আমি কিছু কথা বলতে চাই। আর সেটা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা।
আপনারা হয়তো বলবেন, এতদিন বাদে আবার এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা হচ্ছে কেন, সেসব তো এই ৫০ বছরে অনেক বলা হয়েছে।
তার উত্তরে আমি বলতে চাই, না, এখনো সব বলা হয়নি। এবং আমার ধারণায় এক হাজার বছরেও সব বলা হবে কি না, সন্দেহ। কারণ এ ছিল এমন একটা যুদ্ধ, যেখানে মানুষেরা লাঠি, দা, আর সড়কি-শাবল নিয়ে শত্রুর রাইফেল, বেয়নেট, গ্রেনেড আর মেশিনগানের মোকাবিলা করতে ছুটে গিয়েছিল।
এবং অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। এবং তারপরেও তারা শত্রুর মোকাবিলা করতে পিছপা হয়নি।
কারণ একটা হাজার বছরের পরাধীন জাতির মনের মধ্যে যখন স্বাধীনতার স্পৃহা জাগে তাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায় না।
আর এই স্পৃহা জাগিয়ে তোলার পেছনে কার আমরণ সংগ্রাম ছিল তাঁকে আমরা সকলেই চিনি।
তাই এই যুদ্ধ ছিল একেবারে যুদ্ধ মোকাবিলায় অপ্রস্তুত বাংলার সাধারণ জনগণের সঙ্গে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান জনগণের যুদ্ধ।
সে-কারণেই রূপকথার মতো শুনতে অবিশ্বাস্য এই মুক্তিযুদ্ধের কথা যুগে যুগে মানুষের মুখে ফিরবে।
আমার নাম তাহমিনা বেগম।
আমি বাগেরহাট থানার বৈতপুর গ্রামের মেয়ে। আমি আগে হিন্দু ছিলাম। হিন্দু হিসেবেই বড় হয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের দুজন ছেলেমেয়েও ছিল। তখন আমার নাম ছিল দিপালী। দিপালী গুহ।
আমাদের গ্রামটা ছিল সবুজে – শস্যে একাকার। গ্রামের মধ্যবিত্ত হিসেবে আমাদের দিব্যি খেয়েপরে মাস চলে যেত। আমার স্বামীর গঞ্জে একটা মনোহারি দোকান ছিল। সেখানে যে-আয় হতো, তাতে আমাদের খাওয়াপরার কোনো কষ্ট ছিল না।
তাছাড়া আমাদের ধানের জমি ছিল। সেজন্যে বাইরে থেকে আমাদের চাল কিনতে হতো না।
বরং প্রতি মৌসুমে আমার বাবা চাল বিক্রি করেও কিছু উপার্জন করতেন।
আমার বাবা-কাকারা ’৪৭-এ দেশভাগ হলেও নিজেদের বাসভূমি ত্যাগ করে ভারতে যাননি। যাওয়ার কল্পনাও করেননি। হাজার হাজার হিন্দু পরিবারের মতো আমরাও আমাদের জন্মভূমিতে থেকে গিয়েছিলাম। কারণ জন্মভূমিতে থাকার অধিকার পৃথিবীর সকল মানুষের সমান।
এবং আমরা সুখেই ছিলাম।
কিন্তু ’৫৪-র নির্বাচন আমাদের প্রথম রাজনীতিসচেতন করে তুলল। আমরা বুঝতে পারলাম পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের দেশটিকে একটি কলোনিতে পরিণত করতে চায়। এসব আমার ছোটভাই প্রদীপ গুহের কাছে শুনতাম। সে ছেলেবেলা থেকে ছিল আওয়ামী লীগের ভক্ত।
তারপর ১৯৭০-এ যখন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়, তখন আমরা বড় আশা করেছিলাম যে, এবারের ইলেকশনের পর আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কারণ সর্বাধিক ভোটে তিনি সত্তরের ইলেকশনে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু তা আর হলো না। আমাদের গ্রামে যেসব মুসলিম লীগ নেতারা ছিল তারা বলাবলি করত যে, শেখ সাহেব যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে পাকিস্তান নাকি রসাতলে যাবে।
আমরা ওদের এসব কথা বুঝতে পারতাম না। তবে ভোটের সময় আমরা সকলে, গ্রামের সকল হিন্দু পরিবার নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম।
তারপর যখন ২৫শে মার্চে ঢাকায় ইয়াহিয়ার সৈন্যরা মানুষ মারতে শুরু করল, আমাদের গ্রামেও শুরু হলো তাণ্ডব।
আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন, আমাদের গ্রামে একবার বা দুবার মাত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা আসে, এবং তারা এসে ঝটপট করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে আবার চলে যায়, কিন্তু তারা চলে যাবার পর গ্রামের রাজাকার বাহিনী বাঙালি হয়েও, চোদ্দো পুরুষের বাঙালি হয়েও আমাদের ওপরে যে-অত্যাচার শুরু করে এবং দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত যে-অত্যাচার চালায়, ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
’৭১-র ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাগেরহাটে প্রবেশ করে।
প্রবেশমাত্রই তারা কাড়াপাড়া এলাকার ১০০ জন মানুষকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলে। তারপর নাগেরবাজার আর তেলপট্টি এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এরপর রাজাকারদের হুকুম দেয় মুসলমানদের বাড়িঘর-দোকানপাট সবকিছু লুটপাট করে নেবার জন্যে।
মুহূর্তের ভেতরে যাদের আমরা আগে, দাদা, ভাই বা চাচা বা মামা বলে ডাকতাম তাদের ভেতরে একটা পরিবর্তন দেখা দেয়, তারা রে রে রে রে করে তেড়ে এসে সব লুটপাট করতে শুরু করে!
