বিদায়ব্যথার ভৈরবী

আবুল হাসনাতকে আমি বরাবর ভাই বলতাম, তিনি বলতেন বন্ধু। যদিও বয়সে আমি ছোট, তিনি বরাবর ‘আপনি’ এইভাবে সম্বোধন করতেন, বলেকয়েও তাঁকে দিয়ে ‘তুমি’ বলাতে পারিনি। প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালে, মুক্তিযুদ্ধের পর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়নের নতুন কার্যালয়ে। আমরা তখন ব্যস্ত জয়ধ্বনি এই নামে একটি ট্যাবলয়েড সাইজের কাগজ ছাপাতে। প্রায় প্রতিদিন বিকালে এখানে আসা হয় অভিন্নহৃদয় বন্ধু খান মোহাম্মদ ফারাবীর সঙ্গে, তার মোটরসাইকেলে। হাসনাতভাই এখানে আসতেন কখনো-সখনো। 

সেই বছরের শেষে অথবা ১৯৭৩-এর গোড়ার দিকে বেরুলো সাহিত্য পত্রিকা গণসাহিত্য। হাসনাতভাই ছিলেন, সঙ্গে তাঁর দুই কমরেড, মতিউর রহমান ও মফিদুল হক। সকল পরিকল্পনা ও সম্পাদনা এই তিন নিকটবন্ধুর সম্মিলিত চেষ্টায়। পশ্চাতে হয়তো আরো কেউ কেউ থেকে থাকতে পারেন, আমরা তাঁদের খোঁজ পাইনি। ফারাবী ও আমি গোড়া থেকেই তাঁদের ফাই-ফরমাস খাটার মানুষ। কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি, ফারাবী অর্থনীতিতে – আমি ইংরেজি সাহিত্যে। ইচ্ছা লেখক হবো। ফলে সহজেই গণসাহিত্যে জুটে গেলাম, হাসনাতভাই ও মফিদুলভাইয়ের স্নেহের ছায়ায়। মতিভাই তখন দলের কেন্দ্রীয় নেতা, সম্ভবত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেক্রেটারি, তাঁর নাগাল পাওয়া কিঞ্চিত দুরূহ।  

কমিউনিস্ট পার্টির নাম কোথাও না থাকলেও এর পেছনে যে পার্টির শক্ত সমর্থন রয়েছে, সেটা আমাদের জানা ছিল। কলকাতার নামজাদা সাহিত্য পত্রিকা পরিচয়ের ধাঁচে, স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা রচিত হবে এই পত্রিকার হাত দিয়ে, এমন একটি গোপন অভিপ্রায় হয়তো আমাদের জ্যেষ্ঠ কমরেডদের ছিল। রাতারাতি নতুন বাংলাদেশের সেরা লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন মিলল। বাংলাদেশের সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল এদেশের বামপন্থী – একসময় যাদের মস্কোপন্থী বলা হতো – সেইসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এদের সকলের মুখপত্র হয়ে উঠল গণসাহিত্য। রাজনীতি ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক; কিন্তু কখনো কখনো রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করতে সংস্কৃতি অগ্রবর্তী ভূমিকা নেয়। বাংলাদেশে এই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকবার হয়েছে, সবচেয়ে স্মরণীয় ১৯৫২ সালে, যখন ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন অনায়াসে রূপান্তরিত হয়েছিল স্বাধিকার-আন্দোলনে। ঠিক সেই রকম একটি ভূমিকা সম্ভবত গণসাহিত্যের জন্য ভাবা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির এই তিন কমরেড – মতিউর রহমান, আবুল হাসনাত ও মফিদুল হক – সে-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বপ্নচারী।

ফারাবী ও আমি প্রথম সংখ্যা থেকেই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুক্ত ছিলাম বলাটা হয়তো অতিশয়োক্তি, বস্তুত জোগালির কাজ ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা আমাদের ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কথা দিয়েছেন লেখা দেবেন। সেটা আনতে হবে। বিটপীতে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি হয়ে আছে, রামেন্দু মজুমদারের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে। প্রথম প্রুফ দেখা শেষ, দ্রুত তা পৌঁছে দিতে হবে ছাপাখানায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে আমাদের নিদ্রাহীন আগ্রহ। সে-পত্রিকায় আমাদের লেখার তখনো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল সদরঘাটের একটি পুরনো প্রেস থেকে, এখান থেকে বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকা বেরুত। আমরা তখনো প্রুফ দেখার কলাকৌশল শিখে উঠিনি। হাসনাতভাইয়ের উৎসাহে ও তত্ত্বাবধানে সে-কাজে হাত দিয়েছিলাম। আমি জানি ভালোর চেয়ে মন্দই করেছিলাম বেশি, পরে মফিদুলভাইয়ের মৃদু তিরস্কার কানে এসেছিল। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই প্রেসে কাটানোর একটা সুফল হলো যে, হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। স্বল্পবাক মানুষ তিনি, কাজ বুঝিয়ে দিতেন কিন্তু সে-কাজে ভুল হলে বিন্দুমাত্র বিরাগ ছাড়া নিজেই তা করে রাখতেন। তখন হয়তো এই ব্যাপারটা পুরোপুরি অনুধাবন করে উঠিনি, কিন্তু এখন বুঝি, যেকোনো দেশের সাহিত্য বিকশিত হওয়ার পেছনে চাই এক বা একাধিক যোগ্য সাহিত্য পত্রিকা। আর চাই সে-পত্রিকা আগলে রাখার জন্য যোগ্য কারিগর। সম্ভাবনার অর্থে গণসাহিত্য ছিল সেই রকম একটি পত্রিকা। আলাদা করে কারো নাম বলতে পারি না, কিন্তু হাসনাতভাই ও তাঁর দুই বন্ধুর গভীর অভিনিবেশ ও আদর্শিক অঙ্গীকার ছাড়া এই পত্রিকা নির্মাণ অসম্ভব ছিল, একথায় কোনো ভুল নেই।

হাসনাতভাই বরাবরই রুচিশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশনার জন্য পরিচিত। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের হয়ে কত অসংখ্য পত্র-পত্রিকা ও একুশের স্মরণিকা তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে, ভাবতে অবাক লাগে। বিশেষ করে মনে পড়ে আট পাতার ফোল্ডার ডিজাইনের একটি অসাধারণ একুশের স্মরণিকা, আমি তোমাদেরই লোক। একটিমাত্র কবিতা দিয়ে সাজানো স্মরণিকাটি, লিখেছেন বিষ্ণু দে। কবিতাটি নয়, আমাদের যা নজর কেড়েছিল তা হলো ফোল্ডারটির ডিজাইন। অলংকরণের ভার ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর ওপর। এই আরেকজন লোক, পেছন থেকে কত কাজই না তিনি করে দিয়েছেন, অনেকেই তা জানে না। এই স্মরণিকাটি সাজানো হয়েছিল বাঙালির চিরাচরিত আল্পনার আদলে, যেন নিজের কন্যাকে বিয়ের সাজে সাজিয়েছেন, ফুলের মালা দিয়ে। আসলে সে-মালা তো বাংলাদেশের জন্য, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সতেজ মালা তো তারই জন্য। আবারো বুঝলাম সাহিত্য মানে শুধু কথার পর কথা বসানো নয়, তাকে ভালোবাসায় ও যত্নে পরিবেশনাও। আমৃত্যু এই কাজটি করে গেছেন হাসনাতভাই, কারো কাছ থেকে ধন্যবাদ পাবেন এই আশায় নয়, এটি তাঁর দায়িত্ব, এই তাড়না থেকেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার বছর-দেড়েকের মাথায় আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে আসি ছাত্র হিসেবে। সে-সময় হাসনাতভাইও বছরখানেকের জন্য মস্কো আসেন, পার্টি স্কুলে প্রশিক্ষণের জন্য। আমি কিয়েভে, তিনি মস্কোয়। ফলে একে অপরের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। ছয় বছর পর দেশে ফিরে আসার পর দেখা হওয়া মাত্রই হাসনাতভাইয়ের প্রশ্ন, কাক দেলা? কী খবর, কেমন আছেন? অল্পবিস্তর রুশ ভাষা শিখেছিলেন, আমার ওপর সে-জ্ঞানের ঝালাই অনেকবারই হয়েছে। বড় ভালোবাসতেন শহরটিকে। যে-রাস্তায় হেঁটেছেন, যে-মিউজিয়ামে গেছেন, যে-রুশ সহপাঠী অথবা দোভাষীর সঙ্গে বলশয় থিয়েটারে গেছেন, সেসব প্রতিটি  দৃশ্য মনে গাঁথা ছিল।

শুধু মস্কো নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটাকেই গভীরভাবে ভালোবাসতেন হাসনাতভাই। আমি নিজে কখনো সে-দেশকে অথবা তার আদর্শিক রাজনীতি  ভালোবাসিনি, বরং খোলামেলাভাবে তার সমালোচনাই করতাম। সোভিয়েত দেশ থেকে ফিরে এসে আমি দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজের সুযোগ পাই। পাশের কামরায় বসতেন হাসনাতভাই, ততদিনে তিনি সাব-এডিটর থেকে পদোন্নতি পেয়ে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন। আমার আশেপাশের প্রতিটি মানুষের ২০-৩০ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। আমার মাত্র হাতেখড়ি। কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আমাকে হাতের ময়লা ভেবে হয় কৃপা করতেন, নয়তো অপাংক্তেয় ভেবে উপেক্ষা করতেন। ভরসার স্থল ছিলেন হাসনাতভাই। আমি ভয়ে নিজ টেবিল ছেড়ে পাশের কক্ষে নিউজ রুমে যাই না, হাসনাতভাই নিজেই এসে বসতেন আমার টেবিলে। দিনে একটি সম্পাদকীয় লেখা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই, আমি অলস সময় কাটাতাম বই পড়ে, অথবা কাজের ভান করে। হাসনাতভাইয়ের কাছে সহজেই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। অনেকদিন তিনি নিজেই ডেকে বাইরে নিয়ে যেতেন। বংশালের পাইস হোটেলে সেই আমার প্রথম লুচি-ভাজি খাওয়া।

সংবাদের নিউজ সেকশনেই হাসনাতভাই কাজ শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার পর দাউদ হায়দার কিছুদিন সাহিত্যপাতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মৌলবাদীদের প্রতিবাদের মুখে তাঁকে সরে যেতে হলে হাসনাতভাই সাহিত্যপাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পান। এটা কোনো পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল না, কিন্তু হাসনাতভাইয়ের হাতে পড়ার পর থেকেই সাহিত্যপাতা সম্পূর্ণ নতুন জীবন খুঁজে পায়। এমন একটা কাজের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন তিনি। আগে থেকেই দেশের সেরা লিখিয়েদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তিনি বরাবর রাজনীতিমনস্ক, তবে ঝাণ্ডা হাতে মিছিলের অগ্রভাগে নয়। তাঁর কাজ ছিল সে-ঝাণ্ডা যেন যথাসময়ে সঠিক নকশায় সবার হাতে হাতে পৌঁছে যায় তা নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না, নেতা হওয়ারও কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যাঁরা নেতা তাঁদের ঠিক জানা ছিল অনেক কাজই অগোছালো থেকে যাবে এই লোকটি ছাড়া।

একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতা করতে গিয়ে নিজের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভোলেননি হাসনাতভাই। ফলে প্রকাশ্যে অথবা অলক্ষ্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার ছাপ প্রতি সপ্তাহের পাতাতেই থাকত। রাতারাতি এই পাতার চেহারা বদলে গেল। যেন এক গোপন ইশতাহার, পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত লেখা থেকে সে-ইশতাহারের বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে যেত। দেশের সেরা লেখকেরা নিজেরা এসে লেখা দিয়ে যেতেন। আমি শওকত ওসমান ও সৈয়দ শামসুল হককে দেখেছি লেখা দিতে এসেছেন, কিন্তু হাসনাতভাই নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছেন, হাসনাতভাই না আসা পর্যন্ত সম্পাদক বজলুর রহমান বা সন্তোষ গুপ্তের টেবিলে গিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। খুব কম কথার মানুষ ছিলেন হাসনাতভাই, নবীন লেখকেরা এসে স্বল্পবাক এই মানুষটিকে দেখে কিছুটা হতাশ হতো। ‘লেখা নিয়ে এসেছেন, ঠিক আছে রেখে যান।’ অনেককে তাঁর এই শীতল মনোভাবের জন্য অভিযোগ করতে দেখেছি, কিন্তু তাঁকে কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে, নবীন লেখকদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষায় এটি তাঁর একটি কৌশল।

বাইরের এই যে কঠোর নিরাবেগ চেহারা, তা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে পারলে অন্য এক হাসনাতভাইয়ের খোঁজ মেলে। আমরা যারা তরুণ তারা তো হাসনাতভাইয়ের ভরসাতেই লেখায় হাত দিয়েছিলাম। এই পত্রিকার পাতাতেও স্থান পেয়েছিলাম। হাসনাতভাইয়ের উৎসাহেই আমি সংবাদে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহে কলাম লেখা শুরু করি। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যেকোনো বিষয়ে লেখার। দেশ-বিদেশের খবর তিনি অনেকের চেয়ে বেশি রাখতেন, ফলে আমার কোথাও ভুলত্রুটি হলে ধরিয়ে দিতেন। কাজটা শিক্ষকের, কিন্তু কোনোদিন ভুলেও আমাকে তেমন ভাবার সুযোগ দেননি। এটা-সেটা বই এগিয়ে দিতেন, বিদেশি কোনো পত্র-পত্রিকা হাতে এলে আমাকে পড়তে দিতেন। এখন বুঝি এর পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন কারণ ছিল – আমার দেখার চোখটা সম্প্রসারিত করা। রাজনীতিতে তিনি বাম ঘরানার, মস্কোপন্থী, কিন্তু মনের দরোজা বরাবর খোলা রাখতেন।

হাসনাতভাই গোড়া থেকেই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন প্যালেস্টাইন প্রশ্নে। না, শুধু সে-জাতির রাজনৈতিক লড়াই নয়, সাহিত্য কীভাবে সে-লড়াইতে কার্যকর সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে, সে-জটিলতার অনুসন্ধানে ছিল তাঁর আজীবনের আগ্রহ। এই অনুসন্ধানেরই একটা ফল ছিল হৃদয়ে প্যালেস্টাইন – এই নামের একটি কবিতা সংকলন। কাজটা তাঁর একার নয়, মফিদুলভাইসহ আরো অনেকেই হয়তো জড়িত ছিলেন, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সূত্রধার যে তিনি এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই। সে-সময় হাসনাতভাইয়ের উস্কানিতে আমাকেও দুটি বা তিনটি প্যালেস্টাইনি কবিতা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে হয়েছিল। প্যালেস্টাইন নিয়ে আরেকটি কাজও তিনি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন। সংবাদের সাহিত্যপাতায় আমার নিয়মিত কলামে অনেক সময়েই প্যালেস্টাইন প্রশ্নে রাজনৈতিক ভাষ্য লিখতে হয়েছে। আমি নিজে কখনো সেসব লেখা জমিয়ে রাখিনি, তার বিশেষ কোনো গুরুত্বও ছিল না আমার কাছে। আমার অজ্ঞাতে সেসব আলাদা করে জমিয়ে রেখেছিলেন হাসনাতভাই, সেসব একত্র করে তিনি প্যালেস্টাইন : মুক্তির মুখোমুখি এই নামে একটি ছোট বই প্রকাশ করেছিলেন আফ্রো-এশিয়া সংহতি পরিষদের ব্যানারে। বিস্মিত হয়েছিলাম বললে পুরোটা বলা হবে না, রীতিমতো হতবাক হয়েছিলাম। সম্পাদক হিসেবে যে-সাংগঠনিকতা তাঁর স্বভাবজ ছিল, এটি সম্ভবত তারই প্রকাশ। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রেষণাও যে কাজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরে সেই একই প্রেষণা দেখেছি মতিভাইয়ের মধ্যে।

সংবাদ ছেড়ে আমি ততদিনে ঢাকার জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্রে। অল্পদিনেই এই কেন্দ্র হয়ে উঠল আমাদের আড্ডার নতুন ক্ষেত্র। হাসনাতভাই মাঝেমধ্যেই আসতেন। খুব কাছেই ধানমণ্ডি তিন নম্বরে ভারতীয় দূতাবাসের একটি দফতরে আসর জমিয়ে বসেছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। হাসনাতভাই সেখানে এলে এক পাক ঘুরে আমার দফতরেও ঢুঁ দিতেন। এই কেন্দ্রে আমার সহকর্মী ছিলেন মনজুরুল হক। আমরা দুজনেই সোভিয়েতফেরত, দুজনেই সাহিত্যের ছাত্র ও হাসনাতভাইয়ের স্নেহে বশ। কখনো কখনো এসে জুটতেন হায়াৎ মামুদ, তিনিও একসময় মস্কোয় কাটিয়েছেন প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদক হিসেবে। আমাদের আরেক বন্ধু আফসান চৌধুরীও কখনো-সখনো এসে হাজির হতেন। কত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে তাঁদের সাহচর্যে। শিল্প-সাহিত্যের আঁতলামি নয়, গল্প-গুজবে, কখনো-সখনো পরচর্চায় – পরনিন্দায়। হাসনাতভাই সে-আলোচনায় শ্রোতা মাত্র, তাঁর মুখ দিয়ে কোনোদিন অন্য কারো বিষয়ে বিন্দুমাত্র নিন্দা শুনিনি। আমি খুঁচিয়েও পারিনি।

হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে সেসময় মঞ্জু ও আমি মিলে বর্ণবাদবিরোধী একটি কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম জাতিসংঘের ব্যানারে। শেকল ভাঙ্গার গান নামের সেই সংকলনে দেশের প্রায় সকল সেরা কবির নতুন লেখা ছিল। এই কাজটি সম্ভব হতো না হাসনাতভাই পাশে না থাকলে। কারো ফোন নম্বর দিয়ে, কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের শ্রমকে লাঘব করে দিয়েছিলেন। কাজটি গুছিয়ে আনতে মফিদুলভাইও অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সে-কথাও মানতে হবে।

পেছন ফিরে সে-ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। অনেকের কবিতা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু হাসনাতভাইয়ের কবিতা ছিল না। তিনি কবিতা লেখেন মাহমুদ আল জামান এই নামে, একথা আমাদের অজ্ঞাত ছিল না, কিন্তু তিনি নিজে কখনো নিজের কাব্যকীর্তি নিয়ে মুখ খুলতেন না। সব দেশের সবকালের কবিরাই আগ বাড়িয়ে নিজেদের কবিতার কথা বলতে ভালোবাসেন, বিশেষত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। হাসনাতভাই নন। নিজের সব ব্যাপারেই তাঁর বিপুল দ্বিধা, সংকোচ। সবচেয়ে সংকোচ নিজের কবিতা নিয়ে। শুধু কবিতা কেন, তিনি যে একজন সফল শিশুসাহিত্যিক, ছোটদের উপযোগী উপন্যাসের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন, একথা কোনোদিন মুখ  ফুটে বলেননি। অথবা তাঁর যে ছোটদের জন্য লেখা পাঁচটি শিশু উপন্যাস রয়েছে, এ-তথ্যও আমাদের অধিকাংশের অজানা।  

১৯৮৯ থেকে আমি নিউইয়র্কে। এর ফলে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক দেখা-সাক্ষাতে যতি পড়ল বটে, কিন্তু পরিচয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। আমাদের মধ্যে পত্রালাপ শুরু হলো। খুব নিয়মিত নয়, অধিকাংশ সময় কেউ ঢাকা থেকে বেড়াতে এলে হাতে একটি চিঠি গুঁজে দিতেন। সঙ্গে এক বা একাধিক বই ও পত্র-পত্রিকা। নতুন কোন বই পড়েছেন অথবা নতুন কোন বইয়ের কথা শুনেছেন, সেসব নিয়ে নিজের মতামত দিয়েছেন, আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। যে-কথা মুখে বলা হয়নি কখনো, পত্রাকারে সেসবের কোনো কোনো বিষয়ও উঠে এসেছে। ঢাকা তাঁর কাছে ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে আসছে, এমন একটা ধারণা আমার হয়েছিল সে-চিঠি পড়ে। 

চিঠি ছেড়ে ই-মেইল চালু হওয়ার পর যোগাযোগ বেড়ে যায়। এসময় হাসনাতভাই সংবাদ ছেড়ে কালি ও কলমে যোগ দিয়েছেন। একদম শুরু থেকেই সে-পত্রিকায় আমার লেখার জায়গা করে দেন তিনি। তাঁর তাগাদাতেই বিদেশি বই নিয়ে অনিয়মিতভাবে লিখেছি আমি। অনেক সময় হাসনাতভাই বইয়ের নাম বলে দিতেন, আমি তা জোগাড় করে পড়ে দু-কলম লেখার চেষ্টা করেছি। যা আমার কাছে বিস্ময়ের মনে হয়েছে, ঢাকায় বসেও হাসনাতভাই বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন স্রোতধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তবে সবচেয়ে আগ্রহ ছিল আধুনিক রুশ সাহিত্য নিয়ে। লক্ষ করেছি, ততদিনে তিনি রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমি কালেভদ্রে তাঁর পত্রিকার জন্য রাজনীতিনির্ভর রচনা পাঠিয়েছি, তিনি ছেপেছেন কিন্তু খুব যে আগ্রহ নিয়ে কাজটা করেছেন তা নয়। অনুমান করি, বাংলাদেশের জটিল ও স্বার্থপর রাজনীতি তাঁকে আহত করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তাঁর জন্য গভীর বেদনার অভিজ্ঞতা ছিল। সেটিও তাঁর রাজনীতি-বিমুখতার কারণ।

নিউইয়র্ক থেকে যতবার ঢাকায় বেড়াতে এসেছি, হাসনাতভাই আগ্রহ নিয়ে দেখা করতে এসেছেন। একবার কয়েক বন্ধু মিলে আমরা নেত্রকোনার অঘোষিত প্রিন্স, উদীচীর সংগঠক ও চলচ্চিত্রকার সেন্টু রায়ের বাসায় সদলবলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত সেই প্রথম হাসনাতভাইকে দেখলাম তিনি আমাদের লঘু আড্ডায় আগ্রহ নিয়ে অংশ নিচ্ছেন। সেটা দ্রব্যগুণে কি না তা বলতে পারব না। সেন্টুর বাসার ছাদে মধ্যরাতের পর গানের আসর বসেছিল। নেত্রকোনার গান-উৎসাহী মানুষদের নিয়ে এক গানের দল গড়ে তুলেছিল সে। এদের কেউ পাকা শিল্পী, কেউবা আনকোরা। এদের দিয়েই মার্কিন জ্যাজের অনুকরণে কয়েক ঘণ্টার এক অসাধারণ জ্যামিং সেশন হয়েছিল রাত তিনটা পর্যন্ত। চেঁচামেচি হয়তো কিছুটা বেশিই হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি পুলিশ এসে হাজির, পাশের বাড়ির কেউ টেলিফোনে অভিযোগ করেছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন হাসনাতভাই, এখন কী হবে? পুলিশ অবশ্য আসার আগে সেন্টুকে ফোন করে সাবধান করে দিয়েছিল, নরম-গরম কোনো পানীয় থাকলে তা সরিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। তল্লাশি করার ভান করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে, উর্দির নিচে একটি শিশি হাতিয়ে পাঁচ মিনিটেই তারা ফিরে গেল। হাসনাতভাই মনে হলো ধরে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।

আরেকবার সিলেটে এক চা-বাগানে, আমরা পাঁচ-ছয় পরিবার বেড়াতে এসেছিলাম মতিভাইয়ের  উদ্যোগে ও বদান্যে। সেবার দেখলাম হাসনাতভাই তাঁর খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। শিল্প-সাহিত্য তো বটেই, রাজনীতি নিয়ে তর্কে তিনিও সমান উৎসাহে যোগ দিচ্ছেন। প্রথম রাতে চা-বাগানের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ এসেছিল, সম্ভবত মতিভাইয়ের পরিকল্পনায়। তাঁরা মাদল বাজিয়ে আমাদের গান শুনিয়েছিল, কোমর দুলিয়ে নাচ দেখিয়েছিল। প্রথমে মতিভাই, তারপর আমার দুই মেয়ে, তারপর সবাই – মায় হাসনাতভাই পর্যন্ত – সেই নাচে সঙ্গ দিয়েছিলাম।

আরেকবার হাসনাতভাই ও লেখক বন্ধু মশিউল আলমকে নিয়ে ট্রেনে চেপে রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হকের গৃহে এক রাতের জন্য কাটাতে এসেছিলাম। গরমের রাত, তদুপরি প্রবল মশা। হাসানভাইয়ের খোলা ছাদে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। ঘুম কোথায়, প্রায় সারারাত তুমুল আড্ডায় কখন যে সকাল হলো, তা টের পাইনি। হাসনাতভাই এসেছেন জেনে সেদিন সন্ধ্যায় সনৎকুমার সাহা,  আমাদের সকল প্রিয় প্রবন্ধকার ও প্রকৃত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, এসেছিলেন। অর্থনীতির অধ্যাপক, অথচ প্রবল রাজনীতিমনস্ক মানুষ। সেদিন হাসনাতভাই সে-আলোচনায় যুক্ত হয়েছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির দক্ষিণ মোড় তাঁকে কতটা বিচলিত করেছিল, তাঁর কথায় টের পেয়েছিলাম।

সম্ভবত ২০০৮ সালে হাসনাতভাই প্রথমবারের মতো নিউইয়র্ক সফরে আসেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সেরা শিল্পীদের অংশগ্রহণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে একটি সপ্তাহব্যাপী চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। সুবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে বেশ বড়সড় একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল, হাসনাতভাই সে-দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। আমার জানামতে সেটিই এদেশে বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রথম প্রতিনিধিত্বশীল চিত্রকলা প্রদর্শনী। সুবীরদা ও হাসনাতভাই, এই দুজনকেই সকল দায়-দায়িত্বের ভার নিতে হয়েছিল। পেছন থেকে উৎসাহ জুগিয়ে ছিলেন আরেক চিরকালীন শিশু কালিদাস কর্মকার। এই প্রদর্শনী নিয়ে পরে তাঁরা ওয়াশিংটন ও বস্টন পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন।

২০১৭ থেকে পরপর তিন বছর হাসনাতভাই নিউইয়র্কে মুক্তধারা আয়োজিত বাংলা বইমেলায় বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি নিজে টেবিলে বই সাজিয়ে রীতিমতো বিক্রেতার ভূমিকায় নেমে পড়েছিলেন। এই ভূমিকায় তিনি অনভ্যস্ত, ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর  রাশেদ তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিল প্রতিবার। এক বছর, সম্ভবত ২০১৮ সালে, বেঙ্গলের স্টল সেরা প্রকাশনার জন্য পুরস্কারও পেয়েছিল। অন্য সবার সঙ্গে তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন কে পুরস্কার পায় সে-ঘোষণার। এবার যে তাঁর স্টল পুরস্কৃত হতে যাচ্ছে, সে-কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না। নামটি আমাকেই ঘোষণা করতে হয়েছিল। হঠাৎ বেঙ্গলের নাম শুনে তিনি যেন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, প্রথম বুঝে ওঠেননি। পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। পরে, মঞ্চ থেকে নেমে  তিনি কপট রাগে বলেছিলেন, এসব নাকি আমার ষড়যন্ত্র। কথাটা মোটেই ঠিক নয়। একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রতিটি স্টল ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের কাছে ভালোমন্দ কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনুমান করি এমন একজন নির্ভেজাল ভালো মানুষকে  বই বিক্রি করতে দেখে কমিটির সদস্যরা যারপরনাই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন।

মেলায় প্রথমবার আসার পর আমাকে সন্তর্পণে ডেকে অনুরোধ করেছিলেন, হাসান, প্লিজ আমাকে কিছু বলতে বলবেন না। আর যদি বলতেই হয় তো আগে থেকে বিষয় বলে দেবেন, আমি লিখে নিয়ে আসব। শেষমেশ তাই হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে এক চমৎকার প্রবন্ধ পড়েছিলেন। কোনো এক বছর স্থানীয় এক সাহিত্য পত্রিকা আমাকে একটি পুরস্কার  দিয়েছিল, হাসনাতভাইয়ের ওপর দায়িত্ব ছিল আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। সেবারও লিখে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর বলা কথা শুনে আমার কান লাল হয়েছিল, চোখে জল এসেছিল।

নিউইয়র্ককে ভালোবাসতেন হাসনাতভাই। এই শহরে তাঁর একমাত্র মেয়ে ও নাতনির বাস, ভালোবাসার সেটিই আসল কারণ। অন্য কারণ, তিনি যা ভালোবাসেন তার সকল উপকরণই এখানে সদা মজুদ। বইয়ের দোকান, নাট্যপাড়া, মিউজিয়াম, আসার আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখতেন এবার কোথায় কোথায় যাবেন। এই শহরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান স্ট্রান্ড, বলা হয় এখানে এত বই আছে যে একের পর এক সাজিয়ে রাখলে তা আট মাইল ছাড়িয়ে যাবে। আসামাত্রই জানতে চাইতেন কবে, কখন নিয়ে যাব স্ট্রান্ডে। আমরা দুজন এই দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি, সব সময় যে বই কিনেছি তাও নয়। শুধু বইয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে, নতুন-পুরনো বই হাতে নিয়ে তাঁর গন্ধ শুঁকতে ভীষণ ভালোবাসতেন। হাসনাতভাইয়ের বিশেষ আগ্রহ ছিল স্মৃতিকথায় ও জীবনী গ্রন্থে। পকেটে একটি তালিকা নিয়ে আসতেন, নিজেই খুঁজে খুঁজে সেসব বার করতেন। একবার জুলিয়ান ফ্রয়েডের একটি আনকোরা জীবনী পেয়ে প্রায় বাচ্চা ছেলের মতো নেচে উঠেছিলেন। সাবওয়েতে বাড়িফেরার পথে সারাটা সময় ঘুরেফিরে সে-গ্রন্থ আবিষ্কারের বিস্ময় রোমন্থনেই কাটালেন। ‘দেখলেন, কিভাবে বইটা পেয়ে গেলাম’, বারবার নিজের আবিষ্কারে নিজেই আনন্দিত হচ্ছিলেন। স্ট্রান্ডের খ্যাতি পুরনো বইয়ের জন্য, এক বা দুই ডলারে প্রায় অক্ষত – কিন্তু কয়েক বছরের পুরনো – বই এখানে দোকানের বাইরে থরে থরে সাজানো। আমাকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্স বইটি জোগাড় করে দিতে, ঢাকায় কেউ একজন তাঁকে ফরমায়েশ করেছিলেন। আমি মাত্র এক ডলারে সেই বই এনে দিলে তিনি প্রথমে প্রমাণ সাইজের সে-বই দেখে আঁতকে উঠলেন। না জানি আপনার কত খরচ হয়ে গেল। আমি যখন সে-বইয়ের মূল্য জানালাম, মনে হলো বুকের ওপর থেকে তাঁর এক বোঝা নেমে গেল।

বই ছাড়া ভালোবাসতেন এই শহরের মিউজিয়াম। এই শহরে ছোটবড় মিলিয়ে ৮০টির ওপর মিউজিয়াম। আমার স্ত্রী রানু ও আমি তাঁকে নিয়ে প্রধান অনেক মিউজিয়াম ঘুরে এসেছি। কান্দিনস্কির ছবি দেখব বলে সাবওয়ে থেকে বেয়াড়া রকম দূরে জুইশ মিউজিয়ামেও গেছি। জ্যাকোমেত্তির স্কাল্পচার দেখতে গুগেইনহাইমে গেছি। হাঁটতে হাঁটতে সোহোর স্বল্পপরিচিত গ্যালারিতেও ঢুঁ মেরেছি। আর মোমা ও মেট তো ছিলই। এসব মিউজিয়ামের জগদ্বিখ্যাত প্রায় সব ছবিই তাঁর পরিচিত, চোখের সামনে তাদের দেখে রীতিমতো শিহরিত হয়েছিলেন। একবার মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে এসে আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, সাসকিয়ার পোর্ট্রেট দেখতে চাই। বুদ্ধদেব বসুর লেখায় পড়েছেন লন্ডন থেকে আমস্টারডাম এসেছিলেন শুধু সাসকিয়ার ছবি দেখবেন বলে। মেট-এ তাঁর পোর্ট্রেট আছে, এ-খবর তিনি জেনে এসেছেন। আগপাছ খবর না নিয়ে আমরা যেদিন যাই মেট-এ তখন সংস্কারের কাজ চলছে, অনেক গ্যালারি বন্ধ। আমাদের সৌভাগ্য, রেমব্রান্টের কয়েকটি ছবি তখনো বাইরে, তার মধ্যে সাসকিয়ার একটি। চুলে মোতির মালায় সাসকিয়া, এই এচিং দেখতে প্রায় আধঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন হাসনাতভাই। যতক্ষণ ছিলেন, রানিং কমেন্টারির মতো  আমাকে কপর্দকহীন রেমব্রান্ট ও ধনীর দুলারী সাসকিয়ার প্রেমের গল্প শুনিয়ে গেলেন। এই প্রথম দেখলাম হাসনাতভাইয়ের মুখে কথার খই ফুটছে। বড় সুন্দর কেটেছিল সেই দিনটি।

মেট থেকে বেরিয়েছি, ফিফথ অ্যাভিনিউর কোনায় দেখি ‘পিকাসো ও তাঁর নারী’ শীর্ষক এক প্রদর্শনী চলছে। এই শোটি বছরতিনেক আগে মতিভাই ও আমি নিউইয়র্কের গ্যাগোসিয়ান গ্যালারি দেখেছিলাম। সে-অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে এক প্রবন্ধ কালি ও কলমে ছেপেছিলেন হাসনাত ভাই। গুগেনহাইমের উলটোদিকে এক সাধারণ ভবনের সাত না আটতলায় শো চলছে, হাসনাতভাই-ই আগে তার সাইনবোর্ড দেখলেন। ছুটলাম আটতলায় পিকাসোর বান্ধবীদের দেখতে। আমার দেখা ছবি, অতিরিক্ত মুগ্ধতার বিশেষ কোনো কারণ নেই। কিন্তু হাসনাতভাই যেন হাতে চাঁদ পেলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি ছবি দেখলেন, মনে হলো নিজের হারানো প্রেম ফিরে এসেছে। মারি তেরেস, ফেরনান্দে, জ্যাকুলিন, দোরা মার – এই নারীদের গল্প তাঁর জানা, যৎকিঞ্চিত আমারও। ফিসফিস করে তাঁদের গল্প আমাকে নতুন করে শোনালেন। আসলে তিনি নিজেকেই শোনাচ্ছিলেন, গল্পের সঙ্গে ছবির মানবীর মিল-অমিল যাচাই করে নিচ্ছিলেন।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় হলেও তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় ছিল না, সেকথা আগেই উল্লেখ করেছি। ২০১৮ সালে তাঁর শেষ নিউইয়র্ক ভ্রমণের পর আমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন তাঁর ভুবনডাঙার মেঘ নধর কালো বেড়াল কাব্যগ্রন্থটি। দেশে ফিরে আমার জন্য কারো হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন তাঁর নির্বাচিত কবিতা। মুখে বলেননি, অনুমান করি তিনি হয়তো চেয়েছিলেন এই বই নিয়ে আমি কোথাও আলোচনা করি। নানা কারণে করা হয়নি ভেবে এখন নিজের ওপর ক্রোধ জাগছে।

বস্তুত, এই বই-দুটি হাতে পাওয়ার পর প্রথম আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতা পড়ার সুযোগ হলো। পড়তে গিয়ে এই মানুষটির অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্যের সঙ্গে পরিচিত হই। কাছের মানুষ অথচ তাঁর চরিত্রের এই আলো-আঁধারির দিকটি আমার অজ্ঞাতই রয়ে গিয়েছিল। বড় চাপা মানুষ ছিলেন, মুখ ফুটে কখনো নিজের কোনো কথা বলতেন না। এখন কবিতা পড়ে তার অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে ধাঁধায় পড়তে হচ্ছে। কবিতা পড়ে তার অর্থ আক্ষরিকভাবে উদ্ধার করতে নেই, জীবনানন্দ দাশ সেকথা আমাদের শিখিয়েছেন, কিন্তু যে-শিল্পে ব্যক্তির নাড়ির স্পন্দন নেই, নেই তাঁর বেদনার স্বেদচিহ্ন, তাতে জীবন থাকে না, কবিতাও থাকে না। স্পষ্টতই স্বদেশ, স্বাদেশিকতা ও প্রেম – তাঁর কবিতার এই তিনটি প্রধান ধ্বনিচিহ্ন। বাংলাদেশের অধিকাংশ কবির কাব্যসৃষ্টির চরিত্র এই ত্রিমাত্রিক ঘেরাটোপে বাঁধা। কিন্তু যখনই কোনো কবির কণ্ঠস্বরে বেদনার, বিচ্ছিন্নতার ও একাকিত্বের আর্তি নৈঃশব্দ্যের সুর হয়ে বাজে, তখনই তিনি লক্ষণীয় হয়ে ওঠেন। আবুল হাসনাতের কবিতায় আমি সেই সুর শুনতে পাই। 

তাঁর কবিতার রোমান্টিক চরিত্র সম্বন্ধে হাসনাতভাই নিজেও অবহিত ছিলেন। নির্বাচিত কবিতার ভূমিকায় দেখছি তাঁর এমন একটি স্বীকারোক্তি :

কখনও অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনও ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে। কখনও সুদূর অতীতে দেখা কোন এক হেমন্ত শীত সকালের কথা ভেবে। স্মৃতি কখনও মিছিলে উত্তোলিত কোন নারীর রণক্লান্ত হাত বড়ই উদ্বেল করে। মিছিলে দেখা সেই নারীর মুখ, ঘামে ভেজা শরীর, স্বপ্নের দু’টি চোখ আমার ক্লান্তি আর নৈরাশ্যে পঙক্তির পর পঙক্তি রচনায় উদ্দীপিত করে। কিন্তু হৃদয়ে তা গুঞ্জরিত হলেও লেখা আর হয়ে ওঠে না। আর ঘুরেফিরে মনে পড়ে, ভুবনডাঙ্গার মেঘ, নৃত্যরত সাঁওতাল মেয়ের সহাস্য মুখ, প্রান্তিকের উদার প্রান্তর, শাল বীথি, মহুয়া বৃক্ষ আর প্রান্তরে জ্যোৎস্নার প্লাবন।

এই কথার সঙ্গে এবার মিলিয়ে পড়ুন ‘ক্ষুধার চিৎকার’ – এই কবিতার অংশবিশেষ :

অনেক কিছুই বলতে চাই, কিন্তু

কিছুই বলা হয়ে ওঠে না

নিজেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে

জলের গেলাসে মুখ দেই

সেই জল, জ্বলতে জ্বলতে পড়তে পুড়তে

নামতে নামতে

নদীর স্রোতের মত হয়ে যায়

ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পাঁজরে নারীর সমর্পণ

আর ক্ষতচিহ্ন

জল, তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে জলই হয়ে ওঠে

আত্মধ্বংসী

আমি মধ্যরাতে সবিতা হালদারের জন্য

এখনো কাঁদি

আর ভুবনডাঙ্গায় প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে

হা ঈশ্বর, তুমি তাকে রেখো সর্বদা দুধে-ভাতে

ভুবনডাঙ্গায় এখনো সে হাঁটে

এলার মতো, নন্দিনীর মতো

ক্ষুধার চিৎকারে যদিও ঘুম নেই,

প্রগাঢ় মৃত্যুর মত ঘুম নেই দু’চোখে

বাগানে ফুল ফুটেছে থরোথরো।

নিউইয়র্কে এলে হাসনাতভাই প্রথমেই খোঁজ করতেন শহীদ কাদরীর কথা। একদা এক যৌবনে শহীদভাই ঢাকা আলো করে রাখতেন তাঁর কথার ইন্দ্রজালে, প্রতিভার আলোকচ্ছটায়। যারা তাঁর সে-ম্যাজিকে বশীভূত হয়েছেন, হাসনাতভাই তাঁদের একজন। আমার দূতিয়ালিতে বারকয়েক তাঁদের দুজনের মুখোমুখি দেখা হয়েছে, একই সোফায় পাশাপাশি বসে কত কী গল্প। অনেক গল্প ইঙ্গিতে, দু-চারটে নাম শুনে অনুমান করতে হয় এই গল্প শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদকে নিয়ে। শহীদভাই হো হো করে হাসতেন, হয়তো হাসনাতভাইয়ের কোনো গোপন অজ্ঞাত ঘটনার সূত্র ধরে তাঁকে খোঁচাচ্ছেন। বেশ বুঝতে পারতাম লজ্জায় অধোবদন হচ্ছেন তিনি, অথবা কে জানে, হয়তো পুরনো দিনের কথা মনে পড়ায় বুকের ভেতর কোনো ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি জেগে উঠছে।

হাসনাতভাই বিস্তর গুরুগম্ভীর গদ্য রচনা লিখেছেন, তার প্রায় কিছুই আমাদের অধিকাংশের কাছে পরিচিত নয়। কখনো মুখে বলেননি, হাসান, লেখাটি পড়ে দেখবেন। মাত্র কয়েকমাস আগে হাতে এসেছে তাঁর গদ্যগ্রন্থ, প্রত্যয়ী স্মৃতি অন্যান্য। এই বইটি পড়ার পর মনে হলো আমি কিছুই জানি না লেখক আবুল হাসনাত বিষয়ে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি প্রধান ব্যক্তিত্ব বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন রয়েছে এই গ্রন্থে। যাঁদের কাছ থেকে দেখেছেন, স্মৃতিতে যাঁরা ধরা আছেন, তাঁদের বিষয়ে নির্মোহ রচনা নির্মাণ কঠিন। এই গ্রন্থে হাসনাতভাই সে-চেষ্টাও করেননি। ফলে যে এক কুড়ি প্রবন্ধ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার প্রতিটি – আমার বিবেচনায় – হাসনাতভাইয়ের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অঞ্জলি হয়ে ধরা পড়েছে। অঞ্জলিই বটে, কিন্তু তাঁর দেখার চোখটি যে মৌলিক তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।

আমার কাছে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে গ্রন্থভুক্ত শামসুর রাহমানের ওপর একটি দীর্ঘ রচনা। গণসাহিত্য করার সময় রাহমানভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়েছিল, পরবর্তীকালে খানিকটা ঘনিষ্ঠতাও। একাত্তর-পরবর্তী শামসুর রাহমানের কবিতা আমার নিজের খুব প্রিয় নয়, মনে হয় তিনি স্বাদেশিকতার পোস্টারে আটকে গেছেন। এই নিয়ে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে কখনো-সখনো মৃদু বচসা হয়েছে, তিনি বুঝিয়েছিলেন সব দেশের একজন মুখপাত্র চাই, যাঁর কণ্ঠে ধরা পড়বে সেই জাতির আনন্দ ও বেদনার, পতন ও অর্জনের তন্ময় উচ্চারণ। শামসুর রাহমান ছিলেন ঠিক সেই রকম একজন মুখপাত্র। একই কথা বলেছিলেন শহীদভাই, সম্ভবত হাসনাতভাইকে সামনে রেখেই। ‘শামসুর রাহমান ও তাঁর কবিতা’ শীর্ষক রচনায় এই কথার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাসনাতভাই। এমন একটি আশ্চর্য মন্তব্য রয়েছে সেখানে ‘আমার কেবলই মনে হয় (সমকালীন) সময়চেতনাকে নানাদিক থেকে অবলোকন করতে গিয়ে কিংবা এই অঞ্চলের মানুষের বঞ্চনা ও প্রতিবাদকে কাব্যভাষায় রূপ দিতে গিয়ে (শামসুর রাহমান) কখন যে বাংলা কবিতার স্বর পাল্টে দিয়েছিলেন, তা তাঁর সময়ের কোন সমালোচকই যথার্থভাবে অনুধাবন করেননি।’ কথাগুলি পড়তে গিয়ে গালে যেন তাঁর সপাট চড় এসে লাগল।

কথা ছিল ২০২০ সালের জুন মাসে নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় তিনি আসবেন। আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম এবার নিউইয়র্কের বাইরে টেনেসি অথবা নিউ অরলিয়ন্সে এক-দুদিনের জন্য বেড়াতে যাব। কোথাও কোনো গ্রামে কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছাও তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। মেয়ে ও নাতনির সঙ্গে সময় কাটাবেন, এমন কথা তো প্রায়ই বলতেন। কোভিডের কারণে কিছুই হলো না। তাঁর মৃত্যুর দিন-পনেরো আগে আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা, অস্ফুট কান্নার সুরে বলেছিলেন, মেয়েটাকে বোধহয় আর দেখা হলো না।

অনেক কিছুই দেখা হলো না, অনেক কিছুই বলা হলো না। হাসনাতভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আমার ডাকঘরের ফুলকন্যা সুধার কথা মনে পড়েছিল। অমল ঘুমিয়ে পড়েছে, একথা শুনে সেই বালিকা বলেছিল, জেগে উঠলে ওকে কানে কানে বোলো, সুধা তোমাকে ভোলেনি। হাসনাতভাইকে বলি, আমরা আপনাকে ভুলিনি, ভুলব না।