বাবার কথা

ডালিয়া নওশিন

Mazharul Islam house

আববার কথা কী যে লিখব, তা ভাবতে ভাবতে তো কত সময় কেটে গেল। নিজের বাবার কথা লেখা যে এতো কঠিন হবে, এটা কখনই ভাবতে পারিনি। এখন তো আববা আর আমাদের মাঝে নেই – এটাই মহাসত্য। কি অবিশ্বাস্য! সারাজীবন সেই মানুষটা আমাদের পরিবারকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছিলেন, যিনি আমাকে এবং আমাদের পরিবারের সবাইকে সকল সুবিধা-অসুবিধায়, দুঃখে-আনন্দে, সকল প্রকার কর্মে হাত বাড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; কোনো কিছু চাইবার আগেই সামনে এনে দিয়েছেন – সেই আববাকে আর কখনো চোখের সামনে চাইলেও পাবো না, তাঁকে আর ‘আববা’ বলে ডাকতে পারব না – এ-কথা ভাবলে বুকের মধ্যে এক অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করা ছাড়া – এই পরম সত্যটাকে তো আর এড়িয়ে যেতে পারছি না।

আববা দীর্ঘদিন ধরে কিছু জটিল রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে গত ১৫ জুলাই, ২০১২-তে আমাদের ছেড়ে ‘ফিরে না আসার’ দেশে চিরকালের জন্যে চলে গেলেন। আর চলে যাওয়ার সময় তিনি আমাদের সকলের অন্তরের একটা অংশ চিরদিনের মতো তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

আববা, অর্থাৎ ‘স্থপতি মাজহারুল ইসলাম’, শুধুমাত্র একজন বাবাই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন বন্ধু, একজন শিক্ষক, একজন আদর্শবাদী-সৎ-কর্মঠ ব্যক্তি – যিনি তাঁর সকল কর্মই করে গেছেন সম্পূর্ণ নিরলস-নির্বিঘ্ন এক উদার মনোবৃত্তিসহকারে।

আববাকে মনে হয় জীবনের বেশিরভাগ সময় সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামায় দেখেছি। সাদার প্রতি তাঁর এক মহাআসক্তি ছিল। তাই আমার আম্মাকেও বেশিরভাগ সময় সাদা শাড়ির সঙ্গে সুন্দর চিকন পাড় পরে থাকতে দেখেছি। বাড়ির আসবাবেও আববা সবসময় সাদা চাদর, টেবিলে সাদা কাপড়, দেয়ালে সাদা রং, সাদা গাড়ি – এসব পছন্দ করতেন।

আববা সবসময় সুন্দর-পরিপাটি পরিবেশ পছন্দ করতেন। তাঁর সবল ব্যক্তিত্বকে বজায় রেখে আমাদের সকলকে সাজিয়ে-গুছিয়ে সবার সামনে উপস্থাপন করতেন। তবে বাঙালিয়ানা তাঁর মজ্জাগত ছিল বলে আম্মাকে তিনি যেমনি সুন্দর সুন্দর ঢাকাই শাড়ি, ভিটি শাড়ি কিনে দিতেন; তেমনি আমাকেও অষ্টম শ্রেণি থেকে শাড়ি পরতে উৎসাহিত করেছিলেন।

বাঙালিয়ানার আরেক উদাহরণ ছিল তাঁর বাংলা গান। কবিতা, গল্প, নাটকের ওপর প্রচন্ড রকম আসক্তি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়িতে সিকান্দার আবু জাফর চাচা প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। আমার শিক্ষক, যাঁর কাছে আমার গানে হাতেখড়ি, সেই প্রিয় সুধীন দাস আর কাকিমা (স্ত্রী নীলিমা দাস) প্রায়ই এসে গান পরিবেশন করতেন। আববার প্রিয়জনদের মধ্যে আরো যাঁরা আসতেন তাঁদের মধ্যে পটুয়া কামরুল হাসান চাচা, সৈয়দ জাহাঙ্গীর চাচা এবং শিল্পী রশিদ চৌধুরী – তাঁরা দিনের পর দিন সময় কাটিয়েছেন আমাদের ৩নং পরীবাগের বাসায়।

আমাদের সেই ঐতিহাসিক ৩নং পরীবাগের ১৫০ বছরের পুরনো বাড়িটিতে বহু সুনামধন্য শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক, ছাত্রছাত্রী, নাট্যকার, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকের আনাগোনা হয়েছে। তখন ৩নং পরীবাগ ছিল সকল সৃজনশীল বোদ্ধাগোষ্ঠীর কেন্দ্রবিন্দু। গান ভালোবাসতেন বলে আমাকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সুধীন দাসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘গান শিখবে নিজের ভালোলাগার জন্যে, অন্য কারো জন্য নয়।’ মার্গীয় সংগীত তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হলেও আববা দেশি-বিদেশি সব ধরনের সুন্দর-সুন্দর গানের রেকর্ড কিনে আনতেন। রবীন্দ্র-নজরুল, ডিএল রায়, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, ঠুংরি ছাড়াও বিদেশি Paul Robeson, Louis Amstrong, Frank Sinatra, Joan Baez প্রমুখ রং-বেরঙের শিল্পীর গান সংগ্রহ করেছেন আববা। সংস্কৃতির সকল অঙ্গই ছিল তাঁর হৃদয়ের ইন্দ্রিয়ে মিশে।

দেশে যখনই কোনো বর্ণিল-শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান পরিবেশিত হতো, আববা তখন আমাদের সেখানে নিয়ে যেতেন। ষাটের দশকে ঢাকায় প্রচুর cultural troupe বিদেশ থেকে আসত। যেমন Russian Ballet, Chinese Circus, Circorama, Opera ইত্যাদি। তখন খুব ভালো ভালো ছায়াছবিও বিদেশ থেকে আসত। কিছু ছবির নাম না নিলেই নয়, যেমন – Ballad of a soldier, The crane’s are flying, Gone with the wind, For whom the bell ইত্যাদি। আববা তখন বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক প্রচুর ছায়াছবিও দেখতে ভালোবাসতেন। আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এসব পৃথিবীবিখ্যাত ছায়াছবি নিয়ে আন্তর্জাতিক film festival-ও প্রায়ই হতো।

আববার আরেকটা প্রচন্ড ভালোলাগা এবং ভালোবাসার বিষয় ছিল বইপড়া। বাজারে নতুন বই এলেই Zeenat Book Store কিংবা নওরোজ কিতাবিস্তান – আববাকে ফোন করে জানাত। ‘স্যার, চলে আসুন। ভালো বই এসেছে।’ সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ নিউমার্কেটে চলে যেতেন আববা, আর ফিরে আসতেন ১০-২০টা বই (বইয়ের পাহাড়) হাতে নিয়ে। সব ধরনের বই, যেমন : স্থাপত্যশিল্প, রাজনীতি, উপন্যাস তো থাকতই। তবে সবচেয়ে প্রিয় ছিল সায়েন্স ফিকশন – প্রধানত আইজাক আসিমভ এইচজি ওয়েলস – তাঁদের লেখা বেশি প্রিয় ছিল। আবার গোয়েন্দা সংক্রান্ত কল্পিত উপন্যাসও আববার বেশ প্রিয় ছিল। যেমন রবার্ট লুডলুম, আগাথা ক্রিস্টি – তাঁদের লেখা উপন্যাস। আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে এখনো পরিষ্কার মনে আছে – আমাদের বাড়িতে সাধারণ আসবাবপত্রের চেয়ে বই-উপন্যাসের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ছিল রাজনৈতিক বইয়ে ভরা একটা বিশাল কক্ষ। লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং, গান্ধী, ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, মার্টিন লুথার কিং – এজাতীয় বই।

সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রতিটি বই কেনামাত্র আগে নিজে পড়ে ফেলতেন; তারপর দেয়ালে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন।

আববাকে দেখেছি দেশের জন্য প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে। দেশমাতৃকা ছিল আববার প্রথম প্রেম। ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে আববা যেমন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন; তেমনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে আববাকে দেখেছি হতবাক হয়ে যেতে। পাকিস্তানি মিলিটারি জঙ্গিকে তাদের বর্বরোচিত রক্ত হননের জন্যে বুঝতে পারলেও, বাঙালি বাঙালির ওপর এতো জঘন্য পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে! বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে এভাবে নিঃশেষ করে দিতে পারে – তা জীবনে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি আববা।

ধীরে-ধীরে আববা অনুধাবন করতে আরম্ভ করলেন যে, দেশের মানুষ আগের মতো আর সৎ প্রবৃত্তি, সৎচিন্তা, নিজের দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা – এসব গুণ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে – দেশের চিত্রপট তাই আস্তে-আস্তে পালটে যাচ্ছে।

’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা ওপারে চলে গিয়েছিলাম। আমার দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন হলেন তানভির মাজহার ইসলাম (তান্না)। ওর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না বলে আমরা ভীষণ অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আববাকে তখন দেখেছি পাগলের মতো এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে।

