তিন বছর বয়সী কন্যা অর্চিকে নিয়ে কবীর আর লিলির ছোট্ট সংসার। নির্ঝঞ্ঝাট, ঝামেলাবিহীন। দুজনেরই মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন থাকে গ্রামে বা মফস্বলে, এই শহরে তাদের প্রায় কেউ নেই। বন্ধুবান্ধবও কম, আঙুলে গোনা। টেনেটুনে ভালোই চলছিল তাদের, অন্তত তারা ভালো বলে মেনে নিয়েছিল এই ভেবে যে, একভাবে না একভাবে তো চলছে, কত মানুষের যে চলছেই না! কিন্তু ইদানীং, না ইদানীং নয়, বছর দেড়েক তো হলোই, তারা এক আশ্চর্য বিড়ম্বনায় পড়েছে। বিড়ম্বনা না বলে বিভ্রমও বলা যায়, যদিও তা মাঝে মাঝেই রূপ নিচ্ছে বিড়ম্বনায়। বিভ্রমে ভুগছে দুজনেই।
কবীর একটা চাকরি করে। বড়ো কিছু নয়, সরকারি ব্যাংকের ছোটখাটো কর্মকর্তা; বেতনটাও ওই মাপেরই, তা না বললেও চলে। লিলিও চাকরি করতো, শিক্ষকতা, একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরিটাও আর নেই। তো, কবীর অফিসে যাওয়ার সময় লিলি হয়তো বলে দেয় – ‘পেঁয়াজ নাই, আনতে হবে’ কিংবা ‘এক লিটার তেল এনো’ অথবা ‘পারলে কাঁচাবাজারটা সেরে এসো, ঘরে মাছ-মাংস-শাক-সবজি টানটান, বড়োজোর আর একদিন চালাতে পারবো’ ইত্যাদি। হয়তো একেকদিন একেকটা বলে কিংবা কোনো-কোনোদিন একসঙ্গে সবকটা বলে। কবীর মন দিয়ে শোনেও। কিন্তু সারাদিন ব্যাংকের বিরামহীন ব্যস্ততা শেষে অফিস থেকে বেরিয়ে কী এক অদ্ভুত কারণে তার মনে হয়, লিলি আজকে ফুল নিয়ে যেতে বলেছে। তাও কয়েক ধরনের ফুল। বেলি, রজনীগন্ধা, গোলাপ, গন্ধরাজ। কিন্তু উপলক্ষটা কী? এত ফুল একসঙ্গে কী দরকার? যদিও উপলক্ষ ছাড়াও ফুল লাগে, তার বউ খুব ফুলপ্রেমী কি না! প্রতিদিনই তার কোনো-না-কোনো ফুল লাগে, ছোট্ট বসার ঘরের একমাত্র ফুলদানিতে রাখার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন ফুল সে পায় কোথায়? আগের বাসায় বড় একটা ব্যালকনি ছিল। সেখানে টবে অনেক ধরনের ফুলগাছ লাগিয়েছিল লিলি। ওর গাছভাগ্য ভালো, কিংবা ওর যত্নআত্তি গাছদের খুব পছন্দ ছিল, সেজন্য কোনোটাই মরেনি, তরতাজা হয়ে শাখা-প্রশাখা মেলে দিয়েছিল আর ফুল ফুটিয়েছিল অকৃপণভাবে। কিন্তু সে-বাসা ছেড়ে আসতে হয়েছে। নতুন বাসায় কোনো ব্যালকনিই নেই। একটা শোবার ঘর, ছোট্ট একটা বসার ঘর, রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট একটা খাবার জায়গা, একটা বাথরুম। সব মিলিয়ে এই। কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই। আলো-বাতাসও ঠিকভাবে ঢোকে না। সারা দিন-রাত অন্ধকার আর গুমোট গরম। যদিও লিলি তার নিপুণ হাতের জাদুতে সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে বাসাটি, কিন্তু ফুলগাছগুলি বাঁচেনি। মানুষের যত্নআত্তির সঙ্গে সঙ্গে ওদের তো প্রকৃতির আলো-বাতাসও লাগে, বড় কমজোরি আর স্পর্শকাতর ওরা, একটা কিছুর অভাব হলেই বড্ড অভিমান হয় ওদের, বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলে। ফুলগাছ কি না, তাই অমন স্বভাব। আগের বাসা ছেড়ে আসার সময় লিলি খুব মন খারাপ করেছিল, যদিও বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ-বাসায় আসার কিছুদিন পর ফুলগাছগুলি যখন মরে যেতে লাগলো, সে কেঁদে আকুল হয়েছিল। আগের বাসার চেয়ে কত ছোট এই বাসা, কী যে ঘিঞ্জি, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়; সেসব নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, অথচ ফুলগাছের জন্য কান্না! কবীর ভারি অবাক হয়েছিল। অবশ্য বিয়ের এই অর্ধযুগ পরেও লিলির অনেক কিছুতেই সে অবাক হয়। মনে হয়, এই মেয়েটা অন্যরকম, সবার মতো নয়।
