বিজয়রথের যাত্রাপথ

একান্ন বছর আগে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম – পাকিস্তানের প্রায় এক লাখ সৈনিক তাদের সেনাপতিসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা এই গৌরবের চিত্র যেমন মনে রাখব, তেমনি ঘটনাটি যে অর্ধশত বছর আগের সে-কথাও ভুলব না। সে-কথা মনে রাখা জরুরি। কারণ মানুষ এবং তার ইতিহাস সবসময় চলমান, পরিবর্তনশীল।

একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর অপরাহ্ণে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পড়ন্ত রোদের আলোয় আমাদের যে বিজয়রথ এসে সগৌরবে থেমেছিল তার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। সে-কথায় যাওয়ার আগে প্রাসঙ্গিক দুটি বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরা দরকার।

ব্রিটিশ-পূর্বকালে উপমহাদেশের বাংলাসহ অধিকাংশ অঞ্চলই মুসলমান শাসকদের অধীনে ছিল। ভারতবর্ষে মুসলিম অভিবাসনের সূচনা হয়েছিল সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজদের কাছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা হয়ে একে একে রাজ্য-হারানোর প্রেক্ষাপটে এদেশের অভিজাত মুসলমানদের উচ্চতর শ্রেণির অভিমান, স্বাতন্ত্র্য ও অহংবোধ বেশ ভালো রকম ঘা খেয়েছিল। তাই শাসকদের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। এদিকে যে-কোনো বহিরাগত শাসকের চাই স্থানীয় সহায়ক গোষ্ঠী। ইংরেজদের সেই চাহিদা পূরণ করেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত ও উচ্চাভিলাষী মানুষ। সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শাসকদের সহযোগী গোষ্ঠীরও সার্বিক অগ্রগতি ঘটেছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে উপমহাদেশের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে – তাদের পারস্পরিক ব্যবধান বেড়েছে, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বহুমাত্রিক প্রকাশও ছিল স্বাভাবিক ফসল। ব্যবধান, বিভেদ ও বিরোধের  আর্থিক, বৈষয়িক, প্রশাসনিক, সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক ইত্যাদি বহুতর মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে এবং তা প্রকট হয়েছে দিনে দিনে। আবার আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমের রেনেসাঁস-উত্তর উদার মানবিক দর্শন ও নব্য বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে এদেশের যে নতুন মানবিক জাগরণ ঘটেছে তাতেও হিন্দুরা গেল এগিয়ে। এদের মধ্যে আত্মপরিচয়, আপন ঐতিহ্য ও

সংস্কৃতি সম্পর্কেও আগ্রহ বেড়েছে। একে সামষ্টিক পরিচয়ে সহজেই হিন্দুজাতির উত্থান হিসেবেও দেখা যায়। তাছাড়া হিন্দুধর্মে কিছু সংস্কার হলেও নিম্নবর্গের তাতে হিন্দু ও অপর ধর্ম, বিশেষত প্রতিবেশী মুসলমানকে, সামাজিক সম্পর্কে অন্তর্ভুক্ত করার মতো বাস্তবতা ছিল না। এ সময়ে বরং জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনা জোরদার হয়েছিল। একসময় এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ঘটল প্রতিবেশী সম্প্রদায়ে। মুসলমানরাও ইংরেজি শিক্ষায় ঝুঁকল, ইংরেজের সাহচর্যে চাকরি ও ব্যবসায় যুক্ত হলো, এবং এ-সম্প্রদায়েও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তার ধারা তৈরি হলো। যত দিন গেছে ততই ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হলো, উভয় সম্প্রদায়ে দূরত্ব ও বৈরিতা বাড়ল। দাঙ্গা তথা পারস্পরিক হানাহানি, ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তপাতের পটভূমিতে দেশভাগ হলো – ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো।

