বারবনিতা

আমাদের যৌথ পরিবার বাবা মারা যাওয়ার পরেও অনেকদিন টিকে ছিল। আমরা দু-ভাইবোন তখন ছোট। আমার বাবা, ছোট ফুপা আর ফুপার চাচাতো ভাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রাস্তা থেকে ছিটকে ইটবোঝাই ট্রাকের নিচে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। মা আর ছোট ফুপু গলাগলি ধরে অনেকদিন কাঁদল। একসঙ্গে একাধিকজন তাদের প্রিয়জন হারালে হারানোর বেদনা বোধহয় ভাগাভাগি হয়ে খানিক লাঘবও হয়। কয়েকমাস পর মা আর ছোট ফুপু একে অন্যের চুল বেঁধে দিতে গিয়ে কী নিয়ে যেন হেসে বারান্দার ওপর ঢলে পড়ছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে। ছোট ফুপু ছিল অকালবিধবা। আবার
বিয়ের শখ ছিল তার। কিন্তু দাদা বিধবা বিয়ের ঘোরতর বিরোধী। এমনকি বৈধব্য গ্রহণ করার পর দাদা মা আর ফুপুকে কোনোদিন রঙিন শাড়ি কিনে দেয়নি।
ওপর-নিচ মিলিয়ে এগারো কামরার দোতলা বাড়ি আমার দাদার। শান বাঁধানো পুকুর। ফুপুরা নাইওরে এলে চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোনে মিলে সারাবাড়ি একেবারে গমগম করত। কাজের লোকেরা দম ফেলার সময় পেত না। সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যায় তারা পুকুরে বসে বল সাবান দিয়ে মাথা ঘষতো, আর ছোট ফুপুর ব্যবহৃত ক্ষয়ে যাওয়া কসকো সাবান গামছায় এক পোঁচ মাখিয়ে এমনভাবে মুখ ডলতো যেন এক পর্দা চামড়া উঠিয়ে ছোট ফুপুর মতো সুন্দরী হয়ে উঠবে। তারা সাবান ঘষতো আর গাইতো –
বড়বাড়ির বড় মেয়ে লাম্বা মাতার চুল
তাতে জামোই পরি দিল সইঞ্জিমনির ফুল
রূপ দেইকি তার সুনু পাউডার গড়াগড়ি যায়
ও কি না হা রে-এ-এ-এ
সেই সময় একদিন আমার বাম রাজনীতির ভবঘুরে সেজ কাকু জেলা শহরে মিটিং সেরে রাত তিনটার ফরটিন ডাউন থেকে নেমে স্টেশনের ঘুটঘুট্টে অন্ধকারে উষ্টা খাওয়ার জোগাড়। পায়ে কী বাধল? কুকুর কুণ্ডলী হয়ে একটা প্রাণী ঘুমাচ্ছে। কেঁউ করে উঠল। কাকু টর্চ জ্বেলে দেখে দশ-বারো বছরের হাড্ডিসার এক মেয়ে প্লাটফরমের ওপর শুয়ে আছে।
‘এই মেয়ে, কার মেয়েরে তুই? এখানে কেন?’ কাকু হাঁটু গেড়ে বসে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করে।
মেয়েটি আ-উ করে পাশ ফিরে শোয়।
‘ওঠ ওঠ। চল আমার সাথে’ – বলে ওর হাত ধরে টেনে তুলে বাড়ি নিয়ে আসে।

যশোর পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউডে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করলাম বয়স যখন আমার চল্লিশ পেরিয়েছে। কিছুটা ধরাধরি করেই এখানে বদলি নিয়েছিলাম। কারণ ছিল। বাড়ির কাছাকাছি থাকতে পারবো, মাঝে মধ্যে গিয়ে আমাদের পুরনো দোতলা বাড়ির আঙিনায় হাতাভাঙা ইজিচেয়ার টেনে বসে বাঁশঝাড়ের পেছনে বুড়ি চাঁদের খুঁড়িয়ে ওঠা দেখবো। দাদা, চাচা, ফুপু, মায়ের কক্ষের আলাদা আলাদা গন্ধ নেবো। অকৃতদার সেজ কাকু তো হঠাৎ করেই আগেভাগে পৃথিবী ছেড়েছে। দাদি জীবিত অবস্থায় কড়িকাঠে ঝুলন্ত ছোট ফুপুকে দরজা ভেঙে নামানো হয়েছিল। আমার আম্মা আর এক ফুপু বিদেশে তাদের ছেলেমেয়েদের বাচ্চা মানুষ করেন। দাদা-দাদির কক্ষে পাই দোক্তার গন্ধ, আটার হালুয়ায় তেজপাতার গন্ধ, দাদির কেচে রাখা পুরনো শাড়ির গন্ধ। এটা ভীষণ টানে। আমরা চাচাতো-ফুপাতো বোনেরা তখন নতুন ঋতুবতী। দাদির পুরনো ধবধবে সাদা শাড়ি ছিঁড়ে ব্যবহার করতাম। একদিন চালের গুড়ি শুকানোর জন্য দাদি তার পুরনো কাপড়ের বাক্স খুলে একেবার হায় হায় করে ওঠে। সেখানে শুধু দশ-বারোটা শাড়ির পাড় সাপের মতো পেঁচিয়ে রয়েছে। এছাড়াও আমাদের শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, বকুলতলা, মেজ চাচার চিলেকোঠা কেবল স্মৃতির আয়নায় দেখেই আমার সাধ মিটতো না। মতির মা এখনো বাড়ি পাহারা দেয়। মতি বউ-বাচ্চা নিয়ে জমিজিরাত দেখভাল করে। আমার ভাই আমেরিকা থেকে কালেভদ্রে এলে ও দুদিন কাটিয়ে যায়। অন্য কাজিনদের বেশিরভাগই বিদেশে। এলে পরে একসঙ্গে কদিন বাড়িটাকে আমরা জীবন্ত করে তুলি। বাড়িটার খিলানে খিলানে চড়–ইয়ের বাসার ভেতর এ-বাড়ির গল্পগুলো জমে থাকে। একসময় কত কী ঘটে গেছে যে-বাড়িতে তার সবটুকু কি জানি?
কিছুদিন প্রশিক্ষণ বন্ধ ছিল। আমি যোগদানের পরপরই আবার শুরু হলো। মফস্বলের এসএসসি পাশ নিম্নমধ্যবিত্ত মেয়েদের খুব পছন্দের প্রশিক্ষণ। আমিই যখন এইচএসসি পাশ করলাম তখন আমাদের এক শরিক চাচা আমাকে মেডিক্যালে
চার-পাঁচ বছর ধরে না পড়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকের দেড় বছরের প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে কাজ করতে বলেছিলেন। এখানে যোগদানের পর সে-কথা খুব মনে পড়ছিল। এখন এ প্রশিক্ষণের চাহিদা এত বেড়েছে যে মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত অনুরোধ করে তাদের প্রার্থীকে প্রথম ব্যাচেই নেওয়ার জন্য। বলা তো যায় না আন্তর্জাতিক সংস্থার ফান্ডিং আবার কতদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়! এখন আর এসএসসি পাশ মেয়েরা পাত্তা পায় না। বিএ, এমএ পাশ মেয়েদেরই চাহিদা পূরণ করা যায় না।
‘ম্যাডাম, এক মহিলা এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে’ – বিরক্তিমুখে আমার অফিস সহায়ক জানালো। আগন্তুক কাপড়-চোপড়-চেহারায় স্মার্ট না হলে আমার সহায়ক এমন বিরক্ত হয়।
‘কী নাম? কে পাঠিয়েছে?’ – এলাকার এমপি বা সরকারদলীয় নেতার লোকজন হলে বসিয়ে রাখা ঠিক হবে না বলে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘নাম বললো ওফিরন না কফিরণ।’ মানে নামটাও তার পছন্দ হয়নি।
ওফিরন। ওফিরন। আমাদের বাড়ির সেই ওফিরন নয় তো? সে আসবে কোত্থেকে এতকাল বাদে? আর আমার এখানেই বা তার কী কাজ? অবশ্য এ-এলাকায় ওফিরন নামটা বেশ কমন। আসতে বললাম।
জাত কবি-সাহিত্যিকরা নাকি পাঁচ মিনিটেই মহাকাব্যের গল্প খাড়া করতে পারেন। আমাদের বাড়ি থেকে ওফিরনের চলে যাওয়ার দিনটি মুহূর্তে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার মতো আমার চোখে ভেসে উঠলো। ওফিরন তখন অষ্টাদশী সুন্দরী। অন্যান্য কাজের বুয়াদের মতো পুকুরে বসে সাবানে গা না ঘষেও ওফিরনের ত্বক দিয়ে জোনাকি বিচ্ছুরিত হতো। একদিন এক অমাবস্যার সন্ধ্যায় বছরের ধান কাটতে আসা চারজন ঠিকে মুনিষের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ লালন মজিদের সঙ্গে ছোট ফুপুর পুরনো কাতান পরিয়ে দাদি ওফিরনের বিয়ে পড়িয়ে দেন। আমরা দরদালানের উত্তরের চৌকোনা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। বিয়ে পড়ানো পাড়ার মক্তবের মোল্লাকে টাকা আর বাতাসা দিয়ে বিদায় করা হলো। লালন মজিদ খুশিতে বাগবাগ। পারলে তখনই গান ধরে ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময় অঅঅঅয় …’। মজিদ গতবছরেও ধান কাটতে এসেছিল। আমার ভাই ওর নাম দিয়েছিল লালন মজিদ। সে লালনের গান ছাড়া আর কিছু গাইতো না। কাজের চেয়ে গান গাইতো বেশি। সেজ কাকু বলতো, বাড়িতে সমাজতান্ত্রিক পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রতিবছরই মজিদের আগমন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রত্যেকে বাতাসা মুখে দিয়ে যে যার ঘরে কেটে পড়লাম। পরদিন সকালে ওদের দুজনকে আর দেখা যায়নি। আর কোনোদিনও না। এমনকি এতদিনের বিশ্বস্ত ওফিরনের অভাবও কেউ অনুভব করতো কি না জানা যায়নি। যেন ওফিরন নামে কেউ কোনোদিনও ছিল না। কিংবা ন-দশ বছরের অভ্যাসেও কেউ মনের ভুলে ডেকে ওঠে না ‘ওফিরন, বেশি করে ঝাল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে আন।’ ছোট ফুপুকে আমি একদিন মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম –
‘ওফিরন আর আসবে না?’
‘ওর কথা মুখে আনবি না। বজ্জাত বারোভাতারি মেয়েছেলে!’
হ্যাঁ, ওফিরনই। সেই টলটলে সোমেশ্বরীর থির জলে এখন বলিরেখার তরঙ্গ। অফিস সহায়ক পূর্বাবত বিরক্ত মুখ নিয়ে দরজায় দারোয়ানের মতো দণ্ডায়মান। আমি তাকে দরজা ভেজিয়ে চলে যেতে বললাম। ওফিরন আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর গায়ে সেই পুরনো গন্ধ। আচার, আমসত্ত্ব, রসুন, মশলা, সোডায় কাচা কাপড়ের ঘ্রাণ। ওকে কাঁদতে দিলাম কিছুক্ষণ। ওর ঘাড়ে জমা নরম শাড়ির ভাঁজ আমারও ক-ফোটা অশ্রু শুষে নিল। ওর যা কথা আছে বাসায় গিয়ে নিরিবিলিতে শুনবো বললাম।
একজন দিনমজুরের সংসার যেমন হয় তার চেয়ে ভালো ছিল না ওফিরনদের। লালন মজিদ চিরকালের ঘরভোলা মানুষ। গান যার সঙ্গী কাজ তার শত্তুর। তবে ওফিরনকে কোনোদিন অবহেলা করেনি। পরের বাড়িতে রান্নার কাজ করতে হয়েছে ওফিরনকে।
না করলেও চলতো কিন্তু মেয়েটাকে লেখাপড়া শেখানোর খুব শখ ছিল তার। ছেলে ছোট। লেখাপড়া করেনি। লালন ফকিরের মাজারে গিয়ে পড়ে থাকে, গাঁজা-ভাং খায়, জটা মাথায় দোতারা হাতে কালেভদ্রে বাড়ি আসে। দুদিন থাকতে বললে গান গাইতে গাইতে ফিরে যায় –
‘কমল-কোঠা কারে বলি, কোন মোকাম তার কোথা গলি …’
‘মেয়িডার খুব বিয়ি আসছে। ঘটক আমাগের ছিঁইড়ি খাচ্চে। তেবে আমি মেয়িডাক নিজির পায় দাঁড় না করায়ি বিয়ি দেব না। আইএ পাশ কইরি দুই বছর বসি রাখিচি। আমার মেয়িডার টেরনিংয়ের বেবুস্তা করা লাগবেনে বোলে বুবু’ – ওফিরন আমার হাত চেপে ধরে। ভিআইপিদের প্রার্থীদের জন্য চার-পাঁচটা সিট রেখে দেওয়া লাগে। প্রিন্সিপালেরও এখতিয়ার আছে তার নিজের দুজন প্রার্থী নেবার। দু-বছর বাদে প্রশিক্ষণ শুরু হওয়াতে এবার প্রায় সবাই ভিআইপিদের প্রার্থী। তালিকাও প্রস্তুত। কিন্তু ওফিরনের প্রতি কি আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই? ওফিরন কি ন-দশ বছর মুখ বুজে আমাদের দায়িত্ব পালন করেনি? ওকে কি আর একটু ভালো বিয়ে আমরা দিতে পারতাম না? ওকে এক রাতে বিয়ে দিয়ে কেন বিদায় করে দিতে হলো?
‘সৎমা মাইরি ধইরি বাড়ির তি বের কইরি দিলি পরে আমি রেলগাড়িতে উইঠি পড়ি। আমার বাড়ি কনে ছিলু তা আমার মনে নিকো। তেবে রেলের ধারে খেলা করতাম খুব। একেকবার মনে হইতু রেলের তলায় মাথা দিই। তখুন যে ক্যানে দিইনি …’ বলে ওফিরন মাথার ঘোমটা ফেলে খুলে যাওয়া খোঁপা আবার বাঁধে। এখনো ওর চুলে তেমন পাক ধরেনি। ওর ঘাড়ের ওপর একটা লালচে রঙের ছোট্ট তিল ছিল। ওটা এখন একটা কিসমিসে পরিণত হয়েছে। আঁচলের খুট থেকে পান নিয়ে মুখে পুরে যে-গল্প সে শোনালো তা বিশ্বাস করা যেমন কঠিন ছিল, তেমনি ওর সামনে বসে থাকাও দায় হয়ে উঠলো।
‘সেই ঘুরঘুট্টি রাত্তিরি তুমার সেজ কাকু ইস্টিশন তি আমাক তুইলি নিয়ি গেল তুমাগের বাড়ি। তুমার আর আমার বয়স তখুন সুমান সুমানই। তুমার দাদি-মা-চাচি-ফুপুরা খুব যত্ন কইরি আমাক কতদিন ভালো খাতি দিইলু, স্যান করাইলু, তুমার পুরুনু জামা আমার গায় একটু ঢিলকুই হইলু। দু-এক বছরের মদ্যি আমি গায়-গতরে তুমার চায়ু বড় হইয়ি উঠলাম। তকুন তুমাগের বাড়ি কত লোক কত লোক। তুমার বড় চাচার মেয়ির বিয়ির জন্যি কুটুমি কুটুমি বাড়ি ভরা। সেই পেত্থমবারের মতো তুমার বেধবা ফুপুর এক দেওর আমাকে কুপস্তাব দেয়। আমি রাজি না হলি সে বলে যে সে আমাক বিয়ি করতি চায়। তারপর তুমাগের বাড়ির বিয়ি শেষ হইলু, আমার মদু খাইয়ি যে চইলি গেল সে গেল জম্মের মতো।’ একটু দম নেয় ওফিরন। পাবনার তাঁতের শাড়ির সুতো জড়িয়ে যাওয়া পাড় টেনে টেনে সোজা করতে থাকে। যেন অনেক কাহিনি জড়িয়ে আছে ওই পাড়ের মতো তার জীবনে।
‘ইরপর তুমার বড় চাচার মেয়ি ছেইলি হতি নাইওরে আসলি পর যে রাতি ছেইলি হইলু সেই রাতি তুমার অপিসার দুলাভাই আমার ঘরে। সে চইলি যাবার পর তুমার ছোট ফুপু আমাক সাবধান কইরি দিলু। ও কথা সাতকান হলি আমাক পুঁইতি ফেলবে। বুইললো –
হারামজাদি, পুরুষমানুষগের সামনে কাজ করার সুমায় গায়-মাতায় ভাল কইরি কাপুড় দিতি পারিসনি? ফর্সা গতর দেকানোর ঠেলা কী এবার বোঝ!’
বড়াপা এখন মালয়েশিয়ায় থাকে। ওর দুই ছেলে। খুবই মেধাবী ওরা। দুলাভাই দায়িত্বশীল স্বামী হিসেবে আমাদের অন্যান্য জামাইকে টপকে সবসময় এক নম্বরে। ও মা গো! এই তার পরিচয়?
‘সিবার তুমরা সবাই বড় ফুপুর বাড়িতে বকরি ঈদ করতি গেইলি। তুমার দাদা তখুনু বাঁইচি। দাদা ভাল হাঁটাচলা করতি পাইরতো না বুইলি দাদি আমাক থুয়ি গেল। এছাড়াও বাঁধা মুনিষদের ভাত রাঁধা ছিলু। আমার আইজ আর তুমার কাচে লুকোনোর কিচু নেই। তুমার খারাপ ঠেকতি পারে। বুলতি পারো এদ্দিন বাদে এসব বুলছি কেনে। তুমার আশি বছরের দাদা গা-পা টিপার নামে আমার সারা শরীর হাতাইছে। আমি তো সে কতা কেউরি বুলতি পারিনি। আর আমার কতা কি কেউ বিশ্বাস কইরতু? আমি তো ভাত-কাপুড়-আশ্রায় পাইচ্চিলাম। বের কইরি দিলি কনে যাতাম? বেশ্যিপাড়া ছাড়া আমার কুনু ঠাঁই হইতু?’
আমার দাদাকে কোনোদিন নামাজ কাজা করতে দেখিনি আমরা। সারাজীবন তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আমাদের পারিবারিক মসজিদে পড়ে আসতে দেখেছি। এমনকি তিনি ইমামতিও করতেন মাঝে মধ্যে। শুধু পক্ষাঘাত হবার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর তিনি বিছানাগত ছিলেন। আমার ওরকম নামাজি দাদার এ-অবস্থা? মা গো!
‘তুমাগের বাঁধা মুনিষগুনুও ছাইড়ি দিইনি আমাক বুবু। তুমার বেধবা ছোট ফুপু আমাক খিতিলি কইরতো বেশি। অল্পবয়সী বেধবা, তার তো গার কামড় থাকতিই পারে। তুমার দাদা তো তাক নিকি বসতি দিলু না। আমাক ডাইকি ডাইকি গা বুক ডোলি নিতু। তার শরীলির মদ্যি হাত চালাতি হইতু আমাকে।’
‘থাম ওফিরন।’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ‘আর বলতে হবে না। আমি আর নিতে পারছি না। তোর মেয়ের ভর্তির কতদূর কী করা যায় দেখি। কাল নিয়ে আসিস একবার’ – বলে ওকে বিদায় করে দিয়ে দুই হাতের দশ আঙুলে মাথা চেপে শুয়ে পড়লাম। এতসব ঘটনার কিছুই জানি না আমি? এদেশে প্রায় সব বাড়িতেই ওফিরনরা থাকে। কত হত্যা, কত আত্মহত্যা, ভ্রূণ হত্যা, শিশু হত্যা, কত পলায়ন, কত নির্যাতন প্রতিনিয়ত চোখের আড়ালে ঘটে চলেছে আমরা তার কতটুকু জানি আর কতটুকুই বা বিশ্বাস করি? আমরা আমাদের সব গোপন কি সবাইকে বলি? ওফিরন কি আরো কিছু বলতে চেয়েছিল? কিছু গোপন করেছিল? এ ছার চিকিৎসকের জীবনে কম তো দেখিনি এসব! অন্য কোনো পেশায় থাকলে ওফিরনের কথা বিশ্বাস না-ও করতে পারতাম। একটা অসহায় মেয়ের সুন্দরী হওয়াও তো কম ঝক্কির না! ক্ষমা করে দিস ওফিরন, ক্ষমা করে দিস আমাদের।
পরদিন সকালে মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো ওফিরন। মেয়েকে বাইরে বসিয়ে রেখে অফিস সহায়কের সঙ্গে ঢুকলো সে। সহায়কের মুখে বিরক্তি তো নেই-ই কেন জানি অতি আগ্রহে ভরপুর। মেয়েটিকে ডেকে আনতে বলায় সে বিদ্যুৎবেগে ছুটে গেল। তার পরপরই যেন বিদ্যুল্লতা থমকে এসে স্থির হলো চোখের সামনে। মাথায় ওড়নার ঘোমটা দেওয়া নতমুখী মেয়েটি বিনয়ে আধখানা। স্বর্ণলতার মতো হাত দুটি অবিকল মায়ের মতো। আমি ওকে কাছে ডেকে ওর হাত ধরে থাকলাম। ওর গা থেকে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ এসে আমাকে আমূল আন্দোলিত করলো। যে-ঘ্রাণ নেওয়ার আশায় এই উত্তর চল্লিশে আমি বাড়ির কাছাকাছি বদলি হয়ে এসেছি। আমাদের খিড়কির দরজার বাইরে ভাতের চাল ধোয়া পানি রাখা কাত হয়ে থাকা মেটে হাঁড়ির ঘ্রাণ, বর্ষা সরে গেলে ছাদের ঢালু কোনায় গজিয়ে ওঠা ব্যাঙের ছাতার ঘ্রাণ, বুড়িছুট খেলতে গিয়ে তারে শুকানো মায়েদের শাড়ি নাকে পেঁচিয়ে গেলে খেলা ফেলে তার ঘ্রাণ, বাহির বাড়িতে সারারাতের ভেজা বিচালি গাদার ঘ্রাণ। ওফিরনের মেয়ের গায়ে আমাদের বাড়ির প্রতিটি কক্ষের আলাদা আলাদা ঘ্রাণ। আমাদের বাড়ির ঘ্রাণ। আমাদেরই বড়ির ঘ্রাণ।
হেমন্তের ভোরগুলোয় মোরগ বাগ দেবার আগেই ভাড়ার ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে লালন মজিদের দরাজ কণ্ঠের গানটি অনেকদিন পর গেয়ে উঠলো মন ‘ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়, আপন ঘর না বুঝে বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়…।’