কিন্তু এত ফুল সে পাবে কোথায়? বিকেল পড়ে আসছে, অফিস ছুটির পর এখন ঘরমুখো মানুষের ভিড়, মতিঝিলের রাস্তার পাশে, ফুটপাতে হরেক রকমের দোকান, কিন্তু কেউ ফুল বিক্রি করছে না। অবশ্য করলেই বা কী? ফুল কেনার বিলাসিতা তার পোষায় না। পকেটের যা অবস্থা, তাতে মাস পার করাই দায়। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বরং বাসে ওঠা যাক। বাসগুলি আসতে না আসতে হুড়মুড় করে ভরে যাচ্ছে, ওঠাই দায়। কিন্তু এখানে ভদ্রতার কোনো অবকাশ নেই, ঠেলেঠুলে, দরকার হলে ধাক্কা বা গুঁঁতো মেরে উঠে যেতে হবে। সেও ওঠে এবং পেছনদিকে জানালার পাশে একটা আসন পায়। আহ! যেন যুদ্ধজয়! এই ভিড়ের মধ্যে বসতে পারা কি যেমন-তেমন ব্যাপার? তাও জানালার পাশে? কত মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, কতজন যাচ্ছে ঝুলে। যে গরম পড়েছে, বাপরে বাপ, যেন পুড়িয়ে মারবে; তার ওপর ওরকম গাদাগাদি ভিড়ে যদি দাঁড়িয়ে যেতে হয়! উফ, ভাবা যায় না! কিন্তু বসেও শান্তি নেই। বাস এগোতেই চায় না। একেকটা সিগন্যালে কমপক্ষে পনেরো মিনিট বসে থাকতে হয়। কোথাও এক ফোঁটা বাতাস নেই। অসহনীয়। ধুঁকতে ধুঁকতে বাসটা শিশু পার্কের কাছে পৌঁছলো ঘণ্টাখানেক পর। আর তখনই তার মনে পড়লো, অর্চিকে নিয়ে একদিন শিশু পার্কে আসার কথা ছিল, তা আর হয়েই উঠলো না। আহা তার অতটুকু মেয়ে, একটা বদ্ধ খাঁচায় বড় হচ্ছে, খেলার একটু জায়গাও নেই, আকাশ দেখার উপায়ও নেই। মেয়েটা মায়ের মতোই শান্ত স্বভাবের, কোনো আবদার নেই, মর্জি নেই, কান্নাকাটি নেই। ছোট ছোট খেলনা দিয়ে সারাদিন একা একাই খেলে, আপনমনে। মেয়ে আর তার মায়ের কথা মনে পড়তেই কবীরের ফের মনে পড়ে গেল, লিলি আজ কী যেন নিয়ে যেতে বলেছে। কী নিতে বলেছে? ও, হ্যাঁ, ফুল। এই মেয়েটা যে কেন এত ফুল ফুল করে! খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নাই, ফুল! একটু মেজাজ খারাপ হলেও পরমুহূর্তেই তার আবার মন খারাপও লাগে। ফুলই তো চেয়েছে, শাড়ি-গয়না তো নয়! সামান্য ফুলই যদি না দিতে পারে, তাহলে কেমন স্বামী সে? অতএব অনন্ত যানজটে ক্লান্ত-বিরক্ত-বিধ্বস্ত হতে হতে সে এবার আকুল হয়ে ফুল খোঁজে। এই এলাকায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যানজট ও ভিড়ের মধ্যে ফুল বিক্রি করতে আসে। রোদের তাপে মলিন হয়ে যাওয়া বাসি ফুল। হয়তো গতকাল কি তার আগের দিন বিক্রি হয়নি ওগুলো, ফুলের দোকানদারদের কাছ থেকে ওরা কম দামে কিনে নিয়েছে। কিন্তু ওরা ঘোরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলির আশেপাশে, বন্ধ জানালায় টোকা দেয়, ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে দুটো ফুল কেনার জন্য, কিন্তু জানালা খোলে না কেউ, গাড়ির ভেতর বসে থাকা ‘সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা’ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। না তাকালেও অন্তত তারা রাগ করে না, কিন্তু পুরুষরা দারুণ বিরক্ত হয়, জানালা খুলে শক্ত করে ধমক লাগায়। ওরা ধমক খেয়ে আরেক গাড়ির কাছে যায়, তবু কোনো বাসের কাছে আসে না। আসবেই বা কেন? বাসযাত্রীরা কি কখনো ফুল কেনে?
উপায়ান্তর না দেখে সে ফুলওয়ালা ছেলেমেয়েদের ‘এ্যাই এ্যাই’ বলে ডাকে, কিন্তু ওরা ফিরেও তাকায় না। এভাবে ডাকলে ওরা বুঝবেই বা কী করে যে ওদের ডাকা হচ্ছে? কিন্তু কীভাবে ডাকলে যে ভদ্রস্থ শোনাবে আর ওরাও বুঝবে, ভেবে পাচ্ছে না কবীর। অবশেষে বাধ্য হয়েই ‘এ্যাই ফুলওয়ালা, এ্যাই ফুলওয়ালি’ বলে ডাক দেয় সে। ডাকটা নিজের কাছে বিদঘুটে শোনায়, অন্তত ফুল যারা বিক্রি করে তাদেরকে ওয়ালা/ওয়ালি বলে ডাকা উচিত নয় বলে মনে হয় তার। কিন্তু ডাকে কাজ হয়, দু-তিনজন ফিরে তাকায় তার দিকে। হাত ইশারায় কাছে ডাকে সে, নিতান্তই অনিচ্ছায় একজন ছেলে এগিয়ে আসো।
– কী কন?
রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা, যেন খুব বিরক্ত। ওর হাতে অনেকরকম ফুল। একটা বাহারি তোড়াও আছে। লিলি তো কয়েক রকম ফুল নিতে বলেছে, তোড়াটাই নেওয়া যাক।
সে আঙুল তুলে তোড়াটা দেখিয়ে বলে, ওটার দাম কত?
ছেলেটা একটু অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। তার চোখ স্পটতই বলছে, বাসে বসে কেউ ফুলের তোড়া কেনে নাকি? কিন্তু সে তো বিক্রেতা, সব কাস্টমারই লক্ষ্মী, অতএব দাম হাঁকায় – দুইশো টেকা!
– দুইশো!
– হ।
– বিশ টাকা দিমু।
ছেলেটা যেন আগেই জানতো, এই লোক ফুল কিনবে না। কোনো উত্তর না দিয়ে, একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, চলে যায় সে। অবাক হয় না কবীর। ওরা গাড়ির আশেপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘ্যানঘ্যান করবে, খুব ভালো করেই জানে গাড়ির যাত্রীরা ওদের কাছ থেকে ফুল কিনবে না, তাদের কেনার জন্য দোকান আছে, তবু ওখানেই যাবে, কিন্তু বাসের যাত্রীদের কাছে আসবে না, কেউ দামাদামি করলে পাত্তাও দেবে না। এসবের মানে সে বোঝে। তারও তো ছাত্রজীবন ছিল, সেই জীবনে অল্পবিস্তর বামপন্থী রাজনীতিও ছিল, না বোঝার মতো কিছু নেই। পুরনো দিনের সেসব কথা অবশ্য মনে করতে চায় না কবীর। সে তাই আরেকজনকে ডাকে। এইবার একটা মেয়ে এগিয়ে আসে।
– ফুল নিবেন স্যার? – মেয়েটি বলে। কবীর আশাবাদী হয়। ওই ছেলেটার মতো রুক্ষ নয় মেয়েটি, এসেই ধমকের সুরে বলেনি, কী কন?
– হ্যাঁ, নেবো।
– কোনটা নিবেন?
– ওই তোড়াটা কত?
– দুইশো টাকা।
– দুইশো! এত চাও কেন?
– কত দিবেন স্যার?
– বিশ টাকা।
মেয়েটার মুখ কালো হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটার মতো হেঁটে চলে যায় না।
– দেবে না?
– খামু কি স্যার?
– মানে?
– এত কম দামে বেচলে কী খামু?
কবীর একটু চমকায়। হ্যাঁ, তাই তো! ওরা তো শখ করে এই গরম-ভিড়-যানজটের ভেতরে ফুল বেচতে আসেনি। ওদেরও তো খিদে আছে!
– আচ্ছা, পঞ্চাশ টাকায় দেবে? – এক ধাক্কায় তিরিশ টাকা বাড়িয়ে বলে কবীর।
– আরেকটু বাড়ায়া দেন স্যার।
– আচ্ছা তুমিই বলো, কত দেবো।
– আর বিশটা টাকা দেন স্যার।
– আচ্ছা দাও।
সত্তর টাকা দিয়ে ফুল কিনেই তার মনে হলো, বিরাট অপচয় হয়ে গেল। এসব তাকে মানায় না। এক কেজি চালের দাম এখন সত্তর টাকা। এক কেজি চালে তাদের দুদিন চলে যায় অনায়াসে। কিন্তু মেয়েটার টলমল চোখ দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি কবীর। মনে হয়েছে, মেয়েটি অনেকদিন কিছু খায়নি। আহারে! তারও তো একটা মেয়ে আছে, সেই কথা মনে পড়েছিল তার! টাকাটা হাতে পেয়ে মেয়েটি মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়েছে। টলমল চোখে ওই মিষ্টি হাসির দাম অনেক।
সত্তর টাকা দিয়ে ফুল কিনতে দেখে বাসের সহযাত্রীরা তার দিকে একযোগে তাকিয়ে থাকে। সত্যি বলতে কী, তারা প্রথম থেকেই এই লোকের কার্যকলাপ খেয়াল করছিল এবং বিরক্ত হচ্ছিল। এবার তাদের চোখে একই সঙ্গে বিস্ময়, ক্ষোভ, এমনকি ঘৃণাও। কবীর পাত্তা দেয় না। সে জানে, এরাও তারই মতো ব্যর্থ মানুষ, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ। পার্থক্য শুধু এই যে, সে একটা ফুলের সঙ্গে সংসার পেতেছে, সেখানে কোনো ঘৃণার জায়গা নেই, আছে গভীর মায়া আর প্রেম। এই লোকগুলি সেসবের দেখা পায়নি।
গরমে ঘেমেনেয়ে সে শেষ পর্যন্ত বাসায় পৌঁছলো আরো দেড় ঘণ্টা পর। পথ আধাঘণ্টার, লাগে আড়াই ঘণ্টা, মন ও মেজাজ দুটো খিঁচড়ে যায়, শরীর ভেঙে আসে ক্লান্তিতে। তবু লিলি যখন দরজা খোলে, অর্চিকে কোলে নিয়ে, তার মন ভালো হয়ে যায়! কী সুন্দর একটা সংসার তার, কী সুন্দর দুজন মানুষ তার অপেক্ষায় থাকে! অর্চি হাত বাড়িয়ে দেয় বাবার দিকে, কোলে উঠবে। কবীর বলে, ‘আমার শার্ট ভেজা মা, একদম ঘেমে গোসল হয়ে গেছে, এখন কোলে নিলে তোমার গায়ে গন্ধ হয়ে যাবে।’ কিন্তু অর্চি হাত বাড়িয়েই থাকে। কবীর এবার ফুলের তোড়া আর টিফিনের ব্যাগ লিলির হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি শার্ট খুলে ফেলে, গামছা দিয়ে সারা শরীর মুছে নিয়ে অর্চিকে কোলে নেয়।
লিলি আগেই খেয়াল করেছিল, কবীর আজো বাজার আনেনি, এনেছে ফুলের তোড়া। শুকিয়ে যাওয়া মলিন ফুল, তবু ফুল তো! লিলি স্পষ্টতই খুশি হয়। একটা ছোট বাটিতে পানি নিয়ে সামান্য হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে ভালো করে নেড়ে ফুলগুলির ওপর ছিটিয়ে দেয়। রোদে পোড়া ফুলের গায়ে হলুদমেশানো পানি ছিটিয়ে দিলে নাকি ওরা হেসে ওঠে, মানে ফের তাজা হয়ে ওঠে। এই রসায়ন অবশ্য কবীর বোঝে না। হলুদমেশানো পানির সঙ্গে ফুলের কী সম্পর্ক, সে তা বুঝবে কী করে? কিন্তু এই কাজ লিলি নিয়মিতই করে, এমনকি তার যখন ফুলগাছ ছিল, তখনো সন্ধ্যার দিকে ফুলের ওপর এভাবে হলুদ-পানি ছিটিয়ে দিত। রসায়ন না বুঝলেও কবীর খেয়াল করেছে, ফুলগুলি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে তরতাজা হয়ে ওঠে। লিলি যখন ফুল নিয়ে মেতে থাকে, তখন এত মগ্ন হয়ে যায় যে কোনোদিকে খেয়াল থাকে না। কবীর যে তাকে লক্ষ করছে তাও বুঝতে পারে না। ফুলগুলির গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে সুন্দর করে গুছিয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখে সে। কিন্তু তারপরই মনে হয়, বাজার ছাড়া চলবে কীভাবে? কবীর কেন বাজার আনেনি? নাকি সে-ই বলেনি বাজারের কথা? সে কি তবে সকালে বাজারের কথা বলার বদলে ফুলের কথা বলেছিল? এত বড়ো ভুল তার হলো কী করে? কিন্তু ভুলটা যে কার, সে-সিদ্ধান্ত নিতে পারে না লিলি। সহসা কবীরকে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। বেচারা সারাদিন পর ফিরলো, ঘর্মাক্ত-ক্লান্ত চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, কী পরিমাণ বিধ্বস্ত। এখন কী করে বাজারের কথা জিজ্ঞেস করে সে? কবীর কিছুক্ষণ অর্চির সঙ্গে খেলে, কিছুক্ষণ গল্প করে, গল্প শোনে। মেয়েটা কিছুদিন হলো কথা শিখেছে, এখন অজস্র কথা বলে। সারাদিন লিলিকে সেসব শুনতে হয়। সন্ধ্যায় বাপ এলে সে নতুন করে কথার ঝাঁপি খুলে বসে। কিন্তু শুধু ওর কথা শুনলে চলবে কীভাবে? চা-নাস্তা খাবে না? লিলি তাই বলে, গোসল করে এসো। আমি নাস্তা বানাই।
– পানি আছে?
– হ্যাঁ। বালতিতে ধরে রেখেছি।
– এই গরমে এক বালতির পানিতে কিছু হয় না বুঝলে? ইচ্ছে করে, ঝরনা ছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।
– এক বালতি না। তিন-চারটা পাতিলেও পানি ধরে রেখেছি।
– সব খরচ করলে রাত চলবে কী করে?
– রাতে তো মেশিন ছাড়বে একবার, তখন আবার ধরে রাখবো।
– বাড়িওয়ালারা কী নিষ্ঠুর দেখেছ! এত গরমে ঠিকমতো পানিও দিতে চায় না। হিসাব করে মেশিন ছাড়ে।
– এ আর নতুন কী!
– তা ঠিক। কী আর করা!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গোসল করতে যায় কবীর। লিলি নাস্তা বানাতে বসে। কী নাস্তাই বা দেবে সে? ঘরে প্রায় কিছুই নেই। কবীর বাজার করবে ভেবে বাসার আলুগুলি দিয়ে চপ বানিয়েছিল। বাপ-বেটি দুজনেই শখ করে খায় কি না! গোসল শেষে কবীর এসে টেবিলে বসলে দুটো চপ আর একটা শসা কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় লিলি। কবীর এতেই খুশি। লিলির সবকিছু এত গোছানো, এত রুচিসম্মত যে দেখলেই মন ভরে যায়। বাপের সঙ্গে বসেছে অর্চিও। সে পেয়েছে একটা চপ। ওটাই সে এক ঘণ্টা ধরে খাবে। খাইয়ে দিলে চলবে না, সে নাকি ‘বলো’ হয়েছে, নিজে নিজেই খেতে পারবে! কবীর খেয়াল করলো, লিলি টেবিলে বসলেও তার সামনে কোনো খাবার নেই।
– তুমি খাবে না? জিজ্ঞেস করলো সে।
– কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছি। খিদে নেই।
– কিছুক্ষণ আগে! তার মানে সন্ধ্যার সময়। এত দেরিতে ভাত খাও কেন?
– পানি ছিল না তো। কাজ সারতে দেরি হয়ে গেল।
সরল মিথ্যেটুকু ধরতে পারলো না কবীর। পানি সবসময় না থাকলেও লিলি পানি ধরে রাখে, কাজও সময়মতোই শেষ করে, অর্চিকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে দুপুরেই। এখন একটু খিদে যে লাগেনি তাও নয়। কিন্তু যে কটা আলু ছিল তাতে চপ হয়েছে মাত্র ছ’টা। বাপবেটিকে তিনটা দিয়ে বাকি তিনটা ফ্রিজে তুলে রেখেছে আগামীকালের জন্য। কালকে কী হবে, সে জানে না তো! একটু আগাম প্রস্তুতি থাকা ভালো। এরকম ছোটখাটো দু-একটা মিথ্যাকে অন্যায় বলে মনে করে না লিলি, কবীর সেটা ধরতেও পারে না। খুব সরল মানুষ সে, সরলভাবেই বলে, তবু আমাদের সঙ্গে একটু খাও।
– হ্যাঁ, চা খাবো।
– শুধু চা?
– না, টোস্ট বিস্কুট দিয়ে খাবো।
কিছুক্ষণের মধ্যে চা আসে। এতক্ষণ বাপের সঙ্গে অনর্গল কথা বলছিল অর্চি, এখন একটু দম নিয়েছে। কবীরের মুখও হাসি হাসি, সম্ভবত অফিসের ক্লান্তি খানিকটা দূর হয়েছে, লিলি তাই এবার জিজ্ঞেস করে, আজকে বাজার আনোনি যে!
– বাজার! – ভীষণ অবাক হয় কবীর।
– হ্যাঁ।
– আনতে বলেছিলে নাকি?
– বলিনি? – লিলি এবার নিজেই বিভ্রমে পড়ে। তাহলে কি সে-ই বলেনি? বাজারের বদলে ফুলের কথা বলার মতো ভুল তারই হলো?
