বড় রাস্তা থেকে নেমে ছোট রাস্তার দিকে পা বাড়ালো শিরিন। সে-মুহূর্তে মনে পড়ল তার মায়ের কথা।
মা শরিফুন নাহার অফিসে যাওয়ার সময় চোখেমুখে আশঙ্কা নিয়ে বলেছেন, শিরিন তোর কি একটুও ভয়-ডর নেই? কাল তোকে বারবার বলেছি, কটা দিন ছুটি নে। বাসায় থাক। আর বের হবি না। এতে যদি তোর খারাপ লাগে তাহলে পাগলা পিরে চলে যা, তোর ছোট খালার বাড়িতে। এদিকে কী হয় না হয়, তারপর -। তুই আমার কথা কানে তুললি না। দেখ, এবার তোর কোন বিপদ হয়!
মায়ের কথা সে আমলে নেয়নি।
তার বেশ ক্লান্তি লাগছে। বাসায় ফেরার সময় তার প্রত্যেক দিন এমনই হয়।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে সে বাসা থেকে বের হয়। অফিসে গিয়ে প্রথমে তাকে রিপোর্ট দিতে হয়। আগের দিন কী কী কাজ করেছে – সেসবের। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। মাথার ওপর ছাতা মেলে, গ্রামের পথ ধরে হাঁটে।
মানবিক সংস্থায় তার চাকরি। গ্রামের গরিব-দুঃখী মহিলাদের কাছে গিয়ে তাদের সমস্যা নিয়ে বারো ধরনের কথা পাড়তে হয়। শুনতে হয় তাদের কথাও। এসব করতে করতে বিকেল পড়ে যায়, তখন বাসার দিকে সে রওনা দেয়। তাও পায়ে হেঁটে। ইচ্ছে করলে রিকশার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু সংস্থাটি যে বেতন-ভাতা দেয়, তা দিয়ে রিকশায় যাওয়া-আসা করলে পোষাবে না। তাই পা দুটিই ব্যবহার করে সে প্রতিদিন।
এই ছোট রাস্তা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটার পর একটা মোড় পড়বে। মোড়ের বাঁ পাশের ছোট গলি দিয়ে তাকে ঢুকতে হবে। গলির শেষ মাথার বাসাটি তাদের।
মোড়ের কাছে এসে মাথার ওপর থেকে ছাতাটা নামাল সে। গলিটা এতটাই ছোট যে, অপরদিক থেকে কেউ এলে তার গায়ে ছাতা লাগতে পারে। তাই গলি দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় ছাতা ব্যবহার করা যায় না।
ছাতা গুটিয়ে নেওয়ার সময় তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। শ্লথ হয়ে গেল তার পায়ের গতি। মুখের আদলও বদলে গেল তার। মোড়ের পাশে মুদি দোকানের সামনে একটা ছেলেকে দেখে।
ছেলেটার নাম সোলায়মান আখন্দ। তাকে সবাই সলু আখন্দ বলে ডাকে। প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর তার দেখা মিলল। আগে তার গায়ে-গতরে গোশত ছিল না। লিকলিকে চেহারা ছিল। এখন তাকে বেশ নাদুস-নুদুস লাগছে। সলুর পাশে আরো দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এ-পাড়ার ছেলে। সলুর হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। জোরে জোরে টানছে আর ওপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। তাদের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে।
দুরুদুরু বুকে এগোনোর সময় সে ভাবল, সলু যদি এখন একচোট নিয়ে ফেলে, তখন কি উপায় থাকবে? ছয় বছর আগেও উপায় ছিল না, তার অসুরে শক্তির কাছে।
মুদি দোকানের কাছে মোড় ঘোরার সময় সলু তাকে দেখে ফেলল। প্রথমে চমকে ওঠার ভাব দেখাল সে। এরপর হাতের সিগারেটটি দূরে ছুড়ে মারল। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হনহন করে চলে গেল সে ডান দিকের রাস্তা ধরে।
তার অবস্থা দেখে শিরিন ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফোটাল। অস্ফুটস্বরে বলল, হুঁ।
সে মুহূর্তে তার কানে এলো, ভয় পাইছে বুঝি! এজন্য – সলুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের মধ্যে কেউ একজন বলে ফেলল কথাটা, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না শিরিনের। সে কার উদ্দেশে কথাটা বলল, পেছন থেকে বুঝতে পারল শিরিন। সলু ওভাবে সটকে পড়াতে এমন কথা বেরিয়েছে তার মুখ থেকে।
শিরিন মনে মনে বলল, এত সাহসী পুরুষের কেন এই অবস্থা!
