বিলেতে প্রথমবার

ইকতিয়ার চৌধুরী

ডোভার উপকূলে ফেরির তীব্র ভেঁপুতে ঘুম ভাঙলে চোখ কচলিয়ে কেবিন থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ইংলিশ চ্যানেলের ওপর হালকা কুয়াশা। রেলিং ভিজে আছে। অল্প অল্প শীত। পাড়ে ভিড়ছে আমাদের বহুতল ফেরিটি। ফেরিটি যেন একটি বিশাল পস্নাজা। তাতে একাধিক রেসেত্মারাঁ, শুল্কমুক্ত বিপণি, বসার জায়গা, যেখানে চলছে একঘেয়ে বিরক্তিকর টিভি প্রোগ্রাম, পরিচ্ছন্ন টয়লেট ইত্যাদি। রাতের অনেকটা নিয়ে প্রকাশ, সৌমিত্র আর আমি কেনাকাটা করেছি বিপণিগুলোতে। যতটুকু সময় কাটিয়েছি সে-তুলনায় কেনাকাটা অকিঞ্চিৎকর। প্রকাশ এক বোতল বস্ন্যাক লেবেল, আমি মোটে একটি সুইস মিলিটারি নাইফ। তারই দাম পনেরো পাউন্ড। বস্ন্যাক লেবেলের বোতলটি সৌমিত্রের সৌজন্যে। আর দু-সপ্তাহ পরেই সে দেশে ফিরবে। তখন ওর সম্মানে প্যারিসে পানাহারের যে-আসর বসবে তখন বস্তুটির সদ্ব্যবহার হবে। এই প্রবাসে নেপালি প্রকাশ আর সৌমিত্র চাকমার বন্ধুত্ব অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের তুলনায় গাঢ়। তুই-তোকারি করে কথা বলে তারা।

প্যারিসে আন্তর্জাতিক বাসস্টেশনে রাত নটায় লন্ডনগামী বাসে ওঠার আগে রাতের খাবারের পর্ব মিটিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ইংলিশ চ্যানেলের ফ্রান্সের দিককার পাড় ক্যালেতে যখন বাসসহ ফেরিতে উঠলাম তখন খিদে পেয়ে গেল। সেলফ সার্ভিস রেসেত্মারাঁগুলো অনেকটুকু জায়গা নিয়ে। পরিচ্ছন্ন। রকমারি খাবারের অভাব নেই তাতে। তবে এশীয় ধাঁচের কোনো খাদ্য নেই। মুরগির লাল টকটকে কারি দেখে মনে হতে পারে, প্রচুর মশলায় ঝাল করে রান্না। কিন্তু বাস্তবে স্বাদটি উলটো। মরিচের পরিমাণ খুবই সামান্য। টমেটো সসের সঙ্গে অল্প চিনি মিশিয়ে রান্না করায় মিষ্টি মিষ্টি লাগছে তা। ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে রাত কাবার হয়ে যাবে। খদ্দেরদের খানাপিনার গতি তাই মন্থর। প্রকাশ আমাদের গাইডের মতো। নববইয়ের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের একসময়ের রাজধানী ভিশি থেকে সৌমিত্র আর আমি যখন ইতালি গেলাম ও তখন লন্ডন ঘুরে যাওয়ায় বিরানববইয়ের জুনের এই যাত্রায় আমাদের জ্ঞান দিতে পারছে।

পৃথিবীর সব জায়গার মতো ফেরির শুল্কমুক্ত বিপণিগুলো খদ্দের-যাত্রীদের বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। শুল্কমুক্ত বলে জিনিসপত্রের দাম কম মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে কেনাকাটা করলে দু-একটি দ্রব্য ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গলা কাটা যায়। আমার ইচ্ছা ছিল একটি বৈদ্যুতিক চায়ের কেতলি কেনার। কিন্তু তার মূল্য ইসলামাবাদের তামিল দোকানগুলোর এই একই ধরনের জিনিসের দেড়গুণ। প্যারিসের গার দ্য নর্দ এলাকার একটি মহল্লাকে আমরা ইসলামাবাদ ডাকি। কারণ তামিল, ভারতীয়দের মতো ওখানে পাকিস্তানিরা ভালোই এঁটে বসেছে। রেসেত্মারাঁ, মাংসের দোকান, সেলুন, দোকানপাট প্রভৃতি চালাচ্ছে তারা। আমাদের দেশীয় মশলা আর আনাজপাতির সপ্তাহের বাজার ওখান থেকেই। চুল কাটানোর খরচও ফরাসি সেলুনগুলোর তুলনায় পাকিস্তানিগুলোয় অর্ধেক। মাত্র দুশো দশ টাকা প্রতি দফায়। আরো একটি ভারতীয় মুদিদোকান আমাদের কাঁচা জিনিসপত্রের জোগানদার।

রাতের কালো সমুদ্রে চোখ রেখে কারো সময় কাটে না। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। তাই যাত্রীদের বসার জায়গার এক কোণে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা।

পন্টুনের দিকে এগোচ্ছে ফেরি। ডোভারের দুরারোহ সাদা পর্বত স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ছে। প্রকাশ বলল, এত হোয়াইট ক্লিফ নাকি আর কোথাও নেই। খানিক বাদে বিলেতের মাটিতে পা পড়ল আমাদের। ঘুম ঘুম সকাল। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকিংয়ের জন্য দাঁড়াতে হলো। অনেকগুলো কাউন্টার। নতুন শিফটের লোকজন তাতে জায়গা নিচ্ছে একে একে। সেখানকার বাধ্যবাধকতা শেষ হলে আবার আমরা অপেক্ষমাণ বাসে উঠব। অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলো আমাদের। ইউরোপীয় সম্প্রদায়ভুক্ত দেশের অধিবাসীদের জন্য পৃথক কাউন্টার। কিন্তু কূটনৈতিক কিংবা অফিসিয়াল ছাড়পত্রধারীদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। ইমিগ্রেশনের তরুণী কর্মকর্তাটি আমার লাল পাসপোর্টে একটি সিলমোহর দিলো। তাতে লেখা ‘যুক্তরাজ্যে জীবিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ’। এ হচ্ছে এক ধরনের বর্ণবাদী মনোভাব। কারণ আমার ধারণা, ছোট-বড় নির্বিশেষে কোনো দেশের কূটনীতিক তার পেশা ত্যাগ করে আর যা-ই হোক ইউরোপের ‘রুগ্ণ মানব’ ব্রিটেনে কাজের জন্য প্রবেশ করবে না। একজন যুবককে, সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদে সন্তুষ্ট না হয়ে ভেতরে নিয়ে গেল অভিবাসন দফতরের এক কর্মকর্তা।

চেয়ারে শরীর রেখে গাঢ় ঘুম হয়নি রাতে। চোখ তাই জ্বালা করছিল। বাস চলতে শুরু করলে তা বুজে আসতে থাকল। আধঘুম তন্দ্রার ভেতর দিয়ে আমি বিলেতের নিসর্গ দেখতে থাকলাম। দেশটি যথেষ্ট সবুজ। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। জনবসতি হালকা। বসতিহীন স্থানে যেমন গজিয়ে ওঠে আগাছার ঝাঁক সেরকম কোনো কোনো দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, এমন অজ জায়গার মানুষ হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে কী করে ১৭৫৭-তে পলাশীর আমবাগানে আরেক বহিরাগত শাসক নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করেছিল ভারতবর্ষে। আমরা জাতি হিসেবে এতই পশ্চাৎপদ যে, দূরের শেকড়হীন লোকদের আগ্রাসন ঠেকাতে পারিনি। উপমহাদেশের সেই শেকড়হীন মানুষের দেশ ব্রিটেন। আমার ছোটবেলাকার বিলেত। যদিও এই দেশে আসার স্বপ্ন লালন করিনি কখনো। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সবসময় মিল থাকে না। তখন অষ্টম শ্রেণিতে। আমার ওপর ক্লাসের ঘনিষ্ঠ তিন সহপাঠী আলতাফ, মুকুল আর করিমভাই। তারা নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ছাত্র। করিম তাঁতশ্রমিক। বাবার সামর্থ্য নেই তাই নিজ উপার্জনে পড়াশোনা। তার একচালা ঘরের শোলার বেড়ার বাতার ফাঁকে সাদা ফুলস্কেপ কাগজের একটি পাতা টানানো। তাতে নীল কালিতে মোটা ও বড় করে দুটো শব্দ বসানো ‘বিলেত যাব’। এক সংগ্রামী কিশোরের স্বপ্ন। মুকুল এখন কৃষিবিদ। আলতাফ (ভেটেরিনারি সার্জন) কয়েক মাস আগে দু-বছর বিলেতে কাটিয়ে দেশে ফিরে গেছে। ওদের মতো করিমভাইয়েরও যদি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগটি হয়ে যেত তবে এক তাঁতশ্রমিকের বিলেত যাওয়ার আকাঙক্ষা হয়তো পূর্ণ হতো। আধঘুম তন্দ্রার মাঝে ডুবে থাকা আমাকে নিয়ে করিমভাইয়ের সেই বিলেতে বাসটি ছুটে চলে অথচ তা তিনি জানতেও পারেন না।