তাদের ব্যবহার দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। তারপর ভাবতে থাকি এই যদি হয় মুসলমানদের অবস্থা তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচবো?
ভাবতে ভাবতেই এপ্রিল মাস চলে এলো। ঘরসংসার ফেলে কচি ছেলেমেয়ে, স্বামী, বাবা-মা ও কাকিমা-দিদিমাদের সঙ্গে নিয়ে কীভাবে কোথা দিয়ে পালাবো এইসব ভাবতে ভাবতেই আমাদের গ্রামে শান্তি কমিটি গঠিত হয়ে গেল। সেইসঙ্গে বিশাল এক রাজাকার বাহিনী।
আমাদের গ্রামের রজব আলী ফকির হলো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
আপনাদের বলে রাখি এই চেয়ারম্যান আর এখানকার রাজাকার বাহিনী সংখ্যালঘুদের ওপরে এমনসব অত্যাচার শুরু করে যা আমাদের চোদ্দো পুরুষেও ঘটেনি।
শ্রাবণ মাসে রাজাকাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অত্যাচারের ভয় দেখিয়ে, লুটপাটের ভয় দেখিয়ে বাগেরহাট শহরে যত হিন্দু ছিল তাদের কিছু মেরে ফেলে বাকি সকলকে মুসলমান করে ফেলল। প্রাণের ভয়ে সকলেই মুসলমান হয়ে গেল ।
রাজাকার বোকারা বুঝল না, পুরুষানুক্রমিক ধর্মকে কি এত সহজে ভোলা যায়? নাকি ভোলা সম্ভব? বুকের ভেতরে হাহাকার রেখে বাগেরহাট শহরের সকল হিন্দু ধর্ম পালটে মুসলমান হলো। কিন্তু সেখানেই রাজাকাররা থেমে থাকল না। বরং মহাউৎসাহ নিয়ে এবার আমাদের গ্রামে এসে হানা দিলো। এবং প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে একের পর এক আমাদের এলাকার মানুষদের মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকল। প্রাণ হারাবার ভয়ে আমি, আমার স্বামী, আমার দুই ছেলেমেয়ে, আমার কাকা-কাকিমা ও তাদের ছেলেমেয়েরা সকলে মিলে মুসলমান হলাম। আমার দিপালী নাম পালটে রাখা হলো তাহমিনা বেগম।
কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকের দল এতেও আমাদের নিস্তার দেয়নি। মাত্র এক মাস বাদেই আশ্বিন মাসের শেষ দিকে একদিন রাত তিনটের সময় ৫০-৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারপর তারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় প্রার্থনা করল।
আমরা যখন দোটানায় ভুগছি তখন আমার ভাই প্রদীপ গুহ চালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে চিনে ফেলল যে তারা রাজাকার। দেখে ভয় পেয়ে গেল আমার ভাইটি। সে তখন বাড়ির ছাদে উঠে গাছ বেয়ে বাড়ির পেছন দিক থেকে নামতে চেষ্টা করল। কিন্তু নামামাত্রই তাকে রাজাকাররা ধরে ফেলল। আমার ভাই তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে অনেক অনুরোধ করল। কিন্তু তারা তাতে মোটেই বিচলিত না হয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তার গলা দু-ফাঁক করে ফেলল। আমার ভাইয়ের চিৎকারে আমরা বাড়ির মধ্যে সকলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
কিন্তু তারপর? তারপর কি রাজাকাররা আমাদের, সদ্য মুসলমান হওয়া আমাদের, গগনবিদারী কান্না দেখে মায়া করে বাড়ি ছেড়ে গেল? না।