সলু আখন্দকে দেখে তার তো বুক কাঁপার কথা, পা কাঁপার কথা। কোনোটাই কাঁপলো না তার।
সরু গলি দিয়ে গিয়ে বাসার কলিংবেল টিপল শিরিন।
মা শরিফুন নাহার দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে পা ফেলতে না ফেলতে তিনি ভয়ার্ত স্বরে শিরিনকে বললেন, সলু জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। দুপুরের পর থেকে সে এদিকে ঘোরাঘুরি করছে। আমার খালি ভয় হচ্ছে!
শিরিন কোনো সাড়া দিলো না। তার চোখ গেল ভেতরের দরজার দিকে। দরজার পাশে রুনু ভাবি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে কোনো আশংকার ছাপ নেই। তাকে বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে।
রুনুর পাশ দিয়ে শিরিন তার রুমে গেল।
ছাতা, ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে সে ধপ্ করে বিছানায় বসল। দীর্ঘ পথ হেঁটে আসাতে তার হাঁপ ধরেছে। ঘামও ছুটছে শরীর থেকে।
শরিফুন নাহার এলেন। তার সামনে এসে আবার ভয়ার্ত গলায় বললেন, সামিনার মা শুনে এসেছে, সলু নাকি এবার ফাঁসিতে ঝুলবে। এজন্য সে আরো জঘন্য কাজ করতে প্রস্তুত। আবার পাড়ার ছেলেরা বলাবলি করছে, সলু নাকি অ্যাসিড ছুড়ে মেরে তোর মুখ ঝলসে দেবে। আমার খালি ভয় হচ্ছে!
মায়ের কথায় নিস্পৃহ থেকে গেল শিরিন।
সলুর কথা নানাভাবে নানা জনে বলে আসছে অনেকদিন ধরে। সে শুনেছে, সলু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শিরিনকে মানুষের সামনে নগ্ন করবে। তার নগ্ন শরীর পাড়ার লোকদের দেখাবে। মোবাইলে সেই নগ্ন ছবি পোস্ট দেবে। একবার নগ্ন করতে গিয়ে সে…। এবার সলু সেই কাজটি করে ছাড়বে।
জেলখানায় তার দুই বন্ধু দেখা করতে গিয়েছিল, তাদের কাছে নাকি সলু এসব বলেছে। পরে তারা বিভিন্নজনের কাছে এসব বলেছে। সে-কথা চালাচালি হওয়ার পর এ-বাসায় এসে পৌঁছে। অনেকে এসে শরিফুন নাহারকে পরামর্শ দেয়, মেয়ের ভালো চাইলে তাড়াতাড়ি একটা সদ্গতি করুন। পরে হায় হায় করতে হবে।
এতে তারা বোঝাতে চেয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দ্রুত সেরে ফেলুন।
শরিফুন নাহার আবার মুখ খুললেন, ভেবেছিলাম জেল থেকে বেরিয়ে এলে ছেলেটা ভালো হবে। অনেকে তো ভালো হয়। ওর ভাবসাবে মনে হচ্ছে তার উল্টোটা। আর তুইও আমার কোনো কথা শুনছিস না। আমার খালি ভয় হচ্ছে!
শিরিন এবার মুখ খুলল – মা, তুমি অত ভয় ভয় করো না তো। সে যদি কিছু ঘটাতে চায়, তখন না হয় দেখা যাবে।
– যদি ঘটিয়ে ফেলে, তখন কী করার থাকবে?
– তুমি এ নিয়ে এত চিন্তা করো না তো।
– তোর গা ছেড়ে দেওয়া কথা আমার পছন্দ হয় না।
শরিফুন নাহার মুখ বেজার করে বেরিয়ে গেলেন।
পাড়ার সবার মুখে মুখে একটা কথা, সলু জেল থেকে বেরিয়ে এসে শিরিনের সর্বনাশ করবে। এ-কথা শোনার পর কোনো মায়ের মন কি ঠিক থাকে? শরিফুন নাহারের মন ভালো নেই। সলুর জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার তারিখ জানার পর থেকে তিনি উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
অন্যদিকে সলুর মা অনেকদিন ধরে নানাভাবে শিরিনের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। বলছেন, ওই মেয়েটার জন্য আমার ছোট ছেলেটা জেলে গেল। বাপ মরা ছেলেটাকে কত আদর-যত্ন করে বড় করলাম। সে এখন জেলের ঘানি টানছে। পাড়ায় কত মেয়ে আছে, তাদের দিকে চোখ গেল না সলুর, ওর দিকে খালি চোখ গেল। ছেলেটার লেখাপড়া হলো না। সাধ ছিল ওকে এমএ পাশ করাব। শেষ পর্যন্ত বিএ-টাও পাশ করতে পারল না। আর মেয়েটা বিএ পাশ করে চাকরি নিল। সে এখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় লবেজান করে। আর আমার ছেলেটার মুখে কলঙ্কের দাগ পড়ল।
শিরিনের ওপর কলঙ্কের দাগ পড়েনি ঠিক। এরপরও সে এখন কলঙ্কিত। সেটা তার মা এবং বড় ভাই আমিন উদ্দিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। এ পর্যন্ত চারজন পেশাদার ঘটক লাগিয়েছেন আমিন, ছোট বোনের বিয়ের জন্য। ঘটকরা শিরিনের বিয়ের ফুল ফোটাতে পারেনি। তারা ব্যর্থ হয়েছে।
কয়েকটা সম্বন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছিল। পরে তারা উৎসাহ হারায়। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমিনের। সেটা হলো, সলু আখন্দ বিষয়ক ঘটনা। যে মেয়ের জন্য একটা ছেলে জেলের ঘানি টানছে। সে মেয়েকে … একসময় আমিন ঘটকের কাছে ঘোষণা দেয়, তার বোনের বিয়েতে সে পনেরো লাখ টাকা যৌতুক দেবে। তবু তার বোনটা পার হয়ে যাক।
তার এ-ঘোষণায় ঘটক একটা সম্বন্ধ নিয়ে আসে। ছেলে হাই স্কুলের শিক্ষক। যে-স্কুলে শিক্ষকতা করে ছেলেটা সে-স্কুলটি এমপিওভুক্ত নয়। বেতন-ভাতা পেতে দেরি হবে। ছেলেদের কিছু জোতজমি আছে।
বোনের বিয়েতে পনেরো লাখ টাকা যৌতুক দেওয়ার মতো তেমন কোনো সামর্থ্য নেই আমিনের। গ্রামে তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা নেই। একসময় জোতজমি ছিল, তা তিস্তা নদীতে চলে গেছে।
বাবা আছির উদ্দিন তিন দশক আগে শহরতলিতে আট শতক জমি কিনেছিলেন। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ চাকরি করার সুবাদে। জীবিত অবস্থায় তিনি চার শতক জমিতে বাড়ি করে গেছেন। বাকি চার শতক অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শিরিনের বিয়ের জন্য আমিন সেই চার শতক জমি বিক্রির ডাক তোলে।
পরে সে-জমি বিক্রি করার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ সম্বন্ধটি ভেঙে যায়।
শুধু একজন শিরিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। পাত্র রেলওয়েতে চাকরি করে। পাত্রের এক বন্ধুর সঙ্গে শরিফুন নাহারের মোটামুটি কথা হয়েছিল। এতে শিরিন হ্যাঁ-না মন্তব্য করার আগে রুনু বেঁকে বসে। সে শাশুড়িকে বলে, মা আপনার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? পাত্রের বয়স কত জানেন?