সবারই ইচ্ছা ছিল চো আমাদের সঙ্গী হোক। কিন্তু ওর দেশ নে উইনের মিয়ানমারে আজ অবধি কঠিন বিধিনিষেধ। চো কূটনৈতিক পেশার লোক হলেও পাসপোর্টটি সে-ধরনের তো নয়ই, উপরন্তু তা দিয়ে শুধু ফ্রান্স ভ্রমণ সম্ভব। প্যারিসে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আমাদের যখনই ফরাসি দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত প্রতিবারই চো-কে ওদের বিদেশ মন্ত্রক থেকে পাসপোর্টে প্রয়োজনীয় দেশটির নাম অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হতো। তাতে যে-ঝামেলা তা ভুক্তভোগী না হলেও ওর কাছাকাছি থাকায় দেখেছি আমরা। সামরিক জামত্মার নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় চো-র লন্ডন-ভ্রমণের অনুমতি ছিল না। এক্ষেত্রে নেপালিদের অবস্থাও অনেক নিয়ন্ত্রিত। যেমন প্রকাশের ছাড়পত্রটিও কূটনৈতিক নয়। দাফতরিক। ও যেহেতু কোনো দূতাবাসে পেশাগত দায়িত্বে নেই, তাই এই ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে ভাবার আছে।

নটার দিকে ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনালে পৌঁছলে লন্ডনের অনুজ্জ্বল সূর্যহীন দিন আমাদের স্বাগত জানাল। সংগত কারণেই আমরা খুশি হতে পারলাম না। ইউরোপে রৌদ্রহীন ভেজা দিন কার ভালো লাগে। কিন্তু এ থেকে গড়ে প্রায় অর্ধেক বছর পরিত্রাণ নেই।

প্যারিস থেকে প্রকাশ এখানকার একটি রেস্টুরেন্ট কাম দু-শয্যাবিশিষ্ট রেস্টহাউসে আমাদের তিনজনের জন্য জায়গা সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল। গেলবার লন্ডনে এক সপ্তাহ ও সেখানেই থেকেছে। কিন্তু এ-যাত্রায় সেটি খালি পাওয়া যায়নি। সৌমিত্র তাই আমাদের হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব শহীদুল হককে বলেছে একটি সস্তা হোটেলের জন্য। এটি কাল যাত্রা শুরুর আগের কথা। তাই ব্যবস্থাটি পাকা হয়েছে কিনা জানা নেই আমাদের।

শহীদুল হককে প্রথমে দূতাবাসে পরে বাসায় ফোন করে বোঝা গেল তিনি অফিসের পথে রয়েছেন। ওয়েমবি­ থেকে কুইনস গেট আসতে ওর কতক্ষণ লাগবে কে জানে। আর লন্ডনের ট্রাফিক জ্যামের ধরন যদি হয় ব্যাংককের মতো তবে দীর্ঘ সময় ভিক্টোরিয়া বাস টার্মিনালে পড়ে থাকতে হবে। বাঙালি-অধ্যুষিত সেখানকার ব্রিকলেন এলাকাটির নাম জানা ছিল আমার। আপাতত সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। পাতাল রেলটিউবে চড়ে বসলাম আমরা। প্যারিসে এই যোগাযোগ ব্যবস্থাটির নাম মেট্রো। আরো এক ধরনের পাতাল রেল রয়েছে সেখানে। সংক্ষেপে যাকে বলা হয় আরইআর। তার লাইনগুলো প্রশস্ত। কামরাগুলোও বড় এবং টিউবের চেয়ে পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক। পস্ন্যাটফরমে যাত্রীদের জন্য বসার জায়গা। সর্বোপরি আরইআরের ব্যবস্থাপনা টিউবের চেয়ে অনেক উন্নত বলে মনে হয়। আরইআর স্টেশন সাতলেতে পাশাপাশি নটি লাইন। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এটি একটি বড় রেল জংশন। রেল জংশন বড়-ছোট থাকতেই পারে। কিন্তু মাটির নিচে এত বিশাল আয়োজন সেটিই প্রশংসার ও আশ্চর্যের বিষয়। লন্ডনবাসীর মাঝে যে-ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার প্রথম কথা হলো তিনি একজন সিলেটি। টিউব থেকে বেরিয়ে গাইড ম্যাপ দেখে আমরা ব্রিকলেনের দিকে এগোচ্ছি। ফুটপাতে কাপড়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান পড়ছে একটি-দুটি করে। তারই মাঝে এক সবজি বিক্রেতা। শ্মশ্রম্নম–ত। সুট-টাইয়ের দেশে বড় নির্বিবাদে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে দোকান সাজাচ্ছে। তাকে দেখে আমার মধ্যে কেন জানি বদ্ধ ধারণা এলো, লোকটি বাঙালি না হয়েই পারে না। বাংলায় গেস্টহাউসের খোঁজ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় যে-জবাব দিলেন তা হলো, এখন তো হোটেল খোলা পাবে না। সাড়ে দশটা-এগারোটার আগে তো নয়ই।

এ ছাড়া তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মুসলমান?

লোকটি শুরু থেকেই তুমি করে বলছিল। ইচ্ছা করে নয়, ওর অজ্ঞতা থেকে। কী বলতে চায় সে তা জানার জন্য বললাম, হ্যাঁ।

একটি মসজিদের অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,

দু-চারদিন সেখানে থাকতে পারো। তবে খাবারের ব্যবস্থা নিজের।

একটি বারের জন্যও সে আমাদের পরিচয় জানার আগ্রহ অনুভব করল না। যেন ধরেই নিয়েছে আশ্রয়হীন ভাগ্যান্বেষী স্বদেশি যুবক। মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই বর্তে যাব।

প্রকাশ গোমাংসভোজী খাঁটি ব্রাহ্মণ সমত্মান। শুয়োর তার ততোধিক প্রিয়। অবশ্য নেপালে ওর কথামতো ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নেওয়াটা বাংলাদেশের মতো তথাকথিত বড় বিষয় নয়। কারণ সেখানকার অনেকেই প্রকাশের দলভুক্ত। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের একটি বইয়ে পড়েছিলাম, বহুকাল আগে আমাদের দেশে
পুজো-পার্বণে, নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আচার-রীতি সমাধার কাজগুলো চালিয়ে নেওয়ার জন্য উত্তর ভারতের আর্য পুরুষেরা অনার্য মায়ের গর্ভে বীজ বুনেছিলেন। গর্ভজাত পুরুষেরা যাতে ধর্মীয় কাজগুলো চালিয়ে নিতে পারে। যার কোনো বৈধ ভিত্তি ছিল না। তারই বংশানুক্রম ফসল গাঙ্গেয় অববাহিকার নগণ্যসংখ্যক ব্রাহ্মণ সমত্মান। পৌরোহিত্যের আসনটি যাদের নিয়ন্ত্রণে।

সৌমিত্র বৌদ্ধ। আমি মুসলমান। গরুর মাংস ভালোবাসি কিন্তু গরুখেকো নই। সিলেটিকে তাই ব্রিকলেনের রাস্তা দেখিয়ে দিতে বললাম। লোকটি সরল। এর তুমি করে বলা থেকে মনে নেওয়ার কিছু নেই। তবে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাও সাধারণ কিন্তু ইচ্ছা করেই বাদামি চামড়ার মানুষদের অবজ্ঞা করতে চায়। অধিকাংশ বাঙালির দেহের খাঁচাটি ছোট। বলিষ্ঠও নয়। হাজার বছরের ইতিহাসে তার কোনো আবিষ্কার নেই। যুদ্ধজয় নেই। সেই কবে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে একবারই তারা বিজয় সিংহের নেতৃত্বে শ্রীলংকায় উপনিবেশ স্থাপন করতে পেরেছিল। উন্নত মানুষদের সংস্পর্শে এলেই কেবল বোঝা যায় জাতি হিসেবে আমরা আজ অবধি কত পশ্চাৎপদ। হাজার বছরের পরিক্রমায় আমাদের যা কিছু গর্বের তা হলো, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে
যুদ্ধজয় এবং বিশ্বে নিজেদের প্রথমবারের মতো স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা। একটু খেয়াল করলে সহজেই বোঝা যায়, এশিয়ার নতুন শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের প্রতি ইউরোপীয়দের ব্যবহার বাংলাদেশসহ এশিয়ার অপরাপর দেশের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক মর্যাদাপূর্ণ। কোরীয়, জাপানি, চীনাদের সঙ্গে তো তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলে অনেক সময়।