দুই

পাকিস্তান আনার সংগ্রামে বাঙালি মুসলমানের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। জিন্নাহ নিজে ভাবতেন, অনেক সময় বলতেনও এবং বাস্তবেও কথাটা অনেকটাই সত্য যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একক নেতৃত্বের ফসল। পাকিস্তান আন্দোলনে বা মুসলিম লীগে জিন্নাহর সমকক্ষ বা কাছাকাছি মর্যাদায় ও ভূমিকায় কেউ ছিলেন না, অন্যরা ছিলেন তাঁর অনুসারী ও অনুগ্রহভাজন। কিন্তু বণিক সম্প্রদায়ের প্রান্তিক-মুসলমান জিন্নাহর না ছিল ইসলামি সংস্কৃতি ও দেশীয় মুসলমান সমাজের সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠতা, বন্ধন বা চর্চার অভ্যাস, না তিনি ছিলেন

সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে একজন খাঁটি ভারতবর্ষীয় বা উপমহাদেশীয়। ইসলাম বা ভারতবর্ষ কিংবা ভারতবাসী বা মুসলমান হিসেবে কোথাও তাঁর শিকড় ছিল না। তাঁর পক্ষে সহজেই ইংরেজের পোশাকের মতোই তার ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। আবার বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে সর্বনিম্ন ঝুঁকিতে সর্বোচ্চ লাভ আদায়ই তাঁর সহজাত লক্ষ্য। এটা সম্ভব একক সিদ্ধান্তে চললে, পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম লীগে তিনি কারো সঙ্গেই নেতৃত্ব বা সিদ্ধান্ত ভাগ করে নেননি। আবার এটাও মানতে হবে যে, জিন্নাহ ভারতের জাতীয় নেতাদের কাছ থেকে যথাযথ কদর পাননি, সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ওদিক থেকে গরজ দেখা যায়নি। ফলে জিন্নাহর মতো প্রখর আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত অভিধা পেয়েও সেই জায়গা থেকে সরে আসতে দ্বিধা করেননি। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, কংগ্রেস নেতৃত্ব যদি সেদিন সহনশীল উদার মনোভাব দেখিয়ে জিন্নাহকে সঙ্গে রাখতেন, তাহলে পরবর্তী ইতিহাস হয়তো ভিন্নরকম হতো, এত রক্তপাত ও দীর্ঘ ট্র্যাজেডির দায়ও বহন করতে হতো না।

জিন্নাহতে অনেক মানুষ মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন; কিন্তু তিনি নিজে সেই মানুষদের একজন ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ একক মানুষ। তাঁর পক্ষে সাধারণ বাঙালির সহজিয়া মানবতাবাদ আর শিক্ষিত বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ও এর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের আবেগ ও অহংকার বোঝা ছিল দুঃসাধ্য। পশ্চিমের চারটি প্রদেশের মানুষ ইংরেজ আমল থেকেই উর্দুভাষায় লেখাপড়া করে উর্দুকে তাদের প্রমিত ভাষামাধ্যম হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাদের পক্ষে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালির ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল বিপরীত।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ যখন সকল জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক ভেদাভেদ ভুলে এক পাকিস্তানি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং সেই লক্ষ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপানোর জেদ ধরেছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল পাকিস্তান নিয়ে জনগোষ্ঠীর, অন্তত বাঙালি অংশের, আকাক্সক্ষা সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার ছিল না। ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতেই শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান তাঁর জেদি ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। এ নিয়ে শিক্ষিত বাঙালির ঐকমত্য সকল রাজনৈতিক মতপথের বিভাজন ভেঙে দিয়েছিল। মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতো বয়স্ক ধার্মিক মুসলমান, ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ^াসী তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক আবুল কাশেম ও অন্যরা যেমন জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন, তেমনি বামপন্থী, কংগ্রেসী ও মধ্যপন্থীরাও প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। কংগ্রেস ও বামপন্থীদের কোনো কোনো অংশ ব্যতীত এঁরা সকলেই পাকিস্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহ ও পাকিস্তান সরকারের জবরদস্তি ও চালাকি কেউই গ্রহণ করেননি, মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে তাঁরা আপসে রাজি হননি। শিক্ষিত বাঙালির এই বৃহত্তর ঐক্য, দেশব্যাপী গ্রামবাংলার জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে  যেতে দেরি হয়নি মূলত জিন্নাহর মৃত্যুর পরেও ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের একতরফা বৈরী সিদ্ধান্ত ও দমন-পীড়নের কারণে।