বরং তারপর তারা আমাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে আমার বাবা, কাকা এবং পাশের বাড়ির আরো তিনজনকে একসঙ্গে ধরে হাত বেঁধে বাড়ির সীমানার বাইরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল।
তারপর সীমানা পেরিয়েই রাজাকার অধিনায়ক সিরাজ মাস্টার আর তার দল গুলি করে তিনজনেরই মাথার খুলি উড়িয়ে দিলো।
আমরা ঘরে বসেই সব শুনলাম। জানলাম। চোখের নিমেষে আমাদের ভাই মারা গেল, বাবা-কাকা মারা গেল, আমাদের সাধ্য হলো না যে আমরা বাইরে গিয়ে এই দৃশ্য চোখে তাকিয়ে দেখি। শুনেছি সিরাজ মাস্টার নাকি কোথাও পড়াতেন। কিন্তু তার মতো নৃশংস ব্যক্তি কীভাবে স্কুলে পড়াতেন আমি জানি না। সেই দিন আমার মনে হয়েছিল তাহলে কি সব মানুষের ভেতরেই একজন করে খুনি বাস করে? শুধু পরিবেশ অনুকূল হলেই মানুষের সেই খুনি সত্তা রামদা হাতে বেরিয়ে আসে মানুষের সমাজে? তাহলে মানুষের লেখাপড়া শিখে কী লাভ হয়? যদি ভেতরের দৈত্যটাকে মেরে ফেলতে না পারে?
কী লাভ হয় শিক্ষা অর্জন করে?
সেই ছেলেবেলায় প্রথম পাঠে পড়েছিলাম, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দাও, মানীকে সম্মান করো, মানুষকে ভালোবাসো।
কোথায় গেল সেসব শিক্ষা?
কী জানি।
আমি তো অতটা লেখাপড়া করতে পারিনি, তাই এসব কথার উত্তর দিতে পারবো না।
বাবা, কাকা, ভাই ও পাশের বাড়ির তিনজনই বেলা হওয়া পর্যন্ত সেই খোলা জায়গাতেই পড়ে থাকলেন। তারপর আমি সাহস করে একটু একটু করে বাড়ির বাইরে গেলাম। দেখলাম আমার বাবা কাকা ভাই তখনো তাদের যতটুকু মুখের অংশ অবশিষ্ট ছিল তাই নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।
যেন তারা তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে তাকিয়ে আছেন বিচারের জন্য।
তাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চাপ চাপ রক্ত ও মগজের অংশ। কিন্তু আমি যেন তখন ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছি। আমার দেখে ভয় লাগল না। পাড়ার কয়েকজন মিলে আমরা লাশগুলো উদ্ধার করে মাটিচাপা দিয়ে রাখলাম।
তার পরে-পরেই আমরা যে-কজন বেঁচে ছিলাম খালি হাতেই হাঁটতে হাঁটতে বাগেরহাট শহরে চলে এলাম।
পেছনে ফেলে রেখে এলাম আমাদের বাড়ির একজন পুরনো কৃষাণ ও ৭০ বছরের বৃদ্ধ দিদিমাকে।
কৃষাণের কাছে দিদিমার দেখাশোনার দায়িত্ব রেখে এলাম।
তাছাড়া বাড়িঘরের সবকিছু আমাদের আগের রাতেই লুট হয়ে গিয়েছিল।
আমরা গ্রামের সমৃদ্ধিশালী মানুষ ছিলাম। আমার বাবার ফসলি জমি ছিল। আমার স্বামীর গঞ্জে বড় মনোহারি দোকান ছিল। আমাদের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু আমরা পথের ফকির হয়ে চলে এলাম বাগেরহাট শহরে। আমাদের সঙ্গে পাথরের মতো ভারি হয়ে চলল সদ্য আত্মীয় হারিয়ে যাওয়ার শোক।
তার আগে আমাদের দশ পুরুষের সনাতন ধর্ম তো হারিয়েছি।
কী লাভ হলো আমার বাবার সনাতন ধর্ম হারিয়ে?
এখানেই কি আমার কাহিনি শেষ?