প্যারিসে স্যাকরে কোর একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে জায়গাটির নাম মমার্থ। সেখানে প্রতিদিন শত শত পর্যটকের সমাগম ঘটে। জায়গাটি একটি উঁচু টিলা। টিলার মাথায় সিনাগগ। সিঁড়িতে অনেকটা পথ পেরিয়ে শীর্ষে উঠতে হয়। সিনাগগের আশপাশের প্রাঙ্গণ সারাক্ষণ জমজমাট। সেখানে দাঁড়িয়ে প্যারিসের অনেকটা চোখে পড়ে। প্যারিসকে মনে হয় ধূসর। কংক্রিটপ্রধান। যদিও স্যাকরে কোর নিজে শ্যামলিমায় ঢাকা। সিনাগগে ওঠার সিঁড়ির ধাপে ধাপে ঘন সবুজ ঘাস চোখ নরম করে দেয়। স্যাকরে কোর কথাটির অর্থ পবিত্র আত্মা। সেখানে সাত্ত্বিক মানুষের যত না পদার্পণ ঘটে তার চেয়ে বেশি আসে
ভাগ্য-অন্বেষণকারীরা। নির্দোষ, আনন্দপ্রিয় পর্যটক সেখানে একদ- বিশ্রামের ফাঁকে যেমন ফেলে আসা স্বদেশভূমিকে ভাবে, তার চেয়ে বেশি ভাবনায় বিচলিত থাকে স্যাকরে কোরকে ঘিরে নানা পেশায় জড়িত মানুষ। আফ্রিকান পোড়খাওয়া ফেরিওয়ালা, উপমহাদেশের নব্য টুকিটাকি বিক্রেতা, কমার্শিয়াল আর্টিস্ট, যন্ত্রীগায়ক এবং তাদের সঙ্গী বাদকদল, কঠিন ও কোমলপানীয় বিক্রিকারী এবং টিলার পাদদেশে প্রবেশপথের একটুখানি ওপরে চড়ুইপাখিদের নিয়ে সংসার পাতা মানুষটি ভবিষ্যৎ ভাবনায় বিচলিত ওই লোকগুলোর দলে। পাখির সর্দার ফরাসিটির হাতে চড়ুইয়ের উপাদেয় খাবার। তিনি সেগুলো ছিটোলেই পাখিগুলো খাদ্যের লোভে শরীরজুড়ে বসতে চায়। লোকটির ব্যবসা হচ্ছে মাত্র এক ফ্রাতে এই খাবার পর্যটকদের কাছে বিক্রি করা। আর পর্যটকদের ভালো লাগা হচ্ছে ওগুলো ছড়িয়ে চড়ুইয়ের সান্নিধ্য উপভোগের নির্মল আনন্দে মাতা। বিষয়টি পেশা হিসেবে নেওয়া যায় না; কিন্তু সারাদিনের উপার্জন প্রচুর। স্যাকরে কোরে বাঙালি ফেরিওয়ালা পেয়েছি আমি। তার কাঁধের ব্যাগে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ডিজাইনে করা পস্নাস্টিক ও সিলোফেন জাতীয় পাতলা কাগজের পাখি। খেলনাটি চাবি দিলে পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত উড়তে পারে। পৃথিবীর সব নামকরা শহরের মতো সেখানেও ফেরিওয়ালার জীবন অনির্বিঘ্ন। মাঝেমধ্যেই আছে পুলিশের তাড়া। তবে ওপরে সিনাগগের পাশের শিল্পীপলিস্নটি চমৎকার। অন্তত পঁচিশ-ত্রিশজন আর্টিস্ট ছবি এঁকে যাচ্ছে একনাগাড়ে। তাদের বসার আবহটি ফুটপাতে সেলুন বিছিয়ে বসার মতো। একটি টুল ও ইজেল নিয়ে পদচারণা করছে তারা। কোনো পর্যটক পঞ্চাশ কিংবা একশ ফ্রাঙ্ক খরচ করতে রাজি হলেই এক ঘণ্টার কম সময়ে তার পোর্ট্রেট আঁকা হয়ে যাবে। পোর্ট্রেট ছাড়াও এসব শিল্পী ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র প্রভৃতিও করে আর বোধহয় স্বপ্ন দেখে রঁদা, বত্তিচেলি, রেমব্রান্ড, পিকাসো হওয়ার। ওঁদের অনেক শিল্পকর্ম ভালো বাঁধাইয়ে যত্ন করে টানানো আছে চত্বরটি ঘিরে। দাম নেহাত কম নয়। শৌখিন মধ্যবিত্ত বাঙালিদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এসব শিল্পীর কারো কারো উদ্ভাবনী যথেষ্ট রসবোধপূর্ণ। যেমন একটি স্যুভেনির শপে ঝুলছে গেঞ্জি। সেগুলোর বুকের ওপর এক আকারের নানা ভঙ্গির না হলেও দেড় ডজন স্তন। সাদার ওপর কালো প্রিন্টগুলো ফুটেছে ভালো। বাইশ-চবিবশের একটি ফরাসি জোড়া দাঁড়িয়ে দেখছে তা। একটি স্তন দেখিয়ে ছেলেটি বলল, সেটির আকার-প্রকার মেয়েটির মতো। তরুণীটি তখন তার কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো। স্যাকরে কোর জায়গাটি বড় নয়। তবু আয়োজন বাড়াতে ও পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য ঢাকার শিশুপার্কের ট্রেনের মতো এখানে রয়েছে মিনি ট্রেন সার্ভিস। তবে ট্রেনগুলোর জন্য রেলের দরকার হয় না। কারণ এর চাকাগুলো রবারের। ফরাসি মুল­yকে দূরপাল্লায় ডিলাক্স কোচেও এ-ধরনের চাকা। সেগুলো সব নিরেট টায়ার, ভেতরে কোনো টিউব নেই।

স্যাকরে কোরে যেটি মজার বিষয় তা হলো, সিঁড়িতে বসে বিয়ার-ঠোঁটে অলস ভঙ্গিতে লাতিনোদের গান শোনা। চমৎকার বাজনার সঙ্গে তারা গায় এবং নিয়মিত ব্যবধানে টুপি উলটিয়ে ধরে পয়সা তোলে। কোনো চাপাচাপি নেই। নিজেদের গানের ক্যাসেটও বিক্রি করে তারা। তাদের গান শুনতে শুনতে, শিল্প-সাহিত্যের অনুপম নগরী ধূসর প্যারিসের ঝাপসা বিস্তারে চোখ রেখে একটি কর্মদিন কাটিয়ে দেওয়া কোনো ঘটনা নয়। এই গানের আসরেই একটি কোমলপানীয় বিক্রেতা আমাকে তুই করে বলেছিল। ইচ্ছা করেই। কারণ পাশের শ্বেতকায়দের সে আপনি সম্বোধন করছিল। বাংলা ভাষার তুই ও তুমির মতো ফরাসি ভাষায়ও দুটো সম্বোধন আছে। তু এবং ভু। ফেরিওয়ালাটি বারবার তু করে বলছিল। আমি এর জবাবের কোনো প্রয়োজন মনে করিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় বাঙালির এখন ইমেজ সংকট চলছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায়। এটি কাটাতে আরো অনেক বছর লেগে যাবে। এ সমস্ত দেশের শ্বেতকায়রা প্রায়শ দেখছে বাদামি রঙের খর্বকায় একজাতীয় মানুষ তাদের হোটেল-রেসেত্মারাঁয় কাজ করে। মেট্রো কিংবা ব্যস্ত এলাকায় ফুল, বাদাম অথবা সিগারেট, লাইটার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমি যতটুকু জানি, সমগ্র ফ্রান্সে এ-মুহূর্তে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি অবস্থান করছেন। তাঁদের শতকরা একজনেরও সামনে ডেস্ক নিয়ে বসে কাজের মতো কোনো কর্মসংস্থান হয়নি। এসব অড জব থেকে পয়সা আসছে, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে আমাদের দেশ; কিন্তু পাশাপাশি ভাবমূর্তি যে বিনষ্ট হচ্ছে সে-বিষয়েও সন্দেহ নেই।

আজ পর্যন্ত যত বিদেশির সঙ্গে কথা হয়েছে তাতে দেখেছি তারা আমাদের চেনে সাইক্লোন আর ত্রাণসাহায্যের সংবাদে। কারণ পরিচয় পর্বের প্রারম্ভেই তারা এ-প্রসঙ্গ আনে। এদের সংখ্যা কম নয়। প্রায় চলিস্নশটি দেশের নাগরিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। ভিশিতে ফরাসি ভাষা শেখাকালে পরীক্ষার প্রশ্নেও এ থেকে রেহাই পাইনি। বিষয়টি এরকম – বাংলাদেশের জলোচ্ছ্বাসের ওপর একটি মর্মস্পর্শী অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে নিচে অনুভূতি প্রকাশমূলক কিছু শব্দ দেওয়া হয়েছে। ওই শব্দগুলো থেকে পরীক্ষার্থীদের ভাবপ্রকাশকারী সঠিক শব্দটি নির্বাচন করতে হবে। ভিশির দৈনিক সংবাদপত্র লা মোনতানে কোনোদিন আমাদের খবর দেখিনি। ১৯৯১-এ যখন ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত ও গৃহহীন হলেন, তার পরদিন ব্যানার হেডলাইনে বাংলাদেশকে পেলাম। নিঃসন্দেহে এই ঘটনার সংবাদমূল্য অপরিসীম। কিন্তু যেমনটি দেখি, পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যম অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু নেতিবাচক খবরগুলোকে প্রাধান্য দেয়। আমাদের সম্পর্কে পাশ্চাত্য এত কম জানে যে, আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ফরাসি লেখকের একটি বহুল আলোচিত গ্রন্থেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির বছরটি ১৯৭১-এর পরিবর্তে ১৯৭৪ উলেস্নখ করা হয়েছে। পৃথিবীতে আজ অবধি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে একটি মাত্র দেশ। তার উদাহরণে বাংলাদেশের নাম বলতে গিয়ে ওই অপকর্মটি ঘটানো হয়েছে।

ব্রিকলেনে আমাদের অবস্থানের মেয়াদ ছিল ঘণ্টাদুয়েক। সেখানে যে অনেক বাঙালি আছেন এবং তাঁদের শেকড়ও মাটির গভীরে বেশ ঢুকেছে তা ভালোই বোঝা যায়। ব্রিকলেনে বাংলায় শাড়ি, চাল প্রভৃতির বিজ্ঞাপন, বাঙালি মালিকানাধীন দোকানপাট, সোনালি ব্যাংকের শাখা অফিস দেখে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা কারো মনে হতে পারে সে বাঙালি মহল্লায় প্রবেশ করেছে। আমরা দুদফা ব্রিকলেন ঘুরে দেখলাম। ব্রিকলেন সবে জাগছিল তখন। আমাদের ভাবনায় প্রথম থেকেই কাজ করছিল মাথা গোঁজার বিষয়টি। বাঙালি অভিবাসী এলাকায় যদি একটি গেস্টহাউস পাওয়া যেত তবে তাতে যেমন খরচ সাশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে তার চেয়ে বড় সুবিধে দেশীয়
খাবারপ্রাপ্তি। দিনের পর দিন ফরাসি খাবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা। মন্থরগতিতে একটি পাকিস্তানি রেসেত্মারাঁয় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। রমজান শুরু হয়েছে বলেই হয়তো অন্য কোনো খদ্দের নেই। সারা রেসেত্মারাঁয় আমরা মাত্র তিনজন। নাস্তার প্রাচ্যদেশীয় মেন্যু আমাদের যথেষ্ট তৃপ্তি দিলেও থাকার জায়গার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত নিরাশ হতে হলো। কারণ ব্রিকলেনে বাঙালি-পরিচালিত কোনো গেস্টহাউস নজরে পড়ল না আমাদের।

তবে অসুবিধে হয়নি। সেখান থেকে হাইকমিশনে যোগাযোগ করলে শহীদুল হক ওঁর গাড়িতে আমাদের প্যাম ব্রিজে বাংলাদেশ সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। লন্ডনের একটি সপ্তাহ আমরা সেখানেই থাকব।

সেন্টারটির অবস্থান একটি তিনতলা ভবনে। কাছেই টিউব স্টেশন নটিং হিল গেট। বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সেটি নিজস্ব সম্পত্তি। সেখানে সাময়িক আবাসনের জন্য কয়েকটি রুম আছে। নিচে কিচেন। কেউ ইচ্ছা করলে রেঁধেও খেতে পারে। স্নানাগার, টয়লেটের অবস্থা চলনসই। ভাড়াও সে-অনুযায়ী। দৈনিক মাত্র ১০ পাউন্ড। ভবনের পেছনের স্ট্রিটে আশরাফ মিয়ার রেস্টুরেন্ট। সেখানে তুলনামূলক কম খরচে খাবার ব্যবস্থাও করেছেন শহীদুল হক। আশরাফ মিয়ার বাড়ি সিলেট। ছাবিবশ বছর হলো আছেন বিলেতে। প্রথম সন্ধ্যায় যেদিন ডিনারে গেলাম নিজ থেকেই তিনি বললেন সব। আরো বললেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েদের দেশ এখন এটিই। আমরা যতদিন আছি ততদিনই শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ।’ প্রবাসে অনেকদিন আছি জেনে নিজেই মেন্যু ঠিক করে বললেন, ‘আমি জানি আপনাদের এখন কী ধরনের খাবার চাই।’

করলা, ঢেঁড়স ভাজি, মুরগি, চিংড়ি ভুনার সঙ্গে এলো ডাল। জানালেন, ইলিশ মাছ আজ তিনি করেননি। আশরাফ মিয়ার রেস্টুরেন্টে বাঙালির তুলনায় ইংরেজদের সংখ্যাধিক্য। প্রতি সন্ধ্যায়ই দেখি ইংরেজ খদ্দেরে ধীরে ধীরে রেস্টুরেন্টের নিচতলা, ওপরতলা ভরে ওঠে। বাংলাদেশি খাবার ব্রিটিশদের এতো প্রিয় জানা ছিল না। সেই রেস্টুরেনেট বসেই এক সন্ধ্যায় একজোড়া স্থানীয় তরুণ-তরুণীকে তাদের বিয়েতে যাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে তাদের, তালিকা করতে দেখলাম। সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে বাঙালিদের রেসেত্মারাঁ-ব্যবসা যুক্তরাজ্যে ভালোই চলছে। সারা বিলেতে বাঙালি-পরিচালিত রেস্টুরেন্টের সংখ্যা তাই প্রায় দশ হাজার।

আশরাফ মিয়া বলেছিল, আমাদের ছেলেমেয়েদের আর সে-অর্থে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না। লন্ডনে বাসে কিংবা টিউবে, অক্সফোর্ড স্ট্রিটসহ নানা জায়গায় ঘোরার সময় নতুন প্রজন্মের বাঙালি কিংবা ভারতীয়দের দেখে আমার কতকটা তাই মনে হচ্ছে। এদের ইংরেজি কথোপকথনে কোনো উপমহাদেশীয় টান নেই। উচ্চারণ নিখুঁত হওয়ায় তা কান পেতে বুঝতে হয়। পরিচ্ছেদ তো বটেই, ভাবভঙ্গিও এদেশীয়দের মতো। দীর্ঘদিন বিলেতে আছেন এমন একজন বললেন, ‘এখানে এখন আমাদের শিকড় গজিয়ে গেছে, কারণ খুন করার জন্য আপনি লন্ডনে ভাড়াটে বাঙালি পাবেন।’ ওঁর ভাষ্যমতে, একমাত্র সাউথ ওয়াল গেটেই পঞ্চাশ হাজারের ওপর বাঙালির বাস। ইংরেজদের সঙ্গে গোলমালে তাদের অনেকেই লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। জানি না এসব কতটুকু সত্যি। কারণ মাত্র এক সপ্তাহে লন্ডনের মতো একটি প্রাচীন ও বিশাল নগরীর কতটুকুইবা জানা সম্ভব। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ভালো করে দেখতেই যেখানে এর চেয়ে বেশি সময়ের প্রয়োজন। তবে পরিবর্তন যে আসছে না তা নয়। অতি নিভৃতে ঘুরে যাচ্ছে ইতিহাসের চাকা। প্রাকৃতিক সম্পদ ফুরিয়ে আসছে ইউরোপে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ লৌহ ও কয়লার খনি। প্রযুক্তি,  বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও সার্ভিসের দক্ষতায় বর্তমানে টিকে আছে উপনিবেশবাদী ইউরোপ।

লন্ডনের আবহাওয়া মাঝেমধ্যেই অসুবিধেয় ফেলছে আমাদের। বিস্তর না হলেও বৃষ্টি হচ্ছে বেশ। আর তাতেই টিউব, দোকানপাট কিংবা পাবে ঢুকতে হচ্ছে দৌড়ে। বৃষ্টির সময় পাব মন্দ জায়গা নয়। বসে বসে চুমুক দেওয়া আর ভাবনার জাল ছড়িয়ে যাওয়া। সঙ্গী থাকলে হতে পারে তুমুল আড্ডা। প্যারিসের বারের সঙ্গে লন্ডনের পাবের পার্থক্য রাজসিক পানকারীরা ভালো বলতে পারবেন। এখানকার পাবে ঢোকার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে দু-জায়গার পানশালার সজ্জা ভিন্ন আর আসবাবে রয়েছে প্রভেদ। বারের মতো পাবে সচরাচর সাইনবোর্ড দেখা যায় না। বহির্দ্বার ও জানালার প্রতিনিধিত্বমূলক নকশা থেকে অনেক ইমারতের মাঝেও পাবকে চেনা যায়। শোনা কিংবা পড়ায় একটি জায়গা সম্পর্কে আগেই জানা হলে স্থানটির একটি অবয়ব মনের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায়। বিলেত সম্পর্কে এভাবে পরোক্ষ জানাশোনা আমাদের
একটু-আধটু ছিল। পরোক্ষ পরিচিত জায়গাগুলোর যে-চেহারা এতদিন মানসচক্ষে দেখেছি তার সঙ্গে বাস্তবের মিল ছিল না। অবশ্য সেটিই সচরাচর হয়ে থাকে। হাইড পার্ক দেখে আমি ইতোমধ্যে রীতিমতো হতাশ হয়েছি। যেমনটি আশি সালে হয়েছিলাম কলকাতার গড়ের মাঠ দর্শনে। দুটো স্থানকেই বিরান প্রান্তর বললে অত্যুক্তি হবে না। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের হাইড পার্ক নাকি গণতন্ত্রচর্চার পীঠস্থান বিশেষ। যুক্তরাজ্যে যে-কোনো নাগরিক এখানকার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশগুলোয় স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত দিয়ে থাকেন। বাক্স্বাধীনতা এখানে এতটাই স্বীকৃত যে, কেউ কথা বলতে চাইলে হস্তক্ষেপ আসে না। এসব থেকে ধারণা হয়েছিল, বারোয়ারি লোকের সমাবেশে হাইড পার্ক সারাক্ষণের জন্যে প্রাণবন্ত। আমরা যেদিন সেখানে গেলাম সেদিন পার্কটি নিথর হয়ে ছিল। অবশ্য ছুটির দিনের চরিত্রটি এরকমই কিনা জানি না। শ দু-তিনেক চেয়ার ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে বিশাল পার্কটির এক কোণে। তাতে একটি প্রাণীও আসীন নেই। শুধু অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকের গেটটায় একটি পানীয় স্ন্যাকসের ট্রলি। খদ্দেরের চাপ না থাকায় বিক্রেতা একটি সুদর্শনা, বিশাল স্তনের অধিকারিণী খোঁড়া মেয়ের সঙ্গে র‌্যালা করছে। পার্কের কাছে মার্বেল আর্চের সামনে ব্রিটেনের যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড় হয়ে থাকার ভবিষ্যৎ মেয়াদ নিয়ে ফলহীন তর্কে বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম সবাই। কাপড়ের হেলানো চেয়ারে তাই গা ছেড়ে দিলাম। হাইড পার্কের বিশাল শূন্যতায় চোখ রাখলে তা আপনিই বুজে এলো। আমাদের কোনো তাড়া ছিল না। লন্ডনের বিখ্যাত লালরঙা ডাবল ডেকারে সাইট সিয়িং ট্যুর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। হাইড পার্কের কোণ থেকে প্রতি আধঘণ্টা পরপর যাত্রারম্ভ সেটির। এই নগরীর বিশেষ স্থানগুলো মাত্র দু-আড়াই ঘণ্টায় আমরা এক পলক দেখব।

ডাবল ডেকার বাসের ছাদহীন দোতলায় বসে যখন আমাদের ওই ভ্রমণ শুরু হলো তখন চারদিকে চমৎকার রোদ। সময়টি মধ্যাহ্ন হওয়ায় ঝকমকে ভাবটা একটু বেশি। অক্সফোর্ড স্ট্রিট ছুঁয়ে গ্রসভেনর স্কয়ারের পাশ দিয়ে পিকাডেলি হয়ে বাসটি ট্রাফালগার স্কয়ারে একটু দাঁড়াল। কিন্তু আরোহীদের নামতে দেওয়া হলো না। অবশ্য সেরকম ব্যবস্থা যে নেই তা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামান্য থামা সে শুধু পর্যটকদের ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যবস্থাটি পরে আর বহাল
থাকল না। হোয়াইট হল, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে, ওয়েস্টমিনস্টার সেতু প্রভৃতির মিলনক্ষেত্র পেরিয়ে যখন বিখ্যাত বিগ বেন ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনির দূরত্বে এলাম, তখন বাসটিকে না থামতে দেখে একটু আশ্চর্য হলো সবাই। জোরদার কোনো অনুরোধ না আসায় বাসটি পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে নগরীর মাঝ বরাবর প্রবাহিত টেমস নদীর ওপরকার ল্যামবেথ সেতুতে উঠে গেল। ল্যামবেথ থেকে নদী তীরবর্তী পার্লামেন্ট ভয়ানক চমৎকার লাগছিল। কিন্তু আমাকে তার চেয়ে বেশি আলোড়িত করছিল ‘রিভার টেমস’। যখন পাঠশালার ছাত্র ছিলাম, তখন টেমসের একটি রঙিন পোস্টারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। নীল জল আর তাতে ভাসমান জাহাজ ও ছোট ছোট প্রমোদতরির পানে তাকিয়ে পরিবেশটি অনুধাবনের চেষ্টা করেছি বহুদিন। অথচ সে-ভাবনার প্রায় পঁচিশ বছর পর আমি সত্যি সত্যিই টেমসের বুকে। সেই কিশোর-চোখও নেই – ছবির মতো সুন্দর টেমসও ছিল না কখনো। তাই আমার আজকের চোখে নদীটির দূষিত জল আর হৃদয়ে কৈশোরস্মৃতির সূত্রে পাওয়া আলোড়ন ছাড়া অবাক কোনো বিস্ময় এলো না।

এই ফাঁকে অক্সফোর্ড স্ট্রিট আর ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের কথা একটু বলে নিতে চাই। লন্ডনে কেনাকাটার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে অক্সফোর্ড স্ট্রিট। তেল ব্যবসায়ী ও স্থাবর সম্পত্তির কারবারিদের মধ্যে অনেকের বসবাসও সেখানে। আরো আছে তৈরি পোশাকের বিখ্যাত দোকান মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং সি অ্যান্ড এ-এর শাখা। তবে ইংল্যান্ডের থান কাপড় অনেক ক্ষেত্রেই দেশের বাইরে সস্তা। কয়েক মাস আগে পোর্টসাঈদে খুব সস্তায় আমি এখানকার তৈরি কয়েক পিস সুটের কাপড় কিনেছিলাম। ধারণা ছিল, আরো সস্তায় লন্ডনে পাওয়া যাবে। কিন্তু দাম যা দেখছি তা পোর্ট সাঈদের তুলনায় তিনগুণ।

আজকের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে এলাকা কয়েকশো বছর আগে জলাভূমি ছিল। একাদশ শতকে এটির গড়ে ওঠা শুরু হয়। খানিক বাদে ইয়র্ক সড়ক থেকে বাঁয়ে নেমে আবার বাসটি টেমসে উঠল। এবার ওয়াটারলু সেতু ধরে নদী পেরোনোর পালা। গাইড তার পেশাদারি ভাষণে বলছে, এরকম আরো দুদফা টেমসকে পাড়ি দেবো আমরা। একবার লন্ডন ব্রিজ হয়ে আরেকবার টাওয়ার ব্রিজ ধরে। যোগাযোগ দ্রম্নত ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য টেমসের বুকে নির্মাণ করা হয়েছে অনেক ব্রিজ। পৃথিবীর সব উন্নত নগরীর এটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে আমরা অনেক পেছনে। ঢাকার সীমানাবর্তী নদী বুড়িগঙ্গায় মোটে একটি মাত্র সেতু ‘মৈত্রী’ গড়তে পেরেছি আমরা। প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বহতা সিয়েন নদীর দুপার অনেকগুলো সেতু দিয়ে সংযুক্ত। প্রাচীন ফেরাওনিক সভ্যতার পাদপীঠ কায়রোর প্রাণতরঙ্গ নাইলের ওপরও গড়া হয়েছে একাধিক সড়ক-সেতু। যে-কারণে এসব নগরকে আর বিভক্ত মনে হয় না। চলাচলেও নেই কোনো ভোগান্তি।

টাওয়ার ব্রিজকে দেখে আমার মনে হলো, এটির নির্মাণকৌশল ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের কারিগরি পন্থার মতো। এরকম ব্রিজ আরো দেখেছি। কলকাতার হাওড়া ব্রিজ এবং রাঙামাটিতে পর্যটন মোটেলের কাছের ছোট্ট সেতুটি এমন ধরনের। তবে বিনীতভাবে বলছি, সবই আমার অনুমান। কারণ প্রকৌশলবিদ্যা আমার মধ্যে নেই।

রাঙামাটির ব্রিজটিকে মনে পড়ছে কারণ আমার তৃতীয় দফা রাঙামাটি ভ্রমণে আমি আর লীনা আমাদের বিয়ের সাতদিনের মধ্যে ওখানটায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। ওই সেতুটি মনে পড়ার আরো একটি বিশেষ কারণ দ্বিতীয় দফা রাঙামাটি সফর। বিয়ে উপলক্ষে ওই ভ্রমণটি খুবই উপভোগ্য হয়েছিল। ঢাকা থেকে এক সকালে আমার এখনকার সফরসঙ্গী তখনকার বর সৌমিত্র চাকমার সঙ্গে আমত্মঃনগর ট্রেনে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পথে চট্টগ্রাম রওনা হলাম। আমাদের সঙ্গী ছিল দুটো চাকমা মেয়ে। দুজনই মেধাবী। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে, অন্যজন মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। ছ-ঘণ্টার কিছু বেশি সময় পর চট্টলায় পৌঁছে গেলাম। রাতটি সেখানে কাটিয়ে পরদিন বরযাত্রীবেশী আমরা যাত্রা করব রাঙামাটি। বাকি দিন এবং সন্ধে চমৎকার কাটল। যে-বাসায় উঠেছিলাম সেখানকার সময়টুকু এবং সন্ধ্যায় সৌমিত্রের ম্যাজিস্ট্রেট-বন্ধু জ্ঞান প্রকাশের বিয়ে উপলক্ষে চিনে রেসেত্মারাঁর আসর খুব ভালো লাগল আমার। এর আগে কখনো দেশের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী পৃথক জাতিসত্তার নাগরিকদের সঙ্গে এভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। যতই মিশছিলাম জানার সুযোগ হচ্ছিল ততই। চাকমা তরুণ-তরুণীদের সম্পর্ক অনেক সহজ ও সাবলীল মনে হলো। অন্তত বাঙালিদের তুলনায়। চট্টগ্রামে যে-বাসায় উঠেছি আমরা সেখানে কোনো মহিলা বাসিন্দা দেখছি না। পৌঁছার পর হোটেলের মাংস, ভাত মেঝেতে সংবাদপত্র বিছিয়ে খেলাম। চাকমা মেয়ে দুজন এতে যেভাবে যোগ দিলো এবং পরে ব্রিজ খেলায়ও অংশ নিল তাতে আমার মনে হলো, এদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক খোলামেলা।

পরদিন প্রাতরাশের পর একটি সংরক্ষিত বাসে আমরা রাঙামাটি যাত্রা করলাম। অপরাহ্ণে নন্দিতা খিসার সঙ্গে সৌমিত্রের বিয়ে। নন্দিতার বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা। নানা সুবিমল দেওয়ান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরো কয়েকজন পাহাড়ি নাগরিক। এদের পাঁচ-সাতজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আমি তো এমন পরিবেশ পাইনি কখনো, তাই ভালো লাগছিল খুব। বাসটি যখন পার্বত্য জেলায় প্রবেশ করল একজন বলল, ‘এখান থেকে কি একটি আলাদা দেশ হতে পারে না?’ কতক্ষণে আমরা রাঙামাটি পৌঁছব – এ-আলোচনায় পথের আর্মি পোস্টের তল্লাশিকে কেউই স্বাভাবিকভাবে নিল না। কারণ একই দেশের নাগরিক হয়েও এই পীড়ন থেকে তারা বাঙালিদের মতো মুক্ত নয়। রাঙামাটি পৌঁছে এর চেয়েও সরাসরি আলোচনার মুখোমুখি হলাম। তবে আমাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে বিতর্ক করার মতো কোনো ঘটনা ছিল না সেটি। বাস থেকে নেমে শহরের একটি চাকমাপলিস্নতে সৌমিত্রের এক আত্মীয়ার বাসায় উঠলাম আমরা। ওর প্রস্তাবিত শ্বশুরবাড়ি কাছেই। বরযাত্রা তাই ওখান থেকেই। পদব্রজে। এত কাছে যে অন্য কোনো বাহন অপ্রয়োজনীয়।

চাকমা সম্প্রদায়ের বিয়েতে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। আধুনিক মুসলিম সমাজে প্রচলিত ‘চুক্তি’র মতো কোনো ব্যাপার তো নয়ই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, পুরোহিত মুরবিবদের সামনে বর-কনের হাত এক করে দেন। মেয়ের জন্য ‘ডালা’ নেওয়া এবং অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খিসা মহাশয়ও অনেককে নিমন্ত্রণ করেছেন। শুয়োর এবং মুরগি কাটা হয়েছে বহু আগেই। চুলো থেকে সেগুলো নামাতে আর সামান্য দেরি। বিয়েবাড়িটি লেকের পাড়ে। গাছপালায় ছাওয়া। টিলার ওপরকার সব বাড়িতেই গাছপালা দেখতে পাচ্ছি। রাঙামাটি কলেজ থেকে
ইট-বিছানো রাস্তায় সামান্য এগোলেই পাড়াটি। শহরের কোলের মাঝে হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট নিরিবিলি। ছায়াময় শ্যামল গ্রামের মতো। সেই ছায়ায় চেয়ারে বসেছিলাম আমরা। কালামামা আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন আসরে। আসরটি বসেছে একটি ফাঁকা বাড়িতে। মাটির ঘর। বাঁশের বেড়া। মেঝে সুন্দর করে নিকানো। তিনি কনের মামা। ওঁর গাত্রবর্ণ চাকমা গোষ্ঠীর গড় গায়ের রঙের চেয়ে একটু নিম বলে সবাই ভালোবেসে ডাকে কালা, যা কৃষ্ণেরই নামান্তর। কালামামার মতো আরো কয়েকজন চাকমা যুবককে পেলাম আমি। কেউ সিভিল সার্ভেন্ট, কেউবা সবে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন। ওরা বললেন, ‘আপনি বরের বন্ধু, খালি গলায় লেকের ঢেউ গুনবেন তাই কি হয়।’ অতএব জিনিস এলো। ফুরিয়ে গেলে আবার এলো। তৃতীয় দফায় বেশ কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হলো। একজন বললেন, ‘রাঙামাটি কেমন লাগছে?’ বললাম, ‘ভালো।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অন্য আরেকটি কারণে এ-জায়গাটি আমার ভালো লাগে। বাংলাদেশের এটিই মনে হয় একমাত্র শহর যেখানে রিকশার গঞ্জনা নেই। গরিবের বাহনও স্কুটার। আর মনে হয় বলছি এজন্য যে খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুর, বরগুনা ও কুড়িগ্রাম – এই পাঁচটি জেলায় যাইনি।’

পার্বত্য জেলায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শান্তি বাহিনী প্রসঙ্গে দু-তিনজন খোলাখুলি আলোচনা করলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন এমন একজন বললেন, পাহাড়ি ছাত্র প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে এ নিয়ে তারা কয়েকবার কথা বলেছেন এককালীন পররাষ্ট্র সচিব নজরুল ইসলামের সঙ্গে। আমি মূলত শুনছিলাম। ১৯৭১ সালে আমত্মঃনিয়ন্ত্রণের জন্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের দিন মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম, স্বাধীন দেশ হিসেবে ভূপরিবেষ্টিত পার্বত্য জেলার আত্মপ্রকাশ আসলেই টিকে থাকার মতো কিনা। পাহাড়ি পানীয় খুব কড়া। মনে হয় এর সবটুকুই নির্জলা মদ। তবু পাত্র খালি হয়ে যাচ্ছিল। চতুর্থ দফায় শূন্য গ্যালন নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এলো বাহক। আমাদের মাঝে একজন প্রৌঢ় ছিলেন। পরনে লুঙ্গি। খালি গা। কথায় বোঝা যাচ্ছিল কালামামাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। প্রয়োজনে ফরমায়েশও শোনে। দ্রব্যগুণ কিনা জানি না দীঘলকান্তি, বক্ষের দশ আনা জুড়ে পেটওয়ালা লোকটি চ্যালেঞ্জ করে সুরা আনতে গেল। কৃতকার্য হয়ে ফেরার পর দেখলাম লোকটি সৃষ্টিছাড়া রসিকও বটে। আমার পাত্রটি ভরে দিয়ে দাঁত মেলে বললেন, ‘আপনার গস্নাসটির মুখ বেশি ছড়ানো তাই গ্যালন কাত করতে করতে ভরে গেল।’

পার্বত্য সমাজে মদ্যপান অচ্ছুত বিষয় নয়। তারপরেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব ছুঁয়েও দেখেন না। তবে কনের পরিবারটি এ ব্যাপারে রক্ষণশীল নয় বলেই মনে হলো। বিয়ের পরদিন মধ্যাহ্নভোজে বসেছি। অতিথি আমরা মাত্র দুজন। টেবিলে কনের বাবা এক বোতল পানীয় নিয়ে এলেন। কিন্তু আগের বিকেলে যথেষ্ট হওয়ায় সেদিকে আর তাকানোর সাহস হয়নি।

টাওয়ার ব্রিজ ধরে টেমস পেরোনোর খানিকক্ষণ পর আমরা এবার লোয়ার টেমস স্ট্রিট ধরে পুবদিকে চলতে শুরু করলাম। ডাবল ডেকারের খোলা ছাদে কয়েকজন মাত্র পর্যটক। আবহাওয়া ভালোই ছিল। কিন্তু এখন আকাশ ঘোলা হয়ে আসছে। বাতাস ছুটতে শুরু করেছে জোরে। তাতেই শীত শীত লাগতে আরম্ভ করল। অন্য রাস্তায় ফিরতি যাত্রা চলছিল আমাদের। গাইড বলছিল, পথে আবার পড়বে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে, তারপর বাকিংহাম প্যালেস এবং সেখান থেকে আমরা হাইড পার্ক কর্নারে ফিরে যাব।

গাইডেড ট্যুরে লন্ডন দেখা আমাদের এটুকুই। এ-ধরনের দেখার চেয়ে নিজেরা ঘুরে দেখলেই বেশি জানা যায়। এর মধ্যে একদিন আমরা কাটিয়েছি অক্সফোর্ডে। লন্ডন থেকে বাসে মাত্র চলিস্নশ মিনিটের পথ। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরলুম। অক্সফোর্ড ছোট শহর। আমাদের মতো সাধারণ পর্যটকদের সেখানে দেখার তেমন কিছু নেই। ইংরেজরা বুদ্ধি খাটিয়ে প্রায় দুশো বছর আমাদের প্রভু ছিল। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এদের বহুকিছু শুনেছি আমরা। ভারতবর্ষে ইংরেজদের ভালো কাজগুলোর একটি ওদের শিক্ষাব্যবস্থার ধাঁচে স্কুল-কলেজ স্থাপন। অক্সফোর্ডের পড়াশোনা নিয়ে আমরা এত শুনেছি যে, তা কতকটা ‘কাহিনি’র মতো। পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর তালিকায় এ-নামটি বেশ বনেদি। তা অক্সফোর্ডে না হলে বিশটির মতো কলেজ রয়েছে বইকি। আমি অবশ্য জানি না, কোন কলেজটির সবচেয়ে বেশি সুখ্যাতি। আমরা যতটা পারি পায়ে পায়ে অক্সফোর্ড ঘুরলাম। কোনো সংগীত বিদ্যালয়ের একদল ছাত্রছাত্রী বয়সে কিশোর-কিশোরী, চৌরাস্তার সন্ধিস্থল কারফাক্সে চারদিক খোলা একটা ছাউনির নিচে বেহালায় চমৎকার সুর তুলছিল। সে-বাদ্যে জমে গেল ভিড়। ভিড়ের অংশ হয়ে জিরিয়ে নিলাম আমরা। কিন্তু কেনাকাটা, ম্যাকডোনাল্ডসে দুপুরের খাওয়া, ডৌম রেড ক্লিফে আরো কিছু হাঁটাহাঁটি, ফেরার আগে বাস টার্মিনালের গপ্পো – এভাবেই কেটে গেল অক্সফোর্ডের দিন। সেখানকার স্যুভেনির শপগুলোয় পেলাম তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির সংবাদ। অক্সফোর্ড-নামাঙ্কিত গস্নাস, কাপ, চাবির রিং কিংবা ইরেজার, পেনসিল, কলম প্রভৃতি দেখে পর্যটক বিভ্রান্ত হতে পারেন এগুলো ব্রিটেনে তৈরি। কিন্তু এসব নিদর্শন এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। অল্প পুঁজিনির্ভর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানায় এ জিনিসগুলো সহজেই তৈরি হতে পারে।

প্যারিসে ফেরার আগের দিন বৃষ্টি আমাদের ভালোই নাজেহাল করল। সকাল থেকেই আকাশ ছিল বোজা। সঙ্গে ছিল হাওয়া। এর আগের দিনগুলো সামার সুটেই চালানো গেছে। সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট পরে নিলাম। সোয়েটারটি উপহার পেয়েছি। ভিশিতে একবার খুব ঠান্ডা লাগল। কাঁচা সর্দি পড়তে পড়তে নাক হয়ে উঠল লাল। আমার সহপাঠিনী প্যালেস্টাইনি তরুণী সারাহ তখন ওটি কিনে দেয়। সঙ্গে এক হালি সবুজ লেমন। আমার ভালো গরম কাপড় ছিল না সে-সময়। ওর ধারণা হয়েছিল, ভিটামিন সি-র অভাব ও ঠান্ডা লাগায় আমার ওই দুরবস্থা। লন্ডনের দিনগুলো হাতেগোনা। মেঘাচ্ছন্ন দিনকে ভাবনায় না নিয়ে তাই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য মাদাম তুশোর ওয়াক্স মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি প্রধানত মোম ও নানা উপকরণে তৈরি ইতিহাসখ্যাত সব ব্যক্তির প্রতিমূর্তিতে পূর্ণ। বর্ণাঢ্য পোশাকে সেগুলো হয়ে উঠেছে আরো জীবন্ত। তুশো নাম্নী এক ক্ষীণাঙ্গিনী ১৮০২ সালে হঠাৎ করেই এ-ধরনের কাজ আরম্ভ করেন এবং তা ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়। তিনি অবশ্য অনেক আগেই মারা গেছেন; কিন্তু এখনো ওই ধারায় কাজ চলছে এবং তাঁর নামে পরিচিতি লাভকারী মিউজিয়ামটি দিনের পর দিন সমৃদ্ধ হয়ে চলছে। আমাদের উপমহাদেশের ইন্দিরা গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর আবক্ষ মূর্তি এখানে জায়গা পেয়েছে। এখানে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক নেতা ভস্নাদিমির লেনিন যেমন আছেন, তাঁর চেয়ে কোনো অংশে কম জাঁকিয়ে নেই স্ত্রী হমত্মারক ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপস্নবে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্ত্রী অনুপম ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন তুশোর মিউজিয়ামে। শ্বাস টানায় তার বক্ষ ওঠানামা করছে। অধিকাংশ কাজই এত শিল্পম–ত যে, খুবই প্রাণবন্ত মনে হয়। ফরাসি বিপস্নবকালে অভিযুক্তদের শিরশ্ছেদের জন্যে ব্যবহৃত গিলোটিন নমুনা হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে মিউজিয়ামটিতে। মাদাম তুশো এই গিলোটিনপ্রাপ্ত লোকদের শুধু মস্তকসংবলিত প্রতিমূর্তি গড়ার মধ্য দিয়ে এ-ধরনের কাজ শুরু করেছিলেন। আরো আছে বিখ্যাত সব খুনির পরিচয় সংবলিত আলোকচিত্র। মিউজিয়ামের এই অংশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে নরক বলে। তুশোতে ঢুকতে পকেট থেকে কয়েক পাউন্ড বেরিয়ে যায় টিকিট কাটতে। তবু এই মলিন, ঠান্ডা দিনে দর্শনার্থীর কমতি নেই। সারি বেঁধে তারা ঢুকছেন মিউজিয়ামে। গভীর আগ্রহে পর্যবেক্ষণ করছেন নানা কারণে বিশিষ্ট হয়ে থাকা মানব-মানবীদের। হাসছেন। কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। আবার নিস্পন্দ কোনো আবক্ষ কিংবা প্রমাণ আকারের প্রতিমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে উঠিয়ে নিচ্ছেন ছবি।

ইংল্যান্ড অর্থাৎ ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্যদের যুগল প্রতিমূর্তি স্থাপিত হয়েছে অনেকটুকু জায়গাজুড়ে। প্রিন্সেস ডায়ানার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে গভীর অভিনিবেশে একজন দর্শক তাকিয়ে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি থামের পাশে। এই ঠান্ডায়ও পরনে হাফ শার্ট। লোকটি নিথর। জানি না, কোনো আগ্রাসী সৌন্দর্যে ভদ্রলোক বিদ্ধ কিনা। তার নিস্পন্দ পলকহীন চাহনি অন্য একজন দর্শককে মুহূর্তের জন্য বোকা বানাল। দর্শকটি ভদ্রলোকের শার্টের হাতার কাপড় দু-আঙুলের মৃদু ডলায় পরখ করছেন। শার্টধারী নড়ে উঠলে পরখকারী ভারি বিব্রত হলেন। ডায়ানার রূপে বিমুগ্ধ লোকটিও লজ্জা পেয়েছেন তার নিথরতার জন্য।

মাদাম তুশোর মিউজিয়ামটি বড় নয়। ঢাকা মিউজিয়ামের চেয়েও ছোট হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে প্রবেশের খানিকবাদেই প্রকাশ, সৌমিত্রের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। বেরিয়ে গুম হয়ে বসে রইলাম। বাসভর্তি স্কুলের ছাত্রছাত্রী আসছিল একে একে। ওদের অনেকেই অখেয়ালে আমার গায়ে উঠে যাচ্ছিল। একটি কিশোরী দুটো গরম কেক হাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সহযাত্রী এক কিশোরের অপেক্ষায়; কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে আগামী দিনের পুরুষটির গল্প শেষ হতে চাচ্ছিল না। অনেক উপমহাদেশীয় মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। প্যারিসে যেমন দেখতে পাওয়া যায় আফ্রিকানদের।

তুশো থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পথে অর্থাৎ মার্লিবান স্ট্রিট থেকে বস্নুমসবুরি যেতে আমরা বৃষ্টিতে কাকভেজা হলাম। ওটি দেখার জন্যে ঘণ্টা চারের একটু বেশি সময় হাতে ছিল আমাদের। তাই ভেজা কাপড়েই ওখানটায় ঢুকে যেতে হলো। কারণ একটিই, যতটুকু দেখে নেওয়া যায়। পৃথিবীবিখ্যাত মিউজিয়ামের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি তথ্যানুসন্ধানী ক্ষুদ্র মানব। মহাকালের নানা ঘটনা, আবিষ্কার ইতিহাস হয়ে বিন্দু বিন্দু করে জমা হয়েছে এখানটায়। সংগ্রহ ভা-ারটি তাই আজ মহীরুহের মতো। জ্ঞানপিপাসু কিংবা পাপী অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে এটি তীর্থের মতো। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, জন্মসূত্রে জার্মান কার্ল মার্কস তাঁর জীবনের একটি দশক কাটিয়েছেন ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে। আমার যতদূর মনে পড়ছে ‘থিওরি অব সারপস্নাস ভ্যালু’ এখানকার কাজের সূত্রেই তিনি দিতে পেরেছেন। মহামতি লেনিন ও রাশিয়ায় অক্টোবর বিপস্নবের আরেক নেতা ট্রটস্কিও এখানে পড়াশোনা করেছেন দীর্ঘদিন। আমাদের হাতে যা সময় তাতে যেহেতু এর অংশবিশেষ শুধু দেখা সম্ভব, সেহেতু আমরা পছন্দের বিভাগগুলো দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এশিয়া বিভাগের উপমহাদেশীয় শাখায় নটরাজের একটি তামার মূর্তি খুঁজে পাওয়ায় সেটির ছবি ওঠাতে প্রকাশ রাজি না হলেও আট-দশটি স্ন্যাপ নষ্ট করল। আলো ঠিকমতো সমন্বয় করতে পারছিল না সে। কিন্তু বস্তুটি ব্রিটিশরা লুট করে এনেছে নেপাল থেকে, তাতেই ওর এত আগ্রহ। মিউজিয়ামে যুগ যুগ ধরে জমে ওঠা বিশাল সংগ্রহে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। অনেক দর্শনার্থী অবশ্য রীতিমতো মনোযোগী। হাতে ক্যাটালগ। তালিকানুযায়ী সংগ্রহ মিলিয়ে দেখছেন তারা। বিশেষ বিশেষ আগ্রহের বস্তুগুলোর পরিচয় জেনে নিতে চান। প্যারিসেও এরকম আন্তরিক দর্শনার্থী পাওয়া যায়। বিভিন্ন মিউজিয়ামে। মুজে দ্য রঁদা, মুজে দ’ওরসি, ল্যুভর অথবা পিকাসো মিউজিয়ামে বহু লোককে দেখেছি খাতা, কলম, ক্যাটালগ হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে। তাঁরা হতে পারেন কোনো লেখক কিংবা গবেষক, যা আমার জানা নেই।

মিউজিয়াম ভবনটি উনিশ শতকের। সভ্যতার বিভিন্ন কালের সব ধরনের শিল্পকলার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে এখানে। মিসরীয়, গ্রিক, রোমান, চীনা, অ্যাংলো-সাক্সন প্রভৃতি সভ্যতার নিদর্শন সযত্নে রাখা হয়েছে। পেছনেই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বেলায় ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ডের খ্যাতি প্রাচীন। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোয় এই লন্ডন ইউনিভার্সিটির সুখ্যাতিও কম নয়।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম একবারে দেখার চেষ্টা বাতুলতা। এর বিশালতায় আমার মনে হচ্ছে যতবার লন্ডনে আসা যাবে ততবারই এটি একটু একটু করে দেখা উচিত।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই ‘ম্যাগনা কার্টা’র সঙ্গে পরিচিত। ব্রিটেনের সংবিধান মূলত অলিখিত। শত শত বছরের প্রথা ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তের ওপর গড়ে উঠেছে তা। এই সংবিধানের যে একেবারেই লিখিত রূপ নেই তা নয়। যেমন ম্যাগনা কার্টা মধ্যযুগের অত্যাচারী রাজার সঙ্গে স্বাধিকারকামী জনগণের চুক্তি। প্রজারা রাজাকে বাধ্য করেছেন তাঁদের দাবি মেনে নিয়ে কিছু কিছু অধিকারের স্বীকৃতি হিসেবে এই চুক্তি করতে। ওই দলিলটি মানপত্রের মতো বাঁধিয়ে ডেস্কের ওপর শুইয়ে রাখা। এর জন্য প্রজাদের রক্ত ঝরেছে এবং সেই রক্তঝরা পথ বেয়েই শত শত বছরের পরিক্রমায় এসেছে গণতন্ত্র। ম্যাগনা কার্টার মতো আরো নিদর্শন দেখতে পেলুম আমরা। শেক্সপিয়র, ডিকেন্স, দ্য ভিঞ্চি, শেলি, কিটসসহ বিখ্যাত সব লেখকের চিঠিপত্র, লেখার পান্ড‍ুলিপি। প্রেমের চিঠিও সম্মানের সঙ্গে স্থান পেয়েছে এখানে। অকালপ্রয়াত শেলি, কিটস রোমান্টিসিজমের দুজন যুবরাজ। লোকজন তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন দলবেঁধে দেখছে। প্রয়াত লেখকদের হস্তাক্ষরসংবলিত ভিউকার্ড মিউজিয়ামস্থিত স্যুভেনির শপটির বিশেষ আকর্ষণ।

শেষ ঘণ্টা বাজা পর্যন্ত আমরা মিউজিয়ামে কাটালুম। খানিকবাদেই সন্ধে নামবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি নেই। লন্ডনকে ঘিরে আছে পরিচ্ছন্ন আকাশ।

টিউবে বাংলাদেশ সেন্টারে ফেরার পথে একটি মজার ঘটনা ঘটল। সৌমিত্র আর প্রকাশের মাঝখানে একজন তরুণী।
আমি জায়গা না পাওয়ায় দাঁড়িয়ে। ফরাসিতে ওরা একে অপরকে বলছে – মসিয়্যু ভুজাভে দ্য লা সস। আ কোতে দ্য ভু ইলিয়া উইন বেল ফি (তোমার সৌভাগ্য মসিয়্যু, পাশে সুন্দরী তরুণী)।

মেয়েটি ওদের মাঝখানে। কার যে সৌভাগ্য বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু ঘটনা সেটি নয়। খানিক বাদে তরুণীটি কাঁধের ঝোলা থেকে যখন একটি ফ্রেঞ্চ বই টেনে পড়তে শুরু করল তখন তার পাশের দুজন চুপসে গেল।

এরকম অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম আরো একবার। ভিশিতে। আমার তখন সেখানে আট মাস হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে প্যারিসে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের সুবাদে সেখানে ভাষা শিখতে এলেন ওয়াসার ইঞ্জিনিয়ার তাজুল এবং ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ। একদিন ক্লাসের অবসরে চা খাচ্ছি। আমাদের সামনে এসে বসল একটি শ্যামা মেয়ে। লম্বা চুল, ডাগর চোখ। কদিন হয় তাকে দেখছি আমরা। তাজুল সাহেব ওঁর বিখ্যাত লক্ষ্মীপুরী টানে বললেন,

– দেখেন তো চৌধুরী, জিনিসটা আমাদের কিনা?

আমি একটু সংকুচিত হলাম। মেয়েটি যদি আমাদের কথা বুঝতে পারে তবে বিড়ম্বনা হতে পারে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে হরেকরকম মানুষ আসে এখানে। হয় বেড়াতে, না হয় ভাষা শিখতে। তবে আজকের দিনে ফরাসি ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই ভিশি ব্যাপক পরিচিত। কদিন আগে সিঁড়িতে এক তরুণী আমাকে অপ্রত্যাশিতভাবে থামিয়ে ততোধিক অপ্রত্যাশিতভাবে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মুসলিম?

কেন বলো তো?

থাকার জায়গা খুঁজছি আমি।

এর সঙ্গে আমার ধর্মীয় পরিচয় জানার সম্পর্ক?

আমি নিজেও মুসলমান।

ও। কোত্থেকে এসেছ তুমি?

দক্ষিণ আফ্রিকা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলিম থাকাটা অসম্ভব না হলেও তথ্যটি আমাকে একটু আশ্চর্য করে বইকি। মেয়েটি আরো জানায়, ওর পূর্বপুরুষ মালয়েশীয়। তাজুল সাহেবের প্রশ্নে তাই একটু সাবধান হলাম। কী জানি শ্যামাটি আবার বাংলাদেশের কিনা। বললাম, জানি না।

তখন তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত টানলেন, মনে হয় ইন্ডিয়ান।

আর তখনি মেয়েটি আমাদের বিস্ময় জাগিয়ে বলল,

ঠিকই ধরেছেন। আমার বাড়ি কলকাতা। বাংলা ভালো বলতে না পারলেও বুঝতে পারি।

কেন?

আমার জন্ম সুইডেনে। এখন আমরা ওখানকার নাগরিক। বাবা বহুদিন হলো বাংলা ছেড়েছেন।

আলাপেই আরো জানলাম ওর নাম রানু। ছুটিতে দাদা সুমিতের সঙ্গে ভিশিতে ভাষা শিখতে এসেছে।

কোনো কটু মন্তব্যে ওইদিন বিব্রতকর পরিস্থিতি হলেও হতে পারত। আজো সৌমিত্র ও প্রকাশের মন্তব্য তেমনি অল্পের ভেতরেই গেল। এটুকুতে ইউরোপের মানুষ বেশি কিছু মনে করে বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে এরা আমাদের মতোই হালকা অশস্নীল মন্তব্যে মজা নেয়। ভিশিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি এমনটি দেখেছি। সেখানকার একটি সংগঠন ১৯৬০ সাল থেকে ভারতের অহিংস স্বাধীনতা-আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে অনুষ্ঠান করে আসছে। ওই রকম এক স্মরণসভার শেষ পর্বে ছিল সংগীত ও নাচের আসর। মাঝে একটি নাটিকা। দোতলার অডিটরিয়ামে দর্শক এসেছিলেন প্রচুর। একটি ছোট্ট শহরের মিলনায়তন হলেও মঞ্চের আকার ও সুযোগ-সুবিধা আমাদের মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউস মঞ্চের চেয়ে অনেক বেশি। ভিশির গ্রান্ড ক্যাসিনোতে যে রাজকীয় মিলনায়তন আছে সেরকমটি আমরা কবে নাগাদ করতে পারব তা ঈশ্বর জানেন। তো নাচের অনুষ্ঠানে একসময় শুরু হলো নৃত্য ‘ফ্রেঞ্চ কেকা’। এই ধরনের নাচের জন্যে সুগঠিত মেদহীন শরীর ও দীর্ঘদিনের চর্চা দরকার। নাচিয়ে তরুণীরা পরেছিলেন মঞ্চছোঁয়া ঝালরওয়ালা পোশাক। তারা যখন পোশাকসহ এক পা উঁচিয়ে তা মাথা বরাবর করছিলেন তখন উল্লাস করছিল দর্শকেরা। মাঝেমধ্যে নাচিয়েরা পোশাক তুলে পাছা দেখাচ্ছিলেন। এসব নাকি ফেঞ্চ কেকার বৈশিষ্ট্য। যুবকেরা তখন শিস ও মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল। স্কুল এবং কলেজের দিনগুলোয় যাত্রাগানের আসরে আমরা লঘু নৃত্যের তালে ‘পয়সা শোধ’ বলে যেমন চেঁচাতাম ঠিক সেরকম। পার্থক্য এই, এখানে বিশৃঙ্খলা কম। পরের দিন ক্লাসে শিক্ষিকা কোলেথকে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার ঘটনাটি বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমাদের আমাদের মতো পয়সা শোধ জাতীয় শস্নীল নয় মন্তব্য আছে কিনা।’ তিনি জানালেন, ‘খুব আছে। তুমি যে-মন্তব্যটি শোনালে হুবহু ওরকমও।’ বললাম, ‘টাকা-পয়সা হাতের ময়লা আজ আছে কাল নেই, মজা করে তোমরা কি কখনো বলো?’

তখন তিনি হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের ভাষায় কি এই বাক্য সত্যিই আছে?’

আমার সহপাঠী প্যালেস্টাইনি চিকিৎসক মাহমুদ ও পাকিস্তানি কূটনীতিক মঈনও জানাল আরবি ও উর্দুতেও এই ধরনের কথা ভালো করেই প্রচলিত। হাস্য, কৌতুক, অশস্নীলতার ভাষা সারা পৃথিবীতেই এক। প্রেম ও জীবনের ভাষাও। ফরাসি দেশের একটি পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি ‘তিনি বড্ড নিঃসঙ্গ, স্বামী তার ছোট বোনকে ফুসলিয়ে ছমাস হলো গৃহত্যাগ করেছে।’ এর চেয়ে ‘কড়া’ জিনিসও অবশ্য ইউরোপে খোলামেলা আসে। সে-তুলনায় প্রকাশ, সৌমিত্রের মাঝে উপবিষ্ট তরুণীটিকে নিয়ে আমাদের চাপল্য এক কথায় কিছু না। তবু মেয়েটি টিউব ত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি সহজ হতে পারলাম না।

পরদিন রাতে প্যারিস ফিরলাম, আগের মতোই সড়কপথে। r