তিন

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি বাহিনীর গুলিতে ছাত্রদের শাহাদাৎবরণ ভাষার প্রশ্নে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার সব বাধা ভেঙে চুরমার করে দেয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি বাঙালিমাত্রের প্রাণের দাবি হয়ে ওঠে। এ-সময় ভাষা, সাহিত্য,সংস্কৃতি নিয়ে যেমন তৈরি হয়েছে প্রবল আবেগ, তেমনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমেই বেড়েছে প্রতিরোধের জোশ। এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৯৫৪-র নির্বাচনে, হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করল, আর পাকিস্তান আন্দোলনের  বাহন মুসলিম লীগের হলো ভরাডুবি। এরপর থেকে পাকিস্তান সরকারের দিক থেকে জাতি হিসেবে বাঙালি ও অঞ্চল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈরিতা বেড়েছে, আমাদের প্রতি রীতিমতো উপনিবেশের আচরণ করা হয়েছে। তারাই একতরফা শাসক হয়ে পূর্ব বাংলায় শোষণ-বঞ্চনা লুণ্ঠন চালিয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা সকলেরই জানা আছে, কেবল লক্ষ করতে হবে, পাকিস্তানের সকল শাসক ও সরকার ধারাবাহিকভাবে বাঙালির  বিরুদ্ধে এ বৈষম্য ও বঞ্চনা, সন্দেহ ও অভিযোগ, দমন ও পীড়ন চালিয়ে গেছে। তাতে পূর্ণতা পেয়েছে ভাষা-আন্দোলনের সময়ে সূচিত ভাষা-সংস্কৃতির আবেগ – এ-আবেগ একেবারে পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী চেতনায় সকল পর্যায়ের মতপথের মানুষকে এককাতারে নিয়ে এলো।

যথার্থ নেতৃত্ব ছাড়া তো আর জনগণের এরকম বিদ্রোহী  জাগরণ বিভিন্ন বাধা ডিঙিয়ে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে না। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় বাঙালি রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ রাষ্ট্রের প্রস্তাবের উত্থাপক ও অখণ্ড বাংলার এককালের প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন সবার বয়োজ্যেষ্ঠ ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা। এছাড়া ছিলেন কৃষক নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, দেশভাগের সময়কার বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দী সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও যুক্তফ্রন্টের অন্যতম চিন্তক আবুল মনসুর আহমদসহ আরো অনেক নেতা। এঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তরুণ মুজিব মুসলিম লীগের কর্মী ও সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হলেও প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের প্রবণতা ছিল বেশ জোরালো। তার কিছু প্রকাশ তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, অভিজ্ঞতা যতই বেড়েছে ততই জ্যেষ্ঠ ও সমকালীন নেতাদের সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ হচ্ছে, এবং তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই সত্য যে, এভাবে বাঙালির উন্নতি বা মুক্তি অর্জিত হবে না। যুক্তফ্রন্ট গঠন করার সময় প্রধান নেতাদের পারস্পরিক মতান্তর, খামখেয়ালিপনা, দোদুল্যমানতা এবং নানান সুবিধাবাদের পরিচয় বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে সবিস্তারে বলেছেন। আর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার পরিণতি দেখে ক্ষুব্ধ মুজিব না বলে পারেন না – ‘এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়েও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ২৭৩)

চার

ভাষাকে কেন্দ্র করেই যেহেতু বাঙালির জাগরণ ঘটেছিল এবং পাকিস্তানের দিক থেকে যেহেতু বারবার যে জাতীয় তমদ্দুন বা সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা চলছিল, তা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছিল, এমনকি তার অস্বীকৃতি ঘটাচ্ছিল, তাই এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষিত বাঙালিদের মনে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রবলতর হয়ে প্রকাশের পথ খুঁজছিল। এই চেতনার জাগরণকে আরো শক্তিশালী করেছিল এদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে প্রথম এমন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে ১৯৫১ সালের ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯শে  মার্চ। এই সম্মেলনের মূল সভাপতি নির্বাচিত হন পুঁথি সংগ্রাহক ও গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। এতে যোগ দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কলিম শরাফী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এবং শিল্পী আমিনুুল ইসলাম, হামিদুর রাহমান, বিজন চৌধুরী প্রমুখ। কমিটির সভাপতির ভাষণে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য আবর্জনা নহে, উপেক্ষণীয় নহে, তুচ্ছ বস্তু নহে। অন্যদেশের সাহিত্যিকদের মত আপনারাও ইহার উপর আপনাদের সাহিত্যের ইমারতের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিতে সক্ষম হইবেন।’

এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে লিখে গেছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম – চট্টগ্রাম শহর মাতিয়ে শিল্প ও সঙ্গীতের বিশেষ করে কলকাতার সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের নিয়ে বাংলাদেশে এই প্রথম সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন। এ দেশের জনচেতনায় যে এক বিশাল প্রভাব ফেলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই, যার স্বাভাবিক এবং সর্বোচ্চ প্রকাশ আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। …

পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন দৈনিক ‘সত্যযুগে’র সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘের একটি স্কোয়াড এবং সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ^াস, হেনা বর্মণ, ওস্তাদ বাহাদুর খান প্রমুখ শিল্পী-সাহিত্যিকরা। এই সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও বিশ^শান্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। মানুষের মঙ্গল করার সদিচ্ছাকে অঙ্গীভূত করে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে, এক দেশের ওপর অন্য দেশের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মানবতার পক্ষে এই সম্মেলন হয়ে ওঠে একটি গণতান্ত্রিক ঐক্যমঞ্চ।’

(বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, পৃ ৪২-৪৩)

চট্টগ্রামের সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ১৯৫২ সালের ২২, ২৩ ও ২৪ আগস্ট কুমিল্লায় পূর্ব পাকিস্তান

সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানেও মূল সভাপতির ভাষণে বর্ষীয়ান পুঁথিসংগ্রাহক সাহিত্যবিশারদ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনগুলির সকল অনুষ্ঠান, বক্তব্য ও প্রকাশনা অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে আমাদের সমাজের চিন্তাশীল মানুষেরা প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁদের গভীর ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে কুমিল্লা সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘আহ্বান’ নামক আবেদন থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায় – যাঁহারা এ দেশের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাদানে নিরত, যাঁহারা সাহিত্য রচনা করেন, সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ অন্তরে পোষণ করেন; সঙ্গীতে, চিত্রে যাঁহারা প্রাণের সন্ধান পান, দর্শন বিজ্ঞানের সাধনায় যাঁহাদের জীবন ব্যয়িত হয়, সেই সব শিক্ষাব্রতী সাহিত্যিক সাহিত্যানুরাগী শিল্পী-দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের উপরই পড়িয়াছে জাতির মানস সংস্কৃতি উন্নয়নের মহৎ ভার। লক্ষ লক্ষ মøান মূঢ় অন্তর আজ তাঁহাদেরই মুখের দিকে চাহিয়া আছে। তাঁহারাই যে জাতির প্রতিনিধি। তাহাদিগকেই যে আজ জাতির মূক মুখে ভাষা দিতে হইবে, অন্তরে আশা ধ্বনিয়া তুলিতে হইবে। …

‘চিন্তা-নায়ক, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সমবেত প্রচেষ্টাই এই কার্যকে দ্রুত সাফল্যের পথে লইয়া যাইতে পারে। অবকাশ ও সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ইহার জন্য সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্মেলন প্রয়োজন।

(স্মৃতির সন্ধানে, পৃ ৪৪৭)

এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার কার্জন হলে ১৯৫৪ সালে আয়োজিত হয় তিন দিনের পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। এখানে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বহুউদ্ধৃত ঐতিহাসিক যুগান্তকারী বক্তব্যে হিন্দু-মুসলমানের দাঁড়ি-টিকি, লুঙ্গি-ধুতির পার্থক্যকে বাহ্য বিষয় আখ্যা দিয়ে অন্তরে যে প্রকৃতি তাদের এক বাঙালি করেই সৃষ্টি করেছেন সে-কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তারপরেও সাহিত্যের প্রশ্নে আরো স্পষ্ট করেছেন তাঁর অবস্থান – আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবী ফারসী শব্দের অবাধ আমদানী প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল আকুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসল। তারা এইসব মাতলামিতে এমন মেতে গেলেন যে, প্রকৃত সাহিত্যসেবা, যাতে দেশ ও দশের মঙ্গল হতে পারে, তার পথে আবর্জনার স্তূপ দিয়ে সাহিত্যের উন্নতির পথ রুদ্ধ করেই খুশীতে ভূষিত হলেন না, বরং খাঁটি সাহিত্যসেবীদের নানা প্রকাশে বিড়ম্বিত ও বিপদগ্রস্ত করতে আদাজল খেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। … ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং অন্যান্য পশ্চিম বঙ্গের কবি ও সাহিত্যকগণের কাব্যগ্রন্থ ও আলোচনা এমনিক বাঙ্গালি নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে থাকলেন। কেউবা এতে মিলিত বঙ্গের ভূতের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আবোল তাবোল বলতে শুরু করে দিলেন এবং বেজায় হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন।

এই ধারার সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারি (টাঙ্গাইল) সম্মেলন। তাতে আরো বড় আকারে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছিল। এখানেই মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশে নিজের পথে চলবার কথা বলেছিলেন।

এসব সম্মেলন প্রদেশে প্রগতিশীল সংগ্রামকে জোরদার করেছিল এবং এর পেছনে কবি-সম্পাদক-সংগঠক মাহবুব উল আলম চৌধুরী-সম্পাদিত সীমান্ত পত্রিকার মতো প্রকাশনার ভূমিকা কত বড় ছিল তা স্পষ্ট হয় চট্টগ্রাম সম্মেলনের অন্যতম কর্মী ইবনে গোলাম নবীর ১৯৯৭ সালের স্মৃতিচারণ থেকে –

চট্টগ্রামের সীমান্ত পত্রিকা ও তাকে অবলম্বন করে

সাংস্কৃতিক বৈঠকের প্রচেষ্টায় যে প্রগতিশীল ক্রিয়াকর্মের শুরু হয়েছিল তারই সফল পরিণতি ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন, ১৯৫২ সনে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত

সাংস্কৃতিক সম্মেলন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কার্জন হলের সেই বিখ্যাত সম্মেলন। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী। চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে দেশব্যাপী এ ধরনের সম্মেলন করা তখনকার দিনে সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অবদান শীর্ষে। 

                                  (স্মৃতির অতলে, পৃ ৩৩৪)

আবারো বলব, সীমান্ত একা নয়, এরকম নিয়মিত ও অনিয়মিত অনেক প্রকাশনাই সেদিন গণজাগরণে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। আইয়ুবের সামরিক শাসনের মধ্যে এসে পড়েছিল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। আগেকার প্রতিটি সম্মেলনের মতোই এটি উদযাপনে পাকিস্তান সরকারের দিক থেকে প্রবল বাধা এসেছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ১০, ৭, ৫, ৩ বা ১ দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদ্যাপিত হয় বাঙালির বিশ্বমাপের কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে আয়োজিত অসংখ্য সেমিনার, সম্মেলন, স্মরণিকা ও পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যার অজস্র লেখা ও আলোচনা রবীন্দ্রসাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এসবে তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্বদেশে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের নানা দিক আলোচনায় উঠে আসে।

তারপর থেকে আমরা লক্ষ করব, ঢাকায় তো বটেই, দেশের অন্যান্য জেলা শহরেও বিভিন্ন উপলক্ষে বড় আকারে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। বাংলা একাডেমি, লেখক সংঘ, ডাকসু, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে মানবতাবাদী ও বাঙালি চেতনায়

