনের জন্যে কারাবন্দি করে এবং ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে সকলের সম্পদ লুঠ করে। একই সঙ্গে তারা সমর্থ যুবকদের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। নয় মাসে ভারতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা হয় প্রায় এক কোটি যার সত্তর শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। সুতরাং সংবাদ-মাধ্যমকে খোরাক দিতে পাকিস্তান মোটেই কার্পণ্য করেনি। অন্যদিকে জুলাই থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান ছিল অতর্কিত ও প্রায়ই সফল। শরণার্থী কেন্দ্রে এক সময়ে

কলেরার প্রাদুর্ভাব এবং জনগণের দুর্গতি স্বাভাবিকভাবেই সংবাদ-মাধ্যমকে আকৃষ্ট করে।

তৃতীয়ত, এই মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাতিসংঘের মহাসচিব পয়লা এপ্রিলেই মানুষের দুঃখকষ্ট-লাঘবের জন্য ত্রাণ-সাহায্যের প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান এই প্রস্তাবে সাড়া দিলে ৭ জুনে পূর্ব পাকিস্তান ত্রাণ কার্যক্রমের (টঘঊচজঙ) সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এই উদ্যোগ তেমন সাফল্য লাভ করলো না। কিন্তু এতে যে অবকাঠামো তৈরি হয় বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে তাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠে একটি শক্তিশালী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। ২১ ডিসেম্বরে এই উদ্যোগের নাম হয় ঢাকা ত্রাণ কার্যক্রম (টঘজঙউ), যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ত্রাণ কার্যক্রম (টঘজঙই) নাম গ্রহণ করে এবং প্রায় দেড় বছর বহাল থাকে। ১৯ মে ভারত সরকার শরণার্থী-সমস্যা মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য চায়। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (টঘঐঈজ) এ ব্যাপারে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে এবং বিশ্ব খাদ্য কার্যক্রম (ডঋচ) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (টঘওঈঊঋ) সারা বছর সক্রিয় থাকে। ১ আগস্টেই মহাসচিব উ থান্ট বুঝতে পারেন যে, মুক্তিযুদ্ধের ফলে ‘অবস্থা এমনি যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোতে দুষ্টবৃত্তির সৃষ্টি করেছে’ তার মোকাবিলা করা খুবই দুরূহ। মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম ও ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রমের প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে মানবাধিকার সংরক্ষণ, গণহত্যা-প্রতিরোধ, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান – এমনি ধরনের বিষয় যা জাতিসংঘের দায়িত্বে বর্তে তা সামনে এসে দাঁড়ায়। সর্বোপরি আঞ্চলিক শান্তিহানির সম্ভাবনা সবসময়েই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নভেম্বরে তা প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রতিটি বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির সীমাবদ্ধতার কারণে জাতিসংঘ তেমন বলিষ্ঠ ভূমিকাপালনে ব্যর্থ হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও দেশের আগ্রহ জাগিয়ে তোলার জন্য ভারত সরকার শুধু প্রচারণা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের দূত মিশন পাঠায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীও নানা স্থানে সফর করেন। বাংলাদেশও সীমিতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় মিশন পাঠায়। মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহ ও দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাংলাদেশের এইসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ ছিল।

১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে খুব কম রাষ্ট্রই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, পরাশক্তির দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে পারলো না, যদিও প্রায় অর্ধশত সদস্য এই বিষয়ে কোনো না কোনো মন্তব্য করেন। জাতিসংঘের আলোচনায় চারটি দেশের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। লাক্সেমবুর্গের প্রতিনিধি বলেন, ‘যখন আমাদের চোখের সামনে লাখ লাখ লোকের বর্ণনাতীত দুর্দশা দেখতে পাই, যখন দেখি যে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়া তুলে, যখন দেখি যে সভ্যসমাজে যে মৌলিক অধিকার দুর্বলতম জনের জন্যেও স্বীকৃত তা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে যে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার নামে এই ধরনের বর্বরতাকে কি চলতে দেয়া উচিত?’ কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল শার্দ প্রশ্ন করেন, ‘যখন একটি অভ্যন্তরীণ বিবাদ অগণিত দেশকে এত প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলিত করে, তখন তাকে কি আর অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচনা করা সমীচীন?’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক হিউম বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের আস্থা সৃষ্টি হবে এবং তারা স্বদেশে থাকবে, দেশোন্নয়নে মনোনিবেশ করবে।’ অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট রজার্স বলেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়টি পাকিস্তানের জনগণ ও সরকারই মোকাবিলা করবে। শান্তিপূর্ণ অবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংযমের প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ প্রয়োজন।’

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে নির্বিকার থাকে। ৩০ নভেম্বর পাকিস্তান প্রস্তাব করে যে সীমানা-পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হোক। কিন্তু কেউ তা বিবেচনায় আগ্রহী ছিলেন না। পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর মার্কিন উদ্যোগে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদ বিবেচনা করে। ভারতকে নিন্দা করে প্রস্তাব নিতে বলে চীন। আমেরিকা তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি দাবি করে ও ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে এই প্রস্তাব বানচাল এবং পাকিস্তানের বাংলাদেশ দখলে রাখার উদ্যোগ ব্যাহত হলো। ৬ ডিসেম্বর আমেরিকার আরেক   প্রস্তাব সোভিয়েত ভেটোতে নাকচ হলো। যুদ্ধবিরতি নিয়ে কতিপয় সদস্য উৎসাহী ছিলেন কিন্তু সৈন্য-প্রত্যাহারে তাঁদের সমর্থন ছিল না। চীন তার দৃঢ় মতামত থেকে বিচ্যুত না হয়ে এবার ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানালো। আবার ১২ ডিসেম্বরে আরেক মার্কিন প্রস্তাবে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো, ১৩ ডিসেম্বরে পড়লো সোভিয়েতের তৃতীয় ভেটো। জেনারেল ইয়াহিয়া পরাজয়বরণ করলে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি হলো, তবে জাতিসংঘ তাতে কোনো ভূমিকা পালন করলো না। ২১ ডিসেম্বরে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব পাশ করে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগটিকে শক্তিশালী করবার সুযোগ নিল।

বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) জাতিসংঘ থেকে অনেক আশা করেছিল। তারা ১৯৭১ সালের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। এই দলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আর এর সদস্য ছিলেন আরো ষোলজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সংসদ-সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কতিপয় কূটনীতিবিদ। এই দলের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিকারীর সঙ্গে লবি করা এবং জাতিসংঘকে সমস্যা-সমাধানে সক্রিয় করা। তাঁরা পাকিস্তান দূতাবাসের রোষানলে পড়েন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগে তাঁরা নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন। এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরাও সহজে যোগাযোগ করতে দিতেন না। চিলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধরবার জন্য তাঁদের অর্থমন্ত্রী সুপারিশ করলেন। চিলিতে পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ দলের সদস্যও ছিলেন। তথাপি তাঁর সঙ্গে অনেক কষ্টে ও চালাকি করে মোলাকাত পেতে হয়। একমাত্র ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া আর কতিপয় পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো গোপনে অথবা অনেক পানি ঘোলা করে। এই ছিল তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির রূপ। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের দাবি ছিল যে, নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বক্তব্য শুনতে হবে। ১২ ডিসেম্বর সে-রকম এক সম্ভাবনাও ছিল, কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর আপত্তিতে তা টিকলো না। পাকিস্তান জাতিসংঘে একটি ১৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে যাতে প্রথমবারের মতো প্রায় অর্ধেক সদস্য ছিলেন বাঙালি এবং নেতৃত্বও        দেন এক বাঙালি মাহমুদ আলী (বর্তমানে পাকিস্তানে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী)।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ছিলেন এই প্রতিনিধিদলের সদস্য। তাঁদের একমাত্র কাজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তাদের ও রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর তাঁবেদারি। জাতিসংঘ বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধকালে কোনো সংকটেরই মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। মহাসচিবের মর্যাদা ব্যবহার করে সমঝোতার প্রচেষ্টা নিতেও ব্যর্থ হয়। মানবাধিকার রক্ষা, গণহত্যার বিচার, উপনিবেশবাদের অবসান- এইসব তো ছিল সম্পূর্ণভাবে এখতিয়ার-বহির্ভূত- পরাশক্তির বিভেদের ছিল এমনি দাপট। শরণার্থীর বিষয়ে জাতিসংঘ যে অবদান রাখে তার পরিসর ছিল সীমিত। ভারত এই সমস্যা-মোকাবিলায় যে অর্থ ব্যয় করে তার এক-চতুর্থাংশের কম মোট সাড়ে ২১ কোটি ডলার জাতিসংঘের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

পাকিস্তানের সমর্থন আসে মূলত মার্কিন সরকার, চীন সরকার এবং মুসলিম দেশগুলো থেকে। মুসলিম দেশগুলোকে পাকিস্তান বোঝাতে সমর্থ হয় যে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশকে ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং তাতে বাংলাদেশে অমুসলিমরা প্রাধান্য পাবে। মার্কিন সরকার সর্বদাই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থক, অবশ্য    পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধহীন উদ্যোগে তারা ভারতেরও সমর্থক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালে আমেরিকা বাইশ বছরের বৈরিতা পরিহার করে চীনের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নেয় এবং এই উদ্যোগে দূতীয়ালি করে চীনের বন্ধু ও আমেরিকার সহযোগী পাকিস্তান। জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে রাওয়ালপি-ি থেকে পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) গমন করে দুদেশের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। তাই জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানকে নাখোশ করার কোনো প্রচেষ্টাই মার্কিন সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পরবর্তীকালে সম্ভবত তাদের বিবেচনায় সোভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় উদ্যোগকে তারা ব্যর্থ করে দিতে মনস্থ করে। তবে অনেকের মতে নিক্সন-কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবে ভারত এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সহ্য করতে পারতেন না। আমরা দেখবো যে মার্কিননীতি একান্তই কিসিঞ্জার-নিক্সনের নীতি ছিল, তাতে কংগ্রেস, সংবাদ মাধ্যম, শিক্ষা পরিম-ল বা সচেতন জনমতের কোনো দামই ছিল না। চীন পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বন্ধু এবং এই বন্ধুত্বে জনহিত নিয়ে তাদের কোনো ভাবনাই ছিল না। তাই যদিও বাংলাদেশে জনযুদ্ধই সংঘটিত হয় তবু চীন তাতে সমর্থন দিতে বিরত থাকে। তবে চীনে তখন ক্ষমতার লড়াই ছিল তুঙ্গে এবং সে কারণে চীনের পাকিস্তান সমর্থন শুধু কথা ও বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিছু অর্থ সাহায্য ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাকিস্তান চীন থেকে পায়নি। জেনারেল ইয়াহিয়া জান্তার মহাভরসা এবং কিসিঞ্জারের নিশ্চিত বিশ্বাস যে চীন পূর্বাঙ্গনে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলবে তা একান্তই কুসুমস্বপ্নে পরিণত হয়। তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো দুটো। বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা-প্রতিষ্ঠার পর চীন জাতিসংঘে ভেটো প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য হওয়া দুবছর বিলম্বিত করে এবং মুসলিম দেশগুলোর, বিশেষ করে আরবদের, মধ্যে থেকে মাত্র দুটি দেশ ইরাক ও ইয়েমেন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দেয়। চীন এবং সৌদি আরব সেই স্বীকৃতি দান করে ১৯৭৫ সালে।

ব্রিটেন ও আমেরিকার অবস্থান বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। অন্যান্য দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব খুবই কম কথায় সারা যায়। যেসব দেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমতগঠনের সামান্য প্রচেষ্টা চলে, সেগুলো ছিল জাপান, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং কানাডা। নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও (তখন বলতো সিংহল) কিছু আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জাপানে তখন বাঙালির সংখ্যা পঁচিশের কম। তাঁদের কজন এবং শিক্ষাঙ্গনের কতিপয় দিকপাল এপ্রিলের শুরুতেই বাংলাদেশের জন্যে কাজে নামেন। তাঁরা সংবাদপত্রের দপ্তরে ধরনা দেন, রেডক্রসের কাছে আবেদন করেন, ডায়েট সদস্যদের কাছে যান, সরকারের কাছে আবেদন করেন। জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে ১১ এপ্রিলে এবং তার প্রতিনিধি হন অধ্যাপক সুয়শি-নারা, কিন ইচি টাকেনাকা এবং ইয়াসুআকা নারা। বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন শেখ আহমদ জালাল, ইসকন্দর চৌধুরী, আবদুর রহমান প্রমুখ। তাঁরা দিল্লিতে যান সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ সম্মেলনে। তাঁরা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জন্যে যোগাযোগ যন্ত্র পাঠান। তাঁরা রেডক্রসের মাধ্যমে সাহায্য-সহায়তা শরণার্থী কেন্দ্রে পৌঁছে দেন। জাপান-সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ত্রাণসাহায্য প্রদান করে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও রাখেন। জাপানি সংবাদ-মাধ্যম, বিশেষ করে, ইংরেজি পত্রিকা, সারা নয় মাসই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জাপানে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তথ্য সচিব এস এ মাসুদ ও তৃতীয় সচিব কাজী আবদুর রহিম, নভেম্বরের শুরুতে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন।

ইন্দোনেশিয়ায় কতিপয় বাঙালি – কামাল, সানাউল্লাহ, শামসুজ্জামান, সিদ্দিক আহমদ, মেজর আবদুল মতিন ‘আমরা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তাঁরা জনমতগঠনে পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনার আশ্রয় নেন। ইন্দোনেশিয়া সরকারিভাবে পাকিস্তানকেই সমর্থন করে যদিও ভারতকে সংযমের জন্যে উপদেশ দিতে গিয়ে পাকিস্তানকেও সেই উপদেশ বিতরণ করে। ফিলিপাইনসে বাঙালি তেমন ছিলেন না, তবে সেখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং পূর্ব এশিয়ায় তিনিই হন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। ফিলিপাইনস বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নিরাপত্তা প্রদান করে এবং তাঁর প্রচারণা চালাতে সুযোগ দেয়। ফিলিপাইনস প্রকাশ্যে কোনো অবস্থানই ঘোষণা করেনি। সিঙ্গাপুরে অধ্যাপক মাহফুজুল হক একটি সমিতি গড়ে তোলেন। খ্যাতনামা সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ছদ্মনামে বাংলাদেশের সমর্থনে পত্রিকায়-সাময়িকীতে লেখালেখি করেন। সরকারিভাবে সিঙ্গাপুর পাকিস্তানের পক্ষেই অবস্থান নেয়। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। হংকংয়ে অস্থায়ী ট্রেড কমিশনার মহিউদ্দিন আহমদ আগস্টেই বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য পরিবর্তন করেন। হংকংয়ের ব্যবসায়ী মনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব মোটেই ছিল বলে মনে হয় না।

আফ্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ মোটেই দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। বায়াফ্রার ব্যর্থতা তখন সকলের মনেই ছিল বেশ নতুন। আফ্রিকায় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে কতিপয় বাঙালি কর্মকর্তা আনুগত্য পরিবর্তন করেন, যেমন লাগোসে, তিউনিসে অথবা কায়রোতে। তবে তাঁদের সবাইকেই লন্ডনে চলে যেতে হয়। অবশ্য ইরাকে রাষ্ট্্রদূত আবুল ফতেহ আটঘাট বেঁধে কুয়েত হয়ে লন্ডনে এসে ২৯ আগস্টে তাঁর আনুগত্য পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। তিনজন রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের কর্মকর্তার আনুগত্য পরিবর্তন পাকিস্তানের ভাবমূর্তির দারুণ ক্ষতিসাধন করে। ইরাকের পরে হয় ফিলিপাইনসে এবং আরোএকমাস পরে আবদুল মোমিন বুয়েনস আয়ার্স থেকে আনুগত্য পরিবর্তন করে লন্ডনে হাজির হন।

ইউরোপে স্থানীয় মানবাধিকার-কর্মীরা প্রায় সর্বত্র জোরেশোরে মাঠে নামেন। সুইডেনে এক সময়ের বাঙালি কূটনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক একটি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সুইডেনে গেলে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গানার মিরডালের নেতৃত্বে সেখানে অ্যাকশন বাংলাদেশ কমিটি প্রতিষ্ঠা পায়। হল্যান্ডে গবেষক ও লেখিকা ক্রিস্টিন ওয়েস্টগার্ডের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও পশ্চিম জার্মানিতে তেমনি শক্তি সংগঠিত হয়। সুইজারল্যান্ডে নভেম্বরে দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ওয়ালিউর রহমানের আনুগত্য-পরিবর্তন মানবাধিকার-আগ্রহীদের আরো উৎসাহী করে। ফ্রান্সে একটি শক্তিশালী লবি তৈরি হয় এবং সে মাসে তারা বিশ্ব ব্যাংকের     পাকিস্তান কনসোর্টিয়াম সম্মেলনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জোর প্রচার চালিয়ে সাফল্য অর্জন করে। বাংলাদেশে এক সময়ে গবেষণারত থর্নার-যুগল এবং কতিপয় বাঙালি ছাত্র এই সমিতি গড়ে তোলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান মুজিবনগরের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে বিখ্যাত আঁদ্রে মরলো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। এই সব দেশেই বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভ্রমণ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের বাণী পৌঁছে দেন। সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ড জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মন্তব্যকালে ত্রাণ-সাহায্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতি জোর দেয়।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুমঁ ভালো করে বুঝিয়ে দেন যে শরণার্থী সমস্যার একমাত্র সমাধান বাংলাদেশে জনগণের রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা। তিনি বলেন, ‘এই অন্যায়কে যদি মূলে শোধরানো না যায় তাহলে শরণার্থীর স্রোত বন্ধ হবে না।’ ১৪ ডিসেম্বর ফ্রান্স ব্রিটেনের সঙ্গে মিলে নিরাপত্তা পরিষদে একটি    প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বিভক্তি, ভারত-পাকিস্তানের রেষারেষি-হ্রাস এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দেবার জন্য নানা উদ্যোগের কথা হয়। দুর্ভাগ্যবশত মার্কিন একগুঁয়েমির জন্য এইপথে এগুনোই গেল না।

কানাডায় কতিপয় প্রবাসী বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। সেখানে ভারতীয় গোষ্ঠীও বেশ বড় ছিল এবং বাংলাদেশ সম্বন্ধে জ্ঞানীগুণী অনেকে কানাডীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞ-সংস্থায় ছিলেন। কানাডায় এপ্রিলেই মন্ট্রিয়ল, টরোন্টো ও ভানকুভারে বাংলাদেশ সমিতি গঠিত হয়। কানাডার অক্সফাম শরণার্থী কেন্দ্রে ত্রাণকাজে লিপ্ত হয়। কানাডায় প্রথমদিকেই পাকিস্তানি জাহাজের বাঙালি জাহাজিরা জাহাজ ত্যাগ করে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। কানাডীয় পার্লামেন্টের এক সদস্যদল ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত-এলাকা পরিদর্শন করে এবং দুই দেশেই ভ্রমণ করে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিবাচক মন্তব্য করেন, সাংসদ এম পি ব্রুইন বস্তুত একজন বাংলাদেশ লবিস্টে পরিণত হন। আগস্ট মাসে টরোন্টোতে অক্সফামের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা জোর সমর্থন লাভ করে। জাতিসংঘে কানাডীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জোরালো বক্তব্যের বিষয় আগেই বিবৃত হয়েছে।

আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালির কিছুসংখ্যক বৃহত্তর নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বোস্টন, ডেট্রয়েট, ফিলাডেলফিয়া এবং লস এঞ্জেলসে বসবাস করতেন। ছাত্ররা সারাদেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। ভারতীয়রাও বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করতেন। এছাড়া বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক মার্কিন পরিবারের, শিক্ষাঙ্গনে দক্ষিণ-এশিয়ায় আগ্রহী একটি বড় গোষ্ঠী ছিল। এঁরা সবাই একেবারে শুরুতেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জোর প্রচারণা চালান। মার্কিন সংবাদ-মাধ্যমও এ-বিষয়ে ছিল সক্রিয়। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পরেই নিউইয়র্কে পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকাকে তার সদস্যরা ইস্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা নাম দেন। এই সমিতির নেতা কাজী শামসুদ্দিন আহমদ ও ডা. খন্দকার আলমগীর স্বাধীনতার দাবি তোলেন মার্চের আগেই এবং মার্চ মাসে সমিতির নাম দেন বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা আমেরিকায় এর তিরিশটি শাখা প্রতিষ্ঠা পায়। শিকাগোতে ছিলেন বিখ্যাত বাস্তুকলাবিদ ও প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান। তিনি জুনে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ নামে একটি লবি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিক্ষাঙ্গনের দিকপালরা শুরুতেই মার্কিন সরকারের ওপর বাংলাদেশকে সাহায্য করবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ২২ এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি সংবাদপত্রে এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য দাবি তুলে। এতে সাতজন নোবেল লরিয়েট ছাড়াও শত শত শিক্ষক অংশ নেন। নানা সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ইংরেজি ও বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশনার নানা উদ্যোগে হতে থাকে। ডিফেন্স লীগের বাংলাদেশ নিউজলেটার ১৭ মে ১৯৭১-এ প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তার শেষ পাক্ষিক নিবেদন ছিলো ১৯৭২-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ মিশনের সাপ্তাহিক বুলেটিন ৩ সেপ্টেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পরে ১৯৭২ সালে ৫ মে তার শেষ সংখ্যা বের হয়। ফিলাডেলফিয়ায় ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল স্থাপন করেন মযহারুল হক দম্পতি, ড. বিচার্ড কান ও ক্রিপেনডর্ফ দম্পতি প্রমুখ। ভেন্ডারবিলটে মুহাম্মদ ইউনূস এই রকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ডা. উইলিয়াম গ্রিনোর নেতৃত্বে বোস্টন, বাল্টিমোর ও ওয়াশিংটনে কর্মরত বিজ্ঞানী গোষ্ঠী যারা একসময় ঢাকায় কলেরা-গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। এইসব প্রতিষ্ঠান ছিল একদিকে প্রচারে অন্যদিকে অর্থসাহায্যদানে নিবেদিত।

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল ওয়াশিংটনে দূতাবাসের বাঙালিদের প্রচেষ্টায় ২৯ মার্চে ক্যাপিটল হিলে বিক্ষোভ অবস্থান। ১২ জুনে নিউইয়র্কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে র‌্যালি হয় অত্যন্ত সার্থক। ১১ জুলাই বাল্টিমোর হার্বারে হয় একটি নৌ-বিক্ষোভ। জোয়ান বায়েজ, ওস্তাদ আলি আকবর খান, প-িত রবিশঙ্কর প্রমুখ প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনের বিটল দল ও বব ডায়লান একটি কনসার্ট করেন। নভেম্বরে ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে শরণার্থী ক্যাম্পের নকলে ‘সিউয়ার সিটি’ বিক্ষোভ হয়। হার্ভার্ডের অধ্যাপক মেসনসহ জ্ঞানী ব্যক্তিরা বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরে কংগ্রেস ও অন্যান্য মহলে তা প্রচার করেন। নয় মাস সংবাদ-মাধ্যম অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার করে। নানা বিশেষ প্রতিবেদনে টেলিভিশন এই বিষয়ে সোচ্চার থাকে।

সবচেয়ে অনুধাবনীয় বিষয় হলো মার্কিন সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও কংগ্রেসের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। নির্বাহী বিভাগ ছিল  পাকিস্তানের সমর্থনে। কংগ্রেস কিন্তু ছিলো একেবারে উলটো অবস্থানে। ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দুই দলের প্রতিনিধি বা সিনেটররা বাংলাদেশের পক্ষে বলিষ্ঠ মন্তব্য রাখেন এবং নির্বাহী বিভাগকে অনেক উদ্যোগ নিতে বাধ্য করেন, কখনো বিরত করেন। কংগ্রেসে যেসব বিষয়ে নজর দেওয়া হয় তা ছিল পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা ও বন্ধ করার দাবি, পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ বন্ধ করা, শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তহবিল বরাদ্দ করা, বাংলাদেশে নিরপেক্ষভাবে খাদ্য সরবরাহ করা, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করা, শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেওয়া পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যে উদ্যোগ নেওয়া এবং সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া। সিনেটর আর কংগ্রেসম্যানরা ৯ মাসে নেওয়া ১ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৯৮টি বিবৃতি দেন যার মধ্যে মাত্র ১৯টি ছিল নিক্সনের নীতি বা পাকিস্তানের পক্ষে। কংগ্রেসের উদ্যোগেই পাকিস্তানে সবরকম মার্কিন সাহায্য বন্ধের আইন পাশ হয় এবং তাঁদের সাবধানতাই বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এখন জানা যাচ্ছে যে, নির্বাহী বিভাগে বিভিন্ন স্তরে নিক্সন-কিসিঞ্জার নীতি মোটেই গ্রহণীয় ছিল না।

৪ আগস্ট ১৯৭১ সালে আমেরিকায় মোট চোদ্দজন বাঙালি কূটনীতিবিদ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে আরো আটজন এই কাজটি করেন। ৪ আগস্টের সম্মিলিত উদ্যোগের ভূমিকা ছিল অনন্য। সারা বিশ্বে এতে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং পাকিস্তানি দখলের অসারতা প্রমাণিত হয়। পরের দিন ওয়াশিংটনে উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা পায় যার নেতৃত্ব দেন মুজিবনগর থেকে প্রেরিত সাংসদ এম আর সিদ্দিকী। ১৯৭২ এর ৪ এপ্রিলে আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিরা ছিলেন নানা শহরে অবস্থিত। বিলেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন শুরু হয় ষাটের দশকে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতে যদি দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা পায় তবে যুক্তরাজ্যে ছিল তৃতীয় যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে কাকতালীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি আন্দোলনের জন্য একটি বলিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সংবাদ-মাধ্যম ভারত-ব্যতিরেকে অন্য কোথাও এত বলিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। ২৮ মার্চে ট্রাফালগার স্কোয়ারে র‌্যালি ও জনসভা দিয়ে শুরু হয় বিলেতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালিরা এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় একশ কমিটি অফ অ্যাকশন গঠন করেন। ২৪ এপ্রিলে সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় একটি স্টিয়ারিং কমিটি যার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী। ৩ মে প্রকাশিত হয় নিউজলেটার পরে তার নাম হয় বাংলাদেশ নিউজলেটার এবং তার সম্পাদক ছিলেন পাকিস্তানি একজন সমর্থক ফরিদ জাফরি। স্টিয়ারিং কমিটি তাদের বুলেটিন বাংলাদেশ টুডে প্রকাশ করতে থাকে ১ আগস্ট থেকে।

লন্ডনে ছিল নানা জায়গা থেকে সংগৃহীত বাংলাদেশীদের উপস্থিতি। বিলেতে জনতা-ছাত্র-মহিলা সবাই ছিল নানাভাবে সক্রিয় ও নিবেদিত। গউস খান, সুলতান শরীফ, তসাদ্দুক আহমদ, শেখ আবদুল মান্নান, ওয়ালি আশরাফ, লুলু বিলকিস বানু, মুন্নি রহমান, বি এইচ তালুকদার, সাখাওয়াত হোসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী- এমনি অসংখ্য ব্যক্তি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বিলেতের অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী-সংস্থা শরণার্থী-সেবায় ছিল নিবেদিত। জুলাই মাসে অপারেশন ওমেগা নামে এক উদ্যোগ ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুস্থদের ত্রাণকার্যে। গান-বাজনার মাধ্যমেও বাংলাদেশের প্রচার অব্যাহত থাকে। ১৮ সেপ্টেম্বরে ওভালের কনসার্টটি ছিল সুপ্রসিদ্ধ।

বিলেতেও পার্লামেন্ট ছিল সবসময়ে সোচ্চার ও সক্রিয়। ১৪ মে হাউজ অফ কমনসে সর্বসম্মতিক্রমে পাকিস্তানকে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়। ১৮ জুনে ২৫০ জন এমপি পাকিস্তানে অর্থনেতিক সাহায্য স্থগিতের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করেন। টোরি সরকার বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন না করলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রাখে।

ব্রিটেন ও আমেরিকায় বাংলাদেশের জন্য কতিপয় জনপ্রতিনিধি চিরদিনের বন্ধু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁদের অনেকেই যুদ্ধচলাকালে ভারত ও বাংলাদেশ অথবা ভারত ও পাকিস্তান সফরেও যান। বিলেতে এইসব বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন জন স্টোনহাউস, জন এনালস, পিটার শোর, জুডিথ হার্ট, বার্নার্ড ব্রেইন, ব্রুস ডগলাসম্যান, রেজিনাল্ড প্রেন্টিস, আর্থার টেমলি, লর্ড ব্রকওয়ে প্রমুখ। আমেরিকায় এই দলে ছিলেন সিনেটর কেনেডি, সিনেটর চার্চ, সিনেটর স্যাক্সবি, সিনেটর হ্যারিস, সিনেটর ক্লিফোর্ড কেস, সিনেটর ম্যাকগভার্ন, সিটের পার্সি, সিনেটর হোলিংস, কংগ্রেসম্যান গালাগার, কংগ্রেসম্যান হেলস্টোস্ফি, কংগ্রেসম্যান ম্যাকোলস্কি জুনিয়র, কংগ্রেসম্যান হেলপার্ন, কংগ্রেসম্যান ফ্রেজার প্রমুখ।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা ছিল কূটনৈতিক পারদর্শিতার এক অনবদ্য নিদর্শন। শুরুতে তারা পাকিস্তানকে সংকট সমাধানের উপদেশ দিয়ে নিবৃত্ত থাকে। তাদের নানা বক্তব্য-বিবৃতিতে শান্তি-প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের জন্য নসিহত থাকে। জুলাই মাসে জেনারেল ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন যে, তিনি ভারতের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধে প্রস্তুত এবং তার পেছনে শক্তি আছে (ফাইনানসিয়াল টাইমস, ৩০ জুলাই)। এরপরেই সোভিয়েত উদ্বেগ অনেক বেড়ে যায়। ৯ আগস্টে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই বিষয়ে সোভিয়েত উদ্যোগ অনেক পুরনো ছিল তবে ভারতই এতদিন পেছপা ছিল। কিন্তু তারপরও রাশিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। তারা সাবধানে সবসময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি ব্যবহার করে। নভেম্বরে আসে পরিবর্তন। দেখা গেল যে পাকিস্তানের বাংলাদেশ-দলন মনোভাবে কোনো পরিবর্তন নেই, কোনো রকম সমঝোতার প্রচেষ্টা নেই। তখন সোভিয়েত আগ্রহ মোড় ফেরে। তবে ভারতকে সংযমের চূড়ান্ত পরিচয় দিতে রাশিয়া সবসময়ে উদ্বুদ্ধ করে। ৯ ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধবিরতি সমর্থন করে তবে বাধ্যতামূলক সংলাপের অঙ্গীকার ছাড়া যুদ্ধাবসানে অনীহা প্রকাশ করে। তারা সবসময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলাপ চায়। পশ্চিম পাকিস্তানে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা ভারতকে উপদেশ দেয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাদের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না এবং এজন্যেই পরপর তিনবার নিরাপত্তা পরিষদে তারা ভেটো প্রয়োগ করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই মানবতার বিজয়ের একটি মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের মূল উপাদান বাংলাদেশেই ছিল। ভারত ও পাকিস্তানেও ছিল ব্যাপক উপাদান। তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বহির্বিশ্ব এই মহাকাব্যে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাতে প্রধান ভূমিকা রাখে কতিপয় রাষ্ট্র, যেমন, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ব্রিটেন। জাতিসংঘ একটি ভূমিকা রাখতে পারতো তবে পরাশক্তিশাসিত বিশ্বে সেই সুযোগটি দেওয়া হলো না। বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া বর্তমানের মতো না এগোলেও ১৯৭১ সালে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে সশস্ত্র বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেরই উদ্ভব হয়। এজন্যে অবশ্য দাম দিতে হয়েছে অনেক। তিরিশ লক্ষ জীবন, আড়াই লাখ মহিলার মর্যাদা, দেশের সম্পদের প্রায় অর্ধেক স্বাধীন বাংলাদেশে বিধ্বস্ত অর্থনীতি, সহিংস সমাজ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ব্যর্থতা – এমনি ধরনের ত্যাগ ও বঞ্চনা দেশটিকে পোহাতে হয়।

গ্রন্থপঞ্জি :

1| R. Sison & Leo E Rose : War and Secession : Pakistan, India and the Nation of Bangladesh. California University, 1990.

2| Henry Kissinger : White House Years. Little Brown & Company, New York, 1979.

3| Jack Anderson : Andersen Papers. Random House, New York, 1979.

4| Lawrence Liftschuly : Bangladesh : The Unfinished Revolution. Zed Publishers, London, 1979.

5| A.M.A Muhith : American Response to Bangladesh Liberation War. UPL, Dhaka, 1996.

6| Qamruddin Ayi“ : Mission to Washington. United Press Publications, Karachi, 1973.

7| Government of India : Bangladesh Documents. Vol-I-II. Delhi, 1971.

8| Archer K Blood : The Cruel Birth of Bangladesh. UPL, Dhaka, 2002.

9| Bangladesh Mission in UN : Liberation War of Bangladesh and the United Nations. New York, 2000.

10| Roedad Khan : The American Papers. UPL, Dhaka, 1999.

11| W. Norman Brown : The United States and India, Pakistan, Bangladesh. Harvard University, 1973.

12| J A Naik : India; Burma and Bangladesh. S. Chand & CW়., New Delhi, 1972.

13| Sukumar Biswas : Japan and The Emergence of Bangladesh. Agamee Prakashani, Dhaka, 1998.

14| S. A. Jalal : Bangladesh Liberation and Japan. Hakkani Publishers, 2003.

১৫। আবু সাঈদ চৌধুরী : প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯০।

১৬। আবদুল মতিন : স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি। র‌্যাডিক্যাল এশিয়া প্রকাশনী, লন্ডন, ১৯৮৯।

১৭। আবুল মাল আবদুল মুহিত : স্মৃতি অম্লান ’৭১। আগামী, ঢাকা, ১৯৯৬।

১৮। এ. এফ. সালাউদ্দিন, সুক্মার বিশ্বাস এবং অন্যান্য সম্পাদিত : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : নানা প্রসঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা, ১৯৯৬।

১৯। এ. এফ. সালাউদ্দিন আহমদ, মোনায়েম সরকার এবং নুরুল ইসলাম মনজুর সম্পাদিত : বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। আগামী, ঢাকা, ১৯৯৭।

২০। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত : স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ৪, ১৩, ১৪ খ-। বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা, ১৯৮২ ও ১৯৮৫। ২১। মাসুদা ভাট্টি : বৃটিশ দলিলপত্র। জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৩।