– জানি। এতে অসুবিধা কিসের? আমার বয়স যখন তেরো-চৌদ্দো, তখন তোমার শ^শুরের বয়স তিরিশের মতো।
– বয়স না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু লোকটা আগে দুটি বিয়ে করেছিল। প্রথম বউ মারা গেলে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। বছর দুয়েক পর দ্বিতীয় বউ তাকে তালাক দিয়ে চলে যায়। প্রথম স্ত্রীর জোয়ান দুটি ছেলে আছে। পরেরবার বিয়েতে একটি মেয়ে হয়। সেও বাবার কাছে থাকে। এমন পাত্রের সঙ্গে শিরিনের বিয়ে হোক, আমি চাই না। শিরিনও চাইবে না।
শরিফুন নাহার রুনুর কথায় চুপ মেরে যান। তিনি চেয়েছিলেন সলু আখন্দ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে শিরিনের বিয়ে দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে। তখন আর কোনো হাঙ্গামার আশঙ্কা থাকবে না।
রুনু দরজার সামনে এসে শিরিনকে বলল, এভাবে আর কত বসে থাকবে? বাথরুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে এসে কিছু মুখে দাও। মা খালি খালি টেনশন করছেন। আমার মনে হয় সলু তোমার এদিকে আর পা বাড়াবে না। তার একবার উচিত শিক্ষা হয়েছে। সে আবার –
শিরিন উঠে দাঁড়াল।
রুনু আবার বলে, মা মনে মনে চাচ্ছেন পাড়ার মাতব্বরদের দিয়ে একটা আপসরফা করতে। আমি মনে করি ওসবের দরকার নেই। সলু আখন্দকে দৌড়ের মধ্যে রাখা যায়। জেলে থাকতে যেসব হুমকি-ধমকি দিয়েছে, নোংরা কথা বলেছে, তা জানিয়ে থানায় একটা ডায়েরি করে দিলে সে বাপ বাপ করবে।
বারান্দা থেকে শরিফুন নাহার বলে উঠলেন, বউমা তুমি আবার থানা-পুলিশের কথা বলো কেন? এ নিয়ে তো কম কেলেংকারি হয়নি। যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, তার জন্য তো আমি –
– এসব করলে সলু লাই পেয়ে যাবে। আপনারা তো তখন পুলিশ ডাকেননি। লোকজন সলুকে ধরে ইচ্ছেমতো প্যাঁদানি দিয়ে পুলিশ ডেকেছে। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ঢুকিয়েছে। আদালতের বিচারে তার শাস্তি হয়েছে। আপনারা তো তাকে জোর করে জেলে ঢুকিয়ে দেননি। আপনাদের কোনো দোষ নেই।
– দোষ নেই, এ-কথা ঠিক। কিন্তু সমাজে বাস করতে হলে অনেক সময় অনেক কিছু মেনে নিতে হয়, করতে হয়।
– আমি মেনে নেওয়ার পক্ষে নই মা। শিরিন তুমি কী বলো?
শিরিন নিরুত্তর।
শান্তভাবে পা তুলল সে বাথরুমের দিকে যাওয়ার।
দুই
রাতে শোয়ার পর খাবার টেবিলে আমিন উদ্দিন ও রুনুর কথা শুনতে পায় শিরিন। বাজারে একটা ছোটখাটো ওষুধের দোকান আছে আমিনের। দোকানে কোনো কর্মচারী নেই। একা চালায়। সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে সে বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত ১১টায়।
আমিন বলছে, সলু নাকি প্রতিশোধ নেবে।
– তুমি কার কাছ থেকে শুনলে এ-কথা? রুনু বলল।
– সন্ধ্যার দিকে হামিদ চাচা বাজারের দিকে গিয়েছিলেন। তিনি দোকানের সামনে গিয়ে কথাটা জানালেন। আগের মতো কিছু একটা ঘটাতে পারে সলু।
শিরিন উসখুস করল। মনে মনে বলল, আগের মতো কিছু … এর মানে জেলে থাকতে সে যে হুমকি দিয়েছে, তারই প্রতিধ্বনি।
রুনু বলল, হামিদ চাচার কী এমন গরজ পড়েছে যে, বাজারে গিয়ে তোমাকে কথাটা জানানোর। শুনেছি, হামিদ চাচা কথা চালাচালি করার লোক। সে লোক গিয়ে একটা কথা বলল, আর তুমি সেটা বিশ্বাস করে ফেললে?
– বিশ্বাস না করার কী আছে। ছেলেটা গোঁয়ার টাইপের। একবার অঘটন ঘটিয়েছে। আবার যদি -। যে একবার জেল খাটে, তার সাহস নাকি আরো বেড়ে যায়।
রুনু এবার খুনসুটি মেরে বলল, তাহলে সলুর সঙ্গে আপসরফা করো। বলো, ভাই সলু, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার তুমি মাফ করে দাও।
– তুমি বাঁকা কথা শোনাচ্ছ কেন?
– বাঁকা কথা বললাম কই। হামিদ চাচা বুঝি এজন্যই গিয়েছিলেন।
মায়ের কথা শোনা গেল। তিনি কিছুক্ষণ আগে শুয়ে পড়েছেন। বিছানা থেকে তিনি বললেন, বউমা খালি উল্টো কথা শোনায়। বুঝতে চায় না কিছু। সলু যদি আবার ক্ষেপে যায় –
রুনু বলল, এজন্যই তো বলছি, তার কাছে গিয়ে আপসরফা করুন।
কথাটা বুঝি আমিনের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলো। তাই ধমকের সুরে বলল, চুপ করো।
রুনু চুপ হয়ে গেল।
শরিফুন নাহারও আর কথা বাড়ালেন না।
তিন
বাসায় আমিনের নাক ডাকার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, শরিফুন নাহারও ঘুমিয়ে পড়েছেন। তা না হলে তিনি এতক্ষণে দু-চার কথা বলতেন। শিরিন ঘুমিয়েছিস? তার সাড়া পেলে বলতেন, ঘুমাও।
শোয়ার আগে তিনি শিরিনকে বলেছেন, যদি তোর ভয় লাগে, তাহলে আমার এখানে শুয়ে পড়। এতে সে সাড়া দেয়নি।
তার একা একা শোয়ার অভ্যাস। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার আলাদা রুম, আলাদা বিছানা হয়েছে। সেই থেকে সে মায়ের কাছে শোয় না। হঠাৎ মায়ের কাছে শুলে অস্বস্তি লাগবে। ঘুম হবে না।
থাকার ব্যাপারে তিনি শিরিনের কাছ থেকে সাড়া না পেলেও একটা কথা জোর দিয়ে বলেছেন, জানালা ভালো করে লাগাবি। একতলা বাসা। জানালা খোলা রাখা যাবে না। রাখলে বিপদ হতে পারে।
তার রুমটা বাসার বাউন্ডারির দিকে। বাড়ির চারদিকে চার ফুট দেয়াল আছে। গরমের দিনে সে জানালা খোলা রেখে ঘুমায়, বাইরের বাতাস নিতে।
গতকালও সে জানালা খোলা রেখে ঘুমিয়েছিল। শরিফুন নাহার জানালা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেননি। বিপদটা কী, শরিফুন নাহার তা খোলাসা করে বলেননি। তবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি শিরিনের।
তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, খোলা জানালা দিয়ে মানুষ গুলি করে দেয়াল টপকে যেতে পারে। অ্যাসিড ছুড়ে মেরে দ্রুত পালাতে পারে। এমন ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। বছর দুয়েক আগে খড়মপট্টিতে রায়হানা নামে এক মেয়ে রাতে জানালা খুলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর রাতে মোস্তাক নামে এক ছেলে খোলা জানালা দিয়ে রায়হানার গায়ে অ্যাসিড ছুড়ে মারে। রায়হানা আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে। অ্যাসিডে তার মুখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ঝলসে যায়।
প্রেমের প্রস্তাবে রায়হানা রাজি না হওয়ায় মোস্তাক এ জঘন্য কাজ করেছে। এজন্য সে শাস্তি পেয়েছে। ঘটনার পর সে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। আদালতের বিচারে তার জেল হয়।
রায়হানাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ সে চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে ফেরে। কিন্তু স্বাভাবিক চেহারা সে ফিরে পায়নি।
আর সলু আখন্দ তো তার জন্য জেল খেটেছে। মোস্তাকের চেয়ে তার ক্ষোভ বেশি থাকার কথা।
শিরিন মায়ের কথায় জানালার ছিটকিনি ভালো করে লাগিয়ে দিয়েছে। এরপরও তিনি আশ^স্ত হতে পারেননি। এসে জানালা ঠেলেঠুলে দেখেছেন – ঠিকঠাক আছে কি না।
বিছানা থেকে নামল শিরিন। ঘুম ছাড়া আর কাঁহাতক শুয়ে থাকা যায়। মেঝের ওপর সে ধীর পায়ে পায়চারি করতে থাকল।
এ-সময় তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
ভাবল, এই গভীর রাতে কে ফোন করল! এ-সময় তো কোনোদিন ফোন আসেনি।
বিছানার পাশে ছোট টেবিলে ওপর রাখা মোবাইল ফোনটি তুলে নিল। কানের কাছে নিয়ে খাটো স্বরে বলল, হ্যালো –
কোনো সাড়া মিলল না।
শিরিন আবার বলল, হ্যালো –
এবারো নীরবতা।
শিরিন মোবাইল রেখে দিলো।
তার গলা শুকিয়ে গেছে। ভাবল, পানি খেয়ে নিলে ভালো হতো। পানি খেতে হলে খাবার টেবিলের কাছে যেতে হবে। ওখানে পানির জগ, গ্লাস আছে। খাবার টেবিলের পাশে গেলে শরিফুন নাহারের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তখন তিনি নানান কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করবেন। তোর কি ঘুম আসছে না, তোর কি খারাপ লাগছে? আরো কত প্রশ্ন।
এসব মনে করে পানি খাবার কথা ছেড়ে দিলো সে।
নীলাভ আলোর মধ্যে মোবাইলের দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, কে ওভাবে রিং দিয়ে …
মোবাইলটা তুলে নিল শিরিন। রিসিভ কলের নাম্বারটা বের করল। সে নাম্বারে রিং দিলো শিরিন।
দুবার রিং হতেই অপর প্রান্তে রিসিভ করার সাড়া পাওয়া গেল; কিন্তু কোনো কথা ভেসে এলো না।
– হ্যালো। শিরিন বলল।
সাড়া মিলল না।
দ্বিতীয়বার ‘হ্যালো’ বলল। এবারও কোনো সাড়া না পাওয়ায় মোবাইল রেখে দিলো শিরিন।
বন্ধ জানালার কাছে গেল সে। এরপর খুব আস্তে করে জানালা খুলল, যাতে শরিফুন নাহার টের না পান।
বাইরের দিকে তাকাল শিরিন।
আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। গাছের আড়াল থেকে সে-চাঁদ ওপরের দিকে উঠছে। একটা গানের কলি তার মনে পড়ে গেল –
নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে …
– ধুর কী এসব – মনে মনে বলল শিরিন।
সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। দেখল চাঁদের ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। চোখের সামনে সে দেখতে পাচ্ছে রান্নাঘরের পেছনে পেয়ারা ও লেবু গাছ। তার পাশে একটি কামরাঙার গাছ আছে। সেটাও দেখা যাচ্ছে। এ-গাছগুলোর যত্ন নেন শরিফুন নাহার।
একবার তার মনে পড়ল সলু আখন্দের কথা। সে মনে মনে বলে উঠল, সলু আখন্দ তুমি নাকি অ্যাসিড ছুড়ে মেরে আমার মুখ ঝলসে দেবে? তুমি এসো, আমার চোখে-মুখে বালতির পর বালতি অ্যাসিড ছুড়ে মারো।
তুমি একবার আমার সামনে ঘোষণা দিয়েছিলে, আমি তোমার দেমাগ দেখিয়ে ছাড়ব। সে-ঘোষণার প্রতিফলন ঘটাতে তুমি কি না করেছ! এবার বাদ রাখবে কেন? এসো, অ্যাসিড ছুড়ে মারো।
সলু ডানপিটে ছেলে। পাড়ার সবাই জানে। সে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এরপর তার লেখাপড়া কতদূর এগিয়েছিল তা জানত না শিরিন।
একদিন সে শিরিনের সামনে দাঁড়াল। শিরিন তখন কলেজ থেকে ফিরছিল। কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ করে আসছিল, সলু ঠারে ঠারে থাকে। কখন সে কলেজ থেকে ফেরে। কাছ দিয়ে গেলে আড়চোখে তাকায় তার দিকে।
সে একদিন তার মুখোমুখি দাঁড়াল।
শিরিনের বুক ধুকধুক করে।
সলু বলল, শিরিন তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
– কী কথা? এমন প্রশ্ন তোলেনি শিরিন সেদিন। তাকে উপেক্ষা করে, মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে হনহন করে চলে আসে।
এর দুদিন পর কলেজে যাওয়ার সময় দেখা মিলল সলুর। সে তার পিছু নিয়েছে। পিছে পিছে কলেজের গেট পর্যন্ত যায়। শিরিন তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি।
ছয়-সাতদিন পর কথা বলার সুযোগ নেয় সলু। তার পাশে পাশে হাঁটছে। শিরিন অস্বস্তি বোধ করে। ভাবে, ওর সঙ্গে এভাবে চললে মানুষ কী মনে করবে? পাড়ার একটি খারাপ ছেলের সঙ্গে …
সলু বলে, শিরিন শোনো –
শিরিন থমকে দাঁড়ায়। তির্যক দৃষ্টি হেনে তার দিকে তাকায়।
সলু বলে, কলেজ ছুটির পর আমি তোমার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি একটু আমাকে সময় দেবে?
শিরিন তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুতপায়ে এগোয়।
কলেজ ছুটির পর গেটের সামনে দেখা মিলল সলুর। কলেজে যাওয়ার সময় সে যে তার কথার গুরুত্ব দেয়নি, তার তোয়াক্কা করেনি সলু। তাকে দেখে কয়েক পা এগিয়ে আসে সলু। কিন্তু শিরিনের সঙ্গে তার কয়েকজন সহপাঠীকে দেখে সে থেমে যায়।
শিরিন সলুকে দেখেও না দেখার ভাব দেখায়। তার সামনে দিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে সে চলে আসতে থাকে।
সলু পিছু নেয়।
আস্তে আস্তে সহপাঠীরা খসে পড়ে। যার যার বাসার দিকে চলে যায়। একা হয়ে পড়ে শিরিন। সে-সময় সলু আখন্দ পেছন থেকে বলে ওঠে, শিরিন শোনো –
শিরিন পেছন ফিরে একবার তাকাল। তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি হেনে হন্হন্ করে হাঁটতে থাকে।
সলু তখন পেছন থেকে বলে ওঠে, শিরিন, তোমার দেমাগ কত, আমি তা দেখিয়ে ছাড়ব।
এরপর সলু আখন্দ লাপাত্তা। তার কলেজ যাওয়া-আসার সময় সলুর দেখা মেলে না। শিরিন ভাবে, সলু আর তার দিকে পা মাড়াবে না। অপমান চাপিয়ে রাখতে সেদিন হয়তো সে ওভাবে হুমকি দিয়েছে।
শিরিন সলুর বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দেয়।
হঠাৎ তার আবির্ভাব ঘটে জাফর মিলিটারির গরুর খামারের সামনে। তখন শিরিন কলেজ থেকে ফিরছিল। জাফর মিলিটারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল চারটি অস্ট্রেলিয়ান গাভি দিয়ে।
