বাঁশরি আর ওরা

অর্ণব রায়

সুয্যি উঠে পড়েছে। বাঁশরিও উঠে পড়ে। না উঠে উপায় আছে? ওদের মধ্যে অনেকে সকাল হতে-না-হতেই উঠে পড়ে যে। কেউ-কেউ অবশ্য বেলা দুপুর গড়িয়ে দেয় উঠতে-উঠতে। কেউ আবার উঠে পড়ে, তবে ঘণ্টাদুয়েক যেতে-না-যেতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় আবার। বাঁশরি চেষ্টা করে সারাদিনে অন্তত একবার হলেও সকলের কাছে যেতে, সকলকে দেখা দিতে। শুধু গেলে তো হবে না, কথা বলা, ওদের সঙ্গে কথা বলাটাই তো আসল, তাই না? যেতে কথা বলতে বুঝতে বোঝাতেই বাঁশরির দিন পার হয়ে যায়। নাওয়া-খাওয়ার কথা খেয়ালই থাকে না। তার ওপর পুরনো যে কজন আছে তো আছেই, রোজই নতুন-নতুন এসে দলে জুটছে। সেই তুলনায় ছেড়ে যায় কয়জনা! আর বাঁশরিই কি চায় কেউ ছেড়ে যাক!

ওদের ছোট-ছোট হাত ছোট-ছোট পা। কেউ টলটল করে এটা-ওটা ধরে হাঁটছে তো কেউ এখনো উপুড় হতেই শেখেনি,  বিন্দু-বিন্দু হাত-পা-মুখ আকাশের দিকে তুলে ছুড়তে থাকে। কেউ হামা টানছে। এটা-ওটা তুলে মুখে দিতে শিখেছে কেউ-কেউ। কেউ সবে মেরুদ- সোজা করে বসে কাত করা পৃথিবীটাকে সোজা করে দেখছে। দেখছে আর বলতে চাইছে। অ-অ করে, আধভাঙা শব্দ জুড়ে-জুড়ে, দাঁতহীন মুখে মাড়ি বের করে হেসে, কখনো তারস্বরে কেঁদে চিৎকার করে তাদের কথা বলতে চাইছে। আর বাঁশরি না হলে কে বুঝবে ওদের কথা? কে ওদের সঙ্গে কথা বলবে? কে ওদের বাবা মাদের, দাদু ঠাকুমাদের ধরে-ধরে বোঝাবে, ওদের কোথায় কষ্ট হচ্ছে! কী দেখে ওরা মজা পাচ্ছে! ওরা কী চায়! তাই তো সকাল হতে-হতেই উঠে পড়তে হয় আর তারপর বেরিয়ে পড়তে হয় টাউনের রাস্তায়-রাস্তায়। যেসব বাড়িতে ওরা আছে, সেসব বাড়ির দিকে।

তার আগে অবশ্য বাঁশরিকে সাফসুফ হয়ে নিতে হয়। ওদের কাছে কি আর ঘুম থেকে উঠে-উঠেই পরিষ্কার না হয়ে যাওয়া যায়! বাঁশরি প্রথমেই রাস্তা থেকে দুমুঠো ধুলো তুলে খুব কষে মুখে ঘষে নেয়। দুগালে চিবুকে কপালে। মুখভর্তি কালো দাড়ির সঙ্গে ধুলো মিশে কটা তামাটে করে তোলে। এরপর বাঁশরি একটু শরীরচর্চাও করে। যেমন রাস্তায় গড়াগড়ি, ঘোড়ার গাড়ির পেছনে দৌড়ানো, নেড়িকুকুরদের ধাওয়া করা – এইসব। কোনোদিন ইচ্ছে হলে ঘোষেদের ছোটপুকুরের পাড়ের ঢাল ধরে হড়হড় করে সিলিপ খেয়ে সোজা জলে গিয়ে পড়ে। এসব কসরত করার আগে অবশ্যই সে বাইরে যাওয়ার ভালো পোশাকখানা পরে নেয়। সেই যে পোস্টাপিসের বীরেনদা দিলো না, খাকি জামা প্যান্ট। না-হয় পেছন দিকটা একটু ফেটে গেছে আর বাঁশরি বীরেনদার থেকে লম্বা বলে প্যান্টটা গোড়ালি থেকে আধ বিদ্যা উঠে থাকে, তাতে কি! এর সঙ্গে একটা ধুলো-ধুলো কালো মতন মাফলার মাথায় জড়িয়ে নেয়, ব্যস। তা না হলে ওরা বাঁশরিকে চিনবে কী করে! একে তো ওইটুকু মাথা। সবে-সবে দুনিয়ায় এসেছে। চোখ কান নাক মুখ ফোটেইনি ভালো করে। যা দেখছে যা শুনছে সবই ধোঁয়া-ধোঁয়া। তার ওপর ওইটুকু মাথায় চিন্তা কি কম! আর ওদের চিন্তা মানে তো বাঁশরিরও চিন্তা।

এই যে ইন্দিরাপলিস্নর তপনদার বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া এসেছে যে-লোকটা, ওর বাড়ির নতুন মানুষটার দেড় মাস বয়স হলো। কয়দিন হলো ঘরের ঈশান কোণের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকছে। কী দেখছে, কাকে দেখতে পাচ্ছে, ভয় করছে কি না, সেটা কি আর ওর মা বুঝতে পারবে কোনোদিন! এ তো সদ্য-সদ্য এসেছে এই দুনিয়ায়! বাঁশরিকেই তো ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারল না। কাল অতক্ষণ ধরে কথা হলো তারপরও। আজ আবার যেতে হবে। আবার কথা বলার চেষ্টা করে দেখতে হবে।

কোন দিদি কোন বউদি কোন মাসিমা কখন ওদের কাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে বা খাওয়াতে কি হিসু করাতে কি ভোলাতে বাইরে নিয়ে আসবে তার মোটামুটি একটা হিসাব থাকে বাঁশরির। তাকে তো আর কেউ ডেকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে ওদের খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসতে দেবে না। তাকে যা দেখার যা কথা বলার রাস্তা থেকেই, দূরে দাঁড়িয়েই সারতে হয়। তাতে এমনিতে খুব একটা অসুবিধে নেই। কিন্তু ইদানীং টাউনটা অচেনা মানুষে ভরে যাচ্ছে। নতুন-নতুন ইস্কুল অফিস আদালত খুলছে আর বাইরে থেকে লোক পিলপিল করে চাকরি করতে আসছে, ব্যবসা করতে আসছে। তারা সব পুরনো বাসিন্দার বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে থাকছে। তারপর কয়েক বছর গড়াতে-গড়াতে নিজেরা জমি কিনে বাড়ি করে আবার নিচতলা ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। এই তো সেদিন পর্যন্ত ব্যাপারটা কী ছিল, ওরা যে বাবা মা কাকা কাকিমা দাদু ঠাকুমাদের কোলে চেপে থাকত, তারা সকলে বাঁশরির চেনা। অমুকদা তমুক বৌদি অমুক মাসিমা। ফলে ওদের বাবা-মাদের সঙ্গে কথা বলার আড়ালে ওদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে পারত সে। এখন তো লোকে তাকে দেখলেই ওদের নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়। শুধু ভেতরে চলে যাওয়া নয়, একটু বেশি উৎসাহ দেখালে গালাগাল ঘাড় ধাক্কা এমনকি পিঠের ওপর দুচার ঘা – এসব কি বাঁশরির ওপর দিয়ে বয়ে যায়নি! তা বলে কাজ করতে গিয়ে ওসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে!

এই তো গতকালই, ব্যাংকের পেছনের পাড়ার কাতুপিসিদের বাড়ির নীলুদাকে বোঝাচ্ছিল, ওরে তোর ছেলে বিকেল হলেই তোর সঙ্গে বাইকে চেপে বেরোতে চায় না। শীত পড়ছে তো, ওর কানে ঠান্ডা লাগে। ও তো আর বলতে পারে না। না-না, যতই টুপি মাফলার চাপাও, ফাঁকফোকর দিয়ে হাওয়া ঠিকই ঢোকে। আর বাইকও তো তুমি কিছু আসেত্ম চালাও না বাপু। ওতে ওর ভয় করে। খালি মনে হয়, পিছলে পড়ে যাব। ও প্রাণপণে তোমার হাত দুটো চেপে ধরতে চায়। আর তুমি ভাবো ওর মজা লাগছে। তার চেয়ে বিকেলবেলা করে ছাদে যাও না। অত বড়ো ছাদ তোমাদের। অত অত পায়রা ঘুঘু কাক সব আসে। দুচার দানা গম কি যব ছিটিয়ে দাও, আরো আসবে। ছেলেটাও একটু নিশ্চিন্তে আনন্দ করতে পারবে।

এ সমস্ত বলতে-বলতেই সামনের বাড়ির বউটা ওকে কোলে নিয়ে বাইরে এলো। অন্য লোক হলে বুঝত, নীলু বারান্দায় এসেছে বলেই বুঝি বৌটি বাইরে, কিন্তু বাঁশরি বুঝল, ওর মন খারাপ। ওর মা চাকরি করে তো, ছুটি ফুরিয়ে আসছে। বাবা মাকে কথা বলতে ও শুনেছে। সবটা বোঝেনি। এইটুকু বুঝেছে, মা আর আগের মতো সবসময় ওর কাছে থাকবে না। সারাদিনের অনেকটা তাকে একা-একা থাকতে হবে। মাকে ছাড়া থাকতে হবে। বিছানা ভরা খেলনা নিয়ে, উঠোনে পড়ে থাকা রোদ্দুর নিয়ে, মেঝেতে একটার পেছনে আর একটা সারি দিয়ে চলা পিঁপড়েদের নিয়ে থাকতে হবে। তাই ওর গলার কাছে কী একটা জমে যাচ্ছে পুঁটুলি মতন। ও বুঝতে পারছে না। এরকম তো ওর আগে হয়নি। পেটের ভেতর মোচড় দিয়েছে, মা তার বুকের সঙ্গে ওর মুখটা লাগিয়ে দিয়েছে, পেট ভরে গেছে। তলপেটে চাপ, মা শিস দিয়েছে, ও হিসু করেছে। রাতের বেলা চোখ খুলে গেলে মা, জড়িয়ে আছে, ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলে মা। এখন যদি মা-ই না থাকে সারাদিন, তাহলে ও কী করবে, কী বলবে? কী খাবে? কাকে ডাকবে? তাই ও বাঁশরিকে ডাকছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। দুহাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে।

ভাগ্যিস আজ এ-পাড়ায় এসেছিল বাঁশরি। নইলে তো এর সঙ্গে দেখাই হতো না। বোধহয় এ-পাড়ায় নতুন এসেছে। তাই বাঁশরির কাছে খবর নেই। ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে ভদ্রমহিলা তার
চেহারা-ছবি দেখে ভয়ে দুপা পিছিয়ে যায়। তাই দেখে এ-বাড়ি থেকে নীলু গলা তুলে বলে, ভয় পাবেন না বউদি, ও কিছু করবে না। ও বোবা তো, কথা বলতে পারে না। বাচ্চা-টাচ্চাদের একটু ইয়ে করে আরকি। আপনার কোলে বাচ্চাটাকে দেখেছে, তাই। ওর কাছাকাছি যাবেন না, তাহলেই হবে।

ভদ্রমহিলা আশ্বস্ত হন। বোবা শুনে তার মুখটা একটু করুণায় গলে যাওয়া মতন হল। বাঁশরিও নিজের মুখটাকে যথাসাধ্য করুণ আর হাসি-হাসি করে এগিয়ে গেলো। এবার ওর সঙ্গে জরুরি কথাবার্তা।

বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, কুকুর খরগোশ পাখি হাওয়া দেয়াল বাড়ি গাছ এদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বড়োদের সঙ্গে কথা বলাই হলো না বাঁশরির। তাদের কাছে তাই সে বোবা, তাদের কাছে সে তারকাঁটা, ছিটেল। আর লোকেদের এই ধারণাই তার অস্ত্র। সে যেখানে-সেখানে ঢুকে পড়তে পারে, যা খুশি তাই বলে দিতে পারে। কেউ কিছু মনে করে না।

কেন শহরে কি আর বোবাকালা নেই? না ন্যাকড়া পরে মাথায় জটা গায়ে ময়লা ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো ক্ষ্যাপার কমতি আছে! হালদারপাড়া ঢোকার মুখটায় ওই যে সাইকেলের দোকান চালায় সুবল, ও তো জন্ম থেকে শুনতেও পারে না, বলতেও পারে না। তবু দেখ সদর শহরে গিয়ে কয়েক বছর বোবাকালাদের ইস্কুলে পড়ে হাত পা ঠোঁট নেড়ে কথা বলার ভাষা শিখে এসেছে। সকলের সঙ্গে, মানে সুস্থ সবল বড়ো মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা ব্যবসাপাতি দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। বাঁশরিকেও তো কতবার ধরেপেড়ে শেখাতে চেয়েছে। তা বাঁশরির সময় হলে তো! তার সঙ্গে কথা বলার কত লোক!

শীতের দুপুর ঝিম হয়ে আছে। মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা নিয়ে বাঁশরি এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা সাধারণত এই সময় বাইরে থাকে না। এই হা-হা দুপুরে যারা বাইরে থাকে, তাদের বাপ-মা ওদের নিয়ে ভাবে না। একটু বড়ো দাদা-দিদিদের পিঠে বস্তা ঝুলিয়ে টাউনের দিকে ছেড়ে দেয়। তার সঙ্গে জুড়ে দেয় ওদের। ওরা সারাদিন টাউন ঘুরে-ঘুরে ফেলে দেওয়া পাউডারের কৌটো, ঘোড়ার নাল, পস্নাস্টিক – আরো যা-যা অপ্রয়োজনীয় ও মূল্যবান, তুলে নিয়ে বস্তায় ভরে। বাঁশরি খুব একটা ওদের ধার ঘেঁষে না। ওরা দুপুর হলে কোনো গাছতলায় বসে বিড়ি খায়, এ ওর মাথার উকুন মেরে দেয়, মারপিট করে, খিসিত্ম দেয়। আর কিছু কাজ না পেলে হাঁ করে বোঁদা মেরে বসে থাকে। ওরা বড়ো তাড়াতাড়ি দুনিয়ার খাঁজখোঁচ শিখে নেয়। আরো তাড়াতাড়ি শেখে গাল দিতে। আর যত ছোটই হোক, বাঁশরির কথা ওরা বোঝে না। ওদের দাদা-দিদিদের সঙ্গে মিলে বাঁশরিকে দেখলে সিটি মারে, ঢিল ছোড়ে, পেছন-পেছন তালি মারতে-মারতে ছোটে। বড়োরা প্যান্ট ধরে নামিয়ে দিলে তার উদোম দশা দেখে ওরাও ঠিক বড়োদের মতো, কথা বলতে শিখে যাওয়া লোকদের মতো খ্যা-খ্যা করে হাসে। দৌড়ে পালাতে-পালাতে চারপাশে গোটা দুপুর জুড়ে সে শব্দ শুনতে পায় বাঁশরি।

তার চেয়ে এই ভালো। দত্তদের বাড়ির পেছনের মাঠে একজন কোমরসমান মানুষের সঙ্গে এসেছে একজন হাঁটুসমান মানুষ। সে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে ওরই মতো নতুন পৃথিবীতে আসা একটি ছোট মাপের ছাগলকে। বাঁশরি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে পায় দুজনে দুটো সরু কঞ্চি নিয়ে পা টিপে-টিপে ছাগলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছাগলটাও ঘাস দাঁতে কাটতে-কাটতে চোখ টেরিয়ে ওদের দেখছে আর অপেক্ষা করছে।ওরা আর একটু এগোতেই দিলো তিড়িং করে এক লাফ। হাঁটুসমান মানুষটা চমকে উঠে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে গেল। আর তাই না দেখে ওর  দিদিটা খিলখিল করে হেসে দিলো। ছোটটাও অমনি ‘ভয়’ ‘ভয়’ করে কেঁদে দিলো। কী ই বা আর করবে! কোনোমতে তো এই কয়টামাত্র শব্দ শিখেছে। তাই দিয়ে কি সব বোঝানো যায়! বোঝানো যায় যে তার ভয় হচ্ছে, রাগ হচ্ছে, বড়দের ভাষায় অভিমান হচ্ছে? দিদিটা এত পাজি? আমি পড়ে গেলাম আর ও হাসছে! পাছুতে কী ফুটে গেল, ব্যথা করছে। সব কি বোঝানো যায়?

এই যে কোয়ার্টারপাড়ার পুপু ইঁদুরগুলোকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে কয়দিন হলো, মা কি দাদুন কি বুমবুম সেসব কিছু বুঝতে পারছে? ইঁদুর? ওই যে বড়-বড় ইঁদুরকে বাবা মারতে গেল। অ্যাত্তোবড়ো লেজ, গুলিস্ন-গুলিস্ন চোখ। বাবা যাওয়ার সময় বলে গেল যে। সন্ধেবেলা পুপু গাড়িগুলো নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে যখন খেলছিল। কালো জিপগাড়িটা লাল গাড়িটাকে দুম করে মেরে দিলো আর লাল গাড়িটার ‘আউ’ হয়ে গেল, তখনই তো বাবা ওর সঙ্গে খেলছিল, তখনই তো বাবা ওকে, প্রত্যেকবার যেমন বলে, আসেত্ম করে গোটা-গোটা করে বলল, পুপুসোনা, আমি কিন্তু কাল চলে যাব, তুমি কিন্তু কেঁদো না বাবা। আমি কদিন পরেই আবার চলে আসব। পুপু তখন হলুদ গাড়িটাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিক-ওদিক দেখছে, খাটের তলায় ঝুঁকে দেখছে, বাবার কথা অত খেয়ালই করেনি। খালি ‘চলে যাব’টা ওর কানে গিয়ে লাগে। তবে পুপু তো এখন বড় হচ্ছে, আগের মতো বলে না, যাস না। তাই পুপু বড়দের মতোই বলল, কোঠায় যাবে? তখনই তো বাবা বলল ইঁদুরগুলোর কথা। সেই থেকেই বাবাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে পুপুর। মাকে জিগ্যেস করবে ভাবে, ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে না। এত কথা বাঁশরি কীভাবে জানল যদি না পুপু ওকে বলে থাকে। কত বিকেল যে ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, তা কি আর ওর মা জানে? এই যে বাবা চলে গেলেই ওর মন খারাপ করতে থাকে। সবসময় ও বুঝতেও পারে না। গাড়িগুলো নিয়ে সামনের ছোট বাগানমতনটায় মাটি ঘাঁটা নিয়ে মেতে থাকে। কিন্তু ওর গোল-গোল চোখদুটো তুলে মাঝে-মাঝেই গেটের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে নেয়। বাবা ওটা ঠেলেই আসে যে। পিঠে ব্যাগ, দুহাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে, পুকুল বলে ডাকে। কবে আসবে? বাঁশরি ভাবে, পুপুর মাকে জিগ্যেস করবে। কিন্তু ওর কথা কি পুপুর মা বুঝতে পারবে?

এই সমস্ত ভাবনা-চিন্তায় তার মাথা গরম হয়ে ওঠে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। তার ওপর এবিসিডি অ আ ই ঈ এক দুই তিন চার, ওদের বাচ্চাকাচ্চা, ছোট হাতের এ, ছোট হাতের বি, ১/২  ১/৩ – এদের সারারাত ধরে চেল্লামেলিস্ন, এলাকা দখল নিয়ে ঝগড়াঝাটি মারামারি তো লেগেই আছে। লোকে এদের কালু ভুলু লালু এরকম সব নাম দেয়। পাতের গোড়ার ঝোলমাখা ভাত কাটাকুটি খেতে দেয়। তারপর এদিক-ওদিক লেজ নাড়া দেখে ভাবে, ওরা খুব খুশি। তবে ওদের নিয়ে আদিখ্যেতা করার আরো লোক আছে। তাছাড়া ওরা নিজেরা একটু বড় হতে না হতে দল পাকিয়ে নিজেদের লড়াইটা নিজেরাই শিখে যায় বলে বাঁশরিকে খুব বেশি ভাবতে হয় না ওদের নিয়ে। যত চিন্তা এই মানুষের শাবকদের নিয়ে। জন্মে জন্মে ওরা না পারে দাঁড়াতে না পারে তাকাতে। আরে সোজা হয়ে বসতেই তো কতদিন চলে যায়। মা-বাবা আর কতটুকু বোঝে বাপু! খাওয়ালো হাগালো মোতালো ডাক্তার বদ্যি করল আর ব্যাপার বুদ্ধির বাইরে চলে গেলে ওঝা তান্ত্রিক ঝাড়ফুঁক, মোটা-মোটা তাবিজ-কবজ কোমরের ঘুনসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া। ওতেও যে ওদের ব্যথা লাগে। সেই জন্যেই তো বাঁশরিকে দিন নেই রাত নেই রাস্তায়-রাস্তায় গলিতে-গলিতে পার্কে-মাঠে ঘুরে বেড়াতে হয়, খুঁজে বেড়াতে হয়।

এরকম ঘুরতে-ঘুরতেই হাসপাতালের পেছন দিকটায় এসে পড়ে বাঁশরি। আর সেখানেই ওকে দেখতে পায়। হাসপাতালের পেছন দিকটায় এই হারা উদ্দেশ্যে পড়ে থাকা জমিটা আসলে একটা বেঁটে বেঁটে ঝোপঝাড়ে ভরা মাঠ। মাঝে-মাঝে দু-একটা গোবদা গাছ আর হাঁটুসমান কি কখনো কোমরসমান উইয়ের ঢিবি। সমস্ত কিছু মিটে যাওয়ার পর, ঝড়ঝাপটা সব থেমে সবদিক শান্ত হওয়ার পর মাথাটা চিন্তাভাবনা করার জায়গায় এসে থিতু হলে বাঁশরি সিদ্ধান্তে আসে, সেদিন তাকে হাসপাতালের দিকটায় কিছু একটা টেনে নিয়ে গেছিল। নয়তো ও তো কাঁদছিল না। বা আগে হয়তো কেঁদেছিল। কিন্তু কারোর কি কানে যায়নি? আশপাশে বাড়িঘর সেরকম নেই ঠিকই, তবে লোকে হাগতে-মুততেও তো আসে। তাহলে কি শুনেও না শোনা করে চলে গেছে? ঝামেলায় পড়তে হবে বলে?

বাঁশরিও মুততেই এসেছিল। সন্ধের পর ঘুলি-ঘুলি অন্ধকারে একটু ভেতরের দিকেই এসে পড়েছিল সে। তখনই মুতের ছড়ছড় আওয়াজ শেষ হলে ঝিঁঝির ডাক ব্যাঙের কঁক্কঁক্ বাদে অন্যরকম একটা আওয়াজ পায়। আওয়াজ যতটা না পায়, বুকের ভেতরে টের পায়, ওখানে জ্যান্ত কিছু একটা আছে। সে ওইদিক পানে এগিয়ে যায়।

ওদের অনেককে ওদের বাবা মায়েরা চায় না। তবু ওরা এসে যায়। তখন রাস্তায় ট্রেনে বাসে ভাগাড়ে আঁস্তাকুড়ে ফেলে রেখে যায়। সবচেয়ে বেশি ফেলে রেখে যায় হাসপাতালে আর হাসপাতালের আশপাশে। এরকম বহু ঘটনার কথা বাঁশরি শুনেছে। ছোট থেকে শুনে আসছে। আর আজ এরকম ঘটনা তার পায়ের কাছে শুয়ে। হাত-পা নাড়ছে। বয়স বোধহয় এখনো দিনের হিসাব পেরিয়ে সপ্তাহের হিসাবে ঢুকতে পারেনি। হাসপাতালের মেইন গেটের বাইরে যে সারি দিয়ে জামাকাপড়ের দোকান, সেখানে পাওয়া যায় এরকম উলের মতো দেখতে ছাপছাপ টুপিওয়ালা জামা আর প্যান্ট পরানো। ঘুমোচ্ছে না, কাঁদছে না, তাকিয়ে আছে। কিন্তু এত ছোট আর এত ভয় পেয়েছে যে, বাঁশরির সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলতে পারছে না।

শুনতে অবাক লাগবে কিন্তু গল্প থেকে একটু চোখ তুলে ভেবে দেখলেই বিশ্বাস হবে, এই যে বাঁশরি, এত যে বাচ্চাদের সঙ্গে তার দহরম-মহরম মেলামেশা, এত কথাবার্তা, সব কিন্তু ওই দূর থেকে, বারান্দার নিচ থেকে, গ্রিলের বাইরে থেকে। কে আর সাধ করে নিজের বাচ্চাকে তার কোলে দিতে যাবে! ফলে, এই এত বছরে যদিবা একাবোকা পেয়ে পথচলতি কোনো বাচ্চার মাথায় হাত রেখেছে বা চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়েছে কিংবা খুব সুবিধা হলে কচি হাতটা একটু ধরে কয়েক পা একসঙ্গে হেঁটেছে, কোনো বয়সের কোনো বাচ্চাকেই তার কোলে নেওয়া কি আদর করা হয়ে ওঠেনি। আর সত্যি বলতে কি, খুব যে ইচ্ছে করেছে, তাও নয়। ওরা তো তার বন্ধু। বন্ধু আবার বন্ধুকে কোলে নেয় নাকি কখনো! কোলে তো নেবে বাবা মা কাকা কাকিমা দাদু ঠাকুমা, কোলে তো নেবে বড়রা, তাই না?

কিন্তু আজ এই ছোট্ট মানুষটাকে এরকম জনমানুষছাড়া মাঠের মধ্যে অ্যাত্তোবড় আকাশের তলায় ঘোর হয়ে আসা অন্ধকারের মধ্যে একা শুয়ে থাকতে দেখে তার কী যে হলো, এবার কী করব, কী করা উচিত এরকম ভাবনা আসার আগেই চট করে দুহাতে ওকে তুলে নিল। এত ছোট মানুষকে কীভাবে কোলে নিতে হয় বুঝতে না পেরে জাগরণ ক্লাবের সতুদা ম্যাচ জিতে যেভাবে কাপ ধরেছিল, সেভাবে ধরে থাকে। মাথার ওপর তোলে না। মুখের সামনে ধরে।

প্রথমেই দুহাতের বুড়ো আঙুলের নিচে সে বুকের ধুকপুকি টের পায়। কি দ্রুত চলছে সে ধুকধুক! আর টের পায় গোটা শরীরটা থিরথির থিরথির করে কাঁপছে। অনেক ছোটবেলায় সে একখানা বেড়ালের বাচ্চাকে হাতের মধ্যে নিয়ে এরকম ধুকধুক আর কাঁপুনি টের পেয়েছিল। এ বোধহয় ঘাড় নাড়তেও শেখেনি। তার সঙ্গে যখন কথাও বলতে পারছে না, তখন এ-দুনিয়ার কিছুই রপ্ত হয়নি বোঝা যাচ্ছে। খালি চোখ পিটপিট করতে শিখেছে। চোখ পিটপিট করছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে কে জানে।

পেঁচার ডাক বা কুকুরের চিৎকারের ঝাঁকুনি ছাড়াই বাঁশরির বাস্তববুদ্ধি ফিরে আসে। এ দুনিয়ার রাস্তাঘাটে চরে চরে তারও তো দেখাশুনো কম হলো না! সে খুব ভালোই বুঝতে পারল, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। সে একা কিছুই করতে পারবে না। লোকজনকে খবর দিতে হবে। বড় মানুষদের ডাকতে হবে। এ যদি এখুনি হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে বা বাঁশরি যদি একে কোলে করে এই মাঠের বাইরে লোকজনের মধ্যে যায়, চাইকি এখুনি যদি কেউ এখানে মুততেই আসে আর তাকে এভাবে একখানা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে নির্ঘাত ভাববে হয় বাচ্চা ফেলতে এসেছে অথবা হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি করে পালাচ্ছে। আর তার চেহারাটাও তো খুব একটা সুবিধের নয় কি-না। আর একবার যদি পাবলিক তাকে বাচ্চা চোর বলে ঠাউরে নেয়, তাহলে আর দেখতে হবে না। রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে ‘চোরের মার’ কাকে বলে তা বিস্তর দেখা আছে বাঁশরির। হাসপাতাল চত্বরে কি বাসস্ট্যান্ডে দু-একটা করে হেরোইনখোর সাইকেল চোর কি পকেটমার হামেশাই ধরা পড়ছে।

কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত, এতক্ষণ তো এখানেই ছিল, আর একটুখানি থাকলে কী আর হবে, যাব আর আসব – এরকম ভেবে যেখান থেকে তুলেছিল সেখানেই সাবধানে শুইয়ে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল। সব আগে রাস্তার ওপারে নাড়ুর চায়ের দোকানে আর পাঁচটা লোককে আড্ডা মারতে দেখে সেখানে লাফিয়ে পড়ল এবং সব বোবার মতোই হাত-পা নেড়ে, অঁ-আঁ-অ্যাঁ ইত্যাদি আওয়াজ বের করে হাত তুলে মাঠটার দিকে দেখিয়ে, যাকে সামনে পেল তার হাত ধরে টেনে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল।

এর পরের ঘটনা সরল এবং প্যাঁচালো। তার এই উত্তেজিত মূকাভিনয় দেখে লোকজন ‘কী হলো কী হলো’ বলে তার পেছন-পেছন চলল। টর্চ মোবাইলের আলো এসব নিয়ে ওই মাঠের মধ্যে ঢুকল। তারপর বাচ্চা ফেলে যাওয়া কেস দেখে বেশ কিছু লোক চটপট সরে পড়ল। কে সেধে ঝামেলা ঘাড়ে নিতে যাবে বাবা! কার না কার বাচ্চা। কী জাত কে জানে! তাছাড়া এই বাচ্চা ফেলে যাওয়া তো নতুন কিছু নয়। হামেশাই হচ্ছে। দু-চারজন যারা এখনো বাঁশরিকে চেনে তারা তার এই নাদান লাফালাফিতে বিরক্ত হলো। কেউ-কেউ বলল, আহা কথা বলতে পারে না তো, তাই অমন উত্তেজিত হয়ে গেছে।