মনে পড়ে, তখন কলকাতায় ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করানো হয়েছিল, তারই সদস্য হিসেবে আমরা দিল্লিতে গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে সেই ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্ব – কল্পনা দত্তের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। এই সেই দুঃসাহসী কল্পনা দত্ত, যিনি মাস্টারদার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। আববাকে তিনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে আমাদের নিয়ে নির্দ্বিধায় থাকার জন্যে। আমরা ছিলামও বেশ কিছুদিন তাঁর বাড়িতে।

আববা যে কত উঁচু মাপের এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তা উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল, যখন দেখেছি ভারতীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পিএন হাক্সার, ইন্দিরা গান্ধী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় – এ ধরনের অনেক গুণিজনের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল – আববারই জন্যে।

শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করার সুবাদে আববার পশ্চিমবঙ্গের কমবেশি সকল উচ্চপদস্থের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সুনীল মুনসি, প্রসূণ ব্যানার্জি, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, (নাম মনে নেই) – তাঁদের সঙ্গেও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তার ফলে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আববার এসব স্বনামধন্য বন্ধুকে কাছে থেকে দেখার এবং পরিচিত হওয়ার। প্রত্যেককে দেখেছি – আববাকে কতটা শ্রদ্ধাভরে সমাদর করতেন।

আমার আববা ছিলেন মেধাবী এবং তাঁর জীবন ছিল আদর্শে পরিপূর্ণ। তাঁর চিন্তা ছিল উদারচেতা। তিনি তাঁর জীবন সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেছিলেন দেশের মানুষের কল্যাণমূলক কাজে। সবার ঊর্ধ্বে দেশই ছিল তাঁর অন্তরের শ্রেষ্ঠ স্থানটিতে।

ধর্মের ব্যাপারে আববা কখনই গোঁড়ামি পছন্দ করতেন না। হয়তো ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকতে পারেন। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠে তিনি ধীরে ধীরে ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে ভন্ডামি এবং ধর্মকে নিয়ে বাড়াবাড়ি ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন সব ধর্মের সব সৎ মানুষকে  সমানভাবে শ্রদ্ধা করতে। এ যে কত বড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তা আজীবন উপলব্ধি করব প্রতিটি মুহূর্তে।

আমার আববা ছিলেন একজন প্রচন্ড রকমের সৎমানুষ। তিনি নিজে সৎ ছিলেন বলেই কঠিন সত্যকে জোর গলায় বলতে পারতেন – এ-ব্যাপারে তাঁর কোনোই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। কোনো ধরনের অন্যায়কে তিনি জীবনে কোনোদিন প্রশ্রয় দেননি। নীতিবিরুদ্ধ কাজকে তিনি সবসময় ঘৃণার চোখে দেখতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তিনি সর্বদা প্রস্ত্তত থাকতেন। যে-কোনো ভন্ড মানুষকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন।

আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই – পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি – আসলে আমার আববা খুব একাকিত্বে ভুগতেন। তাঁর জীবনদর্শন, চিন্তাধারা এবং মন-মানসিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলে যাওয়ার মতো সঙ্গী বা বন্ধু তিনি কখনই পাননি। আমরা পরিবারের সদস্যরাও বোধহয় তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। আসলে আববা অনেক সামনের দিকে দেখতে পারতেন। ভবিষ্যতের কথা তিনি সর্বাগ্রে বুঝে নিতেন সুন্দরভাবে।

তাই আমরা হয়তো আববার মতো এতো বড়মাপের মানুষ কোনোদিন হতে পারব না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করব তাঁর সব আদর্শ, নীতি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে উপলব্ধি করতে। মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে।

আববা, আপনি আমাদের মাঝে হয়তো নেই, কিন্তু আপনার হাতের ছোঁয়া অসংখ্য বস্ত্ত, আপনার প্রচ্ছদ প্রতিটি ঘরে-ঘরে – আমাদের সব সময় ঘিরে রাখছে – আপনার ছবির দিকে তাকালে মনে হয় আপনি কথা বলছেন – এখনো আমাদের পথনির্দেশনা দিচ্ছেন। আপনাকে হয়তো কিছুটা দূরে কোথাও রেখে এসেছি, কিন্তু আপনি আমাদের মাঝেই প্রতি মুহূর্তে বিচরণ করছেন। আমি এখনো আপনার আওয়াজ শুনতে পাই – এখনো মনে হয় এই বুঝি আপনি ঘরে ঢুকবেন –

যে ঘরে ছিলো প্রতি মুহূর্তে তোমার বিচরণ

সে ঘরে ফিরে আসবে না তো জানি

তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি –