বাংলা কবিতার ইতিহাসে নতুন যাত্রা

আজির হাসিব
কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক
বেঙ্গল পাবলিকেশন্স
ঢাকা, ২০১৯
২৮০ টাকা

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক সুরেশ রঞ্জন বসাক সংকলিত-সম্পাদিত ও অনূদিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প : কবি অ-কবি প্রত্যক্ষদর্শী ও পরোক্ষদর্শীদের কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশক : আবুল খায়ের। প্রকাশিত হয়েছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা থেকে। প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা।
সুরেশ রঞ্জন বসাক একজন নিষ্ঠাবান গবেষক-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক – অনেক অভিধায় তাঁকে অভিষিক্ত করা হলেও এখনকার আলোচ্য প্রসঙ্গ অনুবাদক সুরেশ রঞ্জন বসাক এবং তাঁর অনুবাদকর্ম কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থ। যাঁরা অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার নিরন্তর প্রয়াস দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে সুরেশ রঞ্জন বসাক তাঁদের একজন।
আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে স্বীকার বা অস্বীকার করে হলেও তিরিশি আধুনিকতাবাদী কবিতার ধারা বাংলা কবিতাকে নতুন সময় ও সম্ভাবনার দিকে ধাবিত করেছিল। এরপরও বৈশ্বিক নানা ঘটনা পৃথিবীর নানান দেশের মানচিত্রে যেমন অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, তেমনি কবিতার শরীরেও যুক্ত হয়েছে এসকল ঐতিহাসিক-ট্র্যাজিক ও মিথিক নানা ঘটনার আঁচড়। তাই কবিতাও নানা সময়ে নিজের রং-রূপ বা সুর-স্বর পালটেছে। আর কবিতার এই ইতিহাস আলোচনায় যুক্ত হলেই দুটি ঘটনা যুক্ত হয়ে যায় অনায়াসে; ঘটনাদুটো হলো গত শতকের দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, বোমা-বারুদ-বন্দুকের ভয়াল হুংকার কিংবা ঘৃণ্য পাশবিকতা। বাস্ত্তহারা মানুষের আর্তনাদ, নারীধর্ষণ আর গণহত্যার বীভৎস রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এ দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো বিভিন্ন দেশের কবিতার সুর ও স্বরের যে-পরিবর্তন ঘটেছে তা তো নিরেট সত্য বিষয়। এমনকি বাংলাদেশের কবিতায়ও যুক্ত হয়েছে বাঁকবদলের নান্দনিকতা। শুধু কি কবিতায়, নন্দনচর্চার প্রতিটি স্বরভাষায় একরকম বাঁকবদল এনেছিল দুটি বিশ্বযুদ্ধ।
সুরেশ রঞ্জন বসাক তাঁর অনূদিত-সম্পাদিত ও সংকলিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থটিকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করে কবিতাগুলোকে মলাটবদ্ধ করেছেন। ভূমিকায় গ্রন্থটির অনুবাদ প্রসঙ্গে সম্পাদক-অনুবাদক নিজে একটি অসাধারণ ভূমিকা টেনেছেন। ভূমিকা ও অনূদিত কবিতার পরম্পরার মধ্যে লুকিয়ে আছে হলোকস্টের বীভৎসতা এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কবিতার বহুমাত্রিক সুর ও স্বরের ইঙ্গিতভাষ্য। গ্রন্থটির নামকরণের উপশিরোনামে যুক্ত হয়েছে কবিতাগুলো ‘কবি অ-কবি প্রত্যক্ষদর্শী ও পরোক্ষদর্শীদের কবিতা’। কবিতাগুলো যুদ্ধকালীন কঠিন সময়ে মৃত্যুপথযাত্রীদের রচিত কবিতা। মৃত্যুর পূর্বের অনুভূতি। মূলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী দ্বারা জার্মানিতে ও ইউরোপের বিভিন্ন ক্যাম্পে যুদ্ধবন্দিদের ওপর ভয়ংকর নৃশংসতা চালানো হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ বেঁচেও গিয়েছিলেন এবং নিজের জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন কবিতা লিখে, চিরকুট লিখে। আবার অনেকেই ক্যাম্পের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আর কোনোদিন বের হতে পারেননি। এসব বন্দির ওপর নানারকম কঠিন পরীক্ষণও চালানো হয়েছিল। নানা পৈশাচিকতার উন্মাদনায় তাদের হত্যা করা হয়েছিল। নারীর ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের মতো অহরহ ঘটনা তো রয়েছেই। এরকম বীভৎস পরিস্থিতির মুখোমুখি মৃত্যুপথযাত্রীরা মৃত্যুর ঠিক আগে যা লিখেছেন তা-ই কবিতা হয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মলাটবদ্ধ হয়েছে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত করে সম্পাদনা করেছেন সুরেশ রঞ্জন বসাক। পর্বগুলো হচ্ছে নিধন পর্ব, সাক্ষ্য পর্ব, শোক পর্ব। নিধনপর্ব সম্পর্কে সম্পাদকের অভিমত :
‘নিধন পর্বে উঠে এসেছে মৃত জীবিত কবিদের লেখায় ধ্বংসযজ্ঞের কবিতাচিত্র। […] ইতিহাস যতভাবে ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করে, কবিতাও তা-ই করে। আমাদের চাক্ষুষ হয় ট্রাকে-ট্রেনে-ভ্যানে নিয়ে আসা ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ, পরিধেয় খুলে নেওয়া, কয়েদির পোশাক পরা নম্বরধারী নামগোত্রহীন শুধু বন্দি, মানুষ নয়, অভুক্ত, শ্রম ও রোগকাতর নরকঙ্কাল, মৃত্যু মৃত্যু এবং মৃত্যু – গুলিতে, মাটিতে পুঁতে, গাছে ঝুলিয়ে, জীবন্ত পুড়িয়ে, গ্যাস চেম্বারে ঠেসে ধরে – যতভাবে মৃত্যুকে বীভৎস করা যায়।’
প্রতিটি পর্বের প্রারম্ভে একটি এপিগ্রাফ কবিতা যুক্ত করেছেন অনুবাদক সুরেশ রঞ্জন বসাক। আর এই প্রারম্ভিক কবিতাটির মধ্যেই যেন এই পর্বের চিত্রবীক্ষণ হয়ে ওঠে। নিধনপর্বের শুরুতে সম্পাদক যুক্ত করেছেন একটি কবিতা; এটি হচ্ছে : ‘Dead? … Not dead? …/ Alive? … Not alive?’ …/ ‘Alle Stuecke da … Jawohl lieber Mann …’/ ‘jawohl’ answers the standing corpse/ Here … I am here …’, (‘Dawn at block 30 in Dachau; Henri Pouzol)। প্রতিটি পর্বের কবিতা পাঠ করলে গা শিউরে ওঠার মতো অবস্থা হয়। ফিরে যেতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে; যুদ্ধকালীন মাঠে-ময়দানে, রেলস্টেশনে কিংবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে ছিল না মানবিকতার কোনো বালাই, ছিল নির্মম পাশবিকতা আর বীভৎসতার হিংস্র খেলা। সেই বীভৎসতার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদের কলমে-চিরকুটে যা লেখা হয়েছে তা-ই কবিতা হয়েছে। মহাকালের পাঠককে জানিয়ে দিচ্ছে ‘হলোকস্ট’ কিংবা মহাযুদ্ধের গণহত্যার নির্মমতার কথা। হ্যাঁ, কবিতা যদি বিশেষ মুহূর্তের ব্যঞ্জনাময় উৎসারণ হয় তাহলে হলোকস্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি, অ-কবি যাঁরাই যা-কিছু লিখেছেন তা-ই কবিতা হয়ে উঠেছে এভাবে :

ক. হাজারখানেক, আরো বেশি এবং অনেক বেশি মানুষ
জ্বালানি কাঠের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা
একটি মাত্র কূপে
ওদের একসাথে সমাহিত করা হবে।

(‘গণকবর’, ডারমাস্জা সোম)

খ. যেখানে মড়া পোড়ানোর চুলিস্ন­র কালো
ধোঁয়ায়
গোটা দুনিয়া বিষাক্ত হয়ে পড়েছে,
সেখানে গোলাপ ফোটানোর কী এমন
দরকার।
নীল আকাশজুড়ে তীব্র বাতাস
ভয়ংকর মেঘগুলোকে তাড়িয়ে চলেছে
কিন্তু একখ- কালো মেঘে আমি শঙ্কিত।

(‘ডাকাউয়ে লাল গোলাপ’, ফেলিক্স   রাক)

গ. দিনরাত শব পোড়ানোর চুলিস্ন থেকে উঠে আসা ধোঁয়া
বিষাক্ত করছে জীবিতদের জীবন;
আর কাছাকাছি বনের ভেতর থেকে, সূর্য ওঠার আগে,
বন্দিদের গুলি করে মারার শব্দ ভেসে আসছে।

খুঁটি, মাদি ঘোড়া, শেকল, ফাঁসিকাষ্ঠ
হত্যার জন্যে এসবই হচ্ছে ওদের    সরঞ্জাম।
শেকলে হাত-বাঁধা প্রথম বন্দি যখন     কুকুরের মতো ঝুলতে থাকে
এসএস গার্ডদের ফুর্তি দেখে কে।

(‘সূর্যালোকে ডাকাউ,’ ফেলিক্স রাক)

ঘ. মুমূর্ষুদের কাছ থেকে সে নিংড়ে নেয়
বিকৃত আনন্দ
নোংরা আদর চুম্বনে
আবৃত করে
কদর্য স্পর্শ
আর ঘৃণ্য যৌনকর্ম

(‘কাপো’, মিয়ারকো জুসেপ্পি কামিয়া)

উলিস্ন­খিত কবিতাগুলোতে সাধারণ মানুষের ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল সেই বীভৎসতার রূপ ফুটে উঠেছে। যেমন : জ্বালানি কাঠের মতো মানুষকে একটি কূপে একত্রিত করে রাখা হয়েছে। এটি হত্যার প্রস্ত্ততি, একটু পরে হত্যা করা হবে। চারদিকে মড়া পোড়ানোর বিষাক্ত গন্ধে ছেয়ে গেছে। এটি একটি বন্দি ক্যাম্পের চিত্র। এরপরও পাশের বাগানে গোলাপ ফোটার দৃশ্য যেন হিংস্রতার সঙ্গে ভালোবাসার এক কঠিন বৈপরীত্য প্রকাশিত হয়েছে। এসব বন্দিকে হত্যা করার জন্য খুঁটি, মাদি ঘোড়া, ফাঁসিমঞ্চ সবই প্রস্ত্তত। সূর্য ওঠার আগেই গুলির ভয়ংকর শব্দ। এই শব্দ মানুষ হত্যার। কিংবা বন্দিদের সঙ্গে নোংরা যৌনাচার বিকৃত চুম্বন। এসব করেছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। মানুষের মধ্যে কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! হলোকস্টের ভেতরেও মানুষ আশা করেছে হয়তো সে বেঁচে যাবে; আবার ফিরে যাবে আবাসে, প্রিয়জনের কাছে। হয়তো কেউ ভাগ্যবশত বেঁচেও গিয়েছিল; ফিরেওছিল নিজ আবাসে। তাঁদের এই প্রত্যাবর্তন ছিল স্বপ্নের মতো নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আস্বাদ। তবে কবিতার বিষয়-বর্ণনা থেকে অনুমিত হয়, বেঁচে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আবার অনেকে সেই বন্দি ক্যাম্পগুলোতে গ্যাসচেম্বারের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। ওদের জীবনে নেমে এসেছিল কী কঠিন যন্ত্রণা! চোখের সামনে বীভৎস মৃত্যুকে অবলোকন করতে করতে নিজেই মৃত্যুপথে ধাবিত হচ্ছে। এ এক কঠিন অনুভূতি :
দাঁতগুলো উৎকট পচা চিবোতে থাকে
দাঁতগুলো জিহবাকে টুকরো টুকরো
কাটে
আমি একটু নড়লে
আমার বাঁ পাশের বন্ধুটি ধপাস পড়বে
আমার বাঁ পাশের বন্ধুটি আজ রাতে
মাত্র এক ঘণ্টা আগে মারা গেছে
সেই কাকভোরে একটি মাত্র চিৎকারে

(‘ডাকাউ বস্ন­ক ৩০ ভোরবেলা’, হেনরি পিজল)

ক্যাম্পগুলোতে মৃত্যু কী যন্ত্রণাদায়ক ছিল তা অনুভব করা যায় কবিতাগুলো পাঠ করলে। সহজেই অনুমান করা যায়, ফলমূলের-সবজির বস্তা যেমন ট্রাক বা লরির ওপর গাদাগাদি করে রাখা হয়, ক্যাম্পগুলোর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মানুষকেও গাদাগাদি করে রাখা হতো। কী অদ্ভুতভাবে একজন বন্দির সঙ্গে অন্য বন্দির শরীর লেগে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। এই কঠিন অবস্থায় একজন অন্যজনের মৃত্যু দেখেছে। এও অনুভব করছে হয়তো কিছুক্ষণ পর দম বন্ধ হয়ে তার নিজেরও মৃত্যু হবে এবং হয়েছে। এর পরও বন্দিদের মনের ভেতরে আকুলিবিকুলি করে ওঠে : ‘অন্তস্তলে আমাদের মুক্তির বীজমন্ত্র’ (‘ডোরাকাটা কয়েদির পোশাক’, এডগর কুপফার কবেরিজ) অথবা, ‘তবুও আমরা মাথা না নুইয়ে হাঁটি’ (‘ডোরাকাটা কয়েদির পোশাক’, এডগর কুপফার কবেরিজ)। এভাবেই চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতনের নগ্নতা – যা ছিল মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও বিবেকবোধের জলাঞ্জলি। হয়তো প্রতিটি যুদ্ধই এমন। ১৯৭১ সাল, টর্চার সেল, গণহত্যা, বধ্যভূমি স্মরণ করিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর কী নিষ্ঠুর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চলেছিল।
নিধনপর্বের কবিতাগুলো যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টের অভিমুখী কবিদের বয়ান; তবু এই কবিতাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের কথা শুধু স্মরণ করে দেয় না, নতুনভাবে ১৯৭১ সালের নয় মাসে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর ক্যাম্পগুলোর কথা ভাবায়।

সুরেশ রঞ্জন বসাক গ্রন্থটির দ্বিতীয় পর্বের নাম দিয়েছেন ‘সাক্ষ্য পর্ব’। এ-প্রসঙ্গে অনুবাদক ভূমিকায় উল্লে­খ করেছেন : ‘[…] সাক্ষ্য পর্বের কবিতাগুলো সাক্ষাৎকারভিত্তিক। মুক্তিদাতা সেনারা যা দেখেছেন তা-ই বলেছেন নিরলংকারভাবে। এতে অতিকথন নেই, আছে মিতকথন। এতে কাব্য নেই, সাক্ষ্য আছে; মেদচর্বি নেই, শুধু রক্তমাংসের – আত্মার আর্তি আছে, বেদনা আছে।’
(বসাক, ২০১৯ : ১৫-১৬)
সাক্ষ্যপর্বের শুরুতে অনুবাদক প্রথম পর্বের মতো এপিগ্রাফ কবিতা যুক্ত করেছেন : ‘The past. Forgotton, I know./ The soldier’s boot … the history?/ : Mist, fog, night, sleep, sleep : / The crematorium/ So … the aquarium’s murky events.’ (Tadeusz Borowski. ‘Camp Near Munich’)। এই পর্বে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধে নিযুক্ত ও পরবর্তী সময়ে যুদ্ধফেরত সেনাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বর্ণনা। এগুলো কবিতা হয়ে না-উঠলেও কবিতার মতো; আর আনুপূর্বিক বর্ণনাকে যদি মহাকাব্যিক বলা হয় তবেও তো কম হবে না। এটাও তো স্মরণ করা দরকার, পৃথিবীর বিখ্যাত মহাকাব্যগুলো তো যুদ্ধেরই বর্ণনাযুক্ত। পুরাণে হেলেন-সীতাকে নিয়ে যুদ্ধ হলেও এসবের পেছনে তো দখলদারী মনোভাব কম ছিল না। আর সেই সামন্ততান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা ঔপনিবেশিক চিন্তার সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোগসাজশ তো ছিলই। যুদ্ধফেরতদের বর্ণনায় যুক্ত হয়েছে হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার চিত্র :
ক. প্রাইভেট কার সাইজের মালগাড়ি
রবার টায়ার, চাকায় ভর্তি,
পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রেন,
সর্বত্র মৃতদেহ ঠেসে রাখা,
একজনের ওপর আরেকজন,
একপাশটায় হেলে গেছে বলে
মৃতদেহের সত্মূপ অনায়াসে দেখা যাচ্ছে।

(‘প্রাইভেটকার সাইজের মালগাড়ি’)

খ. মালবাহী গাড়িগুলো দেখে
আমার ভীষণ বমি বমি লাগছিল।
মৃত মাংসের দুর্গন্ধ,
গায়ের সাথে লেপ্টানো মলমূত্র।

(‘মালবাহী গাড়িগুলো দেখে’)

গ. ইহুদি অধ্যুষিত ক্যাম্পের অংশে খ্রিষ্টানদের থাকতে দেয়া
আরেক ধরনের সূক্ষ্ম শাস্তির ভেতরে শাস্তি।
ধরে আনা তিন ব্যক্তি নাৎসিদের বন্দি-গার্ড, কাপো
তাই ইহুদি নেতা ওদের হত্যার অনুমতি চাইছে।

(‘ক্যাম্পে ইহুদিদের জন্য নির্ধারিত অংশে’)

ঘ. কালো রুটি, পোড়া রুটি
সব রকমের রুটি,
ওয়াগন বোঝাই রুটি,
[…]
ভাগ করে নেয়া বলে কোনো বিষয় নেই।
ওরা জন্তুর মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে থাকে।

(‘কালো রুটি, পোড়া রুটি’)

ঙ. রুমের শেষ প্রান্তে একটি টয়লেট
এক হাজার মানুষের জন্যে একটি টয়লেট।
অন্য প্রান্তে একটি দরজা,
রাতেই যারা চিরনিদ্রায় গেছে
সকালে তাদের মৃতদেহগুলোকে
তিন-চাকার ঠেলাগাড়িতে ফেলার জন্যে
ওই একটি দরজা।
পরের দরজাটি ডাক্তারের অফিসের,
যেখানে একবার প্রবেশ করলেই
মৃত হয়ে ফিরে আসতে হয়।

(‘রুমের শেষ প্রান্তে একটি টয়লেট’)

উলিস্ন­খিত প্রতিটি কবিতায় যুদ্ধফেরত সেনাদের যুদ্ধস্মৃতির কাব্যিক চিত্রকল্প যুক্ত হয়েছে। মালগাড়িতে রাবার টায়ার, চাকার সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ ঠেসে রাখার দৃশ্য সত্যিই করুণ। ট্রাক-ট্রেন কিংবা রেলস্টেশনে মৃতদেহের সত্মূপ কিংবা
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চারদিকে পড়ে আছে মানুষের সারি সারি মৃতদেহ! এসব মালবাহী গাড়ি থেকে বা খোলা আকাশের নিচে পড়ে
থাকা মৃতদেহ থেকে বেরিয়ে আসছে পচা মাংসের দুর্গন্ধ। নির্যাতনের ভেতরেও রয়েছে নানারকম সূক্ষ্ম চালাকি। ইহুদি বন্দি ক্যাম্পে খ্রিষ্টানদেরও রাখা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে ইহুদি বন্দি নেতা খ্রিষ্টানদের হত্যা করতে চেয়েছিল। এসব বন্দির মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া হলো সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভাজন ও জাতিভেদ।
সংকলক-সম্পাদক-অনুবাদক সুরেশ রঞ্জন বসাক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থের সর্বশেষ পর্বের নাম দিয়েছেন ‘শোক পর্ব’। এই পর্ব নিয়ে অনুবাদক অসাধারণ একটি মন্তব্য করেছেন। তাঁর উচ্চারণ : ‘ইতিহাসে যা শেষ, কবিতায় তা শুরু’ (২০১৯ : ১৬)। বিষয়টি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসচেতনার মতো। অনুবাদকের ভাষায় : ‘ইতিহাসের পরিহাস হলো, নাৎসিরা বই পুড়িয়ে শুরু করেছিল, মানুষ পুড়িয়ে শেষ করেছে।’ (পৃ ১৬)। অনুবাদক সংকলনের ধারাবাহিকতায় শোকপর্বেও একটি এপিগ্রাফ যুক্ত করেছেন যেটি এই পর্বের কবিতাগুলোর মর্মার্থ ধারণ করেছে। শোকপর্বের এপিগ্রাফ কবিতাটি হচ্ছে : ‘If I were to begin, if I were to begin to tell you/ The half, the quarter, a mere smattering of what we went through!’ (James Fenton : ‘A German Requiem’)। এই পর্বে যুক্ত করেছেন বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত কবি যেমন বারটল্ট ব্রেশট, কার্ল স্যান্ডবার্গ, জন বেরিম্যান, ডাবিস্ন­উ এইচ অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডার প্রমুখের কবিতা।
অনুবাদক যেমনটি ভূমিকায় উল্লে­খ করেছেন, সুবিখ্যাত কবি হেনরিক হেইন, হেমিংওয়ে, হারমান হেসে, হাম্রলি, ফ্রয়েড, আইনস্টাইন, আঁদ্রে মার্লো, মায়াকোভস্কি, প্রম্নস্ত ও কার্ল মার্কসের গ্রন্থ নিষিদ্ধ ও পোড়ানো হয়েছিল। এর প্রধান কারণ হতে পারে কবি-শিল্পী-বোদ্ধাদের লেখায় এমন কিছু কঠিন সত্য উচ্চারিত হয় যা নাৎসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করতে পারে। কারণ, তাঁরা রাষ্ট্রের জনগণকে একটি সত্যের ওপর দাঁড় করিয়ে দ্রোহী সুর তুলতে পারেন কবিতা-শিল্পের মাধ্যমে। এরকম সাদৃশ্যপূর্ণ অজুহাত তুলে পেস্ন­টো তো তাঁর ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ থেকে কবিদের নির্বাসনে দিতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত, পৃথিবীর কোনো শাসকই কবি-শিল্পী-বোদ্ধাদের ভালো চোখে দেখতেন না, কারণ এঁরা প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষ। কবিদের কাছে শাসকের অপকর্মের বিষয়গুলো ধরা পড়ে, তাই তাঁরা কঠিন সত্য উচ্চারণ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তব চিত্র নিয়েও কবিরা কবিতায় শাসকদের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন এভাবে :
ক. আমাকে পোড়াও! তিনি তাঁর গনগনে কলমে লিখলেন –
আমি কি সবসময় সত্যি কথা লিখিনি?
আর এখন তোমরা কিনা আমাকে মিথ্যেবাদী বানাচ্ছ?
তার চেয়ে আমাকে পোড়াও!

(‘গ্রন্থদাহ’, বারটল্ট ব্রেশট)

খ. অস্টারলিজ আর ওয়াটারলুতে
মৃতদেহগুলো সত্মূপাকৃতি করে রাখো,
বেলচা দিয়ে মাটি চাপা দাও : আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

আমি ঘাস। আমি সবকিছুকে ঢেকে  রাখি।

(‘ঘাস’, কার্ল স্যান্ডবার্গ)

গ. ভাবলাম, আকাশে বুঝি বজ্রের গর্জন শুনলাম;
ওটা হিটলারের কণ্ঠ, ইউরোপকে উদ্দেশ করে, ‘ওদের মরতেই হবে’;

কিন্তু ওরা তো জার্মান-ইহুদি না,     প্রিয়তমা,
ওরা তো জার্মান ইহুদি না।     [...]
পোতাশ্রয়ে গেলাম, মালখালাসের     জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি,
মাছগুলো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, যেন স্বাধীন ওরা :
মাত্র দশ ফুট দূরে, প্রিয়তমা,
মাত্র দশ ফুট দূরে।

(‘রিফিউজি বস্নুজ’, ডাবিস্ন­উ এইচ অডেন)

ঘ. আমার বয়স চবিবশ
আমাকে হত্যা করতে নেওয়া হয়েছিল,
আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম।

পরবর্তী সবকিছু শূন্যগর্ভ সমার্থক শব্দ
মানুষ ও পশু 
প্রেম ও ঘৃণা
বন্ধু ও শত্রম্ন
অন্ধকার ও আলো।

কী মানুষ কী পশু, হত্যা করার কায়দা   একই,
আমি দেখেছি :
টুকরো টুকরো করে কাটা ট্রাকভর্তি     মানুষ
ওরা বাঁচবে না।
(‘উত্তরজীবী’, টাডিউজ রোজেউইক্স)

ঙ. চার নম্বর-এইচ, চার নম্বর সারি
সিমেন্টের সাধারণ ধূসর বস্ন­কের ওপর
ভুল বানানে লেখা তোমার নাম,
তোমার কবর নম্বর নয়শো পঁচাত্তরে ফুলের তোড়া রেখে
আমি শপথ নিয়েছিলাম,
তোমার মৃত্যুকে বৃথা যেতে দিব না, বাবা। […]
দ্রম্নত ছেড়ে এলাম ডাকাউ জঙ্গলশ্মশান,
না, আর এখানে বসে কাঁদব না

আমার জীবন অন্য কোথাও
চার হাজার মাইল দূরে
এবং হিরোশিমা থেকে চলিস্ন­শ বছর দূরে
তবু - মনে হয়, মাত্র গতকাল

(‘হিরোশিমার চলিস্ন­শ বছর পর’, টাটিয়ান সিংকোভেক-মেভার)

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থে সংকলিত ও অনূদিত কবিতাগুলোর মধ্যে নানাভাবে মানুষের মৃত্যুর ভয়ংকর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সত্য বলার জন্য, সত্য লেখার জন্য কবিকে ক্যাম্পে যেতে হয়েছে, পুড়তে হয়েছে। অথবা, ব্যক্তিকবি নয়, কবির মতো অসংখ্য মানুষকে সেই ক্যাম্পে পুড়তে হয়েছে। আবার কখনো মৃতদেহগুলো সত্মূপীকৃত করে রাখা হতো, বেলচা দিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হবে বলে। আর কবি মাটির মধ্যে মিশে যেতে চেয়েছেন, ঘাস হতে চেয়েছেন। কবি হয়তো ক্যাম্পের নরকযন্ত্রণা থেকে মৃত্তিকায় মিশে যাওয়াকে আনন্দময় বলেই ধরে নিয়েছেন আনুভূতিক ব্যঞ্জিত সুর ও স্বরে। ডাবিস্নউ এইচ অডেন তাঁর ‘রিফিউজি বস্নুজ’ কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন হন্তারক হিটলারের ইউরোপকে উদ্দেশ করে মানুষ হত্যার হুংকার : ‘ওদেরকে মরতেই হবে’। কিন্তু তার এ-হুংকারের ভেতরে যে শুধু ইহুদিরা ছিল তা নয়। জার্মানরাও যে ছিল। বিষয়টি দাঁড়িয়েছিল ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ তবে অডেন পরবর্তী স্তবকে একটি রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন এভাবে ‘মাছগুলো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, যেন স্বাধীন ওরা’। জলের মাছগুলো স্বাধীন হলেও মৃত্তিকার মানুষগুলো পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি। কবির অসাধারণ অনুভূতি মানুষের পরাধীনতা বিষয়ে।
টাডিউজ রোজেউইকসের কবিতায় যুক্ত হয়েছে চবিবশ বছরের যুবকের প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কদর্য গল্প। এমন পরিস্থিতিতে কবির অনুভব মানুষ-পশু, প্রেম-ঘৃণা,
বন্ধু-শত্রম্ন যেন মূল্যহীন সমার্থক হয়ে ওঠে। ‘হিরোশিমার চলিস্ন­শ বছর পর’ কবিতায় টাটিয়ান সিংকোভেক-মেভার উচ্চারণ করেছেন দ্রোহী সন্তানের আর্তি : ‘তোমার কবর নম্বর নয়শো পঁচাত্তরে ফুলের তোড়া রেখে/ আমি শপথ নিয়েছিলাম,/ তোমার মৃত্যুকে বৃথা যেতে দিব না, বাবা।’ এগুলো সবই একটি মহাযুদ্ধের বিদীর্ণচিত্র – যা কবিতার সুর-স্বরে উচ্চারিত ও উচ্চকিত হয়েছে এবং ফেলে আসা ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ – এই সময়কে মহাকালের মুখোমুখি করে নতুনভাবে বিনির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি কবিতাই একেকটি ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়েছে।
সুরেশ রঞ্জন বসাক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গ্রন্থে তিনটি পর্বে মোট ১৫৯টি কবিতা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি যেমন মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন, একই সঙ্গে ভিনদেশি বিভিন্ন ভাষার উচ্চারণে ও প্রতিলিপিকরণে পরিচয় দিয়েছেন ভাষিক দক্ষতার। কিছু কিছু কবিতা পাঠ করলে মনেই হয় না যে এগুলো অনূদিত কবিতা; এখানেই একজন অনুবাদক হিসেবে তাঁর সার্থকতা। তেমনি একটি কবিতা :

আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদো না,
আমি তো সেখানে নেই; আমার ঘুম আসে না।
আমি প্রবহমান হাজার বাতাস হয়ে গেছি,
হয়ে গেছি তুষারের ওপর ঠিকরে পড়া হিরে
পরিপক্ব শস্যের মাঠের ওপর দীপ্যমান সূর্য,
আমি হয়ে গেছি হেমন্তের নম্র বৃষ্টি,
তোমরা যখন ভোরের নৈঃশব্দ্যকে শব্দময় করো
আমি তখন শান্ত পাখিদের ঘুম-ভাঙা বৃত্তায়মান উড়াল হয়ে যাই।

আমি নিশীথ নক্ষত্রের নরম আলো
আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদো না,
আমি সেখানে নেই; আমি মরিনি।

(‘আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদো না’, মেরি এলিজাবেথ ফ্রাই)

শুধু তাই নয়, সুরেশ রঞ্জন বসাকের কনসেনট্রে্রশন ক্যাম্প কাব্যের উপযোগিতা নানা কারণে ব্যাপক। প্রথমত, বাংলা ভাষায় এই ধারার কবিতাচর্চা এর আগে হয়নি। তাই, বাংলা কবিতার ইতিহাসে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ধারার কাব্যচর্চা এদেশীয় পাঠককে কবিতাচর্চার নতুন পথ দেখাতে সমর্থ হবে। এই অনূদিত কবিতাগুলো পাঠককে নিয়ে যায় সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে। এক্ষেত্রে পাঠক যেন ইতিহাসের সেই বর্বর সময়ের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে পরিব্রাজকের মতো বারবার সেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নির্মমতাকে আরো একবার ঘুরে দেখে আসতে পারেন। প্রতিটি কবিতার শরীরের মধ্যে লুকিয়ে আছে হলোকস্টের নির্মমতার চিহ্ন। কবিতার চিত্রকল্পের ভাঁজে ভাঁজে লেগে আছে নির্যাতিত ও মৃত্যুমুখে ধাবিত মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদের ক্ষতচিহ্ন। কবি অ-কবি প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা পরোক্ষদর্শীদের বর্ণনাই হয়ে উঠেছে ডাকাউ, বার্গেন-বেল্সন ও বুহেনওয়াদসহ বিয়ালিস্নশ হাজার ক্যাম্প ও সাব-ক্যাম্পের নির্মমতা-পৈশাচিকতা ও পাশবিকতার চিত্র।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি কবিতার প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কবিতাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর নির্মমতার কথা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনারা গণহত্যা চালিয়েছিল দিনের পর দিন। নারীদের বিবস্ত্র করে ক্যাম্পে ধর্ষণ করা হয়েছিল দিনের পর দিন। পাকবাহিনীর বিকৃত আনন্দের উন্মাদনার সঙ্গে নাৎসি বাহিনীর যে সাদৃশ্য রয়েছে তা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কবিতা পাঠ করলে অনুধাবন করা যায়।
পাকবাহিনী এদেশের সনাতন ধর্মের লোকদের টার্গেট করে যেভাবে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল, নাৎসিরাও সেভাবে চেয়েছিল ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে দিতে। প্রকারান্তরে নাৎসিরা সেখানে ইহুদি, কমিউনিস্ট ও অ-জার্মান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং ষাট লাখ ইহুদি ও এক কোটি সত্তর লাখ (অনার্য) সাধারণ মানুষকে নির্মূল করা হয়েছিল। পাকবাহিনীও এদেশের তিরিশ লাখ বাঙালিকে (হিন্দু-মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী) নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এরকম অবস্থায় সুরেশ রঞ্জন বসাক-অনূদিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কাব্যের উপযোগিতা বাংলা সাহিত্য ও বাংলাভাষী পাঠকের জন্য নিঃসন্দেহে পরম প্রাপ্তি বলা যায়। একই সঙ্গে সচেতন পাঠকের মনে সৃষ্টি করেছে এক নতুন আত্মজিজ্ঞাসা। সেটি এরকম, ১৯৭১ সালে পাকসেনারা যে-গণহত্যা করেছিল সে-সময়ের মৃত্যুপথযাত্রী শহীদদের স্মৃতিকথা, চিরকুট, কবিতা কিংবা শেষ
কথাগুলো জাতি কি সংরক্ষণ করতে পেরেছে? অথবা, এগুলো অনুসন্ধানে কি পর্যাপ্ত গবেষণা চলছে? এরকম অনেক প্রশ্ন আর গণহত্যার নানা দৃশ্যের করুণ চিত্র ভেসে ওঠে পাঠকের মনে। সুরেশ রঞ্জন বসাকের এ-কাজ নিঃসন্দেহে বাংলার অনুবাদ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে; কবিতার ইতিহাসে যুক্ত করেছে নতুন পথের
ধারা।