– কী জানি! আমার তো মনে হলো, তুমি ফুলের কথা বলেছ।
একটু ভেবে লিলি বলে, মনে হয় বাজারের কথাও বলেছিলাম।
– কেন বাজার নেই?
– আজকের দিনটা চলবে। কালকে চলবে কি না…
– আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে অফিসে যাওয়ার আগেই তোমাকে বাজার এনে দিয়ে যাবো।
– সকালে লাগবে না। বিকেলে আসার সময় এনো।
– না সকালেই আনবো। অফিস শেষ করে মাথার ঠিক থাকে না। বাসায় আসার জন্য মন অধীর হয়ে থাকে।
– আচ্ছা, তোমার যেভাবে সুবিধা হয়।
কিন্তু সকালে সুবিধা হলো না। ভোর ছ’টায় পানির জন্য মোটর ছাড়া হয়। দুজনেই গোসল সেরে নেয় সে-সময়, তারপর পানি ধরে রাখে সারাদিনের জন্য। এইসব করতে করতে সাতটা বেজে যায়। তারপর নাস্তা তৈরি করে খেতে খেতে আটটা। তখন আর বাজারে যাওয়ার সময় থাকে না। বাজারে কেবল গেলেই তো হয় না, দেখেশুনে দামাদামি করে জিনিসপত্র কিনে ফিরতে ফিরতে দেড়-দু ঘণ্টা সময় দরকার। সেক্ষেত্রে কবীরের অফিসে দেরি হয়ে যায়। বেরোনোর সময় কবীর বলে, চিন্তা করো না, আজকে বাজার নিয়েই ফিরবো।
কিন্তু সেদিনও একই ভুল হয়। ফেরার পর লিলি দেখে, আজো কবীর ফুল নিয়ে ফিরেছে। সারাদিন ধরে সে ভাবছিল, আজকেও যদি বাজার না আসে তাহলে চলবে কীভাবে? রাতের রান্না হয়নি। চাল অবশ্য আছে। কিন্তু তরকারি রান্নার মতো কিছু নেই। এমনকি ডাল বা ডিমও নেই। এরকম টানাটানি তাদের কখনোই ছিল না। সচ্ছলতা বা সাচ্ছন্দ্য বলতে যা বোঝায়, তার অভাব হয়তো বরাবরই ছিল, কিন্তু ঘরে রান্নার মতো কিছুই থাকবে না, এরকম পরিস্থিতি আগে ছিল না। করোনার আগে লিলি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতো। বেতন ছিল পনেরো হাজার টাকার মতো। সঙ্গে কবীরের বেতন। ভালোই চলছিল। নিজেরা খেয়েপরে মা-বাবার জন্য বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতো প্রতি মাসে। তারপর এলো সেই ভয়ংকর মহামারির কাল। স্কুল গেল বন্ধ হয়ে। শিক্ষকদের দেওয়া হলো বিনা বেতনে ছুটি। সেই ছুটি আর শেষ হয়নি, স্কুলটাও আর খোলেনি। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অবস্থা এরকমই। আজ আছে, কাল নেই। এর মধ্যে লিলি গর্ভধারণ করলো, অর্চির জন্ম হলো। সেজন্য বেশ খরচ হলো। সব মিলিয়ে তাদের অবস্থা পড়ে যেতে লাগলো। বাধ্য হয়েই আগের বাসাটা ছেড়ে তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসায় উঠলো তারা। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়তে লাগলো। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য লিলি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। পায়নি। না পেয়ে ভেবেছে, ভালোই হলো। বাইরে যেতে হলে অর্চিকে কার কাছে রেখে যেতাম?
সেদিনও কবীরকে ফুল নিয়ে ফিরতে দেখে মন খারাপ হয়ে যায় লিলির। এখন উপায়? কী রাঁধবে সে? চা-নাস্তা খাওয়ার সময়ও লিলি গালে হাত দিয়ে চুপ করে ভাবতে থাকে। কবীর জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে লিলি? মন খারাপ?
– না। ভাবছি।
– কী ভাবছো?
লিলির বাজারের কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মানুষটার চেষ্টার অন্ত নেই, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছে না, সে বোঝে। প্রতিদিন তাকে বাজারের কথা বলা যায়?
– কী ভাবছো বললে না! – কবীর আবার জিজ্ঞেস করে।
– ভাবছি, কী রান্না করবো!
– ওহ! আজকেও বাজার আনতে ভুলে গেছি। কী যে হয় আমার! ফেরার সময় কেবল মনে হয়, তুমি ফুল আনতে বলেছ!
– হুঁ।
– কিছু নেই, না?
– চাল আছে।
– আর কিছু নেই?
– তরকারি রান্নার মতো কিছু …
– আচ্ছা, আমি এনে দিচ্ছি।
– এখন বাজারে যাবে?
– বাজারে না। দোকানে যাই। দেখি কিছু পাই কি না।
লিলি বাধা দেয় না। সত্যিই রান্নার মতো কিছু নেই। লিলি অবশ্য দিনভর ভেবেছে, যদি আজকেও কবীর ভুল করে, তাহলে কী করবে। ভাবতে ভাবতে মনে পড়েছিল সে মাকে দেখেছে, শাশুড়িকেও দেখেছে, কুমড়ো ফুলের বড়া বানাতে। খেতে দারুণ স্বাদ। কিন্তু সেই ফুল সে পাবে কোথায়? আচ্ছা, কুমড়ো ফুল দিয়ে যদি বড়া বানিয়ে খাওয়া যায়, তাহলে গোলাপ, বেলি, রজনীগন্ধা, টগর, গন্ধরাজ খাওয়া যাবে না কেন? মানুষ তো শাপলা ফুলের ডাটাও খায়। তাহলে রজনীগন্ধার ডাটা খাওয়া যাবে না কেন? আচ্ছা, কবীর যাওয়ার সময় কী
বলে গেল? বাজার আনবে নাকি ফুল আনবে? সে-ই বা কী বলেছিল? বাজার আনার কথা নাকি ফুল আনার কথা? তার মনে পড়ে না। কবীর কি তাহলে ফুলগুলিই রান্নার কথা বলেছে?
আর সে সেটা নিয়েই ভেবে মরছে? কী করা যায়? গতকালের আনা ফুলগুলি প্রায় শুকিয়ে গেছে, বড়া বানানো যাবে না। কেটেকুটে রান্নাও কি করা যাবে না? ভাবতে ভাবতে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে – আজকে একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক। সে ফুলগুলি, ফুলের ডাটাগুলি কুচিকুচি করে কেটে সিদ্ধ করে রেখেছে। এখন দেখতে লাগছে শাকের মতো, আলাদা করে ফুল বা ফুলের ডাটা চেনা যাচ্ছে না; কিন্তু রান্না করার সাহস হয়নি। খেতে কেমন হবে, কে জানে! যদি মুখে দেওয়া না যায়?
কিছুক্ষণ পর এক হালি ডিম, এক কেজি আলু আর এক কেজি ডাল নিয়ে ফিরে আসে কবীর। বলে, আজকের মতো চালিয়ে নাও। কালকে বাজার নিয়ে আসবো।
লিলি বলে, তুমি মেয়ের সঙ্গে একটু খেলো। আমি রান্নাটা সেরে আসি।
রান্নাঘরে গিয়ে সে ডাল চড়ায়, আলুুভর্তা করে, তারপর সাহস করে ফুলের কুচির সঙ্গে মশলা মাখিয়ে চুলায় দেয়। কিছু একটা তো হবে! দেখাই যাক না!
খেতে বসে কবীর বলে – বুঝলে লিলি, বাজারে যেতে ভয় লাগে। এক হালি ডিমের দাম আশি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে, এক কেজি আলুর দামও আশি টাকা। কখনো এরকম দাম শুনেছ? মাছ-মাংসের কাছে তো যাওয়াই যায় না। সবজির দামও আকাশছোঁয়া। কী করবো বলো?
– বুঝি। আমি সব বুঝি।
– বাচ্চাটা বড়ো হচ্ছে। ওর এখন পুষ্টিকর খাবার দরকার। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, ফলমূল, শাকসবজি। তুমি এত পরিশ্রম করো, তোমারও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া দরকার।
– আর তোমার?
– আমার? হ্যাঁ, আমারও দরকার। ধরো আমরা তিনজন যদি প্রতিদিন একটা করে ডিম খাই, তাহলে দিনে তিনটা, মানে মাসে নব্বইটা ডিম লাগে। মানে আঠারোশো টাকার ডিম। মাছ-মাংসের হিসাব করলে…
– থাক আর বলো না।
– আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমার যদি গ্রামের দিকে পোস্টিং হতো, তাহলে এত কষ্ট করতে হতো না।
– গ্রামে কি দাম কম?
– সবজির দাম কম। কৃষকরা তো দাম পায় না। ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে এনে চার-পাঁচগুণ বেশি দামে বেচে। মাছের দামও কম। মানে শহরের তুলনায়। তাছাড়া এত বেশি বাসাভাড়া লাগতো না। অনেক টাকা বেচে যেত।
– তা ঠিক।
– সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমাদের এলাকায় বদলি হতে পারতাম। তাহলে বাড়িতে থাকতাম, ভাড়া লাগতো না। বাড়িটাও সেই টাকায় ঠিকঠাক করে নিতাম। নিজেদের জন্য আলাদা একটা টিনের ঘর তুলতাম।
– ওখানে ব্যাংকের শাখা আছে?
– হ্যাঁ, আছে।
– তাহলে সেই চেষ্টা করা যায় না?
– তুমি শহর ছেড়ে থাকতে পারবে?
– অবশ্যই পারবো। আমি তো এই শহরের কেউ না। তোমার মতো গ্রাম থেকে পড়তে এসেছিলাম ঢাকায়।
– আচ্ছা, তাহলে অফিসে বলে দেখবো।
– যদি গ্রামের দিকে বদলি হতে পারো, তাহলে একটা উঠানওয়ালা বাসা ভাড়া করো। টিনের ঘর হলেও চলবে। আমি একটা বাগান করবো। – বলতে বলতে লিলির চোখ টলমল করে ওঠে।
কবীরের মন খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটার ফুলবাগানের এত শখ অথচ একটু জায়গাও সে দিতে পারছে না। এই বাসায় একটা ব্যালকনিও যদি থাকতো তাহলে অন্তত টবের গাছগুলি বাঁচানো যেত।
– আমি বদলি হওয়ার চেষ্টা করবো লিলি। বলে সে।
কবীর জানে, বদলির জন্য তদবির করার মতো কেউ নেই তার। চাকরির শুরুর দিকে পোস্টিং মফস্বলেই ছিল। তখনো সে বিয়ে করেনি। একা একা থাকতো, খারাপ লাগতো না তার। তারপর বিনা চেষ্টায় তার পোস্টিং হলো ঢাকায়। কত লোক ঢাকায় আসার জন্য অস্থির, তারা আসতে পারছে না, আর সে আসতে না চেয়েও সুযোগ পেয়ে গেল। এই শহর তার ভালো লাগে না। যদিও পড়াশোনা এবং চাকরিবাকরির জন্য অনেক বছর ধরে সে ঢাকায়, তবু শহরটাকে তার আপন মনে হয় না। এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে সে। কিন্তু বদলি হবে কী করে? কাকে বলবে? তার দৌড় ব্রাঞ্চের ম্যানেজার পর্যন্ত। তিনি বদলির ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। হেড অফিসে গিয়ে যদি তদবির করা যেত! কিন্তু সেখানেও তো তার কেউ নেই।
চুপচাপ খাচ্ছিল সে, আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে। এবার আনমনেই ফুলের তরকারিটা তুলে নেয় পাতে। ভাতও মাখে আনমনেই। তারপর মুখে দিয়েই থমকে যায় সে। লিলির দিকে অবাক হয়ে তাকায়। জিজ্ঞেস করে, এটা কিসের তরকারি লিলি?
– কেন? খেতে ভালো হয়নি?
– খুবই ভালো হয়েছে। কী সুন্দর ঘ্রাণ, কী দারুণ স্বাদ! এরকম ঘ্রাণের তরকারি তো কোনোদিন খাইনি। কী দিয়েছ তরকারিতে? কোনো বিশেষ মশলা?
লিলি চুপ করে থাকে।
– কী হলো, কথা বলছো না যে!
– বাটিটা এদিকে দাও তো, আমি একটু খেয়ে দেখি।
কবীর বাটি এগিয়ে দেয়। লিলিও মুখে দিয়ে মুগ্ধ হয়। আসলেই তো দারুণ স্বাদ! গন্ধটাও দারুণ সুন্দর।
কবীর খেতে খেতে আবার জিজ্ঞেস করে, কিসের তরকারি এটা? তুমি না বললে রান্নার মতো কিছু নেই!
– ফুলের তরকারি। – লিলি এবার মুখ খোলে।
– কিসের?
– ফুলের।
– ফুলের? মানে?
– কালকে যে ফুলগুলি এনেছিলে, সেই ফুল আর ডাটাগুলি কুচিকুচি করে কেটে রান্না করেছি। বোঝা যায়?
কবীর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারে না। লিলিও বেশিক্ষণ কবীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর কবীরের কণ্ঠ শুনতে পায় লিলি, দূরাগত আর ভেজা ভেজা সেই কণ্ঠ, যেন শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে এক পশলা হাওয়া এলো – তুমি … তুমি ফুল দিয়ে তরকারি রান্না করেছ! ফুলগুলি আমরা খেয়ে ফেললাম!
– কী করবো বলো! তুমি প্রতিদিন ফুল আনো, ওগুলো তো শুকিয়ে যায়, তখন ফেলে দিতে হয়। তাছাড়া রান্নার মতো কিছু ছিল না বলে … লিলি কথা শেষ করতে পারে না। অনেকক্ষণের চেপে রাখা কান্না এবার শ্রাবণের বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.