আরে বাপু কী যে হবে কী হতে পারে, সে তো জানাই আছে। হাসপাতালে খবর যাবে। ডাক্তার নার্স সুপার সব আসবে। মেটার্নিটি ওয়ার্ডের সব খাতাপত্তর ওলটপালট হবে। খুব খানিক কথাবার্তা বাকবিত-া ভাবনাচিন্তার পর সুপার রায় দেবে, আপাতত একে ওয়ার্ডেই নিয়ে যাওয়া যাক, তারপর খোঁজখবর করে যা হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে। এত ছোট বাচ্চাকে তো আর ফেলে যাওয়া যায় না। আর কোথাও কিছু খোঁজ না পেলে, যার সম্ভাবনাই বেশি, জেলা সদরে হোম তো আছেই। সেখানে খবর দিলেই হলো।

এসব কথাবার্তা লোকজন, ওকে মাটি থেকে তুলে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া, দু-চারজনের এমনকি হাসপাতালের সুপারের ওর পিঠ চাপড়ে দেওয়া, এসবের দিকে বাঁশরির খেয়াল থাকে না। সে সারাক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে যায়। এর মধ্যে ও দুবার কেঁদেছে। একবার এক নার্সের কোলে হিসু করে দিয়েছে। তাতে সবাই হেসে উঠেছে। আঙুল তুলে মুখে পোরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কথা বলেনি। বাঁশরি নানাভাবে চেষ্টা করেছে। নিজের দুকান ধরে বাঁদরলাফ, এর-ওর আড়াল থেকে টুকি দেওয়া। দুহাতের দশ আঙুল দিয়ে কাতুকুতুর ভঙ্গি করা। কিছুতেই কিছু হয় না।

বাঁশরি প্রথমে ভাবল, বোবা নাকি? তারপর মনে হলো, হোক বোবা, সে তো বাইরের পৃথিবীর কাছে। তার সঙ্গেও কথা বলতে পারবে না, এরকম বোবা তো কেউ হয় না। আর তখনই তার মনে ভয় ঢোকে, তাহলে কি সে বোবা হয়ে গেল। পুরোপুরি বোবা! ওই যে পায়ের কাছ থেকে তুলে ওকে দুহাতের মধ্যে নিয়েছিল। বুড়ো আঙুলের নিচে টের পেয়েছিল বুকের ধুকধুক, তার হাতে ছড়িয়ে গেছিল সারা শরীরের থিরথির থিরথির কাঁপা। তখন, তখনই যে দুমুহূর্তের জন্য ইচ্ছে হয়েছিল একে আমার কাছে রেখে দিই। পৃথিবীর সব বড়োর মতো বাবাদের মতো মনে হয়েছিল, বুকের সঙ্গে চেপে ধরি, মাথাটা এলিয়ে থাকুক কাঁধে। দুহাতে জড়িয়ে থাকুক আমার গলা আর আমি তাকে চারদিক থেকে ঘিরে থাকি। সবকিছু থেকে বাঁচাই। আমারই কাছে থাক ও। আমারই কাছে বড় হোক। তাতেই কি, তাতেই কি বাঁশরি আর ওদের সকলের বন্ধু থাকল না? তাতেই কি বাঁশরিও বড় হয়ে গেল? এত বড় যে ওরা তার কথা বুঝতে পারছে না, সেও বুঝতে পারছে না ওদের কথা?

রাত হয়ে গেছে। শীতের রাত। শহর জুড়ে ওরা সবাই যে-যার ঘরের ভেতরে আরো ভেতরে ঢুকে গেছে। কাকে পাবে এখন বাঁশরি? কার কাছে যাবে? একটা হলেও কথা বলতে পাবে? কথা শুনতে পাবে? কে বাইরে আছে? বাবার সঙ্গে মায়ের সঙ্গে কাকা দাদু ঠাকুমা কারোর সঙ্গে। কেউ একজন! কেউ?

বাঁশরি শহরের রাস্তায়-রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। r