খামারটি টিনের চালার। রাতে সেখানে একজন লোক থাকে। তার জন্য একটি চৌকি আছে। ছোট্ট খামারটি বাঁশের চেঁচা দিয়ে ঘেরা।
দিনের বেলায় একজন লোককে দেখা গেলেও তাকে সব সময় দেখা যায় না।
খামারের ভেতর থেকে সলু আখন্দ হার্মাদের মতো বেরিয়ে আসে। খপ্ করে তার একটা হাত ধরে ফেলে। এরপর একটা হ্যাঁচকা টান দেয়। এতে শিরিনের হাতে থাকা একটা খাতা, একটা বড় সাইজের বই ছিটকে পড়ে।
সলু আখন্দ ওসবের খেয়াল না করে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে খামারের দিকে।
সলুর দুর্মর শক্তির কাছে শিরিন কোনো প্রতিরোধ করতে পারে না, একটু চেঁচামেচি করা ছাড়া।
শিরিনকে ধড়াম করে চৌকির ওপর ফেলে দেয়। এরপর সলু আখন্দ তার ওপর হামলে পড়ে।
এলাকাটি পৌর এলাকার মধ্যে পড়লেও তখন তেমন একটা ঘরবাড়ি গড়ে ওঠেনি। ফাঁকা ফাঁকা ছিল। গরুর খামারটি ছিল আরো একটু ফাঁকা জায়গার মধ্যে।
সলু শিরিনের বুক দলিত-মথিত করতে থাকে। এতে শিরিন বাধা দিয়ে সুবিধা করতে পারছিল না। সে যে একটু চেঁচামেচি করেছিল, তাও বন্ধ হয়ে যায়। সলু এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরাতে।
আদিম প্রবৃত্তি মেটাতে সলু অস্থির হয়ে ওঠে। তখন শিরিনের মুখ চেপে ধরা তার হাতটা নিচে নেমে আসে। দু-হাত দিয়ে শিরিনের সালোয়ারের ফিতা খুলতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর সে-সময় শিরিন বড় সুযোগ পেয়ে যায়। সে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে। বলে, বাঁচান-বাঁচান, আমাকে বাঁচান।
তার ওই আর্তচিৎকার মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছে যায়, তা বুঝতে পারেনি সলু আখন্দ। সে-সময় বুঝি তার বোধশক্তি লোপ পেয়েছিল। কারণ তখন সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল আসঙ্গ লিপ্সায়।
লোকজন জড়ো হতে থাকে। এরই মধ্যে তিন-চারজন খামারের ভেতর ঢুকে পড়ে। সলু তাদের দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। দিগ্বিদিক খুঁজে পায় না। তাকে দুজন জাপটে ধরে।
শিরিন তখন উঠে বসে। আর হু-হু করে কাঁদে।
তার এ-কান্না সমবেত মানুষের মর্ম স্পর্শ করে।
শিরিন মনে মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল, সলু আখন্দ তুমি না আমাকে নগ্ন করতে চেয়েছো! হ্যাঁ, তুমি আমাকে নগ্ন করে…
দু-হাত বাড়ায় সে জানালার গ্রিলের দিকে। শক্তভাবে গ্রিল চেপে ধরে।
আবার মনে মনে বলল, সলু আখন্দ আমি খারাপ মেয়ে, আমাকে কেউ বিয়ে করবে না। কারণ তুমি আমার জন্য –
ক্ষোভে-আক্রোশে গ্রিলের লৌহপাতগুলো টানাটানি করতে লাগল সে।
একবার চিৎকার দিয়ে সে বলে উঠল, সলু আখন্দ, তুমি চলে এসো। এসে তুমি আমাকে নগ্ন করে ফেলো। তারপর আমার নগ্ন শরীর পাড়ার সব মানুষকে দেখাও। তারপর দেখাও সারা শহরের মানুষকে। এমনকি সারা দেশজুড়ে…
তার এই আর্তচিৎকার রাতের নীরবতা ভেঙে
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.