না। আমাকে আরো অনেক দূর যেতে হবে।
পরের মাসটা ছিল কার্তিক মাস।
মাত্র তিন সপ্তাহ হয়নি আমাদের গ্রামের বাড়িতে লুট এবং হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এর ভেতরে আবারো রাজাকারের দল আমাদের গ্রামের বাড়িতে চড়াও হলো।
কারণ? কারণ হলো আমাদের দড়াটানা নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গোলাগুলি করত।
যে-কোনো সময় তারা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করবে।
সেই ভয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রজব আলী হুকুম দিলো সমস্ত এলাকার ঘরবাড়ি ভেঙে, গাছপালা কেটে একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে।
হুকুম দেবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। রাজাকাররা আবারো আমাদের বাড়িতে ঢুকল। এবার আসবাব চুরি করতে নয়, ঘর ভেঙে ফেলে আগুন ধরাবার জন্যে।
আমরা তখন বাগেরহাট শহরে সরে গিয়েছি।
তো আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই পেল আমার দিদিমাকে। তারা দিদিমাকে দেখে হাসতে হাসতে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে তাকে তার বিছানার লেপকাঁথা দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে ফেলল। তারপর কেরোসিন ঢেলে লেপে আগুন ধরিয়ে দিলো। দিদিমা চেঁচিয়ে কেঁদে ছটফট করতে করতে বারবার করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সে-চেষ্টা তাঁর সফল হলো না। তিনি চিৎকার করে আমার কাকার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন তাঁকে উদ্ধার করবার জন্যে। এই কাকাটি তাঁর মাকে বড়ই ভালোবাসতেন। আমার হতভাগ্য দিদিমা জানতেও পারলেন না যে তাঁর আদরের ছোট ছেলেকে দু-সপ্তাহ আগেই রাজাকাররা মাথায় গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দিয়েছে।
তো যাক আমার নিজস্ব দুঃখের কথা।
এর পরপর রাজাকাররা নৃশংসভাবে আমাদের গ্রামের সম্মানী ব্যক্তি ভোলা বোসের জীবননাশ করল। প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁকে হত্যা করল তারা। মানুষজন তাকিয়ে দেখল। কেউ কিছু বলতে পারল না। ভোলা বোস নিজেও কারো কাছে কোনো অনুরোধ করলেন না তাঁকে বাঁচাতে।
যেন বিনা প্রতিবাদে ভাগ্যকে মেনে নিলেন তিনি। একবার শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর সব শেষ।
আমাদের গ্রামের বিরাট সমৃদ্ধিশালী একজন মানুষ ছিলেন যাঁর নাম ছিল বলরাম। তাঁর বিশাল গদি ছিল। মানুষজন গমগম করত তাঁর গদিতে। গদির ওপরে বসে তিনি কাজ করতেন। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিল। গ্রামের বহু মানুষকে তিনি সাহায্য করতেন। এককালে তাঁর অধীন ছিল রজব আলী। রাস্তায় কখনো বলরামের সঙ্গে দেখা হলে দাদা বলে তোয়াজ করত।
এখন বলরামকে মেরে তাঁর গদির ওপরে গিয়ে বসল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রজব আলী।
গদির ওপরে বসেই সে এরপর তার হুকুম চালাতো।
নিজেকে সে মনে মনে যেন বলরামই মনে করত!
তাকে ঘিরে থাকতো চাটুকার রাজাকারের দল।
গদির ভেতরে একটা ঘর ছিল। সেখানে রজব আলীর হুকুমে রাজাকাররা সমানে মানুষদের জবাই করতো। তার হুকুম ছিল যে, প্রতিদিন দশটি করে মানুষ জবাই করতেই হবে। যদি কোনোদিন দশজন মানুষ জোগাড় করা না যেত তো রজব আলী রেগে টং হয়ে যেত। তখন তার চেহারা দেখে মনে হতো যেন রাজাকার কাউকে দিয়ে সে দশ নম্বর পূরণ করবে!
সেই ভয়ে যেদিন দশের কোটা পূর্ণ হতো না, সেদিন রাজাকাররা রাস্তা থেকে ফকির ধরে এনে দশজনের কোটা পূরণ করতো!
এর ফলে রাস্তায় ভিক্ষা করা ফকিরের সংখ্যা রাতারাতি শূন্য হয়ে গেল।
আমি মুসলমান মেয়ে তসলিমা বেগম হয়ে একদিন একজনের জন্যে সুপারিশ করতে গিয়ে দেখলাম সেই ঘরের ভেতরে চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে।
দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল। চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলাম। তারপর থেকে আর বাইরে বেরোতাম না।
শুধু বলরাম বাবুর গদি নয়, ওয়াপদা রেস্ট হাউসের কক্ষেও বহু মানুষকে রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা হত্যা করেছে। ডাকবাংলোঘাটেও প্রতিদিন মানুষ ধরে এনে জবাই করতো।
আমার এখন ভাবলে মনে হয় প্রতিদিন টাটকা রক্ত চোখে না দেখলে রাজাকারদের ভালো লাগত না। আমি নিজেও যেন প্রতিদিন রক্ত চোখে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নইলে কোন সাহসে আমি একজনের প্রাণ বাঁচাবার সুপারিশে সেই জল্লাদখানায় গিয়ে হাজির হতে পেরেছিলাম?
এর উত্তর আমার জানা নেই!
আমার কাহিনি শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু একসময় তো শেষ হতেই হবে। আরো অনেক কিছু আমার বলার ছিল, আরো অনেক ঘটনা, যেসব আমার সচক্ষে দেখা, যেমন বাগেরহাট থানার মির্জাপুর গ্রামের বহু মেয়ে অপমানিত হবার পরে নিজেরা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেউবা বিষপান করে অপমানের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। সেই সব কচি প্রাণের হিসাব কে রেখেছে?
আমি হলফ করে বলতে পারি, সমস্ত বাংলাদেশে আমাদের গ্রামের রাজাকারদের মতো আর কোনো রাজাকার তাদের নিজস্ব বাসভূমির ওপর, ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা প্রতিবেশী মানুষের ওপর, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা গ্রামবাসীর ওপর, এরকমভাবে সন্ত্রাস ও নৃশংস অত্যাচার চালায়নি।
তারা এরকমই নৃশংস ছিল যে, শেষের দিকে মানুষ জবাই করতে করতে এমন পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, এরপর মানুষ ধরে জবাই করার সময় সম্পূর্ণ গলা কাটতো না। অল্প একটু কেটে ছেড়ে দিত। এরকম চার-পাঁচজনকে অল্প একটু গলা কেটে ছেড়ে দিত, আর তারা হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছটফট করতে করতে মরে যেত।
সেই সঙ্গে আমার এ-প্রশ্নটাও মনে ওঠে যে, তাহলে এইসব রাজাকার প্রয়োজন হলে, টাকার লোভে, বা সম্পত্তির লোভে বা পদবির লোভে বা কারো তৈরি করা গদিতে বসার লোভে তাদের নিজেদের ঘরের মা ও বোনদের ধর্ষণ করতে পারতো? তাদের লেপ-কাঁথার ভেতরে জড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতো? আগুন ধরাবার সময় উল্লাসে হইচই করতে পারতো? গলা ছুরি দিয়ে একটুখানি কেটে ছটফট করে মরে যাবার জন্যে উঠোনে ফেলে রাখতে পারত?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমার এক মুহূর্তও দেরি হয় না।
আমার মন চিৎকার করে উঠে বলে, পারতো, পারতো, পারতো! অনায়াসে পারতো।
রাজাকার সব পারতো।
তবে সবচেয়ে বীভৎস এবং চমকপ্রদ ঘটনা যেটা সে-কথা বলেই আমি আমার এই তিক্ত স্মৃতির দরজায় তালা লাগিয়ে দেবো, নইলে আজ রাতে আমার ঘুম হবে না।
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রজব আলীর প্রিয় একজন বৃদ্ধ মানুষ আমাদের গ্রামে ছিল।
সে এত বৃদ্ধ ছিল যে বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটতো। পিঠ সোজা করে সে দাঁড়াতে পারত না।
সেই বৃদ্ধের ছিল একটি রামদা। সেই রামদাটিকে সে সকাল-সন্ধ্যা শান দিয়ে রাখতো। মানুষ জবাই করতে এই বৃদ্ধের খুব ভালো লাগত। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষ সে জবাই করেছে। কিন্তু খাড়া হয়ে কাজ করতে তার খুব কষ্ট হতো। যেহেতু তার কষ্ট হতো, তাই জবাই হতে যে- মানুষটিকে তার কাছে ধরে আনা হয়েছে, তাকে সে খুব মধুর স্বরে বলত, ‘বাবা, নিচু হও। তা নইলে কাটতে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বসে পড়ো, তোমাদের কষ্টও কম হবে, আমারও কষ্ট কম হবে।’
আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে এইসব নিধনের ইতিহাস বলতে হয়। আর নিধনের ইতিহাস বলতে গেলে মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা এইসব শয়তানের ইতিহাস বলতে হয়। এই শয়তানকে যারা লোভের যৌতুক দিয়ে জাগ্রত করে তাদের বিচারের পর শুধু একবার মাত্র ফাঁসি দিলেই সব শেষ হয়ে যায় না, বারবার করে ফাঁসি দিতে হয়। বারবার করে তাদের কবর থেকে উঠিয়ে ফাঁসি দিতে হয়।
এই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।
নইলে সেই পিশাচ বুড়োর মতো
যুগে যুগে আমাদের শুনতে হবে, ‘বাবা, নিচু হও!’ ৎ
সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.