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। এসব উপলক্ষে পুরো ষাটের দশক জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ নানান সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। তখন প্রদেশে ছাত্রসমাজের পরিসর বেড়েছে, ছাত্র সংগঠন হয়ে উঠেছে রাজনীতির অগ্রবাহিনী এবং ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গভীর বন্ধন। এ সময় দেশচেতনা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় গণমানুষের আবেগ নানাভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো – সব শহরে-গঞ্জে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস উদ্যাপন। তখন থেকেই বেশিরভাগ জেলা ও প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব শহিদ মিনার নির্মাণও শুরু হয়েছে। একুশের প্রত্যুষে নগ্নপায়ে ছাত্র-জনতার মিছিল, কুয়াশা ভেদ করে সমবেত কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি গাওয়া, কখনো মিছিল থেকে ভাষা, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসনের সেøাগান উঠেছে। এ উপলক্ষে ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংগঠন প্রকাশ করেছে একুশে সংকলন, তাতে থাকছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ। প্রবীণ আবুল ফজল থেকে শুরু করে নবীন আনিসুজ্জামান, ডাকসাইটে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী থেকে তরুণ আহমদুর রহমান, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত নামি অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী থেকে তরুণ হায়াৎ মামুদ, প্রবীণ বামলেখক রণেশ দাশগুপ্ত থেকে তরুণতর মফিদুল হক সকলেই তখন লিখছেন, নানা সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। সারা প্রদেশ জুড়ে ছাত্র-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী এবং সচেতন রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে যেন আসন্ন স্বাধীন বাংলাদেশের মঞ্চসজ্জা ও প্রেক্ষাপট রচনার কাজ করে গেছেন।

পাঁচ

এমন সময়ে বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন স্বায়ত্তশাসনের – ছয় দফার মধ্য দিয়ে যেন স্বরাজের ডাক এলো। এবারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক-জনতার মধ্যে বাংলাদেশের চেতনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সচেতন সৃজনশীল মানুষের পক্ষে দেশের এই ডাক উপেক্ষা করে থাকা আর সম্ভব ছিল না। তখন সর্বত্র হচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, অনেক বাম সংগঠন তিন কবিকে মিলিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী শুরু করেছে এসময়। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বাঙালির এই সাংস্কৃতিক জাগরণে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সময়ে রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলি ফিরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে একালেও রচিত হচ্ছিল প্রাসঙ্গিক গণসংগীত। সারা প্রদেশ যেন জেগে উঠেছিল প্রগতিশীল সংস্কৃতি চেতনায়, ছাত্র-তরুণদের মধ্যে প্রগতিশীল মানবতাবাদী সংস্কৃতি চেতনার বান ডেকেছিল। এ যেন বিপ্লবের জন্যে অধীর অপেক্ষায় থাকা জনগণ। মানুষ তার পেশা, জীবিকা ও প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে নিজেকে কেবল বন্দি করতে চাইল না। তার মধ্যে যে দেশপ্রেমিক মানুষটির জাগরণ ঘটেছে সে নিজের প্রয়োজন ছাড়িয়ে দেশের ও মানুষের কাজ করতে আকুল। ফলে এ-সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ঘর-সংসারের গণ্ডি ভেঙে বাঙালি নেমে এসেছিল রাজপথে, সমাবেশস্থলে, শহিদ মিনারে জমায়েত হয়েছে, কোনো মিলনায়তন বা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে মেতে উঠেছে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ আয়োজনে। যেভাবে ব্যাপক আকারে উদ্যাপিত হয়েছে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী, তেমনি বিশাল আকারে আয়োজিত হলো রুশ ঔপন্যাসিক মাক্সিম গোর্কির জন্মশতবার্ষিকী। শহরে শহরে পালিত হলো রুশ বিপ্লবের সুবর্ণজয়ন্তী, উদ্যাপিত হলো রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের জন্মশতবর্ষ। এসব অনুষ্ঠানমালায় আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে নানা অনুষঙ্গ যুক্ত হতে থাকল। গানের ভাণ্ডারে যেমন বঙ্গভঙ্গকালীন এবং চল্লিশের দশকের বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের, বিশেষত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংগ্রামী দেশচেতনার গান যুক্ত হয়েছে তেমনি রচিত হয়েছে সমকালের প্রেক্ষাপটে অনেক গান। চারুশিল্পীরা আল্পনা আর পটচিত্রের নানা বৈচিত্র্য এনে সজ্জায় দেশীয় রূপ ফুটিয়ে তুললেন। নতুনভাবে চালু হলো খদ্দর। সে এক জাগরণীর এলাহিকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু সেই জাগরণের নেতা। কখনো বন্দি, কখনো মুক্ত, কিন্তু সবসময় এগিয়ে চলার সাথি ও সারথি।  সব বাধা, সকল স্বৈরাচারী রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেবল এগিয়ে চলার ব্রত তাঁর। আগরতলা মামলা আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছয় দফার সংগ্রামী নেতাকে বাঙালির মহানায়কে রূপান্তরিত করেছে।

এই পটভূমিতে সত্তরের নির্বাচনে মানুষ কেবল আওয়ামী লীগকেই বিজয়ী করেনি, তারা কেবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তির সনদ ছয় দফাকে বিজয়ী করেনি, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তানবাদকে পরাজিত করেছে এবং বাংলাদেশের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এরপরে আমাদের দিক থেকে স্বাধীনতা ছিল সময়ের ব্যাপার। কারণ জনগণের এই বিজয় এবং বিজয়ের এই দাবি থেকে পিছু হটার উপায় ছিল না। হয়তো বিষয়টা ছিল আমাদের স্বাধীনতা কি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হবে, এটা কি স্বায়ত্তশাসনের ধাপ পেরিয়ে তার পূর্ণ রূপে ধরা দেবে, নাকি সত্যিই পাকিস্তান সরকার ও তাদের সামরিক বাহিনী জেদ ধরে যুদ্ধের দিকে আমাদের ঠেলে দেবে। তারা যুদ্ধই বেছে নিয়েছিল, আক্রমণ ও হত্যার পথ ধরেছিল, শত্রুতা ও চক্রান্তের বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল। আর মুজিবের অনুসারী জয়বাংলার সৈনিক বাঙালি ধরেছিল তাঁরই ৭ই মার্চের দৃপ্ত ঘোষণা বাস্তবায়নের পথ – স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে তারা ছিল আপসহীন, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সে ছিল বীরত্বের, ত্যাগের পথ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথ, সংগ্রাম ও বিজয়ের পথ। সেই পথের শেষে গন্তব্যে পৌঁছেছি আমরা নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে।

তখন ১৬ই ডিসেম্বরের শীতবিকেলের পূর্ব-পশ্চিম দিগন্তে লালিমা ছড়াচ্ছিল, সে-আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল রমনার সবুজ চত্বর – আর সেই লাল-সবুজের অপরূপ আলোয় আমাদের বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ যেন বাংলার ও বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল।

ছয়

তবে ইতিহাস তো একটি যাত্রা, প্রায়ই অভিযাত্রা – মহাকালের বৃহৎ পরিসরে ক্লান্তিহীন পথচলা। কখন যেন সেই আনন্দ-মুখরিত সময়ের পরে অর্ধশত বছরেরও বেশি অতিবাহিত হয়ে গেল। বিজয় অর্জনের পরে বন্দিশালা পাকিস্তান থেকে ফিরে প্রথম পর্বে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও নতুন রাষ্ট্রের অভিযাত্রার বুনিয়াদ গড়ার কাজে যখন হাত দিয়েছেন তখনই তিনি সপরিবারে নিহত হলেন। জেলহত্যার মাধ্যমে নিহত হলেন চার জাতীয় নেতা, যার অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ। শুরু হলো বাংলাদেশের পিছনে ফেরার যাত্রা। সে উল্টোযাত্রা রদ করে পুনরায় নিজস্ব খাতে স্রোতস্বিনীকে ফেরাতে ফেরাতে বিশ^জুড়ে যেন এলো পালাবদলের নতুন যুগ – বিশ^ায়ন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ও নতুন প্রযুক্তি যেন হুড়মুড় করে যুগপৎ অনেক সমস্যা ও সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো বিশ্ববাসীকে। নবযুগের বার্তা পেয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বাংলাদেশ এগিয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে মনে হয় নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ও অঙ্গীকার সেগুলির পুনঃসংজ্ঞায়ন, পুনর্মূল্যায়ন ও নবীকরণ প্রয়োজন। নয়তো এ কেবল আপ্তবাক্যে পরিণত হবে। পরিবর্তন স্বাভাবিক, কিন্তু বুঝতে হবে, চেতনা তখনই কালজয়ী হয় যখন তা কালের এই পরিবর্তিত ইস্যু ও এজেন্ডার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারে। এখন ইতিহাস আমাদের সামনে সেই দায় পূরণের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে।