প্রণবরঞ্জন রায়
এক-এক ভূখন্ডের মানুষজনের জীবনে কিছু কিছু সন্ধিক্ষণ আসে। সে-সব সন্ধিক্ষণে অবস্থার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের কিছু অভূতপূর্ব সমস্যা তৈরি হয়, কিছু সম্ভাবনাও। সে-সব কিছু ক্ষণজন্মা শিল্পীর উত্থানের পথ প্রশস্ত করে। তাঁদের শিল্পে ওই সন্ধিক্ষণে মানুষের দুঃখ-বেদনা, সুখ-আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা-নিরাশা, বিপন্নতা-স্বস্তিবোধ একটা সংহত চেহারা পায়। আর তাঁদের শিল্প যে-কাজটা করে তা হলো – দেশকালের বিশিষ্ট সন্ধিক্ষণজাত মানবিক অভিজ্ঞতার ও অভিজ্ঞতাজাত চেতনার একটা দেশকালোত্তীর্ণ সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি। যে-শিল্পস্রষ্টা (তাঁর শিল্প গ্রিক পুরাণ-বর্ণিত নটি শিল্পের যেকোনোটিই হতে পারে), তাঁর সৃষ্টিতে সাফল্যের সঙ্গে এ-কাজটা করেন, তিনিই সে-ভূখন্ডের সর্জন-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ বলে বিবেচিত হন। কালধারায়, তিনি প্রথম ব্যক্তি হোন বা না-ই হোন। চসার অ্যাংলো-স্যাকসন মানবগোষ্ঠীর লিখিত ভাষার প্রথম শিল্পী হতে পারেন। পন্ডিত কবি মিলটনের শিল্পচাতুর্য অতুলনীয় হতে পারে। কিন্তু সমকালীন অবস্থার ঘাত-প্রতিঘাতে আবর্তিত মানুষের ভাগ্য হেরফেরে মানুষের কৃতকর্মের ফলাফল ও মনোবিকলন বিষয়ে দেশকালোত্তীর্ণ আবেদন সৃষ্টি-পারঙ্গমতার কারণে শেক্সপিয়র অ্যাংলো-স্যাকসন জাতি-উদ্ভূত ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আগেও ছিলেন জোত্তো। কিন্তু তাঁর ভুয়োদর্শনের সঙ্গে ছিল দৃশ্যভাষাতাত্ত্বিক পিছুটান। ছিলেন অনুজ সমসাময়িক মিকেলেঞ্জেলো ব্যুয়োনারোত্তি, যাঁর ভাবনায় ইহজাগতিক শক্তিধর মানুষও ঐশীশক্তির ক্ষমতায় পরাভূত। রেনেসাঁস মূল্যবোধের সর্বোত্তম প্রকাশের কারণে তাই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ইউরোপীয় প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠ শিল্পী। এতশত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য। শিল্পকলা – তা সংগীত, নৃত্য, নাট্যাভিনয়নির্ভর অথবা দৃশ্যকলানির্ভর চিত্র-ভাস্কর্য, স্থাপত্য এবং সিনেমা, যা হোক না কেন – তখনই এক ভূখন্ডীয় মানবসমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক বলে বিবেচিত হতে পারে – যখন একজন স্রষ্টার সৃষ্টিমূলে থাকে সমকালীন মানুষের জাগতিক অভিজ্ঞতালব্ধ দুঃখ-বেদনা, সুখ-আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা-নিরাশা, বিপন্নতা-স্বস্তিবোধ সম্পর্কে একটা সংহত ধারণা। যখন শিল্পী-অভিজ্ঞতায় সাধারণের এসব বোধ ওই সংহত ধারণা সৃষ্টির সহায়তা করে আর সৃষ্টির প্রেরণা জোগায়। শিল্পবস্ত্ত নির্মাণকৌশল, নির্মাণদক্ষতা, প্রয়োজনীয় শুধু শিল্পভাষা নির্মাণের উপায় হিসেবে। যে-উপায়ে স্রষ্টার ধারণাকে উপভোক্তার কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভবেদ্য করে পৌঁছে দেওয়া যায়। শিল্পীর অভিজ্ঞতাজাত ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতার দেশ-কালজ সার্বিকতা, একজন শিল্পীর ভূখন্ডের মানবসমাজের প্রতিভূ বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য নির্মাণচাতুর্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সত্তা সৃষ্টির আগে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন পূর্বাংশে যে-বাঙালিরা বাস করতেন, তাঁরা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠী বলেই বিবেচনা করতেন। তার আগেও ছিলেন ব্রিটিশশাসিত ভারতের পূর্বের এক প্রদেশের বাংলা ভাষাভাষী প্রজারা। তাঁদের মধ্যে ছিল সনাতনী পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম-দেশজ-লোকজ ধর্ম আর ইসলাম ধর্মের বিভাজন। ব্যক্তিচেতনায় এ-বিভাজনের তারতম্য ঘটত। ব্যবহারিক জীবনেও তার প্রভাব দেখা যেত। কৃষি ও মৎস্যজীবী-প্রধান পূর্ব বাংলার প্রাক্তন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কৃষি অর্থব্যবস্থানির্ভর সচ্ছল পরিবারের যে কিশোর স্কুলের শিক্ষা শেষে কলকাতার সরকারি চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশী করতে এসেছিলেন, তাঁর পরিবার যে বাংলার পূর্ব-পশ্চিম মুসলমান-হিন্দু বিভাজন সক্রিয়ভাবে মানতেন বা চিত্রকলা শিক্ষাকে উদ্ভট বলে মনে করতেন, এমনটা মনে হয় না। অর্থাৎ অনেক পরিবারের মতোই পূর্ব বাংলার এ-পরিবারটির চেতনায় ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভাজন ততটা গুরুত্ব পেত না। এবং পরিবারভুক্ত ব্যক্তিদের নিজ অভিরুচি অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করার স্বাধীনতা ছিল। এমনই এক রাষ্ট্রীয় সামাজিক-পারিবারিক অবস্থা থেকে প্রাক্তন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা থেকে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে কলকাতার সরকারি চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ের পাঠ সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে, ক্রমে ওই বিদ্যালয়েই কৃতী শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন।
কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষাদীক্ষার ভিতটা তৈরি হয়েছিল ঊনবিংশ শতকীয় ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক সাউথ কেনসিংটনীয় স্কুলের আদর্শে, উপনিবেশের প্রয়োজন মনে রেখে। মানুষের সর্জন-প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করার জন্য নয়। দৃশ্যমান বহির্জগতে যা চর্মচক্ষে দেখা যায়, কাগজ অথবা কাপড় কিংবা বোর্ডের পটে, পেনসিল কলম কাঠকয়লা অথবা জলরং তুলি কিংবা তেলরং তুলি দিয়ে তারই এক বিভ্রমাত্মক বিবরণ উপস্থাপন চাক্ষুষ করে তোলা এ শিক্ষাদীক্ষায় শ্রেয় ছিল। ব্রিটিশশাসিত বাংলার শিক্ষা দফতরের পুরনো নথিতে দেখা যায়, ওই শিক্ষার অন্যতম মূল শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে ‘ড্রইং ইন লাইট অ্যান্ড শেড’ (ড্রইং উইথ লাইন নয়) কতটা গুরুত্ব পেত। বস্ত্তবিম্ব গঠনে সীমা বা সংজ্ঞা রেখাকে হতে হতো এক উৎস থেকে আসা আলোয় দেখা বস্ত্তসীমার অনুরূপ, আর বস্ত্তর ঘনত্বের বিভ্রম দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলা হতো বস্ত্ত-শরীরে ওই উৎস থেকে আসা আলোর আর ছায়ার তারতম্য সম্পাদন করে। চিত্রপটে এ-নিয়মে আঁকা বিম্বের সমাহার ঘটানো হতো এমন করে যাতে সেই ন্যাস জগৎ-সম্ভব কোনো ঘটনা বা অবস্থার বিবরণ দেয়। এ-শিল্পাদর্শে রচিত ছবির গুণাগুণ ও রচয়িতার দক্ষতা বিচার সহজ। হয়তো শিল্পমূল্য বিচার নয়। দক্ষতাগুণে মফস্বল-আগত জয়নুল আবেদিন তাঁর পঁচিশ বছর বয়সকালের আগেই হয়ে উঠেছিলেন কৃতী শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মানুষ ছিলেন না জয়নুল, জলরঙে ছবিও আঁকতেন। কখনো-সখনো তেলরঙেও। গ্রামীণ জীবন ছিল তাঁর বিষয়বস্ত্ত। সেসব দৃশ্য রচনাতেও নিসর্গের চেয়ে সকর্মক নারী-পুরুষের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার কাজ প্রাধান্য পেত। নেহাতই বিবরণাত্মক ছিল না সে-সব ছবি। বিবরণ ছাপিয়েও সময়ে সময়ে ঘটনা-বর্ণনার একটা প্রবণতা, একটা দৃশ্যকাহিনি গড়ে তোলার চেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে উঠত। কিন্তু সবটাই হতো কলকাতা আর্ট স্কুলীয় শিল্পাদর্শের মধ্যে। তথাকথিত ন্যাচারালিস্টিক-রিয়ালিস্টিক ধাঁচে।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত-রচয়িতা সলিল চৌধুরী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে-রচনা দিয়ে, সেই ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা’ ছিল ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তরবিষয়ক। সেই দীর্ঘ বর্ণনাত্মক প্রবন্ধ-সংগীত (ভারতীয় সংগীততত্ত্বে কাব্যসংগীতকে এই নামেই চিহ্নিত করা হয়েছে), মন্বন্তরপূর্ব একান্ত এক গ্রামীণ জনজীবনের ছবি আঁকার পরই, অচিন্ত্যপূর্ব বিপর্যয় বহনকারী দুর্ভিক্ষের দারুণ আঘাতে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তটিকে তুলনাবিহীন কথায়-সুরে অভিব্যক্তি দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। সেই মুহূর্তের আগের আর পরের বাংলা আলাদা। সেই সন্ধিমুহূর্তটি ব্যক্তি জয়নুল আবেদিনের জীবনেরও সন্ধি-মুহূর্ত। শহরের রাস্তায় গ্রাম থেকে শরণার্থী হয়ে আসা নিরন্ন কৃষিজীবীর মৃত্যুপথযাত্রার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা, কলকাতার সরকারি চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ের ছাবিবশ বছর বয়সী কৃতী কলাশিক্ষককে বিবেকী শিল্পীতে পরিণত করল। তাঁর পূর্বতন শিল্পাভ্যাসের আদ্যন্ত পরিবর্তন ঘটল, জাগতিক অভিজ্ঞতার আঘাতে। অভিজ্ঞতার এ-আঘাত তাঁকে মরমি জীবন-শিল্পীতে পরিণত করল। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার গ্রামীণ সমাজের এক নিদারুণ সন্ধিক্ষণের মরমি রূপকার হিসেবে জয়নুল হয়ে উঠলেন বিপন্ন বাংলার জীবনের রূপকার। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক গবেষকদের গবেষণার ফলে আজ আমরা জানি, ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তর বিদেশি শাসকের ঔদাসীন্য-অবহেলা-অপশাসনে ভয়াবহ আকার গ্রহণ করলেও তার বীজ ইংরেজশাসিত বাংলার ভূমি সম্পর্ক ও কৃষিকেন্দ্রিক আর্থব্যবস্থার মধ্যে ওতপ্রোত ছিল। এই ভূমিভিত্তিক ও কৃষি উৎপাদননির্ভর মানব-সম্পর্কই যে মূলত বাংলার মানুষকে হাসিয়েছে-কাঁদিয়েছে, মন্বন্তর সে-সত্যটাকে জয়নুল আবেদিন, রামকিঙ্কর বেজ, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোরের মতো দৃশ্যশিল্পী; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক-কবি; বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্রের মতো নাট্যশিল্পী এবং সলিল চৌধুরীর মতো সংগীতকারের সৃষ্টিতে উদ্ঘাটিত হয়ে তাঁদের বাংলার বিবেকি সর্জন-প্রতিভার প্রতিভূতে পরিণত করে। এঁদের মধ্যেও আবার জয়নুল আবেদিনের কাজ সবচেয়ে তাৎক্ষণিক হওয়ার কারণে ছিল সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়াঋদ্ধ। সবচেয়ে বহুপ্রজ তিনি তো ছিলেনই। ১৯৪৩-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে ১৯৪৪-এর শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কলকাতার দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়, কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ এবং পিপলস ওয়রে আবেদিন সাহেবের দুর্ভিক্ষ-প্রপীড়িত নর-নারী-শিশু আর সঙ্গী কুকুর-কাকের স্কেচের প্রতিলিপি ছাপা হয়েছে।
দেখা দরকার, ইংরেজ-প্রবর্তিত প্রাতিষ্ঠানিক কলাবিদ্যা শিক্ষক মহাশয় কীভাবে বাংলার বিবেকি আধুনিক শিল্পীতে পরিণত হলেন। এ-ব্যাপারে তাঁর শিল্পের সাক্ষ্য কী? ছবির বিষয়ের বা বিষয়বস্ত্তর পরিবর্তনটা তো প্রাথমিক। শান্ত-স্নিগ্ধ পল্লীজীবন, কৃষিকর্মকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন – এই তো ছিল প্রাক-মন্বন্তর আবেদিনের ছবির বিষয়। ছবি ছিল বিবরণধর্মী। বিশদে ভরপুর। তার বদলে দেখলাম – স্বল্পতম মলিন ছিন্ন বসনে অস্থিচর্মসার হতোদ্যম নারী-পুরুষ-শিশু। নিরাভরণ পটে স্বল্পতম বিম্ববিন্যাসে শহরের পথ-আশ্রিত নিরন্ন ক্ষুধার্ত গ্রাম থেকে আসা শরণার্থীর মৃত্যু-অপেক্ষার দৃশ্যের পরে দৃশ্য। বিবরণ বিশদহীন। ন্যূনতম সরলরেখার টানে শহরের বাড়ির অংশ, ফুটপাত-ক্যারেজওয়ে বিভাজন আর প্রতীকী ডাস্টবিন দিয়ে শহর আভাসিত মাত্র। আর কোনো স্থানবিবরণী পশ্চাৎপট নেই। নেই কোনো বিশদ প্রেক্ষাপট। শীর্ণকায় কুকুর আর কাক একদা অন্নদাতাদের সঙ্গে ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে উদ্যত। সযত্নে ন্যূনতম অর্থপূর্ণ বিম্ব নির্মাণ এবং প্রেক্ষাপটহীন দ্বিমাত্রিক চিত্রপট-পৃষ্ঠে তাদের প্রক্ষেপণ নিবিষ্ট দর্শককে ছবির বিষয়বস্ত্ত নিয়ে অল্পই ভাবায়। দুর্ভিক্ষ ঘটনাটি কারক মাত্র। সেই কারকের কারণে অসহায় মানুষের দুর্দশা, অবলম্বনহীনের মৃত্যুপথযাত্রাই আসল অনুভবের বিষয়। মন্বন্তর নয়। এ-অভিজ্ঞতায় আহত শিল্পীর মরমি বিবেকের আর্তিই ছবির আদত বিষয়বস্ত্ত। মন্বন্তর নামক নৈর্ব্যক্তিক অবস্থাসৃষ্ট ব্যক্তিগত বোধের অভিব্যক্তিই আবেদিনের মন্বন্তরের ছবির গূঢ় বিষয়বস্ত্ত। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, জয়নুলের বিষয় আপন মানুষের দুর্দশায় অসহায় মরমি মনের আর্তি।
মরমি বিবেকের আর্তি দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য, দেখলাম, আবেদিন ছবিকে বিশদের ভারমুক্ত করে, বিম্বকে তাৎপর্যপূর্ণ করে উপস্থাপনে মন দিলেন – দুভাবে। এক, শারীরিক অবস্থা ও দেহজ বিভঙ্গ ও ভঙ্গিমাকে ন্যূনতম উপায়ে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে, আর দুই, শুধু অর্থময় বিম্ব আর বিম্বাংশকে মূল বিম্ব-পার্শ্বে সংস্থাপন করে।
তবে, মরমি বিবেকের আর্তি তাৎপর্যপূর্ণভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য জয়নুল আবেদিন তাঁর সৃষ্টির দৃশ্যভাষাগত যে-পরিবর্তন ঘটালেন তাতেই তাঁর সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তব-বিভ্রম সৃষ্টিকারী কলাধারার সম্পর্ক ছিন্ন হলো। তিনি এমন এক শিল্পভাষা গ্রহণ করলেন যে-দৃশ্যভাষায় শিল্পী ব্যক্তি বাস্তব সম্বন্ধে তাঁর নিজ প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তি দিতে পারেন। রেখা, রেখাঙ্কন প্রক্রিয়া, রেখার চরিত্র আর চিত্রক্ষেত্রে রেখা প্রক্ষেপণ হলো তাঁর মূল উপায়। আলোছায়ানির্ভর ত্রিমাত্রিক প্রেক্ষিত, আর তার সঙ্গে বিম্বের ঘনত্ব সম্পাদন অহেতুক বলে বর্জিত হলো। বিম্বের সীমা বা সংজ্ঞা রেখা ছবিতে তার বাস্তব বিভ্রমকালীন ভূমিকা হারিয়ে তার নিজ চারিত্র্যে অভিব্যক্তি সঞ্চারের ক্ষমতা অর্জন করল। এই ক্ষমতায়নের কারণে বিম্বের সীমারেখা বিম্বকে বিবৃত করার বদলে ধারণা-চিহ্নিত করার কাজে নিয়োজিত হলো। বিম্ব বিশেষ থেকে নির্বিশেষে পরিণত হলো। এসব নির্বিশেষ বিম্ব সমন্বয়ে বর্ণিত অবস্থার শিল্পীমনোজাগতিক প্রতিক্রিয়া দৃশ্য-ইঙ্গিতে ব্যক্ত করার জন্য আবেদিন যে-ধরনের রেখা ব্যবহার করলেন তাকে বলা হয় জেসচারাল লাইন বা ভঙ্গিমাময় রেখা। রেখাঙ্কনের প্রক্রিয়ায় ছবিতে শিল্পীর মানসিকতা অভিব্যক্তি পায়। আবেদিনের রেখা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ঋজু ধাক্কার তির্যক রেখা। চলিষ্ণু রেখা। এ-ধরনের রেখার সাহায্যে আবেদিন কিছু নির্বাচিত বিম্বাংশ অতিরঞ্জিত করে তাৎপর্যময় করে উপস্থাপন করার পদ্ধতি নির্মাণ করলেন, তা তাঁর একান্তই আপন হওয়া সত্ত্বেও নজিরবিহীন ছিল না। মানুষের দুর্দশায় তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াকে অভিব্যক্তি দিতে, তিনি নিজের প্রয়োজনেই এই ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ দৃশ্যভাষাতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছিলেন। ফলে তাঁর এক্সপ্রেশনিস্ট ভাষারীতি গ্রহণ ছিল একান্তভাবে প্রাসঙ্গিক।
পরিবর্তিত আবেদিনের ছবির আরো একটি দৃশ্যভাষাতাত্ত্বিক দিক অত্যন্ত তাৎপর্যময়। এটি বিম্ব নির্মাণগত বা semantic নয়। এটি বিন্যাসগত বা syntactic। ওঁর ছবির ন্যাস সম্বন্ধে তো আগেই বলা হয়েছে যে, তা নির্বাচিত বিম্বের আর গৌণ বিম্বাংশের পাশাপাশি অবস্থানভিত্তিক। অন্য তাৎপর্যপূর্ণ ন্যাস-পদ্ধতিটি এরকম : বিম্ব-নির্মাণে তির্যক (diagonal) ঋজু টানের (stroke) ব্যবহারে আবেদিন তাঁর ছবির শ্লথ-ভঙ্গিমাময় মানবী-বিম্বেও এক ধরনের গতিময়তা সঞ্চার করেন। অধঃপতিত দুর্দশা থেকে উত্তরণ ইচ্ছা (ছবিতে বর্ণিত চরিত্রাবলির না হলেও তা যেন শিল্পীরই সুপ্ত ইচ্ছার এক সংগোপন অভিব্যক্তি)। আবেদিনের মন্বন্তরকালীন ছবিতে শুধু নয়, ১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে আহত আর নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী দেশবাসীর দুর্দশার অভিজ্ঞতায় করুণা-উদ্বেল আবেদিনের ‘মনপুরা’ সিরিজের ছবিতেও আবার সেই তির্যক (diagonal) গতি-ছন্দের ন্যাসে সুপ্ত উত্তরণ-ইচ্ছারই এক প্রকাশ দেখি। এটা কোনো facile আশাবাদ নয়। এটা হয়তো মানুষের শ্রেয়োচিন্তার এক বিশিষ্ট প্রকাশ। কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ, যে-মানুষ রাজনৈতিক বিভাজনোর্ধ্ব বাংলার অন্নদাতা, আবার যে-বাংলার মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সহায়তাবিহীন অসহায় প্রজা, সকলের দুর্দশায় সমব্যথী হওয়ার অভিব্যক্তি, কালোত্তীর্ণ আবেদনমন্ডিত করার পারঙ্গমতার কারণে… আর তারই সঙ্গে দুর্দশা থেকে উত্তরণের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে অনুচ্চার দৃশ্যভাষা দেওয়ার কারণে, জয়নুল আবেদিনকে আমার শুধুই শিল্পাচার্য বলতে দ্বিধা হয়। তিনি তো নির্বিশেষ আচার্য। শুধুই আচার্য। যার সারা জীবনের চর্চা আর মনন, যাঁর চর্যার বিচার, বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্যতা, প্রেরণা পরবর্তী প্রজন্মের চর্চার বিষয় হওয়া বিধেয়।
প্রথা ভাঙার প্রেরণার যথেষ্ট কারণ প্রয়োজন। অন্য প্রথা আত্তীকরণের সপক্ষে সাযুজ্যের যুক্তি থাকা প্রয়োজন। আত্তীকৃৎ পদ্ধতি প্রকরণের প্রাসঙ্গিকতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের শ্রেয়ো-সম্পর্কিত ধারণা, আর তার সঙ্গে সে-বার্তা মানুষের বোধগম্য দৃশ্যভাষায় বাঙ্ময় করার তাগিদই জয়নুল আবেদিনকে বাংলার মানুষের শিল্প-বিবেকের মর্যাদা দেয় এবং চিরকাল দেবে।
দেশ-ভাগোত্তর পূর্ববাংলায় দৃশ্যশিল্পকলা কর্মকান্ড সংগঠনে আর কলাশিক্ষা প্রসারে আবেদিন সাহেবের ভূমিকা বাংলাদেশে এতই সর্বজনস্বীকৃত যে, তা নিয়ে কোনো পুনর্বিবেচনার প্রশ্নই ওঠে না। সে সুবাদেই তাঁর শিল্পাচার্য পরিচিতি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.